ইসলাম সাহেব জন্মেছিলেন ব্রিটিশ-ভারতে। তিনি মারা গেছেন মুক্তিযুদ্ধের পরের বছর, সদ্য স্বাধীন হওয়া বাংলাদেশে। জহর আর জহির, ইসলাম সাহেবের দুই ছেলে। ওরা দু’জনেই জন্মেছে, দেশ যখন পাকিস্তান ছিলো। জহরের বয়স এখন সাতান্ন, টেক্সাসের কলোরাডোতে থাকে উনত্রিশ বছর ধরে। ছোট ছেলে, জহিরের বসবাস ঢাকাতে। ওদের মা জহিরের সঙ্গে থাকেন স্বাধীনতা-উত্তর ওদের বসতভিটাতে। বসতভিটা অবশ্য আরেকটি ছিলো, করাচীতে। একাত্তরের ফেব্রুয়ারীতে ছেড়ে-ফেলে চলে এসেছেন ইসলাম সাহেব, এক রকমের কাউকে কিছু না বলে, কিছু না জানিয়ে।
এইভাবে চলে আসার ক্ষয়ক্ষতি অনেক। ক্ষত অনেক গভীর, সেই ক্ষত শ্যাওলা জমা ডোবার মতো। যে ডোবায় মাছ হয় না, পানি পান করা যায় না, আবার ভরাটও করা যায় না। ক্ষত অনেক গভীর হয়।
জহরের মনে আছে, করাচীতে ওদের প্রতিবেশী ছিলেন আলম সাহেবের পরিবার। আলম সাহেবের বড় ছেলে সারওয়ার, জহরের সমবয়সী। পাকিস্তানের ওই অংশে একটি মাত্র বাঙলা স্কুল ছিলো। কী বুঝে ইসলাম সাহেব তার ছেলেদের বাঙলা স্কুলে দিয়েছিলেন। আলম সাহেব কম আবেগী মানুষ, সন্তানদের ভালো উর্দ্দুভাষী স্কুলেই পাঠিয়ে ছিলেন। কিন্তু একাত্তরের শুরুতে আলম সাহেবও সপরিবারে ঢাকা চলে আসেন। ছিয়াত্তরের জহর আর সারওয়ার দু’জনেই এইচ.এস.সি পরীক্ষায় বসে।
ওরা তখন ঢাকা সেনানিবাসের আদমজী ক্যান্টনমেন্ট কলেজে পড়ে। মোহাম্মদপুরে থাকতো বিধায় বিকেলে মোহাম্মদপুরের বেড়ী বাঁধের উপর আড্ডা দিতো, শিয়া মসজিদের পাশে। পরীক্ষার খাতায় লেখা প্রশ্নের উত্তর বন্ধুরা মিলিয়ে দেখতো। উর্দু মাধ্যমে লেখাপড়ার জন্য সারওয়ারের যথেষ্ঠ সীমাবদ্ধতা ছিলো বাংলা ভাষায়।
প্রতি পরীক্ষার দিন, বিকেলের আড্ডায় কোন প্রশ্নের কে কি উত্তর দিয়েছে, আলোচনা হতো। রসায়ন পরীক্ষা দিয়ে এসে সারওয়ারের মন খুবই খারাপ।
বন্ধুরা জানতে চাইলো কি হয়েছে?
ও বললো একটা সর্ট কোয়েশ্চেন বুঝতে পারিনি বলে উত্তর করতে পারিনি।
জহর জিজ্ঞেস করলো, ‘কোনটা?’
‘পানির উপাদান কি কি?’
‘উপাদান’ শব্দটি সারওয়ার বোঝেনি।
তখনই ওদের পেছন দিয়ে একটা রিক্সা যাচ্ছিলো। সেই সময়টাতে অনেক রিক্সাতে যাত্রীর সিটের নীচে রেডিও, ক্যাসেট প্লেয়ার থাকতো। অবাক কান্ড, পেছন দিয়ে চলে যাওয়া রিক্সার ক্যাসেটে বাজছিলো, “এ ব্যথা কি যে ব্যথা, বোঝে কি আনজনে ........”
বন্ধুরা সবাই হো হো করে হেসে উঠেছিলো।
বাসায় ফিরে এই মজার ঘটনা জহর আম্মাকে বলেছিলো। সব শুনে জহরের আম্মা বলেছিলেন, “তোমাদের হাসাটা সঙ্গত হয়নি।”
কী বুঝে জহরের আম্মা এমন বলেছিলেন কে জানে?
দুই.
ইসলাম সাহেব পাকিস্তান নেভীতে চাকুরী করেছেন দীর্ঘ সময়। সেবার তিনি চাকুরীর বরাতে দীর্ঘ বারো মাস আমেরিকা সফরে ছিলেন। মার্কিন সরকার বন্ধুত্বের নিদর্শন হিসেবে পাকিস্তান সরকারকে সমুদ্রগামী তেলবাহী বিশাল এক জাহাজ উপহার দিয়েছিলেন।
জহরের মনে আছে, ওর আব্বা ওকে বলেছিলেন, একবার জাহাজে তেল ভরে নিলে, জাহাজটি চারবার পৃথিবী প্রদক্ষিণ করতে পারতো। জহর আর তার ছোটভাই জহিরকে সঙ্গে করে ওদের আব্বা করাচী নৌ-বাহিনীর পোর্টে তেলবাহী টেঙ্কারটি দেখাতে নিয়ে গিয়েছিলেন। সেদিন জাহাজটির মার্কিন নাম বদলে পাকিস্তান নৌ-বাহিনীর প্রস্তাবিত নাম লেখা হচ্ছিলো “পি এন এস ঢাকা”।
টেঙ্কারটি মার্কিন নৌ-বাহিনীতে ডিকামিশন্ড হয়ে যায় একটি নৌ-বহরের তেলবাহী জাহাজ হিসেবে। ইসলাম সাহেবের দীর্ঘ বারো মাস আমেরিকা সফরের কারণ ছিলো, বন্ধুত্বের নিদর্শন হিসেবে পাওয়া জাহাজটির ছোটখাটো কিছু মেরামত এবং পাকিস্তান নৌ-বাহিনীর ক্রুদের ট্রেনিং। ইসলাম সাহেবের পদোন্নতি হয়ে তিনি তখন জাহাজটির ‘রেডিও অফিসারে’র নিয়োগ পেয়েছেন।
তিনি যখন আমেরিকা সফরে যান, দেশে তার স্ত্রী সন্তানসম্ভবা ছিলেন। আমেরিকা যেতে না চাওয়ার কোন উপায়ও ছিলো না। নৌ-বাহিনীর চাকুরী, সবে পাওয়া পদোন্নতি। ইসলাম সাহেব আমেরিকা থাকাকালীন সময়টাতে, জহর আর জহিরের পর তাদের তৃতীয় সন্তানের জন্ম হয়।
আর অন্য সকল নৌ-সেনাদের সঙ্গে তিনি যখন জাহাজটি নিয়ে দেশে ফিরলেন। তার কনিষ্ঠ সন্তানটির বয়স আটমাস। তখনও শিশুটির নাম রাখা হয়নি। ইসলাম সাহেবের স্ত্রী’র সখ ছিলো, ছেলের পিতা দেশে ফিরে ছেলের নাম রাখবেন। তিনি দেশে ফিরে দেখলেন সবাই ওদের সন্তানকে ‘ছোটবাবু’ বলে ডাকে। উর্দ্দু ভাষাভাষী প্রতিবেশীরা ‘ছোটেবাবু’ বলে।
জহর আর জহিরকে নিয়ে যেদিন বিশাল তেলবাহী জাহাজটি দেখতে গিয়েছিলেন, সেদিন সন্ধ্যায় বাসায় ফিরে দেখলেন ছোট ছেলেটির ঠান্ডা লেগেছে। পরেরদিন ছোটবাবুর অবস্থার খারাপের দিকে গড়ালো। শ্বাস নিতে কষ্ট পাচ্ছিলো। হাসপাতালে নেয়ার পর জানা গেলো, নিমোউনিয়া। ফুসফুসে ইনফেকশান হয়ে গেছে। নিতান্তই ছোট শরীর, সইতে পারলো না। সবার মায়া কাটিয়ে চলে গেলো। আত্মীয়-স্বজনরা বলাবলি করেছেন, ছোটবাবু ওর আব্বার সাথে দেখা করার জন্যই প্রাণটা ধরেছিলো। ইসলাম সাহেব দেশে ফেরার পাঁচদিনের দিন ছোটবাবু চলে গিয়েছিলো।
ছোটবাবু চলে গিয়েছিলো যে সময়টাতে, জহরের বয়স তখন পাঁচ বছর। জহর অতশত বোঝেনি। এতো অল্প সময়ের জন্য ছোটবাবু এসেছিলো, এক আজলা পানি দিয়ে পরক্ষণে তুলে নিলে, প্রকৃতিও তো তা টের পায় না। এই যে আত্মীয়-স্বজনরা বলাবলি করেছে, ছোটবাবু সবার মায়া কাটিয়ে চলে গেছে; জহরের কেবলই মনে হয়েছে, এতো অল্প সময়ে কি মায়া তৈরী হয়?
তিন.
ক’বছর আগের কথা। জহির এক মেডিকেল কনফারেন্সে বার্সিলোনা গিয়েছিলো। ফ্লাইট ছিলো ঢাকা থেকে করাচী-ইস্তাম্বুল হয়ে বার্সিলোনা। জহির রাতে দেরী করে শুতে যায়। ভিয়েনা রওনা হবার আগের রাতে জহির প্লেনের টিকেট, পাসপোর্ট, আর সব কাগজ-পত্র গোছাচ্ছিলো শোবার ঘরে। ছেলেমেয়েরা ঘুমিয়েছে তখন, জহিরের বউ এসে বললো, “মা তোমাকে ডাকছেন, মা’র ঘরে যেতে বলেছেন।”
জহির অবাক হয়ে জানতে চায়, “আম্মা এখনও ঘুমায়নি?”
জহিরের বউ কিছু বলে না।
জহির হাতের কাজ রেখে আম্মার ঘরে যায়, “আম্মা এখনও ঘুমাননি?”
“না বাবা, তোমাকে একটা কথা বলবো বলে বসে আছি।”
“বলেন আম্মা।”
“বাচ্চারা ঘুমিয়েছে?”
“হ্যাঁ আম্মা।”
“বাবা, এদিকটায় বিছানার ওপর বসো।”
জহির মায়ের বিছানায় বসতে বসতে বলে, “কী বলবেন আম্মা?”
জহিরের আম্মা কয়েকটা মূহুর্তের নীরবতার পর জানতে চান, “করাচীতে তোমার বিরতি কতক্ষণ?”
“দুইঘন্টা। কেন আম্মা?”
“না বাবা, ছোটবাবুর কবরটা তো করাচীতে। তুমি যদি একটু সময় বের করে ছোটবাবুর জন্য দুই রাকাত নামাজ পড়ে দিতে। এয়ারপোর্টে নিশ্চয়ই নামাজের ব্যবস্থা আছে?”
জহির চিন্তাই করেনি এমন একটা প্রসঙ্গের কথা। ছোটবাবু যখন মারা যায়, ওর বয়স তখন মাত্র এক বছর। ছোটবাবুর কিছুই জহিরের স্মৃতিতে নেই। বড়ভাই জহর তখন তখন পাঁচ বছরের ছিলো, ওরই তো মনে নেই। ও কিছুক্ষণ নীরব হয়ে বসে থাকে। ধীরে ধীরে বলে, “আম্মা, আমি খেয়াল করিনি। আপনি আমাকে আগে মনে করিয়ে দিলে আমি পাকিস্তানের ভিসা নিয়ে মৌরীপুরে ছোটবাবুর কবরটা দেখে যেতাম।”
“কবরটা কি আর আছে এখন? অতটুকুর দরকার হবে না। তুমি শুধু ছোটবাবুর জন্য দুই রাকাত নামাজ পড়ে দিও।”
জহির আবারও কিছুক্ষণ চুপচাপ হয়ে বসে থাকে। একসময় বলে, “আপনি শুয়ে পড়েন আম্মা। আমি করাচী এয়ারপোর্টে ছোটবাবুর জন্য নামাজ পড়ে দিবো। সব বড় এয়ারপোর্টে নামাজের ব্যবস্থা থাকে।”
জহিরের মনটা খারাপ হয়ে যায়। নিজের ঘরে ফিরে এসে ফেলে রাখা হাতের কাজগুলো সারতে ইচ্ছে হয় না। মনে পড়ে, গতবছর জহর ভাইজান ক্রীসমাসের ছুটিতে ঢাকায় ছিলেন। বিজয় দিবসের রাত ছিলো। আম্মা কেন জানি কথার পরতে পরতে ছোটবাবুর কথা বলছিলেন।
জহর ভাইজান বিষয়টা লক্ষ্য করেছিলেন। এক পর্যায়ে ভাইজান বলেছিলেন, “আম্মা, কলোরাডোতে আমি এক অল্পবয়সী পাকিস্তানী ছেলেকে চিনি। ও একদিন আমাকে বলছিলো, ওর মা বাংলাদেশের, বাঙালী। লাহোরে থাকেন। দেশের খাবার ওর মা মিস্ করেন খুব। কাঁঠালের তরকারী ভীষণ ভালোবাসেন।
আমি অবাক হয়ে ছেলেটার দিকে তাকাতেই ও বললো, ঐ যে করলার চেয়ে ছোট, ঢেড়শের চেয়ে বড়, সবুজ সবুজ।
দু’একটা তরকারীর নামের পর ছেলেটাকে আমি জিজ্ঞেস করলাম, পটল?
ছেলেটা ঝলমল চোখে বলে উঠলো, হ্যাঁ, হ্যাঁ, তাই।”
আম্মা অস্পষ্ট স্বরে বললেন, “আহারে, বাঙালী মা। মানুষ কত নিরুপায় হয়।”
জহির তাকিয়ে দেখেছিলো, আম্মার চোখ ছলছল করছিলো। কে জানে কেন?
এখন মনে হয়, হয়তো ছোটবাবুর জন্য।
হঠাৎ জহির খেয়াল করে এমটিভিতে একটা গান হচ্ছে, “বালমা মাইকা ছাড় গ্যায়ে, এ্যাহি জাগাৎ কী রীৎ .....”
চার.
ইসলাম সাহেব সপরিবারে পাকিস্তান থেকে ঢাকায় চলে আসার পরপরই ওই পঁচিশ তারিখের রাত। মার্চ মাসের পঁচিশ তারিখের রাত। নিকষ কালো রাত। মানুষ থতমত খেয়ে গেছে। ইসলাম সাহেব তো আরও বেশী থতমত খাওয়া মানুষ। বাড়তি ভয় ছিলো, যদি ডেকে পাঠায় চাকুরী থেকে। তিনি পরিবার নিয়ে পালিয়ে গেলেন ঢাকা থেকে। নারায়ণগঞ্জ হয়ে নদীপথে কুমিল্লার গ্রামের বাড়ীতে। সারা গ্রামভরা শহর থেকে আসা মানুষ। প্রতিটা বাড়ী গমগম করে মানুষে।
জহরের বয়স তখন চৌদ্দে পড়েনি। ওদের গ্রামটা গোমতী নদীর পাড়ে। এপ্রিলের মাঝামাঝির কথা, দুপুরবেলা, নদীর পাড়ে বসেছিলো জহর ওর আব্বার সাথে। গোমতী পাহাড়ী নদী। এই সময়টাতে নদীতে তীব্র স্রোত থাকে। স্রোতের সাথে প্রচুর কচুরীপানা ভেসে আসে, কচুরীপানা ভেসে যায় মেঘনায়। কচুরীপানার সাথে আরও কত কিছু ভেসে আসে। কতো অজানা মানুষের বাড়ীর চৌকাঠ, আগুনে পোড়া।
জহরই প্রথম দেখলো, শোলাকান্দি বাঁক ঘুরে কিছু একটা ভেসে আসছে। অত দূর থেকে আকার দেখে বোঝা যায় না জিনিষটা কী? দু’টো পাখি বসে ছিলো জিনিষটার ওপর। এগিয়ে আসছিলো, জহর ঠাওর করলো ওই পাখি দু’টো শকুন। কাছে আসলে ইসলাম সাহেব বুঝলেন, জিনিষটা মানুষ। পঁচে ফুলে উঠা মানুষের দেহ। শকুন ঠুকরে ঠুকরে খাচ্ছে দেহটাকে। চোখ দু’টো নেই, খালি গর্ত। নদীর পাড় ঘেষে আরও কাছে এলে সারা বাজারে একটা চাপা বিকট গন্ধ ছড়িয়ে গেলো। এরই মধ্যে নদীর পাড়ে অনেক মানুষজন জমে গেছে।
সেটা শুরু ছিলো। তারপর অগুনিত লাশ ভেসে গেছে প্রতিদিন। এমনও দিন গেছে, জহর নিজে গুনেছে আঠারো বিশটা লাশ। লাশগুলো ভেসে যায়, মাছে খায়, শকুনে খায়।
তখন, আরেক দিকে গ্রামে গ্রামে ছেলেরা রাতের অন্ধকারে চলে যাচ্ছে আগরতলা। পাঁচানী, শোলাকান্দি, নূরপুর, সব গ্রাম থেকেই খবর আসে। একদিন সকালে উঠে জহর আব্বার কাছে শুনলো, ওদের বাড়ীর খশরু চাচা আর পশ্চিম-পাড়ার শওকত আগের রাতে আগরতলার পথে রওনা হয়ে গেছে।
খশরু চাচা আর শওকত বাড়ী ছেড়ে যাওয়ার ছয়দিনের মাথায়, রাত আটটার দিকে পাকিস্তানী সেনা ভর্তি একটা লঞ্চ এসে লালপুরের বাজারের ঘাটে এসে ভিড়লো। দেওয়ান চাচা এসে খবরটা দিয়ে চলে গেলেন। ইসলাম সাহেব বাড়ীর সোমত্ত মেয়েদেরকে উত্তর ঘাটলায়, পুকুর পারের ধইঞ্চা ঝোপের ভেতর লুকিয়ে থাকতে বললেন মিলেটারী গ্রাম ছেড়ে যাওয়া পর্যন্ত। আর তিনি নিজে জহরের হাত ধরে বাজারমুখী হলেন।
বাজারে পৌঁছে দেখলেন সকল ধরনের প্রস্তুতিপর্ব শেষ করে পাকিস্তানী সেনারা লঞ্চ থেকে নামছে। সারেং-এর কেবিনের সামনে একটা মেশিনগান বসানো।
ইসলাম সাহেব এগিয়ে গিয়ে সালাম দিয়ে বললেন, “আপ্ লোগোকে সাবকুছ্ খেরিয়াত তো হ্যায়?”
ক্যাপ্টেন প্রথমে কিছুটা অবাক হলেন। দশ মিনিটের মাথায় ক্যাপ্টেনের জড়তা কাটলো। সেও করাচীর ছেলে। লঞ্চের সৈন্যদের বাজারের টং দোকানের চা খাওয়ালেন ইসলাম সাহেব। ক্যাপ্টেন তবুও কথার মধ্যে জানতে চাইলেন, এই গ্রামের কোন জোয়ান ছেলে মুক্তিবাহিনীতে গেছে কি না।
ইসলাম সাহেব মিথ্যে বললেন অবলীলায়, “হারগিজ নাহি।”
সন্তুষ্ট হয়ে ক্যাপ্টেন, “চালো, আপ্ ভী সাহি হ্যায়। য়্যাকীন কারলেতা হু।”
ক্যাপ্টেন তার সৈন্যদের নিয়ে বাজার থেকেই চলে গিয়েছিলো। গ্রামে ঢোকেনি।
সারা যুদ্ধের সময় ধরে লালপুর গ্রামে মিলেটারী ঢোকেনি আর।
পাঁচ.
এরও অনেক আগের কথা।
ইসলাম সাহেবের নৌ-বাহিনীর চাকুরীর পুরোটা সময়ে তার পোষ্টিং ছিলো করাচীতে। যে সময়ের কথা এটা, জহর বেশ ছোট, সম্ভবত পঞ্চম শ্রেনীতে পড়ে। আর ছোটভাই জহির ওর থেকে আরও চার বছরের ছোট। বিকেলে পাড়ার মাঠে ক্রিকেট খেলতো। বাঙালী বলতে শুধু ওরা দু’ভাই। অন্য সবার মাঝে সিন্ধী ছিলো, বিহারী ছিলো, বেলুচ ছিলো, পাঞ্জাবী ছিলো। পাঞ্জাবী ছেলেটা বয়সে সবার বড়, ব্যাটটাও ওর ছিলো। তাই ভাব নিতো। কে কখন ব্যাটিং করবে, ও ঠিক করে দিতো।
একবার জহরের ব্যাটিংয়ের পালা আসার পরেও, পাঞ্জাবী ছেলেটা জহরকে ব্যাটিং করতে না দিয়ে, ধাক্কা মেরে সরিয়ে দিয়েছিলো। কারণটা ছিলো তার একটু আগেই জহর ওকে আউট করেছিলো।
আর যায় কোথায়। ওর ছোটভাই জহির, একটা পাথর তুলে, ছুঁড়ে পাঞ্জাবী ছেলেটার মাথা ফাটিয়ে রক্তাক্ত করে ফেললো। খেলা শেষ। পাঞ্জাবী ছেলেটা কাঁদতে কাঁদতে বাসায়। কতোক্ষণ পর ওর মাকে নিয়ে জহর-জহিরদের বাসায় হাজির, পাঞ্জাবী ছেলেটার মা জহিরের আম্মাকে উচ্চস্বরে বললো, ‘দ্যেখিয়ে আপকে ছোটে বেটেনে ক্যায়া কিয়া মেরি লাডলা কো?’
আম্মা আগুন চোখে জহিরের দিকে তাকাতেই, ও ফুঁসে উঠে ততাধিক রাগের স্বরে বললো, ‘ও ভাইজানকে ধাক্কা দিলো কেনো?’
জহর-জহির তখন অনেক ছোট। রাজনীতি বুঝতো না। নিজেরটা বুঝতো।
রচনাকাল ২০১৪, সিডনি।
এইভাবে চলে আসার ক্ষয়ক্ষতি অনেক। ক্ষত অনেক গভীর, সেই ক্ষত শ্যাওলা জমা ডোবার মতো। যে ডোবায় মাছ হয় না, পানি পান করা যায় না, আবার ভরাটও করা যায় না। ক্ষত অনেক গভীর হয়।
জহরের মনে আছে, করাচীতে ওদের প্রতিবেশী ছিলেন আলম সাহেবের পরিবার। আলম সাহেবের বড় ছেলে সারওয়ার, জহরের সমবয়সী। পাকিস্তানের ওই অংশে একটি মাত্র বাঙলা স্কুল ছিলো। কী বুঝে ইসলাম সাহেব তার ছেলেদের বাঙলা স্কুলে দিয়েছিলেন। আলম সাহেব কম আবেগী মানুষ, সন্তানদের ভালো উর্দ্দুভাষী স্কুলেই পাঠিয়ে ছিলেন। কিন্তু একাত্তরের শুরুতে আলম সাহেবও সপরিবারে ঢাকা চলে আসেন। ছিয়াত্তরের জহর আর সারওয়ার দু’জনেই এইচ.এস.সি পরীক্ষায় বসে।
ওরা তখন ঢাকা সেনানিবাসের আদমজী ক্যান্টনমেন্ট কলেজে পড়ে। মোহাম্মদপুরে থাকতো বিধায় বিকেলে মোহাম্মদপুরের বেড়ী বাঁধের উপর আড্ডা দিতো, শিয়া মসজিদের পাশে। পরীক্ষার খাতায় লেখা প্রশ্নের উত্তর বন্ধুরা মিলিয়ে দেখতো। উর্দু মাধ্যমে লেখাপড়ার জন্য সারওয়ারের যথেষ্ঠ সীমাবদ্ধতা ছিলো বাংলা ভাষায়।
প্রতি পরীক্ষার দিন, বিকেলের আড্ডায় কোন প্রশ্নের কে কি উত্তর দিয়েছে, আলোচনা হতো। রসায়ন পরীক্ষা দিয়ে এসে সারওয়ারের মন খুবই খারাপ।
বন্ধুরা জানতে চাইলো কি হয়েছে?
ও বললো একটা সর্ট কোয়েশ্চেন বুঝতে পারিনি বলে উত্তর করতে পারিনি।
জহর জিজ্ঞেস করলো, ‘কোনটা?’
‘পানির উপাদান কি কি?’
‘উপাদান’ শব্দটি সারওয়ার বোঝেনি।
তখনই ওদের পেছন দিয়ে একটা রিক্সা যাচ্ছিলো। সেই সময়টাতে অনেক রিক্সাতে যাত্রীর সিটের নীচে রেডিও, ক্যাসেট প্লেয়ার থাকতো। অবাক কান্ড, পেছন দিয়ে চলে যাওয়া রিক্সার ক্যাসেটে বাজছিলো, “এ ব্যথা কি যে ব্যথা, বোঝে কি আনজনে ........”
বন্ধুরা সবাই হো হো করে হেসে উঠেছিলো।
বাসায় ফিরে এই মজার ঘটনা জহর আম্মাকে বলেছিলো। সব শুনে জহরের আম্মা বলেছিলেন, “তোমাদের হাসাটা সঙ্গত হয়নি।”
কী বুঝে জহরের আম্মা এমন বলেছিলেন কে জানে?
দুই.
ইসলাম সাহেব পাকিস্তান নেভীতে চাকুরী করেছেন দীর্ঘ সময়। সেবার তিনি চাকুরীর বরাতে দীর্ঘ বারো মাস আমেরিকা সফরে ছিলেন। মার্কিন সরকার বন্ধুত্বের নিদর্শন হিসেবে পাকিস্তান সরকারকে সমুদ্রগামী তেলবাহী বিশাল এক জাহাজ উপহার দিয়েছিলেন।
জহরের মনে আছে, ওর আব্বা ওকে বলেছিলেন, একবার জাহাজে তেল ভরে নিলে, জাহাজটি চারবার পৃথিবী প্রদক্ষিণ করতে পারতো। জহর আর তার ছোটভাই জহিরকে সঙ্গে করে ওদের আব্বা করাচী নৌ-বাহিনীর পোর্টে তেলবাহী টেঙ্কারটি দেখাতে নিয়ে গিয়েছিলেন। সেদিন জাহাজটির মার্কিন নাম বদলে পাকিস্তান নৌ-বাহিনীর প্রস্তাবিত নাম লেখা হচ্ছিলো “পি এন এস ঢাকা”।
টেঙ্কারটি মার্কিন নৌ-বাহিনীতে ডিকামিশন্ড হয়ে যায় একটি নৌ-বহরের তেলবাহী জাহাজ হিসেবে। ইসলাম সাহেবের দীর্ঘ বারো মাস আমেরিকা সফরের কারণ ছিলো, বন্ধুত্বের নিদর্শন হিসেবে পাওয়া জাহাজটির ছোটখাটো কিছু মেরামত এবং পাকিস্তান নৌ-বাহিনীর ক্রুদের ট্রেনিং। ইসলাম সাহেবের পদোন্নতি হয়ে তিনি তখন জাহাজটির ‘রেডিও অফিসারে’র নিয়োগ পেয়েছেন।
তিনি যখন আমেরিকা সফরে যান, দেশে তার স্ত্রী সন্তানসম্ভবা ছিলেন। আমেরিকা যেতে না চাওয়ার কোন উপায়ও ছিলো না। নৌ-বাহিনীর চাকুরী, সবে পাওয়া পদোন্নতি। ইসলাম সাহেব আমেরিকা থাকাকালীন সময়টাতে, জহর আর জহিরের পর তাদের তৃতীয় সন্তানের জন্ম হয়।
আর অন্য সকল নৌ-সেনাদের সঙ্গে তিনি যখন জাহাজটি নিয়ে দেশে ফিরলেন। তার কনিষ্ঠ সন্তানটির বয়স আটমাস। তখনও শিশুটির নাম রাখা হয়নি। ইসলাম সাহেবের স্ত্রী’র সখ ছিলো, ছেলের পিতা দেশে ফিরে ছেলের নাম রাখবেন। তিনি দেশে ফিরে দেখলেন সবাই ওদের সন্তানকে ‘ছোটবাবু’ বলে ডাকে। উর্দ্দু ভাষাভাষী প্রতিবেশীরা ‘ছোটেবাবু’ বলে।
জহর আর জহিরকে নিয়ে যেদিন বিশাল তেলবাহী জাহাজটি দেখতে গিয়েছিলেন, সেদিন সন্ধ্যায় বাসায় ফিরে দেখলেন ছোট ছেলেটির ঠান্ডা লেগেছে। পরেরদিন ছোটবাবুর অবস্থার খারাপের দিকে গড়ালো। শ্বাস নিতে কষ্ট পাচ্ছিলো। হাসপাতালে নেয়ার পর জানা গেলো, নিমোউনিয়া। ফুসফুসে ইনফেকশান হয়ে গেছে। নিতান্তই ছোট শরীর, সইতে পারলো না। সবার মায়া কাটিয়ে চলে গেলো। আত্মীয়-স্বজনরা বলাবলি করেছেন, ছোটবাবু ওর আব্বার সাথে দেখা করার জন্যই প্রাণটা ধরেছিলো। ইসলাম সাহেব দেশে ফেরার পাঁচদিনের দিন ছোটবাবু চলে গিয়েছিলো।
ছোটবাবু চলে গিয়েছিলো যে সময়টাতে, জহরের বয়স তখন পাঁচ বছর। জহর অতশত বোঝেনি। এতো অল্প সময়ের জন্য ছোটবাবু এসেছিলো, এক আজলা পানি দিয়ে পরক্ষণে তুলে নিলে, প্রকৃতিও তো তা টের পায় না। এই যে আত্মীয়-স্বজনরা বলাবলি করেছে, ছোটবাবু সবার মায়া কাটিয়ে চলে গেছে; জহরের কেবলই মনে হয়েছে, এতো অল্প সময়ে কি মায়া তৈরী হয়?
তিন.
ক’বছর আগের কথা। জহির এক মেডিকেল কনফারেন্সে বার্সিলোনা গিয়েছিলো। ফ্লাইট ছিলো ঢাকা থেকে করাচী-ইস্তাম্বুল হয়ে বার্সিলোনা। জহির রাতে দেরী করে শুতে যায়। ভিয়েনা রওনা হবার আগের রাতে জহির প্লেনের টিকেট, পাসপোর্ট, আর সব কাগজ-পত্র গোছাচ্ছিলো শোবার ঘরে। ছেলেমেয়েরা ঘুমিয়েছে তখন, জহিরের বউ এসে বললো, “মা তোমাকে ডাকছেন, মা’র ঘরে যেতে বলেছেন।”
জহির অবাক হয়ে জানতে চায়, “আম্মা এখনও ঘুমায়নি?”
জহিরের বউ কিছু বলে না।
জহির হাতের কাজ রেখে আম্মার ঘরে যায়, “আম্মা এখনও ঘুমাননি?”
“না বাবা, তোমাকে একটা কথা বলবো বলে বসে আছি।”
“বলেন আম্মা।”
“বাচ্চারা ঘুমিয়েছে?”
“হ্যাঁ আম্মা।”
“বাবা, এদিকটায় বিছানার ওপর বসো।”
জহির মায়ের বিছানায় বসতে বসতে বলে, “কী বলবেন আম্মা?”
জহিরের আম্মা কয়েকটা মূহুর্তের নীরবতার পর জানতে চান, “করাচীতে তোমার বিরতি কতক্ষণ?”
“দুইঘন্টা। কেন আম্মা?”
“না বাবা, ছোটবাবুর কবরটা তো করাচীতে। তুমি যদি একটু সময় বের করে ছোটবাবুর জন্য দুই রাকাত নামাজ পড়ে দিতে। এয়ারপোর্টে নিশ্চয়ই নামাজের ব্যবস্থা আছে?”
জহির চিন্তাই করেনি এমন একটা প্রসঙ্গের কথা। ছোটবাবু যখন মারা যায়, ওর বয়স তখন মাত্র এক বছর। ছোটবাবুর কিছুই জহিরের স্মৃতিতে নেই। বড়ভাই জহর তখন তখন পাঁচ বছরের ছিলো, ওরই তো মনে নেই। ও কিছুক্ষণ নীরব হয়ে বসে থাকে। ধীরে ধীরে বলে, “আম্মা, আমি খেয়াল করিনি। আপনি আমাকে আগে মনে করিয়ে দিলে আমি পাকিস্তানের ভিসা নিয়ে মৌরীপুরে ছোটবাবুর কবরটা দেখে যেতাম।”
“কবরটা কি আর আছে এখন? অতটুকুর দরকার হবে না। তুমি শুধু ছোটবাবুর জন্য দুই রাকাত নামাজ পড়ে দিও।”
জহির আবারও কিছুক্ষণ চুপচাপ হয়ে বসে থাকে। একসময় বলে, “আপনি শুয়ে পড়েন আম্মা। আমি করাচী এয়ারপোর্টে ছোটবাবুর জন্য নামাজ পড়ে দিবো। সব বড় এয়ারপোর্টে নামাজের ব্যবস্থা থাকে।”
জহিরের মনটা খারাপ হয়ে যায়। নিজের ঘরে ফিরে এসে ফেলে রাখা হাতের কাজগুলো সারতে ইচ্ছে হয় না। মনে পড়ে, গতবছর জহর ভাইজান ক্রীসমাসের ছুটিতে ঢাকায় ছিলেন। বিজয় দিবসের রাত ছিলো। আম্মা কেন জানি কথার পরতে পরতে ছোটবাবুর কথা বলছিলেন।
জহর ভাইজান বিষয়টা লক্ষ্য করেছিলেন। এক পর্যায়ে ভাইজান বলেছিলেন, “আম্মা, কলোরাডোতে আমি এক অল্পবয়সী পাকিস্তানী ছেলেকে চিনি। ও একদিন আমাকে বলছিলো, ওর মা বাংলাদেশের, বাঙালী। লাহোরে থাকেন। দেশের খাবার ওর মা মিস্ করেন খুব। কাঁঠালের তরকারী ভীষণ ভালোবাসেন।
আমি অবাক হয়ে ছেলেটার দিকে তাকাতেই ও বললো, ঐ যে করলার চেয়ে ছোট, ঢেড়শের চেয়ে বড়, সবুজ সবুজ।
দু’একটা তরকারীর নামের পর ছেলেটাকে আমি জিজ্ঞেস করলাম, পটল?
ছেলেটা ঝলমল চোখে বলে উঠলো, হ্যাঁ, হ্যাঁ, তাই।”
আম্মা অস্পষ্ট স্বরে বললেন, “আহারে, বাঙালী মা। মানুষ কত নিরুপায় হয়।”
জহির তাকিয়ে দেখেছিলো, আম্মার চোখ ছলছল করছিলো। কে জানে কেন?
এখন মনে হয়, হয়তো ছোটবাবুর জন্য।
হঠাৎ জহির খেয়াল করে এমটিভিতে একটা গান হচ্ছে, “বালমা মাইকা ছাড় গ্যায়ে, এ্যাহি জাগাৎ কী রীৎ .....”
চার.
ইসলাম সাহেব সপরিবারে পাকিস্তান থেকে ঢাকায় চলে আসার পরপরই ওই পঁচিশ তারিখের রাত। মার্চ মাসের পঁচিশ তারিখের রাত। নিকষ কালো রাত। মানুষ থতমত খেয়ে গেছে। ইসলাম সাহেব তো আরও বেশী থতমত খাওয়া মানুষ। বাড়তি ভয় ছিলো, যদি ডেকে পাঠায় চাকুরী থেকে। তিনি পরিবার নিয়ে পালিয়ে গেলেন ঢাকা থেকে। নারায়ণগঞ্জ হয়ে নদীপথে কুমিল্লার গ্রামের বাড়ীতে। সারা গ্রামভরা শহর থেকে আসা মানুষ। প্রতিটা বাড়ী গমগম করে মানুষে।
জহরের বয়স তখন চৌদ্দে পড়েনি। ওদের গ্রামটা গোমতী নদীর পাড়ে। এপ্রিলের মাঝামাঝির কথা, দুপুরবেলা, নদীর পাড়ে বসেছিলো জহর ওর আব্বার সাথে। গোমতী পাহাড়ী নদী। এই সময়টাতে নদীতে তীব্র স্রোত থাকে। স্রোতের সাথে প্রচুর কচুরীপানা ভেসে আসে, কচুরীপানা ভেসে যায় মেঘনায়। কচুরীপানার সাথে আরও কত কিছু ভেসে আসে। কতো অজানা মানুষের বাড়ীর চৌকাঠ, আগুনে পোড়া।
জহরই প্রথম দেখলো, শোলাকান্দি বাঁক ঘুরে কিছু একটা ভেসে আসছে। অত দূর থেকে আকার দেখে বোঝা যায় না জিনিষটা কী? দু’টো পাখি বসে ছিলো জিনিষটার ওপর। এগিয়ে আসছিলো, জহর ঠাওর করলো ওই পাখি দু’টো শকুন। কাছে আসলে ইসলাম সাহেব বুঝলেন, জিনিষটা মানুষ। পঁচে ফুলে উঠা মানুষের দেহ। শকুন ঠুকরে ঠুকরে খাচ্ছে দেহটাকে। চোখ দু’টো নেই, খালি গর্ত। নদীর পাড় ঘেষে আরও কাছে এলে সারা বাজারে একটা চাপা বিকট গন্ধ ছড়িয়ে গেলো। এরই মধ্যে নদীর পাড়ে অনেক মানুষজন জমে গেছে।
সেটা শুরু ছিলো। তারপর অগুনিত লাশ ভেসে গেছে প্রতিদিন। এমনও দিন গেছে, জহর নিজে গুনেছে আঠারো বিশটা লাশ। লাশগুলো ভেসে যায়, মাছে খায়, শকুনে খায়।
তখন, আরেক দিকে গ্রামে গ্রামে ছেলেরা রাতের অন্ধকারে চলে যাচ্ছে আগরতলা। পাঁচানী, শোলাকান্দি, নূরপুর, সব গ্রাম থেকেই খবর আসে। একদিন সকালে উঠে জহর আব্বার কাছে শুনলো, ওদের বাড়ীর খশরু চাচা আর পশ্চিম-পাড়ার শওকত আগের রাতে আগরতলার পথে রওনা হয়ে গেছে।
খশরু চাচা আর শওকত বাড়ী ছেড়ে যাওয়ার ছয়দিনের মাথায়, রাত আটটার দিকে পাকিস্তানী সেনা ভর্তি একটা লঞ্চ এসে লালপুরের বাজারের ঘাটে এসে ভিড়লো। দেওয়ান চাচা এসে খবরটা দিয়ে চলে গেলেন। ইসলাম সাহেব বাড়ীর সোমত্ত মেয়েদেরকে উত্তর ঘাটলায়, পুকুর পারের ধইঞ্চা ঝোপের ভেতর লুকিয়ে থাকতে বললেন মিলেটারী গ্রাম ছেড়ে যাওয়া পর্যন্ত। আর তিনি নিজে জহরের হাত ধরে বাজারমুখী হলেন।
বাজারে পৌঁছে দেখলেন সকল ধরনের প্রস্তুতিপর্ব শেষ করে পাকিস্তানী সেনারা লঞ্চ থেকে নামছে। সারেং-এর কেবিনের সামনে একটা মেশিনগান বসানো।
ইসলাম সাহেব এগিয়ে গিয়ে সালাম দিয়ে বললেন, “আপ্ লোগোকে সাবকুছ্ খেরিয়াত তো হ্যায়?”
ক্যাপ্টেন প্রথমে কিছুটা অবাক হলেন। দশ মিনিটের মাথায় ক্যাপ্টেনের জড়তা কাটলো। সেও করাচীর ছেলে। লঞ্চের সৈন্যদের বাজারের টং দোকানের চা খাওয়ালেন ইসলাম সাহেব। ক্যাপ্টেন তবুও কথার মধ্যে জানতে চাইলেন, এই গ্রামের কোন জোয়ান ছেলে মুক্তিবাহিনীতে গেছে কি না।
ইসলাম সাহেব মিথ্যে বললেন অবলীলায়, “হারগিজ নাহি।”
সন্তুষ্ট হয়ে ক্যাপ্টেন, “চালো, আপ্ ভী সাহি হ্যায়। য়্যাকীন কারলেতা হু।”
ক্যাপ্টেন তার সৈন্যদের নিয়ে বাজার থেকেই চলে গিয়েছিলো। গ্রামে ঢোকেনি।
সারা যুদ্ধের সময় ধরে লালপুর গ্রামে মিলেটারী ঢোকেনি আর।
পাঁচ.
এরও অনেক আগের কথা।
ইসলাম সাহেবের নৌ-বাহিনীর চাকুরীর পুরোটা সময়ে তার পোষ্টিং ছিলো করাচীতে। যে সময়ের কথা এটা, জহর বেশ ছোট, সম্ভবত পঞ্চম শ্রেনীতে পড়ে। আর ছোটভাই জহির ওর থেকে আরও চার বছরের ছোট। বিকেলে পাড়ার মাঠে ক্রিকেট খেলতো। বাঙালী বলতে শুধু ওরা দু’ভাই। অন্য সবার মাঝে সিন্ধী ছিলো, বিহারী ছিলো, বেলুচ ছিলো, পাঞ্জাবী ছিলো। পাঞ্জাবী ছেলেটা বয়সে সবার বড়, ব্যাটটাও ওর ছিলো। তাই ভাব নিতো। কে কখন ব্যাটিং করবে, ও ঠিক করে দিতো।
একবার জহরের ব্যাটিংয়ের পালা আসার পরেও, পাঞ্জাবী ছেলেটা জহরকে ব্যাটিং করতে না দিয়ে, ধাক্কা মেরে সরিয়ে দিয়েছিলো। কারণটা ছিলো তার একটু আগেই জহর ওকে আউট করেছিলো।
আর যায় কোথায়। ওর ছোটভাই জহির, একটা পাথর তুলে, ছুঁড়ে পাঞ্জাবী ছেলেটার মাথা ফাটিয়ে রক্তাক্ত করে ফেললো। খেলা শেষ। পাঞ্জাবী ছেলেটা কাঁদতে কাঁদতে বাসায়। কতোক্ষণ পর ওর মাকে নিয়ে জহর-জহিরদের বাসায় হাজির, পাঞ্জাবী ছেলেটার মা জহিরের আম্মাকে উচ্চস্বরে বললো, ‘দ্যেখিয়ে আপকে ছোটে বেটেনে ক্যায়া কিয়া মেরি লাডলা কো?’
আম্মা আগুন চোখে জহিরের দিকে তাকাতেই, ও ফুঁসে উঠে ততাধিক রাগের স্বরে বললো, ‘ও ভাইজানকে ধাক্কা দিলো কেনো?’
জহর-জহির তখন অনেক ছোট। রাজনীতি বুঝতো না। নিজেরটা বুঝতো।
রচনাকাল ২০১৪, সিডনি।
1 মন্তব্যসমূহ
Seaching for identity
উত্তরমুছুন