
নীহারুল ইসলাম
আবহ দপ্তরের ঘোষণা অনুযায়ী সেটা ছিল একটা সাধারণ ঘূর্ণাবর্ত। সেই সাধারণ ঘূর্ণাবর্ত কী করে যে অসাধারণ হয়ে উঠেছিল! যার জেরে সেবছর বাংলা ও ঝাড়খন্ডের আকাশ ঘিরে মিশকালো মেঘ জমাট বেঁধে ঠাই দাঁড়িয়েছিল দিনের পর দিন। আর লাগাতার ক’দিন ধরে বিরামহীন বৃষ্টি ঝরিয়েছিল। কিন্তু সেটা যে সাধারণ ঘূর্ণাবর্ত ছিল না, বুঝতে অসুবিধা হয়নি কারও। নিজের নিজের চোখে সবাই দেখেছিল। বৃষ্টি তো নয়, যেন বৃষ্টি-বোমার বর্ষণ হয়েছিল। সঙ্গে ছিল ঝোড়ো হাওয়ার ইন্ধন। প্রায় সবকিছু নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়ার জোগাড়! কিন্তু সবকিছু নিশ্চিহ্ন হয়নি।
শুধুমাত্র বাসুমাটির বাঁধটা কেটে গিয়েছিল। বলতে গেলে সেটাও ছিল একটা মহাপ্রলয়। বহুদিন পূর্বে যা ঘটেছিল এই বাংলার বুকে। গ্রামের পর গ্রাম, মাঠের পর মাঠ প্লাবিত হয়েছিল। ক্ষেতের ফসল ক্ষেতে ছিল না। খড়-কুটো হয়ে কোথায় যে ভেসে গিয়েছিল! ঝোঁপ-জঙ্গলগুলি হয়ে উঠেছিল নূহ নবীর এক একটা ভাসমান জাহাজ। সেই সব জাহাজের কোনও একটিতে সাপ-ব্যাঙের সঙ্গে হাসিমুদ্দিন নামে একজন মানুষ ভাসতে ভাসতে তেপান্তরের মাঠে একটা বাবলাগাছের মাথায় গিয়ে লটকেছিল। এবং এতকিছুর পরেও হাসিমুদ্দিন নামের মানুষটা নাকি জ্যান্ত ছিল। তবে আগান-বাগান, গাছগাছালির চরম ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল। আর জানমালে মানুষ এমনই নাকাল হয়েছিল যে, সেই প্লাবনের কথা মনে পড়লে যারা বেঁচে আছে তাদের বুড়ো হাড়ে আজও থরথরি কাঁপুনি ধরে। আর যারা বেঁচে নেই তাদের সন্তানেরা তাদের পূর্বপুরুষের কাছে শোনা গল্প স্মরণ করে আজও বুকে ধুকপুকি টের পায়। শুধু মানুষ কেন, পশুরা গর্তে থাকতে ভয় করে। আর পক্ষীরা ব্যাঙ্গমা-ব্যাঙ্গমীর কাছে সেই মহাপ্রলয়ের গল্প শুনে গাছে বাসা বাঁধতেই ভুলে আছে সেই থেকে! শূণ্য আকাশই যেন তাদের ঘরবাড়ি।
আক্রান্ত মানুষদের মধ্যে যারা মারা পড়েছিল, আপদ গিয়েছিল। তবে যারা বেঁচে ছিল তাদের বিভ্রান্ত করে ভোট পেতে বিরোধীরা সেই দুর্যোগকে বলেছিল, ‘ম্যানমেড’! সঙ্গে এও বলেছিল, ‘সরকার মানুষকে বিপদে ফেলতে এই অবস্থার সৃষ্টি করেছে! আমরা ক্ষমতায় এলে এই ঘটনার নিরপেক্ষ তদন্ত করাব।’ কিন্তু ঘূর্ণাবর্ত জনিত কারণে দিনের পর দিন সেই বিরামহীন ঝড়-বৃষ্টিকে বিরোধীরা ‘ম্যানমেড’ বলেছিল নাকি ‘বাসুমাটির বাঁধ কেটে যাওয়াটা’কে, তা আজ পর্যন্ত স্পষ্ট হয়নি। যদিও সেদিনের সেই বিরোধীরাই আজ সরকারে। কথামতো তারা সুপ্রীম কোর্টের প্রাক্তন বিচারপতির নেতৃত্বে কমিশন বসিয়ে নিরপেক্ষ তদন্ত চালাচ্ছে। কবে তার রিপোর্ট বেরোবে? কিংবা আদৌ বেরোবে কিনা না, বলা খুব মুশকিল। তবে সেই দুর্যোগের মধ্যে সেদিন পোস্টাফিসের সামনেকার পুকুরপাড়ের যে গাছটি বুক ভেঙে মাটিতে আছড়ে পড়েছিল, মাটি কেন, গাছটি তো আছড়ে পড়েছিল পোস্টাফিসের গেটের সামনের বিডিও অফিস, জোতখামার, রাজগুরুপাড়া, ফকিরপাড়া যাওয়ার পিচ রাস্তাটার ওপর। যাইহোক, সেটা ছিল নিছকই দুর্যোগ জনিত একটা দুর্ঘটনা। হয়ত গাছটির বুকে ফুটো ছিল! হ্যাঁ, ফুটো একটা ছিলই। কাঠঠোকরা ঠুকরে ঠুকরে গাছটির বুকে একটা ফুটো করেছিল। সেরকম ফুটো তার বুকেও আছে। একটা নয়, দু’দুটো! তাহলে তারও বুক ভেঙে আছড়ে পড়ার কথা! কিন্তু কই- সে তো বুক ভেঙ্গে আছড়ে পড়ে নি! তাহলে কি ‘নির্মল পঞ্চায়েত সমিতি’র বিজ্ঞপ্তি-বোর্ড টাঙাতে ওই গাছে বড় বড় যেসব গজাল পোঁতা হয়েছিল তাতেই যে ক্ষতের সৃষ্টি হয়েছিল তা থেকেই কি ওরকমভাবে বুক ভেঙে আছড়ে পড়া? এইসব ভাবতে ভাবতে পাশে দাঁড়িয়ে থাকা সমবয়সী আর একটি গাছ, নানারকম সুখদুখ সয়ে ওই ভাঙা গাছটির সঙ্গে যে বেড়ে উঠেছিল, সে দেখেছিল
হৃদয় বিদারক সেই দৃশ্য। কিংবা সেই দৃশ্য দেখতে দেখতে সে এইসব কথা ভেবেছিল। যাইহোক, তার প্রাণে হাহাকার উঠেছিল। কিন্তু গাছের হাহাকার কে শোনে বা কে বোঝে? একমাত্র জগদীশচন্দ্র নামে একটা পাগলমানুষ অনেকদিন আগে ব্যাপারটা অনুধাবন করেছিলেন। যদিও গাছেরা কেউ জগদীশচন্দ্রের নাম জানে না। জানলে নিশ্চয় তাঁকে তারা আজ পূজা করত। তবে আজকের মানুষ যারা তাঁকে জানে তারাও তাঁকে ভুলে থাকার চেষ্টা করে। কারণ, তারা মনে করে ওই মানুষটি ‘গাছেরও প্রাণ আছে’ বলে একদা প্রলাপ বকেছিলেন! যে-কারণে মনুষ্যসমাজের প্রভূত ক্ষতি সাধন হয়েছে। তারপরেও সেই গাছটি বুক ভেঙে আছড়ে না পড়লেও এতদিন দাঁড়িয়ে ছিল তার বুক ভাঙা শোকতাপ নিয়ে। কিন্তু তার জীবনে যে এমন সুখের দিন আসবে, ভাবেনি কোনওদিন। সে ভেবেছিল তার জীবনেও নেমে আসবে ওই রকম আর একটা দুর্যোগের দিন, দুঃখের দিন! আর সেও তার সঙ্গী গাছটির মতো বুক ভেঙে আছড়ে পড়বে। কিন্তু যেদিন শুনল, সে যে জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে সেই পুকুরপাড়ে একটা পার্ক হবে। শিশুপার্ক! সেই পার্কে শিশুরা খেলতে আসবে। কী যে আনন্দ হয়েছিল তার! যে ক’দিন বাঁচবে, শিশুদের কোমল হাতের স্পর্শ পাবে! ওই সব নিষ্পাপ শিশুদের সংস্পর্শে একটু স্বস্তিতে বাঁচবে। সেই স্বস্তিতে বাঁচার আগাম স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিল সে।
গাছটি সেই মতো অপেক্ষা করছিল। প্রথম যেদিন শিশুপার্কের কাজ শুরু হল, মানে বাউন্ডারি ওয়ালের জন্য ভিত খোঁড়ার কাজ, উদোম কোদাল চলল। গাইতি চলল। সেই সঙ্গে দোসর যন্ত্রদানব জেসিবি তো ছিলই। ওতেই তার একটা মূল্যবান জড় কেটে গেল। তার কষ্ট হল। সে ব্যথা পেল। তার রক্তপাত ঘটল। কিন্তু তার রক্ত তো আর মানুষের রক্তের মতো লাল নয়। তার রক্তে হিমোগ্লোবিন নেই। তার রক্ত সভ্যতাকে ছিবড়ে করে উৎপন্ন হয় না। তার রক্ত তৈরী হয় সালোকসংশ্লেষ পদ্ধতিতে। তাই কেউ টের পেল না। যারা ভিত খুঁড়ছিল, তাদের রক্তও ঘাম হয়ে ঝরে পড়ছিল। স্বভাবতই তারাও টের পেল না। রক্ত-ঘাম সব একসঙ্গে মাটিতে মিশে যাচ্ছিল। আর সে টের পেলেও ‘একটা ভালো কাজ হচ্ছে’ ভেবে নিজের শরীরে সব কষ্ট, সব ব্যথা সহ্য করে গেল। কাউকে কিছু বলল না। এমন কী, নিজেকেও কিছু বলল না। সারারাত চেতনে অবচেতনে তার শরীরের সাদা রক্ত ক্ষরণ হয়ে চলল। তবু একটা শিশুপার্ক হবে সেই আনন্দে সে মশগুল হয়ে রইল।
এর মধ্যে স্থানীয় এক নেতার কথায় শিশুপার্ক নির্মাণের পরিকল্পনায় একটু রদবদল ঘটে গেল। শিশুপার্ক হবে এম. পি. লটের টাকায়। অথচ এম. পি. সাহেব নিজে আসবেন না! তা কী করে হয়? মহান গণতন্ত্রে এটা কোনও মতেই হয় না। যখন লোকসভা নির্বাচন মাথার ওপর! তাহলে এম. পি. সাহেব নিজেই এসে এই শিশুপার্কের উদ্বোধন করুন। সামনে লোকসভা নির্বাচনটা যদি এই হুজুগে আবার উৎরে যায়! এমন ভাবনা এল স্থানীয় এক সাধারন নেতার মাথায়। মনে-আসা-কথা সে আবার চেপে রাখতে পারে না। কথা চেপে রাখতে গেলেই তার পেট গুড়গুড় করে। শরীরে আরও অনেক সমস্যা দেখা দেয়। অগত্যা সে তার বড় নেতাদের বলল তার মনের কথা। তার পেট গুড়গুড়ি থেমে গেল। শরীরে সমস্যার বদলে ভাগ্যে জুটল প্রশংসা। বড় নেতারা তার ভাবনার তারিফ করল। তারা আর সব বড় নেতাদের অর্থাৎ জেলার নেতা, রাজ্যের নেতাদের সঙ্গে ব্যাপারটা নিয়ে আলোচনা করল। সেই মতো এম. পি. সাহেবের সঙ্গে যোগাযোগ করা হল।
এম. পি. সাহেব তখন দিল্লিতে। ব্যস্ত। তবু ধৈর্য ধরে সব শুনে তিনি বললেন, এখন তো সংসদে অধবেশন চলছে! বুঝতেই পারছেন, নির্বাচনের আগে গুরুত্বপূর্ণ সব বিল পাশের ব্যাপারটা আছে! তবু আপনারা যখন বলছেন, আমি আমার নির্বাচনক্ষেত্র অবশ্যই যাব। তবে এক সপ্তাহ পরে। সামনের সপ্তাহের পরের সপ্তাহে ডেট হলে ভাল হয়।
এম. পি. সাহেব আসবেন বলে কথা! এক সপ্তাহ কেন, দু’সপ্তাহ- দু’মাস হলেও রাজী।
আগে কথা হয়েছিল শিলান্যাস করবেন পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি। অতিথি হিসাবে সঙ্গে থাকবেন স্থানীয় সমষ্টি উন্নয়ন আধিকারিক। সেই মতো শ্বেতপাথরে তাঁদের নাম খোদাই হয়ে চলে এসেছিল। কিন্তু এম. পি. সাহেবের আগমন বার্তা পেয়ে পার্টির ব্লক-সভাপতির ফোন কন্ট্রাক্টরকে, হ্যালো- আমরা চাইছি, আপাতত এক সপ্তাহ আপনি
শিশুপার্কের কাজ বন্ধ রাখুন। এম. পি. সাহেব নিজেই আপনার কাজের উদ্বোধন করতে রাজী হয়েছেন। তাঁর নামটা যাতে উদ্বোধক হিসেবে শ্বেতপাথরে খোদাই থাকে তার ব্যবস্থা করবেন। একটা ভালো মঞ্চ হলে ভালো হয়। সামনে হাজার খানেক চেয়ার। আপনি শুকাইদাকে বললে সে-ই সবকিছু করে দেবে। শুকাইদার সঙ্গে তো আপনার সম্পর্ক ভালোই! আর ডেট হবে এম. পি. সাহেবের কথা মতো। কাল সেটা আপনাকে জানিয়ে দেওয়া হবে...
কন্ট্রাক্টর আর কী করে, লেস্ মেরে কাজ নিয়েছে। কাজ তো তাকে যে করে হোক ওঠাতে হবে। আর যাই হোক পঁচিশ লক্ষ টাকার ক্রেডেন্সিয়াল! কম কথা নাকি?
- ‘জী হুজুর’ বলে সে পার্টির ব্লক-সভাপতিকে সম্মতি জানায়।
গাছটি কিন্তু এত সব ভেতরের খবর জানতে পারে না। সে নিজের অনেকগুলি অঙ্গের সঙ্গে একটা মুল্যবান অঙ্গ কেটে অপেক্ষা করে। মাটি না হোক, কংক্রীট ঢালায়ের ব্যান্ডেজ পেলে অন্তত আর কিছুদিন দাঁড়িয়ে থাকতে পারবে। কিন্তু সে গুড়ে বালি! সকাল হয়। দুপুর আসে। বিকেল গড়ায়। সন্ধ্যে হয়। রাত নেমে আসে। গাছটি তবু অপেক্ষা করে। এই বুঝি ডাক্তার এল! মানুষের কাছে মিস্ত্রি ‘মিস্ত্রি’ হলেও গাছটি কিন্তু মিস্ত্রিদের ‘ডাক্তার’ ভাবছে। যেন তারা এলেই সে বেঁচে যাবে!
হয়ত বেঁচেও যেত! নতুন করে নাম খোদাই করা শ্বেতপাথরও চলে এসেছিল। কিন্তু শেষ মুহূর্তে নতুন শ্বেতপাথরে একটা সুক্ষ্ম ভুল ধরা পড়ে। সেই ভুলটা অন্য কারও চোখে পড়ে না, শুধুমাত্র সমষ্টি উন্নয়ন আধিকারিকের চোখে পড়ে। কারণ তার নামেই ওই সুক্ষ্ম ভুলটা ছিল। ঠিক নামে ভুল নয়, নামের আগে তাঁর খুব কষ্ট করে পাওয়া একটা ডিগ্রির উল্লেখ ছিল না। সেটা হল ‘ডা.’। কারণ সমষ্টি উন্নয়ন আধিকারিক হওয়ার আগে তিনি খুব কষ্ট করে হোমিওপ্যাথি ডাক্তার হয়েছিলেন। বয়সকালে দিনরাত এক করে বউয়ের বদলে বই’কে বুকে সেঁটে রাখা, সেটা যে কী কষ্ট, স্পষ্ট মনে আছে তাঁর। অথচ নামের আগে সেই ত্যাগ করে পাওয়া ‘ডা.’ কথাটাই লেখা থাকবে না, নিজে একজন আধিকারিক হয়ে সেটা তিনি হজম করেন কী করে? অতএব আবার শ্বেতপাথর বদল, উদ্বোধনের তারিখ বদল। এম. পি. সাহেব এই তারিখ বদল ব্যাপারটা নিজেও চাইছিলেন। ক্ষমতাসীন দলের এম. পি. হওয়ার এই একটা অসুবিধা। অধিবেশন চলাকালীন দিল্লি ছাড়া যায় না। হাইকমান্ডের হুইপ! তার ওপর নির্বাচনের আগে শেষ অধিবেশন। স্বভাবতই তিনিও সমষ্টি উন্নয়ন আধিকারিকের এই সিদ্ধান্তে খুশি হলেন।
ওদিকে এই তারিখ বদলের ঝক্কিতে গাছটি অপেক্ষা করতে করতে একদিন সকালে টের পেল যে, সে আর মাটির সঙ্গে সম্পর্ক রাখতে পারছে না। যে কোনও সময়ে তার পতন ঘটতে পারে! পতন-ঘটা মানে জড় উপড়ে মুখ থুবড়ে আছড়ে পড়ার কথা। কিন্তু মুখ জড় উপড়ে মুখ থুবড়ে আছড়ে পড়লে তো তাকে পোস্টাফিসের গেটের সামনের বিডিও অফিস, জোতখামার, রাজগুরুপাড়া, ফকিরপাড়া যাওয়ার রাস্তাতেই পড়তে হয়। আর রাস্তাটা খুব চালু। সব সময় লোকজন, গাড়িঘোড়া, সাইকেল-রিক্সা, তার ওপর আজকাল হয়েছে মোটরবাইক, চলাচল করে। এই তো এখন কত লোকজন! কত গাড়িঘোড়া! সাইকেল-রিক্সা! মোটরবাইক! তাহলে কী করে সে এই সময় উপড়ে পড়বে? এই সময় উপড়ে পড়লে যে অনেক জানমালের ক্ষতি হয়ে যাবে! কিন্তু সে তো জানমালের ক্ষতি করতে চায় না! সে তো কোনও দুর্যোগ নয়! অথচ সে টের পাচ্ছে, তার শরীরের শিরা-উপশিরাগুলি মাটি থেকে একটা একটা করে ছিঁড়ে যাচ্ছে! মাটি তাকে ধরে রাখতে পারছে না। টের পাচ্ছে তবু সে খুব কষ্ট করে দাঁড়িয়ে সঠিক সময়ের অপেক্ষা করছে। ভাবছে কখন উপড়ে পড়লে কারও কোনও ক্ষতি হবে না। কখন রাস্তায় এসব চলাচল বন্ধ হবে? অপেক্ষা করতে করতে জোহর গড়িয়ে আসর, আসর গড়িয়ে মাগরিব, মাগরিব গড়িয়ে এষা, এষার ওয়াক্ত গড়িয়ে মাঝ রাত! তারপর মাঝরাত গড়িয়ে কিভাবে ফজর হয়ে এল গাছটি ছাড়া আর কেউ তা টের পেল না। তবে ফজর হওয়াটা অনেকেই টের পেল। রাজগুরু পাড়ায় অনুকুল ঠাকুরের মন্দিরে ভোরের প্রার্থনা আর ফকিরপাড়ার জুম্মা মসজিদে ফজবের নামাজের আজান শুরু হয়ে গিয়েছে ততক্ষণে। গাছটি দেখল রাস্তায় লোকজন-
গাড়িঘোড়া চলাচল আপাতত বন্ধ আছে। কিন্তু যেই প্রার্থনা আর নামাজ শেষ হবে, আবার সবকিছুর চলাচল শুরু হয়ে যাবে। তাহলে এটাই সুযোগ! না, গাছটি আর অপেক্ষা করল না, কিংবা অপেক্ষা করতে পারল না, ঢলে পড়ল পোস্টাফিসের গেটের সামনের পিচ রাস্তার ওপর। কয়েক বছর আগে ঠিক যেভাবে তার সঙ্গী গাছটি ভেঙে পড়েছিল, ঠিক সেভাবেই। তবে দুর্যোগে তার সঙ্গী গাছটি বুক ভেঙে আছড়ে পড়েছিল। আর সে তার শরীরের সব শিরা-উপশিরা ছিঁড়ে মুখ থুবড়ে উপড়ে পড়ল একেবারে পোস্টাফিসের গেটের সামনে...।
ডাক ও তার বিভাগের আওতায় হলেও আজকাল পোস্টাফিসের ভূমিকা যে জায়গায় এসে ঠেকেছে তাতে সে কথাটা কাউকে জানানোর প্রয়োজন বোধ করে না। কিংবা খবরটা কাউকে জানানোর মতো তার কোনও পরিকাঠামো নেই। শুধু একজন যে, রোজ সন্ধ্যার পর স্বভাব দোষে একটু মদ্যপান করে, যে-কারণে তার শরীরে মেদ জমতে শুরু করেছে বলে ডাক্তারের পরামর্শ মেনে ওই রাস্তায় রোজ ভোরবেলা পায়চারী করে, দৃশ্যটা প্রথম তার চোখেই পড়ে। আর সে তার স্মার্ট ফোনে পিচ রাস্তায় মুখ থুবড়ে পড়ে থাকা গাছটির একটি ফোটো তুলে ফেস্বুকে সেটে দেয়। শিরোনাম লেখে, পার্ক গড়তে বৃক্ষ নিধন...
নীহারুল ইসলাম
‘সাগরভিলা’ লালগোলা, মুর্শিদাবাদ, ৭৪২১৪৮ পঃ বঃ, ভারতবর্ষ।
জন্ম- ১২ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৭, মুর্শিদাবাদ জেলার সাগরদিঘী থানার হরহরি গ্রামে (মাতুলালয়)।
শিক্ষা- স্নাতক (কলা বিভাগ), কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়। পেশা- শিক্ষা সম্প্রসারক।
সখ- ভ্রমণ। বিনোদন- উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত শ্রবণ।
রৌরব, দেশ সহ বিভিন্ন লিটিল ম্যাগাজিনে লেখেন নববই দশক থেকে।
প্রকাশিত গল্পগ্রন্থঃ
পঞ্চব্যাধের শিকার পর্ব (১৯৯৬), জেনা (২০০০), আগুনদৃষ্টি ও কালোবিড়াল (২০০৪), ট্যাকের মাঠে, মাধবী অপেরা (২০০৮), মজনু হবার রূপকথা (২০১২)।
দু’টি নভেলা--, জনম দৌড় (২০১২), উপন্যাস।
২০০০ থেকে ‘খোঁজ’ নামে একটি অনিয়মিত সাহিত্য সাময়িকী’র সম্পাদনা।
পুরস্কার :
লালগোলা ‘সংস্কৃতি সংঘ’ (১৯৯৫)এবং শিলিগুড়ি ‘উত্তরবঙ্গ নাট্য জগৎ’ কর্তৃক ছোটগল্পকার হিসাবে সংবর্ধিত
(২০০৩)। সাহিত্য আকাদেমি’র ট্রাভেল গ্রান্ট পেয়ে জুনিয়র লেখক হিসাবে কেরালা ভ্রমণ (২০০৪)। বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ কর্তৃক “ইলা চন্দ স্মৃতি পুরস্কার” প্রাপ্তি (২০১০)। ‘ট্যাকের মাঠে মাধবী অপেরা’ গল্পগ্রন্থটির জন্য পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি প্রবর্তিত “সোমেন চন্দ স্মারক পুরস্কার” প্রাপ্তি (২০১০)। ভারত বাংলাদেশ সাহিত্য সংহতি সম্মান “উত্তর বাংলা পদক” প্রাপ্তি (২০১১)। রুদ্রকাল সম্মান (২০১৩) প্রাপ্তি।
niharulislam@yahoo.com
0 মন্তব্যসমূহ