বাড়ি ভর্তি মানুষ। দূর- দূরান্তর থেকে আত্মীয়স্বজন এসে হাজির। ঢাকা থেকে বড় ফুপুও এসে গেছেন। চাচারা দাদিও ঘরে বসে আছেন। বয়সের ভাঙা শরীরে দাদী নেতিয়ে যাচ্ছেন। এখন যায় তখন যায় অবস্থা। সবার চোখ ছলছল করছে। যখন তখন কেঁদে ফেলবে এমন অবস্থা।
একটা মানুষের সময় শেষ- তিনি শাশ্বতর মায়া ছেড়ে চলে যাবেন- তাঁর নশ্বরের জীবনে- এটা যেন কেউ মেনে নিতে পারছেন না। তাকে আকড়ে ধরে রাখতে চায়ছেন।
মেঝে ফুপু দাদির মাথার পাশে বসে আছেন এবং এক দৃষ্টিতে মায়ের বুজা অক্ষি কোটরে তাকিয়ে আছেন। চাচীরা ঘরের এ কোণ ওকোণে কুন্ডলী পাকিয়ে বসে আছেন। কারো মুখে কোনো কথা নেই। যেন সব কথা হারিয়ে গেছে।
দাদা এই নিরবতা ভেঙে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, ‘শিলু এখনো এলো না।’
সবাই এদিক ওদিক তাকালেন- যেন শিলুকে খুঁজছেন।
শিলু হচ্ছেন ছোট ফুপু। তিনি থাকেন ঝালকাঠিতে। ছোট ফুপুর কথা শুনে পিয়াস একটু নড়ে-চড়ে বসলো। একটা চিনচিনে সুখ দাদির মরণ যাত্রার কথা ভুলিয়ে দিলো। যেন অন্য জগতে চলে গেলো সে। যেখানে মরণ কষ্ট নেই-দুঃখ জরার অস্থিত নেই। একটা স্বপ্ন তৈ তৈ করে খেলা করে দুধ সাদা রাজহাঁসের মত। পিয়াসের মুখ চকচক করছে। সে অপেক্ষা করছে ছোট ফুপুর জন্য। সে জানে ছোট ফুপু আজ একা আসবেন না। দলবল নিয়েই আসবেন। আর দলবলের সাথে নিশ্চয় ছোট ফুপুর বড় মেয়ে নীলা থাকবে।
নীলার বিয়ে হয়েছে এক বছর। অনার্স পড়তে পড়তেই বিয়ে হয়ে যায়। স্বামীর বিরাট ব্যাবসা। জাহাজ ভর্তি চুনাপাথরের যত সব কারবার। এই ব্যাবসা-টাকা পয়সা দেখেই ছোট ফুপু নীলাকে বিয়ে দিয়ে দিলেন। নীলার প্রথমে খুব অমত ছিল। রাগ করে একবার নানি বাড়ি চলে এসেছিল। মামা-মামীকে অনেক বুঝিয়ে ছিল-যেন এ বিয়ে ভেঙে দেয। নানাকে দিয়ে ছোট ফুপুর কাছে মোবাইল করিয়েছিল নীলা। কোনো ফোন-টোনে কাজ হয়নি। ছোট ফুপুর একটাই কথা- আমার মেয়ে যেখানে খুশি সেখানে বিয়ে দেবো। দরকার হলে মেয়েকে কেটে টুকরো টুকরো করে রূপসা খালে ভাসিয়ে দেবো। তবুও কারো কথা শুনবো না।
অবশেষে টাকার কুমরের সাথে বিয়ে হয়ে গেলো। গাড়ি বাড়ি, ধন-দৌলতের ভেতর থেকেও নীলা প্রথম প্রথম সুখী ছিল না। বিয়ের পরও পিয়াসের সাথে মোবাইলে অনেক কথা হতো। বার বার সে বলতো, সে সুখী নেই। ভারী ভারী সোনার গয়না পরতে পরতে তার কান-নাক না কী ব্যথা হয়ে যাচ্ছে। গলা ছিড়ে পড়ছে ভারী হারের ওজনে। সারা দিন না কি সেজে গুজে সো-পিচের মত বসে থাকতে হয়।
পিয়াস ভেবেছিল এ মেয়ের দ্বারা আর সংসার হবে না। কবিতা পড়া মেয়ে। যে মেয়ে একবার কবিতা পড়েছে। ‘যে জীবন ফড়িঙের দোয়েলেন- মানুষের সাথে তার হয় না কো দেখা’- সে কী করে এই সোনা গয়নার সংসার করবে !
কিন্তু সব কবিতা মিথ্যে করে নীলা ভয়ংকর সংসারি হয়ে গেলো। তার মোবাইলে কথা বলা বন্ধ হলো। পিয়াসের সাথে সমস্ত নেটওয়ার্ক বিচ্ছিন্ন হলো। পৃথক দীপবাসি হলো নীলা।
ছোট ফুপুর কাছে শুনেছে নীলা না কি আর মোবাইল ব্যবহার করে না। আজেবাজে জায়গা থেকে কল আসে। বদ ছেলেরা সারাদিন জ্বালায়। এই জন্য মোবাইল বন্ধ করে দিয়েছে। স্বামীও না কি এতে বেজায় খুশি। খুশি হয়ে নীলাকে একটা লাল রঙের প্রাইভেট কারও কিনে দিয়েছে।
অবশ্য প্রাইভেট কারের কথা নীলার শেষ চিঠিতে জানিয়ে ছিল পিয়াসকে। লিখে ছিল, ভাইয়া সংসার নিয়ে বড় ঝামেলায় আছি। এতো বড় সংসার আমাকেই সামলাতে হয়। স্বামী তো না যেন বিশ্বব্যাংক। টাকা-পয়সা নিয়েই তার চলাফেরা। এতো টাকা দিয়ে কী করবে- আমি ভেবে পাই না। একটা মানুষের যে এতো টাকা হতে পারে, তা আমি কোনো দিন কল্পনাও করিনি। আমাকে একটা লাল রঙের প্রাইভেটকার কিনে দিয়েছে। বলেছে মন খারাপ হলে এখানে সেখানে ঘুরে বেড়াতে। তুই বল, সংসার ফেলে আমার ঘোরার সময় আছে ! ভাইয়া আমার তো লেখাপড়া আর হলো না। তুই যেন বন্ধ করিস না। অনার্সে ভালো একটা রেজাল্ট করবি। তোকে নিয়ে আমার অনেক স্বপ্ন। তোর জন্য একটা মোবাইল পাঠালাম, সবাসরি জাপান থেকে আনা। এটা না কি অনেক দামী। তোর জন্য পাঠালাম নিশ্চয় খুশি হয়ে ছিস।
পিয়াস বুঝে গেছে, ফড়িঙের দোয়েলের জীবন ফেলে নীলা মানুষের সংসারে ঢুকে গেছে।
দুপুরে দুইটা প্রাইভেট কারে করে ছোট ফুপু তার দলবল নিয়ে হাজির হলেন। গাড়ির হর্ণ শুনে পিয়াস ছুটে রাস্তায় এলো। লাল রং এর প্রাইভেট কারের ভেতর থেকে ইন্ডিয়ান সিরিয়ালের নায়িকার মত ভারী ভারী গয়না পরা-উজ্জ্বল মেকাপে নীলা বেরিয়ে এলো।
নীলাকে দেখে অপেক্ষার কথা গুলো হারিয়ে ফেললো পিয়াস। ছোট ফুপু কোনো কথা না বলে দলবল নিয়ে দ্রুত বাড়ির ভেতর ঢুকে গেলেন।
পিয়াস নীলার পেছন পেছনই আছে। নীলা একবার জিজ্ঞেস করলো, ‘ভাইয়া ভালো আছিস ?’
পিয়াস একটু ঠোঁট চেঁপে হাসলো। এ হাসি দ্বারা কী বুঝাতে চেয়েছে পিয়াস- তা সে নিজেও দজানে না। যেনো ‘ভালো আছিস’ বললেই এরকম একটু হাসতে হয়। এই জন্যই হাসা।
ছোট ফুপু ঘরে যেয়ে দাদির গলা ধরে অনেক্ষণ মরা কান্না- কাঁদলেন। ওনার কান্নার সাথে সাথে সবাই একটু চোখ ভেজালেন অশ্রুজলে। পিয়াসেরও চোখ ভিজে উঠলো। সে ভেজা চোখে নীলার দিকে তাকালো। নীলারও চোখ টলমল করছে।
পিয়াস নীলার গা ঘেঁসে দাঁড়িয়ে আছে। পরিবেশ স্বাভাবিক হওয়ার জন্য অপেক্ষা করছে। একটু স্বাভাবিক হলেই নীলার সাথে কথা বলবে। অনেক কথা তার বলার আছে।
এই দিনটার জন্যই হয়তো পিয়াস অপেক্ষা করছিল। নীলাকে বড় প্রয়োজন ছিল তার। এই থমথমে পরিবেশের মধ্যেও সে নীলার প্রয়োজন অনুভব করছে। অনেক কিছু জানার আছে তার। বিশেষ করে একটা মোবাইল নাম্বার।
যে নাম্বারটা হারিয়ে, পিয়াস স্রোতহীন নদীর মত পড়ে আছে। কূল জল সবই আছে কিন্তু ঢেউ নেই। গতিহীন জীবন নিয়ে সে বেঁচে আছে।
সারাটা বিকেল পিয়াস নীলার পেছন-পেছন অসহায়ের মত ঘুর-ঘুর করলো। নীলা যেন কিছুই বুঝতে পারলো না। সন্ধ্যার পর বাড়ির পরিবেশ একটু-একটু করে স্বাভাবিক হতে লাগলো। শুধু বড় ফুপু দাদির পাশে বসে থাকলেন। চাচীরা যাঁর-যাঁর রান্নাবাড়ি নিয়ে ব্যাস্ত হয়ে পড়লেন। মেজে ফুপু আর ছোট ফুপু নীলাকে নিয়ে মেজে চাচার ঘরে গল্প করছেন। সব গল্পই মূলত হচ্ছে নীলার সংসার নিয়ে। ছোট ফুপু বেশ অধিকার নিয়ে নীলার সংসারের গল্প বলছেন- জামাইয়ের টাকা পয়সার গল্প করছেন। কত ধনী পরিবারে বিয়ে দিয়েছেন। তাঁর জন্যই তো নীলা এতো সুখী।
পিয়াসকে ঘরে ঢুকতে দেখে মেজে ফুপু বললেন, ‘আয়, বোস।’
ছোট ফুপু তার গল্প বলেই যাচ্ছেন। এ গল্প তার আর শেষ হওয়ার নই।
মেজে ফুপুও যেন গল্প শুনতে-শুনতে হাঁফিয়ে উঠেছেন। তিনিও এই গল্প থেকে মুক্তি চান। তাই তিনি কথা ঘুরানোর জন্য বললেন, ‘পিয়াস তোর লেখা-পড়ার খবর কী ?’
পিয়াস নীলার দিকে এক বার তাকিয়ে বললো, ‘মার্স্টাসের র্ফমফ্লাপ চলছে। পরীক্ষার আর দেরি নেই।’
‘মন দিয়ে লেখা পড়া কর। এরপর বিসিএস এর জন্য চেষ্টা করবি।’
পিয়াস আর কোনো কথা বললো না। আড় চোখে নীলার দিকে তাকালো।
মেয়েটাকে কখন একা পাবে, সেই কথা চিন্তা করছে। তার তো অনেক কথা বলতে হবে।
কিন্তু নীলা তো এখন মহিলাদের মত চলাফেরা করছে। আগের মত আর পিয়াসকে সময় দিচ্ছে না। অভিজ্ঞ মহিলার মত নীলা মামিদের রান্না ঘরে যেয়ে- বিভিন্ন রান্নার রেসিপি শিখাচ্ছে। যেন সে বিখ্যাত রাধূনী হয়ে গেছে।
আর পিয়াস খানা বাড়ির নুলো কুকুরের মত নীলার পেছন-পেছন ঘুরছে।
বড় চাচী তো বলেই ফেললেন, ‘কি রে পিয়াস, তুই মেয়েদের মধ্যে ঘুর-ঘুর করছিস কেনো। যা তোর দাদীকে দেখে আয়।’
পিয়াস বুঝলো, এবার মেয়েদের মেয়েলী তত্ত্ব বিষয়ক কথার্বাতা হবে। এখানে না থাকাই উত্তম।
সে উঠে দাদীর ঘরে চলে গেলো।
বড় ফুপু দাদীর পাশেই এখনো বসে আছেন। তার চোখ ফোলা, হয়তো বা কেঁদেছেন।
পিয়াসও দাদীর পাশে বসলো। বড় ফুপু বললেন, ‘ তুই মা‘র পাশে বস। আমি একটু আসছি।’
বড় ফুপু চলে গেলেন।
পিয়াস দাদীর হাত ধরে বসে আছে। তারও কষ্ট হচ্ছে। সে দাদীর মুখের দিকে তাকালো। মুখটা সামান্য হা করে দাদী চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছেন।
পিয়াস একবার , ‘দাদী, ও দাদী ’-বলে ডাক দিলো।
দাদী কোনো শব্দ করলেন না। শুটকি মাছের মত শুকনো শরীর নিয়ে দাদী পড়ে আছেন। থেকে- থেকে বুকটা তাঁর গাঢ় নিঃম্বাসে উঠানামা করছে।
কান্নার মত কষ্ট হচ্ছে পিয়াসের। ছোট বেলায় মা মারা যাওয়ার পর বাবা যখন আর একটা বিয়ে করলেন। তখন দাদীই তাকে বুকে টেনে নিয়ে মানুষ করেছেন। মা‘র অভাব কোনো দিন বুঝতে দেননি। দাদীর বড় আদরে বড় হয়েছে পিয়াস। ভাত মেখে খায়িয়েছেন- গোছল করিয়েছেন। সেই দাদী আজ মারা যাচ্ছেন। এ কষ্ট যেন সে রাখতে পাছে না।
রাতে খাওয়া-দাওয়ার পর অনেক সাধনায় নীলাকে একটু একা পাওয়া গেলো। ব্যাগ থেকে শাড়ি-কাপড় বের করছিল। পিয়াস যেয়ে বললো, ‘নীলা তোর সাথে কিছু কথা আছে।’
‘কী কথা, বল।’
‘একটা জিনিস চাইবো, দিবি ?’
‘কী ?’
পিয়াস মন মরা করে মেঝের দিকে তাকিয়ে বললো, ‘চাঁদনির মোবাইল নাম্বারটা দিবি।’
কথাটা শুনে নীলা যেনো খুব অবাক হলো। বললো, ‘কেনো তোর সাথে ওর যোগাযোগ নেই ?’
পিয়াস শিুশুদের মত নাক ফুলিয়ে বললো, ‘ওর সাথে ঝগড়া হয়েছে। আমি রাগ করে নাম্বার ডিলেট করে ফেলেছি। এক বছর ওর সাথে কোনো যোগাযোগ নেই।’
তারপর একটু থেমে বললো, ‘এই এক বছরে ও কোনোদিনও কল দেয়নি।’
‘বলিস কি ? এমন র্দুদান্ত প্রেম শেষ করলি কেমন করে ?’
‘আর বলিসনে একদিন আমার মোবাইলে ওয়েটিং দেখে সে কী ঝগড়া শুরু করলো। তারপর এক কথায় দুই কথায় বেঁধে গেলো।’
পিয়াস ফকিরের মত বললো, ‘দে না ! ওর নাম্বারটা।’
‘ভাইয়া, বিয়ের পর তো কারো সাথে আমার আর কোনো যোগাযোগ নেই। মোবাইল ফোনই তো ব্যবহার করা বন্ধ করে দিয়েছি। সিম-টিম তো সব ফেলে দিয়েছি। কোথায় নাম্বার পাবো বল।’
চাঁদনি হচ্ছে নীলার কাছের বান্ধবীদের মধ্যে একজন।
পিয়াস যখন ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা দিয়ে ঝালোকাটি গিয়েছিল ছোট ফুপুর বাড়িতে বেড়াতে, তখন চাঁদনির সাথে পরিচয় হয়। চমৎকার একটা মেয়ে। ও ঝালোকাটি মহিলা কলেজে পড়তো।
পিয়াস নীলা আর চাঁদনি পুরো ঝালোকাটি চষে বেড়িয়েছে। ঘুরে বেড়িয়েছে এখানে-সেখানে। কত জায়গায়ই না তারা ঘুরেছে- সুজাবাদের কেল্লা, ঘোষাল রাজবাড়ি, সাতুরিয়া জমিদার বাড়ি, কবি জীবনানন্দ দাশের মামা বাড়ি।
ধানসিঁড়ি নদীর পাশে বসে তারা কত গল্প করেছে। কবি জীবনানন্দ দাশকে চিনিয়েছে চাঁদনি। সেই ধানসিঁড়ি নদীর জল মেখে তারা কবিতায় ভিজেছে। মেয়েটা দারুণ কবিতা পছন্দ করে। জীবনানন্দ দাশের পঞ্চান্নটা কবিতা তার মুখস্থ।
কী সুন্দর কবিতা বলে মেয়েটা-
‘তুমি তা জানো না কিছু- না জানিলে
আমার সকল গান তবুও তোমারে লক্ষ্য করে;
যখন ঝরিয়া যাবো হেমন্তের ঝড়ে-
পথের পাতার মতো তুমিও তখন
আমার বুকের’ পরে শুয়ে রবে’
কবিতার মত সুন্দর মেয়েটাকে পিয়াস অভিমানে হারিয়ে ফেলেছে। ভালোবেসে যার নাম দিয়ে ছিল ‘চন্দ্রাবতী’।
একটা মানুষের সময় শেষ- তিনি শাশ্বতর মায়া ছেড়ে চলে যাবেন- তাঁর নশ্বরের জীবনে- এটা যেন কেউ মেনে নিতে পারছেন না। তাকে আকড়ে ধরে রাখতে চায়ছেন।
মেঝে ফুপু দাদির মাথার পাশে বসে আছেন এবং এক দৃষ্টিতে মায়ের বুজা অক্ষি কোটরে তাকিয়ে আছেন। চাচীরা ঘরের এ কোণ ওকোণে কুন্ডলী পাকিয়ে বসে আছেন। কারো মুখে কোনো কথা নেই। যেন সব কথা হারিয়ে গেছে।
দাদা এই নিরবতা ভেঙে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, ‘শিলু এখনো এলো না।’
সবাই এদিক ওদিক তাকালেন- যেন শিলুকে খুঁজছেন।
শিলু হচ্ছেন ছোট ফুপু। তিনি থাকেন ঝালকাঠিতে। ছোট ফুপুর কথা শুনে পিয়াস একটু নড়ে-চড়ে বসলো। একটা চিনচিনে সুখ দাদির মরণ যাত্রার কথা ভুলিয়ে দিলো। যেন অন্য জগতে চলে গেলো সে। যেখানে মরণ কষ্ট নেই-দুঃখ জরার অস্থিত নেই। একটা স্বপ্ন তৈ তৈ করে খেলা করে দুধ সাদা রাজহাঁসের মত। পিয়াসের মুখ চকচক করছে। সে অপেক্ষা করছে ছোট ফুপুর জন্য। সে জানে ছোট ফুপু আজ একা আসবেন না। দলবল নিয়েই আসবেন। আর দলবলের সাথে নিশ্চয় ছোট ফুপুর বড় মেয়ে নীলা থাকবে।
নীলার বিয়ে হয়েছে এক বছর। অনার্স পড়তে পড়তেই বিয়ে হয়ে যায়। স্বামীর বিরাট ব্যাবসা। জাহাজ ভর্তি চুনাপাথরের যত সব কারবার। এই ব্যাবসা-টাকা পয়সা দেখেই ছোট ফুপু নীলাকে বিয়ে দিয়ে দিলেন। নীলার প্রথমে খুব অমত ছিল। রাগ করে একবার নানি বাড়ি চলে এসেছিল। মামা-মামীকে অনেক বুঝিয়ে ছিল-যেন এ বিয়ে ভেঙে দেয। নানাকে দিয়ে ছোট ফুপুর কাছে মোবাইল করিয়েছিল নীলা। কোনো ফোন-টোনে কাজ হয়নি। ছোট ফুপুর একটাই কথা- আমার মেয়ে যেখানে খুশি সেখানে বিয়ে দেবো। দরকার হলে মেয়েকে কেটে টুকরো টুকরো করে রূপসা খালে ভাসিয়ে দেবো। তবুও কারো কথা শুনবো না।
অবশেষে টাকার কুমরের সাথে বিয়ে হয়ে গেলো। গাড়ি বাড়ি, ধন-দৌলতের ভেতর থেকেও নীলা প্রথম প্রথম সুখী ছিল না। বিয়ের পরও পিয়াসের সাথে মোবাইলে অনেক কথা হতো। বার বার সে বলতো, সে সুখী নেই। ভারী ভারী সোনার গয়না পরতে পরতে তার কান-নাক না কী ব্যথা হয়ে যাচ্ছে। গলা ছিড়ে পড়ছে ভারী হারের ওজনে। সারা দিন না কি সেজে গুজে সো-পিচের মত বসে থাকতে হয়।
পিয়াস ভেবেছিল এ মেয়ের দ্বারা আর সংসার হবে না। কবিতা পড়া মেয়ে। যে মেয়ে একবার কবিতা পড়েছে। ‘যে জীবন ফড়িঙের দোয়েলেন- মানুষের সাথে তার হয় না কো দেখা’- সে কী করে এই সোনা গয়নার সংসার করবে !
কিন্তু সব কবিতা মিথ্যে করে নীলা ভয়ংকর সংসারি হয়ে গেলো। তার মোবাইলে কথা বলা বন্ধ হলো। পিয়াসের সাথে সমস্ত নেটওয়ার্ক বিচ্ছিন্ন হলো। পৃথক দীপবাসি হলো নীলা।
ছোট ফুপুর কাছে শুনেছে নীলা না কি আর মোবাইল ব্যবহার করে না। আজেবাজে জায়গা থেকে কল আসে। বদ ছেলেরা সারাদিন জ্বালায়। এই জন্য মোবাইল বন্ধ করে দিয়েছে। স্বামীও না কি এতে বেজায় খুশি। খুশি হয়ে নীলাকে একটা লাল রঙের প্রাইভেট কারও কিনে দিয়েছে।
অবশ্য প্রাইভেট কারের কথা নীলার শেষ চিঠিতে জানিয়ে ছিল পিয়াসকে। লিখে ছিল, ভাইয়া সংসার নিয়ে বড় ঝামেলায় আছি। এতো বড় সংসার আমাকেই সামলাতে হয়। স্বামী তো না যেন বিশ্বব্যাংক। টাকা-পয়সা নিয়েই তার চলাফেরা। এতো টাকা দিয়ে কী করবে- আমি ভেবে পাই না। একটা মানুষের যে এতো টাকা হতে পারে, তা আমি কোনো দিন কল্পনাও করিনি। আমাকে একটা লাল রঙের প্রাইভেটকার কিনে দিয়েছে। বলেছে মন খারাপ হলে এখানে সেখানে ঘুরে বেড়াতে। তুই বল, সংসার ফেলে আমার ঘোরার সময় আছে ! ভাইয়া আমার তো লেখাপড়া আর হলো না। তুই যেন বন্ধ করিস না। অনার্সে ভালো একটা রেজাল্ট করবি। তোকে নিয়ে আমার অনেক স্বপ্ন। তোর জন্য একটা মোবাইল পাঠালাম, সবাসরি জাপান থেকে আনা। এটা না কি অনেক দামী। তোর জন্য পাঠালাম নিশ্চয় খুশি হয়ে ছিস।
পিয়াস বুঝে গেছে, ফড়িঙের দোয়েলের জীবন ফেলে নীলা মানুষের সংসারে ঢুকে গেছে।
দুপুরে দুইটা প্রাইভেট কারে করে ছোট ফুপু তার দলবল নিয়ে হাজির হলেন। গাড়ির হর্ণ শুনে পিয়াস ছুটে রাস্তায় এলো। লাল রং এর প্রাইভেট কারের ভেতর থেকে ইন্ডিয়ান সিরিয়ালের নায়িকার মত ভারী ভারী গয়না পরা-উজ্জ্বল মেকাপে নীলা বেরিয়ে এলো।
নীলাকে দেখে অপেক্ষার কথা গুলো হারিয়ে ফেললো পিয়াস। ছোট ফুপু কোনো কথা না বলে দলবল নিয়ে দ্রুত বাড়ির ভেতর ঢুকে গেলেন।
পিয়াস নীলার পেছন পেছনই আছে। নীলা একবার জিজ্ঞেস করলো, ‘ভাইয়া ভালো আছিস ?’
পিয়াস একটু ঠোঁট চেঁপে হাসলো। এ হাসি দ্বারা কী বুঝাতে চেয়েছে পিয়াস- তা সে নিজেও দজানে না। যেনো ‘ভালো আছিস’ বললেই এরকম একটু হাসতে হয়। এই জন্যই হাসা।
ছোট ফুপু ঘরে যেয়ে দাদির গলা ধরে অনেক্ষণ মরা কান্না- কাঁদলেন। ওনার কান্নার সাথে সাথে সবাই একটু চোখ ভেজালেন অশ্রুজলে। পিয়াসেরও চোখ ভিজে উঠলো। সে ভেজা চোখে নীলার দিকে তাকালো। নীলারও চোখ টলমল করছে।
পিয়াস নীলার গা ঘেঁসে দাঁড়িয়ে আছে। পরিবেশ স্বাভাবিক হওয়ার জন্য অপেক্ষা করছে। একটু স্বাভাবিক হলেই নীলার সাথে কথা বলবে। অনেক কথা তার বলার আছে।
এই দিনটার জন্যই হয়তো পিয়াস অপেক্ষা করছিল। নীলাকে বড় প্রয়োজন ছিল তার। এই থমথমে পরিবেশের মধ্যেও সে নীলার প্রয়োজন অনুভব করছে। অনেক কিছু জানার আছে তার। বিশেষ করে একটা মোবাইল নাম্বার।
যে নাম্বারটা হারিয়ে, পিয়াস স্রোতহীন নদীর মত পড়ে আছে। কূল জল সবই আছে কিন্তু ঢেউ নেই। গতিহীন জীবন নিয়ে সে বেঁচে আছে।
সারাটা বিকেল পিয়াস নীলার পেছন-পেছন অসহায়ের মত ঘুর-ঘুর করলো। নীলা যেন কিছুই বুঝতে পারলো না। সন্ধ্যার পর বাড়ির পরিবেশ একটু-একটু করে স্বাভাবিক হতে লাগলো। শুধু বড় ফুপু দাদির পাশে বসে থাকলেন। চাচীরা যাঁর-যাঁর রান্নাবাড়ি নিয়ে ব্যাস্ত হয়ে পড়লেন। মেজে ফুপু আর ছোট ফুপু নীলাকে নিয়ে মেজে চাচার ঘরে গল্প করছেন। সব গল্পই মূলত হচ্ছে নীলার সংসার নিয়ে। ছোট ফুপু বেশ অধিকার নিয়ে নীলার সংসারের গল্প বলছেন- জামাইয়ের টাকা পয়সার গল্প করছেন। কত ধনী পরিবারে বিয়ে দিয়েছেন। তাঁর জন্যই তো নীলা এতো সুখী।
পিয়াসকে ঘরে ঢুকতে দেখে মেজে ফুপু বললেন, ‘আয়, বোস।’
ছোট ফুপু তার গল্প বলেই যাচ্ছেন। এ গল্প তার আর শেষ হওয়ার নই।
মেজে ফুপুও যেন গল্প শুনতে-শুনতে হাঁফিয়ে উঠেছেন। তিনিও এই গল্প থেকে মুক্তি চান। তাই তিনি কথা ঘুরানোর জন্য বললেন, ‘পিয়াস তোর লেখা-পড়ার খবর কী ?’
পিয়াস নীলার দিকে এক বার তাকিয়ে বললো, ‘মার্স্টাসের র্ফমফ্লাপ চলছে। পরীক্ষার আর দেরি নেই।’
‘মন দিয়ে লেখা পড়া কর। এরপর বিসিএস এর জন্য চেষ্টা করবি।’
পিয়াস আর কোনো কথা বললো না। আড় চোখে নীলার দিকে তাকালো।
মেয়েটাকে কখন একা পাবে, সেই কথা চিন্তা করছে। তার তো অনেক কথা বলতে হবে।
কিন্তু নীলা তো এখন মহিলাদের মত চলাফেরা করছে। আগের মত আর পিয়াসকে সময় দিচ্ছে না। অভিজ্ঞ মহিলার মত নীলা মামিদের রান্না ঘরে যেয়ে- বিভিন্ন রান্নার রেসিপি শিখাচ্ছে। যেন সে বিখ্যাত রাধূনী হয়ে গেছে।
আর পিয়াস খানা বাড়ির নুলো কুকুরের মত নীলার পেছন-পেছন ঘুরছে।
বড় চাচী তো বলেই ফেললেন, ‘কি রে পিয়াস, তুই মেয়েদের মধ্যে ঘুর-ঘুর করছিস কেনো। যা তোর দাদীকে দেখে আয়।’
পিয়াস বুঝলো, এবার মেয়েদের মেয়েলী তত্ত্ব বিষয়ক কথার্বাতা হবে। এখানে না থাকাই উত্তম।
সে উঠে দাদীর ঘরে চলে গেলো।
বড় ফুপু দাদীর পাশেই এখনো বসে আছেন। তার চোখ ফোলা, হয়তো বা কেঁদেছেন।
পিয়াসও দাদীর পাশে বসলো। বড় ফুপু বললেন, ‘ তুই মা‘র পাশে বস। আমি একটু আসছি।’
বড় ফুপু চলে গেলেন।
পিয়াস দাদীর হাত ধরে বসে আছে। তারও কষ্ট হচ্ছে। সে দাদীর মুখের দিকে তাকালো। মুখটা সামান্য হা করে দাদী চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছেন।
পিয়াস একবার , ‘দাদী, ও দাদী ’-বলে ডাক দিলো।
দাদী কোনো শব্দ করলেন না। শুটকি মাছের মত শুকনো শরীর নিয়ে দাদী পড়ে আছেন। থেকে- থেকে বুকটা তাঁর গাঢ় নিঃম্বাসে উঠানামা করছে।
কান্নার মত কষ্ট হচ্ছে পিয়াসের। ছোট বেলায় মা মারা যাওয়ার পর বাবা যখন আর একটা বিয়ে করলেন। তখন দাদীই তাকে বুকে টেনে নিয়ে মানুষ করেছেন। মা‘র অভাব কোনো দিন বুঝতে দেননি। দাদীর বড় আদরে বড় হয়েছে পিয়াস। ভাত মেখে খায়িয়েছেন- গোছল করিয়েছেন। সেই দাদী আজ মারা যাচ্ছেন। এ কষ্ট যেন সে রাখতে পাছে না।
রাতে খাওয়া-দাওয়ার পর অনেক সাধনায় নীলাকে একটু একা পাওয়া গেলো। ব্যাগ থেকে শাড়ি-কাপড় বের করছিল। পিয়াস যেয়ে বললো, ‘নীলা তোর সাথে কিছু কথা আছে।’
‘কী কথা, বল।’
‘একটা জিনিস চাইবো, দিবি ?’
‘কী ?’
পিয়াস মন মরা করে মেঝের দিকে তাকিয়ে বললো, ‘চাঁদনির মোবাইল নাম্বারটা দিবি।’
কথাটা শুনে নীলা যেনো খুব অবাক হলো। বললো, ‘কেনো তোর সাথে ওর যোগাযোগ নেই ?’
পিয়াস শিুশুদের মত নাক ফুলিয়ে বললো, ‘ওর সাথে ঝগড়া হয়েছে। আমি রাগ করে নাম্বার ডিলেট করে ফেলেছি। এক বছর ওর সাথে কোনো যোগাযোগ নেই।’
তারপর একটু থেমে বললো, ‘এই এক বছরে ও কোনোদিনও কল দেয়নি।’
‘বলিস কি ? এমন র্দুদান্ত প্রেম শেষ করলি কেমন করে ?’
‘আর বলিসনে একদিন আমার মোবাইলে ওয়েটিং দেখে সে কী ঝগড়া শুরু করলো। তারপর এক কথায় দুই কথায় বেঁধে গেলো।’
পিয়াস ফকিরের মত বললো, ‘দে না ! ওর নাম্বারটা।’
‘ভাইয়া, বিয়ের পর তো কারো সাথে আমার আর কোনো যোগাযোগ নেই। মোবাইল ফোনই তো ব্যবহার করা বন্ধ করে দিয়েছি। সিম-টিম তো সব ফেলে দিয়েছি। কোথায় নাম্বার পাবো বল।’
চাঁদনি হচ্ছে নীলার কাছের বান্ধবীদের মধ্যে একজন।
পিয়াস যখন ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা দিয়ে ঝালোকাটি গিয়েছিল ছোট ফুপুর বাড়িতে বেড়াতে, তখন চাঁদনির সাথে পরিচয় হয়। চমৎকার একটা মেয়ে। ও ঝালোকাটি মহিলা কলেজে পড়তো।
পিয়াস নীলা আর চাঁদনি পুরো ঝালোকাটি চষে বেড়িয়েছে। ঘুরে বেড়িয়েছে এখানে-সেখানে। কত জায়গায়ই না তারা ঘুরেছে- সুজাবাদের কেল্লা, ঘোষাল রাজবাড়ি, সাতুরিয়া জমিদার বাড়ি, কবি জীবনানন্দ দাশের মামা বাড়ি।
ধানসিঁড়ি নদীর পাশে বসে তারা কত গল্প করেছে। কবি জীবনানন্দ দাশকে চিনিয়েছে চাঁদনি। সেই ধানসিঁড়ি নদীর জল মেখে তারা কবিতায় ভিজেছে। মেয়েটা দারুণ কবিতা পছন্দ করে। জীবনানন্দ দাশের পঞ্চান্নটা কবিতা তার মুখস্থ।
কী সুন্দর কবিতা বলে মেয়েটা-
‘তুমি তা জানো না কিছু- না জানিলে
আমার সকল গান তবুও তোমারে লক্ষ্য করে;
যখন ঝরিয়া যাবো হেমন্তের ঝড়ে-
পথের পাতার মতো তুমিও তখন
আমার বুকের’ পরে শুয়ে রবে’
কবিতার মত সুন্দর মেয়েটাকে পিয়াস অভিমানে হারিয়ে ফেলেছে। ভালোবেসে যার নাম দিয়ে ছিল ‘চন্দ্রাবতী’।
1 মন্তব্যসমূহ
গল্পটা জমলো না ঠিক।
উত্তরমুছুনঅনেক টাইপ ভুল আছে।