গত কয়েক বছর যাবৎ দেশের একটি জনপ্রিয়
সংবাদপত্র প্রিয়কথায় প্রতি শুক্রবার প্রকাশিত হয় জীবিকা সন্ধানী’র কলাম বাস্তবতা। সকল বয়সের মানুষদের নিত্যদিনের ছোট বড় সব আকারের মৌলিক
বিষয় নিয়ে তিনি লেখেন এই কলামে। তাঁর লেখা পড়ার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে সমাজের
বিভিন্ন স্তরের সকল বয়সের নারী-পুরুষ নির্বিশেষে। প্রতি সপ্তাহে প্রকাশিত তাঁর
লেখা নিয়ে যেমন ব্যস্ত হয়ে পড়ে পত্রিকার আলোচক-সমালোচক মহল, ঠিক তেমনি আলোচনার ঝড়
বয়ে যায় অফিসের সহকর্মীদের মধ্যে, যুবক-যুবতীদের আড্ডায়, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর ছাত্র-শিক্ষক
বৈঠকে, এমন কি কিশোর- কিশোরীদের গল্পের মাঝেও। অনেকেই বলে প্রিয়কথা’র
ভাগ্য খুলে দিয়েছে কলামিষ্ট জীবিকা সন্ধানী।
বাস্তবতা কলাম যখন জনপ্রিয়তায় তুঙ্গে,
ঠিক তখন ভক্তদের চাপের মুখে প্রিয়কথা’র সম্পাদক সহ সকল আলোচক-সমালোচকরা মরিয়া হয়ে
খুঁজে বেড়াচ্ছে কলামিষ্টকে। টেলিভিশনের বিভিন্ন টক
শো’তে তাঁর লেখা নিয়ে আলোচনা এবং তাঁর আত্মগোপন নিয়ে সমালোচনাও হচ্ছে বেশ। ভক্তদের দাবী
মেটানোর চেষ্টায় কয়েকবার সংবাদপত্রের পক্ষ
থেকে তাঁকে খুঁজে বেড় করার পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে, কিন্তু প্রতিবারই লেখক জনসম্মুখে আসতে
অনিচ্ছা প্রকাশ করেছেন এবং ব্যর্থ হয়েছে পরিচালকমণ্ডলী। দেশের অন্যতম একটি সংগঠন দিশারী
আয়োজিত দেশের প্রসিদ্ধ শিল্পী এবং লেখকদের পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানের জন্য এ বছর শ্রেষ্ঠ
লেখক হিসেবে তাঁর নাম নির্বাচিত হয়। পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়ে দিশারী’র পক্ষ থেকে শুভ
সংবাদটি জানানো হয় দেশবাসীকে এবং তাঁকে নিমন্ত্রণ করা হয়। সংবাদটি জেনে লেখক
জীবিকা সন্ধানী তাঁর পরবর্তী লেখায় দিশারী’র প্রতি কৃতঙ্ঘতা প্রকাশ করেন এবং প্রিয়কথা’র
সম্পাদকে সংবাদপত্রের টিম লিডার হিসেবে মূল্যবান সম্মানী গ্রহণ করার জন্য অনুরোধ
করেন। সম্পাদক মীর আব্বাস জীবিকা সন্ধানীর অনুরোধ রক্ষা করলেও
তাঁর অর্জিত পুরস্কার ১৫ লক্ষ্য টাকার চেক নিয়ে বিপাকে পড়ে। ই-মেইলে তাঁর সাথে যোগাযোগ
করলে, তিনি টাকাগুলো পাঁচটি গৃহহারা পরিবারের পুনর্বাসনের কাজে ব্যবহার করতে পরামর্শ
করেন। মীর আব্বাস অফিসের সবার মতামত নিয়ে একাউন্ট খুলে তিনি তাঁর
অফিসের বিশ্বস্ত কর্মী জয়নালকে নিয়ে কমলাপুর রেল স্টেশনের বস্তি থেকে পাঁচটি
পরিবারকে ঢাকার বাইরে তাদের গ্রামে থাকার ঘর তৈরী করে দেয় এবং প্রতিটি পরিবারকে
একটি করে রিক্সা এবং কিছু হাঁস, মুরগী কিনে দেয়। মীর আব্বাস এমন মহৎ কাজ করার সুযোগ পাওয়ায় খুব খুশি হয়,
তাঁর মনে লোভ হয় জীবিকা সন্ধানীর মতো একজন ভালো মানুষের সান্নিধ্য পাওয়ার। তাই এতদিনে
তিনি প্রথম একজনকে নিয়োগ করে লেখকের ইনকামিং ই-মেইল থেকে আই পি অ্যাড্রেস দিয়ে
লেখককে খুঁজে বেড় করতে। তিনি খুব আশ্চর্য হয় এই জেনে যে, যে কম্পিউটার থেকে লেখকের
ই-মেইলের আসছে; তা প্রিয়কথা’র নামেই রেজিষ্ট্রেশন করা কিন্তু অফিসে নেই। সকল
প্রকার খোঁজাখুঁজির পরেও না পাওয়ায় ধারণা করা হয় যে, কোম্পানি ব্যবহৃত পুরানো যে
সকল কম্পিউটার বিভিন্ন সময়ে বিক্রি করা হয়েছিল সেটা হয়তো তাদেরই একটি। যেহেতু লেখক
জনসন্মুখে আসতে অনিচ্ছুক, তাই সবকিছু ভেবে অফিসের পক্ষ থেকে তাঁকে বিরক্ত না করার
সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। জীবিকা সন্ধানী নিয়মিত
লিখে যাচ্ছেন তাঁর কলাম বস্তবতা; পাশাপাশি গল্প এবং কবিতা। সমান্তরালভাবে নিয়মের মধ্যেই তাঁর লেখা নিয়ে চলচ্ছে আলোচনা-সমালোচনা।
প্রায় চার বছর পর হঠাৎ করে চার সপ্তাহ জীবিকা
সন্ধানীর লেখা আসে না। সম্পাদক সহ পুরো অফিস চিন্তায় পরে যায়। ই-মেইল পাঠায়, কোন
উত্তর আসেনা। যেহেতু যোগাযোগের আর কোন উপায় নেই তাই অফিস থেকে আর কিছু করারও নেই।
কিন্তু প্রতিদিনই পাঠকদের ফোন আসে পত্রিকা অফিসে। ভক্তরা জানতে চায় প্রিয় লেখকের লেখা বন্ধ হওয়ার কারণ। কেউ কেউ
পত্রিকা অফিসে এসে জানতে চায় জীবিকা সন্ধানীর কুশলাদী। সকাল গড়িয়ে দুপুর ছুঁই
ছুঁই, অফিসের অনেকেই লাঞ্চ ব্রেকে, সহ সম্পাদক কাসেমও লাঞ্চে বেড় হবে বলে রুম থেকে
বেড় হয়। রিসিপশনের দিকে এগুতেই চোখে পড়ে ৪০ -৪৫ বছরের মধ্যবিত্ত পরিবারের একজন
মহিলা। সাজসজ্জা নেই একদম, খুব সাধারণ। রিসিপশনিস্ট ডেস্কে কেউ নেই। তাই কাসেম নিজেই সামনের দিকে এগুতে এগুতে ভদ্র মহিলাকে
উদ্দেশ্য করে, “কা’কে খুঁজচ্ছেন?” মহিলা শান্ত কন্ঠে শুধু, “আমি জীবিকা সন্ধানী...
” উচ্চারণ করতেই কাসেম ভদ্রমহিলার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে চিৎকার করে এক দমে বলে যায়,
“আপনি জীবিকা সন্ধানী! আপনাকেইতো আমরা খুঁজছি।” ভদ্রমহিলা আবার শান্ত কন্ঠে বলে,
“না আমি জীবিকা সন্ধানী না, তবে...” কাসেম এবার উচ্চস্বরে বলে উঠে, “আপনারা কেন
খামোখা বিরক্ত করছেন আমাদের? দেশের সবাই জানে যে তিনি নিজেকে গোপন রেখে বছরের পর
বছর লিখে যাচ্ছেন। আমরাও তাঁকে খুঁজছি, তাঁর কোন প্রকার সন্ধান পেলে আমরা নিশচয়ই সবার
সাথে এমন সুখবরটা শেয়ার করবো।” ভদ্র মহিলা এতক্ষণে আবার কথা বলার সুযোগ পায়, “আমি
জানি আপনারা জীবিকা সন্ধানীকে খুঁজছেন, আমি তাঁর সন্ধান নিয়ে এসেছি।” কাসেম
বাক্যহারা হয়ে যায় কিছুক্ষণের জন্য। খুশিতে একটা লম্বা নিঃশ্বাস নিয়ে ভদ্র মহিলাকে
নিজের রুমে নিয়ে যায়। তাঁকে বসার জন্য অনুরোধ করে এবং অফিসের পিয়ন সেলিমকে ডেকে
আব্বাস অফিসে আছে কিনা জানতে চায়। আব্বাস অফিসেই তাঁর নিজের রুমে কাজ করছিলো।
সেলিমের কাছে খবর পেয়ে আব্বাস নিজেই কাসেম এর রুমে আসে।
আব্বাসঃ কি খবর কাসেম ভাই? জরুরী তলব; সব
ঠিকতো?
কাসেমঃ হ্যাঁ, সব ঠিক আছে। পরিচয় করে দেই, ইনি হচ্ছেন সেতারা বেগম, জীবিকা
সিন্ধানীর খোঁজ নিয়ে এসেছেন।
আব্বাস একটি চেয়ার টেনে বসতে বসতে, পিয়নকে
ঢেকে কিছু নাস্তা দেয়ার জন্য বলে।
আব্বাসঃ জীবিকা সন্ধানীকে আপনি কিভাবে চেনেন?
আপনার কি হন তিনি?
সেতারাঃ আমার স্বামী।
কাসেমঃ আপনার স্বামী! তবে আপনি একা কেন? তিনি এখন কোথায়?
সেতারাঃ সে হাসপাতালে।
আব্বাসঃ কি হয়েছে তাঁর?
সেতারাঃ ক্যান্সার, লাং ক্যান্সার।
আব্বাসঃ কোন হাসপাতালে?
সেতারাঃ ঢাকা পিজি হাসপাতালে।
কাসেমঃ আমরা কিভাবে বুঝবো যে যিনি হাসপাতালে
ক্যন্সারের সাথে যুদ্ধ করছেন, তিনি আপনার স্বামী এবং তিনিই লেখক জীবিকা সন্ধানী?
সেতারাঃ আপনারা তাঁকে বিভিন্ন পদ্ধতিতে খুঁজছেন;
কিন্তু তিনি সর্বদাই নিজেকে আড়াল করে রেখেছেন। ডাক্তার বলেছে তাঁর
অবস্থা ভালো হওয়ার মতো নেই। তিনি হয়তো কয়েকদিনের মধ্যেই চির বিদায় নিয়ে চলে যাবেন। আমি মনে করলাম, তাঁকে
এক নজর দেখার অধিকার আপনাদের আছে। সে কারণেই আমার এভাবে আজ এখানে আসা। আমাকে বিশ্বাস করা অথবা না
করার ব্যাপার পুরোটাই আপনাদের। আমাকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব হাসপাতালে ফিরে যেতে হবে।
আব্বাসঃ কাসেম ভাই একবার হাসপাতালে গিয়ে দেখা
দরকার।
কাসেমঃ আমারও তাই মনে হয়। চলেন, দেখে আসি।
আব্বাসঃ আপনি আর কোন মিডিয়াকে জানাননি তো?
সেতারাঃ আমি তো আর কাউকে চিনি না। আমার কাছে
শুধু এখানকার ঠিকানা আছে।
আব্বাসঃ আপনি চলুন আমাদের সাথেই, হাসপাতালে
গিয়ে আপনার স্বামীর সাথে দেখা করে আসি।
এরই মধ্যে সেলিম সিঙারা এবং চা নিয়ে রুমে
প্রবেশ করে। সেতারা বেগমকে খেতে অনুরোধ করে আব্বাস। কাসেম সেলিমকে বলে ড্রাইভারকে গাড়ি বেড় করার জন্য। তাড়াহুড়ো করে চা খেয়েই সবাই গাড়ির দিকে রওয়ানা হয়। গাড়িতে উঠার আগেই দেখা হয়
মেশিন অপারেটর তানভীর এর সাথে। সেতারাকে দেখেই প্রশ্ন করে সে, চাচী আপনে এখানে?
চাচা কেমন আছে এখন? সেতারা উত্তর দেয়, “খুব একটা ভালো নাই। তুমি একবার তোমার চাচার
সাথে দেখা কইরো। তোমার কথা সে প্রায়ই বলে।” আব্বাস এদের কথা শেষ হতেই তানভীরকে
প্রশ্ন করে, তুমি কি একে চেনো? তানভীর
উত্তর দেয়, চিনবো না কেন? সে তো আমাদের জয়নাল চাচার স্ত্রী।
আব্বাসঃ জয়নাল চাচা মানে?
তানভীরঃ সিনিয়র মেশিন অপারেটর জয়নাল সরদার।
আব্বাসঃ আমাদের জয়নাল সরদার? ক্যান্সার ধরা
পড়েছে, এখন হাসপাতালে। ও মাই গড, এ আমি কি শুনছি? আমি তো সবকিছু গুলিয়ে পাকাচ্ছি।
আমি নিজেইতো জয়নাল সরদারকে আমাদের পুরানো কম্পিউটার দিয়েছিলাম।
কাসেমঃ আমার কোন ভাষা নেই।
আব্বাসঃ চলো হাসপাতালে যাই আগে। তানভীর,
ভিতরে গিয়ে রিসিপশনে বলো, এখানকার টেলিভিশনের চ্যানেলগুলোতে খবর দিতে যেন তারা ক্যামেরা
নিয়ে পিজি হাসপাতালে আসে। জীবিকা সন্ধানী’র খোঁজ পাওয়া গেছে।
গাড়ী হাসপাতালের সামনে থামতেই চোখে পড়ে চার-
পাঁচটি টিভি নিউজ ক্যামেরা। গাড়ি থেকে মীর আব্বাস বেড় হতেই সবার একই প্রশ্ন কোথায়
জীবিকা সন্ধানী? হাসপাতালে কেন? কি করে নিশ্চিত হলেন যে জীবিকা সন্ধানী হাসপাতালে?
এমন অনেক প্রশ্নকে উপেক্ষা করে মীর আব্বাস শুধু সাংবাদিকদেরকে তাকে অনুসরণ করার
জন্য অনুরোধ করে। হাসপাতালের জেনারেল ওয়ার্ডে একটি বিছানায় শুয়ে আছেন প্রিয়কথা
সংবাদপত্রের সিনিয়র মেশিন অপারেটর জয়নাল সরদার, যিনি লেখক পরিচয় গোপন রেখেছেন
বছরের পর বছর। আজ তাঁর সেই পরিচয় জনগন দেখবে টিভি পর্দায়। এমন দিনের
জন্য তিনি কখনোই অপেক্ষা করেননি। তবুও ঘটতে যাচ্ছে কিছুক্ষণের মধ্যেই। কিন্তু বাধা
হয়ে দাঁড়ায় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের নিষেধ সম্মানের সাথে গ্রহণ
করে আব্বাস এবং অন্যান্য রোগিদের কোন প্রকার বিরক্ত ব্যতীত জীবিকা সন্ধানীর
ইন্টারভিউ নেয়ার অঙ্গীকার করে সে। আব্বাস প্রথমে সেতারা
বেগমকে অনুরোধ করে তাঁর স্বামীর কাছে যাবার জন্য। সেতারা তার স্বামীর শরীর স্পর্শ
করতেই চোখ বন্ধ অবস্থায়ই অস্পষ্ট শব্দে স্ত্রীকে প্রশ্ন করে, “তুমি আমাকে একা রেখে
কোথায় গেলে? একা থাকতে আমার ভয় হয়- বলতে বলতে চোখ খুলতেই বিছানার চারিদিকে দেখে
টিভি ক্যামেরা, একটু দূরে পত্রিকার সম্পাদক মীর আব্বাস, সহ সম্পাদক কাসেম চৌধুরী। কথাগুলো
জড়িয়ে পাকিয়ে স্ত্রীকে প্রশ্ন করে, কেন তুমি এমন করলে? আব্বাস সামনের দিকে এগিয়ে
আসতেই বাক্যহীন হাত জোড় করে ক্ষমা চাইলো জীবিকা সন্ধানী। আব্বাস নিজের হাতে জয়নাল
সরদারের হাত দু’টো চেপে ধরে বিনিতভাবে অনুরোধ করে, “জনপ্রিয় লেখক জীবিকা সন্ধানীর ছবি
তোলার পারমিশন চাচ্ছি। এতগুলো টিভি চ্যালেন একত্রে এখানে ছুটে এসেছে, আশা করি আপনি
তাদেরকে নিরাস করবেন না। আমরা হাসপাতালে আপনাকে বিরক্ত করার জন্য ক্ষমা চাচ্ছি।” কাসেম এই
মুহূর্তে সকল সাংবাদিকদের অনুরোধ করে লেখককে প্রশ্ন করে বিরক্ত না করার জন্য।
জীবিকা সন্ধানী স্ত্রী সেতারার সাহায্য নিয়ে উঠে
বসার চেষ্টা করেন, কিন্তু পারে না। চেষ্টা করেন কিছু বলার, কিন্তু শারীরিক দুর্বলতা এবং আবেগ
দু’টো মিলে একটা কথাও তিনি বলতে পারলেন না। শুধু স্ত্রীকে কাছে নিয়ে আবারও এলোমেলো
শব্দে বলার জন্য অনুরোধ করে, “সবাইকে বলো আমার শেষ লেখাটা তৈরী আছে। সময় মতো পেয়ে যাবে সবাই।” আর কিছু বলার আগেই সেতারা
অনুভব করে তার স্বামীর চোখ বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। নার্স, ডাক্তার! বলে চিৎকার করে উঠে
সে। আব্বাস সবাইকে চলে যাবার জন্য অনুরোধ করে। কাসেম সবাইকে নিয়ে হাসপাতালের বাইরে যায়। নার্স ছুটে এসে
অক্সিজেন দেয়, ডাক্তার ডাকে। ডাক্তার এবং নার্স কিছুক্ষণ চেষ্টা করে এদিক সেদিক,
কিন্তু কোন প্রকার সাড়া দেয় না জীবিকা সন্ধানী। ডাক্তার তাঁকে একটা ইঞ্জেকশন দিয়ে,
রোগীকে কোন প্রকার বিরক্ত না করার জন্য নির্দেশ করে। আব্বাস ডাক্তারের
সাথে সাথে রুম থেকে বেড় হয়ে তাঁর চিকিৎসার পরবর্তী প্রয়োজনীয় পদক্ষেপগুলো জানতে চাইলে, ডাক্তার কোন প্রকার আশা দেয়
না। বরং উল্টো তাঁদের দোষারোপ করে তাঁর এমন শারীরিক অবস্থায় তাঁর অনাঙ্খিত কাজটি
করার জন্য, যা কিনা তাঁর মানসিক চাপের কারণ হয়েছে এবং পরবর্তীতে এমন কাজ আর না
করার জন্য অনুরোধ করে। হাসপাতালের বারান্দায় আব্বাস সেতারার সাথে দেখা করে, জীবিকা
সন্ধানীর চিকিৎসার দায়িত্ব নেয়ার ইচ্ছার কথা জানায়, কিন্তু সেতারা জানায় “জয়নালের
ইচ্ছার বিরুদ্ধে আমি একটি কাজ করেছি; আপনাদেরকে তাঁর কাছে নিয়ে এসেছি। আর নয়।
আমাকে ক্ষমা করবেন। আপনারা দোয়া করবেন তাঁর জন্য, যতদিন বেঁচে আছে যেন ওঁর কষ্ট কম
হয়।” জয়নাল একা, আমি বরং তাঁর কাছে যাই বলে সেতারা রুমের মধ্যে যায়। মন খারাপ করে কিছুটা
পথ ফিরে যেতেই চিৎকার শুনে পিছনে তাঁকায় আব্বাস। কেউ নেই! আবার ফিরে আসে
সে। রুমে ঢুকে দেখতে পায় নার্স সব কিছু খুলে ফেলেছে। ডাক্তার চাদর দিয়ে ঢেকে
দিচ্ছে জীবিকা সন্ধানীর শরীর। আব্বাস চোখ বন্ধ করে রুম থেকে বেড় হয়ে যায়, ফোন করে
কাসেমকে। চোখ থেকে কয়েক ফোঁটা পানি পড়ে, কিন্তু মনের মধ্যে দাউ দাউ করে জ্বলে
ব্যর্থতার আগুণ।
প্রায় এক মাস পরে আব্বাস অফিসের ই-মেইল চেক
করতেই চমকে উঠে, থমকে যায় কিছুক্ষণের জন্য। তারপর অতি আগ্রহ নিয়ে মৃত্য ব্যক্তির
ই-মেইল খুলে। ছোট একটা চিঠিঃ
প্রিয় আব্বাস ভাই,
চার মাস আগে ডাক্তার বলেছিলো, আমার জীবনের জোনাকীটা
খুব বেশী হলে আর মাত্র ২ থেকে আড়াই মাস জ্বলবে। ঐ হিসেব করেই আমি
অটো সেন্ডিং সেটিংএ বাস্তবতা কলামের শেষ
লেখাটা এটাচ করলাম। এখানে আছে সবার জন্য আমার
শেষ লেখা, একটি খোলা চিঠি।
প্রিয় পাঠকবৃন্দ,
এই লেখাটা যখন আপনাদের হাতে পৌঁছাবে তখন হয়তো
আমি আকাশের একটি নক্ষত্র মাত্র। এ লেখাতে আছে আমার আসল পরিচয় এবং আমার সম্পর্কে আপনাদের
সকল প্রশ্নের উত্তর। আপনাদের কাছে আমি আমার ছদ্মনাম জীবিকা সন্ধানী নামে পরিচিত;
কিন্তু আমার পুরো নাম জয়নাল সরদার। অল্প বয়সে অন্যায়ের
বিরুদ্ধে রুঁখে দাঁড়াতে গিয়ে একদিন হয়েছিলাম গৃহহারা, গ্রামহারা এক যুবক। কমলাপুর রেল স্টেশনে অতিবাহিত করেছি অনেকগুলো রাত। গ্রামের
চাচা, সাংবাদিক মেহের চৌধুরী আমাকে এভাবে দেখে একদিন তুলে নিয়ে এসেছিলেন তাঁর
বাড়িতে। আমার জীবনের গল্প শুনে আমার
পড়াশোনার দায়িত্ব নেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন সেদিন তিনি। নিজের
সন্তানের মতোই তিনি ভালোবাসতেন আমাকে। আমার লেখা ছোট গল্প পড়ে তিনি গল্পগুলো ছদ্মনামে সংবাদ
পত্রে দেয়ার জন্য উপদেশ দেন। ছদ্মনাম ব্যবহারের উপকারিতা জানতে চাইলে তিনি খুব অল্প
কথায় ব্যখ্যা করেন যে, “ছদ্মনামের লেখায় লেখককে কেউ ব্যক্তিগতভাবে জানেনা বলে পাঠকদের
সঠিক এবং সত্যিকার প্রতিক্রিয়া জানা যায়।” তাঁর জীবনকালেই প্রকাশিত হয়েছিলো আমার
দু’টো গল্পের বই, জনপ্রিয়তা পেয়েছিলো বই দু’টো, কিন্তু তিনি কখনোই আমাকে অন্যদের
কাছে লেখক হিসেব পরিচয় করিয়ে দিতেন না। আমি তাঁর বাসায়
থেকেই মাষ্টার্স পাশ করি। কিন্তু আমাকে তিনি তাঁর নিজের পেশা সাংবাদিকতা করার
জন্য অনুপ্রাণিত করতেন না; তবে, সমাজের ন্যায় অন্যায় নিয়ে লেখার জন্য উৎসাহ দিতেন।
আমাকে মাথা উঁচু করে বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখাতেন। তবুও মাঝে
মাঝে আমার খুব মন খারাপ হতো, মনে হতো আমি চাচার কেউ নয় বলে চাচা এমন করছে। এসব
কারণে বাড়িতে পার্টি হলে আমি নানান বাহানায় বাড়ির বাইরে অথবা নিজের রুমে থাকতাম। একদিন
বাড়িতে পার্টি চলছিলো; শহরের অনেক নামী-দামী জনপ্রিয় ব্যক্তিদের উপস্থিতি ছিলো
বাড়িতে। আমি একা বাড়ির সামনের একটি গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে ধূমপান করছিলাম। হঠাৎ টের
পাচ্ছিলাম তিন-চাঁর জন বারান্দায় বসে কিছু জরুরী বিষয় আলাপ করছে। তাদের কথায়
দলাদলির একটা গন্ধ পেলাম; তাই ভয়ে আমি লুকিয়ে গেলাম, চুপ করে তাদের কথা শুনছিলাম
আর অন্ধকার রাতে আড়াল থেকে মানুষের অন্ধকার মহলের ছবিগুলো পরিস্কারভাবে দেখতে
চেষ্টা করছিলাম। সে রাতে সবকিছু শুনলেও তারা কা’কে নিয়ে প্লান করছিলো বুঝতে পারছিলাম না। কথা শেষে সবাই
বাড়ির ভিতরে চলে গেলে, অস্থির আমি রাস্তা ধরে হাঁটতে বেরুলাম। কিছুক্ষণ পরে বাড়ি
ফিরে দেখি চাচা একা সোফায় শুয়ে আছে। আমাকে দেখা মাত্রই বকাবকি শুরু করলেন। আমার অপরাধ; আমি
বাড়িতে ছিলাম না। তাঁর বদ্ধুরা আমাকে খুঁজে পায়নি, ইত্যাদি। আমি কিছুক্ষণ চুপ থেকে
চাচাকে তাঁর বেড রুমে নিয়ে যাই। সে রাতে চাচাকে আমার কথাগুলো বলা হয়নি। পরের দিন
সকালে চা খেতে খেতে শুধু বললাম, তুমি সাবধানে থেকো, তুমি যে বন্ধুদের জন্য আমাকে
বকাবকি করলে, তারা আমাকে খোঁজেনি। জটিল প্লানের জন্য বাড়িটা কতটা নিরাপদ তা আন্দাজ
করছিলো। চাচার মধ্যে কোন পরিবর্তন দেখলামনা বরং উল্টো আমাকে উপদেশ দিলো যখন অনুমান
করতেই পেরেছিস, সাবধানে থাকিস তুইও। সেদিন বাড়ি থেকে বেড়িয়ে অফিসে যাবার পথেই গাড়ী
এক্সিডেন্টে মারা যান তিনি। শোক সংবাদটা আমার কানে আসার সাথে সাথে আমার মনে হলো এটা
এক্সিডেন্ট হতে পারে না। পূর্ব অভিঙ্গতায় তবে এও ভালো করে বুঝলাম, যেহেতু চাচার
সততাই তাঁর মৃত্যর একমাত্র কারণ, তাই এদের সাথে মাঠে থেকে লড়াই করতে পারবো না। বিলেত
ফেরত চাচীকে তাঁর বাড়ির সবকিছু বুঝিয়ে দিলাম। চাচী কিছুদিন পর আবার লন্ডন ফেরত গেলে
আমি কাপুরুষের মতো গা ঢাকা দেই। বেশ কিছুদিন পর প্রিয়কথা’র একজন মেশিন অপারেটর হিসেবে আমি
কাজ নেই। নিজেকে স্থীর করেই প্রথমে চাচার মৃত্যকে একটা খুন হিসেবে প্রমান করার জন্য শুরু
করলাম সবগুলো পত্রিকা এবং সাংবাদিকদের কাছে অনেক প্রমাণ সহ নামহীন চিঠি পাঠাতে। যখন এটা একবার প্রতিষ্ঠিত
হয়ে গেলো যে সাংবাদিক মেহের চৌধুরীকে খুন করা হয়েছিলো, তখন খুনিরা এর প্রতিবাদ করে
এবং তাদের নিজেদের বিভিন্ন কর্মকান্ডে এক পর্যায়ে তারা ধরা পরে যায় এবং পরবর্তীতে তা
প্রমানিত হয় এবং তাদের শাস্তি হয়। এজন্য আমার খুব বেশী কিছু করতে হয়নি। এরপর আমি
সিদ্ধান্ত নেই চিরদিনের জন্য আমি নিজেকে লুকিয়ে রেখে সমাজের ন্যায় অন্যায় নিয়ে আমি
লিখবো, তুলে ধরবো শাসক গোষ্টিদের অন্যায়, অবিচার এবং চেষ্টা করবো প্রয়োজনীয়
পদক্ষেপ নিয়ে নির্যাতিতদের পাশে দাঁড়াবার। সেটা হতে পারে গল্পের চরিত্রে, কবিতার বিদ্রোহী
ছন্দে কিংবা বাস্তবতা নামের কলামে। তখন থেকেই আমি কলাম লিখতে শুরু করি। পাঠকদের প্রতিক্রিয়ায় অনুপ্রাণিত
হয়ে শুরু করলাম বাস্তব ঘটনা
নিয়ে গল্প এবং প্রতিবাদী কবিতা লিখতে। নিজেকে লুকিয়ে রাখতে সহায়তা করায় কখনোই আমার
গল্পের বই বাংলাদেশ থেকে প্রকাশিত হয়নি। এটা আমার জীবনের একটি বড় কষ্ট, তবে এই
কষ্টকে এভাবে সান্তনা দেই যে, ভালো কিছুর জন্য একটু বিসর্জন, সর্বদা সুফল বয়ে আনে।
কলকাতার বিভিন্ন প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত বইগুলো থেকে অর্জিত অর্থ আমি সর্বদাই
জীবিকা সন্ধানী ট্রাস্ট একাউন্টে জমা করেছি। এই একাউন্ট আমার স্ত্রী পরিচালনা করে।
সে ইতিমধ্যে ২৫ জন গরীব, গৃহহারা মেধাবী কিশোর-কিশোরীকে বোর্ডিং স্কুলে ভর্তি করে
দিয়েছে। আমাদের কোন সন্তান নেই সত্যি, তবে ঐ ২৫ জন আমাদের সন্তান
এবং আশাকরি সেতারা আরো নতুন নতুন সন্তানের দায়িত্ব নিয়ে তাদের জীবিকা সন্ধানে
সহযোগিতা করতে সক্ষম হবে। আমার লেখা বেশ কয়েকটি বই এখনও অপ্রকাশিত আছে। আমার
স্ত্রী সবগুলো বই ধীরে ধীরে বাংলাদেশ থেকেই প্রকাশিত হতে সাহায্য করবে। আমার
স্ত্রী’কে সকল প্রকার ঝামেলা মুক্ত রাখার জন্য আমি নিজেই প্রকাশকদের নাম নির্বাচন
করে দিয়েছি। আমার জীবনের সব থেকে বড় প্রাপ্তি আমার লেখার পাঠকবৃন্দ আপনারা, তারপর
দিশারী’র পুরস্কার, যা আমি নিজের হাতে গ্রহন না করেও নিজ হাতে গৃহহারাদের পুনর্বাসনে
ব্যবহার করতে পেরেছি। আমি অত্যন্ত দুঃখিত জীবিত থাকতে জীবিকা সন্ধানীকে খুঁজে দিতে
সাহায্য করিনি বলে। আশাকরি আপনারা সবাই আমাকে ক্ষমা করবেন। জয় হোক সত্যের! মঙ্গল
হোক সততার!
টরন্টো, অন্টারিও
ডিসেম্বর ৯, ২০১৪
1 মন্তব্যসমূহ
onek valo legeche.
উত্তরমুছুন