এক।
সকাল নয়টা বেজে দশ। শীত জেঁকে বসেছে মাসখানেক হল। সূর্যের আলো আর কুয়াশা একটা আপাত সমঝোতায় শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানে বিরাজমান। জলের গন্ধ এখানে চরাঞ্চলের মত না। কর্ণফুলীর জল তার নিজস্বতা হারিয়েছে কলকারখানা নিঃসৃত রাসায়নিক আর নাগরিক বর্জ্যে। এখানের বাতাসে তাই এক মিশ্র গন্ধ। জাহাজঘাটে যারা নিয়ত আসা যাওয়া করে সকালের এই হাওয়ায় শ্বাস নিয়েই তাদের দিন শুরুর পুলক বোধ হয়। ঢোকার লোহার গেটটা অর্ধেক করে খোলা। লোহার উপর মরিচা আর চারদিক ঘিরে আগাছার প্যটার্ন দেখে বোঝার উপায় নেই ঠিক কবে থেকে গেটটা ওইরকম অর্ধেক খোলা অবস্থায় আছে। ঢুকে বাঁ পাশে ছোট দুজন মানুষ বসতে পারে মত পাকা টিকেট ঘর। ওই ঘরে সবাই যায় একথা দিব্যি দিয়ে বলা যাবে না। সাগর পাড়ি দেয়া সন্দ্বীপ-হাতিয়া-ভোলা-বরিশাল রুটের যাত্রীদের একটা অংশ ওই ঘর মাড়ায় না। এরা ছোট ব্যবসায়ী, ছাত্র, কুলি-মজুর কিংবা রাজনীতির সাথে জড়িত।
সবচাইতে উৎসাহে টিকিট কাটে বার্ষিক পরীক্ষা শেষে বছরে একবার গাঁয়ে পদধুলি দেয়া শহুরে পরিবারগুলো। ভূমি থেকে ষাট সত্তর ফুট দীর্ঘ কাঠের পাটাতনের উপর দিয়ে যাত্রীরা পৌঁছায় ষ্টীমার অব্দি। লোকজন বলে ঘাটলা। ঘাটলার শেষ প্রান্তেই উন্মুক্ত টিকিট চেকিং। খয়েরী বা সবুজ চেকের মাফলার জড়ানো চেকারের সাধ্য নাই সবাইকে নজর দেয়ার। সাধ্যের সাথে সাধের ব্যপারটাও আছে। বিআইডব্লুটিসির এই জাহাজগুলো সরকারীভাবে যাত্রী টেনে যাচ্ছে বছরের পর বছর। দায়িত্বপালনকারী কর্মচারীরা পান চিবানোর ফাঁকে কাজকর্মের দেখভাল করে। স্টীমার ছেড়ে দেয়ার সময় ঘনিয়ে এলে জোরালো আর আত্মবিশ্বাসী ভেঁপু বাজে বার তিনেক – “ভোঁওওওওওওওও”। পোটলা পুঁটলি হাতে দৌড় লাগায় মাদ্রাসার ছাত্র, মুরগি ব্যাপারী দৌড়ায় খাঁচা মাথায়, কুলিরা দৌড়ায় শৌখিন শহুরে পরিবারের মালটানার দখল নিতে, শতছিদ্র আঁচলে শরীর আগলে কাচ্চাবাচ্চা কোলে দৌড়ায় প্রান্তিক চাষি বা জেলে পত্নী আর বৃদ্ধা মা। তাই খায়রুলের মত দুই চারজন টিকেট কাটার ব্যপারটাকে খুব একটা পরোয়া করে না। চেকারের দৃষ্টির ফাঁকফোকর দিয়ে গলে বেরিয়ে যায় সুযোগ মত।
সবচাইতে উৎসাহে টিকিট কাটে বার্ষিক পরীক্ষা শেষে বছরে একবার গাঁয়ে পদধুলি দেয়া শহুরে পরিবারগুলো। ভূমি থেকে ষাট সত্তর ফুট দীর্ঘ কাঠের পাটাতনের উপর দিয়ে যাত্রীরা পৌঁছায় ষ্টীমার অব্দি। লোকজন বলে ঘাটলা। ঘাটলার শেষ প্রান্তেই উন্মুক্ত টিকিট চেকিং। খয়েরী বা সবুজ চেকের মাফলার জড়ানো চেকারের সাধ্য নাই সবাইকে নজর দেয়ার। সাধ্যের সাথে সাধের ব্যপারটাও আছে। বিআইডব্লুটিসির এই জাহাজগুলো সরকারীভাবে যাত্রী টেনে যাচ্ছে বছরের পর বছর। দায়িত্বপালনকারী কর্মচারীরা পান চিবানোর ফাঁকে কাজকর্মের দেখভাল করে। স্টীমার ছেড়ে দেয়ার সময় ঘনিয়ে এলে জোরালো আর আত্মবিশ্বাসী ভেঁপু বাজে বার তিনেক – “ভোঁওওওওওওওও”। পোটলা পুঁটলি হাতে দৌড় লাগায় মাদ্রাসার ছাত্র, মুরগি ব্যাপারী দৌড়ায় খাঁচা মাথায়, কুলিরা দৌড়ায় শৌখিন শহুরে পরিবারের মালটানার দখল নিতে, শতছিদ্র আঁচলে শরীর আগলে কাচ্চাবাচ্চা কোলে দৌড়ায় প্রান্তিক চাষি বা জেলে পত্নী আর বৃদ্ধা মা। তাই খায়রুলের মত দুই চারজন টিকেট কাটার ব্যপারটাকে খুব একটা পরোয়া করে না। চেকারের দৃষ্টির ফাঁকফোকর দিয়ে গলে বেরিয়ে যায় সুযোগ মত।
দুইঃ
সেই সাড়ে সাতটায় রিকশা থেকে নেমেছে খায়রুল। মেরুন পাঞ্জাবী আর ধুসর হাফহাতা সুয়েটার পরনে। চুল সামান্য বড় হয়ে গেছে অযত্নে, ঘন ও মাঝারি শ্মশ্রুমণ্ডিত। পকেটে ছিল মোটের উপর ছিয়াশি টাকার মতো। খুঁজে পেতে সাড়ে ছয়শ টাকা সাথে নিয়ে চাচা কফিল মিয়ার সাথে বেরিয়েছিল দিন দশেক আগে। ইজতেমা শেষে ট্রেনে চড়া পর্যন্ত সব ঠিকঠাক ছিল। ট্রেনে উঠেই হারিয়ে ফেলল কফিল মিয়াকে। শেষমেশ ট্রেন বটতলী ষ্টেশনে এলে পকেটে শখানেকের কিছু বেশী নিয়ে মাঝারী সাইজের কাপড়ের পোটলা মাথায় দিয়ে রাতটা কাটিয়ে দেয় প্ল্যাটফর্মে। বাকী সব টাকাই শেষ। ক্লান্তি ছিল একরাশ। তাই শক্ত কংক্রিটের ওপর শুয়েও স্বপ্ন বেশ পরিষ্কার আর বিরতিহীনভাবে শেষ পর্যন্ত দেখা গেছে। ফুফাতো বোন লাইজু মাত্র ম্যাট্রিক পাশ দিল। পর্দার ব্যপারে বেখেয়ালি। কয়েকবারই খায়রুল তাকে বড় ভাইয়ের মত বুঝিয়েছে – “মাথায় ঘোমটা দি চল। পর্দা করন ফরজ কাম।”। সে হাসে আর বলে – “আরে, আম্নের সামনে আইতে আর ঘোমটা কি?”। আজকাল স্বপ্নে তাকে ঘনঘন দেখা যায়। ধান কাটার পরের নাড়ামুড়া উদোম জমিনে দুইজনে বসে গালগল্প করা কিংবা কাচারি ঘরে পড়ার টেবিলে মুখোমুখি হাত ধরে বসা। একটা সুখ সুখ ভাব আসে স্বপ্ন শেষ হলে পর। সমস্যা হল – প্রায়ই মাঝপথে স্বপ্ন কোথায় যেন হারিয়ে যায়, কথার মাঝে খেই হারানোর মত। তারপর অনেক চেষ্টা করেও ফেরত আনা যায় না। খুব মন খারাপ লাগে তখন।
তিনঃ
রিকশা থেকে নেমে টং দোকানে দুটো বনরুটি আর একটা কলা দিয়ে সকালের নাস্তা সেরে নেয় খায়রুল। ঘাটলার কাছাকাছি এসে আরাম করে একটা পড়ে থাকা তেলের খালি ড্রামের ওপর বসে পড়ে। অপেক্ষা করে শেষ মুহূর্তের ভেঁপুর। টিকেট ফাঁকি দেয়ার ওইটাই উপযুক্ত সময়। পকেটের ওই মাত্র কটা টাকা লাগবে সারা দিনের পথে। আর এই ষ্টীমার তো সরকারী। ভাড়া দিতে হবে কেন? বসে বসে সে পরিচিত মানুষ খোঁজে। অনেকটা সময় তো পার করতে হবে? কাউকেই আজ চোখে পড়ছে না। তার মনে হয়, এই পাঁচ ছয় বছর আগেও এই সাগরের পথে অনেক পরিচিত মুখ মিলত। এখন ম্যাট্রিক পাশ দিলে পর সব শহরের পথ ধরে - পড়াশোনার আর চাকরীর আশায়। জোয়ান অশিক্ষিতরা কাজের আশায়। কাজের আশায় যারা যায় তাদের অনেকেই ধানের মৌসুমে ফিরে আসে কামলা দিতে। ওই সময় মজুরী বেশী। কিন্ত শিক্ষিতেরা ফেরে না। দাখিল পাশের পর সে পড়ে রইল গ্রামে। দুবছর পড়াশোনা নিয়ে চেষ্টা চরিত্র করল। কিন্ত জোর করে তো আর কিছু হয় না তাই আরও খানিকটা সময় যাওয়ার পর তার জায়গা হল বড় ভাইয়ের মুদির দোকানে। সেও হয়ে গেল এক বছর। যাক গে, চিন্তা থেকে বাস্তবে ফিরে এল খায়রুল। পরিচিত কাউকে শেষতক না পেয়ে একটা সিদ্ধ ডিম কিনেই কিছুটা সময় পার করার চিন্তা করল সে।
চারঃ
ষ্টীমার ঘাট ছেড়েছে ঘণ্টা দুয়েক। খায়রুল খুঁজে পেতে খোলা ডেক এ নামাজের জন্য নির্দিষ্ট স্থানে আরও অনেকের সাথে সামান্য জায়গা করে নিয়েছে। এম ভি মনিরুল হক তেতলা জাহাজ। এই ডেকের নিচে একতলা যেটা তৃতীয় শ্রেণীর টিকিটের যাত্রীদের জন্য আর উপরে এক তলা –ক্যাপ্টেন আর অন্যান্য ক্রু বা কর্মচারীদের কেবিন। যদিও প্রায় সবগুলো কেবিনই কর্মচারীরা যাত্রীদেরকে ভাড়া দিয়ে দেয় কিছু উপরি আয়ের জন্য। মাঝের এই ডেকে দ্বিতীয় আর প্রথম শ্রেণী মিলিয়ে বেশ কয়েকটি কেবিন। এই কেবিনগুলো ঘিরে রেলিং ঘেরা বারান্দা মত জায়গা যেখানে যাত্রীরা হেঁটে বেড়ায়, দাঁড়িয়ে গল্পগুজব করে কিংবা রাজনীতি নিয়ে তর্ক করে। একদম সামনের অংশ আর পেছনের অংশ খোলা। প্রায় সব খালি জায়গাই যাত্রীরা দখলে নিয়ে বসে পড়েছে। নামাজের স্থানটা পেছনের অংশে। ছোট বাচ্চাকাচ্চাগুলো মা কিংবা বয়স্ক কারো নাগালের মধ্যে কিছু না কিছু নিয়ে খেলায় রত। একটু বড় বাচ্চাগুলো হেঁটে বেড়াচ্ছে নিচের ডেক থেকে উপরের চালকের রুমের আশপাশ পর্যন্ত। বাচ্চাদের একটা পুরো দিনের কৌতূহল মেটানোর জন্য জাহাজখানি যথেষ্ট। মাঝবয়েসী থেকে বুড়ো মুখগুলো ভাবলেশহীন। অনির্দিষ্টভাবে কোন এক দিকে তাকিয়ে আছে। কয়েকজন উঠেই ঘুমিয়ে পড়েছে। বয়সের সাথে মানুষ যেটা প্রথম হারানো শুরু করে তা হল অবাক হওয়ার ক্ষমতা। সাত আটজনের একটা অংশ খায়রুলের পাশেই তিন তাসের আসর জমিয়েছে।
পাঁচঃ
“কোনাই যাইবেন?”
খায়রুল মুখ তুলে চায় পাশের প্রশ্নকর্তার দিকে। তার মত বয়েসই হবে ছেলেটার। তার মতই লোহার গ্রিলে হেলান দিয়ে বসা। চাদরমুড়ি দেয়া মাথা থেকে পায়ের গোড়ালি অব্দি। ছোট চোখ, ভাঙ্গা চোয়াল।
“হাতিয়া”
“কোন ইউনিয়ন”
“ওঁছখালী। আম্নের কই?”
“উত্তর জাহাজমারা, সুখচরে আছিলাম আগে। দইরা ভাঙ্গি লই গেছে বেককিসু”
“অ্যাঁই খায়রুল। আম্নের নাম কি?”
“রাজন দাশ”
হিন্দুর সাথে কথা বলতে সংকোচ হয় খায়রুলের। সামান্য সরে সে প্রশ্ন করে - “শহরে কনে থায়?”
“বড়্দা। কলেজ শেষ করি চিটাগাং চলি গেসে। লজিং থাইকত বদ্দারহাটে এক চিটাইঙ্গা বাসাত। হিয়ানে থাই হড়ালেয়া শেষ কইচ্ছে। যেই মাইয়ারে হড়াইত, হেতিরে বিয়া করি ঘরজামাই অই গেসে” – একটা ছোট নিঃশ্বাস ফেলে রাজন
“তই?” – বাকী গল্প শোনার আশায় তাকায় খায়রুল
“অ্যাঁই মার লয় থাই। দইরা ভাঙ্গি যনের হরে দি, হুরান ঘরের কিসু কাঠ-মাট আসিল। মাইনশের তেন ধার কর্জ করি কিসু লই কোন রইম্যা একখান ঘর বাইন্ছি। অ্যাঁই রিকশা চালাইতাম সুখচরে। মায়ে ভুঁইয়া বাড়ী কাম কইরত। হুকুর ঘাঁডে হিসলা খাই হড়ি আর হাঁইটত হারে না। হেতেনেরে চিকিৎসার লাই চিটাগাং লই জন দরকার”। কিছুক্ষণের জন্য থামে রাজন। তারপর নিচু গলায় বলে “ধারের টিঁয়াই শোধ দিতাম হারি না, চিকিৎসা করামু কেম্নে? হেল্লাই গেসিলাম দাদার কাছে কিসু টিঁয়ার লাই।মায়ে দুগা মুরগা আর বাগানের লাউ দিসিল। হেগুন লই গেসিলাম”
“হিয়ার হরে?” – খায়রুল আগ্রহ ভরে তাকায়
“কত কষ্ট করি খুঁজি বার কইচ্ছি। বৌদি তো অ্যাঁরে চিনে না। হতমে ঢুইকত দিত চা ন। হরে দাদায় আই দুয়ার খুইলছে। একবেলা হেড ভরি খাবাইসে। হরেদি কইল, হেতেত্থে অন হইশা নাই। একশুগা টিয়া দি বিদায় দিসে” – মাথা নিচু করে রাজন
“ভাইরে চিন্তা করিয়েন না। আল্লায় দেইখতাছে সব। উনিই একটা ব্যবস্থা করি দিব” – কথাটা বলেই তার মনে হয় একজন বিধর্মীকে এই আশ্বাস দিয়ে কি লাভ?
শুন্য চোখে রাজন দূর সাগরে তাকিয়ে থাকে। কোনরকম আশ্বস্ত তাকে মনে হয় না। কর্ণফুলী ছেড়ে বঙ্গোপসাগরে পড়েছে জাহাজ। দূরের ভূমির বিচ্ছিন্ন রেখাগুলোর ছিটেফোঁটা আর দেখা যাচ্ছে না। যতদূর চোখ যায় ধু ধু পানি আর ঢেউ। তাবৎ ব্রহ্মাণ্ডে এই সাগরের বুকে শুধু এক জাহাজ আর নিজেকে তার একমাত্র যাত্রী মনে হয়। দ্বিতীয় কোন অস্তিত্ব আর সে টের পায় না।
“আম্নে বইয়েন, অ্যাঁই এক্কানা ওজু করি আই। নামাজের টাইম অই গেসে। অ্যাঁর হুটলিগা রাখি গেলাম। এক্কানা চাইয়েন”
উত্তরে শুধু মাথা নাড়ে রাজন।
পাশেই একটা কলের ব্যবস্থা আছে। রাজনের গল্পে মনটা খারাপ হয়ে যায় খায়রুলের। সৃষ্টিকর্তার কাছে নামাজ পড়ে তার জন্য দোয়া করার কথা ভাবে। কিন্ত বিধর্মীর জন্য দোয়া করাটা ঠিক হবে কিনা তা নিয়ে চিন্তায় পড়ে যায়। ওযু করে সে ফিরে আসে।
“ভাই, অ্যাঁরে এক্কানা জায়গা দিতে অইব নামাজের লাই”
রাজন সরে জায়গা করে দেয়।
দাঁড়াতে যাবে এমন সময় পেছন থেকে ডাক দেয় মাঝবয়েসী একজন। “ভাই আমরা তিনজন আছি। জামাতে হড়ি আইয়েন। আম্নের হিছে আমরা খাড়াই যাই”
দেখতে দেখতে গোটা জনা দশ বারো হয়ে গেল। শেষমেশ যারা নামাজের স্থানটিতে আশ্রয় নিয়েছিল সবাই জায়গা ছেড়ে দিয়ে পাশে গিয়ে অপেক্ষায় রইল। খায়রুল আজান দেয়া শুরু করল।
ছয়ঃ
ক্যান্টিনে আজকের মেনু মুরগী আর আলুর তরকারী। একজনের জন্য আটত্রিশ টাকা। অতিরিক্ত লবন আর কাঁচামরিচ চেয়ে নিল খায়রুল। তারপরেই বড় বড় গ্রাসে হামলে পড়ল। তার মনে হল কত দিন পর সে ঘরে বসে মায়ের রান্না খাচ্ছে। সাগরের নোনা জলে রান্না অমৃত লাগে তার।অতিরিক্ত নুন-ঝালের ঝোলে মাখা দেশি মুরগীর তরকারির মাঝে ডুবে যায় সে। নামাজ শেষে এখানে সিট পেতে বেশ খানিকটা বেগ পেতে হয়েছে খায়রুলের। সন্দ্বীপ না আসা পর্যন্ত মানুষের এই চাপ কমবে না। কাপড়ের পুটলিটা সাথে করে নিয়ে এসেছে। খাবার শেষে টাকা মিটিয়ে বেরিয়ে পড়ল ঘুরে দেখার জন্য। সামনের দিকে চাপাচাপি করে জায়গা বের করে নিয়ে আগাতে হল। আস্তে আস্তে সে একদম সামনে গিয়ে রেলিঙয়ে সামান্য দাঁড়ানোর জায়গা পেয়ে গেল। শীত শুরুর সাথে সাগর ধিরস্থির হয়ে আসতে থাকে। সিগনাল থাকে না বললেই চলে। জাহাজের দুলুনি অনেকটাই কমে আসে – এ অঞ্চলের যাত্রীরা বলে রুলিং। মধ্যাহ্নের কড়া রোদ স্বত্বেও প্রচণ্ড ঠাণ্ডা বাতাসের কারণে একেবারে সামনের এই অংশে মানুষের আপাত স্থায়ী অবস্থান অপেক্ষাকৃত কম। যারা আসছে তারা সামনে থেকে সাগর দেখার ঔৎসুক্য থেকে আসছে। সাধ মিটে গেলে জায়গা ছেড়ে দিচ্ছে। নতুন একজন তার জায়গা নিচ্ছে। শাদা গাংচিলগুলো কিছুক্ষন সামনে ওড়াওড়ি করে, তারপর দুভাগ হয়ে জাহাজের দুই পাশ দিয়ে বিদ্যুতবেগে উড়ে পেছনে চলে যায়, সেখানে কিছুক্ষন পাক খেয়ে আবার সামনে চলে আসে। বিচ্ছিন্ন দুয়েকটা বাকীদের সাথে যোগ দেয় না। নিজের মত ঘুরে ঘুরেপানিতে ভাসতে থাকে। সাগর, জাহাজ আর গাংচিলগুলোর মাঝে কোন একটা অজানা ভাষায় যোগাযোগ আছে মনে হয় খায়রুলের। আপন মনে সে বলে – “আলহামদুলিল্লাহ্”।
সাতঃ
সন্দ্বীপ দেখা গেছে খানিক আগে। তাই সন্দ্বীপের যাত্রীরা যার যার জায়গায় জিনিসপত্র গুছাচ্ছে বা অপেক্ষায় আছে নামার। কুল কাছে এগিয়ে আসলে ঘাট থেকে সরকারী দুটো লঞ্চ ছেড়ে আসে মানুষগুলো জাহাজ থেকে কুলে নামানোর জন্য। বেসরকারিভাবে গোটা দশেকের মত নৌকাও যাত্রী টানে। জাহাজের দু পাশ থেকে ধীরে ধীরে লোহার সিঁড়ি নামানো হয়। সে সিঁড়ির হাতল মোটা দড়ি। সিঁড়ির ধাপগুলো বেশীরভাগই নড়বড়ে। স্বামীর দেশের বাড়ী দেখতে আসা ভিন অঞ্চলের মেয়েরা এই সিঁড়িতে উঠলেই আঁতকে ওঠে। অভ্যর্থনা দিতে আসা শ্বশুর বাড়ীর দেবর সম্পর্কের আত্মীয়রা সাহায্যের অজুহাতে হাত বাড়ায়। অতি ভীত কাউকে সুযোগ মত কোলে উঠিয়ে নামায়। সিঁড়ি থেকে নামার আগ পর্যন্ত এক হাতে শক্ত করে দড়ি ধরে আর এক হাতে শাড়ি মুঠো করে খানিক তুলে সাবধানে নামে হোঁচট খাবার ভয়ে। আজও এমন দুএকজন রয়েছে সিঁড়ি ধরে নামার লাইনে।রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে থাকা দর্শকদের বেশিরভাগের দৃষ্টি এই যাত্রীদের দিকে কেন্দ্রীভূত, ময়শ্চারাইজিং ক্রিমের ব্যবহারে এমন মসৃণ হাঁটু অব্দি পা শহুরে বউ-ঝিরা বেড়াতে এলেই দেখার সুযোগ মেলে। খায়রুলের দৃষ্টিও স্বভাবত সেদিকেই যায়। এক পলক দেখেই সে চোখ নামিয়ে নেয়। তারপর পাশে তাকিয়ে দেখে কোন ফাঁকে রাজন দাশ তার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। যাত্রী পারাপারের এই মচ্ছবও তার উদাস দৃষ্টিতে খুব বেশী পুলক জাগায় না। সে চেয়ে থাকে সারি করে দাঁড়িয়ে থাকা দূরে কূলের কালো কালো মানুষদের দিকে। পেটফুলা শিশু কোলে জট পাকানো চুলে দাঁড়িয়ে থাকা কিশোরী কূল থেকে চেয়ে থাকে প্রতিদিনকার মতো। শীতের এই সময়টায় নদীর ভাঙ্গন কমে আসে। যাত্রী বোঝাই লঞ্চ বা নৌকা স্বচ্ছন্দে ঘাটে ভিড়তে পারে। যাত্রীদেরও নেমে প্যাচপ্যাচে কাদায় পা ফেলতে হয় না বর্ষার মতো।
“তই অন কি ঠিক কইল্লেন?” – প্রশ্ন করে খায়রুল সুয়েটারটা টেনে নিচে নামায় ঠাণ্ডা বাতাসে খানিকটা বেশী ওম পাবার আশায়। - “মারে যাই কি কইবেন?”
ধীরে দৃষ্টি তটরেখা থেকে টেনে খায়রুলের মুখে চায় রাজন। “কইতাম হারিনা”।
হতাশা আর ক্লান্তি স্পষ্টতই দেখতে পায় খায়রুল রাজনের চোখেমুখে।
“আইচ্ছা আম্নে তো হুজুর মানুষ। অ্যাঁর এক্কান হশ্নের উত্তর দেন চাই। খোদা তো ব্যাক কিসু দ্যাখে উরফে বই বই। তইলে অ্যাঁর এই সমস্যা খোদার কাছে কেঁইচ্ছা লাগে কন তো চাই?” – রাজন প্রশ্ন ছুঁড়ে দ্যায়
“খোদা বিফদ দি মানুষেরে হরিক্ষা করে। হিয়ার হরে সময়মত উদ্ধার করে। আর শেষ বিচার তো আছেই। খোদারে যেমনে ডাইকবেন হেইরকম করি হেতেনে সাড়া দিব”
“বাফে মরি গেছে দুই বছর বয়সে। চোখ হুডনের হরেত্থে তিন বেলা খানা জীবনে কবার খাইছি গুনি কই দন যাইব। বিফদ কাডাই যতবার উডি খাড়াইছি হইত্যেকবার ধাক্কা খাই হড়ি গেছি। বিফদে খোদারে এত ডাইকলাম কিন্ত কোনদিন তার দেয়া হাইলাম না। দাদা হরদাদার আমলেত্থে আন্ডা দাশ। শয়ে শয়ে বছরেও কেউ দাশেত্থে উরফে উইঠতে হারে ন। ভাইগ্য একশ বছর আগেও যা আছিল, একশ বছর হরেও তা। খোদার লিস্টে কি আন্ডা হরি না নি?”
“ভাইরে ধৈর্য ধরেন। খোদায় ঠিকই মুখ তুলি চাইব”। ভারাক্রান্ত মনে খায়রুল ভাবে খোদা এই বিধর্মীর ক্ষেত্রে আসলে কি বিচার করে তা তার জানা নাই তবে মুসলমান হলে অবশ্যই তিনি রহম করতেন। মনে মনে নিজের সত্যের পথে থাকার সৌভাগ্য চিন্তা করে শোকর করে সে।
আটঃ
ষ্টীমার সন্দ্বীপের ঘাট ছেড়ে এলে পেছনে কুলের শেষ রেখা মিলিয়ে যেতে থাকলে লাল কমলা হলুদ রং নিয়ে পশ্চিমাকাশে কেউ একজন জলরঙে মেতে ওঠে। ইচ্ছেমত ব্রাশে এখানে ওখানে গাড় নীল বা ধুসর রং এর ছোপ দিয়ে লেপটে দ্যায়। ষ্টীমার সেদিকেই এগোয় যেদিকে রঙের আঁচড়গুলো ডেকে বসা বা দাঁড়িয়ে থাকা মানুষগুলোকে স্মৃতিকাতর করে তোলে কিছুক্ষণের জন্য হলেও। বঙ্গোপসাগর ছেড়ে ষ্টীমার ধীরে ধীরে মেঘনায় ঢুকতে শুরু করে। জলের রং ঘোলাটে নীলবর্ণ থেকে ঘোলাটে বাদামী হতে থাকে। হাতিয়ার দেখা পাওয়ার আগে চোখে পড়ে দীর্ঘ সময়ের সাথে নদী ফুঁড়ে জেগে ওঠা ছোট বড় বিচ্ছিন্ন চর। সময় অসময়ে সেগুলোতে আটকে যায় ষ্টীমারের তলা। তাই পরিচিত অগভীর স্থান গুলো পার হতে গেলে ষ্টীমারের গতি স্লথ হয়ে আসে। পাশ থেকে নেমে যায় লোহার সিঁড়ি। লম্বা আর ভারী গিঁট বাঁধা রশি হাতে সিঁড়িতে দাঁড়ায় একজন। সামনে ঝুঁকে শেষ মাথায় ভারী লোহার টুকরো বাঁধা রশি পানিতে ছুঁড়ে দ্যায়। রশির নির্দিষ্ট দূরত্বে পরপর গিঁট বাঁধা। গিঁট থেকে হিসেব করে নেয় পানির গভীরতা। “সাড়ে এ এ তিন পা আ আ ল্ল ও ও ই ই ই” – প্রতিবার মাপের পর চিৎকার করে জানান দ্যায়। মাপ অনুযায়ী কাপ্তেন গতি বাড়ায় কিংবা কমায়। কপাল খারাপ হলে ষ্টীমার আটকে যায়। তখন পরবর্তী জোয়ারের জন্য অপেক্ষা।
প্রায় অবধারিতভাবে ভাটায় আটকায় এম ভি মনিরল হক। বয়োবৃদ্ধ সঙ্গিহীন মানুষ লাঠিতে ভর করে যেমন দূর পথে খানিক পর পর বসে পড়ে, তেমনই করে মনিরুল হক এই ভেসে ওঠা চরের বুকে নিজেকে ছেড়ে দেয়, জিরিয়ে নেয় ক্লান্তিতে। ভাটা শেষে জোয়ারের আগে প্রায় স্থির পানি আলতো করে ছোট ছোট ঢেউয়ে ছুঁয়ে যায় তাকে। শরত শরত করে একধরণের শব্দ হয়। যাত্রীরা তখন জেগে ওঠা চর নিয়ে ডেকে বসে আলোচনা করে। কেউ বলে এ সব খোদার শাস্তির নমুনা, কেউ বা একে তার অনুগ্রহ বলে দাবী করে – “এরই বাইছা হুনেন - নতুন চর উডিয়েতো আংগোরে বাচায়। আন্নাইলে দইরা বাংগি গেলে যাইবার যাগা কই?চ্যারম্যানেগোর জমি বছর বছর বর্গা ন দি চরে আই নতুন ঘর তুলি থাইকতাম হারি, জমির দখল লইতাম হারি”। প্রতিপক্ষ যুক্তি দেয় –“বল্লার চরে দেইখছেন্নি কি অবস্থা? হারুইন্যা ডাকাইত হিয়ানো যাই উইঠছে। অন হেইদিগে আর মাছ মারন যা না। গত মাসেও দুইজনরে মারি লাশ হানিত হালাই দিছে। লাশ কুলে আই ভিড়নের হরে চিনন যা ন। ধামা দি গাল মাথা কাডি কি যে কইচ্ছে! আহা”। তর্ক বা আলোচনা চলতে চলতেই একসময় জোয়ারের পানি বাড়ে। মনিরুল হক নড়েচড়ে ওঠে। কাপ্তান তৈরি হয়। জল মাপার রশি নিয়ে লোকটা সিঁড়িতে নেমে পড়ে।জলের মাপ নিয়ে নিয়ে আলগোছে ধীরে ধীরে আগায় মনিরুল হক, আগায় চরাঞ্চলের মানুষেরা।
নয়ঃ
পশ্চিমাকাশ যখন অন্ধকারে ঢেকে যেতে থাকে, ডেকে বসে থাকা মানুষগুলোর যখন গল্প করার আর বিষয় থাকে না, বাড়ী ফেরার সকালের উচ্ছাস যখন কেমন যেন বেদনায় রূপ নেয়, তখন দূর থেকে হাতিয়ার কূল দেখা যায়। কাঁধের পুটলি সামলে খায়রুল রেলিং ঘেঁষে দাঁড়ায়। “মা কেইচ্ছা আছে? ভাই একলা এই কয়দিন দোকান সামাল দিত হাইচ্ছে নি?”- ভাবে সে। কাল থেকে কাজে নেমে ভাইকে একটু বিশ্রাম দিতে হবে কয়দিনের জন্য। ষ্টীমার নোঙ্গর করে দাঁড়ালেই কূলে পারাপারের সি-ট্রাক এসে ষ্টীমারের গায়ে গা লাগায়। প্রথম সুযোগেই খায়রুল নেমে পড়ে, সুবিধামত জায়গা দখলে নেয় বসার। যাত্রী ভরে গেলে সি-ট্রাক ছেড়ে যায় মনিরুল হক। যাত্রীরা শেষবারের মতো চেয়ে দেখে তাকে। কূল কাছে আসতে থাকলে ভাঙ্গন পরিষ্কার হয়ে চোখে পড়ে। প্রতি বর্ষায় এই কূল ভাংছে। জাহাজঘাট গত দশ বছরে সরে এসেছে কয়েক মাইল। স্কুল, বাজার, সাইক্লোন সেন্টার সব চোখের সামনে দিয়ে গেল। আর এই বর্ষায় গেল মিয়াঁবাড়ীর মসজিদ। ওই যে এখনও তার মিনার কূল থেকে শ-দুয়েক ফুট দূরে কাত হয়ে অর্ধেক পানির উপরে দেখা যায়। “কতজনেই কইছিলনদী এই মসজিদের আগে আই থামি যাইব, বেক চলি গেলেও এইটা যাইত ন। আল্লার মাল আল্লায়ই সামাল দিব” – মনে মনে ভাবে সে। ছাইরঙা আঁধারে ডুবতে থাকা মিনারের দিকে প্রশ্নবোধক একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে খায়রুল।
জন্মস্থান - ঢাকা, বাংলাদেশ
জন্মসাল - ১৯৭৪
বর্তমান আবাসস্থল - আজমান, সংযুক্ত আরব আমিরাত
পেশা - তথ্যপ্রযুক্তি
0 মন্তব্যসমূহ