এইখানে গুপ্তধন পোঁতা আছে! এই মাটিতে।
জ্যোৎস্নায় চারপাশ ভেসে যাচ্ছে। যমুনা ধীর পায়ে এগিয়ে এল। খুব সন্তর্পনে চারপাশে চোখ তুলে তাকাল। কোথাও কেউ নেই। তবু তার মনে হল একজোড়া চোখ তাকে দেখছে। বিনোদবাবুর চোখ। বিনোদ দত্ত। কানে ভেসে আসে বিনোদবাবুর কন্ঠস্বর, ‘সব পায়রা উড়ে গেছে রে যমুনা। সব। শুধু এই বুড়ো পায়রাটা এখনও এই দেড়শো বছরের পুরোনো বাড়ির রোয়াকে বসে ঝিমোচ্ছে। যেদিন চলে যাব এ বাড়ি প্রেতপুরী হয়ে যাবে রে। প্রেতপুরী!’ কথা শেষে হেসে ওঠেন বিনোদবাবু। হাসি না কান্না বোঝা ভার! হাসির সঙ্গে সঙ্গে পঁচাত্তর বছরের পৃথুল শরীরটা কাঁপতে থাকে।
লোকটা যে দু’হপ্তার বেশী হয়ে গেল নেই, এ কথাটা এখনও বিশ্বাস হতে চায় না যমুনার। মনে হয় এখুনি বুঝি দেখতে পাবে রোয়াক জুড়ে পায়চারি করছেন। পেছনে হাত। মাথা নীচু। মাথাভর্তি চুল। গা ভর্তি লোম। সব সাদা। হঠাৎ মুখ তুলে বলে উঠবেন, ‘ছিঃ। যমুনা! তোকে আমি বিশ্বাস করেছিলাম।’
গা শিউরে ওঠে যমুনার। দেবু কখন আসবে বোঝা মুশকিল। পইপই করে বলে দিয়েছে দেরী না করতে। কতটা খুঁড়তে হবে কে জানে!
পায়ে পায়ে যমুনা জায়গাটার খুব কাছে চলে এসেছে। একটা বাঁশের কঞ্চি পুঁতে চিহ্ন করে রাখা ছিল। এই তো! উবু হয়ে বসে কঞ্চিটায় হাত দিল যমুনা। সারা গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল। একটু দূরে ঐ সজনে গাছটার কাছেই দাঁড়িয়েছিলেন বিনোদবাবু আর তাঁর গুরু শম্ভু গুণীন। শম্ভু গুণীনের কন্ঠস্বর স্পষ্ট শুনতে পেল যমুনা, ‘বুঝলে ভায়া, ঐখানেই মাটির তলায় পোঁতা আছে তোমার বংশের সম্পদ। সাত ঘড়া মোহর। তবে সাবধানে! অসতর্ক হলেই মৃত্যু অবধারিত। তোমাদের ভিটের বাস্তুসাপ কিন্তু ঐ ঘড়া পাহারা দিচ্ছে। তাকে মারতে যেও না যেন। কেবল বোকা বানিয়ে তুলে আনতে হবে ঘড়াগুলো।’ বিনোদবাবুর চোখদুটো পড়ন্ত বিকেলের আলোয় ঝিকমিক করে ওঠে। ঘোর লাগা গলায় বিনোদবাবু বলে ওঠেন, ‘পারবি না যমুনা?’
বিনোদবাবু নেই। কিনু গুপ্তধন আছে। যমুনার বুকের মধ্যে অপরাধবোধ টাটিয়ে ওঠে। ফোঁড়ার মতন। সে মনে মনে বলে, ‘আপনি বলেছিলেন, পাঁচ ঘড়া আপনার। দু’ঘড়া আমার। অথচ মাটি খুঁড়ে সাপের মুখ থেকে ঘড়াগুলো তুলে আনব আমি! কেন না, ও সম্পদ আপনাদের বংশের। তবুও তো রাজী ছিলাম। কিন্তু আজ যখন আপনি নেই, তখন পুরোটা যদি আমি নিই, দোষ হয়ে যাবে? বলুন, দোষ হয়ে যাবে?’
একটা পাখী ডেকে ওঠে। বোধহয় পেঁচা। যমুনা সরে আসে। আগে দেবু আসুক। তবে কাছাকাছি যাবে। বলা তো যায় না। কোথায় লুকিয়ে আছে সাপটা। এ ভিটের বাস্তুসাপ। অনেকবার দেখেছে যমুনা। শরীরময় কেমন সুন্দর নকশা কাটা। সরসর করে চলে যেত এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত। বাড়িময় তার অবাধ যাতায়াত। এ বাড়ির ঠিকে ঝি রামের মা একবার লাঠি দিয়ে মারতে গেছিল সাপটাকে। দেখতে পেয়ে ধমকে উঠেছিলেন বিনোদবাবু, ‘খবরদার। ও সাপ আমাদের বাস্তুসাপ। ভুলেও ওকে ব্যথা দিতে নেই।’ তারপর গলার স্বর নীচে নামিয়ে বিড়বিড় করেছিলেন, ‘ও আর আমিই... আমরাই তো কেবল রয়ে গেছি। আর সব শালা তো ভাগলবা।’ বলেই আবার হেসে উঠেছিলেন বিনোদবাবু। তাঁর সেই শরীর কাঁপানো হাসি।
সত্যিই একসময় কত লোক ছিল এ বাড়িতে। যমুনার এখনও স্পষ্ট মনে আছে সেদিনের কথা যেদিন প্রথম সে এবাড়িতে এসেছিল। তখন যমুনার মা এ বাড়িতে রান্নার কাজ করত। সে সময় বাড়ি ভর্তি লোক। কত হইচই। সেই বাড়ি এখন সত্যিই ভূতের বাড়ি। গোয়ালঘর কবেই ভেঙে গেছে। ইঁদারার মুখ বুজে গেছে আবজর্নায়। বাড়ির চারধারে বাগান এখন মোটেও বাগান নয়। জঙ্গল। সে সবের মাঝখানে পোড়োবাড়িটা ভূতের মতন দাঁড়িয়ে। যমুনার মনে পড়ে যায় বিনোদবাবুর কথা, ‘প্রেতপুরী! প্রেতপুরী! বাড়ি তো নয় ভূতের বাসা...’ ভয় পেয়ে অধৈর্য হয়ে ওঠে যমুনা। দেবু কি আসবে না?
গাছের পাতায় হাওয়া খেলে যায়। ডালে ডালে খস্ খস্ শব্দ ওঠে। পাতার আড়ালে গোল চাঁদ গম্ভীর হয়ে তাকিয়ে থাকে। কী একটা অচেনা পাখীর ডাক শোনা যায়। যমুনা চিনতে পারে না। কেবল গা ছমছম করে ওঠে।
সেই কোন ছোটবেলায় শোনা ঠাকুমার কথাগুলো মনে পড়ে। ঠাকুমার মুখে খালি ভূতের গল্প। একানড়ের একটাই পা। গলাসি ভূত কেবল গলায় দড়ি দিতে বলে। গভীর নলবনের ভূত নাড়াবুনে। কানাওয়ালা ভূত বা ভুলো আবার মানুষের দিক ভুলিয়ে দেয়। সে সব শুনতে শুনতে চোখের ওপর ভৌতিক কালো ছায়া দুলে দুলে যেত। ভয়ে কাঁটা হয়ে যেত যমুনা ও তার ভাই-বোনেরা। ঠাকুমা মজা পেত। তাদের ভয় দেখিয়েই যেন বুড়ির আনন্দ। এভাবেই একদিন, ঠাকুমা শুনিয়েছিলেন যকের ধনের কথা। ‘কিপ্টে লোকেরা বামুনের ছেলেকে ডেকে যক্ করত জানিস তো? আমার বড়পিসি দেখেছিল জানিস, যককে? নদীর জলে ভেসে যাচ্চে পুন্নিমা রাতে। বুঝলি তো, পাঁচটা তামার ঘড়ার ওপর জোড়াসনে বসে, সারা গায়ে সোনার সাপ আর কোলে একখানা ছোট ছেলের কঙ্কাল...’
‘ছোট ছেলে কেন?’ বালিকা যমুনার প্রশ্নে হেসে উঠত ঠাকুমা, ‘ছোট ছেলেকে ঘরে বন্ধ করে রাখত তো। তারা না খেতে পেয়ে মরে গিয়ে যক্ হবে বলে। পাহারা দেবে। ঘড়া ঘড়া মোহর। মোহর তো নয় সুক্। অত মোহর পেলে কোন সুক্টা তোর না পাওয়া থাকবে বল তো। তখন তুই যা চাইবি তাই-ই পাবি।’
যমুনা কখনও ভাবেনি সেই ছোটবেলায় শোনা গল্প বড়বেলায় এভাবে জেগে উঠবে চোখের সামনে। ঘড়া ঘড়া মোহর। আর তাকে ঘিরে থাকা... না, যক নয়... এক বিরাট কালো সাপ। কল্পনায় সাপটার জ্বলজ্বলে চোখ দেখতে পায় যমুনা। কিন্তু সাপের চোখ কি অত জ্বলজ্বলে হয়! সাপটাকে তাড়াতে পারে না যমুনা। তার মনের ভেতর সাপটার জ্বলন্ত, ক্রুর চোখটা জেগে থাকে।
একে নির্জন, তার ওপর এত চুপচাপ চারিদিক, তাই হয়ত এত ভয়ের কথা মাথায় আসছে। যমুনা মশা মারতে মারতে ভাবে। তার এখন মনে হচ্ছে দেবু বোধহয় আসবেই না। কোন ধান্দায় আটকে পড়েছে কে জানে। বাপেরও ওপর দিয়ে যায় ছেলে। ওর বাপের তো ছোটখাটো হাতটান ছিল। তাও যখন নেশায় টান পড়ত তখন। ছেলে তো একেবারে জাতচোর। আজকাল আরও বড় ধান্দায় মেতেছে। বর্ডারে কী সব মাল পাচার করে। বাড়িতে ফেরেই না বেশীরভাগ রাতে। ঘরে নতুন বউ, তাও টান নেই ছেলের! ছেলেকে বাঁধতেই ঘরে বউমা আনল যমুনা। কিন্তু কোথায় কী? নিজে মা হয়েও বুঝতে পারে যমুনা, মেয়েছেলে দেবুর কাছে নতুন কিছু নয়।
এত রাতে গাঙনাপুর থেকে রানাঘাটে এসেছে যমুনা। ট্রেন রাতের মতন বন্ধ। দেবু গাড়ী আনবে। গাড়ীতে করে ঘড়াগুলো নিয়ে... দেবু না এলে সারারাত এখানেই কাটাতে হবে যমুনাকে। তারপর ভোরবেলা প্রথম ট্রেনে... বিরক্তিতে মশা মারতে থাকে যমুনা। আর কি আসা হবে? বারবার আসা যাবে নাকি? কে কোথায় দেখে ফেলবে তাকে! অবশ্য দেখে ফেললেই বা। এ বাড়িতে আর কিচ্ছু নেই, খবর পেয়েছে যমুনা। খাট, আলমারি – যা কিছু ছিল সব বেচে দিয়েছে বিনোদবাবুর ভাইপোরা। শিগগিরই ভাঙা শুরু হবে বাড়িটা। কি নাকি হাসপাতাল হবে। সব ঘর বিলকুল ফাঁকা। তাই তো সদর ফটকে কোনও তালা মারা নেই। না হলে তো যমুনা ঢুকতেই পারত না। সুতরাং কেউ দেখে ফেললে চোর বলে মারতে আসবে না ঠিকই। কিন্তু যমুনা কী উত্তর দেবে? এ বাড়ির পুরোনো রান্নার লোক বলে এত রাতে মায়ায় পড়ে ঘুরতে এসেছে! কেউ বিশ্বাস করবে?
বড্ড মশা। যমুনা পা নাড়া দেয়। মনে হয় এর চেয়ে সেদিন বিনোদবাবুর কথায় রাজী হলেই ভাল হত হয়ত। কী এক ভয়ে সে রাজী হয়নি। বিনোদবাবু অনেক চেষ্টা করেছিলেন, ‘ওসব যক্-টক্ এ বাড়িতে নেই। তুই নিশ্চিন্ত থাক। আমার পূর্বপুরুষরা সব গান বাজনার লোক ছিলেন। ছোট ছেলেকে মাটির নীচে আটকে রেখে দেবে এমন লোক তারা নন। শুধু তো একটা বুড়ো সাপ। পারবি না?’ তারপর যমুনার নিরুৎসাহী মুখ দেখে হতাশ হয়ে বলেছিলেন, ‘যদি জোয়ান থাকতাম এখনও, তবে কি একটা মেয়েছেলের ওপর নির্ভর করতাম, ভাবছিস? এ পাড়ার কাউকে কাউকে হয়তো বলা যেত, কিন্তু কাউকেই বিশ্বাস হয় না আমার... শেষকালে হয়তো পুরোটা পাওয়ার লোভে আমাকেই...’
সেদিন বাড়ি ফেরার পথে ট্রেনে যেতে যেতে যমুনা বারবার ভাবছিল লোকটার এই বয়সেও এত লোভ কেন? প্রথমটায় ওর লোভে চকচকে চোখমুখ দেখে রাগই হচ্ছিল যমুনার। পরে বুঝেছিল ব্যাপারটা। বিনোদবাবুই বুঝিয়ে বলেছিলেন, ‘তুই ভাবছিস বুড়ো হয়ে মরতে চলল, তবু ব্যাটাচ্ছেলের লোভ কত! আসলে কী জানিস, আমার ব্যাঙ্কে যা জমানো ছিল সব ফুরিয়ে এসেছে। একটাই ভাইপো, মাঝে মাঝে টাকা পাঠায় কিছু... এভাবে চলে? পোষ্টাপিসের টাকায় ডালভাতটা জুটে যাচ্ছে, কিন্তু বড় একটা রোগ হলে কী হবে বল তো? তারপর খুব ঠান্ডা স্বরে বলেছিল, ‘আমার যে ভাইপোটা টাকা পাঠায়, সন্তু, ওকে বলতে পারতাম... ও হেসেই উড়িয়ে দেবে... ওরা আজকালকার ছেলে এসব গুপ্তধন-টনে বিশ্বাস করে না। কিন্তু আমি জানি শম্ভু গুনীনের কথা মিথ্যে হতে পারে না।’
শম্ভু গুনীন বিনোদবাবুর গুরু। লোকটার কথা বেদবাক্য মানেন বিনোদবাবু। মাঝে মাঝে লোকটা এ বাড়িতে আসে। তখন তাকে ভালো মন্দ রেঁধে খাওয়াতে হয়। ভাবতে ভাবতে শম্ভু গুনীনের মুখটা ভেসে ওঠে যমুনার চোখের সামনে। অদ্ভুত চেহারা লোকটার। লম্বা একহারা চেহারা। চোখদুটো কোটরে ঢোকা। মাথায় লাল তিলক। বাঁশীর মত নাক। বয়সের থলকুল নেই। যমুনার সঙ্গে কোনওদিনই খুব একটা কথা বলত না। কেবল বিনোদবাবুর সঙ্গেই ঘরে ঢুকে কীসব কথা বলত। কিন্তু ঐ গুপ্তধনের কথাটা যেদিন বলেছিল, সেদিন ঐ সজনে গাছের তলায় দাঁড়িয়ে যমুনার চোখের দিকে তাকিয়ে কিছু কথা বলেছিল লোকটা, ‘তুই খুব কষ্ট পেয়েছিস সারাজীবন। কীরে ঠিক বলছি তো? খালি ভেবেছিস সুখ কই? সুখ? তোর বাবা দিতে পারেনি। সোয়ামি দিতে পারেনি। এখন ছেলে। সেও কি পারবে? হাঃ হাঃ।’ হেসে উঠেছিল শম্ভু গুনীন। তারপর বলেছিল, ‘ঠাকুরকে ডাক। ঠাকুরকে বল। বুকের মাঝে সুখের ঘড়া। কত কাছে। তবু কত দূরে। একটু পাইয়ে দাও। হাঃ হাঃ।’
হাসতে হাসতে যমুনার চোখের থেকে চোখ সরিয়ে নিয়েছিল শম্ভু গুনীন। যমুনা হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছিল। মনে হচ্ছিল কেবল তার দিকে তাকিয়ে থেকেই তার সব মনের কথা কীভাবে যেন জেনে যাচ্ছে লোকটা। সে বুঝতে পারছিল এমন লোকের কথা কখনও মিথ্যে হতে পারে না। গুপ্তধন আছে। আছেই।
অথচ কথাটা শুনে দেবুর কী হাসি! বলে, ‘গুনীন বলল? গুনীন বলল বলেই গুপ্তধন আছে? শাল্লা যত্ত বাতেলাবাজ। খালি চারশো বিশি। পেয়েছে একটা ভীমরতি ধরা বুড়ো আর একটা মুখ্যু মেয়েছেলেকে... ব্যাস্। দিয়েছে সুতো ছেড়ে! তোমরা গোটাতে পারলে না? শালা, ঢপের চপ খাওয়াচ্ছ? অ্যাঁ? সাত ঘড়া মোহর? তাকে পাহাড়া দিচ্ছে সাপ? হাঃ হাঃ, কোন হিন্দি বই-ফই থেকে ঝেড়ে দিয়েছে।’
সেই দেবু শেষ পর্যন্ত রাজী হয়েছে। সত্যি হয়েছে তো? যমুনা ভাবে। বাপের মতনই তো জেদ ছেলের। যা বলবে সেটাই করবে। যদি না তো না। হ্যাঁ তো হ্যাঁ। কিন্তু মনে মনে যমুনা কেমন অদ্ভুত নিশ্চিন্ত হয়। আজ দেবু আসবে। আসবেই।
হঠাৎ ফটক খোলার শব্দ হয়। যমুনা উঠে দাঁড়ায়। দেখে কে যেন আসছে। কে আসছে বুঝতে পারে না। চাঁদের আলো কখন যেন মেঘে ঢাকা পড়েছে। অন্ধকার একটা মূর্তি খানিক দূরে এসে দাঁড়ায়। তার চোখের দিকে চোখ পড়তেই চমকে ওঠে যমুনা। একজ়োড়া ক্রুর দৃষ্টি ঝলসে ওঠে যেন। সারা গায়ে কাঁটা দেয় যমুনার। হঠাৎ জ্যোৎস্নায় ভরে ওঠে চারপাশ। মূর্তিটা তবু অন্ধকার। কেবল চোখদুটো জ্বলছে। যেমন কুকুর বেড়ালের জ্বলে। যেমন কল্পনায় মোহরের ঘড়া ঘিরে রাখা সাপটার জ্বলে। যমুনা চেঁচাতে চায়। পারে না। তার মুখ দিয়ে কথা সরছে না। অন্ধকার গাছ থেকে পাখির ডাক ভেসে আসে। যমুনা দেখে চারপাশের ঝোপঝাড় থেকে সরসর করে বেড়িয়ে আসছে অসংখ্য সাপ। চাঁদের আলোয় তাদের নকশা কাটা শরীর ঝিকিয়ে ওঠে...
বোবায় ধরা শরীরটা কোনওমতে ঘুমের কবল থেকে ছিনিয়ে এনে জেগে ওঠে যমুনা। ধীরে ধীরে উঠে বসে বিছানায়। বিছানা বালিশ ভিজে একসা। হাতের পিঠ দিয়ে মুখ মুছে বিছানা থেকে নামে। আর ঘুম আসবে না। ঘরের কোণে রাখা কুঁজো থেকে জল গড়িয়ে খায়। গামছা দিয়ে ঘাড়-গলা-মুখ মোছে। তারপর বেড়িয়ে আসে বারান্দায়। এক চিলতে বারান্দা। সেটাই রান্নাঘর। পাশাপাশি দু’টো ঘর। অন্যটা শেফালী আর পল্টুর।
শেফালীর ঘরের পর্দা তুলে উঁকি মারে যমুনা। পল্টু ঘুমিয়ে কাদা। শেফালী ঘুম জড়ানো গলায় বলে, ‘কী হল? কিছু বলবেন?’ যমুনা ঘাড় নাড়ে। তারপর পর্দা ফেলে নিজের ঘরে ফিরে আসে। ততক্ষণে সে যা বোঝার বুঝে নিয়েছে। ঘরময় বিড়ির গন্ধ। যেদিনই মাঝরাতে ঘুম থেকে ওঠে যমুনা সেদিনই সে এরকম কিছু টের পায়। লোকটা কে তাও জানে। সনৎ। দেবুর একসময়ের পিরিতের বন্ধু। ঘেন্নায় গা গুলিয়ে ওঠে যমুনার। নিজের ন’বছরের ছেলেকে ঘুম পাড়িয়ে সেই বিছানাতেই পরপুরুষের সঙ্গে...! এ নিয়ে চেঁচামেচি করে লাভ নেই। জানে যমুনা। আশেপাশে জানাজানি হয়ে যাবে। অবশ্য জানাজানি হতে কি আর বাকি আছে? এসব খবর আগুনের বেগে ছড়ায়। তার চেয়েও বড় কথা বেশী কিছু বললে ও মাগী হয়ত ছেলে কোলে সনতের সঙ্গেই...
ভাবতেই গা শিউরে ওঠে যমুনার। পল্টু ছাড়া একদিনও কি বাঁচবে সে?
পাশের ঘরে শেফালীর খাটের তলায় লুকিয়ে থাকা সনৎ সাবধানে বেড়িয়ে এল। ফিসফিস করে বলল, ‘গেটটা খোলো।’ বালিশের তলা থেকে বিড়ির প্যাকেট বের করে পকেটে ঢুকিয়ে নিয়ে চুলে আঙুল চালিয়ে এলোমেলো হয়ে যাওয়া চুল সোজা করে দিল। শেফালী অভিমান জড়ানো গলায় বলল, ‘থাকো না বাবা। বুড়ি এখন আর উঠবে না। তবে আমার কী মনে হয় জানো? উনি সবই বোঝেন। কিন্তু জানে তো ছেলের যা টাকাপয়সা সব আমার নামে... সেই ভয়ে চুপ মেরে থাকেন।’
-কেন ওনার আবার কিসের চিন্তা? কী সব গুপ্তধনের নাকি সন্ধান জানেন... কোথায় যেন? রানাঘাটে, না?
মৃদু হাসির গুঞ্জন ওঠে। হাসি থামিয়ে শেফালী বলে, ‘হ্যাঁ। দত্ত বাড়ি গো। ঐ যে যেটা ভেঙে নার্সিংহোম হয়েছে। আজকের ঘটনা নাকি? দশ বছর হয়ে গেল। তখন সবে আমার বিয়ে হয়েছে। তখন তো উনি ঐ বাড়িতে রান্না করতেন। রীতিমত শক্ত সামর্থ। আহা গো, ছেলেকে কত করে বলেছিলেন...’ ব্যাঙ্গের হাসি হাসে শেফালী, ‘ছেলে তো হেসেই পাগল। বুড়ি এখনও সে শোক ভুলতে পারেনি। অথচ ভাবো গুপ্তধন সত্যিই থাকলে বাড়ি ভাঙার পর কেউ পেত না? আমার কি মনে হয় জানো, এই যে লোকে বলে ছেলে মরে যাওয়াতে বুড়ি পাগলাটে হয়ে গেছে... ভুল কথা। পাগলামী ওনার মধ্যে আগে থেকেই ছিল। নইলে কেউ মোহর মোহর করে খ্যাপে?’
-আচ্ছা, তোমার দেবুকে মনে পড়ে?
আচমকা এই কথায় শেফালী গম্ভীর হয়ে যায়। বলে, ‘তোমার কি আর কোনও কথা নেই? খালি এই কথা বল কেন বল তো?’ তারপর সনতের খুব ঘনিষ্ঠ হয়ে ফিসফিস করে বলে, ‘এ বাড়িতে থাকলে মনে তো পড়বেই। কিন্তু তুমি তো তোমার বন্ধুকে জানতে। ঐ লোকটাকে কি ভালবাসা যায়? কিন্তু... ভাল না বাসলেও মনে তো পড়বেই... চার বছর... থেকেছি তো একসঙ্গে...’
দু’জনে চুপ করে যায়। সনতের মনে পড়ে যায় এই বিছানাতেই তার বন্ধু দেবু... মুখ দিয়ে ভলকে ভলকে রক্ত উঠছে... সনৎ চোখ বুজে ফেলে। ফিসফিস করে বলে, ‘এবার থেকে তুমি ডিউটি থেকে ফেরার পথে কোথাও একটা... আমার অনেক চেনা জায়গা আছে... বলে যাবে ওভার টাইম...এইভাবে এই ঘরে... দেবুর কোনও চিহ্নই তো এ ঘরে নেই, কোনও ছবিও না... তবু মনে হয় শালা... মনে হয়...’
‘নাহ্।’ হিসহিসিয়ে ওঠে শেফালী, ‘আমাকে কি বাজারের মেয়েমানুষ পেয়েছ? নিয়ে যেতে হয় তোমার বাড়িতে নিয়ে চল। আমি তো কবে থেকে বলছি।’
সনৎ চুপ করে দীর্ঘশ্বাস ফেলল, ‘নাও গেটটা খোলো। এবার কাটব।’
যমুনা টের পায় গেট খোলার মৃদু শব্দ। তার আগে জানলা দিয়ে দেখে নিয়েছে শেফালী। যমুনা চোখ বুজে আছে বলে ভেবেছে ঘুমোচ্ছে। যমুনা টের পেল তার চোখ ভিজে যাচ্ছে জলে। কী যে হয়েছে আজকাল। যতদিন যাচ্ছে খালি খালি কান্না পায়। চোখ মোছে যমুনা। আবার চোখ ভিজে যায়। হঠাৎ বিনোদবাবু এসে বসেন খাটের পাশে রাখা ভাঙা চেয়ারটায়। বলেন, ‘সন্তু আজ এসে কি বলে গেল জানিস? বলব বলব না করেও ওকে বলে ফেলেছিলাম গুপ্তধনের কথাটা। সেই শুনে ও বলে মোহর যদি সত্যিই থাকে, সে নাকি সরকারের সম্পত্তি। সরকার জানতে পারলেই বাজেয়াপ্ত করে নেবে।’ তারপর কিছুক্ষণ চুপ। তারপর একটা লম্বা দীর্ঘশ্বাস, ‘তবে থাকুক মাটির তলার জিনিস মাটিরই তলায়। ভেবে দেখলাম... কীই বা করতাম ওসব নিয়ে? আজ আছি কাল নেই... শুধু শুধু ঝামেলা...।’ তারপর ক্ষমাপ্রার্থী দৃষ্টিতে যমুনার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘খুব অন্যায় হয়ে যেত রে। নিজের লোভের জন্যে তোকে সাপের মুখে ঠেলে দিচ্ছিলাম। আসলে কী জানিস, জীবনে কখনও তো কিছু পাইনি, হঠাৎ করে তাই গুপ্তধনের কথাটা শুনে... কিন্তু ওসব দিয়ে কি আর... কী বলিস? তার চেয়ে থাক...’
যমুনার মনে পড়ে এই কথাগুলো বলার দু’দিন বাদেই মারা যান বিনোদবাবু। আর তারপর থেকেই যমুনা কতবার যে দেখেছে এই স্বপ্ন! যেন বিনোদবাবুর ঘাড় থেকে নেমে এসে স্বপ্নটা ভর করল যমুনার ঘাড়ে। ঘড়া ভর্তি মোহর। মোহরে আলো পড়ে ঠিকরাচ্ছে। কিন্তু এগোতে যেতেই... সাপটা। কালো। মসৃন। সারা গায়ে নকশা কাটা।
বিড়বিড় করতে থাকে যমুনা, ‘খুব সুখ পেয়েছিস, না বউ? খুব সুখ অ্যাঁ...? ও সুখ জলের মতন। বয়ে যায়। থাকে না মোটে। তবে তুই যদি ও ছোঁড়ার সাথে চলে যাবি তো যা। আমি আটকাব না। শুধু আমার নাতিকে কোথাও নিতে পারবি না এই বলে রাখলাম। ও গেলে আমার মোহর এনে দেবে কে? ঘড়া ভর্তি মোহর... বুকের মাঝে সুখের ঘড়া... সেই কবে শম্ভু গুনীন বলেছিল... জীবনে পেলাম? যতবার ভেবেছি... ততবার ঐ সাপ... গায়ে নকশা কাটা... তেড়ে আসে। ও ঠাকুর, আর কত ডাকব তোমায়... বলি সারাজীবনে তো হল না...পল্টুরে... বাবা... তুই শেষ আশা বাবা... আমার বুকের মাটি খুঁড়ে ক’খানা মোহর... পারবি না বাবা... এনে দে বাবা... বুকের মাঝে সুখের ঘড়া... বুকের মাঝে...’
জিভের সাথে কথা জড়িয়ে ঘুম নামে যমুনার চোখে। তার ঘুমের ভেতর জেগে থাকে মোহর ভর্তি ঘড়া আর একটা কালো অন্ধকার সাপ।
লেখক পরিচিতি
বিশ্বদীপ দে
পেশা সাংবাদিকতা। নিয়মিত সাহিত্যচর্চা করেন। আকাশবাণী কলকাতার আমন্ত্রিত গল্পকার। প্রথম সারির বহু পত্রপত্রিকায় ছোটগল্প ও প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে।
জ্যোৎস্নায় চারপাশ ভেসে যাচ্ছে। যমুনা ধীর পায়ে এগিয়ে এল। খুব সন্তর্পনে চারপাশে চোখ তুলে তাকাল। কোথাও কেউ নেই। তবু তার মনে হল একজোড়া চোখ তাকে দেখছে। বিনোদবাবুর চোখ। বিনোদ দত্ত। কানে ভেসে আসে বিনোদবাবুর কন্ঠস্বর, ‘সব পায়রা উড়ে গেছে রে যমুনা। সব। শুধু এই বুড়ো পায়রাটা এখনও এই দেড়শো বছরের পুরোনো বাড়ির রোয়াকে বসে ঝিমোচ্ছে। যেদিন চলে যাব এ বাড়ি প্রেতপুরী হয়ে যাবে রে। প্রেতপুরী!’ কথা শেষে হেসে ওঠেন বিনোদবাবু। হাসি না কান্না বোঝা ভার! হাসির সঙ্গে সঙ্গে পঁচাত্তর বছরের পৃথুল শরীরটা কাঁপতে থাকে।
লোকটা যে দু’হপ্তার বেশী হয়ে গেল নেই, এ কথাটা এখনও বিশ্বাস হতে চায় না যমুনার। মনে হয় এখুনি বুঝি দেখতে পাবে রোয়াক জুড়ে পায়চারি করছেন। পেছনে হাত। মাথা নীচু। মাথাভর্তি চুল। গা ভর্তি লোম। সব সাদা। হঠাৎ মুখ তুলে বলে উঠবেন, ‘ছিঃ। যমুনা! তোকে আমি বিশ্বাস করেছিলাম।’
গা শিউরে ওঠে যমুনার। দেবু কখন আসবে বোঝা মুশকিল। পইপই করে বলে দিয়েছে দেরী না করতে। কতটা খুঁড়তে হবে কে জানে!
পায়ে পায়ে যমুনা জায়গাটার খুব কাছে চলে এসেছে। একটা বাঁশের কঞ্চি পুঁতে চিহ্ন করে রাখা ছিল। এই তো! উবু হয়ে বসে কঞ্চিটায় হাত দিল যমুনা। সারা গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল। একটু দূরে ঐ সজনে গাছটার কাছেই দাঁড়িয়েছিলেন বিনোদবাবু আর তাঁর গুরু শম্ভু গুণীন। শম্ভু গুণীনের কন্ঠস্বর স্পষ্ট শুনতে পেল যমুনা, ‘বুঝলে ভায়া, ঐখানেই মাটির তলায় পোঁতা আছে তোমার বংশের সম্পদ। সাত ঘড়া মোহর। তবে সাবধানে! অসতর্ক হলেই মৃত্যু অবধারিত। তোমাদের ভিটের বাস্তুসাপ কিন্তু ঐ ঘড়া পাহারা দিচ্ছে। তাকে মারতে যেও না যেন। কেবল বোকা বানিয়ে তুলে আনতে হবে ঘড়াগুলো।’ বিনোদবাবুর চোখদুটো পড়ন্ত বিকেলের আলোয় ঝিকমিক করে ওঠে। ঘোর লাগা গলায় বিনোদবাবু বলে ওঠেন, ‘পারবি না যমুনা?’
বিনোদবাবু নেই। কিনু গুপ্তধন আছে। যমুনার বুকের মধ্যে অপরাধবোধ টাটিয়ে ওঠে। ফোঁড়ার মতন। সে মনে মনে বলে, ‘আপনি বলেছিলেন, পাঁচ ঘড়া আপনার। দু’ঘড়া আমার। অথচ মাটি খুঁড়ে সাপের মুখ থেকে ঘড়াগুলো তুলে আনব আমি! কেন না, ও সম্পদ আপনাদের বংশের। তবুও তো রাজী ছিলাম। কিন্তু আজ যখন আপনি নেই, তখন পুরোটা যদি আমি নিই, দোষ হয়ে যাবে? বলুন, দোষ হয়ে যাবে?’
একটা পাখী ডেকে ওঠে। বোধহয় পেঁচা। যমুনা সরে আসে। আগে দেবু আসুক। তবে কাছাকাছি যাবে। বলা তো যায় না। কোথায় লুকিয়ে আছে সাপটা। এ ভিটের বাস্তুসাপ। অনেকবার দেখেছে যমুনা। শরীরময় কেমন সুন্দর নকশা কাটা। সরসর করে চলে যেত এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত। বাড়িময় তার অবাধ যাতায়াত। এ বাড়ির ঠিকে ঝি রামের মা একবার লাঠি দিয়ে মারতে গেছিল সাপটাকে। দেখতে পেয়ে ধমকে উঠেছিলেন বিনোদবাবু, ‘খবরদার। ও সাপ আমাদের বাস্তুসাপ। ভুলেও ওকে ব্যথা দিতে নেই।’ তারপর গলার স্বর নীচে নামিয়ে বিড়বিড় করেছিলেন, ‘ও আর আমিই... আমরাই তো কেবল রয়ে গেছি। আর সব শালা তো ভাগলবা।’ বলেই আবার হেসে উঠেছিলেন বিনোদবাবু। তাঁর সেই শরীর কাঁপানো হাসি।
সত্যিই একসময় কত লোক ছিল এ বাড়িতে। যমুনার এখনও স্পষ্ট মনে আছে সেদিনের কথা যেদিন প্রথম সে এবাড়িতে এসেছিল। তখন যমুনার মা এ বাড়িতে রান্নার কাজ করত। সে সময় বাড়ি ভর্তি লোক। কত হইচই। সেই বাড়ি এখন সত্যিই ভূতের বাড়ি। গোয়ালঘর কবেই ভেঙে গেছে। ইঁদারার মুখ বুজে গেছে আবজর্নায়। বাড়ির চারধারে বাগান এখন মোটেও বাগান নয়। জঙ্গল। সে সবের মাঝখানে পোড়োবাড়িটা ভূতের মতন দাঁড়িয়ে। যমুনার মনে পড়ে যায় বিনোদবাবুর কথা, ‘প্রেতপুরী! প্রেতপুরী! বাড়ি তো নয় ভূতের বাসা...’ ভয় পেয়ে অধৈর্য হয়ে ওঠে যমুনা। দেবু কি আসবে না?
গাছের পাতায় হাওয়া খেলে যায়। ডালে ডালে খস্ খস্ শব্দ ওঠে। পাতার আড়ালে গোল চাঁদ গম্ভীর হয়ে তাকিয়ে থাকে। কী একটা অচেনা পাখীর ডাক শোনা যায়। যমুনা চিনতে পারে না। কেবল গা ছমছম করে ওঠে।
সেই কোন ছোটবেলায় শোনা ঠাকুমার কথাগুলো মনে পড়ে। ঠাকুমার মুখে খালি ভূতের গল্প। একানড়ের একটাই পা। গলাসি ভূত কেবল গলায় দড়ি দিতে বলে। গভীর নলবনের ভূত নাড়াবুনে। কানাওয়ালা ভূত বা ভুলো আবার মানুষের দিক ভুলিয়ে দেয়। সে সব শুনতে শুনতে চোখের ওপর ভৌতিক কালো ছায়া দুলে দুলে যেত। ভয়ে কাঁটা হয়ে যেত যমুনা ও তার ভাই-বোনেরা। ঠাকুমা মজা পেত। তাদের ভয় দেখিয়েই যেন বুড়ির আনন্দ। এভাবেই একদিন, ঠাকুমা শুনিয়েছিলেন যকের ধনের কথা। ‘কিপ্টে লোকেরা বামুনের ছেলেকে ডেকে যক্ করত জানিস তো? আমার বড়পিসি দেখেছিল জানিস, যককে? নদীর জলে ভেসে যাচ্চে পুন্নিমা রাতে। বুঝলি তো, পাঁচটা তামার ঘড়ার ওপর জোড়াসনে বসে, সারা গায়ে সোনার সাপ আর কোলে একখানা ছোট ছেলের কঙ্কাল...’
‘ছোট ছেলে কেন?’ বালিকা যমুনার প্রশ্নে হেসে উঠত ঠাকুমা, ‘ছোট ছেলেকে ঘরে বন্ধ করে রাখত তো। তারা না খেতে পেয়ে মরে গিয়ে যক্ হবে বলে। পাহারা দেবে। ঘড়া ঘড়া মোহর। মোহর তো নয় সুক্। অত মোহর পেলে কোন সুক্টা তোর না পাওয়া থাকবে বল তো। তখন তুই যা চাইবি তাই-ই পাবি।’
যমুনা কখনও ভাবেনি সেই ছোটবেলায় শোনা গল্প বড়বেলায় এভাবে জেগে উঠবে চোখের সামনে। ঘড়া ঘড়া মোহর। আর তাকে ঘিরে থাকা... না, যক নয়... এক বিরাট কালো সাপ। কল্পনায় সাপটার জ্বলজ্বলে চোখ দেখতে পায় যমুনা। কিন্তু সাপের চোখ কি অত জ্বলজ্বলে হয়! সাপটাকে তাড়াতে পারে না যমুনা। তার মনের ভেতর সাপটার জ্বলন্ত, ক্রুর চোখটা জেগে থাকে।
একে নির্জন, তার ওপর এত চুপচাপ চারিদিক, তাই হয়ত এত ভয়ের কথা মাথায় আসছে। যমুনা মশা মারতে মারতে ভাবে। তার এখন মনে হচ্ছে দেবু বোধহয় আসবেই না। কোন ধান্দায় আটকে পড়েছে কে জানে। বাপেরও ওপর দিয়ে যায় ছেলে। ওর বাপের তো ছোটখাটো হাতটান ছিল। তাও যখন নেশায় টান পড়ত তখন। ছেলে তো একেবারে জাতচোর। আজকাল আরও বড় ধান্দায় মেতেছে। বর্ডারে কী সব মাল পাচার করে। বাড়িতে ফেরেই না বেশীরভাগ রাতে। ঘরে নতুন বউ, তাও টান নেই ছেলের! ছেলেকে বাঁধতেই ঘরে বউমা আনল যমুনা। কিন্তু কোথায় কী? নিজে মা হয়েও বুঝতে পারে যমুনা, মেয়েছেলে দেবুর কাছে নতুন কিছু নয়।
এত রাতে গাঙনাপুর থেকে রানাঘাটে এসেছে যমুনা। ট্রেন রাতের মতন বন্ধ। দেবু গাড়ী আনবে। গাড়ীতে করে ঘড়াগুলো নিয়ে... দেবু না এলে সারারাত এখানেই কাটাতে হবে যমুনাকে। তারপর ভোরবেলা প্রথম ট্রেনে... বিরক্তিতে মশা মারতে থাকে যমুনা। আর কি আসা হবে? বারবার আসা যাবে নাকি? কে কোথায় দেখে ফেলবে তাকে! অবশ্য দেখে ফেললেই বা। এ বাড়িতে আর কিচ্ছু নেই, খবর পেয়েছে যমুনা। খাট, আলমারি – যা কিছু ছিল সব বেচে দিয়েছে বিনোদবাবুর ভাইপোরা। শিগগিরই ভাঙা শুরু হবে বাড়িটা। কি নাকি হাসপাতাল হবে। সব ঘর বিলকুল ফাঁকা। তাই তো সদর ফটকে কোনও তালা মারা নেই। না হলে তো যমুনা ঢুকতেই পারত না। সুতরাং কেউ দেখে ফেললে চোর বলে মারতে আসবে না ঠিকই। কিন্তু যমুনা কী উত্তর দেবে? এ বাড়ির পুরোনো রান্নার লোক বলে এত রাতে মায়ায় পড়ে ঘুরতে এসেছে! কেউ বিশ্বাস করবে?
বড্ড মশা। যমুনা পা নাড়া দেয়। মনে হয় এর চেয়ে সেদিন বিনোদবাবুর কথায় রাজী হলেই ভাল হত হয়ত। কী এক ভয়ে সে রাজী হয়নি। বিনোদবাবু অনেক চেষ্টা করেছিলেন, ‘ওসব যক্-টক্ এ বাড়িতে নেই। তুই নিশ্চিন্ত থাক। আমার পূর্বপুরুষরা সব গান বাজনার লোক ছিলেন। ছোট ছেলেকে মাটির নীচে আটকে রেখে দেবে এমন লোক তারা নন। শুধু তো একটা বুড়ো সাপ। পারবি না?’ তারপর যমুনার নিরুৎসাহী মুখ দেখে হতাশ হয়ে বলেছিলেন, ‘যদি জোয়ান থাকতাম এখনও, তবে কি একটা মেয়েছেলের ওপর নির্ভর করতাম, ভাবছিস? এ পাড়ার কাউকে কাউকে হয়তো বলা যেত, কিন্তু কাউকেই বিশ্বাস হয় না আমার... শেষকালে হয়তো পুরোটা পাওয়ার লোভে আমাকেই...’
সেদিন বাড়ি ফেরার পথে ট্রেনে যেতে যেতে যমুনা বারবার ভাবছিল লোকটার এই বয়সেও এত লোভ কেন? প্রথমটায় ওর লোভে চকচকে চোখমুখ দেখে রাগই হচ্ছিল যমুনার। পরে বুঝেছিল ব্যাপারটা। বিনোদবাবুই বুঝিয়ে বলেছিলেন, ‘তুই ভাবছিস বুড়ো হয়ে মরতে চলল, তবু ব্যাটাচ্ছেলের লোভ কত! আসলে কী জানিস, আমার ব্যাঙ্কে যা জমানো ছিল সব ফুরিয়ে এসেছে। একটাই ভাইপো, মাঝে মাঝে টাকা পাঠায় কিছু... এভাবে চলে? পোষ্টাপিসের টাকায় ডালভাতটা জুটে যাচ্ছে, কিন্তু বড় একটা রোগ হলে কী হবে বল তো? তারপর খুব ঠান্ডা স্বরে বলেছিল, ‘আমার যে ভাইপোটা টাকা পাঠায়, সন্তু, ওকে বলতে পারতাম... ও হেসেই উড়িয়ে দেবে... ওরা আজকালকার ছেলে এসব গুপ্তধন-টনে বিশ্বাস করে না। কিন্তু আমি জানি শম্ভু গুনীনের কথা মিথ্যে হতে পারে না।’
শম্ভু গুনীন বিনোদবাবুর গুরু। লোকটার কথা বেদবাক্য মানেন বিনোদবাবু। মাঝে মাঝে লোকটা এ বাড়িতে আসে। তখন তাকে ভালো মন্দ রেঁধে খাওয়াতে হয়। ভাবতে ভাবতে শম্ভু গুনীনের মুখটা ভেসে ওঠে যমুনার চোখের সামনে। অদ্ভুত চেহারা লোকটার। লম্বা একহারা চেহারা। চোখদুটো কোটরে ঢোকা। মাথায় লাল তিলক। বাঁশীর মত নাক। বয়সের থলকুল নেই। যমুনার সঙ্গে কোনওদিনই খুব একটা কথা বলত না। কেবল বিনোদবাবুর সঙ্গেই ঘরে ঢুকে কীসব কথা বলত। কিন্তু ঐ গুপ্তধনের কথাটা যেদিন বলেছিল, সেদিন ঐ সজনে গাছের তলায় দাঁড়িয়ে যমুনার চোখের দিকে তাকিয়ে কিছু কথা বলেছিল লোকটা, ‘তুই খুব কষ্ট পেয়েছিস সারাজীবন। কীরে ঠিক বলছি তো? খালি ভেবেছিস সুখ কই? সুখ? তোর বাবা দিতে পারেনি। সোয়ামি দিতে পারেনি। এখন ছেলে। সেও কি পারবে? হাঃ হাঃ।’ হেসে উঠেছিল শম্ভু গুনীন। তারপর বলেছিল, ‘ঠাকুরকে ডাক। ঠাকুরকে বল। বুকের মাঝে সুখের ঘড়া। কত কাছে। তবু কত দূরে। একটু পাইয়ে দাও। হাঃ হাঃ।’
হাসতে হাসতে যমুনার চোখের থেকে চোখ সরিয়ে নিয়েছিল শম্ভু গুনীন। যমুনা হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছিল। মনে হচ্ছিল কেবল তার দিকে তাকিয়ে থেকেই তার সব মনের কথা কীভাবে যেন জেনে যাচ্ছে লোকটা। সে বুঝতে পারছিল এমন লোকের কথা কখনও মিথ্যে হতে পারে না। গুপ্তধন আছে। আছেই।
অথচ কথাটা শুনে দেবুর কী হাসি! বলে, ‘গুনীন বলল? গুনীন বলল বলেই গুপ্তধন আছে? শাল্লা যত্ত বাতেলাবাজ। খালি চারশো বিশি। পেয়েছে একটা ভীমরতি ধরা বুড়ো আর একটা মুখ্যু মেয়েছেলেকে... ব্যাস্। দিয়েছে সুতো ছেড়ে! তোমরা গোটাতে পারলে না? শালা, ঢপের চপ খাওয়াচ্ছ? অ্যাঁ? সাত ঘড়া মোহর? তাকে পাহাড়া দিচ্ছে সাপ? হাঃ হাঃ, কোন হিন্দি বই-ফই থেকে ঝেড়ে দিয়েছে।’
সেই দেবু শেষ পর্যন্ত রাজী হয়েছে। সত্যি হয়েছে তো? যমুনা ভাবে। বাপের মতনই তো জেদ ছেলের। যা বলবে সেটাই করবে। যদি না তো না। হ্যাঁ তো হ্যাঁ। কিন্তু মনে মনে যমুনা কেমন অদ্ভুত নিশ্চিন্ত হয়। আজ দেবু আসবে। আসবেই।
হঠাৎ ফটক খোলার শব্দ হয়। যমুনা উঠে দাঁড়ায়। দেখে কে যেন আসছে। কে আসছে বুঝতে পারে না। চাঁদের আলো কখন যেন মেঘে ঢাকা পড়েছে। অন্ধকার একটা মূর্তি খানিক দূরে এসে দাঁড়ায়। তার চোখের দিকে চোখ পড়তেই চমকে ওঠে যমুনা। একজ়োড়া ক্রুর দৃষ্টি ঝলসে ওঠে যেন। সারা গায়ে কাঁটা দেয় যমুনার। হঠাৎ জ্যোৎস্নায় ভরে ওঠে চারপাশ। মূর্তিটা তবু অন্ধকার। কেবল চোখদুটো জ্বলছে। যেমন কুকুর বেড়ালের জ্বলে। যেমন কল্পনায় মোহরের ঘড়া ঘিরে রাখা সাপটার জ্বলে। যমুনা চেঁচাতে চায়। পারে না। তার মুখ দিয়ে কথা সরছে না। অন্ধকার গাছ থেকে পাখির ডাক ভেসে আসে। যমুনা দেখে চারপাশের ঝোপঝাড় থেকে সরসর করে বেড়িয়ে আসছে অসংখ্য সাপ। চাঁদের আলোয় তাদের নকশা কাটা শরীর ঝিকিয়ে ওঠে...
বোবায় ধরা শরীরটা কোনওমতে ঘুমের কবল থেকে ছিনিয়ে এনে জেগে ওঠে যমুনা। ধীরে ধীরে উঠে বসে বিছানায়। বিছানা বালিশ ভিজে একসা। হাতের পিঠ দিয়ে মুখ মুছে বিছানা থেকে নামে। আর ঘুম আসবে না। ঘরের কোণে রাখা কুঁজো থেকে জল গড়িয়ে খায়। গামছা দিয়ে ঘাড়-গলা-মুখ মোছে। তারপর বেড়িয়ে আসে বারান্দায়। এক চিলতে বারান্দা। সেটাই রান্নাঘর। পাশাপাশি দু’টো ঘর। অন্যটা শেফালী আর পল্টুর।
শেফালীর ঘরের পর্দা তুলে উঁকি মারে যমুনা। পল্টু ঘুমিয়ে কাদা। শেফালী ঘুম জড়ানো গলায় বলে, ‘কী হল? কিছু বলবেন?’ যমুনা ঘাড় নাড়ে। তারপর পর্দা ফেলে নিজের ঘরে ফিরে আসে। ততক্ষণে সে যা বোঝার বুঝে নিয়েছে। ঘরময় বিড়ির গন্ধ। যেদিনই মাঝরাতে ঘুম থেকে ওঠে যমুনা সেদিনই সে এরকম কিছু টের পায়। লোকটা কে তাও জানে। সনৎ। দেবুর একসময়ের পিরিতের বন্ধু। ঘেন্নায় গা গুলিয়ে ওঠে যমুনার। নিজের ন’বছরের ছেলেকে ঘুম পাড়িয়ে সেই বিছানাতেই পরপুরুষের সঙ্গে...! এ নিয়ে চেঁচামেচি করে লাভ নেই। জানে যমুনা। আশেপাশে জানাজানি হয়ে যাবে। অবশ্য জানাজানি হতে কি আর বাকি আছে? এসব খবর আগুনের বেগে ছড়ায়। তার চেয়েও বড় কথা বেশী কিছু বললে ও মাগী হয়ত ছেলে কোলে সনতের সঙ্গেই...
ভাবতেই গা শিউরে ওঠে যমুনার। পল্টু ছাড়া একদিনও কি বাঁচবে সে?
পাশের ঘরে শেফালীর খাটের তলায় লুকিয়ে থাকা সনৎ সাবধানে বেড়িয়ে এল। ফিসফিস করে বলল, ‘গেটটা খোলো।’ বালিশের তলা থেকে বিড়ির প্যাকেট বের করে পকেটে ঢুকিয়ে নিয়ে চুলে আঙুল চালিয়ে এলোমেলো হয়ে যাওয়া চুল সোজা করে দিল। শেফালী অভিমান জড়ানো গলায় বলল, ‘থাকো না বাবা। বুড়ি এখন আর উঠবে না। তবে আমার কী মনে হয় জানো? উনি সবই বোঝেন। কিন্তু জানে তো ছেলের যা টাকাপয়সা সব আমার নামে... সেই ভয়ে চুপ মেরে থাকেন।’
-কেন ওনার আবার কিসের চিন্তা? কী সব গুপ্তধনের নাকি সন্ধান জানেন... কোথায় যেন? রানাঘাটে, না?
মৃদু হাসির গুঞ্জন ওঠে। হাসি থামিয়ে শেফালী বলে, ‘হ্যাঁ। দত্ত বাড়ি গো। ঐ যে যেটা ভেঙে নার্সিংহোম হয়েছে। আজকের ঘটনা নাকি? দশ বছর হয়ে গেল। তখন সবে আমার বিয়ে হয়েছে। তখন তো উনি ঐ বাড়িতে রান্না করতেন। রীতিমত শক্ত সামর্থ। আহা গো, ছেলেকে কত করে বলেছিলেন...’ ব্যাঙ্গের হাসি হাসে শেফালী, ‘ছেলে তো হেসেই পাগল। বুড়ি এখনও সে শোক ভুলতে পারেনি। অথচ ভাবো গুপ্তধন সত্যিই থাকলে বাড়ি ভাঙার পর কেউ পেত না? আমার কি মনে হয় জানো, এই যে লোকে বলে ছেলে মরে যাওয়াতে বুড়ি পাগলাটে হয়ে গেছে... ভুল কথা। পাগলামী ওনার মধ্যে আগে থেকেই ছিল। নইলে কেউ মোহর মোহর করে খ্যাপে?’
-আচ্ছা, তোমার দেবুকে মনে পড়ে?
আচমকা এই কথায় শেফালী গম্ভীর হয়ে যায়। বলে, ‘তোমার কি আর কোনও কথা নেই? খালি এই কথা বল কেন বল তো?’ তারপর সনতের খুব ঘনিষ্ঠ হয়ে ফিসফিস করে বলে, ‘এ বাড়িতে থাকলে মনে তো পড়বেই। কিন্তু তুমি তো তোমার বন্ধুকে জানতে। ঐ লোকটাকে কি ভালবাসা যায়? কিন্তু... ভাল না বাসলেও মনে তো পড়বেই... চার বছর... থেকেছি তো একসঙ্গে...’
দু’জনে চুপ করে যায়। সনতের মনে পড়ে যায় এই বিছানাতেই তার বন্ধু দেবু... মুখ দিয়ে ভলকে ভলকে রক্ত উঠছে... সনৎ চোখ বুজে ফেলে। ফিসফিস করে বলে, ‘এবার থেকে তুমি ডিউটি থেকে ফেরার পথে কোথাও একটা... আমার অনেক চেনা জায়গা আছে... বলে যাবে ওভার টাইম...এইভাবে এই ঘরে... দেবুর কোনও চিহ্নই তো এ ঘরে নেই, কোনও ছবিও না... তবু মনে হয় শালা... মনে হয়...’
‘নাহ্।’ হিসহিসিয়ে ওঠে শেফালী, ‘আমাকে কি বাজারের মেয়েমানুষ পেয়েছ? নিয়ে যেতে হয় তোমার বাড়িতে নিয়ে চল। আমি তো কবে থেকে বলছি।’
সনৎ চুপ করে দীর্ঘশ্বাস ফেলল, ‘নাও গেটটা খোলো। এবার কাটব।’
যমুনা টের পায় গেট খোলার মৃদু শব্দ। তার আগে জানলা দিয়ে দেখে নিয়েছে শেফালী। যমুনা চোখ বুজে আছে বলে ভেবেছে ঘুমোচ্ছে। যমুনা টের পেল তার চোখ ভিজে যাচ্ছে জলে। কী যে হয়েছে আজকাল। যতদিন যাচ্ছে খালি খালি কান্না পায়। চোখ মোছে যমুনা। আবার চোখ ভিজে যায়। হঠাৎ বিনোদবাবু এসে বসেন খাটের পাশে রাখা ভাঙা চেয়ারটায়। বলেন, ‘সন্তু আজ এসে কি বলে গেল জানিস? বলব বলব না করেও ওকে বলে ফেলেছিলাম গুপ্তধনের কথাটা। সেই শুনে ও বলে মোহর যদি সত্যিই থাকে, সে নাকি সরকারের সম্পত্তি। সরকার জানতে পারলেই বাজেয়াপ্ত করে নেবে।’ তারপর কিছুক্ষণ চুপ। তারপর একটা লম্বা দীর্ঘশ্বাস, ‘তবে থাকুক মাটির তলার জিনিস মাটিরই তলায়। ভেবে দেখলাম... কীই বা করতাম ওসব নিয়ে? আজ আছি কাল নেই... শুধু শুধু ঝামেলা...।’ তারপর ক্ষমাপ্রার্থী দৃষ্টিতে যমুনার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘খুব অন্যায় হয়ে যেত রে। নিজের লোভের জন্যে তোকে সাপের মুখে ঠেলে দিচ্ছিলাম। আসলে কী জানিস, জীবনে কখনও তো কিছু পাইনি, হঠাৎ করে তাই গুপ্তধনের কথাটা শুনে... কিন্তু ওসব দিয়ে কি আর... কী বলিস? তার চেয়ে থাক...’
যমুনার মনে পড়ে এই কথাগুলো বলার দু’দিন বাদেই মারা যান বিনোদবাবু। আর তারপর থেকেই যমুনা কতবার যে দেখেছে এই স্বপ্ন! যেন বিনোদবাবুর ঘাড় থেকে নেমে এসে স্বপ্নটা ভর করল যমুনার ঘাড়ে। ঘড়া ভর্তি মোহর। মোহরে আলো পড়ে ঠিকরাচ্ছে। কিন্তু এগোতে যেতেই... সাপটা। কালো। মসৃন। সারা গায়ে নকশা কাটা।
বিড়বিড় করতে থাকে যমুনা, ‘খুব সুখ পেয়েছিস, না বউ? খুব সুখ অ্যাঁ...? ও সুখ জলের মতন। বয়ে যায়। থাকে না মোটে। তবে তুই যদি ও ছোঁড়ার সাথে চলে যাবি তো যা। আমি আটকাব না। শুধু আমার নাতিকে কোথাও নিতে পারবি না এই বলে রাখলাম। ও গেলে আমার মোহর এনে দেবে কে? ঘড়া ভর্তি মোহর... বুকের মাঝে সুখের ঘড়া... সেই কবে শম্ভু গুনীন বলেছিল... জীবনে পেলাম? যতবার ভেবেছি... ততবার ঐ সাপ... গায়ে নকশা কাটা... তেড়ে আসে। ও ঠাকুর, আর কত ডাকব তোমায়... বলি সারাজীবনে তো হল না...পল্টুরে... বাবা... তুই শেষ আশা বাবা... আমার বুকের মাটি খুঁড়ে ক’খানা মোহর... পারবি না বাবা... এনে দে বাবা... বুকের মাঝে সুখের ঘড়া... বুকের মাঝে...’
জিভের সাথে কথা জড়িয়ে ঘুম নামে যমুনার চোখে। তার ঘুমের ভেতর জেগে থাকে মোহর ভর্তি ঘড়া আর একটা কালো অন্ধকার সাপ।
বিশ্বদীপ দে
পেশা সাংবাদিকতা। নিয়মিত সাহিত্যচর্চা করেন। আকাশবাণী কলকাতার আমন্ত্রিত গল্পকার। প্রথম সারির বহু পত্রপত্রিকায় ছোটগল্প ও প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে।
3 মন্তব্যসমূহ
Darun galpo ta. Ami or lekha ageo porechi onek potro-patrikai. Frankly speaking, I'm a big fan of him. Joto din jacche onek onek porinoto hocche or lekha. Pore monei hoina je eta kono nabin lekhoker kolom theke berieche. Amar onek onek subheccha roilo or proti abong agami dine aro onek bhalo bhalo lekha porar asa rakhlam or theke.
উত্তরমুছুনঅনেক অনেক ধন্যবাদ।
উত্তরমুছুনদারুণ
উত্তরমুছুন