দেবতনু সান্যাল এর গল্প : শান্তির নীড়

কুষ্ঠিয়ার একফালি জমির দলিলটা আজ অনেক বছর পর বেরল।হাতে লেখা দলিলের কাগজ হলদে হয়ে গেলেও কমল কুমার মুখার্জীর সই জ্বলজ্বল করছে এখনও।কমল কুমার মুখার্জী-আমার বাবা।বাবার নামের পাশেই ইদ্রিস চাচার স্বাক্ষর।মহম্মদ ইদ্রিস। মুক্তোর মত হাতের লেখা ছিল চাচার। তখনও গোটা দেশটার নাম ছিল বাংলাদেশ। নদীয়ার কুষ্ঠিয়ায় অস্থায়ী আদালতের টাইপিষ্ট ছিল আমার বাবা।ইদ্রিস চাচা পেশায় উকিল। দুজনেই একই গ্রামের মাণুষ।তখনকার অজ পাড়া গাঁয়ে পড়াশুনো জানা লোক বলতে এই দুজন।বয়সে প্রবীণ ইদ্রিস চাচা আমার বাবাকে খুব স্নেহ করতেন। আমাদের গ্রামে একটা নদী ছিল। নামটা এখন আর ঠিক মনে নেই। ইদ্রিস চাচার এক টুকরো জমি ছিল সেই নদীর পাশে। কোন এক সময় চাচা সেই ছোট্ট জমিটা বাবাকে লিখে দেন। আমার বাবার সারা জীবনের এক এবং একমাত্র সম্বল।


সন্দীপ আমার একমাত্র সন্তান। আমেরিকায় সেটল করেছে বেশ কয়েক বছর। দেশের প্রথম সারির সফটওয়্যার কোম্পানীর উচ্চপদস্থ অফিসার। কয়েক বছরেই গাড়ি, ফ্ল্যাট, মোটা মাসমাইনে- স্বচ্ছল, সুন্দর জীবন। আজ যদিও আমার গর্ব সে কারণে নয়। সন্দীপ আজ প্রাইজ পাবে। মস্ত বড় প্রাইজ। সে দেশে ভিষণ নাকি এর সম্মান। সন্দীপের চিত্রনাট্য নিয়ে তৈরী একটা ইংরেজি শর্ট ফিল্ম আজ বেষ্ট শর্ট ফিল্মের অ্যাওয়ার্ড পাবে সে দেশে। রিচার্ড বলে এক সাহেব ছোকরা সন্দীপের বন্ধু। রিচার্ড শখের ফটগ্রাফার। বাপ-মায়ের অগাধ সম্পত্তি। উইক এন্ডের আড্ডায় সন্দীপের গল্প মনে ধরে যায় রিচার্ডের। নিজের খরচে একটা সংক্ষিপ্ত সিনেমা বানিয়ে ফেলে রিচার্ড। আজ সেই সিনেমার গল্পকার স্টেজে উঠবে প্রাইজ নিতে। ছবির নাম- “দ্য নেস্ট আফ পিস”।

আমার বাবার নামটার মধ্যে কেমন যেন একটা রাশভারি গন্ধ লেগে আছে। তার উপর পেশায় আদালতের টাইপিষ্ট! আদতে কমল কুমার মুখার্জী মানুষটি ছিল একদম উল্টো। আইন আদালতের শুকনো যুক্তি-তর্কে মন ছিল না এতটুকু। বাবার জীবন জুড়ে ছিল লেখা। মানুষের জীবনে এমন কিছু জিনিস থাকে যা কেড়ে নিলে মানুষ বেঁচে হয়ত থাকে, কিন্তু সে বাঁচায় প্রাণ থাকে না। বাবার কাছে লেখা ছিল সেরকম। যে লোক রোদ নেই বৃষ্টি নেই মাঠে বাদাড়ে ঘুরে বেড়ায় তার আইনে মন বাঁধবে কেন? যে মানুষ পূর্ণিমা নামলেই গ্রামের পাশে তরমুজ ক্ষেতে মাঝ রাতে চাঁদের তাপ পোহায় তাকে কি বলবে? পাগল? হয়ত তাই। পাগল বলেই হয়ত ট্রাঙ্কে ভর্তি ভর্তি লেখার খাতা ছিল বাবার। ছোটবেলার দেখা বাবাকে যতদূর মনে পড়ে- হয় বাবার সঙ্গে আমি বনে বাদাড়ে ঘুরছি, নয়ত বাবা ঘরের কোণে কিংবা নদীর ধারে বসে একমনে লিখে চলেছে।

আমি যদিও লেখা লিখির ধার কাছ দিয়ে যাই নি কোনদিন। দেখতে দেখতে চাকরি থেকে রিটায়ারও করে ফেললাম গত বছর। এ পর্যন্ত লেখা তো দূরের কথা, একটা গল্পের বই অবধি আমাকে পড়তে দেখেনি কেউ। আমার স্ত্রী শুভ্রারও এসবের শখ নেই কোনকালে। সময় যদিও খুব কম ছিল এসবের জন্য। আমি ছিলাম স্টেট ব্যাঙ্কের ম্যানেজার। শুভ্রা গার্লস স্কুলের হেড মিসস্ট্রেস। দুজন দুজনের জগত নিয়ে ব্যস্ত থেকেছি বরাবর। সন্দীপও বরাবর স্টুডিয়াস স্টুডেন্ট ছিল। কিন্তু পড়ার বইয়ের বাইরে গল্প-কবিতায় তাকেও চোখে পড়ে নি কোনদিন। আসলে জ্ঞান হওয়ার পর থেকেই গল্প কবিতা নিয়ে এমন একটা ভয় মনে শিকড় গেঁথে বসেছিল, নিজের পরিবারকে সচেতন ভাবে সরিয়ে রেখেছি এসব থেকে।

বাবার কথা আলাদা। জীবনের চেনা চাওয়া পাওয়াগুলোর স্বাদ পেতে ত কমল কুমার মুখার্জী আসে নি। বাবাকে কোন দিন বেশি কথা বলতে দেখি নি। কিন্তু কিন্তু মনে মনে মানুষটা বড় অশান্ত ছিল। সমস্ত সময় চারি দেকে কি যেন খুঁজে বেড়াত দুচোখ। বনে, জঙ্গলে, নদীর ধারে যখন যেখানে বাবার সঙ্গে গেছি, দেখেছি, বাবা চুপচাপ গাছপালা কিংবা নদীর দিকে তাকিয়ে বসে আছে ঘন্টার পর ঘন্টা। নদীর জলের কলকল, বাবার বোবা দুটো চোখ- ছোটবেলার আমি অবাক হয়ে দেখতাম শুধু, বুঝতাম না।

সন্দীপ তখনও এ দেশে। হায়ার সেকেন্ডারি পরীক্ষা দিয়ে ছুটি কাটাচ্ছে বেশ। আমার,শুভ্রার দুজনেরই অফিসের চাপ। কাজেই সন্দীপকে সময় দেওয়া হয়ে ওঠে না একদমই। ওর নিজের বন্ধু বান্ধবও নেই খুব একটা। নিজের মত করে বাড়িতে সময় কাটায় কি করে, ভেবে দেখি নি কোনদিন। একদিন অফিস থেকে বাড়ি ফিরে দেখলাম সন্দীপ একটা কবিতা লিখেছে। কাঁচা বয়সের আবেগ পূর্ণ লেখা। বাবার কিছু লেখার খাতা লফটে তোলা ছিল এতদিন। একা একা দুপুরে সেসব নামিয়ে সন্দীপ পড়েছে এতদিন ধরে। সেদিন হঠাৎ নিজে থেকে একটা কবিতাই লিখে ফেলেছে উৎসাহে। সেদিন খুব বকে ছিলাম ছেলেকে। জ্ঞানত ওই ভাবে কোনদিন সন্দীপের সাথে কথা বলি নি আমি। খুব অবাক হয়ে ছিল সন্দীপ। সেদিনের পর থেকে সন্দীপ আর কোনদিন লেখে নি। অন্তত আমার সামনে নয়।

বাবার লেখার নেশা দিনদিন বাড়তে লাগল। আমি তখন চার কি পাঁচ। দিন নেই রাত নেই শুধু এদিক ওদিক ঘোরা আর গুচ্ছ গুচ্ছ লেখা। কাজে ভুল হতে লাগল প্রায়। এরকমও হল গুরুত্বপূর্ণ মামলার নথি টাইপ করতে বসে লিখে ফেলল অদ্ভূত কোন এক গল্প। প্রথম প্রথম সহকর্মী, সিনিয়ার বোঝালেন সবাই। ইদ্রিস চাচাও বোঝালেন অনেক করে। কিন্তু সে মারণ রোগ তখন বাবার শিরায় শিরায় রক্তে মিশে গেছে ততদিনে। হঠাৎ অফিসের বড়বাবু নোটিস ধরালেন বাবার হাতে। চাকরি আর নেই আজ থেকে। দিনে দিনে তলিয়ে যেতে থাকলাম আমরা। বাবার পাগলামও বাড়তে লাগল চোখের সামনে। দেখতে দেখতে ভাতের হাঁড়ি অনিয়মিত হয়ে পড়ল মুখার্জী বাড়িতে। ইদ্রিস চাচা নদীর ধারে একফালি জমিটা দিলেন বাবাকে। বাবা কিন্তু চাষবাস করল না সেখানে। জমিটাকে বেড়া দিয়ে ঘিরে যত্ন করে গাছ লাগাল কিছু। শখ করে জায়গাটার নাম রাখল “শান্তির নীড়”। বাড়িতে কিন্তু শান্তি ছিল না একদিনও। মা প্রথম প্রথম চোখের জল ফেলত। ঠাকুর দেবতার কাছে অনুনয় বিনয় চলতে থাকল রাতদিন। ঠাকুর যখন মুখ ফিরিয়ে রইল মা তখন দিন কে দিন বাবাকে কঠিন ভাষায় আঘাত করতে শুরু করল। দিনে দিনে সে ভাষা কঠিন থেকে অকথ্য হয়ে উঠল মায়ের অজান্তেই। তারপর একদিন গ্রামের অনেকের সাথে আমরা কলকাতায় চলে এলাম। সারা দেশে তখন খুব মারামারি। চারিদিকে। আমি তখন ছোট। কেন এত মারামারি বুঝতাম না। শুধু একদিন সকালে বুঝলাম বাবা আর আমাদের সঙ্গে নেই। কলকাতা শহরের থিক থিকে ভিড়ে কোথায় হারিয়ে গেল বাবা, আর খুঁজে পেলাম না তাকে।

কলকাতায় এখন রাত। আমেরিকায় দিন। শুভ্রা এখন ওখানে ছেলের কাছে। সন্দীপ যে দিন ফোন করে জানাল ওর লেখায় তৈরী সিনেমা প্রাইজ পাবে, আমি রেগে গেছিলাম আবার। হয়ত ভয় পেয়েছিলাম, রাগ নয়। কিন্তু ছেলে এখন বড় হয়েছে। শুভ্রার কথায় আর কিছু বলি নি সন্দীপকে। একটু আগে কথা হল ছেলের সঙ্গে। স্কাইপিতে। শুভ্রাও ছিল পাশে। আর একঘন্টা পরেই প্রোগ্রাম। বিশাল স্টেজে অনেক গুণী লোকের সামনে প্রাইজ নেবে আমার ছেলে। সন্দীপ খুব এক্সাইটেড। কথা বলতে বলতে হঠাৎ থেমে গেল সন্দীপ। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, “বাবা, লেখাটার নাম দিয়েছিলাম দ্য নেস্ট অফ পিস। সিনেমার নামও তাই। দাদুর শান্তির নীড় এর নামে। এই লেখাটার অনেকটা জায়গা জুড়ে দাদুর মতই ছন্নছাড়া নিঃসঙ্গ একজন মানুষ। যার জীবনে টাকা দিয়ে কেনা সাফল্য নেই। কিন্তু একটা কিছু আছে যা খুব দামি। সেই দামি জিনিসের দাম দেবে এমন একজন লোকও পৃথিবীতে আছে। লোকটা পাগলের মত ঘুরে ঘুরে তাকে খুঁজে বেড়ায়”।

স্কাইপি শেষ হয়েছে মিনিট পাঁচেক হল। উঠে গিয়ে আলমারির লকার থেকে দলিলটা বের করেছি। হলদে কাগজে জ্বলজ্বল করছে কমল কুমার মুখার্জীর সই। ইদ্রিস চাচার বাবাকে দেওয়া জমি। আমার বাবার সারা জীবনের এক এবং একমাত্র সম্বল। আমার চোখ চশমার কাঁচের তলায় ঝাপসা হয়ে আসছে ধীরে ধীরে। জলের ধারার মধ্যে দিয়ে দেখতে পাচ্ছি- জোছনায় ধুয়ে যাচ্ছে একটা বিশাল মাঠ। মধ্যরাত্রি। খালি গায়ে ধুতি পরা একটা লোক হনহন করে হেঁটে চলেছে তরমুজ ক্ষেতের মধ্যে দিয়ে। লোকটার চওড়া কাঁধে ছোট্ট আমি বসে। উলঙ্গ পিঠে চাঁদের আলো ঠিকরে পড়ছে। দূরে সরু রেখার মত একটা নদী। পূর্ণিমার নদীতে কেউ ভাসিয়ে দিয়েছে সহস্র প্রদীপ। লোকটা আমাকে কাঁধে করে এগিয়ে চলেছে একফালি জমির দিকে—শান্তির নীড়, দ্য নেস্ট অফ পিস। ​ 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ