দিলওয়ার হাসান এর গল্প : এটি কোনো নারীবাদী গল্প নয়

সই লো সই,

জানি সম্বোধনের ভাষা দেখে ক্ষেপে যাবি। ভাববি- সই আবার কী। ডিকশনারি খুলে দেখার ধৈর্য যে তোর নেই তা-ও জানা আছে আমার। ব্যাপারটা খুলে বলছি তোকে। সই বা সখী কথাটার মানে হচ্ছে বেস্টফ্রেন্ড। এই যেমন আমি। তুই যে- সোসাইটিতে মানুষ সেখানে এ শব্দটি আলোচিত হবার কথা নয়। আজকাল শহরের কাওকে এ শব্দটি ব্যবহার করতে দেখবি না, এমন কী গ্রামেও এখন আর সই বা সখী কথাটি কেউ বলে না।


একটা সময় ছিল যখন দুটি মেয়ের মধ্যে খুব ঘনিষ্টতাকে স্থায়ী রূপ দিতে সই পাতাতো। একে অপরকে সই বলে ডাকত, আর যত প্রাণের কথা তা হতো ওই সইয়ের সঙ্গে। আজ তোর সঙ্গে একটা প্রাণের কথা বলব, তাই সই ছাড়া আমার চলছে না রে,...

তুই হয়ত আমার ওপর খুব রাগ করছিস- মুঠোফোন, ল্যান্ডফোন, ইমেইল, ফেসবুক থাকতে আমি কেন এই দীর্ঘ চিঠির পথ ধরেছি। পড়া শেষ হলে নিজেই বুঝবি চিঠি ছাড়া ব্যাপারটা খোলাসা করা কঠিনই হতো আমার পক্ষে। চিঠির কথা যখন উঠলই তখন একটা মজার ব্যাপার জানাই তোকে। ক’দিন আগে জিপিওতে গিয়েছিলাম একটা কাজে। দেখলাম ওখানে বড় বড় করে লেখা- চিঠি লিখুন ইহা স্থায়ী। পড়ে তো আমি হেসে খুন। এই যে আমি চিঠিটা লিখলাম তোকে, পড়ে যদি ছিঁড়ে ফেলিস (জানি তা-ই করবি তুই), তাহলে তা স্থায়ী হবে কী করে? কম্পিউটার আর ইন্টারনেটের যুগে মানুষ কি কাগজের বোঝা বয়ে বেড়াবে?

গত সপ্তাহে একটা খ্যাতনামা ইংরেজি দৈনিকের পত্র কলামে এক যুবতী পত্র লেখিকার চিঠি পড়ে তোকে এই চিঠি লিখতে বসেছি। পত্র লেখিকা জানিয়েছে, সম্প্রতি এক বয়স্ক ভদ্রলোকের সঙ্গে তার খুবই ঘনিষ্ট সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। যুবতীর বয়স ২৩ আর ভদ্রলোকের ৫৫। তাদের সম্পর্ক এতদূর অবধি গড়িয়েছে যে, ওই সম্পর্কের জন্য যুবতী সবকিছু করতে প্রস্তুত। মজার ব্যাপার হলো, ওই ভদ্রলোকের মেয়ে যুবতীর ঘনিষ্ট বান্ধবী।

পত্র লেখিকার ভাষ্যমতে ভদ্রলোক খুব চৌকস। গান গাইতে পারেন, বাঁশি বাজাতে পারেন (বারি সিদ্দিকীর কাছে বাঁশি বাজানো শিখেছেন), জাদু জানেন (তার এ- বিদ্যার গুরু কে জানিস? জুয়েল আইচ), ভাল ক্রিকেট খেলতেন এক সময় (বাংলাদেশ জাতীয় দলের সাবেক অধিনায়ক রকিবুল হাসান তার ক্রিকেট মেট ছিলেন), তিনি ভাল দাবাড়ু (দাবা ফেডারেশনের সহ সভাপতি ছিলেন দীর্ঘদিন। একবার নিয়াজ মোরশেদকে হারিয়ে দিয়েছিলেন), বাংলা ছাড়াও তিন চারটি ভাষা জানেন। জীবন ও জগৎ সম্পর্কে তার বিস্তর জ্ঞান। ৫০ টিরও বেশি দেশে গেছেন। পৃথিবীর নামকরা সব স্থান পরিদর্শন করেছেন। তিনি একজন হস্তরেখা বিশারদ, নিউমারলোজি ও হিপ্টোনিজমে দখল আছে (সে তো থাকতেই হবে না- হলে নিজের চেয়ে ৩২ বছরের ছোট ছুঁড়িকে পটালেন কেমন করে?)।

প্রতিদিন সকালে তিনি দু-ঘণ্টা দৌঁড়ান আর ঘণ্টা খানেক সাঁতার কাটেন। জিমেও যাতায়াত আছে। সিগ্রেট খান না, তবে মদ ও বিয়ারে অভ্যস্ত। টানা ছ’ পেগ অবধি চালাতে পারেন, বিএক্তিয়ার হন না। ভদ্রলোকের আরও অনেক গুণের কথা জানিয়েছে যুবতী। তার লেখা থেকে অনুমান করছি তাদের সম্পর্কটা বিছানা অবধি গড়িয়েছে। কারণ, কাকু পর্যায়ের এই ভদ্রলোকদের উদ্দেশ্যই থাকে কোনো রকমে পটিয়ে পাটিয়ে মেয়ে স্থানীয়দের বিছানায় নিয়ে যাওয়া। এ বাবদে কাকুরা ভীষণ এক্সপার্ট। এ রকম প্রসঙ্গের উল্লেখ আছে এমন একটা বাংলা উপন্যাস পড়েছিলাম বেশ ক’বছর আগে, নামটা ভুলে গেছি। তবে বিশ্ববিখ্যাত একটা উপন্যাসের কথা বলতে পারি তোকে যেখানে মাঝবয়সী এক কাকু ১২ বছরের এক কিশোরীর সঙ্গে যা খুশি তা-ই করেছিল। উপন্যাসের নাম ললিতা। লেখক ভ্লাদিমির নভোকভ- উপন্যাসের নায়ক হামবার্ট হামবার্ট মধ্যবয়সী লিটারারি স্কলার, জন্ম পারীতে। বাবা সুইস আর মা ইংরেজ। ভদ্রলোকের এক বাল্য প্রেমিকা ছিল অ্যানাবেল লেই নামে যে কিনা অল্প বয়সে মারা যায়। এরপরে তিনি ভ্যালেরিয়া নামের একটা মেয়েকে বিয়েও করেন; কিন্তু সে বিয়ে টেকেনি। হামবার্ট হামবার্ট লেখালেখিতে মনোনিবেশ করবার জন্য নিউ ইংল্যান্ডের ছোট্ট শহর রামসডেলে এসে একটা বাসা ভাড়া নেন। বাড়ির মালকিন শারলোট হেজ নামের এক বিধবা। তারই ১২ বছর বয়সের মেয়ে ডোলারেস হেজ, হামবার্ট হামবার্ট যার প্রেমে পড়েছিলেন পাগলের মতো আর তাকে ডলি, লোলিতা, লোলা, লো আর ল বলে ডাকতেন। তার সংস্পর্শে থাকবার জন্যই ভদ্রলোক মূলত বাসাটা ভাড়া নেন। আর মেয়েটাকে ভোলাবার জন্য আমেরিকান পপ কালচারের নানান জিনিস, বাচ্চাদের ছবি, কমিক্স ইত্যাদি উপহার দেন দেদারসে।

স্কুলের সামার ক্যাম্পে যোগ দিতে লোলিতা বাড়ির বাইরে গেলে ওর মা হামবার্ট হামবার্ট প্রতি প্রেম ভাবে আসক্ত হন। বলেন, হয় আমাকে বিয়ে করুন না হয় আমার বাড়ি ছেড়ে দিন। লোলিতার নিবিড় সান্নিধ্যে থাকবার আশায় হামবার্ট হামবার্ট ওই প্রস্তাবে রাজি হন। এমনি সময় একদিন শারলোট হামবার্ট হামবার্টের ডাইরি পড়ে ফেলেন আর তার বদ মতলব টের পান। মেয়েকে নিয়ে পালিয়ে যাওয়ার ফন্দি আঁটেন। তিনি হামবার্ট হামবার্টকে এই বলে শাঁসান যে, তিনি তার ‘ডার্টি ওল্ডম্যানের’ স্বরূপ ফাঁস করে দেবেন। কিন্তু ভাগ্য হামবার্ট হামবার্টের পক্ষে ছিল- রাস্তা পার হওয়ার সময় একদিন শারলোট গাড়ি চাপা পড়ে মারা যান। হামবার্ট হামবার্ট সামার ক্যাম্প থেকে লোলিতাকে তুলে আনেন আর জানান যে, তার মা অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি আছেন। লোক জানাজানির ভয়ে তিনি লোলিতাকে নিয়ে ওই বাড়িতে ফিরে না গিয়ে একটা হোটেলে ওঠেন। ওখানে অদ্ভূত এক লোকের দেখা পান। লোকটার নাম ক্লারি কুইলটি (পরে লোলিতার সঙ্গে তার বিয়ে হয়েছিল)।

এক রাতে শ্লীলতা হানির উদ্দেশ্যে হামবার্ট হামবার্ট লোলিতার অগোচরে তাকে ঘুমের বড়ি খাইয়ে দেন; কিন্তু ওই বড়ি কার্যকর হয় না। লোলিতা তখন হামবার্ট হামবার্টের কাছে নিজেকে সমর্পন করে। হামবার্ট হামবার্ট জানতে পারেন তিনিই তার প্রথম প্রেমিক নন। সামার ক্যাম্পে অন্য এক যুবকের সঙ্গে তার যৌন সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছিল। হামবার্ট হামবার্ট তখন ওকে জানিয়ে দেন ওর মা আর বেঁচে নেই, এখন তার ইচ্ছে মতোই ওকে তার জীবন কাটাতে হবে। এরপরে দুজনে মিলে দেশের নানা স্থানে ঘুরে বেড়াতে শুরু করে আর অবস্থান করতে থাকে এক হোটেল থেকে আর এক হোটেলে।...

পত্র লেখিকার কথায় ফিরে আসি। সে তার চিঠির শেষে জানিয়েছে, কিছুদিন আগে তারা সিঙ্গাপুরে বেড়াতে গিয়েছিল আর তাতে ওর পরিবারের কারও আপত্তি ছিল না। থাকবার কথাও নয়- কাকুর সঙ্গে বেড়াতে যেতেই পারে।

সিঙ্গাপুরে কী ঘটেছিল সহজেই অনুমান করা যায়। দুজনে একটা ফাইভস্টার হোটেলে উঠেছিল। বেড়াতে গিয়েছিল মেরিনা বে’তে। সন্তোষা আইল্যান্ডে কেবল- কারে সমুদ্র পাড়ি দিয়েছিল। মনোরেলে ভ্রমণ শেষে নাইট সাফারি দেখতে গিয়েছিল। অরচার্ড রোডের পশ শপিংমল থেকে আত্মীয় স্বজন, বন্ধুবান্ধবের জন্য অনেক গিফট কিনেছিল, অতঃপর হোটেলে ফিরে ডিনার শেষে যার যার কক্ষে গিয়ে ঢুকেছিল। দুজনের জন্য দুটো রুমই নেওয়া হয়েছিল, তবে ভদ্রলোক মাঝরাতে যুবতীর ঘরে টোকা মেরে ছিলেন। যুবতী ইতস্তত করে দরজা খুলে দিয়েছিল। তার পরণে ছিল ফিনফিনে নাইটি যা ভেদ করে ঠিকরে বেরিয়েছিল তার যৌবন, আর তা দেখে ভদ্রলোক যৌনাক্ত হয়েছিলেন। যৌনাক্ত শব্দটা ডিকশনারিতে পাবিনে- আমি বানিয়েছি, লেখকরা যেমন বানায়। সেদিন চিলির লেখক ও কবি রোবেরতো বোলানিওর কবিতায় পড়লামঃ

I dreamt I was 69ing with Anais Nin on an enormous basaltic flagstone.

অ্যানিস নিন ছিলেন ফরাসি-কিউবান লেখক। ভীষণ সুন্দরী ছিলেন। হেনরি মিলারের সঙ্গে পারীতে রোমান্টিক আর বোহেমিয়ান জীবন যাপনের জন্য খ্যাত। 69ing ব্যাপারটা বুঝেছিস তো? হোটেল কক্ষে কী ঘটেছিল অনুমান করতে পারছিস নিশ্চয়ই।

পৌঢ় ভদ্রলোক সঙ্গত কারণেই সুখী হয়েছিলেন। যুবতীও। লাভ ট্যুর থেকে ফিরে ভদ্রলোক তার ব্যবসার কাজে খুব ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন। ঘর-সংসার আর সন্তান সন্ততি আছে তার। যা কিছুই হোক না কেন সংসার তো আর ভাঙ্গা যাবে না, নইলে বদনাম হবে- সমাজে থাকা মুশকিল হবে।

যুবতীর সঙ্গে এক সময় তার যোগাযোগ ক্ষীণ হয়ে পড়ে। তিনি তো আর প্রেমে পড়েননি। অন্য আরও অনেক মেয়ের সঙ্গে তার এ রকম সম্পর্ক হয়ত আছে। লোকাল পশ হোটেলে তাদের সঙ্গে হয়ত বিছানায়ও যান। ওই যুবতীকে গেছেন ভুলে। যুবতীটি, বুঝলি তো হোটেল কক্ষেই খুতো হয়ে গেছে। ক্ষত ও বলতে পারিস। এমন ক্ষত যা কোনো দিন শুকাবার নয়। তারপরও সে পৌঢ়কে বিয়ের জন্য চাপ দিয়েছিল। পৌঢ় হেসে উড়িয়ে দিয়েছিলেন। বয়সের পার্থক্যের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। ও যে তার মেয়ের বান্ধবী সে কথাও বলতে ভোলেননি। যুবতী তার সব যুক্তির কাছে হার মেনে দিশেহারা। পত্র কলামের উত্তরদাত্রীর কাছে জানতে চেয়েছে এখন সে কী করবে।

ওই পত্র লেখিকা তুই ছাড়া আর কেউ নয়। আর ওই পৌঢ় ভদ্রলোক তোর প্রিয় হিটলু আঙ্কেল। নামটা বেশ যুবক-যুবক তাই না রে? ওর মেয়ে টিনাই তো তোর বেস্টফ্রেন্ড –মানে সই। আমার চেয়েও সে তোর বেশি প্রিয়। আমিও তোর কম প্রিয় নই। আমার এই ভেবে দুঃখ হচ্ছে যে, তুই ব্যাপারটা আমাকে না জানিয়ে ইংরেজি কাগজের পত্র কলামের উত্তরদাত্রীর কাছে লিখতে গেলি কেন? সে কি তোর সমস্যার সমাধান আমার চেয়ে ভাল দিতে পারবে? আর যা-ই হোক সে তো আর তোর সই নয়!০


লেখক পরিচিতি
দিলওয়ার হাসান
জন্মসাল – ১৯৫৭, জন্মস্থান – মানিকগঞ্, বর্তমান আবাসস্থল – ঢাকা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে অনার্স সহ এম,এ। স্কুল জীবন থেকে লেখালিখি ও সাংবাদিকতা শুরু। ১৯৮১ সালে দৈনিক সংবাদের সহ সম্পাদক হিসেবে কর্মজীবনের শুরু।
পেশা - বেসরকারি চাকরি ও লেখালেখি।
গল্প, প্রবন্ধ, ভ্রমণ কাহিনি, অনুবাদ।
প্রথম আলো, আলোকিত বাংলাদেশ, কালি ও কলম, উত্তরাধিকার, শব্দঘর ও অনলাইন পত্রিকা নিয়মিত লেখেন।

প্রকাশিত গ্রন্থ – অন্য দেশের গল্প, (অনুবাদ গল্প সংকলন), টু উইমেন, (অনুবাদ উপন্যাস), আদম এবং ইভের গল্প(ছোট গল্প), সর্ট স্টোরিজ, আইজ্যাক সিঙ্গার (অনুবাদ গল্প সংকলন), ওস্তাদ নাজাকাত আলি কর্নেলকে একটা চিঠি লিখেছিলেন (ছোট গল্প), হারুকি মুরাকামির শ্রেষ্ঠ গল্প (অনুবাদ গল্প) 0

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

1 মন্তব্যসমূহ