আমার সোনার বাংলা

রুখসানা কাজল

দুর্যোধন দাদু যতবার আমাদের গেট খোলে ঠিক ততবার বাপিকে গালাগাল করে। বিচ্ছিরি বিচ্ছিরি শব্দের গালি। মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে দিই একটা লাগিয়ে । কিন্তু উপায় নেই। মা ত শ্বশুর এসেছে বলে প্রণাম সেরে সেই যে রান্নাঘরে ঢুকে যায় দাদুর প্রিয় খাবার বানাতে তারপর দাদুর দেখভাল আমাকেই করতে হয়। তাছাড়া এই হেটো ধুতি পরা অমার্জিত ,বুনো, জেদি, অশ্রাব্য গালাগালে ওস্তাদ দাদুকে আমিও ভালবাসি খুব।
ইজি চেয়ারে আরাম করে বসে দাদু চোখ সরু করে জানতে চায়, অংকে কত পাইছিস র‍্যা? আমাদের শান বাঁধানো উঠোনে মার্বেল খেলতে খুব অসুবিধা। তার উপর এরকম বাজে জঘন্য প্রশ্নে হাতের তাক্‌ ছুটে যায়। জানিস ই ত – বিরক্ত হয়ে জানাই। এর মধ্যে বাড়ির পেছনের ফুল বাগান থেকে দ্বিজদাস কাকু বেরিয়ে আসে। হাতে নিড়ানির কাঁচি । বাপির ফুল বাগানে কি এক আজব ফুলের গাছে লাগাতে এসেছে। অভূতপূর্ব , অপরিচিত, স্বর্গউদ্যানের এই ফুল, ইন্দ্রের খুব প্রিয়। এখনো এই শহরের কারো বাগানে নেই বলে বাগানে গেছিল। মা রান্না ঘরের জানালা থেকে মুখ বাড়িয়ে বলে, ও দ্বিজ, চা খেয়ে যাস। দ্বিজ কাকু দাদুকে দেখেছে আমি ড্যাম সিওর। কিন্তু না দেখার ভান করে চেঁচিয়ে বলে শুধু চায়ে হবে নানে বড় বৌদি । খাস্তা পরোটা বানাও।

মোরগের স্টু আর খাস্তা পরোটা দাদুর প্রিয় খাবার। পচাগলা মুখটা খোলার আগেই দাদুকে চুপ থাকতে বলি। কে শোনে কার কথা। ফুঁসতে ফুঁসতে দাদু বলে উঠে, এই শুওর চাঁড়ালটা এখানে কি করতিছে ? বারো বারো হারামজাদা। আমার বাড়ির ত্রি সীমানায় আসতি মানা করিছি না! মাগীখাকি। লম্পট । দ্বিজ কাকু হাসতে হাসতে ইঁদারার জল টেনে হাত মুখ ধুয়ে মাদুর পেতে বসে পড়ে।দুজনের সাপে নেউলে অবস্থা। মা ঘামছে রান্না ঘরে। এই রকম সংকট মুহুর্তে আমিই মার ভরসা। মার্বেলে নিরিখ করতে করতে আমি ধমকে উঠি, দাদুকে প্রণাম করো কাকু। মাদুরে বসেই লম্বা একটা হাত বাড়িয়ে দেয় কাকু। দাদু লাঠির বাড়ি মেরে খিঁচিয়ে উঠে, সর শুওর। খবর্দার ছুঁবি না আমাকে। কাকু হাসতে হাসতে ই বলে, ও কর্তা সবাই ত ওপারে নালি স্বর্গে চলি গেছে ।আর এই এখানি থাকি করবা কি । এবার বর্ডারে যাও নালি শ্মশানি শুয়ে পড় ত বাপধন । আমরা চিতা জ্বালায়ে একটু চোলাই খাই। দাদু এবার সত্যি রেগে উঠে ।আমিও। ষড়া গাছের ভুতের মত চেহারা দাদুর। জানি বাপিকে ছেড়ে কোথাও থাকতে পারে না। বড় পুজায় আমার জন্যে নিজে গিয়ে জামার কাপড় নিয়ে আসে। তাতে লাল রঙ থাকবেই । দাদু বলে লাল হচ্ছে উজ্জীবকের রঙ। মানুষকে জাগিয়ে রাখে। দাদুর ছেলেমেয়ে সবাই কলকাতার কোন মধ্যমগ্রামে থাকে। দূরের আত্বিয়দের নিয়ে কয়েক বিঘা জায়গার এক বিশাল বাড়িতে একা থাকে দাদু । আত্বিয়রা দিন গুনছে কবে মৃত্যু হয় এই অপেক্ষায় । যত্ন হয় না মোটেই । তার চে বড় কথা দাদু কারো যত্ন নেয় না। স্বঘোষিত মহারাজ। লাঠিটা এক বিরাট অস্ত্র। ঠিকমত মার পড়লে বাপির ফার্মেসিতে এসে ওষুধ খেয়ে যায় অনেকে । আমার ছোটকাকাই বেশি মার খায়। কারন কাকার বন্ধুরাই দাদুর পেছনে লাগে বেশি। দাদু ছোট বড় কাউকে দেখে না। আমাদের সামনেই যাচ্ছতাই মুখ খারাপ করে সপাং সপাং করে মেরে দেয়। আর কাকা মার খেতে খেতে ই দাদুকে জড়িয়ে ধরে। তখন খুব মজা হয়। আসলে ছোটকাকার এই জড়িয়ে ধরে আদর পাওয়ার জন্যেই দাদু কাকাকে মার দেয় আমরা বুঝতে পারি। মা ত সবাইকে বলে দিয়েছে, স্নেহ বুভুক্ষু প্রাণ মানুষটার। তোরা কিছু বলিস না রে । একমাত্র বাপি ছাড়া কারো কথা কানে তোলে না। রোজ সন্ধ্যায় আফিম খেয়ে ঝিম মেরে থাকে। কোন কোন দিন শরীর খারাপ হলে বাপির হাত জড়িয়ে কেঁদে বলে, তুই আমার মুখে আগুন দিবি কথা দে। এই রাবণের গুষ্টির কেউ যেন আমার মুখাগ্নি না করে। বাপি হাসে। কথা দেয়। তারপর ঘুমের ওষুধ দিয়ে ঘরে এসে মন খারাপ করে লিখতে বসে। কে আমি ? বাপির মাথার ভেতর ইখতিয়ারুদ্দিন মোহাম্মাদ বখতিয়ার খিলজির ঘোড়ার ছুটে আসার শব্দ ।সাথে কেবল সতের জন মুসলিম সৈন্য ছিল ? অসম্ভব।

আমাদের গেটের উপর লাল সবুজ পতাকাটা কিছুতেই ঠিক মত লাগাতে পারছি না। অনেক বড় পতাকা। টিভিতে দেখে মা বাপির কাছে অনেক বায়না করে আদায় করেছি। আমি চাইছি টিভির মধ্যে যেমন পত্‌ পত্‌ করে উড়ে সে রকম করে উড়াতে। বন্ধুরা মিলে কত যে চেস্টা করছি। কিছুতেই হচ্ছে না। পতাকা উড়িয়ে জাতীয় সংগীত আর দেশের গান গেয়ে আমরা বিজয় দিবস পালন করব। সাথে বাজবে বঙ্গবন্ধুর সাত মার্চের ভাষণ । কাজি বাড়ীর মেজ কাকু পতাকাটা ঠিক মত টানিয়ে দিয়ে আস্তে করে আমাদের বলে দিল সব কিছু কর্‌ কিন্তু বঙ্গবন্ধুর ভাষণ চালাস না । আমাদের ভেতর সব চে বড় আর মাথায় ঊচু বাদল ভাই বলে উঠল , তা কি করে হয়। এই ভাষণ ছাড়া বিজয় দিবস, স্বাধীনতা দিবস কি করে পালন করব কাকু ? রক্ত গরম চোখে তাকিয়ে বলে উঠে কাকু, বেশী বেড়ো না। বইতে কি পড়িছ ? কে দিছে স্বাধীনতার ঘোষণা ? তোমার বাপ মুজিবর? সে ত তখন স্বাধীনতার ঘোষণা না দিয়ি পাকিস্তানে বসি পরোটা গোস্ত খাতিছিল। তোমার বাপ যুদ্ধ করিছে বলে কি সব জানে? আর তুমি দামড়া হয়ি এই পোলাপানের সাথে কি কর। ঘরে ভাত নাই ,বাপ জেলে তবু তেজ ফুরায় না দেখতিছি! বাদল ভাই মুখ নীচু করে দাঁড়িয়ে থাকে। সত্যি ত বাদল ভাইয়ের বাবাকে জেলে নিয়ে গেছে পুলিশ। ইন্ডিয়ার দালাল নাকি ওর বাবা। কিন্তু আমরা জানি আসলে বঙ্গবন্ধুকে মেরে ফেলার প্রতিবাদ করেছিল বাদল ভাইয়ের বাবা। আমরা পত পত করে উড়া পতাকার নীচে বাদলভাইকে ঘিরে দাঁড়িয়ে থাকি। একটু বড় হয়েছি। বুঝতে পারি বদলে যাচ্ছে চারপাশ। আমাদের শহরে যারা নতুন এসেছে রাজনীতিতে তারা পুরানো অনেককেই পছন্দ করছে না। পুরানো যারা তারা খুব হিন্দু ঘেঁষা। তাদের অনেক কিছুতেই হিন্দুয়ানী । এই যেমন আমার বাপি। অনেকেই আমাদের সাথে জল চল বদল করে ফেলেছে। কোন এক সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী অনুষ্ঠানে দ্ব্যার্থহীন বাপি বলেছিল,ধর্ম মানুষের প্রয়োজনে মানুষের ই সৃষ্টি কতগুলি নিয়ম কানুন বই আর কিছু নয়। নতুন রাজনীতির খেলোয়াড়দের কেউ একজন বলেছিল, ও তাহলে আপনি বলছেন ইসলাম মানুষের তৈরি ধর্ম ? বাপি উত্তর করেছিল, মানুষের জন্য ত অবশ্য ই। মুহাম্মদ এনেছিলেন মানুষের কল্যাণের জন্য। “এনেছিলেন না আল্লাহ জিব্রাঈল ফেরেশতার মাধ্যমে ঐশী বানী দিয়ে পাঠিয়েছিলেন ?” বিদ্রুপ ভরে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়েছিল সেই নব্য রাজনীতিক। “জিবরাঈল তোমার অন্তরাত্বার ভাষা বলেছিল। আল্লাহ তোমার বিবেক। তুমি ই জানো ন্যায় আর অন্যায় কোনটি। ন্যায়ে থাকো ,ধর্ম তোমার সাথি হবে”

ডায়াস থেকে নেমে এসেছিল বাপি। বাপির বন্ধুরা অসহায়। মা বাপিকে নিয়ে চলে এসেছিল অনুষ্ঠান শেষ না হতেই। নির্ঘুম রাত। দুশ্চিন্তা জটিল ফুল তুলেছিল মার আঁচলে। ভোর রাতে হালকা চাদর মেলে দিতে দিতে মা একবার চকিতে ভেবে নেয় , যখন তখন বিপদ মাথায় নেওয়া এই মানুষটাকে কেন এত ভাল লাগে ? বসার ঘরের দেয়ালে বেগম রোকেয়ার পাশে সিস্টার নিবেদিতার একটি খয়েরি ছবি রয়েছে । মানুষটা বলেছিল ভালবাসায় কিছু চাইতে নেই। সত্যি কি তাই ? এত বেশি পাশাপাশি কাছে থেকে না দেহ, না মৈথুন, না সংসার না সন্তান তাই কি ভালবাসা ? কিম্বা দেহ, মৈথুন, সন্তানের বাইরেও এমন কিছু থাকে যা না পাওয়াই কি ভালবাসা ? অনেকদিন পরে সিস্টার নিবেদিতাকে দেখে মা। চোখ ভেসে উঠে জলে । এই নারী ত জানে ভালবাসার রঙ কত পোড়া পোড়া। কোন কিছু না পাওয়ার রুঢ়তা তবু ভালবাসতে রুদ্ধ করতে পারেনি এই নারীকে। যেন সব পেয়েছিল বেদনা আর যন্ত্রণায়। যেমন সব পেয়েও আমি পুড়ছি অজানা কোন না পাওয়ার বেদনায় !

নিজের বানানো মগে চা খেয়ে চলে গেল কাকু। যাওয়ার আগে এবার সত্যি সত্যি দাদুকে প্রণাম করে । দাদুও একটু নরম হয়। কি গাছ লাগালি ? দাদুর প্রশ্নের উত্তর করে কাকু, স্বর্ণ কাঞ্চন। ও আচ্ছা , তা আমার গাছের খবর কি ? দাদু পেশায় কবিরাজ। গাছ গাছড়ার প্রতি চরম মায়া আর কৌতূহল । দ্বিজকাকু মাথা চুলকে বলে , আনি দিবানি কর্তা। সহজে কি এই গাছ মেলে। কাকু চলে যেতেই চোখ সরু করে বলি , মন্মথকাকুকে তুই তাড়ালি কেন্‌ দাদু? তোকে সিদ্ধি খাওয়ালে যে তাই! বাট আই লাইক দ্যাট ডেলিসাশ চকোলেট । দাদু এক চোখ মেরে শয়তানের হাসি দিয়ে বলে, ও আচ্ছা । তা মন্মথ যদি তোর বুকে হাত দিত ? হাহাহা করে আমি মারতে যাই দাদুকে । শয়তান বুড়ো আমি ত ছোট। মন্মথ কাকু মোটেই ওরকম নয়। কি রকম ? রেগে মেগে বলি, তোর মত! অই যে তুই দিপুদির আঁচল ধরে টানছিস আর টানছিস। পান খাওয়া লাল দাঁত বের করে খুব হাসে দাদু। দাদুর দোকানে দেয়াল জুড়ে রামায়ন মহাভারতের সব চরিত্রের ছবি। ছবিগুলো এত সুন্দর আর মর্মস্পর্শি গল্প রয়েছে ছবিগুলো ঘিরে যে আমি মুগ্ধ হই বার বার। একটা ছবিতে দুর্যোধন দ্রৌপদির লজ্জাহরণ করছে শাড়ি টেনে টেনে। কিন্তু শাড়ি আর শেষ হয়না। এই গল্পটা দাদু আমাদের শুনিয়েছে। তারপর হো হো করে হেসে নিজেই বলেছে দাদুই নাকি অই দুর্যোধন। আমি ছবিটার কথা বলে দাদুকে ক্ষেপাই। মা ত একবার বলেই ফেলেছিল, কাকাবাবু আপনার এরকম নাম কে রেখেছিল? একসাথে তিনটে পান মুখে দিয়ে দাদু বলেছিল, কেন বউমা ? মা আর কিছু না বলে তড়িঘড়ি উঠে চলে গেছিল। ইজি চেয়ারে পা নাচাতে নাচাতে দাদু বলেছিল, বুঝলি আসল নায়ক হচ্ছে দুর্যোধন। অই শালা ভগবান থেকে কুচো দেবতারা আর বেবুশ্যে মা মাগী দেবীগুলো মিলে ইচ্ছা করে দুর্যোধনকে হারিয়েছে ।

আমাদের অঞ্চলে ব্রাহ্মণ খুব কম ছিল। তারপরেও যারা ছিল তারা চলে গেছে ওপারে। দাদু এই ব্রাহ্মণদের কথা উঠলেই প্রচন্ড রেগে গিয়ে গালিগালাজ শুরু করে। ওদের জাত পাতের কারণেই নাকি আজ ভারত বর্ষে এত গন্ডগোল। দাদুরা কায়স্থ। বদ্যি ঘর। আর দ্বিজ কাকু হচ্ছে কামার। দাদুর ভাষায় চাড়াল। দ্বিজকাকুর উপর রাগের আরো কারণ আছে। কাকু নিজের বাসা ছেড়ে অন্য একটা বাসায় চলে গেছে। সেখানে ধোপানী মাসির মেয়েকে বিয়ে করে ঘর করছে সুখে। সবাই বকেছে খুব। কিন্তু কোন লাভ হয়নি বকাঝকা করে। দ্বিজ কাকু খুব জেদি। মা দাদুকে বলেছিল ওদের বিয়েটা মেনে নিন না কাকাবাবু। দাদু রাজী হয়নি। বাপি মাকে আর কিছু না বলতে বলেছে। মাটি যেমন সব সহ্য করে নেয় তেমনি মানুষও সহনশীল। আস্তে ধীরে সব ঠিক হয়ে যাবে একদিন। মা আল্লাহ আল্লাহ করে সব যেন ঠিক হয়ে যায় । ধোপানী মাসিরা খুব গরীব । নদীর জল ফ্রি বলে ব্যবসাটা করে দু মুঠো খেতে পাচ্ছে। এদের মেয়েকে কিছুতেই দ্বিজ কাকুর পরিবার ঘরে তুলবে না। গেল পূজায় দ্বিজ কাকুর জ্যাঠা কলকাতা থেকে এসে কড়া নির্দেশ দিয়ে গেছে দ্বিজ কাকু যেন কখনও আর বাড়িতে ঢুকতে না পারে । যার মা মধুমতির জলে হাঁটু দেখিয়ে কাপড় কাঁচে, প্রতিটি কাপড় আছড়ে পড়ার সাথে সাথে যার দুই বুক কেঁপে উঠে আর নদী চলতি লোকেরা বিনা পয়াসায় সেই সার্কাস দেখে তার আবার জাত কি!

আজকাল দুর্যোধন দাদু বড় ক্লান্ত হয়ে গেছে মন ও শরীরে । আগের সেই তেজ নেই। কবে থেকে যে লড়াই করে যাচ্ছে এই জাত পাত ধর্মীয় গোঁড়ামির বিরুদ্ধে! বাপি ছাড়া কাউকে পাশে পাচ্ছে না ইদানিং। তরুন প্রজন্ম আসে। গলা ফাটিয়ে চীৎকার করে কিছুদিন। তারপর সুড় সুড় করে যেই লাউ সেই কদু হয়ে সমাজ আর বাবা মার লক্ষ্মী সন্তান হয়ে চলে যায়। বাপিও এখন কোন অনুষ্ঠানে যায় না। অনেক ডেকেছে অনেকে। স্রেফ বলে দিয়েছে , সাম্প্রদায়িকতার মলাটে ঢাকা কোন সংস্কৃতির চর্চা করা তার পক্ষে অসম্ভব। ফলে এই ছোট শহরের মানুষরা দু ভাগ হয়ে গেছে। ক্রমেই বাপির পক্ষের মানুষের সংখ্যা কমে আসছে। শহর বাড়ছে । আশেপাশের গ্রামগুলো শহরের আওতায় চলে আসছে। আশ্চর্য জনকভাবে কমে গেছে হিন্দুদের সংখ্যা। কবে কখন কিভাবে যেন হিন্দুরা তাদের ঘর বাড়ি বিক্রি করে চলে যাচ্ছে ইন্ডিয়া। একদিন সকালে দেখা যায় সেখানে বাস করছে এক মুসলিম পরিবার। তুলসি মঞ্চ নাই হয়ে গেছে । ফুলগাছগুলো কেন যে ধ্বংস করে মুসলিমরা কে জানে। অথচ হযরত মুহাম্মমাদ ফুল খুব ভালবাসতেন বলেই জানা যায়। দ্রুত মসজিদ গজিয়ে উঠছে। মসজিদমুখো মানুষের সংখ্যা প্রচুর। অনেকেই পিতৃপুরুষের সম্পর্কে গল্প বানাচ্ছে আজকাল। তারা আদতে কেউ বাঙালি হতে চায়না। সবার পুর্ব পুরুষ আস্তে আস্তে আরব, ইরাক, ইরান, দিল্লি, গুজরাট, আফগানিস্তান, তাজাকিস্তান বা আরো কোন দূর দূর মুস্লিম দেশের মানুষ ছিলেন বলে গল্প ছড়াচ্ছে। এর মধ্যে একদিন ছোটকাকা এসেছিল। চা খেতে খেতে জানালো কাকার ইচ্ছা তাদের পুর্ব পুরষও ইরাণ থেকে এসেছে এই গল্প বানালে কেমন হয়? মা ত হাসতে হাসতে প্রায় বিষম খায়। আয়নায় নিজেকে দেখেছিস? সরল কম বুদ্ধির কাকাও হাসে শিশুর মত। মার হাতের পাশে ছোট কাকার হাত রাখলে মনে হয় যেন কাঠ কয়লা । আর কাকার পাশেই ভূতো কালো আমি ভূগোল মুখস্থ করছি। শেষ প্রচেস্টা হিসেবে ছোটকাকা তবু বলে ব্রাহ্মনের আর আছেটা কি ! মসজিদে নামাজ পড়তে গেলে অনেকেই বংশের পুর্ব ইতিহাস টেনে আনে। বড় ভাইজান ত এগুলো বোঝেনা। সে ত তার জগতে থাকে। ঠাট্টা ইয়ার্কি ত শুনতে হয় আমাকেই। মা খুব বুঝিয়ে বলে ছোটকাকাকে তোদের কিন্তু মিথ্যেটা সহ্য হয় না। যা করার ভেবে করিস। কাকাও অত্যন্ত বিরক্ত মুখে বলে, সত্যিটাই বা কি দিচ্ছে বলো ! ছেলেমেয়ে বিয়ে দেওয়ার সময় আমাদের মত উদার পরিবার কি আর পাব ?

তা ঠিক । ছোট শহর বলে যতটা আধুনিক হচ্ছে তা কেবল পোশাকে । মগজে আর মননে প্রগতিশীলতা সে ভাবে জন্মাচ্ছে না। তা ছাড়া প্রচুর লোক চলে যাচ্ছে আরব দেশে। তেলের টাকায় আরবীয় সংস্কৃতি বয়ে আনছে । বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছিল যে অসাম্প্রদায়িক চেতনার আদর্শ নিয়ে তা লুপ্ত হতে চলেছে এই ছয় বছরে। পচাত্তরে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার সাথে সাথে একাত্তরের পরাজিত শত্রুরা অগ্রগামী হয়ে উঠেছে বিপুল বিক্রমে। । পুরানো আর একাত্তরে পরাজিত শত্রুরা পুনর্গঠিত হচ্ছে নব কলেবরে। এখন আর জয় বাংলা নেই। এটা নাকি হিন্দু শব্দ। এখন থেকে বলতে হবে, বাংলাদেশ জিন্দাবাদ। এটাই উপযুক্ত বাংলা শব্দ। কাজি বাড়ির মেজ কাকা হাত ঘুরিয়ে চোখ পাকিয়ে মাকে বললে যে এই শ্লোগানটায় বেশি জোশ ধরে । জয় বাংলা বললে কেমন যেন নিজেকে হিন্দু হিন্দু লাগত। ও বড় ভাবি, মেয়ে জামাই মুসলমান হয়েছ ত ? মা কিছু বলে না। নিচের উঠোন থেকে আমাদের ঝুল বারান্দার দিকে তাকিয়ে কাকা বলে অন্য মেয়েকে ত বিয়ে দিতে হবে। আপনার মেয়ে হিন্দু বিয়ে করেছে জানলে কি কোন ভাল ঘরের ছেলে আসবে এই মেয়েকে বিয়ে করতে ? মা এবার বলে, মেয়ে পড়াশুনা করছে । পড়াশুনাটা শেষ করুক ত। এসব এখন ভাবছি না মন্টু। মন্টু কাকা হাহাহা করে উঠে উত্তেজনায় । গোল সূতার টুপীটা মাথা থেকে নামিয়ে আমার বয়েস হিসেব করে বলে উঠে, ইয়া মাবুদ আল্লাহর। হযরত আয়েশার ত এর চেয়ে কম বয়েসে নিকাহ হয়ে গেছিল । মাও খুব ঠান্ডা গলায় বলে, তা আমি ই বা কোথায় হযরত মুহাম্মদের (সাঃ) মত সৎ জামাই পাই বল যে এত টুকু মেয়ে বিয়ে দিই ? কাজি বাড়ির মেজ কাকু মন্টু মুক্তিযুদ্ধ করেনি। কিন্তু তার ভাই মুক্তিযোদ্ধা । এদল সেদলে খুব সহজ যাতায়াত মন্টুকাকুর। কথা চালাচালিতে ওস্তাদ। কারো কিছু বলার থাকলে উনাকে একবার বললেই হল। পল্লবিত হয়ে ছড়িয়ে পড়বে সারা শহরে। আমার মা বাপি বুঝেছে মন্টু কাকু কারো কথা নিয়েই এসেছে আমাদের বাড়িতে।

দুর্যোধন দাদু মারা গেলেন এক বর্ষা রাতে। স্বাভাবিক মৃত্যু। শহরের অনেক হিন্দু মুসলিম শেষ দেখা দেখতে গেছে দাদুকে। বল হরি, হরি বোল বলে দাদুকে কাঁধ দিয়ে নিয়ে গেছে দ্বিজদাস কাকুসহ দাদুর আত্মীয়রা। শ্মশানঘাটের আশেপাশ পর্যন্ত অনেক মুসলমানরাও গিয়েছিল। শহরের প্রাচীনতম মানুষ ছিলেন দাদু। প্রাচীনতম স্তম্ভটিও শেষ হয়ে গেল বলে অনেকেই দুঃখ করছিল। অনেক রাতে বাপি ফিরেছে ঘরে। গোসল করে ফ্রেস হয়ে পড়ার টেবিলে বসে মাকে জানাল , আজ কিছু খাব না। আর শোন, দ্বিজ আজ চলে গেল কলকাতা । মা অবাক। সেকি আমাকে বললে না একবার! সময় পায়নি , আজ না গেলে দ্বিজের বিপদ হত। ওর নামে থানায় কমপ্লেইন করেছে কেউ কেউ। রাতেই বর্ডার পেরিয়ে যাবে ভেবো না। আর্ত গলায় বলে মা , খাবে কি? থাকবে কোথায় ? ওদেশেও ত তীব্র অভাব। হাতের কাজ জানে। শ্যামবাজার মাধবের সাথে থাকবে। জান ত বাঁচল। দ্বিজকাকুর ছেলেটার জন্য খুব মন খারাপ লাগছে। সকালেও কাকী এসে গেছে আমাদের বাসায় । খুব কাঁদছিল । আমরা ভেবেছি দাদুর জন্য । আসলে দেশ ছেড়ে চলে যাচ্ছে সেই দুঃখেই কাঁদছিল । মাকে বলতেও পারছিল না হয়ত। কিন্তু বাপি জানালো সত্যিটা। আসলে শ্মশানে যাওয়ার সময় ই জেনেছে কাকুকে অ্যারেস্ট করবে দু একদিনের মধ্যে। তাই শ্মশান থেকেই সরিয়ে দিয়েছে বাপিরা । এক কাপড়ে । কাকিও কিছু জানত না। যে যা পেরেছে টাকা দিয়ে দিয়েছে। দ্বিজের বন্ধু আশফাক পুলিশ বাপির হাতে ছয় হাজার টাকা দিয়েছে কাকুকে দেওয়ার জন্য। সাথে সতর্ক বার্তা , যত শিঘ্রি সম্ভব বর্ডার পার হয়ে চলে যাক । আমরা ঘন হয়ে বসে থাকি। দ্বিজ কাকু আর আশফাক কাকু কোন নাটকে না থাকলে সে নাটক একদম জমে না। স্ক্রিপ্টের বাইরে নিজেরাই সংলাপ বানিয়ে নেয় তাৎক্ষণিকভাবে। নাটকের ভেতরে নাটক। আর এই সব নাটকে প্রায়ই দ্বিজ কাকুর কাছে মার খায় আশফাক কাকু। পুরো ষ্টেজ জুড়ে দ্বিজকাকুর হুংকার শোনা যায়। আশফাক কাকু আর করব না বাপজান বা মিয়াভাই অথবা কর্তামশাই বলে বলে দৌড়াতে থাকে দ্বিজকাকুর ভয়ে। পেছনের সারির দর্শকরা অভিনয় দেখার জন্য দাঁড়িয়ে পড়ে আনন্দে। নাটক জমে লে হালুয়া।


চেনা জানা অনেকের মত দ্বিজ কাকুও একদিন স্মৃতি হয়ে যাবে। যেমন অনেকেই এখন স্মৃতি। খুব বেদনা নিয়ে বাপি জানায় দেশে দেশে এখন রাজনীতিতে ধর্ম ঢুকে পড়েছে ভয়ংকর হয়ে। পৃথিবীর বড় খারাপ সময় চলছে । মানুষ আর মানুষ নামে পরিচিত হবে না। হিন্দু মুসলিম, বৌদ্ধ খৃষ্টান নামে পরিচিতি পাবে। আচ্ছা রাবি আমাদের সন্তানেরাও কি মানুষ হবে নাকি ধর্মের জিরাফ হবে?



লেখক পরিচিতি
রুখসানা কাজল 
সহকারী অধ্যাপক, রাষ্ট্র বিজ্ঞানবিভাগ।
জন্মস্থান গোপালগঞ্জ।
গল্পকার, কবি , প্রবন্ধকার।
লেখেন দৈনিক জনকন্ঠে, সময় প্রতিদিন ওয়েব পত্রিকা, ছোট কাগজে।
প্রকাশিত কবিতার বই : চাঁদ চোয়ানো জ্যোৎস্নায় ফিরে এসো নদীবতী মেয়ে।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ