গ্রীষ্মের প্রচণ্ড দাবদাহে গত কয়টা দিন স্বর্ণকমলপুর শহর পুড়ে ভাজা-ভাজা হয়েছিল। এপ্রিলের ৩ তারিখে আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নামলে শহরের লোকেরা হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। কাচের গ্লাস ভর্তি করে তেঁতুলের শরবত খেয়ে অখ্যাত এক লেখকের সাক্ষাৎকার পড়ছিলাম লেখকেরই রচিত বইয়ের শেষ প্রচ্ছদে। শেষ প্রচ্ছদে এ রকম সাক্ষাৎকারের সংযোজন অভিনব। একজন লেখকের পেশা কী হওয়া উচিত? উত্তরে লেখক বলেছেন, মুচি বা মেথর হলে ভালো হয়, কারণ তারা সমাজের ভেতর মহলের খবরাখবর বেশি রাখে।
তিনি কেন লেখেন আর কাদের জন্য লেখেন? জানা গেল গোমড়ামুখো আর হাবাগোবাদের জন্য লেখেন না তিনি, লেখেন না তাদের জন্য যারা বাসার চাকর-বাকরদের মারধর করে আর ঘুষ খেয়ে বড়লোকি দেখায়। সমাজের কাছে কি লেখক দায়বদ্ধ? এই প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেছেন, কারো কাছেই লেখক দায়বদ্ধ নন। লেখাটেখা পড়ে কেউ নিজেকে বদলেছে বলেও তাঁর জানা নেই। অনেকের ধারণা গোর্কি, তলস্তয়, দস্তয়েভস্কি কিংবা মায়াকোভস্কির লেখা পড়ে উদ্বুদ্ধ হয়ে রুশরা বিপ্লব করেছিল, এসব একেবারেই ফালতু কথা।
...এসব চমকপ্রদ কথায় ডুবে ছিলাম বলে কখন বৃষ্টি পৃথিবীটা শীতল করে দিয়ে গেছে, টের পাইনি। জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখলাম আলো নেই একেবারে আর ঝিরঝির বৃষ্টি এখনো পড়ছে। বইছে ঠাণ্ডা বাতাস।
চা নিয়ে মা ঘরে ঢুকল। বলল, 'রাতে খিচুড়ি আর মাংস করব, তাড়াতাড়ি ফিরিস, গরম-গরম খাবি।' রাত ১১টা-১২টার আগে কখনোই বাড়ি ফিরি না। তাই মায়ের এই আদেশ।
তখন সাইকেলের ক্রিং ক্রিং বেল শুনে বাইরে বেরুলাম। বন্ধু রোমেলের দূত এসেছে চিঠি নিয়ে (তখন দেশে মোবাইল আসেনি)। আমার এই বন্ধু লেখাপড়া শেষ করার আগেই চাকরিতে ঢুকেছে লোভনীয় একটা চাকরির সুযোগ হারাতে চায়নি বলে। খুব ভালো মাইনে পায়। চা-সিগারেট থেকে শুরু করে মদ্য পানীয় সবই আমরা ওর ওপর দিয়ে চালিয়ে দিই, আমাদের পকেট ফাঁকা থাকলে। সে মাঝেমধ্যেই এ রকম বার্তা পাঠায় অথবা নিজের মোটরবাইকে চেপে আমাদের বাড়িতে চলে আসে। রোমেল তার চিরকুট বার্তায় লিখেছে : পত্রপাঠ নীল বাড়িতে চলে আয়। তোর জন্য একটা পরী এনেছি। এই পরী তোর কুমারত্ব ভাঙবে। তবে পরীর ভেতর একটা জিনিস পাবি না আগেই বলে রাখছি- ডানা। হা হা হা। এসে দেখ, পছন্দ হয় কি না। কথাটা ঘুণাক্ষরেও যেন কেউ না জানে। এক বোতল ভদকাও জোগাড় হয়েছে...।
বার্তা পড়ে আমি তো হতভম্ব। একটা শিহরণের অনুভূতি পেলাম মাথা থেকে পা অবধি। আমাদের শহরের ঠিক মধ্যিখানে চমৎকার একটা নীল বাড়ি। উঁচু পাঁচিল দিয়ে ঘেরা। মস্ত বড় গেট। ঢুকতেই বাগান। বেশ কিছুটা পথ হাঁটার পর একতলা একটা বাড়ি পাওয়া যায়। আমাদের এক বন্ধু ভাড়া নিয়েছে। একটা ওষুধ কম্পানির বড় কর্তা। সকালে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়, ফেরে অনেক রাতে। জেলার বাইরে কাজ পড়লে সে রাতে আর ফেরেই না। এ কারণে সব সময় বাড়িটা আমার জিম্মায় থাকে। ঘনিষ্ঠ বন্ধুরা প্রয়োজনে প্রেমিকাদের নিয়ে হুটহাট ও বাড়িতে ঢুকে পড়ে। শহরের মাঝখানে খুব ব্যস্ত স্থানে বাড়িটার অবস্থান বলে ভেতরে কে গেল কে বেরুল তার হদিস রাখা কারো পক্ষে সম্ভব হয় না।
আমি প্রবল রোমাঞ্চে ভাসতে ভাসতে নীল বাড়ির উদ্দেশে বেরিয়ে পড়লাম। পাড়ার মেয়েরা পারফিউম আর ডিওডরেন্টের সাগরে নিজেদের চুবিয়ে নিয়ে ইভিনিং শোতে সিনেমা দেখবে বলে বাড়ি থেকে বেরিয়েছে। তাদের একজন আমাকে দেখে বলল, সিনেমায় যাবেন আমাদের সঙ্গে? ওকে খ্যাপানোর জন্য বললাম, 'এসব বস্তাপচা সিনেমা আমি দেখিনে।'
'তাহলে কোন সিনেমা দেখেন?'
'এই ধরো গদার ক্রুফো, তারকোভস্কি, ভাইদা, পোলানস্কি,...।'
'ধ্যাট।'
মেয়েটা বান্ধবীদের দলে ভিড়ে গেল। আমি রিকশা ধরলাম।
নীল বাড়িতে গিয়ে দেখি ড্রইংরুমের সব কয়টা আসন পূর্ণ। অনেকে কার্পেটের ওপর বসে আছে। খুবই অবাক হলাম। এই গোপন অভিসারের খবর এরা জানল কী করে? ভেতরে ভেতরে কৌতুক বোধও হলো। হিসাব করে দেখলাম ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের কেউ বাদ পড়েনি।
'কী ব্যাপার, এত মক্কেল কোত্থেকে এলো?' নরেন্দ্র বলল, 'ওস্তাদ, তুমি এত দেরিতে যে? খবর পেলে কখন?' সোফায় বসে ঝিমুচ্ছিল রোমেল। কপালে ভাবনার বলিরেখা। আমাকে দেখে তড়াক করে উঠে এলো, 'চল, ও ঘরে যাই, কথা আছে।'
ভদকার বোতল খুলতে খুলতে বলল, একেবারে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিয়েছে আমাকে। শুধু সঞ্জয়কে বলেছিলাম। ওই হারামজাদার কাছ থেকে একে একে সবাই জেনেছে। বলছে পরীটার ঘ্রাণ একাই শুঁকবি? আমরা তো সব কিছুই একসঙ্গে করি। আজ আবার এর ব্যতিক্রম কেন? মিথ্যে বলেনি।
কিন্তু মেয়েটা বেঁকে বসেছিল এত লোক দেখে। আমার সঙ্গে কথা হয়েছিল তিনজনের। ওর টাকার খুব দরকার, তাই তিনজনে রাজি হয়েছিল। ও নাকি একজনের বেশি হলে যায় না। তোর কথা ভেবে রাজি হয়ে যাই। পরীটাকে আমারও খুব পছন্দ। তা এখন অবস্থা নিজে চোখেই দেখতে পাচ্ছিল। ওদের সবার পায়ে ধরার বাকি আছে শুধু। কেউ এখান থেকে এক পা নড়তে রাজি নয়।
'আমি অবশ্য বলেছি, পুষিয়ে দেব। কী আর করা বল।' কথা শেষ করে পরপর দুই পেগ মেরে দিল রোমেল। ওর কথা শুনে আমারও খুব অস্বস্তি লাগছিল। বললাম,
'আমি আর দল ভারী করতে চাইনে রোমেল।'
'দূর কী যে বলিস না, আজ তোর কৌমার্য নস্যাৎ হবে। হা হা হা। পরীটা দেখলে মাথা ঘুরে যাবে তোর।'
'জোগাড় করলি কোত্থেকে?'
'ফরিদকে তো চিনিস। ওর পরিচিত। মেয়েটার বাড়ি মালঞ্চ গ্রামে। ভদ্র ঘরের মেয়ে। খুব বিশ্বস্ত লোক না পেলে বাড়ির বের হয় না।'
'তা তুমি গিয়েছিলে?'
'নারে সাকি। সঞ্জয় গেছে। ও শালা মনে হয় গল্প জুড়ে দিয়েছে মেয়েটার সঙ্গে। প্রেম করার তালে আছে মনে হয়। ভদকার খবর যেন না পায়, তাহলে আবার মাতলামো শুরু করে দেবে।'
প্রিয় বন্ধুদের অবস্থা খুব শোচনীয় তখন। একটার পর একটা সিগারেট ধ্বংস করে চলেছে। আসুন আপনাদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিই : আমাদের নাটের গুরু রোমেলের যে পরিচয় দিয়েছি তাই যথেষ্ট। অন্যের জন্য কিছু করতে পারলে বর্তে যায়। দিল দরিয়া টাইপের মানুষ।
আর এখন যে ভেতরে আছে ওর নামই সঞ্জীব। ওর কথা তো একটু আগেই হয়েছে। কায়স্থ পরিবারের সন্তান। সারা দিন আড্ডা আর গুলতানি মেরে বেড়ায়। বাবা নেই। মা আছে। আছে দুই ভাই, দুই বোন। সারাক্ষণ ওরা তাকে বকাবকি করে। কামাই-রোজগারের ধান্ধা করে না মোটেও।
আর ওই সোফায় বসে গোঁফওয়ালা যে যুবকটি ম্যাগাজিন পড়ছে, ওর নাম দীপংকর। ব্রাহ্মণ ডিগ্রি পড়ছে। কবিতা লেখে, আবৃত্তিও করে। মেয়ে পটাতে ওস্তাদ। ছাত্রনেতা অনলবর্ষী বক্তা। পপুলার। তারপর যারা বসে আছে তারা হলো :
রাজন : একটা সিগারেট কম্পানিতে চাকরি করে। ফিল্ড সুপারভাইজার। প্রতি মাসে মাগনা সিগারেট পায় কম্পানি থেকে। যে পরিমাণ পায় তার চেয়েও বেশি বিলায়। বাকিটা নগদে কেনে দোকান থেকে। ব্রিলিয়ান্ট ছাত্র ছিল। খুব বড়লোকের ছেলে।
আমানুল্লাহ : এই যুবক রাজনের সহকর্মী। এর বাড়ি আমাদের পার্শ্ববর্তী জেলা ফরিদপুরে। ভদ্র টাইপের যুবক। মেয়েদের প্রতি খুব দুর্বল। সেও মাগনা সিগারেট পায়; পেয়েই বাজারে নিয়ে বিক্রি করে দেয়। বন্ধুরা চাইলে কিনে খাওয়ায়।
নরেন্দ্র শীল : নরেন্দ্র এ শহরের সবচেয়ে নামকরা ক্ষৌরকার। ওর দোকানের নাম উত্তম হেয়ার কাটিং সেলুন। বাল্যকালে বাবা মারা গেছে। ওর বাবাও ক্ষৌরকার ছিল। আমরা হাউস মিটিয়ে ওর দোকান থেকে চুল-দাড়ি কাটাই। নখ, গোঁফ আর বগলের লোমও বাদ দিই না। পয়সা নেয় না। পুজোর সময় সবাই মিলে ওকে দামি জামাকাপড় কিনে দিই।
ফারুক : ফারুক শহরের সবচেয়ে আধুনিক টেইলারিং শপের মালিক। ছোট বোনের নামে দোকানের নাম দিয়েছে নীলু টেইলারিং অ্যান্ড আউটফিট। আমরা ওর দোকানের ব্র্যান্ড প্রমোটর, ক্যাম্পেনার যা-ই বলুন না কেন। সব সময় আমাদের কাপড় মাগনা সেলাই করে দেয়। লেডিস গার্মেন্টে ওর স্পেশালাইজেশন। কাপড়চোপড় বানালে ডেলিভারি দিতে বড্ড দেরি করে, ফলে আমরা ওকে যাচ্ছেতাই গালাগাল করি। ও মাইন্ড করে না।
আবুল কালাম : শহরের প্রথিতযশা লইয়ার আনসার উদ্দিনের মজুরি। উকিল-মোক্তারদের মতোই জাঁহাবাজ। দুই হাতে পয়সা কামায় আর আমাদের জন্য খরচা করে। ওর ক্যারিয়ার নিয়ে ওর বাবার বিশাল দুঃখ। ওকে সে উকিল বানাতে চেয়েছিল। কিন্তু কালামের পড়াশোনায় মন ছিল না।
চান মিয়া : জেলা স্কুলের দপ্তরি। শহরের একেবারে শেষ প্রান্তে ওদের বাড়ি। সম্ভ্রান্ত পরিবারের সন্তান। ওর ভাইয়েরা ভালো চাকরিবাকরি করে। ছোটবেলায় বখে যাওয়ায় অগত্যা মধুসূদন হিসেবে চাকরি করতে হচ্ছে। হেড স্যারকে বলে-কয়ে আমরাই ঢুকিয়ে দিয়েছি। সাইকেলে যাতায়াত করে। ওর সাইকেল আমাদের অ্যাজমালি সম্পত্তি। যখন যার খুশি, যেখানে খুশি নিয়ে যেতে পারে। ও জিজ্ঞেসও করে না।
আমাদের গুরু ততক্ষণে পাঁচ পেগ মেরে দিয়ে বসে আছে। তখন থেকেই অনুশোচনায় ভুগছে। 'কাজটা কী ঠিক হচ্ছে সাকি? বলল সে। কথা জড়িয়ে আসছে।'
'কোন কাজ?'
'ওই যে একটা নিরীহ মেয়েকে এতগুলো হায়েনার মুখে ছেড়ে দিয়েছি।'
'দুর, কী যে বল না গুরু। নিশ্চয় অভ্যস্ত...'
'না, বলছিলাম কী, এখনো সময় আছে। বলিস তো পার করে দিয়ে আসি।'
'সে কী তুমি পারবে? বড় ধরনের বেইমানি হয়ে যাবে না?'
'সে-ও ঠিকই রে; কিন্তু এতগুলোকে সামলাবে কী করে?'
'ডেলিকেট ফিগারের একটা মেয়ে, তুই তো দেখিসনি। আমি তো এসব কম ঘাঁটাঘাঁটি করিনি, এ মেয়েটা ভীষণ অন্য রকম।'
'ডানাকাটা পরী, তা-ই তো?'
'আরে না না, ওর চেহারার ভেতর কী যেন একটা আছে, ইন্নোসেন্স। বুঝলি, এ রকমের একটা কিছু, আমার খুব মায়া হচ্ছে রে সাকি! আমাদের ইয়ারদের তো চিনিস তুই। যদি একটুখানি ব্রিফিং করে দিতিস। যাতে...'
'আমাকে হাসালে ওস্তাদ। আমার ব্রিফিংয়ের কথা কার মনে থাকবে বল।'
রোমেল অনেকক্ষণ মাথা চুলকে বলল, 'তা অবশ্য ঠিকই বলেছিস। আর একটা কথা। আজ আমি আর এসবের মধ্যে থাকতে চাচ্ছি না। মেয়েটাকে তোর হাতে দিয়ে গেলাম। কাল সকালে এসে টাকাপয়সার সুরাহা করব। এই পাঁচ শ টাকা রাখ। দরকার হলে খরচ করিস।'
বন্ধুদের কাছে গুরুর মেসেজ পৌঁছুলে একেকজন একেক রকম করে হাসল। তাদের বক্তব্য হচ্ছে : গুরুর আজ কী হয়েছে? এ রকম আজগুবি ধরনের জ্ঞান দিচ্ছে। আমরা কি বাচ্চা ছেলে, নাক টিপলে দুধ বেরুবে; আমরা ডুডুও খাই, তামাকও খাই। হাঁ হাঁ হাঁ।
আমার প্রতিটি মুহূর্ত কাটছিল চরম অস্থিরতায়। কখন এই উন্মাদদের খেলা শেষ হবে? কখন দেখব পরীর আড়ালে লুকিয়ে থাকা মেয়েটাকে কিংবা মেয়েটার আড়ালে ঢাকাপড়া পরীটাকে? শেষটায় কী হাল হবে ওর। আমার সঙ্গে কথা বলার মতো শক্তিটুকু ওর থাকবে তো? ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যাচ্ছিল। বাড়ছিল রাত। উঠে ও ঘরে গেলাম। ঘর ফাঁকা। সোফায় বসে চান মিয়া ঝিমুচ্ছে।
'এ্যাই চান, কটা বাজেরে?'
ধড়মড় করে উঠে বসল। যেন ধমক খেয়েছে কারো।
'কী হইচে, কী হইচে রে সাকি?'
'কিচ্ছু হয়নি, ভেতরে কে?'
'কালামে।'
'ওকে তাড়াতাড়ি করতে বল।'
'আমি কইতে পারুম না সাকি। তুমি কও। ওই হালায় ক্যাচাল লাগাইয়া দিব।'
আমি চিৎকার করে বললাম, 'তাড়াতাড়ি কর কালাম। রাত অনেক হয়েছে।' একটু পরেই কালাম বেরিয়ে এলো। বলল, 'মেয়েটারে লইয়া বাজার বসানো ঠিক হয় নাই সাকি। রোমেলে কই?'
'তোমরা তো সব আঠার মতো লেগেছিলে। কেউ-ই তো আমন্ত্রিত ছিলে না। জবরদস্তি ঢুকে পড়েছিলে।'
কালাম আমার কাছ থেকে এ ধরনের বক্তব্য আশা করেনি। থতমত খেয়ে দ্রুত কেটে পড়ে।
এবার চাঁদের পালা। হাই তুলতে তুলতে উঠে দাঁড়াল
'এই যে চন্দ্র দাঁড়িয়ে রইলে যে...?'
'আমি বাড়ি যামু সাকি? বড্ড ঘুম পাইতাছে।'
'ভেতরে যাবি না কেন? ঘাবড়ে গেছিস?'
'না, এমনেই।'
'যা তাহলে। সাইকেলটা রেখে যাস। আমার লাগতে পারে। এই টাকাটা রাখ, রিকশা নিস।'
'ট্যাকা লাগব না, আচে।'
'ঠিক আছে, যা তবে।'
আমার বুকের ভেতরটা ধকধক করছিল। ভেজান দরজা ঠেলে ঘরে ঢুকলাম। বিছানার ওপর নিথর শুয়ে আছে। আমার সাড়া পেয়ে একটুখানি নড়েচড়ে উঠল। ঘরের ভেতর গুমোটের গন্ধ। নিঃশ্বাস ভারী হয়ে আসে। মেয়েটার গায়ে কাপড় ছিল না। আমাকে দেখে চাদরে গা জড়াল।
'এই যে শুনছেন? রোমেল ভাই কোথায়? তাকে গিয়ে বলুন আমি আর পারছি না। মনে হয় মরে যাব।' যেন এক শ মাইল দূর থেকে ভেসে এলো কথাগুলো। বললাম, 'রোমেল তো নেই। কাল সকালে পাওয়া যাবে ওকে।
যা বলবার আমাকে বল।'
'আমি মারা যাচ্ছি।'
আমার তখন এরেন্দিরার কথা মনে পড়ল। সেই মেয়েটাও তার দাদির কাছে এ রকম একটা বার্তা পাঠিয়েছিল। বললাম, 'তোমার কাছে বাড়তি কাপড়চোপড় আছে?'
'আছে। কেন বলুন তো?'
'পাশেই বাথরুম, সোজা ঢুকে পড়। সাবান-তোয়ালে এসব এনে দিচ্ছি। ডেটলও আছে। পানিতে একটুখানি মিশিয়ে নিও। যাও।'
'আপনে আসবেন না আমার কাছে?'
'মৃতপ্রায় মানুষের ধারেকাছেও যাই না আমি। আমার পছন্দ ফ্রেশ, তরতাজা মানুষ।' অনেকটা ঠাট্টার ভঙ্গিতে বললাম।
মেয়েটা অবাক হলো। একটু ভাবল, তারপর ধীরে ধীরে বাথরুমের পথে পা বাড়াল। বলল, 'আমার কথায় রাগ করেছেন/ আসলে হয়েছে কী...।'
'তোমার কিচ্ছু বলার দরকার নেই। যা বললাম তাই কর।' মেয়েটাকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলাম। তারপর সাইকেলটা নিয়ে নামলাম রাস্তায়, মেইন রোডের লাভলি স্টুডিওর ফটোগ্রাফার ছোকরাটা আমার খুব নেওটা। সাইকেলটা দিয়ে বললাম, 'মাকে গিয়ে বলবি জরুরি একটা কাজে আটকে পড়ায় ভাই আজ রাতে ফিরতে পারবে না।'
রিকশা নিয়ে সিটি বিরিয়ানি হাউসে গেলাম। চুলো থেকে গরম বিরিয়ানির ডেকচি নামছিল। খাসির কাচ্চি। আমার খুব ফেভারিট। দুই বাক্সের অর্ডার দিলাম। সঙ্গে এক্সট্রা টিকিয়া আর মুরগির রোস্ট। আর এক লিটার বোরহানি। বেয়ারা প্যাকেট দিতে এসে বলল, 'কী সাকি ভাই, গোনাগুনতি দুই প্যাকেট যে, বান্ধবীরে লইয়া খাইবেন বুঝি?' এ শহরে রেস্তোরাঁর বয়-বেয়ারাও আমাদের বন্ধুর মতো। হেসে বললাম, 'দুর, কী যে বল!' বিল চুকিয়ে দ্রুত কেটে পড়লাম।
ফেরার পথে পড়ল জীতেন সুইট মার্ট। আধাসের রসমালাই আর ছোট্ট এক হাঁড়ি মিষ্টি দই কিনলাম। রাত ১০টার মতো বাজে। শহর ফাঁকা হয়ে আসছিল। লিভস অ্যান্ড ফ্লাওয়ার্স ফুলের দোকানটা কি খোলা পাওয়া যাবে? গিয়েই দেখি না। শুক্কু মিয়া বলল, 'কী গুরু, এত রাইতে ওই সব খাওয়া-খাদ্য?'
'না, গেস্ট আছে একজন। বেলির মালা আছে?'
'আছে।'
'দাও কয়েকটা। ফ্রেশ হওয়া চাই কিন্তু। কটা গোলাপও দিও শুক্কু মিয়া।'
'এত রাইতে ফ্রেশ পামু কই, তবে মোটামুটি ফ্রেশ।'
'দাও, দাও, কী আর করা।' ফ্রিজে বোধ হয় কোল্ড ড্রিংকস নেই। রাক্ষসগুলো নির্ঘাত সব সাবাড় করে দিয়ে গেছে। দুই বোতল কোক নিয়ে রিকশায় চাপলাম।
নীল বাড়িতে পৌঁছে দেখলাম গোসল শেষ করে লাল টুকটুকে একটা শাড়ি পরে বসে আছে মেয়েটা। সব কয়টা জানালা খুলে দিলাম। গুমোটের গন্ধটা বেরিয়ে গেল। পাশের ঘর থেকে রুম ফ্রেশনার এনে ছড়িয়ে দিলাম। খুট করে জ্বালিয়ে দিলাম ঘরের নিওন বাতি। যেন চোখ ধাঁধিয়ে গেল আমার। পরী আমি দেখিনি তবে তাদের সৌন্দর্য সম্পর্কে বই-পুস্তকে পড়েছি। বইয়ের বর্ণনার চেয়েও বেশি সুন্দরী মেয়েটা। তাকে বলা যায় প্যারাগন অব বিউটি, নিম্ফ্। নিমফেট। এই সৌন্দর্য উপভোগ না করে এতক্ষণ ধরে পাষণ্ডগুলো তার দেহ ভোগ করল? কতক্ষণ ওর দিকে তাকিয়ে ছিলাম জানি না। ওকে কী বলে অভিহিত করব আমি? বেশ্যা, গণিকা, খানকি, ছিনাল, নটী, নষ্টা, ভ্রষ্টা, বারবনিতা, পতিতা, বারবিলাসিনী, অসতী, কুলটা, দুশ্চরিত্রা, গতরখাকি, নগরবধূ, কামিনী, টার্ট, প্রস, প্রসটিটিউট, কলগার্ল, সেক্সওয়ার্কার, হার্লট, হাসলার, হুকার, হোর, যৌনকর্মী? অসম্ভব, অসম্ভব, অসম্ভব। ওগুলোর কোনোটাই নয় সে। ও হচ্ছে প্রিয়, প্রিয়ে, প্রিয়তম...।
'আপনি আমাকে একা রেখে কোথায় গিয়েছিলেন? আমি তো ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। এক গ্লাস পানি খাব।'
কোথায় গিয়েছিলাম আমি? কোন জগতে? জানি না। মেয়েটির কথায় পৃথিবীতে ফিরে এলাম। ফ্রিজ থেকে ঠাণ্ডা পানির বোতল বের করে তার সঙ্গে নরমাল পানি মিশিয়ে এগিয়ে দিলাম। এক ঢোকে খেয়ে ফেলল। মনে হলো অনন্তকাল পরে কোনো কিছু পান করল। খুব মায়া হলো ওর জন্য। ওকে গ্লাসভর্তি কোকা-কোলা এনে দিলাম। এবার লজ্জা পেল একটুখানি। বলল, 'আপনাকে শুধু কষ্ট দিচ্ছি।'
'থাক থাক, বিনয় দেখাতে হবে না। যে ধকল তুমি সামলেছ। তুমি কি আমাকে দশটা মিনিট সময় দেবে? খাবার রেডি করে ডাকছি। নিশ্চয়ই খুব খিদে পেয়েছে তোমার?'
মেয়েটা কিছু না বলে মাথা নিচু করে বিছানার চাদরের ওপর আঙুল দিয়ে আঁকিবুঁকি করতে লাগল।
ডাইনিং টেবিলটা সুন্দর করে পরিষ্কার করলাম। মুছলাম সব কয়টা চেয়ার। শোকেস থেকে বের করলাম সবচেয়ে দামি কাটলারিজ। ওগুলো ধুয়েমুছে চকচকে করে তুললাম। ফুলদানিতে পানি দিয়ে কয়েকটা গোলাপ সাজালাম। প্যাকেট থেকে খাবারগুলো প্লেটে সাজিয়ে মেয়েটাকে ডাকলাম। ঘরময় তখন কাচ্চি বিরিয়ানির ঘ্রাণ। বিরিয়ানির সূত্র ধরে উৎসবের ঘ্রাণ।
আমার সামনের চেয়ারে বসালাম ওকে। তখনো মাথা নিচু করে আছে। তা দেখে খুব রাগ হলো আমার।
'এভাবে মাথা নিচু করে বসে আছ কেন? ও হো, তোমার নামটাই তো জানা হয়নি। আসল নাম বলবে। বানানো নামটাম শুনতে ভালো লাগে না।'
'আমার নাম মোমতাজ মহল।'
'বেশ। বাদশাহজাদির নাম।'
'কে রেখেছে?'
'আমার মা।'
'বাড়িতে কে কে আছে তোমার?' মেয়েটা চুপ।
'বলতে না চাইলে বলবে না...।'
'না না, আমার তিন বোন আর মা।'
'কেন, তোমার বাবা?'
'মারা গেছে।'
'ও, সরি!' কথার মোড় ঘুরিয়ে দেওয়ার জন্য বললাম, 'এই বিরিয়ানিটা খুব নামকরা। ভীষণ স্বাদ। আমার তো রোজই খেতে ইচ্ছে করে। তুমি খেয়ে আমাকে বল কেমন। আর শোন, অন্যান্য খাবার যেগুলো আছে, তুমি পরিবেশন করবে। মেয়ে মানুষ ঘরে থাকতে পুরুষের বাড়াকাড়া বেমানান লাগে।'
মোমতাজ খেতে খেতেই বলল, 'সত্যিই বিরিয়ানিটা খুব স্বাদের। এমন বিরিয়ানি জীবনেও খাইনি।'
'গুড। এবার বোরহানিটা দাও।'
মেয়েটা গ্লাসে বোরহানি ঢালতে ঢালতে বলল, 'একটা কাঁচা মরিচ পেলে খুব ভালো হয়।'
'আছে তো। ফ্রিজের একদম নিচের ড্রয়ারে পাবে। বের করে আন।'
মোমতাজ চেটেপুটে খেল। খুব খিদে পেয়েছিল ওর। রসমালাই আর মিষ্টি দইয়ের প্রশংসা করল খুব।
আমরা শোবার ঘরে ঢুকলাম। ইস্ত্রি করা একটা বিছানার চাদর এনে দিয়ে বললাম, 'সুন্দর করে বিছানাটা করে ফেল। নোংরা বিছানা একদম পছন্দ না আমার।'
মোমতাজ হাসল। ও ঘরটাতে নানা রঙের ডিমলাইট আছে। তার কয়েকটা জ্বালিয়ে দিতেই মোহময় একটা আবহ রচিত হলো।
একটা সিগ্রেট ধরিয়ে মোমতাজের পাশে শুয়ে পড়লাম। শরীরটা কেমন যেন একটু শিরশির করে উঠল। এই প্রথম কোনো মেয়ের এত কাছে এলাম। ওর শরীর থেকে ডাভ সাবানের হাল্কা ঘ্রাণ ভেসে আসছিল।
বললাম, 'তোমাকে নিয়ে প্রথমটায় বড্ড ভয় পেয়েছিলাম আমরা। আমি আর রোমেল।'
'কেন?'
'না এতগুলো মানুষ...পরে সহজ-সরল, মেয়ে এরেন্দিরার কথা মনে পড়ে গেলে ভরসা পেয়েছিলাম। রোমেল তো অনুশোচনায় ভুগে ভুগে কেটে পড়েছে এখান থেকে।'
'এরেন্দিরা কে?'
'একজন হতভাগ্য বালিকা। বিদেশি একটা লেখায় পড়েছিলাম ওর গল্প। মাত্র ১৪ বছর বয়স ছিল ওর। ছোটবেলায় মা-বাবা মারা গেছে। দাদির কাছে মানুষ। দাদি এক বিশাল দেহের মহিলা। সারা দিন শুয়ে-বসে খায় আর হুকুম করে নাতনিকে। আর সহজ-সরল এরেন্দিরা মুখ বুজে সব কাজ করে যাচ্ছে। হঠাৎ এক রাতে দুর্ঘটনাক্রমে ভয়াবহ এক অগ্নিকাণ্ড ঘটিয়ে ফেলল এরেন্দিরা ওদের বাড়িতে। পুড়েটুড়ে সব ছারখার। দাদিমা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, ওই আগুনে যে ক্ষতি হলো তা ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য তোর সারা জীবনটাও যথেষ্ট নয়। হিসাব করে দেখল, ১০ লাখ টাকারও বেশি হবে। আর সেদিন থেকেই বকেয়া চুকিয়ে দেওয়ার সংগ্রামে নামতে হলো এরেন্দিরাকে। কোথা থেকে যেন এক বিপত্নীকের আবির্ভাব ঘটল। লোকটা এমন নচ্ছার আর বদমাশ যে এরেন্দিরাকে দেখে মন্তব্য করল, ওর স্তন দুটো ঠিক কুত্তির মতো। এর জন্য আমি দেড় শ টাকা দিতে পারি। দাদিমা বলল, তিন শ অবধি না উঠলে এমন কচি জিনিস হাসিল করতে পারবে না। তা শেষাবধি ২২০ টাকায় রফা হলো।
'লোকটা এরেন্দিরাকে পেছনের ভাঙাচোরা একটা ঘরে নিয়ে গেল। ওখানে লাগান ছিল একটা দোল খাটিয়া। মেয়েটাকে খাটিয়ায় শুইয়ে ফেলল সে। এরেন্দিরা বিপত্নীক লোকটাকে প্রাণপণে বাধা দিল। নখ দিয়ে আঁচড়ে দিল ওর মুখ, তারপর চিৎকার করে উঠল। লোকটা তাকে এমন জোরে একটা থাপ্পড় মারল যে সে কিছুক্ষণের জন্য শূন্যে ভেসে রইল। সেই ফাঁকে লোকটা তার মরণ থাবা বসাল এরেন্দিরার কচি শরীরে।...
'ওই ঘটনার পর গ্রামে একজন পুরুষও বাকি রইল না যে কি না টাকার বিনিময়ে এরেন্দিরার শরীর ভোগ করেনি। দাদিমার টাকার খাই তত দিনে বহুগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে।
'দাদিমা একদিন একটা ট্রাক ভাড়া করে মালপত্রসহ এরেন্দিরাকে নিয়ে ট্রাকে উঠে বসল। গন্তব্য চোরাকারবারিদের আস্তানা। দাদিমার ধারণা, ওখানে বিস্তর টাকাপয়সা মিলবে। ট্রাকটা তাদের একটা ছোট শহরে নিয়ে পৌঁছে দিল। ওখান দিয়ে যাচ্ছিল ওই এলাকার এক ডাকহরকরা। দাদিমা খুব অল্প পয়সায় তাকে এরেন্দিরার দেহ ভোগ করতে দিল। সে লোকটা অচিরেই এরেন্দিরার সৌন্দর্য আর রতি বৈভবের খবর সর্বত্র চাউর করে দিল। দলে দলে খদ্দেররা এসে এরেন্দিরার তাঁবুর পাশে ভিড় জমাতে লাগল।
'ওখানে টাকাপয়সা কামানো শেষ হলে দাদিমা এরেন্দিরাকে নিয়ে গেল একটা মরুশহরে। ওখানেও তাঁবু পড়ল। ওখানে ছিল সৈন্যদের আনাগোনা। শত শত সৈনিক লাইনে দাঁড়িয়ে থেকে তাঁবুতে ঢুকে এরেন্দিরার শরীর ভোগ করল। শেষে একজন সৈনিক ভেতরে গেলে এরেন্দিরা তাকে বলল, দোহাই তোমার, আমার দাদিমাকে গিয়ে বল, আমি মরে যাচ্ছি। ঠিক তুমি যেমন আমার মাধ্যমে রোমেলের কাছে বার্তা পাঠিয়েছিলে। দাদিমা ভেতরে গিয়ে এরেন্দিরাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলল, আর মাত্র দশজন বাকি। এরেন্দিরা কেঁদেকেটে হয়রান হলে দাদিমা সেদিনের মতো ক্ষান্ত দিয়েছিল।
'পরের দিন এরেন্দিরাদের তাঁবুতে এসে হাজির হলো সহজ-সরল এক যুবক। তার নাম উলিসেস। সেদিনও এরেন্দিরা ক্লান্ত ছিল। বলেছিল, আর তো পারব না। আমি যে মরে যাচ্ছি। উলিসেস বলল, কাল সকালে উঠেই চলে যাব। আর আসা হবে না। এরেন্দিরার মায়া হলো। বলল, টাকা এনেছ? দাও, আমার হাতে আর পাশে এসে শুয়ে পড়। উলিসেস শুয়ে পড়ল ঠিকই, কিন্তু কাঁপতে লাগল। এরেন্দিরা উলিসেসের ব্যাপারটা বুঝতে পারল। বলল, জোরে জোরে শ্বাস নাও, প্রথমবার তো সবারই এমন হয়। উলিসেস এরেন্দিরাকে আদর করতে লাগল। ওই আদর চলল ভোর অবধি। কেননা উলিসেস এরেন্দিরাকে আর এরেন্দিরা উলিসেসকে ভালোবেসে ফেলেছিল।'
গল্পের ওই পর্যায়ে এসে মোমতাজ তার শরীর থেকে ব্রা আর ব্লাউজ খুলে ফেলে আমাকে বলল, 'এ্যাই, এস না।' আমার অবস্থা তখন উলিসেসের চেয়ে শোচনীয়। আমি রীতিমতো কাঁপতে লাগলাম। মোমতাজ আমাকে জড়িয়ে ধরে চুমু খেল। তখন বিদ্যুৎ প্রবাহিত হচ্ছিল আমার শরীরের ভেতর দিয়ে। মোমতাজের শরীরের ওপরে উঠে এলাম আমি, আমার হাত ছুটে গেল ওর স্তনের সন্ধানে। জেগে ওঠা যৌবন পথ খুঁজে পেতে চাইল। মোমতাজের কণ্ঠস্বর আবেশে জড়িয়ে গেল। এখানে নয়, এখানে, হ্যাঁ, ঠিক এইখানে...। অজানা আনন্দে ভরে উঠল সারা শরীর। বুঝলাম, এটাই হচ্ছে প্রেমের খেলা। সেই খেলা চলল সকাল অবধি, কারণ মোমতাজ আমাকে আর আমি মোমতাজকে ভালোবেসে ফেলেছিলাম।
'বুঝলে মোমতাজ, পরের দিন উলিসেস আবার গিয়েছিল এরেন্দিরার তাঁবুতে। আবার দেহমিলনের আনন্দে বিভোর হয়েছিল তারা। হঠাৎ এরেন্দিরা ফিসফিস করে ওর কানে কানে বলেছিল- ওকে খুন করতে সাহস হবে তোমার? কণ্ঠস্বরে একটুও জড়তা বা কাঁপন ছিল না। কী উত্তর দেবে উলিসেস? ভেবে পায়নি। বলেছিল, কে জানে? তোমার সাহস হয় এরেন্দিরা? আমি পারিনি উলিসেস, উনি যে আমার দাদিমা! উলিসেস অনেকক্ষণ ভাবল, তারপর স্থির সিদ্ধান্তে পৌঁছার মতো করে বলল, তোমার জন্য সব কিছু করতে পারি এরেন্দিরা।
'তারপর কী হয়েছিল জান? জামরুলের মোরব্বা আর ক্ষীরের সঙ্গেই ইঁদুর মারার ওষুধ মিশিয়ে উলিসেস খেতে দিয়েছিল দাদিমাকে। কিন্তু দাদিমার জান এত শক্ত যে চেটেপুটে ক্ষীর আর মোরব্বা খেয়ে দিব্যি বেঁচে ছিল সে। এরেন্দিরা তখন মন্তব্য করেছিল, একটা হাতির চেয়েও কড়া ওর জান। বিস্ময়ের সীমা ছিল না উলিসেসের। সে ফিরে গিয়েছিল নিজের বাড়িতে।
'দুই সপ্তাহ পরে আবার ফিরে এসেছিল। দাদিমা বিভোর হয়ে পিয়ানো বাজাচ্ছিল। তার মাথায় পালকের পরচুলা। একটা স্বপ্ন দেখছিল- সাদা দোল খাটিয়ায় একটা ময়ূর। এ তো মৃত্যুর পূর্বাভাস! তখনই ধারালো একটা ছুরি হাতে আবির্ভূত হলো উলিসেস। সোজা ঢুকে গেল দাদিমার ঘরে। তাকে দেখে চিৎকার করে উঠেছিল দাদিমা- কুত্তির বাচ্চা। বড় দেরিতে বুঝতে পেরেছি, তোর মুখটা আসলে বেইমান দেবদূতের মতো। ততক্ষণে উলিসেস তীক্ণ্ণ ছুরিটা দাদিমার বুকের ঠিক মাঝখানে বসিয়ে দিয়েছিল। একবার, দুবার, তিনবার। রক্তের ধারা ছুটে এসে উলিসেসের চোখ-মুখ ভিজিয়ে দিয়েছিল। দরজার আড়াল থেকে ভাবলেশহীন মুখে এসব দেখেছিল এরেন্দিরা।
'উলিসেস শেষবার ছুরিটা দাদিমার বুকে বসিয়ে দিতেই তার দেহ থেক উধাও হয়েছিল প্রাণপাখি। নিথর সেই বিশাল শরীরের পাশে বসে প্রবল ক্লান্তিতে ভেসে গিয়েছিল উলিসেস। এরেন্দিরাকে ডাকল উলিসেস। দেখতে পেল সে দৌড়ে বেরিয়ে যাচ্ছে ঘর থেকে। আবার ডাকল সে। ততক্ষণে এরেন্দিরা সমুদ্রের তীর ধরে দ্রুতবেগে ছুটতে আরম্ভ করেছে...।'
শেষবারের মতো চরম পুলকের শীর্ষে আরোহণ করেছিলাম। সেই আনন্দ হয়তো মোমতাজকেও ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল। বললাম, 'তোমার এই দুর্ভাগ্যের জন্য কে দায়ী? আমিও তাকে খুন করব- উলিসেসের মতো।'
আমার কথা শুনে মোমতাজ হাসল। কিছুই বলল না। আমি জোরাজুরি করতে লাগলাম, 'বল মোমতাজ, কে সেই পাষণ্ড যার কারণে তুমি আজ এখানে। বল, চুপ করে থেক না।' এবার অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল মোমতাজ। অবিশ্বাস্য এক উদ্ভট হাসি। কোনো মেয়েকে কখনো এভাবে হাসতে দেখিনি। খুব অস্বস্তি হচ্ছিল। একটা দীর্ঘ হাই তুলে পাশ ফিরে শুলো মোমতাজ।
আবার চিৎকার করে উঠলাম, 'বল, কে দায়ী তোমার এ অবস্থার জন্য? তাকে নির্ঘাত খুন করব আমি।' বিছানার ওপর চিত হয়ে শুলো সে। মুখে মৃদু হাসি। বলল, 'তুমি তাকে কোনো দিনই মারতে পারবে না, সাকি। কেননা সে ভীষণ পরাক্রমশালী, অসীম তার শক্তি। সে শক্তির সামনে দাঁড়ানো সহজ কথা নয়, তুমি পারবে না, কিছুতেই না।'...
এ কথা শুনে আমার মাথায় আগুন ধরে গেল। 'তুমি তার নাম বল আমাকে। অবশ্যই মারতে পারব তাকে। উলিসেসের মতো হাড়জিরজিরে দুর্বল এক যুবক যদি পরাক্রমশালী ওই নারীকে হত্যা করতে পারে, আমি কেন পারব না?'
উঠে বসল মোমতাজ। বুকের ভেতর আমাকে জড়িয়ে ধরে আমার কাঁধে মাথা রাখল। তারপর ফিসফিস করে বলল, 'সেই নিষ্ঠুর শক্তি কোনো মানুষ নয়- সে হচ্ছে এই সমাজ আর সমাজের ব্যবস্থা। একে হত্যা করা সহজ কাজ নয়।'
ইলেকট্রিক শক লাগা মানুষের মতো নিজেকে মোমতাজের বাহুবন্ধন থেকে বিযুক্ত করলাম। ওকে নিজের সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়ে ওর মুখের ছবি দেখতে লাগলাম, ওই ছবি পাঠ করার চেষ্টা করলাম আমি; কিন্তু পারলাম না। কাজটা বোধ হয় সহজ না।
ভোর হয়ে গিয়েছিল; কিন্তু তখনো আলো ফোটেনি ভালো করে। নীল বাড়ির গাছগাছালিতে আসা পাখিরা প্রচণ্ড জোরে চিৎকার-চেঁচামেচি জুড়ে দিয়েছিল।
তিনি কেন লেখেন আর কাদের জন্য লেখেন? জানা গেল গোমড়ামুখো আর হাবাগোবাদের জন্য লেখেন না তিনি, লেখেন না তাদের জন্য যারা বাসার চাকর-বাকরদের মারধর করে আর ঘুষ খেয়ে বড়লোকি দেখায়। সমাজের কাছে কি লেখক দায়বদ্ধ? এই প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেছেন, কারো কাছেই লেখক দায়বদ্ধ নন। লেখাটেখা পড়ে কেউ নিজেকে বদলেছে বলেও তাঁর জানা নেই। অনেকের ধারণা গোর্কি, তলস্তয়, দস্তয়েভস্কি কিংবা মায়াকোভস্কির লেখা পড়ে উদ্বুদ্ধ হয়ে রুশরা বিপ্লব করেছিল, এসব একেবারেই ফালতু কথা।
...এসব চমকপ্রদ কথায় ডুবে ছিলাম বলে কখন বৃষ্টি পৃথিবীটা শীতল করে দিয়ে গেছে, টের পাইনি। জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখলাম আলো নেই একেবারে আর ঝিরঝির বৃষ্টি এখনো পড়ছে। বইছে ঠাণ্ডা বাতাস।
চা নিয়ে মা ঘরে ঢুকল। বলল, 'রাতে খিচুড়ি আর মাংস করব, তাড়াতাড়ি ফিরিস, গরম-গরম খাবি।' রাত ১১টা-১২টার আগে কখনোই বাড়ি ফিরি না। তাই মায়ের এই আদেশ।
তখন সাইকেলের ক্রিং ক্রিং বেল শুনে বাইরে বেরুলাম। বন্ধু রোমেলের দূত এসেছে চিঠি নিয়ে (তখন দেশে মোবাইল আসেনি)। আমার এই বন্ধু লেখাপড়া শেষ করার আগেই চাকরিতে ঢুকেছে লোভনীয় একটা চাকরির সুযোগ হারাতে চায়নি বলে। খুব ভালো মাইনে পায়। চা-সিগারেট থেকে শুরু করে মদ্য পানীয় সবই আমরা ওর ওপর দিয়ে চালিয়ে দিই, আমাদের পকেট ফাঁকা থাকলে। সে মাঝেমধ্যেই এ রকম বার্তা পাঠায় অথবা নিজের মোটরবাইকে চেপে আমাদের বাড়িতে চলে আসে। রোমেল তার চিরকুট বার্তায় লিখেছে : পত্রপাঠ নীল বাড়িতে চলে আয়। তোর জন্য একটা পরী এনেছি। এই পরী তোর কুমারত্ব ভাঙবে। তবে পরীর ভেতর একটা জিনিস পাবি না আগেই বলে রাখছি- ডানা। হা হা হা। এসে দেখ, পছন্দ হয় কি না। কথাটা ঘুণাক্ষরেও যেন কেউ না জানে। এক বোতল ভদকাও জোগাড় হয়েছে...।
বার্তা পড়ে আমি তো হতভম্ব। একটা শিহরণের অনুভূতি পেলাম মাথা থেকে পা অবধি। আমাদের শহরের ঠিক মধ্যিখানে চমৎকার একটা নীল বাড়ি। উঁচু পাঁচিল দিয়ে ঘেরা। মস্ত বড় গেট। ঢুকতেই বাগান। বেশ কিছুটা পথ হাঁটার পর একতলা একটা বাড়ি পাওয়া যায়। আমাদের এক বন্ধু ভাড়া নিয়েছে। একটা ওষুধ কম্পানির বড় কর্তা। সকালে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়, ফেরে অনেক রাতে। জেলার বাইরে কাজ পড়লে সে রাতে আর ফেরেই না। এ কারণে সব সময় বাড়িটা আমার জিম্মায় থাকে। ঘনিষ্ঠ বন্ধুরা প্রয়োজনে প্রেমিকাদের নিয়ে হুটহাট ও বাড়িতে ঢুকে পড়ে। শহরের মাঝখানে খুব ব্যস্ত স্থানে বাড়িটার অবস্থান বলে ভেতরে কে গেল কে বেরুল তার হদিস রাখা কারো পক্ষে সম্ভব হয় না।
আমি প্রবল রোমাঞ্চে ভাসতে ভাসতে নীল বাড়ির উদ্দেশে বেরিয়ে পড়লাম। পাড়ার মেয়েরা পারফিউম আর ডিওডরেন্টের সাগরে নিজেদের চুবিয়ে নিয়ে ইভিনিং শোতে সিনেমা দেখবে বলে বাড়ি থেকে বেরিয়েছে। তাদের একজন আমাকে দেখে বলল, সিনেমায় যাবেন আমাদের সঙ্গে? ওকে খ্যাপানোর জন্য বললাম, 'এসব বস্তাপচা সিনেমা আমি দেখিনে।'
'তাহলে কোন সিনেমা দেখেন?'
'এই ধরো গদার ক্রুফো, তারকোভস্কি, ভাইদা, পোলানস্কি,...।'
'ধ্যাট।'
মেয়েটা বান্ধবীদের দলে ভিড়ে গেল। আমি রিকশা ধরলাম।
নীল বাড়িতে গিয়ে দেখি ড্রইংরুমের সব কয়টা আসন পূর্ণ। অনেকে কার্পেটের ওপর বসে আছে। খুবই অবাক হলাম। এই গোপন অভিসারের খবর এরা জানল কী করে? ভেতরে ভেতরে কৌতুক বোধও হলো। হিসাব করে দেখলাম ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের কেউ বাদ পড়েনি।
'কী ব্যাপার, এত মক্কেল কোত্থেকে এলো?' নরেন্দ্র বলল, 'ওস্তাদ, তুমি এত দেরিতে যে? খবর পেলে কখন?' সোফায় বসে ঝিমুচ্ছিল রোমেল। কপালে ভাবনার বলিরেখা। আমাকে দেখে তড়াক করে উঠে এলো, 'চল, ও ঘরে যাই, কথা আছে।'
ভদকার বোতল খুলতে খুলতে বলল, একেবারে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিয়েছে আমাকে। শুধু সঞ্জয়কে বলেছিলাম। ওই হারামজাদার কাছ থেকে একে একে সবাই জেনেছে। বলছে পরীটার ঘ্রাণ একাই শুঁকবি? আমরা তো সব কিছুই একসঙ্গে করি। আজ আবার এর ব্যতিক্রম কেন? মিথ্যে বলেনি।
কিন্তু মেয়েটা বেঁকে বসেছিল এত লোক দেখে। আমার সঙ্গে কথা হয়েছিল তিনজনের। ওর টাকার খুব দরকার, তাই তিনজনে রাজি হয়েছিল। ও নাকি একজনের বেশি হলে যায় না। তোর কথা ভেবে রাজি হয়ে যাই। পরীটাকে আমারও খুব পছন্দ। তা এখন অবস্থা নিজে চোখেই দেখতে পাচ্ছিল। ওদের সবার পায়ে ধরার বাকি আছে শুধু। কেউ এখান থেকে এক পা নড়তে রাজি নয়।
'আমি অবশ্য বলেছি, পুষিয়ে দেব। কী আর করা বল।' কথা শেষ করে পরপর দুই পেগ মেরে দিল রোমেল। ওর কথা শুনে আমারও খুব অস্বস্তি লাগছিল। বললাম,
'আমি আর দল ভারী করতে চাইনে রোমেল।'
'দূর কী যে বলিস না, আজ তোর কৌমার্য নস্যাৎ হবে। হা হা হা। পরীটা দেখলে মাথা ঘুরে যাবে তোর।'
'জোগাড় করলি কোত্থেকে?'
'ফরিদকে তো চিনিস। ওর পরিচিত। মেয়েটার বাড়ি মালঞ্চ গ্রামে। ভদ্র ঘরের মেয়ে। খুব বিশ্বস্ত লোক না পেলে বাড়ির বের হয় না।'
'তা তুমি গিয়েছিলে?'
'নারে সাকি। সঞ্জয় গেছে। ও শালা মনে হয় গল্প জুড়ে দিয়েছে মেয়েটার সঙ্গে। প্রেম করার তালে আছে মনে হয়। ভদকার খবর যেন না পায়, তাহলে আবার মাতলামো শুরু করে দেবে।'
প্রিয় বন্ধুদের অবস্থা খুব শোচনীয় তখন। একটার পর একটা সিগারেট ধ্বংস করে চলেছে। আসুন আপনাদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিই : আমাদের নাটের গুরু রোমেলের যে পরিচয় দিয়েছি তাই যথেষ্ট। অন্যের জন্য কিছু করতে পারলে বর্তে যায়। দিল দরিয়া টাইপের মানুষ।
আর এখন যে ভেতরে আছে ওর নামই সঞ্জীব। ওর কথা তো একটু আগেই হয়েছে। কায়স্থ পরিবারের সন্তান। সারা দিন আড্ডা আর গুলতানি মেরে বেড়ায়। বাবা নেই। মা আছে। আছে দুই ভাই, দুই বোন। সারাক্ষণ ওরা তাকে বকাবকি করে। কামাই-রোজগারের ধান্ধা করে না মোটেও।
আর ওই সোফায় বসে গোঁফওয়ালা যে যুবকটি ম্যাগাজিন পড়ছে, ওর নাম দীপংকর। ব্রাহ্মণ ডিগ্রি পড়ছে। কবিতা লেখে, আবৃত্তিও করে। মেয়ে পটাতে ওস্তাদ। ছাত্রনেতা অনলবর্ষী বক্তা। পপুলার। তারপর যারা বসে আছে তারা হলো :
রাজন : একটা সিগারেট কম্পানিতে চাকরি করে। ফিল্ড সুপারভাইজার। প্রতি মাসে মাগনা সিগারেট পায় কম্পানি থেকে। যে পরিমাণ পায় তার চেয়েও বেশি বিলায়। বাকিটা নগদে কেনে দোকান থেকে। ব্রিলিয়ান্ট ছাত্র ছিল। খুব বড়লোকের ছেলে।
আমানুল্লাহ : এই যুবক রাজনের সহকর্মী। এর বাড়ি আমাদের পার্শ্ববর্তী জেলা ফরিদপুরে। ভদ্র টাইপের যুবক। মেয়েদের প্রতি খুব দুর্বল। সেও মাগনা সিগারেট পায়; পেয়েই বাজারে নিয়ে বিক্রি করে দেয়। বন্ধুরা চাইলে কিনে খাওয়ায়।
নরেন্দ্র শীল : নরেন্দ্র এ শহরের সবচেয়ে নামকরা ক্ষৌরকার। ওর দোকানের নাম উত্তম হেয়ার কাটিং সেলুন। বাল্যকালে বাবা মারা গেছে। ওর বাবাও ক্ষৌরকার ছিল। আমরা হাউস মিটিয়ে ওর দোকান থেকে চুল-দাড়ি কাটাই। নখ, গোঁফ আর বগলের লোমও বাদ দিই না। পয়সা নেয় না। পুজোর সময় সবাই মিলে ওকে দামি জামাকাপড় কিনে দিই।
ফারুক : ফারুক শহরের সবচেয়ে আধুনিক টেইলারিং শপের মালিক। ছোট বোনের নামে দোকানের নাম দিয়েছে নীলু টেইলারিং অ্যান্ড আউটফিট। আমরা ওর দোকানের ব্র্যান্ড প্রমোটর, ক্যাম্পেনার যা-ই বলুন না কেন। সব সময় আমাদের কাপড় মাগনা সেলাই করে দেয়। লেডিস গার্মেন্টে ওর স্পেশালাইজেশন। কাপড়চোপড় বানালে ডেলিভারি দিতে বড্ড দেরি করে, ফলে আমরা ওকে যাচ্ছেতাই গালাগাল করি। ও মাইন্ড করে না।
আবুল কালাম : শহরের প্রথিতযশা লইয়ার আনসার উদ্দিনের মজুরি। উকিল-মোক্তারদের মতোই জাঁহাবাজ। দুই হাতে পয়সা কামায় আর আমাদের জন্য খরচা করে। ওর ক্যারিয়ার নিয়ে ওর বাবার বিশাল দুঃখ। ওকে সে উকিল বানাতে চেয়েছিল। কিন্তু কালামের পড়াশোনায় মন ছিল না।
চান মিয়া : জেলা স্কুলের দপ্তরি। শহরের একেবারে শেষ প্রান্তে ওদের বাড়ি। সম্ভ্রান্ত পরিবারের সন্তান। ওর ভাইয়েরা ভালো চাকরিবাকরি করে। ছোটবেলায় বখে যাওয়ায় অগত্যা মধুসূদন হিসেবে চাকরি করতে হচ্ছে। হেড স্যারকে বলে-কয়ে আমরাই ঢুকিয়ে দিয়েছি। সাইকেলে যাতায়াত করে। ওর সাইকেল আমাদের অ্যাজমালি সম্পত্তি। যখন যার খুশি, যেখানে খুশি নিয়ে যেতে পারে। ও জিজ্ঞেসও করে না।
আমাদের গুরু ততক্ষণে পাঁচ পেগ মেরে দিয়ে বসে আছে। তখন থেকেই অনুশোচনায় ভুগছে। 'কাজটা কী ঠিক হচ্ছে সাকি? বলল সে। কথা জড়িয়ে আসছে।'
'কোন কাজ?'
'ওই যে একটা নিরীহ মেয়েকে এতগুলো হায়েনার মুখে ছেড়ে দিয়েছি।'
'দুর, কী যে বল না গুরু। নিশ্চয় অভ্যস্ত...'
'না, বলছিলাম কী, এখনো সময় আছে। বলিস তো পার করে দিয়ে আসি।'
'সে কী তুমি পারবে? বড় ধরনের বেইমানি হয়ে যাবে না?'
'সে-ও ঠিকই রে; কিন্তু এতগুলোকে সামলাবে কী করে?'
'ডেলিকেট ফিগারের একটা মেয়ে, তুই তো দেখিসনি। আমি তো এসব কম ঘাঁটাঘাঁটি করিনি, এ মেয়েটা ভীষণ অন্য রকম।'
'ডানাকাটা পরী, তা-ই তো?'
'আরে না না, ওর চেহারার ভেতর কী যেন একটা আছে, ইন্নোসেন্স। বুঝলি, এ রকমের একটা কিছু, আমার খুব মায়া হচ্ছে রে সাকি! আমাদের ইয়ারদের তো চিনিস তুই। যদি একটুখানি ব্রিফিং করে দিতিস। যাতে...'
'আমাকে হাসালে ওস্তাদ। আমার ব্রিফিংয়ের কথা কার মনে থাকবে বল।'
রোমেল অনেকক্ষণ মাথা চুলকে বলল, 'তা অবশ্য ঠিকই বলেছিস। আর একটা কথা। আজ আমি আর এসবের মধ্যে থাকতে চাচ্ছি না। মেয়েটাকে তোর হাতে দিয়ে গেলাম। কাল সকালে এসে টাকাপয়সার সুরাহা করব। এই পাঁচ শ টাকা রাখ। দরকার হলে খরচ করিস।'
বন্ধুদের কাছে গুরুর মেসেজ পৌঁছুলে একেকজন একেক রকম করে হাসল। তাদের বক্তব্য হচ্ছে : গুরুর আজ কী হয়েছে? এ রকম আজগুবি ধরনের জ্ঞান দিচ্ছে। আমরা কি বাচ্চা ছেলে, নাক টিপলে দুধ বেরুবে; আমরা ডুডুও খাই, তামাকও খাই। হাঁ হাঁ হাঁ।
আমার প্রতিটি মুহূর্ত কাটছিল চরম অস্থিরতায়। কখন এই উন্মাদদের খেলা শেষ হবে? কখন দেখব পরীর আড়ালে লুকিয়ে থাকা মেয়েটাকে কিংবা মেয়েটার আড়ালে ঢাকাপড়া পরীটাকে? শেষটায় কী হাল হবে ওর। আমার সঙ্গে কথা বলার মতো শক্তিটুকু ওর থাকবে তো? ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যাচ্ছিল। বাড়ছিল রাত। উঠে ও ঘরে গেলাম। ঘর ফাঁকা। সোফায় বসে চান মিয়া ঝিমুচ্ছে।
'এ্যাই চান, কটা বাজেরে?'
ধড়মড় করে উঠে বসল। যেন ধমক খেয়েছে কারো।
'কী হইচে, কী হইচে রে সাকি?'
'কিচ্ছু হয়নি, ভেতরে কে?'
'কালামে।'
'ওকে তাড়াতাড়ি করতে বল।'
'আমি কইতে পারুম না সাকি। তুমি কও। ওই হালায় ক্যাচাল লাগাইয়া দিব।'
আমি চিৎকার করে বললাম, 'তাড়াতাড়ি কর কালাম। রাত অনেক হয়েছে।' একটু পরেই কালাম বেরিয়ে এলো। বলল, 'মেয়েটারে লইয়া বাজার বসানো ঠিক হয় নাই সাকি। রোমেলে কই?'
'তোমরা তো সব আঠার মতো লেগেছিলে। কেউ-ই তো আমন্ত্রিত ছিলে না। জবরদস্তি ঢুকে পড়েছিলে।'
কালাম আমার কাছ থেকে এ ধরনের বক্তব্য আশা করেনি। থতমত খেয়ে দ্রুত কেটে পড়ে।
এবার চাঁদের পালা। হাই তুলতে তুলতে উঠে দাঁড়াল
'এই যে চন্দ্র দাঁড়িয়ে রইলে যে...?'
'আমি বাড়ি যামু সাকি? বড্ড ঘুম পাইতাছে।'
'ভেতরে যাবি না কেন? ঘাবড়ে গেছিস?'
'না, এমনেই।'
'যা তাহলে। সাইকেলটা রেখে যাস। আমার লাগতে পারে। এই টাকাটা রাখ, রিকশা নিস।'
'ট্যাকা লাগব না, আচে।'
'ঠিক আছে, যা তবে।'
আমার বুকের ভেতরটা ধকধক করছিল। ভেজান দরজা ঠেলে ঘরে ঢুকলাম। বিছানার ওপর নিথর শুয়ে আছে। আমার সাড়া পেয়ে একটুখানি নড়েচড়ে উঠল। ঘরের ভেতর গুমোটের গন্ধ। নিঃশ্বাস ভারী হয়ে আসে। মেয়েটার গায়ে কাপড় ছিল না। আমাকে দেখে চাদরে গা জড়াল।
'এই যে শুনছেন? রোমেল ভাই কোথায়? তাকে গিয়ে বলুন আমি আর পারছি না। মনে হয় মরে যাব।' যেন এক শ মাইল দূর থেকে ভেসে এলো কথাগুলো। বললাম, 'রোমেল তো নেই। কাল সকালে পাওয়া যাবে ওকে।
যা বলবার আমাকে বল।'
'আমি মারা যাচ্ছি।'
আমার তখন এরেন্দিরার কথা মনে পড়ল। সেই মেয়েটাও তার দাদির কাছে এ রকম একটা বার্তা পাঠিয়েছিল। বললাম, 'তোমার কাছে বাড়তি কাপড়চোপড় আছে?'
'আছে। কেন বলুন তো?'
'পাশেই বাথরুম, সোজা ঢুকে পড়। সাবান-তোয়ালে এসব এনে দিচ্ছি। ডেটলও আছে। পানিতে একটুখানি মিশিয়ে নিও। যাও।'
'আপনে আসবেন না আমার কাছে?'
'মৃতপ্রায় মানুষের ধারেকাছেও যাই না আমি। আমার পছন্দ ফ্রেশ, তরতাজা মানুষ।' অনেকটা ঠাট্টার ভঙ্গিতে বললাম।
মেয়েটা অবাক হলো। একটু ভাবল, তারপর ধীরে ধীরে বাথরুমের পথে পা বাড়াল। বলল, 'আমার কথায় রাগ করেছেন/ আসলে হয়েছে কী...।'
'তোমার কিচ্ছু বলার দরকার নেই। যা বললাম তাই কর।' মেয়েটাকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলাম। তারপর সাইকেলটা নিয়ে নামলাম রাস্তায়, মেইন রোডের লাভলি স্টুডিওর ফটোগ্রাফার ছোকরাটা আমার খুব নেওটা। সাইকেলটা দিয়ে বললাম, 'মাকে গিয়ে বলবি জরুরি একটা কাজে আটকে পড়ায় ভাই আজ রাতে ফিরতে পারবে না।'
রিকশা নিয়ে সিটি বিরিয়ানি হাউসে গেলাম। চুলো থেকে গরম বিরিয়ানির ডেকচি নামছিল। খাসির কাচ্চি। আমার খুব ফেভারিট। দুই বাক্সের অর্ডার দিলাম। সঙ্গে এক্সট্রা টিকিয়া আর মুরগির রোস্ট। আর এক লিটার বোরহানি। বেয়ারা প্যাকেট দিতে এসে বলল, 'কী সাকি ভাই, গোনাগুনতি দুই প্যাকেট যে, বান্ধবীরে লইয়া খাইবেন বুঝি?' এ শহরে রেস্তোরাঁর বয়-বেয়ারাও আমাদের বন্ধুর মতো। হেসে বললাম, 'দুর, কী যে বল!' বিল চুকিয়ে দ্রুত কেটে পড়লাম।
ফেরার পথে পড়ল জীতেন সুইট মার্ট। আধাসের রসমালাই আর ছোট্ট এক হাঁড়ি মিষ্টি দই কিনলাম। রাত ১০টার মতো বাজে। শহর ফাঁকা হয়ে আসছিল। লিভস অ্যান্ড ফ্লাওয়ার্স ফুলের দোকানটা কি খোলা পাওয়া যাবে? গিয়েই দেখি না। শুক্কু মিয়া বলল, 'কী গুরু, এত রাইতে ওই সব খাওয়া-খাদ্য?'
'না, গেস্ট আছে একজন। বেলির মালা আছে?'
'আছে।'
'দাও কয়েকটা। ফ্রেশ হওয়া চাই কিন্তু। কটা গোলাপও দিও শুক্কু মিয়া।'
'এত রাইতে ফ্রেশ পামু কই, তবে মোটামুটি ফ্রেশ।'
'দাও, দাও, কী আর করা।' ফ্রিজে বোধ হয় কোল্ড ড্রিংকস নেই। রাক্ষসগুলো নির্ঘাত সব সাবাড় করে দিয়ে গেছে। দুই বোতল কোক নিয়ে রিকশায় চাপলাম।
নীল বাড়িতে পৌঁছে দেখলাম গোসল শেষ করে লাল টুকটুকে একটা শাড়ি পরে বসে আছে মেয়েটা। সব কয়টা জানালা খুলে দিলাম। গুমোটের গন্ধটা বেরিয়ে গেল। পাশের ঘর থেকে রুম ফ্রেশনার এনে ছড়িয়ে দিলাম। খুট করে জ্বালিয়ে দিলাম ঘরের নিওন বাতি। যেন চোখ ধাঁধিয়ে গেল আমার। পরী আমি দেখিনি তবে তাদের সৌন্দর্য সম্পর্কে বই-পুস্তকে পড়েছি। বইয়ের বর্ণনার চেয়েও বেশি সুন্দরী মেয়েটা। তাকে বলা যায় প্যারাগন অব বিউটি, নিম্ফ্। নিমফেট। এই সৌন্দর্য উপভোগ না করে এতক্ষণ ধরে পাষণ্ডগুলো তার দেহ ভোগ করল? কতক্ষণ ওর দিকে তাকিয়ে ছিলাম জানি না। ওকে কী বলে অভিহিত করব আমি? বেশ্যা, গণিকা, খানকি, ছিনাল, নটী, নষ্টা, ভ্রষ্টা, বারবনিতা, পতিতা, বারবিলাসিনী, অসতী, কুলটা, দুশ্চরিত্রা, গতরখাকি, নগরবধূ, কামিনী, টার্ট, প্রস, প্রসটিটিউট, কলগার্ল, সেক্সওয়ার্কার, হার্লট, হাসলার, হুকার, হোর, যৌনকর্মী? অসম্ভব, অসম্ভব, অসম্ভব। ওগুলোর কোনোটাই নয় সে। ও হচ্ছে প্রিয়, প্রিয়ে, প্রিয়তম...।
'আপনি আমাকে একা রেখে কোথায় গিয়েছিলেন? আমি তো ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। এক গ্লাস পানি খাব।'
কোথায় গিয়েছিলাম আমি? কোন জগতে? জানি না। মেয়েটির কথায় পৃথিবীতে ফিরে এলাম। ফ্রিজ থেকে ঠাণ্ডা পানির বোতল বের করে তার সঙ্গে নরমাল পানি মিশিয়ে এগিয়ে দিলাম। এক ঢোকে খেয়ে ফেলল। মনে হলো অনন্তকাল পরে কোনো কিছু পান করল। খুব মায়া হলো ওর জন্য। ওকে গ্লাসভর্তি কোকা-কোলা এনে দিলাম। এবার লজ্জা পেল একটুখানি। বলল, 'আপনাকে শুধু কষ্ট দিচ্ছি।'
'থাক থাক, বিনয় দেখাতে হবে না। যে ধকল তুমি সামলেছ। তুমি কি আমাকে দশটা মিনিট সময় দেবে? খাবার রেডি করে ডাকছি। নিশ্চয়ই খুব খিদে পেয়েছে তোমার?'
মেয়েটা কিছু না বলে মাথা নিচু করে বিছানার চাদরের ওপর আঙুল দিয়ে আঁকিবুঁকি করতে লাগল।
ডাইনিং টেবিলটা সুন্দর করে পরিষ্কার করলাম। মুছলাম সব কয়টা চেয়ার। শোকেস থেকে বের করলাম সবচেয়ে দামি কাটলারিজ। ওগুলো ধুয়েমুছে চকচকে করে তুললাম। ফুলদানিতে পানি দিয়ে কয়েকটা গোলাপ সাজালাম। প্যাকেট থেকে খাবারগুলো প্লেটে সাজিয়ে মেয়েটাকে ডাকলাম। ঘরময় তখন কাচ্চি বিরিয়ানির ঘ্রাণ। বিরিয়ানির সূত্র ধরে উৎসবের ঘ্রাণ।
আমার সামনের চেয়ারে বসালাম ওকে। তখনো মাথা নিচু করে আছে। তা দেখে খুব রাগ হলো আমার।
'এভাবে মাথা নিচু করে বসে আছ কেন? ও হো, তোমার নামটাই তো জানা হয়নি। আসল নাম বলবে। বানানো নামটাম শুনতে ভালো লাগে না।'
'আমার নাম মোমতাজ মহল।'
'বেশ। বাদশাহজাদির নাম।'
'কে রেখেছে?'
'আমার মা।'
'বাড়িতে কে কে আছে তোমার?' মেয়েটা চুপ।
'বলতে না চাইলে বলবে না...।'
'না না, আমার তিন বোন আর মা।'
'কেন, তোমার বাবা?'
'মারা গেছে।'
'ও, সরি!' কথার মোড় ঘুরিয়ে দেওয়ার জন্য বললাম, 'এই বিরিয়ানিটা খুব নামকরা। ভীষণ স্বাদ। আমার তো রোজই খেতে ইচ্ছে করে। তুমি খেয়ে আমাকে বল কেমন। আর শোন, অন্যান্য খাবার যেগুলো আছে, তুমি পরিবেশন করবে। মেয়ে মানুষ ঘরে থাকতে পুরুষের বাড়াকাড়া বেমানান লাগে।'
মোমতাজ খেতে খেতেই বলল, 'সত্যিই বিরিয়ানিটা খুব স্বাদের। এমন বিরিয়ানি জীবনেও খাইনি।'
'গুড। এবার বোরহানিটা দাও।'
মেয়েটা গ্লাসে বোরহানি ঢালতে ঢালতে বলল, 'একটা কাঁচা মরিচ পেলে খুব ভালো হয়।'
'আছে তো। ফ্রিজের একদম নিচের ড্রয়ারে পাবে। বের করে আন।'
মোমতাজ চেটেপুটে খেল। খুব খিদে পেয়েছিল ওর। রসমালাই আর মিষ্টি দইয়ের প্রশংসা করল খুব।
আমরা শোবার ঘরে ঢুকলাম। ইস্ত্রি করা একটা বিছানার চাদর এনে দিয়ে বললাম, 'সুন্দর করে বিছানাটা করে ফেল। নোংরা বিছানা একদম পছন্দ না আমার।'
মোমতাজ হাসল। ও ঘরটাতে নানা রঙের ডিমলাইট আছে। তার কয়েকটা জ্বালিয়ে দিতেই মোহময় একটা আবহ রচিত হলো।
একটা সিগ্রেট ধরিয়ে মোমতাজের পাশে শুয়ে পড়লাম। শরীরটা কেমন যেন একটু শিরশির করে উঠল। এই প্রথম কোনো মেয়ের এত কাছে এলাম। ওর শরীর থেকে ডাভ সাবানের হাল্কা ঘ্রাণ ভেসে আসছিল।
বললাম, 'তোমাকে নিয়ে প্রথমটায় বড্ড ভয় পেয়েছিলাম আমরা। আমি আর রোমেল।'
'কেন?'
'না এতগুলো মানুষ...পরে সহজ-সরল, মেয়ে এরেন্দিরার কথা মনে পড়ে গেলে ভরসা পেয়েছিলাম। রোমেল তো অনুশোচনায় ভুগে ভুগে কেটে পড়েছে এখান থেকে।'
'এরেন্দিরা কে?'
'একজন হতভাগ্য বালিকা। বিদেশি একটা লেখায় পড়েছিলাম ওর গল্প। মাত্র ১৪ বছর বয়স ছিল ওর। ছোটবেলায় মা-বাবা মারা গেছে। দাদির কাছে মানুষ। দাদি এক বিশাল দেহের মহিলা। সারা দিন শুয়ে-বসে খায় আর হুকুম করে নাতনিকে। আর সহজ-সরল এরেন্দিরা মুখ বুজে সব কাজ করে যাচ্ছে। হঠাৎ এক রাতে দুর্ঘটনাক্রমে ভয়াবহ এক অগ্নিকাণ্ড ঘটিয়ে ফেলল এরেন্দিরা ওদের বাড়িতে। পুড়েটুড়ে সব ছারখার। দাদিমা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, ওই আগুনে যে ক্ষতি হলো তা ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য তোর সারা জীবনটাও যথেষ্ট নয়। হিসাব করে দেখল, ১০ লাখ টাকারও বেশি হবে। আর সেদিন থেকেই বকেয়া চুকিয়ে দেওয়ার সংগ্রামে নামতে হলো এরেন্দিরাকে। কোথা থেকে যেন এক বিপত্নীকের আবির্ভাব ঘটল। লোকটা এমন নচ্ছার আর বদমাশ যে এরেন্দিরাকে দেখে মন্তব্য করল, ওর স্তন দুটো ঠিক কুত্তির মতো। এর জন্য আমি দেড় শ টাকা দিতে পারি। দাদিমা বলল, তিন শ অবধি না উঠলে এমন কচি জিনিস হাসিল করতে পারবে না। তা শেষাবধি ২২০ টাকায় রফা হলো।
'লোকটা এরেন্দিরাকে পেছনের ভাঙাচোরা একটা ঘরে নিয়ে গেল। ওখানে লাগান ছিল একটা দোল খাটিয়া। মেয়েটাকে খাটিয়ায় শুইয়ে ফেলল সে। এরেন্দিরা বিপত্নীক লোকটাকে প্রাণপণে বাধা দিল। নখ দিয়ে আঁচড়ে দিল ওর মুখ, তারপর চিৎকার করে উঠল। লোকটা তাকে এমন জোরে একটা থাপ্পড় মারল যে সে কিছুক্ষণের জন্য শূন্যে ভেসে রইল। সেই ফাঁকে লোকটা তার মরণ থাবা বসাল এরেন্দিরার কচি শরীরে।...
'ওই ঘটনার পর গ্রামে একজন পুরুষও বাকি রইল না যে কি না টাকার বিনিময়ে এরেন্দিরার শরীর ভোগ করেনি। দাদিমার টাকার খাই তত দিনে বহুগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে।
'দাদিমা একদিন একটা ট্রাক ভাড়া করে মালপত্রসহ এরেন্দিরাকে নিয়ে ট্রাকে উঠে বসল। গন্তব্য চোরাকারবারিদের আস্তানা। দাদিমার ধারণা, ওখানে বিস্তর টাকাপয়সা মিলবে। ট্রাকটা তাদের একটা ছোট শহরে নিয়ে পৌঁছে দিল। ওখান দিয়ে যাচ্ছিল ওই এলাকার এক ডাকহরকরা। দাদিমা খুব অল্প পয়সায় তাকে এরেন্দিরার দেহ ভোগ করতে দিল। সে লোকটা অচিরেই এরেন্দিরার সৌন্দর্য আর রতি বৈভবের খবর সর্বত্র চাউর করে দিল। দলে দলে খদ্দেররা এসে এরেন্দিরার তাঁবুর পাশে ভিড় জমাতে লাগল।
'ওখানে টাকাপয়সা কামানো শেষ হলে দাদিমা এরেন্দিরাকে নিয়ে গেল একটা মরুশহরে। ওখানেও তাঁবু পড়ল। ওখানে ছিল সৈন্যদের আনাগোনা। শত শত সৈনিক লাইনে দাঁড়িয়ে থেকে তাঁবুতে ঢুকে এরেন্দিরার শরীর ভোগ করল। শেষে একজন সৈনিক ভেতরে গেলে এরেন্দিরা তাকে বলল, দোহাই তোমার, আমার দাদিমাকে গিয়ে বল, আমি মরে যাচ্ছি। ঠিক তুমি যেমন আমার মাধ্যমে রোমেলের কাছে বার্তা পাঠিয়েছিলে। দাদিমা ভেতরে গিয়ে এরেন্দিরাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলল, আর মাত্র দশজন বাকি। এরেন্দিরা কেঁদেকেটে হয়রান হলে দাদিমা সেদিনের মতো ক্ষান্ত দিয়েছিল।
'পরের দিন এরেন্দিরাদের তাঁবুতে এসে হাজির হলো সহজ-সরল এক যুবক। তার নাম উলিসেস। সেদিনও এরেন্দিরা ক্লান্ত ছিল। বলেছিল, আর তো পারব না। আমি যে মরে যাচ্ছি। উলিসেস বলল, কাল সকালে উঠেই চলে যাব। আর আসা হবে না। এরেন্দিরার মায়া হলো। বলল, টাকা এনেছ? দাও, আমার হাতে আর পাশে এসে শুয়ে পড়। উলিসেস শুয়ে পড়ল ঠিকই, কিন্তু কাঁপতে লাগল। এরেন্দিরা উলিসেসের ব্যাপারটা বুঝতে পারল। বলল, জোরে জোরে শ্বাস নাও, প্রথমবার তো সবারই এমন হয়। উলিসেস এরেন্দিরাকে আদর করতে লাগল। ওই আদর চলল ভোর অবধি। কেননা উলিসেস এরেন্দিরাকে আর এরেন্দিরা উলিসেসকে ভালোবেসে ফেলেছিল।'
গল্পের ওই পর্যায়ে এসে মোমতাজ তার শরীর থেকে ব্রা আর ব্লাউজ খুলে ফেলে আমাকে বলল, 'এ্যাই, এস না।' আমার অবস্থা তখন উলিসেসের চেয়ে শোচনীয়। আমি রীতিমতো কাঁপতে লাগলাম। মোমতাজ আমাকে জড়িয়ে ধরে চুমু খেল। তখন বিদ্যুৎ প্রবাহিত হচ্ছিল আমার শরীরের ভেতর দিয়ে। মোমতাজের শরীরের ওপরে উঠে এলাম আমি, আমার হাত ছুটে গেল ওর স্তনের সন্ধানে। জেগে ওঠা যৌবন পথ খুঁজে পেতে চাইল। মোমতাজের কণ্ঠস্বর আবেশে জড়িয়ে গেল। এখানে নয়, এখানে, হ্যাঁ, ঠিক এইখানে...। অজানা আনন্দে ভরে উঠল সারা শরীর। বুঝলাম, এটাই হচ্ছে প্রেমের খেলা। সেই খেলা চলল সকাল অবধি, কারণ মোমতাজ আমাকে আর আমি মোমতাজকে ভালোবেসে ফেলেছিলাম।
'বুঝলে মোমতাজ, পরের দিন উলিসেস আবার গিয়েছিল এরেন্দিরার তাঁবুতে। আবার দেহমিলনের আনন্দে বিভোর হয়েছিল তারা। হঠাৎ এরেন্দিরা ফিসফিস করে ওর কানে কানে বলেছিল- ওকে খুন করতে সাহস হবে তোমার? কণ্ঠস্বরে একটুও জড়তা বা কাঁপন ছিল না। কী উত্তর দেবে উলিসেস? ভেবে পায়নি। বলেছিল, কে জানে? তোমার সাহস হয় এরেন্দিরা? আমি পারিনি উলিসেস, উনি যে আমার দাদিমা! উলিসেস অনেকক্ষণ ভাবল, তারপর স্থির সিদ্ধান্তে পৌঁছার মতো করে বলল, তোমার জন্য সব কিছু করতে পারি এরেন্দিরা।
'তারপর কী হয়েছিল জান? জামরুলের মোরব্বা আর ক্ষীরের সঙ্গেই ইঁদুর মারার ওষুধ মিশিয়ে উলিসেস খেতে দিয়েছিল দাদিমাকে। কিন্তু দাদিমার জান এত শক্ত যে চেটেপুটে ক্ষীর আর মোরব্বা খেয়ে দিব্যি বেঁচে ছিল সে। এরেন্দিরা তখন মন্তব্য করেছিল, একটা হাতির চেয়েও কড়া ওর জান। বিস্ময়ের সীমা ছিল না উলিসেসের। সে ফিরে গিয়েছিল নিজের বাড়িতে।
'দুই সপ্তাহ পরে আবার ফিরে এসেছিল। দাদিমা বিভোর হয়ে পিয়ানো বাজাচ্ছিল। তার মাথায় পালকের পরচুলা। একটা স্বপ্ন দেখছিল- সাদা দোল খাটিয়ায় একটা ময়ূর। এ তো মৃত্যুর পূর্বাভাস! তখনই ধারালো একটা ছুরি হাতে আবির্ভূত হলো উলিসেস। সোজা ঢুকে গেল দাদিমার ঘরে। তাকে দেখে চিৎকার করে উঠেছিল দাদিমা- কুত্তির বাচ্চা। বড় দেরিতে বুঝতে পেরেছি, তোর মুখটা আসলে বেইমান দেবদূতের মতো। ততক্ষণে উলিসেস তীক্ণ্ণ ছুরিটা দাদিমার বুকের ঠিক মাঝখানে বসিয়ে দিয়েছিল। একবার, দুবার, তিনবার। রক্তের ধারা ছুটে এসে উলিসেসের চোখ-মুখ ভিজিয়ে দিয়েছিল। দরজার আড়াল থেকে ভাবলেশহীন মুখে এসব দেখেছিল এরেন্দিরা।
'উলিসেস শেষবার ছুরিটা দাদিমার বুকে বসিয়ে দিতেই তার দেহ থেক উধাও হয়েছিল প্রাণপাখি। নিথর সেই বিশাল শরীরের পাশে বসে প্রবল ক্লান্তিতে ভেসে গিয়েছিল উলিসেস। এরেন্দিরাকে ডাকল উলিসেস। দেখতে পেল সে দৌড়ে বেরিয়ে যাচ্ছে ঘর থেকে। আবার ডাকল সে। ততক্ষণে এরেন্দিরা সমুদ্রের তীর ধরে দ্রুতবেগে ছুটতে আরম্ভ করেছে...।'
শেষবারের মতো চরম পুলকের শীর্ষে আরোহণ করেছিলাম। সেই আনন্দ হয়তো মোমতাজকেও ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল। বললাম, 'তোমার এই দুর্ভাগ্যের জন্য কে দায়ী? আমিও তাকে খুন করব- উলিসেসের মতো।'
আমার কথা শুনে মোমতাজ হাসল। কিছুই বলল না। আমি জোরাজুরি করতে লাগলাম, 'বল মোমতাজ, কে সেই পাষণ্ড যার কারণে তুমি আজ এখানে। বল, চুপ করে থেক না।' এবার অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল মোমতাজ। অবিশ্বাস্য এক উদ্ভট হাসি। কোনো মেয়েকে কখনো এভাবে হাসতে দেখিনি। খুব অস্বস্তি হচ্ছিল। একটা দীর্ঘ হাই তুলে পাশ ফিরে শুলো মোমতাজ।
আবার চিৎকার করে উঠলাম, 'বল, কে দায়ী তোমার এ অবস্থার জন্য? তাকে নির্ঘাত খুন করব আমি।' বিছানার ওপর চিত হয়ে শুলো সে। মুখে মৃদু হাসি। বলল, 'তুমি তাকে কোনো দিনই মারতে পারবে না, সাকি। কেননা সে ভীষণ পরাক্রমশালী, অসীম তার শক্তি। সে শক্তির সামনে দাঁড়ানো সহজ কথা নয়, তুমি পারবে না, কিছুতেই না।'...
এ কথা শুনে আমার মাথায় আগুন ধরে গেল। 'তুমি তার নাম বল আমাকে। অবশ্যই মারতে পারব তাকে। উলিসেসের মতো হাড়জিরজিরে দুর্বল এক যুবক যদি পরাক্রমশালী ওই নারীকে হত্যা করতে পারে, আমি কেন পারব না?'
উঠে বসল মোমতাজ। বুকের ভেতর আমাকে জড়িয়ে ধরে আমার কাঁধে মাথা রাখল। তারপর ফিসফিস করে বলল, 'সেই নিষ্ঠুর শক্তি কোনো মানুষ নয়- সে হচ্ছে এই সমাজ আর সমাজের ব্যবস্থা। একে হত্যা করা সহজ কাজ নয়।'
ইলেকট্রিক শক লাগা মানুষের মতো নিজেকে মোমতাজের বাহুবন্ধন থেকে বিযুক্ত করলাম। ওকে নিজের সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়ে ওর মুখের ছবি দেখতে লাগলাম, ওই ছবি পাঠ করার চেষ্টা করলাম আমি; কিন্তু পারলাম না। কাজটা বোধ হয় সহজ না।
ভোর হয়ে গিয়েছিল; কিন্তু তখনো আলো ফোটেনি ভালো করে। নীল বাড়ির গাছগাছালিতে আসা পাখিরা প্রচণ্ড জোরে চিৎকার-চেঁচামেচি জুড়ে দিয়েছিল।
লেখক পরিচিতি
দিলওয়ার হাসান
জন্মসাল – ১৯৫৭
জন্মস্থান – মানিকগঞ্জ
বর্তমান আবাসস্থল – ঢাকা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে অনার্স সহ এম,এ। স্কুল জীবন থেকে লেখালিখি ও সাংবাদিকতা শুরু। ১৯৮১ সালে দৈনিক সংবাদের সহ সম্পাদক হিসেবে কর্মজীবনের শুরু।
পেশা - বেসরকারি চাকরি ও লেখালেখি।
গল্প, প্রবন্ধ, ভ্রমণ কাহিনি, অনুবাদ।
প্রথম আলো, আলোকিত বাংলাদেশ, কালি ও কলম, উত্তরাধিকার, শব্দঘর ও অনলাইন পত্রিকা নিয়মিত লেখেন।
প্রকাশিত গ্রন্থ – অন্য দেশের গল্প, (অনুবাদ গল্প সংকলন), টু উইমেন, (অনুবাদ উপন্যাস), আদম এবং ইভের গল্প(ছোট গল্প), সর্ট স্টোরিজ, আইজ্যাক সিঙ্গার (অনুবাদ গল্প সংকলন), ওস্তাদ নাজাকাত আলি কর্নেলকে একটা চিঠি লিখেছিলেন (ছোট গল্প), হারুকি মুরাকামির শ্রেষ্ঠ গল্প (অনুবাদ গল্প)
দিলওয়ার হাসান
জন্মসাল – ১৯৫৭
জন্মস্থান – মানিকগঞ্জ
বর্তমান আবাসস্থল – ঢাকা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে অনার্স সহ এম,এ। স্কুল জীবন থেকে লেখালিখি ও সাংবাদিকতা শুরু। ১৯৮১ সালে দৈনিক সংবাদের সহ সম্পাদক হিসেবে কর্মজীবনের শুরু।
পেশা - বেসরকারি চাকরি ও লেখালেখি।
গল্প, প্রবন্ধ, ভ্রমণ কাহিনি, অনুবাদ।
প্রথম আলো, আলোকিত বাংলাদেশ, কালি ও কলম, উত্তরাধিকার, শব্দঘর ও অনলাইন পত্রিকা নিয়মিত লেখেন।
প্রকাশিত গ্রন্থ – অন্য দেশের গল্প, (অনুবাদ গল্প সংকলন), টু উইমেন, (অনুবাদ উপন্যাস), আদম এবং ইভের গল্প(ছোট গল্প), সর্ট স্টোরিজ, আইজ্যাক সিঙ্গার (অনুবাদ গল্প সংকলন), ওস্তাদ নাজাকাত আলি কর্নেলকে একটা চিঠি লিখেছিলেন (ছোট গল্প), হারুকি মুরাকামির শ্রেষ্ঠ গল্প (অনুবাদ গল্প)
0 মন্তব্যসমূহ