তেতাল্লিশ বছর বয়সে লোকটির শখ হয়েছে জীবনকে অন্যভাবে গড়তে। কিছু স্বপ্ন ওকে তাড়িত করছে। ও অন্যের জমি চাষ করে জীবনধারণের মতো পরগাছা বৃত্তি ত্যাগ করতে চায় এবং অনাকাক্সিক্ষত সন্তানের পিতা হওয়ার দায়ভার থেকে নিজেকে মুক্ত করতে চায়।
লোকটির নাম মান্নান। গাঁয়ের লোকের মুখে মুখে কিভাবে যেন মউন্যা হয়ে গেছে। মাংসহীন, মেদহীন, কুচকুচে কালো শরীর, লম্বায় ছয় ফুটের কাছাকাছি। লোক বলে ওর উন্নত খাড়া নাক বেঁকে গিয়ে দাঁড়কাকের ঠোঁটের মতো দেখায়, সেজন্য ওকে সবাই কাউয়া মউন্যা বলে। নামের বিকৃতির জন্য ওর মনের গভীরে দুঃখ আছে। ও বুঝে যায় কাছে প্রতিবাদ করতে পারে না। ওই নামে ডাকলে সাড়া দেয়, গাঁয়ের ছেলেমেয়েরা পেছন পেছন ওই নাম ধরে ডেকে তামাসা করলে উপেক্ষা করে। হাঁটতে হাঁটতে অন্যমনস্ক হয়ে যায়। মাথা নেমে আসে বুকের কাছাকাছি। লোকটির ক্রোধে উদ্দীপিত হয় না, দুঃখে পীড়িত হয়ে খালের ধারে বসে থাকে। কেউ বুঝতে পারে না যে, ও অসম্ভব আত্মকেন্দ্রিক। ওর বুকের ভেতরে ফসলের মাঠ আছে, ফসলহীন ধু-ধু প্রান্তর আছে, একটা কিছু যোগাড় করে এ বেড়ি ভেঙে বেরিয়ে যাওয়ার আপ্রাণ চেষ্টায় ও ছিন্নভিন্ন। যতো সহজে ও লোকের কথায় ওঠে-বসে, ছুটে কাজ করে ততো সহজ ও নয়। লাঙ্গলের ফলার মতো চিরে যাওয়া মাটি ও নিজে, নিজেকে প্রতিনিয়ত খুঁড়ে খুঁড়ে বাসনার বীজ বোনে। কিন্তু ওর ঘোলাটে দৃষ্টি এবং চোয়াল-ওঠা চেহারায় কেউ তা বুঝতে পারে না। গাঁয়ের চেয়ারম্যান সবার সামনে হাসতে হাসতে বলে, কাউয়া মউন্যা একটা বলদ।
গত রাতে সায়দার সঙ্গে ওর ঝগড়া হয়েছে। সায়দা শারীরিক দিক থেকে যতো রুগণ এবং কৃশ হচ্ছে, ততো ওর জিহ্বা শাণিত হয়ে উঠেছে। বলেছে, ওর পুরুষাঙ্গ কেটে ফেলা উচিত। যে বাপ ছেলেমেয়েদের খেতে দিতে পারে না, তার আবার বাপ হওয়া কিসের জন্য? লোকটি বৌর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। আচ্ছা করে পিটিয়েও নিজের রাগ ঠান্ডা করতে পারেনি। এখন ও দ্রুতপায়ে মাঠের মাখখান দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। বেলা দশটার মতো হবে, ওর অনুমান। কম কিংবা বেশি হতে পারে। দু’পাশে বিস্তীর্ণ কাটা ধু-ধু মাঠ মাঝে-মধ্যে ও হাতের তালু দিয়ে কপাল ঢেকে রোদ আড়াল করে। বৈশাখের তীব্র রোদে চোখমুখ ধাঁধিয়ে যাচ্ছে। আলের ওপর দিয়ে হাঁটছে বলে কখনো ইঁদুরের গর্তে পা পড়ে যায়। লোকটির পায়ের গতিতে অস্বাভাবিক দ্রুততা। কখনও হোঁচট খেয়ে পড়ে যাওয়া কোনো রকমে সামলে নেয়। ও রাস্তার ধারে বসে পড়ে পা ছড়িয়ে দেয়। সামান্য বিশ্রাম দরকার। ও যাচ্ছে সদর হাসপাতালে। নিজেকে নিবীর্য করার বাসনা এখন ওর মধ্যে প্রবল। গত রাতে বউর সামনে দম্ভ করে এ কথাই ঘোষণা করেছে।
নিবীর্য হয়ে যাওয়ার পর লোকটির দুদিন মন খারাপ থাকে। নিজেকে কেমন অচেনা লাগে, কিছুতেই স্বস্তি পায় না। তখন ওর মনে হয় ও কি আসলেই কাক হয়ে গেল? ভাত খেতে পারে না, অর্ধেক ভাত খেয়ে ঘরের বাইরে চলে আসে। বিড়ি ধরানোর জন্য দিয়াশলাই জ্বালাতে গিয়ে ওর হাত কাঁপে ঠকঠক করে। অসম্ভব আতঙ্কে বিস্ফোরিত হয়ে যায় ওর দৃষ্টি, কেবলই মনে হয় কী যেন নেই ওর ভেতরে। কিন্তু না শরীর হালকা মনে হয় না, হাঁটতে কষ্ট নেই, ওর খিদে পায়, পিপাসাও। তবে কি সায়দার কাছে ছোটো হয়ে গেল বলে ওর এমন হচ্ছে? সায়দা কি ওকে করুণা করবে? ও বিড়ি টানতে পারে না, ছুড়ে ফেলে দিয়ে ক্রুদ্ধ পায়ে বউর সামনে এসে দাঁড়ায়। সায়দা বারান্দায় বসে ক্ষুদ-কুঁড়া ভরা চাল বাছছিল, জাউ রাঁধবে। একটু আগে করিমুদ্দিনের বাড়ি থেকে ধান ভেঙে ফিরেছে। করিমুদ্দিনের বৌর সঙ্গে চালের হিসাব নিয়ে মন কষাকষি হয়েছে। ঝগড়া করার সাহস নেই ওর, তাই নিজের ওপরই মেজাজ খারাপ। শুধু নিজের ওপরই নয়, কোনো কারণ ছাড়াই কাউয়া মউন্যার ওপর ও রেগে থাকে। ক্লান্ত, ঘর্মাক্ত শরীর, প্রচ- খিদে চারদিক আঁধার করে রেখেছে। সায়দা স্বামীর দিকে ভ্রƒক্ষেপ করে না। টের পায় না লোকটির ক্রোধ, দেখে না ওর আগুনে-দৃষ্টি। ও রগ ওঠা দুহাতে কুলো তুলে ধরে, বাতাসে উড়ে যায় চালের তুষ। এই লোকটিকে নিয়ে ওর কোনো সুখ-দুঃখ নেই। সবকিছুই নিয়মমাফিক চলে। সুখ বা দুঃখের আবেগ সায়দাকে তাড়িত করে না। যাকে নিয়ে ভালোলাগা নেই তাকে নিয়ে মাথাব্যথা কি?
ও সানুর মা?
লোকটি পা দাপায়। সায়দা প্রথমে অবাক হয়, তারপর নিষ্পৃৃহ ভঙ্গিতে তাকায়, কী কন?
ওর হাতের কুলো থেমে গেছে। ওর মুখের ঘামে চালের কুঁড়ো লেগে আছে। ও হাতের কাজ দ্রুত সারতে চায়। ওর ঠোঁট বেঁকে ওঠে। লোকটির মনে হয় সায়দার ঠোঁটের কোণে সূক্ষ্ম হাসি। ও প্রাণপণে হাসি লুকোতে চাইছে, কিন্তু পারছে না। তাই হাসি আসা-যাওয়া করছে সায়দার ঠোঁটে। এমন হাসি যে ও ছাড়া আর কেউ দেখতে পাবে না।
সায়দা ওর দিকে তাকিয়েই থাকে। ওর চোখ চি-ক-চি-ক করে। কুঁড়ো লেগে থাকায় ওর মুখে আলগা আভার চিকনাই।
লোকটি মাটিতে পা দাপিয়ে বলে, তুমি হাসো কেন?
হাসলাম কখন?
সায়দা বিস্মিত না হয়ে পারে না। লোকটি পাগল হলো নাকি? তারপর মুখ বেঁকিয়ে বলে, যেই সুখে আছে তারপরও আবার হাসি?
সায়দা হাতের কাজে মনোযোগী হয়। এসব বাজে কথায় সময় নষ্ট করার মানে নেই। জাউ না হলে ছেলেমেয়েগুলো খাওয়ার জন্য জুলুম করবে। লোকটি নিজের গোঁতে অবিচল থেকে চিৎকার করে, আমি দেখলাম তোমাকে হাসতে। ভাবছো আমি বোকা, কিছুই বুঝি না। আমার দিকে এখন তুমি বাঁকা চোখে তাকাও?
সায়দা রেগে যায়। মুখ ঝামটা দিয়ে বলে, ওই জন্যে মানুষ আপনেরে কাউয়া বলে। তাই বলে তুমি বলবা? আমি কাউয়া না কি দেখাচ্ছি?
লোকটি কয়েক ঘা দমাদম লাগিয়ে দেয়। সায়দা গড়িয়ে পড়ে, ছড়িয়ে যায় কুলোর চাল। পেটে অসম্ভব খিদে নিয়ে ও বিনিয়ে-বিনিয়ে কাঁদে। লোকটি এমন করেই ওর সঙ্গে পনের বছর ঘর করল। ওর বুখ ফেটে যায়।
লোকটি ঘরে ঢুকে চৌকিতে বসে বিড়ি ধরায়, তারপর চিত হয়ে শুয়ে পায়ের ওপর পা উঠিয়ে দেয়। বিড়ির সুখটানের সঙ্গে ও বউর কান্না শোনে। ওর আনন্দ হয়, তৃপ্তির স্রোত বয়ে যায় শরীরে। ও বুঝে যায় যে ওর ভেতর থেকে কিছুই বেরিয়ে যায়নি। ওর কোনো ক্ষয় হয়নি, ও কিছুই হারায়নি। ও এখনো এক শক্তিমান পুরুষ। সায়দার মতো একশটা মেয়েমানুষকে কাবু করে রাখতে পারে।
একটা বিড়ি ফুরিয়ে যাবার পরও আর একটা ধরায়। ও কিছুটা নিরাসক্ত দৃষ্টিতে সবকিছু ভাবতে চায়। ইচ্ছে করলেই ও সায়দাকে বাদ দিয়ে অন্য নারী ঘরে আনতে পারে। শুধু ইচ্ছে আর কিছু লাগে না। সিদ্দিক সাতটি বিয়ে করেছে, একটি ছেড়েছে, অন্যটি এনেছে। মেয়ে মানুষ এখানে এমনই সস্তা। কিন্তু ও ভেবে দেখল একনারী থেকে অন্য নারী? লাভ কি? সেই তো একই খোঁয়াড়। এর বাইর খোলামেলা জীবন চায় ও। লোকটির বদমাইশি বুদ্ধি নেই, কিন্তু নিজের সঙ্গে খেলতে ভালোবাসে। নিজের প্রতি ভালোবাসা এবং পেষণের মধ্যদিয়ে ও এ ধরনের আত্মরতিতে মগ্ন। বউকে ও ভালোবাসা না, সে তার প্রয়োজন। সন্তানদের প্রতিও তেমন টান নেই। তাই পাঁচটি সন্তান জন্মানোর পর নিজের ওপর বিরক্ত হয়ে ওঠে। এখন ও সেই যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেয়েছে। খোলামেলা জীবনের একটি স্বপ্ন সফল হয়েছে। আর একটি হলেই হয়। ও নিজের জমি চায়Ñ পরগাছা জীবনের কষ্ট যাতে লালন করতে না হয় সেজন্য ও জমি চায়। গতকাল ও রাগে-দুঃখে আমগাছের ডাল থেকে পরগাছা উপড়ে ফেলেছে। শেকড়বিহীন জীবন কি একটা জীবন হলো? তেতাল্লিশ বছরের জীবন লোকটার কাছে চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ও আবার নিজেকে গড়বে।
সায়দার কান্না থেমে এসেছে, এখন হেঁচকি তুলছে। এই থেমে যাওয়া লোকটির পছন্দ হচ্ছে না। ও দ্রুত উঠে আসে। সায়দা উঠে বসেছে, চাল কুড়িয়ে নিচ্ছে। তুষে মাখামাখি হয়ে আছে ওর হাত।
লোকটি ধমকে ওঠে, কাঁদা থামল কেন? কাঁদো আরো কাঁদো?
সায়দা কথা বলে না। আঁচলে চোখ মোছে। এই লোকটির সঙ্গে এমন করেই ঘর করল। না পেল পেটভরে ভাত, না পেল আদর সোহাগ।
কথা বল না যে?
সায়দা ফোঁস করে ওঠে, মরতে পারো না, সব জ্বালা জুড়ায়।
ও জ্বালা জুড়ায়? দেখাচ্ছি?
লোকটির আবার মারে। সায়দাও হিংস্র হয়ে কুলো নিয়ে তেড়ে ওঠে। ওর এই আকস্মিক আক্রমণে লোকটি চুপসে যায়। দু’চার ঘা খেয়েও সায়দা আর কাঁদে না। লোকটি উঠোনে নেমে আসে। নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়িয়ে সায়দাকে দেখে। ও গ-জ-গ-জ করছে, নিচুস্বরে গাল দিচ্ছে, আল্লাহর কাছে মরণ চাইছে। সায়দার কান্না না শুনে লোকটার খারাপ লাগছে। ও বাড়ির বাইরে চলে আসে। কাঁচা রাস্তাটা সোজা চল গেছে বাজারে, সেখান থেকে লঞ্চঘাট। আজ ও কাজে যায়নি। হাসপাতাল থেকে লুঙ্গি আর একশটি টাকা নিয়ে আসার সময় ডাক্তার বলেছিল সপ্তাখানেক বিশ্রাম নিতে। ও রাস্তা থেকে নেমে জলাজমিতে পা ডুবিয়ে বসে। গলার কাছে জ্বলে যাচ্ছে, চুকা ঢেঁকুর উঠছে। কতদিন আর এভাবে বেঁচে থাকবে ও? কতদিন কাজ করতে বিদ্রোহী হয়ে উঠেছে মন, এমন এক টুকরো জমি ওর হয় না কেন? সারাজীবনই কি পরের জমিতে খাটবে? সন্ধ্যায় মহাজনের বাড়িতে পাওনা আনতে গেলে মহাজন কুতকুতে চোখে তাকায়। পরিশ্রমে ক্লান্ত শরীর ভেঙে পড়ে। মহাজন দাঁত বের করে বলে, মউন্যা মুখ কালা ক্যা? মুখ কালা কেন একথা বলতে পারলে তো নিজেকে ভারমুক্ত করতে পারত। কিন্তু বলা হয় না, বলতে পারে না, অত শক্তি অর্জন করা কি সম্ভব? ভূমিহীন চাষির কি মেরুদ- থাকে? বললে হা-হা করে হাসবে মহাজন, তারপর ওকে একটা সত্যিকারের কাক বানিয়ে ছেড়ে দেবে। তাই চুপ করে থাকে লোকটি তখন ভেতর থেকে ভাত আসে ওদের জন্য, সঙ্গে মিষ্টি আলুর তরকারি আর খেসারির ডাল। প্রতিদিনই এমন খাবার। সকালে কাঁচামরিচ আর লবণ দিয়ে পান্তা, সন্ধ্যায় সামান্য তরকারি। এটুকু খেতে পেলে অন্যদের কালো মুখ সাদা হয়, কিন্তু লোকটির হয় না। ও ময়লা নোংরা খেয়ে কাকের মতো পরিতৃপ্ত হতে পারে না। ওর ভেতরে অতৃপ্তি জমাট হয়ে থাকে। গামছায় সোয়া সের চাল বেঁধে ঘরে ফিরলে সায়দা মুখিয়ে থাকে। শুরু হয় ঝগড়া। প্রতিদিনই এমন। ও উপেক্ষা করে হোগলার পাটি পেতে গড়িয়ে পড়ে, তেল চিটচিটে বালিশ থেকে গন্ধ আসে। কুপি জ্বালিয়ে ভাত রাঁধে সায়দা। খেতে খেতে রাত হয়ে যায়। ছেলেমেয়েগুলো ঘুম থেকে টেনে তুলে খেতে দেয়। ততক্ষণে লোকটির নাক ডাকে। সায়দা ঘুমোতে এলে ও উঠে বাইরে যায়। অন্ধকারের ঘরে পেছনে পেসাব করতে বসে। মাথার ওপর পেঁচা ডাকে, বাতাসে শুকনো পাতা ঝরে। ওর ঘুম জড়ানো চোখে স্বপ্ন আটকে থাকে। ও ফিরে এসে আবার ঘুমিয়ে যায়। এসব ভাবতে ভাবতে লোকটির বুকের অস্থিরতা কমে যায়। ও পা দিয়ে পানি ছিটোয়। ছোটো-ছোটো তিতপুঁটি মাছগুলো ওর পায়ের কাছে ঘোরাফেরা করে। ও স্বচ্ছজলে নিজের ছায়া দেখে। বাঁকানো নাক, গভীর কালো চোখ, প্রশস্ত কপাল, লোকটির মনে হয় ওকে রূপকথার রাজপুত্রের মতো দেখাচ্ছে, কোথাও কাকের চিহ্ন নেই। তবু কেন ও কাক হয়েছে না কিছুতেই হবে না।
তখন রাস্তার ওপর থেকে মতলব ওকে ডাকে, ওই কাউয়া মইন্যা শুনে যা?
ও শুনেও শুনতে পায় না। দুবার তিনবার ডাকার পরও ঘাড় কাত করে তাকায়।
কিরে শুনতে পাস না?
মতলব রাস্তা থেকে ঢালুকে নেমে আসে।
তোর জন্য খবর আছে।
খবর?
ও চোখ বড়ো করে তাকায়। মতলব পাশে এসে বসে।
সরকার থেকে ঘোষণা হয়েছে হিলট্রাকে গিয়ে বসতি করলে সরকার জমি দেবে, ঘর তোলার টাকা দেবে।
জমি? বাড়ি?
লোকটির মাথা ঝিমঝির করে। মতলব হেসে বলে, বিশ্বাস হচ্ছে না বুঝি, যাবি? হিলট্রাক? অনেক দূর?
দূর আর কৈ? ছয় মাস পরপর আসবি। বউ-ছেলেমেয়ে নিয়ে গেলে আর ঝামেলা কী? অনেকে যাচ্ছে। গেলে বল, নাম লিখিয়ে দিই।
ভেবে দেখি।
লোকটি হাতের তালুর দিকে তাকিয়ে থাকে। অস্পষ্ট আঁকাবাঁকা রেখাগুলো দেখে। ওর দৃষ্টিতে নিষ্পৃহতা। রেখাগুলো বাড়তে বাড়তে সড়কের মতো বিশাল এবং প্রশস্ত হয়ে যায়। মতলব উঠে পড়ে। যেতে যেতে বল, গেলে কাল সকালে জানাস।
লোকটির করতলে মুখ চেপে ধরে। ইচ্ছে করে চলে যেতে, কিন্তু পিছু টেনে ধরে এই পরিচিত গ্রাম, তেতাল্লিশ বছরের জীবন। ওর বুক পোড়ে। ও শীতল জলে হাত ডুবিয়ে দেয়, অঞ্জলিভরে পানি তুলে চোখেমুখে ঝাপটা দেয়। যেতে চাই, জমি পাব, নিজের ফসল ঘরে তুলব না? না। প্রচ- এক না ওর সামনে এসে দাঁড়ায়। ভেতর থেকে চিৎকার করে ওঠে শৈশব, কৈশোর, যৌবন, নদী, নালা, খাল প্রান্তর। যেতে চাই, এখানে কাক হয়ে থাকব না? যেতে চাই, লোকটি ছটফটিয়ে ওঠে। দুপায়ে জল নেড়ে ঘোলা করে ফেলে। দ্রুত পায়ে রাস্তার ওপর এসে দাঁড়ায়। এখানে থাকলে কোনোদিন এক টুকর জমি ওর নিজের হবে না। ও জমি পাবে, ওর স্বপ্ন। নিজের জমির ফসল ঘরে ওঠাবে। হোক না হিলট্রাক ক্ষতি কী? লোকটি দৌড়াতে চায়। মতলব অনেক দূরে চলে গেছে, কালো ছায়ার মতো, দেখাচ্ছে ওকে। পরগাছা জীবন থেকে মুক্তির আনন্দ মুক্ত বাতাস হয়ে ওর দিকে ছুটে আসতে থাকে।
বাড়ি ফিরে এ কথা সায়দাকে বলতেই ওর চোখ বিস্ফোরিত হয়ে যায়। অসম্ভব তীক্ষèতায় চেঁচিয়ে ওঠে, না আমি যাব না!
সেই কণ্ঠস্বরে লোকটি থিতিয়ে যায়, আমাদের জমি হবে? নতুন ঘর উঠাবো। লাগবে না জমি।
সায়দা ঝাঁপিয়ে ওঠে।
বাপ-দাদার ভিটে ছেড়ে যাওয়ার শখ নেই।
বাপ-দাদার ভিটেয় তো দুই বেলা ভাতও জোটে না।
না খেয়ে মরাও ভালো।
সায়দার প্রবল আপত্তিতে লোকটি দমে যায়। ও রেগে উঠতে পারে না। ভেতরে কি যেন কম হয়ে গেছে। যেআবেগ নিয়ে ছুটে এসেছিল সে আবেগের জোর কমে গেছে, বারবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে বাপ-দাদার ভিটে। তবু কোনোরকমে শক্তি সঞ্চয় করে বলে, আমি কাক হয়ে থাকতে চাই না। সায়দা কথা বলে না। বেশি কথা বলা ওর অভ্যেস নয়। ও চুলোয় কাঠ গুঁজে দিয়ে ব্যস্ত হাতে খুন্তি নাড়ে। লোকটি একটুখানি এগিয়ে ওরে কাছে সরে বসে, ঠিক আছে আমি আগে গিয়ে ঘর-দুয়ার ঠিক করি। তারপর এসে তোমাদের নিয়ে যাব। দেখবে আমাদের সুখ হবে।
তোমার যা খুশি করগে।
আগুনের তাতে সায়দার মুখ লাল দেখায়। খোলা পিঠ বেয়ে দরদরিয়ে ঘাম নামছে। ঘাড়ের ওপর ছোটো খোঁপা, চুল খুবই কম। লোকটির ভেতর বিবমিষা জাগে, ও উঠে বাইরে আসে। এতক্ষণে নিজের ওপর রাগ হয়, সায়দাকে এত সাধারণ মনে হয় না। যেতে না চাইলে ও একাই যাবে। ও ভেবে দেখল আসলে একা যেতে ওর ভয় করছে। নদী-নালার দেশের লোক ও। হঠাৎ করে পাহাড়ি এলাকায় যাওয়ার সাহস কম। সেই জন্য কিছুটা সমর্থন চাইছে। আপাতত বউ ছাড়া তেমন কেউ নেই বলে সায়দাকে এত তেল দেওয়া, নইলে ও কি এসব পাত্তা দেওয়ার মানুষ?
ওর কথা শুনে হো-হো-হো-করে হাসে মতলব, একা কোথায়, গাঁয়ের কত লোক যাচ্ছে?
কত লোক? যাদের জমি নেই, খেতে পায় না যারা একটু নতুন আশ্রয়ের আশায় ছুটেছে।
মতলব ওকে খোঁচায়, কি, কথা বলিস না যে?
কালকে বলব।
আবার কালকে?
মতলব বিরক্ত হয়। লোকটি দ্বিধা কাটিয়ে উঠতে পারে না। স্বপ্ন এবং বাস্তবের টানপোড়ন ও নিজেকে ছিন্নভিন্ন করে।
তোর ভালোর জন্যই বলেছিলাম। না গেলে না যাবি।
আমার বউ যেতে চায় না।
মেয়ে মানুষের আবার কথা। গলায় দড়ি দিয়ে যেখানে টানবি সেখানে যাবে।
মতলবের বিশাল টাক চকচক করে। ঠোঁঠে চিকন হাসি।
আমার ভিটে কে দেখবে?
সেজন্য ভাবনা কী? আমি দেখব।
লোকটি কথা বলে না মতলব চলে গেলে প্রবল ঘৃণায় ও একদলা থুথু ফেলে, মেয়েমানুষ ছাগল তাকে গলায় দড়ি দিয়ে টেনে নিয়ে যাব আর ভিটে সোনা, উনি ওটা দেখবেন? যত্তসব, থুঃ আবার থুতু ছিটিয়ে দেয় ওর চারপাশে। তখন ও মনঃস্থির করে ফেলে, সায়দা ছেলেমেয়ে নিয়ে থাকুক, ও একাই যাবে। তারপর ওখানে গিয়ে সব ঠিকঠাক করলে, ভিটে বিক্রি করে দিয়ে সবাইকে নিয়ে চলে যাবে।
একদিন কাঁথা-বালিশ আর দুখানা লুঙ্গির বোঁচকা নিয়ে ও লঞ্চে ওঠে। গায়ে একটা ফতুয়া, কাঁধে গামছা, মাথায় পুটলি নিয়ে লোকটি ভিনদেশি হয়ে মানকিছড়ির কুমারি গ্রামে আসে। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে বিষণœতা কমে যায় লোকটির। স্থানীয় বাঙালিদের সঙ্গে পরিচিত হয় ওরা। আলাপ হয় মারমা উপজাতি লোকদের সঙ্গে। ওরা এখানে মিলেমিশে থাকে। স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান হরিকুমার মারমা। ষাট বছরের বুড়ো, মুখে অমায়িক হাসি। সারাক্ষণ হুঁকো টানে। লোকটির সঙ্গে আলাপ জমে যায়।
দিন পনেরো লাগে ওর ঘর তুলতে। তারপর কয়েকটি মাটির হাঁড়ি-থালা-গ্লাস কলসি কিনে ও গুছিয়ে সংসার পাতে। চেয়ারম্যান ওকে আব্দুল মান্নান ডাকে, আপনি করে কথা বলে। গামের মতো তুইতোকারি নেই, কাক হয়ে যাওয়া নেই। লোকটি দ্রুত অতীত ভুলতে থাকে। ওর তৃপ্তি পাহাড়ের পাদদেশে ব্যাপ্ত হয়ে যায়। ওর আত্মমগ্ন করতলে অসংখ্য রেখা গজায়। পাহাড়ের চূড়ার দিকে তাকালে সবুজ অরণ্য কিংবা নীলাভ কুয়াশা ওর দৃষ্টির দূসরতা মুছে দেয়। ও নতুনভাবে আবদুল মান্নান হয়ে ওঠে। এখানে না এলে ও কিছুতেই ভিন্ন জীবনের স্বাদ পেত না। সেজন্য ও মনে মনে মতলবকে মাফ করে দেয়। ও ঠিক করে ফেলে যে আর ফিরবে না নিজের গ্রামে। ছেলেমেয়েগুলো অন্যের বাসায় কাজ করে ভাত খাওয়ার মতো উপযুক্ত। ওদের কাছে ওর থাকা না থাকায় বড়ো রকমের হেরফের হবে না। আর সায়দা? সায়দা হয়ত মুক্তির নিশ্বাস ফেলবে। ভাবতেই ওর বুক খচ করে ওঠে। এই একটি জায়গায় নিজের পৌরুষ জেগে ওঠে। পরক্ষণে ও ঝেড়ে ফেলে। এই সব নষ্ট চিন্তা করে লাভ নেই। আগামীর কথা ভাবাই ভালো।
সারাদিন কাজ করে ও যা পায় তাতে ওর দিন ভালো চলে, অন্তত অভাবের তীব্রতা ওকে কাবু করে রাখে না। লোকটি মাটিতে শুয়ে পায়ের ওপর পা রেখে নাচায়। কুমারি গ্রামে একটা কিছু হওয়ার বাসনা ওকে তাড়িত করে। তবে স্থানীয় উপজাতিদের সঙ্গে কতটা পারবে তা ভেবে কুলিয়ে উঠতে পারে না। অনেক রাত পর্যন্ত হরিকুমার মারমার বারন্দায় বসে থাকে। এটা ওটা কথা বলে। এখনও জমির দখল পায়নি। কোন জায়গায় পাবে, কতটুকু পাবে সে নিয়ে আলাপ-আলোচনা হয়। ওর ধারণা জমির মালিক হলে একটা কিছু হওয়া যায়। ও এখন একটা কিছু হওয়ার চেষ্টা করছে। দুটি মুরগি পুষছে, যাতে প্রতিদিন একটা করে ডিম খাওয়া যায়। ইচ্ছে আছে ছাগল কেনার, তাহলে দুধের ব্যবস্থা হয়ে যাবে। রোজ ডিম দুধ খেলে ওকে ভদ্রলোক বলবে সবাই। হরিকুমার ওকে বলেছে কিছু টাকা ধার দেবে। পেলেই দুধেলা ছাগল স্বপ্নের তীব্রতায় ও আচ্ছন্ন থাকে। এসব স্বপ্ন নিয়ে ও নিজের সঙ্গে কথা বলে। খুব ভোরে ওঠে একহাঁড়ি ভাত রান্না করে। সারাদিন তাই খায়। এছাড়া উপায় নেই, কাজ করে সময় পাওয়া যায় না। প্রতি বেলায় ভাত খাওয়ার বাসনায় চকিতে ওর মনে বউয়ের স্বপ্ন উঁকি দেয়। না সায়দা নয়, আর কেউ, অন্য কেউ। এখানকার স্বাস্থ্যবতী, পরিশ্রমী মারমা মেয়েদের দেখে লোকটির বুকের ভেতর হাজার হাজার নিশ্বাস জমে থাকে। কেবলই মনে হয় এ জীবনে কিছুই পাওয়া হলো না। ও নিজের ভেতরে যৌবনের তেজ অনুভব করে। এখানকার আবদুর রবের সঙ্গে ওর বন্ধুত্ব হয়েছে। রব প্রায়ই আসে। নানা গল্প হয়। লোকটি গুণগুনিয়ে গান গাইলে রব গলা ছেড়ে গাইতে বলে। বলে, নদীর দেশের মানুষ আমরা পাহাড়ি এলাকায় এসে সবকিছু কেমন বদলে গেল গো? কথায় কথায় গো বলা ওর অভ্যাস। দুজনে একসঙ্গে বসলে কথা আর ফুরোয় না। সব গাঁয়ের কথা। রব পুরো পরিবার নিয়ে এসেছে, সঙ্গে বিধবা বোন আছে একটা। ও ভালোই আছে এখানে। তবু কথায় কথায় দুঃখ করে। এই দুঃখবোধ লোকটির মধ্যে নেই। ও ঘরের মাথায় লাউগাছ উঠিয়েছে। গাঁয়ে ও যখন গাছ লাগিয়েছে সেটা ছিল প্রয়োজন। এখন লাগায় আনন্দে এবং স্বপ্নে। মাসছয়েকের মধ্যে ও মোটামুটি সব গুছিয়ে ফেলে।
একদিন আবদুর রবকে ডিমেসেদ্ধ করে ছাগলের দুধ খাইয়ে কথাটা পাড়ে, রব আমি এখানে বিয়ে করতে চাই।
লোকটির গোঁফের ওপর লাজুক হাসি খেলে যায়। রব বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে থাকে। ও চোখ নামিয়ে বলে, সন্তোষ মারমার মেয়ে দেবীকে আমার খুব পছন্দ।
ও তো ছোট মেয়ে, বয়স আর কী?
লোকটি ফোঁস করে ওঠে, ছোট কই? কেমন ডাগর হয়ে উঠেছে।
রব হো-হো করে হেসে ওঠে, তুই তো বুড়িয়ে গেছিস। তোর বয়স তো অনেক। লোকটি রেগে যায়, রাগে থম করে থাকে। তখন রব ওকে বোঝায়, ওসব চিন্তা করিস না মান্নান। এরা সাংঘাতিক। এসব কথা শুনলে তোকে মেরেই ফেলবে। বন্ধুর মতো থাকবি দেখবি ওরা কত ভালো।
থাক উপদেশ দিস না।
লোকটি গোঁ গোঁ করে। ওরে চিৎকার করতে ইচ্ছে করে। কেন ও যাকে চায় তাকে পাবে না? ওতো পুরো গেরস্থ হয়েছে, বউ খাওয়ানোর যোগ্য হয়েছে। ওর কিসের অভাব?
রব মৃদুস্বরে বলে, তোর বউ আছে না মান্নান?
ওইটা আবার একটা বউ?
এমন করে বলতে নেই গো।
আবদুর রব বিশাল ঢেঁকুর তোলে। ঘরে একগাদা ছেলেমেয়ের যন্ত্রণায় তেমন কিছু খাওয়া হয় না। আজ ডিম-দুধ ওকে বেশ তৃপ্তি দিয়েছে।
আমি নতুন সংসার পাতব।
লোকটি দৃঢ়তার সঙ্গে ঘোষণা করে। আবদুর রব বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকে। ও এই লোকটির মতো জীবনকে এমন নতুন করে দেখতে পারেনি। এই লোকটির সাহস এবং ইচ্ছাশক্তি ওকে প্রেরণা যোগায়। কিন্তু পথে যেতে যেতে আবদুর রব লোকটিকে করুণা করে। ভাবে কাপুরুষ সংসারের দায়িত্ব থেকে পালিয়ে বাঁচতে চায়। যে নিজের স্ত্রী-পুত্র ত্যাগ করে সে মানুষ না, কিছুতেই না। ও বিড়বিড় করে, কাউয়া, হারামজাদা একটা কাউয়া। আপন সংসারে ফিরে এসে ও স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে। হোক একগাদা ছেলেমেয়ে, তবু সবই তো ওর আপন, ওরই ঔরসের।
না পাহাড়ি মেয়েকে বিয়ে করার স্বপ্ন ওর সফল হয় না। দু-এক জায়গায় কায়দা করে কথাটি পাড়তেই লোকজন তেড়ে ওঠে, এমন চিন্তা যেন মনে না আনে সে কথাও বলে দেয়। দুদিন লোকটি খুব বিষণœ থাকে। কাজে মন বসে না, রাঁধতে ভালো লাগে না। কিছু কাটতে গিয়ে কড়ই ছায়ায় বসে থেকে ভাবে, ভেবেছিল এক নারী থেকে অন্য নারী মানে খোঁয়াড়, কিন্তু তা নয়, তার আলাদা মূল্য আছে। এখন এই মূল্যের খোঁজে ও পাগল হয়ে যায়। লোকটির দিন যেন আর কাটে না।
শেষ পর্যন্ত আবদুর রবের বোন হালিমাকে বিয়ে করার কথা ও ভাবে। কথাটা পাড়তেই রব এক কথায় রাজি। তখন ওর মনে হয়, লোকটি বড় দুঃখী। কোনোদিন সুখ পায়নি, আহা বেচারা। মুহূর্তে খারিজ হয়ে যায় ওর কাপুরুষত্ব এবং কাক-জীবন। এভাবেই মানুষের কাছে বারবার অদল-বদল হয় আব্দুল মান্নান।
আমার বোনটি তোর সংসার সোনায় ভরে তুলবে রে দেখিস ও খুব ভালো মেয়ে। লোকটি ভুরু কুঁচকে বলে, তুইও একটা দায়িত্ব থেকে বাঁচলি।
আবদুল রব দুঃখ পায়।
এমন করে বলে না গো।
লোকটি হা হা করে হাসে। হাসতে হাসতে জগৎ-সংসার একাকার করে ফেলে।
ওর বুক ভরে ওঠে, ওর বুক খালি হয়ে যায়। ও নিজেকে চেনা-অচেনার ভেতর দিয়ে দীর্ঘ সময় পাড়ি দেয়। আবদুর রব ওকে যতো দেখে ততো ওর বিস্ময় বাড়ে। এই লোকটির ওর অচেনা থেকে যায়।
যেদিন হালিমাকে বিয়ে করে সন্ধ্যার পর ঘরে ফেরে সেদিন শান্তিবাহিনী আক্রমণ করে কুমারি গ্রাম। তখন গভীর রাত। হালিমার হাতে মেহেদি, পরনে নতুন ছাপ শাড়ি। লোকটি নতুন লুঙ্গি পরেছে। হালিমাকে বুকে নিয়ে ঘুমিয়ে আছে খড়ের বিছানায়।
দাউদাউ জ্বলে ওঠে ঘর। পুড়ে যায় শনে-ছাওয়া চাল, মুলি বাঁশের বেড়া। চারদিকে চিৎকার, গুলির শব্দ। লোকটি পাগলের মতো দরজা হাতড়ায়। হালিমার শরীরে আগুন, চড়চড় শব্দে ও পুড়ছে। ও দরজা খুঁজে পায় না। এত আলোর মাঝেও দেখতে পায় না কিছু। ও ফিরে তাকায় না। পুড়ে যাচ্ছে ওর শরীর, ও আগুনের মাঝ দিয়ে লাফিয়ে বাইরে আসে। ছুটে আসে একঝাঁক বুলেট। মুখ থুবড়ে পড়ে যায় ও। ঝাঁঝরা হয়ে যায় লোকটি।
পরদিন ভোরের আলো ফুটতে দেখা যায় কুমারি গ্রামের ধ্বংসযজ্ঞের মধ্যে একটি লোক পুড়ে গিয়ে অবিকল কাকের আকৃতিতে কুঁকড়ে পড়ে আছে।
লোকটির নাম মান্নান। গাঁয়ের লোকের মুখে মুখে কিভাবে যেন মউন্যা হয়ে গেছে। মাংসহীন, মেদহীন, কুচকুচে কালো শরীর, লম্বায় ছয় ফুটের কাছাকাছি। লোক বলে ওর উন্নত খাড়া নাক বেঁকে গিয়ে দাঁড়কাকের ঠোঁটের মতো দেখায়, সেজন্য ওকে সবাই কাউয়া মউন্যা বলে। নামের বিকৃতির জন্য ওর মনের গভীরে দুঃখ আছে। ও বুঝে যায় কাছে প্রতিবাদ করতে পারে না। ওই নামে ডাকলে সাড়া দেয়, গাঁয়ের ছেলেমেয়েরা পেছন পেছন ওই নাম ধরে ডেকে তামাসা করলে উপেক্ষা করে। হাঁটতে হাঁটতে অন্যমনস্ক হয়ে যায়। মাথা নেমে আসে বুকের কাছাকাছি। লোকটির ক্রোধে উদ্দীপিত হয় না, দুঃখে পীড়িত হয়ে খালের ধারে বসে থাকে। কেউ বুঝতে পারে না যে, ও অসম্ভব আত্মকেন্দ্রিক। ওর বুকের ভেতরে ফসলের মাঠ আছে, ফসলহীন ধু-ধু প্রান্তর আছে, একটা কিছু যোগাড় করে এ বেড়ি ভেঙে বেরিয়ে যাওয়ার আপ্রাণ চেষ্টায় ও ছিন্নভিন্ন। যতো সহজে ও লোকের কথায় ওঠে-বসে, ছুটে কাজ করে ততো সহজ ও নয়। লাঙ্গলের ফলার মতো চিরে যাওয়া মাটি ও নিজে, নিজেকে প্রতিনিয়ত খুঁড়ে খুঁড়ে বাসনার বীজ বোনে। কিন্তু ওর ঘোলাটে দৃষ্টি এবং চোয়াল-ওঠা চেহারায় কেউ তা বুঝতে পারে না। গাঁয়ের চেয়ারম্যান সবার সামনে হাসতে হাসতে বলে, কাউয়া মউন্যা একটা বলদ।
গত রাতে সায়দার সঙ্গে ওর ঝগড়া হয়েছে। সায়দা শারীরিক দিক থেকে যতো রুগণ এবং কৃশ হচ্ছে, ততো ওর জিহ্বা শাণিত হয়ে উঠেছে। বলেছে, ওর পুরুষাঙ্গ কেটে ফেলা উচিত। যে বাপ ছেলেমেয়েদের খেতে দিতে পারে না, তার আবার বাপ হওয়া কিসের জন্য? লোকটি বৌর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। আচ্ছা করে পিটিয়েও নিজের রাগ ঠান্ডা করতে পারেনি। এখন ও দ্রুতপায়ে মাঠের মাখখান দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। বেলা দশটার মতো হবে, ওর অনুমান। কম কিংবা বেশি হতে পারে। দু’পাশে বিস্তীর্ণ কাটা ধু-ধু মাঠ মাঝে-মধ্যে ও হাতের তালু দিয়ে কপাল ঢেকে রোদ আড়াল করে। বৈশাখের তীব্র রোদে চোখমুখ ধাঁধিয়ে যাচ্ছে। আলের ওপর দিয়ে হাঁটছে বলে কখনো ইঁদুরের গর্তে পা পড়ে যায়। লোকটির পায়ের গতিতে অস্বাভাবিক দ্রুততা। কখনও হোঁচট খেয়ে পড়ে যাওয়া কোনো রকমে সামলে নেয়। ও রাস্তার ধারে বসে পড়ে পা ছড়িয়ে দেয়। সামান্য বিশ্রাম দরকার। ও যাচ্ছে সদর হাসপাতালে। নিজেকে নিবীর্য করার বাসনা এখন ওর মধ্যে প্রবল। গত রাতে বউর সামনে দম্ভ করে এ কথাই ঘোষণা করেছে।
নিবীর্য হয়ে যাওয়ার পর লোকটির দুদিন মন খারাপ থাকে। নিজেকে কেমন অচেনা লাগে, কিছুতেই স্বস্তি পায় না। তখন ওর মনে হয় ও কি আসলেই কাক হয়ে গেল? ভাত খেতে পারে না, অর্ধেক ভাত খেয়ে ঘরের বাইরে চলে আসে। বিড়ি ধরানোর জন্য দিয়াশলাই জ্বালাতে গিয়ে ওর হাত কাঁপে ঠকঠক করে। অসম্ভব আতঙ্কে বিস্ফোরিত হয়ে যায় ওর দৃষ্টি, কেবলই মনে হয় কী যেন নেই ওর ভেতরে। কিন্তু না শরীর হালকা মনে হয় না, হাঁটতে কষ্ট নেই, ওর খিদে পায়, পিপাসাও। তবে কি সায়দার কাছে ছোটো হয়ে গেল বলে ওর এমন হচ্ছে? সায়দা কি ওকে করুণা করবে? ও বিড়ি টানতে পারে না, ছুড়ে ফেলে দিয়ে ক্রুদ্ধ পায়ে বউর সামনে এসে দাঁড়ায়। সায়দা বারান্দায় বসে ক্ষুদ-কুঁড়া ভরা চাল বাছছিল, জাউ রাঁধবে। একটু আগে করিমুদ্দিনের বাড়ি থেকে ধান ভেঙে ফিরেছে। করিমুদ্দিনের বৌর সঙ্গে চালের হিসাব নিয়ে মন কষাকষি হয়েছে। ঝগড়া করার সাহস নেই ওর, তাই নিজের ওপরই মেজাজ খারাপ। শুধু নিজের ওপরই নয়, কোনো কারণ ছাড়াই কাউয়া মউন্যার ওপর ও রেগে থাকে। ক্লান্ত, ঘর্মাক্ত শরীর, প্রচ- খিদে চারদিক আঁধার করে রেখেছে। সায়দা স্বামীর দিকে ভ্রƒক্ষেপ করে না। টের পায় না লোকটির ক্রোধ, দেখে না ওর আগুনে-দৃষ্টি। ও রগ ওঠা দুহাতে কুলো তুলে ধরে, বাতাসে উড়ে যায় চালের তুষ। এই লোকটিকে নিয়ে ওর কোনো সুখ-দুঃখ নেই। সবকিছুই নিয়মমাফিক চলে। সুখ বা দুঃখের আবেগ সায়দাকে তাড়িত করে না। যাকে নিয়ে ভালোলাগা নেই তাকে নিয়ে মাথাব্যথা কি?
ও সানুর মা?
লোকটি পা দাপায়। সায়দা প্রথমে অবাক হয়, তারপর নিষ্পৃৃহ ভঙ্গিতে তাকায়, কী কন?
ওর হাতের কুলো থেমে গেছে। ওর মুখের ঘামে চালের কুঁড়ো লেগে আছে। ও হাতের কাজ দ্রুত সারতে চায়। ওর ঠোঁট বেঁকে ওঠে। লোকটির মনে হয় সায়দার ঠোঁটের কোণে সূক্ষ্ম হাসি। ও প্রাণপণে হাসি লুকোতে চাইছে, কিন্তু পারছে না। তাই হাসি আসা-যাওয়া করছে সায়দার ঠোঁটে। এমন হাসি যে ও ছাড়া আর কেউ দেখতে পাবে না।
সায়দা ওর দিকে তাকিয়েই থাকে। ওর চোখ চি-ক-চি-ক করে। কুঁড়ো লেগে থাকায় ওর মুখে আলগা আভার চিকনাই।
লোকটি মাটিতে পা দাপিয়ে বলে, তুমি হাসো কেন?
হাসলাম কখন?
সায়দা বিস্মিত না হয়ে পারে না। লোকটি পাগল হলো নাকি? তারপর মুখ বেঁকিয়ে বলে, যেই সুখে আছে তারপরও আবার হাসি?
সায়দা হাতের কাজে মনোযোগী হয়। এসব বাজে কথায় সময় নষ্ট করার মানে নেই। জাউ না হলে ছেলেমেয়েগুলো খাওয়ার জন্য জুলুম করবে। লোকটি নিজের গোঁতে অবিচল থেকে চিৎকার করে, আমি দেখলাম তোমাকে হাসতে। ভাবছো আমি বোকা, কিছুই বুঝি না। আমার দিকে এখন তুমি বাঁকা চোখে তাকাও?
সায়দা রেগে যায়। মুখ ঝামটা দিয়ে বলে, ওই জন্যে মানুষ আপনেরে কাউয়া বলে। তাই বলে তুমি বলবা? আমি কাউয়া না কি দেখাচ্ছি?
লোকটি কয়েক ঘা দমাদম লাগিয়ে দেয়। সায়দা গড়িয়ে পড়ে, ছড়িয়ে যায় কুলোর চাল। পেটে অসম্ভব খিদে নিয়ে ও বিনিয়ে-বিনিয়ে কাঁদে। লোকটি এমন করেই ওর সঙ্গে পনের বছর ঘর করল। ওর বুখ ফেটে যায়।
লোকটি ঘরে ঢুকে চৌকিতে বসে বিড়ি ধরায়, তারপর চিত হয়ে শুয়ে পায়ের ওপর পা উঠিয়ে দেয়। বিড়ির সুখটানের সঙ্গে ও বউর কান্না শোনে। ওর আনন্দ হয়, তৃপ্তির স্রোত বয়ে যায় শরীরে। ও বুঝে যায় যে ওর ভেতর থেকে কিছুই বেরিয়ে যায়নি। ওর কোনো ক্ষয় হয়নি, ও কিছুই হারায়নি। ও এখনো এক শক্তিমান পুরুষ। সায়দার মতো একশটা মেয়েমানুষকে কাবু করে রাখতে পারে।
একটা বিড়ি ফুরিয়ে যাবার পরও আর একটা ধরায়। ও কিছুটা নিরাসক্ত দৃষ্টিতে সবকিছু ভাবতে চায়। ইচ্ছে করলেই ও সায়দাকে বাদ দিয়ে অন্য নারী ঘরে আনতে পারে। শুধু ইচ্ছে আর কিছু লাগে না। সিদ্দিক সাতটি বিয়ে করেছে, একটি ছেড়েছে, অন্যটি এনেছে। মেয়ে মানুষ এখানে এমনই সস্তা। কিন্তু ও ভেবে দেখল একনারী থেকে অন্য নারী? লাভ কি? সেই তো একই খোঁয়াড়। এর বাইর খোলামেলা জীবন চায় ও। লোকটির বদমাইশি বুদ্ধি নেই, কিন্তু নিজের সঙ্গে খেলতে ভালোবাসে। নিজের প্রতি ভালোবাসা এবং পেষণের মধ্যদিয়ে ও এ ধরনের আত্মরতিতে মগ্ন। বউকে ও ভালোবাসা না, সে তার প্রয়োজন। সন্তানদের প্রতিও তেমন টান নেই। তাই পাঁচটি সন্তান জন্মানোর পর নিজের ওপর বিরক্ত হয়ে ওঠে। এখন ও সেই যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেয়েছে। খোলামেলা জীবনের একটি স্বপ্ন সফল হয়েছে। আর একটি হলেই হয়। ও নিজের জমি চায়Ñ পরগাছা জীবনের কষ্ট যাতে লালন করতে না হয় সেজন্য ও জমি চায়। গতকাল ও রাগে-দুঃখে আমগাছের ডাল থেকে পরগাছা উপড়ে ফেলেছে। শেকড়বিহীন জীবন কি একটা জীবন হলো? তেতাল্লিশ বছরের জীবন লোকটার কাছে চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ও আবার নিজেকে গড়বে।
সায়দার কান্না থেমে এসেছে, এখন হেঁচকি তুলছে। এই থেমে যাওয়া লোকটির পছন্দ হচ্ছে না। ও দ্রুত উঠে আসে। সায়দা উঠে বসেছে, চাল কুড়িয়ে নিচ্ছে। তুষে মাখামাখি হয়ে আছে ওর হাত।
লোকটি ধমকে ওঠে, কাঁদা থামল কেন? কাঁদো আরো কাঁদো?
সায়দা কথা বলে না। আঁচলে চোখ মোছে। এই লোকটির সঙ্গে এমন করেই ঘর করল। না পেল পেটভরে ভাত, না পেল আদর সোহাগ।
কথা বল না যে?
সায়দা ফোঁস করে ওঠে, মরতে পারো না, সব জ্বালা জুড়ায়।
ও জ্বালা জুড়ায়? দেখাচ্ছি?
লোকটির আবার মারে। সায়দাও হিংস্র হয়ে কুলো নিয়ে তেড়ে ওঠে। ওর এই আকস্মিক আক্রমণে লোকটি চুপসে যায়। দু’চার ঘা খেয়েও সায়দা আর কাঁদে না। লোকটি উঠোনে নেমে আসে। নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়িয়ে সায়দাকে দেখে। ও গ-জ-গ-জ করছে, নিচুস্বরে গাল দিচ্ছে, আল্লাহর কাছে মরণ চাইছে। সায়দার কান্না না শুনে লোকটার খারাপ লাগছে। ও বাড়ির বাইরে চলে আসে। কাঁচা রাস্তাটা সোজা চল গেছে বাজারে, সেখান থেকে লঞ্চঘাট। আজ ও কাজে যায়নি। হাসপাতাল থেকে লুঙ্গি আর একশটি টাকা নিয়ে আসার সময় ডাক্তার বলেছিল সপ্তাখানেক বিশ্রাম নিতে। ও রাস্তা থেকে নেমে জলাজমিতে পা ডুবিয়ে বসে। গলার কাছে জ্বলে যাচ্ছে, চুকা ঢেঁকুর উঠছে। কতদিন আর এভাবে বেঁচে থাকবে ও? কতদিন কাজ করতে বিদ্রোহী হয়ে উঠেছে মন, এমন এক টুকরো জমি ওর হয় না কেন? সারাজীবনই কি পরের জমিতে খাটবে? সন্ধ্যায় মহাজনের বাড়িতে পাওনা আনতে গেলে মহাজন কুতকুতে চোখে তাকায়। পরিশ্রমে ক্লান্ত শরীর ভেঙে পড়ে। মহাজন দাঁত বের করে বলে, মউন্যা মুখ কালা ক্যা? মুখ কালা কেন একথা বলতে পারলে তো নিজেকে ভারমুক্ত করতে পারত। কিন্তু বলা হয় না, বলতে পারে না, অত শক্তি অর্জন করা কি সম্ভব? ভূমিহীন চাষির কি মেরুদ- থাকে? বললে হা-হা করে হাসবে মহাজন, তারপর ওকে একটা সত্যিকারের কাক বানিয়ে ছেড়ে দেবে। তাই চুপ করে থাকে লোকটি তখন ভেতর থেকে ভাত আসে ওদের জন্য, সঙ্গে মিষ্টি আলুর তরকারি আর খেসারির ডাল। প্রতিদিনই এমন খাবার। সকালে কাঁচামরিচ আর লবণ দিয়ে পান্তা, সন্ধ্যায় সামান্য তরকারি। এটুকু খেতে পেলে অন্যদের কালো মুখ সাদা হয়, কিন্তু লোকটির হয় না। ও ময়লা নোংরা খেয়ে কাকের মতো পরিতৃপ্ত হতে পারে না। ওর ভেতরে অতৃপ্তি জমাট হয়ে থাকে। গামছায় সোয়া সের চাল বেঁধে ঘরে ফিরলে সায়দা মুখিয়ে থাকে। শুরু হয় ঝগড়া। প্রতিদিনই এমন। ও উপেক্ষা করে হোগলার পাটি পেতে গড়িয়ে পড়ে, তেল চিটচিটে বালিশ থেকে গন্ধ আসে। কুপি জ্বালিয়ে ভাত রাঁধে সায়দা। খেতে খেতে রাত হয়ে যায়। ছেলেমেয়েগুলো ঘুম থেকে টেনে তুলে খেতে দেয়। ততক্ষণে লোকটির নাক ডাকে। সায়দা ঘুমোতে এলে ও উঠে বাইরে যায়। অন্ধকারের ঘরে পেছনে পেসাব করতে বসে। মাথার ওপর পেঁচা ডাকে, বাতাসে শুকনো পাতা ঝরে। ওর ঘুম জড়ানো চোখে স্বপ্ন আটকে থাকে। ও ফিরে এসে আবার ঘুমিয়ে যায়। এসব ভাবতে ভাবতে লোকটির বুকের অস্থিরতা কমে যায়। ও পা দিয়ে পানি ছিটোয়। ছোটো-ছোটো তিতপুঁটি মাছগুলো ওর পায়ের কাছে ঘোরাফেরা করে। ও স্বচ্ছজলে নিজের ছায়া দেখে। বাঁকানো নাক, গভীর কালো চোখ, প্রশস্ত কপাল, লোকটির মনে হয় ওকে রূপকথার রাজপুত্রের মতো দেখাচ্ছে, কোথাও কাকের চিহ্ন নেই। তবু কেন ও কাক হয়েছে না কিছুতেই হবে না।
তখন রাস্তার ওপর থেকে মতলব ওকে ডাকে, ওই কাউয়া মইন্যা শুনে যা?
ও শুনেও শুনতে পায় না। দুবার তিনবার ডাকার পরও ঘাড় কাত করে তাকায়।
কিরে শুনতে পাস না?
মতলব রাস্তা থেকে ঢালুকে নেমে আসে।
তোর জন্য খবর আছে।
খবর?
ও চোখ বড়ো করে তাকায়। মতলব পাশে এসে বসে।
সরকার থেকে ঘোষণা হয়েছে হিলট্রাকে গিয়ে বসতি করলে সরকার জমি দেবে, ঘর তোলার টাকা দেবে।
জমি? বাড়ি?
লোকটির মাথা ঝিমঝির করে। মতলব হেসে বলে, বিশ্বাস হচ্ছে না বুঝি, যাবি? হিলট্রাক? অনেক দূর?
দূর আর কৈ? ছয় মাস পরপর আসবি। বউ-ছেলেমেয়ে নিয়ে গেলে আর ঝামেলা কী? অনেকে যাচ্ছে। গেলে বল, নাম লিখিয়ে দিই।
ভেবে দেখি।
লোকটি হাতের তালুর দিকে তাকিয়ে থাকে। অস্পষ্ট আঁকাবাঁকা রেখাগুলো দেখে। ওর দৃষ্টিতে নিষ্পৃহতা। রেখাগুলো বাড়তে বাড়তে সড়কের মতো বিশাল এবং প্রশস্ত হয়ে যায়। মতলব উঠে পড়ে। যেতে যেতে বল, গেলে কাল সকালে জানাস।
লোকটির করতলে মুখ চেপে ধরে। ইচ্ছে করে চলে যেতে, কিন্তু পিছু টেনে ধরে এই পরিচিত গ্রাম, তেতাল্লিশ বছরের জীবন। ওর বুক পোড়ে। ও শীতল জলে হাত ডুবিয়ে দেয়, অঞ্জলিভরে পানি তুলে চোখেমুখে ঝাপটা দেয়। যেতে চাই, জমি পাব, নিজের ফসল ঘরে তুলব না? না। প্রচ- এক না ওর সামনে এসে দাঁড়ায়। ভেতর থেকে চিৎকার করে ওঠে শৈশব, কৈশোর, যৌবন, নদী, নালা, খাল প্রান্তর। যেতে চাই, এখানে কাক হয়ে থাকব না? যেতে চাই, লোকটি ছটফটিয়ে ওঠে। দুপায়ে জল নেড়ে ঘোলা করে ফেলে। দ্রুত পায়ে রাস্তার ওপর এসে দাঁড়ায়। এখানে থাকলে কোনোদিন এক টুকর জমি ওর নিজের হবে না। ও জমি পাবে, ওর স্বপ্ন। নিজের জমির ফসল ঘরে ওঠাবে। হোক না হিলট্রাক ক্ষতি কী? লোকটি দৌড়াতে চায়। মতলব অনেক দূরে চলে গেছে, কালো ছায়ার মতো, দেখাচ্ছে ওকে। পরগাছা জীবন থেকে মুক্তির আনন্দ মুক্ত বাতাস হয়ে ওর দিকে ছুটে আসতে থাকে।
বাড়ি ফিরে এ কথা সায়দাকে বলতেই ওর চোখ বিস্ফোরিত হয়ে যায়। অসম্ভব তীক্ষèতায় চেঁচিয়ে ওঠে, না আমি যাব না!
সেই কণ্ঠস্বরে লোকটি থিতিয়ে যায়, আমাদের জমি হবে? নতুন ঘর উঠাবো। লাগবে না জমি।
সায়দা ঝাঁপিয়ে ওঠে।
বাপ-দাদার ভিটে ছেড়ে যাওয়ার শখ নেই।
বাপ-দাদার ভিটেয় তো দুই বেলা ভাতও জোটে না।
না খেয়ে মরাও ভালো।
সায়দার প্রবল আপত্তিতে লোকটি দমে যায়। ও রেগে উঠতে পারে না। ভেতরে কি যেন কম হয়ে গেছে। যেআবেগ নিয়ে ছুটে এসেছিল সে আবেগের জোর কমে গেছে, বারবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে বাপ-দাদার ভিটে। তবু কোনোরকমে শক্তি সঞ্চয় করে বলে, আমি কাক হয়ে থাকতে চাই না। সায়দা কথা বলে না। বেশি কথা বলা ওর অভ্যেস নয়। ও চুলোয় কাঠ গুঁজে দিয়ে ব্যস্ত হাতে খুন্তি নাড়ে। লোকটি একটুখানি এগিয়ে ওরে কাছে সরে বসে, ঠিক আছে আমি আগে গিয়ে ঘর-দুয়ার ঠিক করি। তারপর এসে তোমাদের নিয়ে যাব। দেখবে আমাদের সুখ হবে।
তোমার যা খুশি করগে।
আগুনের তাতে সায়দার মুখ লাল দেখায়। খোলা পিঠ বেয়ে দরদরিয়ে ঘাম নামছে। ঘাড়ের ওপর ছোটো খোঁপা, চুল খুবই কম। লোকটির ভেতর বিবমিষা জাগে, ও উঠে বাইরে আসে। এতক্ষণে নিজের ওপর রাগ হয়, সায়দাকে এত সাধারণ মনে হয় না। যেতে না চাইলে ও একাই যাবে। ও ভেবে দেখল আসলে একা যেতে ওর ভয় করছে। নদী-নালার দেশের লোক ও। হঠাৎ করে পাহাড়ি এলাকায় যাওয়ার সাহস কম। সেই জন্য কিছুটা সমর্থন চাইছে। আপাতত বউ ছাড়া তেমন কেউ নেই বলে সায়দাকে এত তেল দেওয়া, নইলে ও কি এসব পাত্তা দেওয়ার মানুষ?
ওর কথা শুনে হো-হো-হো-করে হাসে মতলব, একা কোথায়, গাঁয়ের কত লোক যাচ্ছে?
কত লোক? যাদের জমি নেই, খেতে পায় না যারা একটু নতুন আশ্রয়ের আশায় ছুটেছে।
মতলব ওকে খোঁচায়, কি, কথা বলিস না যে?
কালকে বলব।
আবার কালকে?
মতলব বিরক্ত হয়। লোকটি দ্বিধা কাটিয়ে উঠতে পারে না। স্বপ্ন এবং বাস্তবের টানপোড়ন ও নিজেকে ছিন্নভিন্ন করে।
তোর ভালোর জন্যই বলেছিলাম। না গেলে না যাবি।
আমার বউ যেতে চায় না।
মেয়ে মানুষের আবার কথা। গলায় দড়ি দিয়ে যেখানে টানবি সেখানে যাবে।
মতলবের বিশাল টাক চকচক করে। ঠোঁঠে চিকন হাসি।
আমার ভিটে কে দেখবে?
সেজন্য ভাবনা কী? আমি দেখব।
লোকটি কথা বলে না মতলব চলে গেলে প্রবল ঘৃণায় ও একদলা থুথু ফেলে, মেয়েমানুষ ছাগল তাকে গলায় দড়ি দিয়ে টেনে নিয়ে যাব আর ভিটে সোনা, উনি ওটা দেখবেন? যত্তসব, থুঃ আবার থুতু ছিটিয়ে দেয় ওর চারপাশে। তখন ও মনঃস্থির করে ফেলে, সায়দা ছেলেমেয়ে নিয়ে থাকুক, ও একাই যাবে। তারপর ওখানে গিয়ে সব ঠিকঠাক করলে, ভিটে বিক্রি করে দিয়ে সবাইকে নিয়ে চলে যাবে।
একদিন কাঁথা-বালিশ আর দুখানা লুঙ্গির বোঁচকা নিয়ে ও লঞ্চে ওঠে। গায়ে একটা ফতুয়া, কাঁধে গামছা, মাথায় পুটলি নিয়ে লোকটি ভিনদেশি হয়ে মানকিছড়ির কুমারি গ্রামে আসে। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে বিষণœতা কমে যায় লোকটির। স্থানীয় বাঙালিদের সঙ্গে পরিচিত হয় ওরা। আলাপ হয় মারমা উপজাতি লোকদের সঙ্গে। ওরা এখানে মিলেমিশে থাকে। স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান হরিকুমার মারমা। ষাট বছরের বুড়ো, মুখে অমায়িক হাসি। সারাক্ষণ হুঁকো টানে। লোকটির সঙ্গে আলাপ জমে যায়।
দিন পনেরো লাগে ওর ঘর তুলতে। তারপর কয়েকটি মাটির হাঁড়ি-থালা-গ্লাস কলসি কিনে ও গুছিয়ে সংসার পাতে। চেয়ারম্যান ওকে আব্দুল মান্নান ডাকে, আপনি করে কথা বলে। গামের মতো তুইতোকারি নেই, কাক হয়ে যাওয়া নেই। লোকটি দ্রুত অতীত ভুলতে থাকে। ওর তৃপ্তি পাহাড়ের পাদদেশে ব্যাপ্ত হয়ে যায়। ওর আত্মমগ্ন করতলে অসংখ্য রেখা গজায়। পাহাড়ের চূড়ার দিকে তাকালে সবুজ অরণ্য কিংবা নীলাভ কুয়াশা ওর দৃষ্টির দূসরতা মুছে দেয়। ও নতুনভাবে আবদুল মান্নান হয়ে ওঠে। এখানে না এলে ও কিছুতেই ভিন্ন জীবনের স্বাদ পেত না। সেজন্য ও মনে মনে মতলবকে মাফ করে দেয়। ও ঠিক করে ফেলে যে আর ফিরবে না নিজের গ্রামে। ছেলেমেয়েগুলো অন্যের বাসায় কাজ করে ভাত খাওয়ার মতো উপযুক্ত। ওদের কাছে ওর থাকা না থাকায় বড়ো রকমের হেরফের হবে না। আর সায়দা? সায়দা হয়ত মুক্তির নিশ্বাস ফেলবে। ভাবতেই ওর বুক খচ করে ওঠে। এই একটি জায়গায় নিজের পৌরুষ জেগে ওঠে। পরক্ষণে ও ঝেড়ে ফেলে। এই সব নষ্ট চিন্তা করে লাভ নেই। আগামীর কথা ভাবাই ভালো।
সারাদিন কাজ করে ও যা পায় তাতে ওর দিন ভালো চলে, অন্তত অভাবের তীব্রতা ওকে কাবু করে রাখে না। লোকটি মাটিতে শুয়ে পায়ের ওপর পা রেখে নাচায়। কুমারি গ্রামে একটা কিছু হওয়ার বাসনা ওকে তাড়িত করে। তবে স্থানীয় উপজাতিদের সঙ্গে কতটা পারবে তা ভেবে কুলিয়ে উঠতে পারে না। অনেক রাত পর্যন্ত হরিকুমার মারমার বারন্দায় বসে থাকে। এটা ওটা কথা বলে। এখনও জমির দখল পায়নি। কোন জায়গায় পাবে, কতটুকু পাবে সে নিয়ে আলাপ-আলোচনা হয়। ওর ধারণা জমির মালিক হলে একটা কিছু হওয়া যায়। ও এখন একটা কিছু হওয়ার চেষ্টা করছে। দুটি মুরগি পুষছে, যাতে প্রতিদিন একটা করে ডিম খাওয়া যায়। ইচ্ছে আছে ছাগল কেনার, তাহলে দুধের ব্যবস্থা হয়ে যাবে। রোজ ডিম দুধ খেলে ওকে ভদ্রলোক বলবে সবাই। হরিকুমার ওকে বলেছে কিছু টাকা ধার দেবে। পেলেই দুধেলা ছাগল স্বপ্নের তীব্রতায় ও আচ্ছন্ন থাকে। এসব স্বপ্ন নিয়ে ও নিজের সঙ্গে কথা বলে। খুব ভোরে ওঠে একহাঁড়ি ভাত রান্না করে। সারাদিন তাই খায়। এছাড়া উপায় নেই, কাজ করে সময় পাওয়া যায় না। প্রতি বেলায় ভাত খাওয়ার বাসনায় চকিতে ওর মনে বউয়ের স্বপ্ন উঁকি দেয়। না সায়দা নয়, আর কেউ, অন্য কেউ। এখানকার স্বাস্থ্যবতী, পরিশ্রমী মারমা মেয়েদের দেখে লোকটির বুকের ভেতর হাজার হাজার নিশ্বাস জমে থাকে। কেবলই মনে হয় এ জীবনে কিছুই পাওয়া হলো না। ও নিজের ভেতরে যৌবনের তেজ অনুভব করে। এখানকার আবদুর রবের সঙ্গে ওর বন্ধুত্ব হয়েছে। রব প্রায়ই আসে। নানা গল্প হয়। লোকটি গুণগুনিয়ে গান গাইলে রব গলা ছেড়ে গাইতে বলে। বলে, নদীর দেশের মানুষ আমরা পাহাড়ি এলাকায় এসে সবকিছু কেমন বদলে গেল গো? কথায় কথায় গো বলা ওর অভ্যাস। দুজনে একসঙ্গে বসলে কথা আর ফুরোয় না। সব গাঁয়ের কথা। রব পুরো পরিবার নিয়ে এসেছে, সঙ্গে বিধবা বোন আছে একটা। ও ভালোই আছে এখানে। তবু কথায় কথায় দুঃখ করে। এই দুঃখবোধ লোকটির মধ্যে নেই। ও ঘরের মাথায় লাউগাছ উঠিয়েছে। গাঁয়ে ও যখন গাছ লাগিয়েছে সেটা ছিল প্রয়োজন। এখন লাগায় আনন্দে এবং স্বপ্নে। মাসছয়েকের মধ্যে ও মোটামুটি সব গুছিয়ে ফেলে।
একদিন আবদুর রবকে ডিমেসেদ্ধ করে ছাগলের দুধ খাইয়ে কথাটা পাড়ে, রব আমি এখানে বিয়ে করতে চাই।
লোকটির গোঁফের ওপর লাজুক হাসি খেলে যায়। রব বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে থাকে। ও চোখ নামিয়ে বলে, সন্তোষ মারমার মেয়ে দেবীকে আমার খুব পছন্দ।
ও তো ছোট মেয়ে, বয়স আর কী?
লোকটি ফোঁস করে ওঠে, ছোট কই? কেমন ডাগর হয়ে উঠেছে।
রব হো-হো করে হেসে ওঠে, তুই তো বুড়িয়ে গেছিস। তোর বয়স তো অনেক। লোকটি রেগে যায়, রাগে থম করে থাকে। তখন রব ওকে বোঝায়, ওসব চিন্তা করিস না মান্নান। এরা সাংঘাতিক। এসব কথা শুনলে তোকে মেরেই ফেলবে। বন্ধুর মতো থাকবি দেখবি ওরা কত ভালো।
থাক উপদেশ দিস না।
লোকটি গোঁ গোঁ করে। ওরে চিৎকার করতে ইচ্ছে করে। কেন ও যাকে চায় তাকে পাবে না? ওতো পুরো গেরস্থ হয়েছে, বউ খাওয়ানোর যোগ্য হয়েছে। ওর কিসের অভাব?
রব মৃদুস্বরে বলে, তোর বউ আছে না মান্নান?
ওইটা আবার একটা বউ?
এমন করে বলতে নেই গো।
আবদুর রব বিশাল ঢেঁকুর তোলে। ঘরে একগাদা ছেলেমেয়ের যন্ত্রণায় তেমন কিছু খাওয়া হয় না। আজ ডিম-দুধ ওকে বেশ তৃপ্তি দিয়েছে।
আমি নতুন সংসার পাতব।
লোকটি দৃঢ়তার সঙ্গে ঘোষণা করে। আবদুর রব বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকে। ও এই লোকটির মতো জীবনকে এমন নতুন করে দেখতে পারেনি। এই লোকটির সাহস এবং ইচ্ছাশক্তি ওকে প্রেরণা যোগায়। কিন্তু পথে যেতে যেতে আবদুর রব লোকটিকে করুণা করে। ভাবে কাপুরুষ সংসারের দায়িত্ব থেকে পালিয়ে বাঁচতে চায়। যে নিজের স্ত্রী-পুত্র ত্যাগ করে সে মানুষ না, কিছুতেই না। ও বিড়বিড় করে, কাউয়া, হারামজাদা একটা কাউয়া। আপন সংসারে ফিরে এসে ও স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে। হোক একগাদা ছেলেমেয়ে, তবু সবই তো ওর আপন, ওরই ঔরসের।
না পাহাড়ি মেয়েকে বিয়ে করার স্বপ্ন ওর সফল হয় না। দু-এক জায়গায় কায়দা করে কথাটি পাড়তেই লোকজন তেড়ে ওঠে, এমন চিন্তা যেন মনে না আনে সে কথাও বলে দেয়। দুদিন লোকটি খুব বিষণœ থাকে। কাজে মন বসে না, রাঁধতে ভালো লাগে না। কিছু কাটতে গিয়ে কড়ই ছায়ায় বসে থেকে ভাবে, ভেবেছিল এক নারী থেকে অন্য নারী মানে খোঁয়াড়, কিন্তু তা নয়, তার আলাদা মূল্য আছে। এখন এই মূল্যের খোঁজে ও পাগল হয়ে যায়। লোকটির দিন যেন আর কাটে না।
শেষ পর্যন্ত আবদুর রবের বোন হালিমাকে বিয়ে করার কথা ও ভাবে। কথাটা পাড়তেই রব এক কথায় রাজি। তখন ওর মনে হয়, লোকটি বড় দুঃখী। কোনোদিন সুখ পায়নি, আহা বেচারা। মুহূর্তে খারিজ হয়ে যায় ওর কাপুরুষত্ব এবং কাক-জীবন। এভাবেই মানুষের কাছে বারবার অদল-বদল হয় আব্দুল মান্নান।
আমার বোনটি তোর সংসার সোনায় ভরে তুলবে রে দেখিস ও খুব ভালো মেয়ে। লোকটি ভুরু কুঁচকে বলে, তুইও একটা দায়িত্ব থেকে বাঁচলি।
আবদুল রব দুঃখ পায়।
এমন করে বলে না গো।
লোকটি হা হা করে হাসে। হাসতে হাসতে জগৎ-সংসার একাকার করে ফেলে।
ওর বুক ভরে ওঠে, ওর বুক খালি হয়ে যায়। ও নিজেকে চেনা-অচেনার ভেতর দিয়ে দীর্ঘ সময় পাড়ি দেয়। আবদুর রব ওকে যতো দেখে ততো ওর বিস্ময় বাড়ে। এই লোকটির ওর অচেনা থেকে যায়।
যেদিন হালিমাকে বিয়ে করে সন্ধ্যার পর ঘরে ফেরে সেদিন শান্তিবাহিনী আক্রমণ করে কুমারি গ্রাম। তখন গভীর রাত। হালিমার হাতে মেহেদি, পরনে নতুন ছাপ শাড়ি। লোকটি নতুন লুঙ্গি পরেছে। হালিমাকে বুকে নিয়ে ঘুমিয়ে আছে খড়ের বিছানায়।
দাউদাউ জ্বলে ওঠে ঘর। পুড়ে যায় শনে-ছাওয়া চাল, মুলি বাঁশের বেড়া। চারদিকে চিৎকার, গুলির শব্দ। লোকটি পাগলের মতো দরজা হাতড়ায়। হালিমার শরীরে আগুন, চড়চড় শব্দে ও পুড়ছে। ও দরজা খুঁজে পায় না। এত আলোর মাঝেও দেখতে পায় না কিছু। ও ফিরে তাকায় না। পুড়ে যাচ্ছে ওর শরীর, ও আগুনের মাঝ দিয়ে লাফিয়ে বাইরে আসে। ছুটে আসে একঝাঁক বুলেট। মুখ থুবড়ে পড়ে যায় ও। ঝাঁঝরা হয়ে যায় লোকটি।
পরদিন ভোরের আলো ফুটতে দেখা যায় কুমারি গ্রামের ধ্বংসযজ্ঞের মধ্যে একটি লোক পুড়ে গিয়ে অবিকল কাকের আকৃতিতে কুঁকড়ে পড়ে আছে।
1 মন্তব্যসমূহ
ভীষণ লেখা - পাকে পাকে জড়িয়ে শেষ পর্যন্ত টেনে রাখে। জ্বালা, পোড়া, শীতল হওয়া - পরপর। অস্থির সময়ের চিত্রলিপি... নিষ্ঠুর বাস্তব।
উত্তরমুছুনশ্রাবণী দাশগুপ্ত।