ছায়ারেখা


রায়হান রাইন

এক চীনা রেস্তরাঁয়

ভেতরের বাতাস বেলী ফুলের মিষ্টি গন্ধে ভরা। পে­য়ারে লো ভল্যুমে বাজছে দ্য সফ্ট মুন ব্যান্ডের একটি গান। যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তো এই গান মঞ্জু বহুবার শুনেছে। আজ সুরটার দিকে খেয়াল করতেই পুরনো সময়ের অনুরণন উঠল মনের ভেতর। আগেও একাধিক বার নাজনীনকে নিয়ে সে এসেছে এখানে, কিন্তু কখনোই সফ্ট মুনের কোনো গান বাজতে শোনেনি। নাজনীন বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে তার হলে চলে যাবে কাল, এক সপ্তাহ দেখা হবে না।
এই না-দেখা হওয়া উপলক্ষেই চীনা রেস্তরাঁয় এসে বসা। যদিও এ নিয়ে নাজনীনের মধ্যে কোনো ভাবান্তর নেই। ফুরফুরে মেজাজ নিয়ে সে গল্প করে যাচ্ছে উচ্ছাসের সঙ্গে। হঠাৎ পাশের টেবিলের দিকে চোখের ইশারা করল নাজনীন। সেই টেবিলে বেশ সাজগোজ করা একটি মেয়ে বসা। দুচোখ বন্ধ করে মেয়েটি তার হাত দুটি বাড়িয়ে রেখেছে সামনে আর ছেলেটি একটি হাত ধরে আঙুলে আংটি পরিয়ে দিচ্ছে। দৃশ্যটা খুব পরিচিত আর বেশ অর্থপূর্ণ। এমন একটা দৃশ্য দেখে তাদের খুব হালকা বোধ হলো। মঞ্জুর মনে পড়ল, নাজনীন কালচারাল স্টাডিজ বিভাগে ভর্তি হবার পর যখন ক্যাম্পাসে যাওয়া শুরু করে, সে-সময় একবার সন্ধ্যাবেলা লেকের ধারে দুজন দাঁড়িয়ে ছিল; চাঁদ ছিল আকাশে আর লেকের উল্টা দিকের প্রাগৈতিহাসিক জঙ্গলের উপর পড়েছিল জোছনা। মঞ্জু চোখ বন্ধ করতে বলেছিল নাজনীনকে। কিন্তু সে বুঝতে পারছিল না কেন তাকে চোখ বন্ধ করতে বলছে মঞ্জু। সে চোখ দুটো বন্ধ করেই খুলে ফেলেছিল পর-মুহূর্তে আর মাথাটা সরাতে গিয়ে মঞ্জুর নাকের সঙ্গে লেগে গিয়েছিল ঠোঁট। নাজনীনের তখন মনে হয়েছিল, প্রেমিক-প্রেমিকারা যখন চোখ বন্ধ করতে বলে তখন তারা আসলে আত্মসমর্পণ করতে বলে। আর সবাই ভালোবেসেই করে এই কাজটি। নাজনীন এ কথাটাই বলেছিল সেদিন। আজ পাশের টেবিলের মেয়েটির বন্ধ চোখ দেখে কথাটা আবারও মনে পড়ল। তার মনে প্রশ্ন, চোখ বন্ধ করে এই মেয়েটি কি এখন কেবল আত্মসমর্পণই করছে? নাকি আরও কিছু? মঞ্জু বলল, “দেখ, এই অংগুরীয় কিন্তু আত্মিক বন্ধনের চিহ্ন।” নাজনীন বলল, “না। এইটা তো দাসত্বের প্রতীক। এইটা না খোলা পর্যন্ত এই ছেলের কাছ থিকা সে কোনোদিন স্বাধীন হইতে পারবে না। আবার, সে যদি কখনো এটা খুইলাও ফেলে, তাকে এ বাবদে মূল্য দিতে হবে অনেক।”

পিন্টু দা’র আসবার কথা। উনি দুজনকে লিফট দেবেন কলোনির গেট অব্দি। কিন্তু তার আসার কোনো লক্ষণ নেই। অবশ্য বেলী ফুলের মিষ্টি সৌরভ আর সফ্ট মুনের গানের সুরের ভেতর বসে থাকতে কারোরই খারাপ লাগছিল না। তাছাড়া এক সপ্তাহ তাদের মধ্যে দেখা-সাক্ষাৎ হবে না। দুজনের মধ্যে গল্পের ডালপালা এলোমেলো ভাবে ছড়িয়ে যাচ্ছিল। তারা দ্বিতীয় দফায় কফির অর্ডার দিল। তখন কথা গড়িয়েছিল বিয়ের প্রসঙ্গে। নাজনীন সবে তৃতীয় বর্ষে পড়ে। মঞ্জু নৃবিজ্ঞানে এম এ শেষ করে একটা বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াচ্ছে আর দেশের বাইরে পড়তে যাবার জন্য আইএলটস দেবার প্রস্তুতি নিচ্ছে। তাদেরও সময় হয়েছে বিয়ের। এ-কথা সে-কথা থেকে বিয়ের নানা ধরন নিয়ে কথা বলতে বলতে কী করে যেন দেনমোহরের প্রসঙ্গ উঠল। নাজনীন বলল, “এইটা নারীর জন্য অমার্যাদাকর।”

“কেন?”

“না কেন?”

“নারীর সামাজিক নিরাপত্তার জন্যে কি এইটা দরকারী না?”

“কিভাবে? মোহরানা কি নারীর নিরাপত্তার ঝুঁকি কমাইতে পারতেছে?”

নাজনীন ব্যাপারটাকে খুব গুরুতরভাবে দেখছে আর খুব গম্ভীর হয়ে পড়ছে দেখে মঞ্জু একটা গল্প বলে, যাতে সে হালকা বোধ করে। গল্পটা কোথাকার মঞ্জুর তা মনে নেই তবে অবশ্যই কোনো আরব দেশের ঘটনাই হবে। সেই দেশে কেউ যখন বেশ্যালয়ে যায়, যে নারীর কাছেই যে যাক আগে তার সঙ্গে বিয়ের চুক্তি সই করতে হয়। ফিরে যাবার সময় লোকটি তালাক দেয় সেই নারীকে। সে তখন যে দেহমোহর দেয় সেটাই হয় তার দেয়া আনন্দের দাম। এটা কি অসম্মানজনক না? মঞ্জু ভেবেছিল, গল্পটা শুনে নাজনীন খুব মজা পাবে কিন্তু দেখল সে আরও গম্ভীর হয়ে পড়েছে।

পিন্টু দা ফোন করে বললেন, “আমি দশ মিনিটের মধ্যে আসতেছি, তোমরা নিচে নামো।”

কাউন্টারের সামনে গিয়ে বিল চাইলে নাজনীনকে লোকটি বলল যে, বিল ইতোমধ্যে পরিশোধ করা হয়ে গেছে। মঞ্জুই দিয়েছে। নাজনীন তখন বেয়ারাকে ডেকে কিছু টাকা বকশিশ দিলো।

তারা নিচে নেমে দাঁড়াতেই পিন্টু দা’র লাল গাড়িটা এসে দাঁড়াল রাস্তার পাশে।
 


প্রেম ছড়িয়ে আছে সবকিছুতে

মঞ্জু বিশ্বাস করে, প্রেম থাকে সবখানে, সবকিছুতে। তবে এই প্রেম বিশেষ বিশেষ মুহূর্তে নিজেকে খুলে ধরে। যখন তার আবরণ খুলে যায় বা কারো মধ্যে সেই প্রেমকে দেখার চোখ সৃষ্টি হয়, তখন সে তা খুঁজে পায়। মঞ্জু এই বিশ্বাসে পৌঁছেছে ক্রমশ, নানা ঘটনায়। পিন্টু দা’র সঙ্গে সে বহু রাত একসঙ্গে ঘুরেছে ক্যাম্পাসে, কখনো কখনো বড় রাস্তা ছাড়িয়ে কাঠগড়া বাজার পর্যন্ত গেছে হেঁটে হেঁটে। তারা তখন রাতের সৌন্দর্য আবিস্কার করেছে; ভোরের সৌন্দর্যকে দেখেছে সূর্যোদয়ের ভেতর। সকাল, সন্ধ্যা আর রাত্রির ভেতর প্রেম আবিষ্কারের সাক্ষী হিসেবে তাদের বন্ধনও টিকে থেকেছে বহুকাল। পিন্টু দা লেখাপড়ার পাট চুকিয়ে অনেক দিন হলো কানাডা প্রবাসী। অবশ্য তাকে দেশে ফিরতে হয় মাঝে মাঝে। ব্যবসার কাজে তিনি বাংলাদেশ-কানাডা আর কানাডা-বাংলাদেশ করতে থাকেন সারা বছর। দেশে এলেই মঞ্জুকে খুঁজে বের করেন। বহুকাল আগে লেকের জলে, গাছের পাতায় ভোর কিংবা রাত্রির ভেতর যে প্রেম তারা অনুভব করতো তা যেন অনিঃশেষ এক ঝর্নাধারা। আবার নাজনীনের সঙ্গে এই প্রেম আবিস্কারের সাক্ষী হওয়া একেবারেই আলাদা। আকাশ জোড়া বৃষ্টির ভেতর নির্জন ক্যাম্পাসে ঘোরগ্রস্তের মতো সাইকেলে ঘুরতে ঘুরতে মঞ্জু বুঝেছে মেঘ আর বৃষ্টির ভাষা। সে-সময়ে নাজনীন ছিল না চারদিকে বাতাস-তাড়িত বৃষ্টির কলরোল, মাথার ভেতর বিশ্বরহস্যের সবচেয়ে জটিল প্রশ্নগুলো ছাড়া কিছুই জেগে নেই; সাইকেল ছুটছে পিচ রাস্তায় আর বৃষ্টির ধারা ধুয়ে মুছে পরিশ্রত করে দিচ্ছে ভাবনাকে। তেমনি এক বৃষ্টির দিনে নাজনীন সহ একবার বৃষ্টিতে ভিজেছিল মঞ্জু। গাছপালা যেমন করে ভেজে তেমনি তারাও ভিজছিল দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে। তারা যখন হাঁটছিল তখনও ছিল বৃষ্টি আর ঘাস-লতা-পাতার আনন্দের মতো আনন্দে বিভোর। এটিই হয়তো ছিল বৃষ্টিকে আবিস্কারের প্রেম। মেঘ-বৃষ্টি-বিজলী সহ আকাশ, গাছ-পালা, জল আর ভিজে বাতাসের সঙ্গে থাকা বিষাদে লীন হয়ে গিয়েছিল তারা। মেঘের ডাকে যখন কেঁপে উঠছিল বুক তখন যেন নিজেদের সত্তা মিশে যাচ্ছিল আকাশের বিস্তারের সঙ্গে। এই বৈশ্বিক চেতনার ভেতর দুজনে আবিস্কার করেছিল নিজেদের প্রেম ও আনন্দকে। এ রকম বৃষ্টির ভেতর হাঁটতে হাঁটতে কোনো বৃষ্টিতে ভেজার দল হয়তো ‘আকাশ জুড়ে বৃষ্টি নামুক রে, মেঘের কোলে রোদ্দুর উঠুক রে...’ গাইতে গাইতে হাঁটছিল কিংবা ‘তুমি চলে যাইবা রে, বন্ধুরে, কবে আইবা রে..’ গানটি শুনতে শুনতে বৃষ্টির আঁধার-নামা বিকালটি আরও বিষাদে বদলে গেছে তখনই মঞ্জুর মনে হয়েছে, প্রেম ছড়িয়ে আছে সবখানে। তাকে আবিস্কারের জন্য খুলে রাখতে হয় চোখ আর হৃদয়কে।

পিন্টু দা নিজেই গাড়ি ড্রাইভ করেন। একেবারেই ঝাড়া হাত পা তিনি। সন্তানাদিও নেই। স্ত্রীর সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হয়েছে বছর খানেক আগে। তাদের ছাড়াছাড়ির ঘটনাগুলো খুবই মর্মান্তিক। যদিও কোথায় যে এই অসমঝোতার শিকড় অনেক কথা শুনেও তার তল পাওয়া যায় না। তারা সব সময়ই পরস্পরকে দোষারোপ করতে থাকেন। মাঝে মধ্যে কণা আপা যখন ফোন করেন পিন্টুদার বিরুদ্ধে বকতে থাকেন অনর্গল। আর পিন্টু দা-ও তার হাজারটা দোষ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখাতে থাকেন, যেন তাদের ছাড়াছাড়িই ছিল পরম শান্তির অবস্থা। এখন, দুজনে পরস্পরকে অনন্তভাবে দোষারোপ করে নিজেদের আর অন্যদের কাছে যেন ছাড়াছাড়ির বৈধতাটাই প্রমাণ করতে থাকেন।

পিন্টু দা মঞ্জু আর নাজনীনকে কলোনির গেটে নামিয়ে দিয়ে চলে গেলেন। দুজনে তার উদ্দেশ্যে হাত নাড়ল। মঞ্জু নাজনীনদের বাসার গলি পর্যন্ত তাকে এগিয়ে দিয়ে যখন নিজের বাসায় ফিরে গেল ততক্ষণে সন্ধ্যা গড়িয়ে গেছে।


রহস্যময় একটি বাড়ি

মঞ্জু আগারগাঁও পাসপোর্ট অফিসে যাচ্ছিল রিকশা করে। পাসপোর্ট সে আগেই করে রাখছে কারণ আগস্ট মাসে আইপিআরএসের ফলাফল জানা যাবে। যদি সেটা নাও পায় অন্য কোনো স্কলারশিপ সে পাবেই। তখন নানা ব্যস্ততার মধ্যে পাসপোর্টের জন্য দৌড়ানোর সময় পাবে না। এমনকি নাজনীনের পাসপোর্টটাও এখনই করে রাখা ভালো, মঞ্জু ভাবে। পরের সপ্তাহে নাজনীন যখন ক্যাম্পাস থেকে ঢাকায় ফিরবে আর মঞ্জুও পাসপোর্টের জন্য আবার আগারগাঁও আসবে তখন তার জন্যেও ফরম জমা দেবে। পাসপোর্ট অফিস থেকে মঞ্জু আজ যাবে আইডিবি ভবনে। নাজনীন মেরীকে নিয়ে জাঁ লুক গদারের ফিল্ম খুজছিল। আইডিবিতে হয়তো পাওয়া যাবে। রিকশায় বসে বসে এসবই ভাবছিল মঞ্জু। হঠাৎ লক্ষ্য করল পিন্টু দা’র গাড়িটা তার পাশ দিয়ে এগোল। পাশ দিয়ে যাবার সময় মঞ্জুকে লক্ষ্য করেছে পিন্টুদা। লাল রঙের গাড়িটা কিছুদূর সামনে গিয়ে রাস্তার ডানদিক ঘেঁষে দাঁড়াল এবং পিন্টু দা জানালা দিয়ে মাথা বাড়িয়ে মঞ্জুকে ইশারা করলেন রিকশা থেকে নেমে যেতে।

পিন্টু দা অফিস থেকে বেরিয়েছিলেন। মঞ্জু পাসপোর্ট অফিস যাচ্ছে শুনে বললেন, “চলো, ওখানেই আগে যাই। পরেরটা পরে।”

“পরের কোনটা?”

“মানে, পরে কোথাও বসব নে।”

“আচ্ছা।”

পিন্টু দা পাসপোর্ট অফিসের সামনের গলিতে গাড়ি থামিয়ে বললেন, “আগে ব্যাংকের সামনে লাইন ধরো গিয়া।”


ব্যাংকে টাকা জমা দেবার পর দশতলা, পাঁচতলা করে কয়েক জায়গায় ঘুরতে হলো মঞ্জুকে। পরে জানা গেল নামাজ ও লাঞ্চ আওয়ারের পর আবারও এসে ছবি ওঠাতে হবে গ্রাউন্ড ফ্লোরে। মঞ্জু বেরিয়ে এলো অফিস চত্বর থেকে। পিন্টু দা বললেন, “চলো, লাঞ্চ সেরে নিই কোথাও।”

“আইডিবিতে চলেন।”

“চলো।”

মঞ্জু পিন্টু দা’কে পাসপোর্ট অফিসের সামনে অনেকক্ষণ অপেক্ষা করিয়ে রেখেছিল, তখনও সে জানে না উনি কোথায় যাচ্ছিলেন। আইডিবি ভবনের রেস্তরাঁয় বসে সে তাকে জিগ্যেস করল, “কোথায় যাচ্ছিলেন তখন?” পিন্টু দা হাসলেন। বললেন, “আছে। পরে বলব নে।” মঞ্জু তাঁর কথায় রহস্যের গন্ধ পেল। কিন্তু এ বিষয়ে আর কিছুই জিগ্যেস করল না। খাবার শেষ করে চারতলার ভিডিও কর্নারগুলোতে গিয়ে খুঁজল গদারের ছবি। পাওয়া গেল হেইল মেরী, পিয়েরে লা ফু আর মাই লাইফ টু লিভ। এগুলোই কিনে নিলো নাজনীনের জন্য।

আইডিবি ভবন থেকে বেরিয়ে মঞ্জু সিদ্ধান্ত নিতে পারছিল না, কোথায় যাবে। তার সামনে দুটো বিকল্প। পাসপোর্ট অফিসে গিয়ে ছবি তোলার কাজটা সেরে ফেলা অথবা পিন্টু দা’র সঙ্গী হওয়া। তবে সিদ্ধান্তটা নেবার ভার সে পিন্টু দা’র উপরই ছেড়ে দিল। উনিই ঠিক করুক যেখানে যাচ্ছেন মঞ্জুকে সেখানে নেবেন কিনা। কিন্তু পিন্টু দা গাড়িতে উঠেই বললেন, “চলো, কোথাও বসা যাক।”

“মানে? আপনি না কোথায় যাচ্ছিলেন?”

“যাব নে পরে। আগো চলো বসি কোথাও।”

“কই আর বসবেন। আমরা তো রেস্টুরেন্টে বসেই ছিলাম।”

“বাইরে কোনো পার্কে গিয়া বসি, চলো।”

“এখানে পার্ক কোথায়?”

“চলো, চাঁদনী উদ্যানে বসি গিয়া।”

“ঠিকাছে।”

ফটকের বাইরে গাড়ি রেখে পিন্টু দা আর মঞ্জু উদ্যানের ভেতরে একটা বেঞ্চিতে বসল। ভ্রাম্যমাণ কফিঅলার কাছ থেকে কফি নিলো দু’কাপ। পরে এ-কথা সে-কথা থেকে পিন্টু দা’র স্ত্রীর প্রসঙ্গ এলো। এ প্রসঙ্গ এলে সব সময়ই যেমন হয়, তেমনি ক্রোধের ঝাঁজ মিশে যেতে থাকল পিন্টু দা’র কথায়। বললেন, আসলে বিয়ের সম্পর্ক মাত্রই বিশ্বাস-অবিশ্বাসের একটা দোলাচল।”

“বিয়ের সম্পর্ক মাত্রই?”

“সব না। তবে বেশির ভাগ। এ থিকা আমি এখন মুক্ত।”

“বাচ্চা নেন নাই কেন?”

“নেই নাই, এই সব টানপড়েনের কারণে আসলে সিদ্ধান্ত নেয়ার পরিস্থিতি ছিল না।”

“আচ্ছা।”

পিন্টু দা নীরব থাকলেন কিছুক্ষণ। মঞ্জু জিগ্যেস করল, “কোথায় না যাইবেন বলছিলেন?”

“হ্যাঁ। ওই যে বাড়িটা দেখতেছ, ও বাড়িতে যাব।”

“কাদের বাড়ি ওইটা।”

“পরে বলব নে।”

“আমি কি যাচ্ছি?”

“না। আপাতত তুমি এখানেই থাকো। আমি শিগগিরই ফিরব।”

মঞ্জু ভালো করে তাকাল বাড়িটার দিকে। উদ্যানের বিপরীত দিকে শাদা পাঁচতলা বাড়ি। খুব সাধারণ বাড়িটা, আলাদা কোনো বৈশিষ্ট্য চোখে পড়ে না। ছাদের উপর কবুতর বসার একটা মাচান, বিশেষত্ব বলতে এটুকুই। কিন্তু কারা থাকে ওখানে? পিন্টু দা কেন তাকে সঙ্গে নিলেন না? মঞ্জু যখন এসব ভাবছে উনি ততক্ষণে উদ্যানের বাইরের পথ ধরে অদৃশ্য হয়ে গেছেন বাড়িটার দিকে।

তাড়াতাড়ি ফেরার কথা বললেও পিন্টু দা ফিরলেন দেড় ঘন্টা পর। তাকে খানিকটা বিধ্বস্ত দেখাল। যেন অনেকটা পথ দৌড়ে ফিরেছেন। মঞ্জু তাকে বাড়িটার ব্যাপারে জিগ্যেস করল না কিছুই। তিনি নিজে থেকেও কিছু বললেন না। মঞ্জু তখন আর পাসপোর্ট অফিসে পুনরায় যাবার আগ্রহ পেল না। পিন্টু দা’র গাড়িতেই ফিরে গেল বাসায়।

দুদিন পর পিন্টু দা’র সঙ্গে পাবলিক লাইব্রেরির সামনে মঞ্জুর দেখা হলো আবারও। রেস্টুরেন্টের পাশে বহেড়া গাছগুলোর নিচে নির্জন সিঁড়ির উপর বসল তারা। ওখানে বসে কফি খেতে খেতে মঞ্জু জিগ্যেস করল, “কণাপা তো চইলা গেছেন গা। এখন কি কোনো গার্লফ্রেন্ডও নাই আপনার?”

“নাই মানে? কানাডায়ও আছে এখানেও আছে।”

“বলেন কি!”

“হ্যাঁ। তবে গার্লফ্রেন্ড বলতে তুমি যেমন বুঝতেছ, তেমন না।”

“কেমন তাহলে?”

“এখানে বন্ধুত্বের কোনো স্থায়িত্ব নাই।”

“মানে?”

“এই বন্ধুত্বের স্থায়িত্ব শরীরী সময়ের সমান।”

“বুঝলাম না।”

“মানে তুমি যতক্ষণ তার সঙ্গে আছে, ততক্ষণই বন্ধুত্ব। অবশ্য কারো কারো স্মৃতি তোমার মনে স্থায়ীও হতে পারে।”

“খুইলা বলেন।”

“আচ্ছা, বলতেছি। ধরো, একটা বাগান বাড়ি। উৎসব মতো নাচগান চলতেছে। অনেকেই গান শুনতেছে, নাচতেছে। এদের মধ্যে মেয়েরাও আছে। তাদের কাউকে তোমার ভালো লাগল। তাকে তুমি পাইতে চাইলা। সেইটা তুমি তাকে জানাইলা। এই জানানোর কিছু নিয়মকানুন আছে। তো সে-রাতেই তুমি তাকে পেয়েও গেলা। ভাইবা দেখ, কী দারুণ একটা ব্যাপার! এখনই দেখলা, হয়তো এটাই প্রথম দেখা, পছন্দ করলা, আবার এখনই পাইলা। কিন্তু পরদিন তাকে মনে রাখার দায় তোমার নাই।”

“এরা কি প্রোস্টিটিউট?”

“আমরা বলি সোসাইটি গার্ল।”

“এই বাগানবাড়িগুলা কোথায়?”

“তুমি কি যেতে চাইতেছ?”

“নাহ। এমনি জিগ্যেস করলাম।”

পিন্টু দা তখন চাঁদনী উদ্যানের পাশের পাঁচতলা শাদা বাড়িটার কথা বললেন।

“সেই বাড়িটা, যেখানে সেদিন গেলেন?

“হ্যাঁ, তবে ওটা বাগানবাড়ি না।”

“মানে?”

“বাগানবাড়ির নিয়মকানুন আর ওই বাড়ির নিয়মকানুন এক না। তবে ওই বাড়ির নিয়ম আরও সহজ। এখানে যে কেউই কাউকে নিয়া যাইতে পারে। এজেন্টদের মারফত মেয়েদের সাথে যোগাযোগ করা লাগে। আর বাড়িটাতে শুধু একটা পার্সেন্টেজ দিয়া যাইতে হয়।”

“কেমন সেটা?”

“মানে, যে দরে তুমি মেয়েটাকে নিলা তার একটা পার্সেন্টেজ বাড়ি ভাড়া বাবদ দিয়া আসতে হয় কাউন্টারে।”


বয়েসী চোখের অনন্ত পাহারা

বুড়ি, মঞ্জুর দাদি, উঠানে বসে যেন অনন্তের দিকে তাকিয়ে থাকে। বড়ই গাছটার নিচে এক চিলতে বাগানের দিকে মুখ করে বসে হয়তো ফটকের ওধারে দেয়ালের দিকেই তাকিয়ে থাকে, নয়তো সালমার রান্না করা দেখে। কিন্তু তার চোখে পরম ঔদাস্য, যেন মৃত্যুর জন্য তার অপেক্ষার ভেতর এসে ভর করেছে অনন্ত। তবু নাজনীন এলেই চঞ্চল হয়ে ওঠে সে। তার চোখ যেন নিঃসীম গগনে সাঁতার কাটা ছেড়ে নেমে আসে পৃথিবীতে। নাজনীন মঞ্জুর ঘরে গিয়ে বসলে বুড়ির দৃষ্টি বাগানের ধারের দেয়াল থেকে সরে আসে দরজার দিকে। আর যদি সে দেখে দরজাটা বন্ধ হয়ে গেছে তাহলে উঠে আসবে আলগোছে। হাতের লাঠিটা উঠিয়ে আঘাত করতে থাকবে দরজায়। তখন দরজা না খোলা পর্যন্ত ঠক ঠক চলতেই থাকবে। অগত্যা মঞ্জু যখন দরজা খুলে দেবে সে দেখবে যে হাসিভরা মুখে বুড়ি দাঁড়িয়ে আছে। মঞ্জুর তখন মনে হবে, তার প্রতি দাদির এটা বুড়ো বয়সের ইর্ষা, হৃত যৌবন বুড়িকে কত কৃপণ করে দিয়ে গেছে!

ইংরেজি এল গড়নের ভবনটার নিচতলার একদম শেষ মাথায় মঞ্জুর ঘর। দাদির ঘরটা অন্য মাথার একেবারে শেষে। বুড়ির ঘরটায় আছে একটা পুরানো সিন্ধুক যাতে লুকানো আছে দাদার ডায়েরিগুলো। কিন্তু দাদি কখনো সেগুলো ধরতে দেয়নি তাকে। মঞ্জুর ঘরের সামনের করিডোর থেকে রেলিং ঘেঁষে যে সিঁড়িটা উঠানে নেমে গেছে সেখানে বড়ই গাছতলা টিনের চালার নিচে সালমা রান্নার তরকারী কোটে। অদূরে বসে বুড়ি তার হাতের লাঠিতে সবার নিয়তিকে শাসন করে। এরকম সময়ে বুড়ি অনন্তের ভেতরে যেমন তেমনই নিজের ভেতরেও বুঁদ হয়ে থাকে, শুধু নাজনীন এলে মঞ্জু যখনই দরজা বন্ধ করবে তখনই উঠে আসবে বুড়ি। এসে নখরা জুড়ে দেবে নাজনীনের সঙ্গে। দুজনের রসিকতা দেখে মঞ্জু তখন হাসবে বটে কিন্তু তার সেই হাসির আড়ালে চাপা একটা ক্রোধ বেরুবার পথ খুঁজবে। মঞ্জুর তখন মনে হবে, বুড়ি তার এক অদ্ভুত প্রতিদ্বন্দ্বী।


কদিন আগে একবার নাজনীন এলে মঞ্জুর যখন ইচ্ছা হলো তার হাতটা ছুঁয়ে দেখবে, সে তার হাতদুটো নিজের মুঠোর ভেতর নিলো এবং জড়িয়ে ধরল তাকে। নাজনীন তখন দরজার দিকে তাকিয়ে হাসতে থাকল। দরজার ফাঁক দিয়ে দেখা যাচ্ছিল উদাস চোখে তাকিয়ে আছে বুড়ি, যেন চোখ দুটো তার কী গভীর ধ্যানে লিপ্ত হয়ে আছে অনন্তের সঙ্গে বোঝাপড়ায়।


সিসা লাউঞ্জ

এই প্রথম এলো মঞ্জু কোনো সিসা লাউঞ্জে। পিন্টু দা’র সঙ্গে দেখা হয়েছিল হাসপাতালের সিঁড়িতে। তার এক আত্মীয়ের স্ত্রীর গুরুতর অপারেশন, সেকারণেই হাসপাতালে এসেছিলেন। মঞ্জু গিয়েছিল মামাত বোনের ছেলেকে দেখতে, সকালবেলায় হয়েছে। সিঁড়িতে দেখা হতেই পিন্টু দা বললেন, “চলো, কোথাও গিয়া বসা যাক।” মঞ্জু তার গাড়িতে ওঠার কিছুক্ষণের মধ্যেই সেটা এই সিসা লাউঞ্জের দরজায় এসে থামল। সে ভেবেছিল কোনো চীনা রেস্তরাঁ। কিন্তু ভেতরে ঢুকে একটা চেম্বারে টেবিলের উপর নলঅলা হুক্কা দেখে বুঝল, এটা সিসা লাউঞ্জ। পিন্টু দা সিসার অর্ডার দিলে মঞ্জু তখনই সিদ্ধান্ত নিলো, সিসা টানবে না। নিষিদ্ধ যে-কোনো কিছুর ব্যাপারে তার একটা ভয় আছে মনে, তবে পিন্টু দা যখন সিসা টানছিলেন মঞ্জু তখন একবারের জন্য প্রলুব্ধ বোধ করল এবং সে নিষেধ ভাঙতে যাচ্ছে এমন একটা শিহরণ টের পেল নিজের ভেতর। কিন্তু শেষ অবধি নিজের ইচ্ছার কথা আর বলতে পারল না পিন্টু দা’কে। কিছুক্ষণের মধ্যেই সিসা লাউঞ্জের বাতাস ভারি হয়ে উঠল ধোঁয়ায়। মঞ্জুর তখন চোখ জ্বালা করতে থাকল। হয়তো ধোঁয়া নয়তো কিছুক্ষণ আগে বাজতে থাকা উচ্চকিত গানটার কারণেই মাথা ঝিমঝিম করতে থাকল তার। সে একবার ভাবল, উঠে যাবে সিসা লাউঞ্জ থেকে। কিন্তু পিন্টু দা’র কথার জালে আটকা পড়ে উঠতে পারল না। তখন আইয়ুব বাচ্চুর একটা গান বাজছিল পে­য়ারে “মন চাইলে মন পাবে, দেহ চাইলে দেহ।” পিন্টু দা বললেন, “খেয়াল করো, গানটা কি দেহ আর মনকে আলাদা করতেছে?”

“ঠিক স্পষ্ট না, মনে হচ্ছে দেহ আর মন এক হইলেও গায়কের কিছু যায় আসে না। কারণ সে সবই দিতে চায়।”

“গানটা আসলে দেহ আর মনকে আলাদা করতেছে না।”

“হইতে পারে। কিন্তু করেই যদি তাইলে সমস্যা কি? দেহ আর মন তো এক না।”

“কে কইছে এক না? তুমি যদি দুইটারে আলাদা করো আর দেহের চাইতে মনরে উচ্চকোটির মনে করো, আর মনের পেছনে ছোটো, তাইলে অথৈ সাগরে পড়বা।”

“কেমনে?”

“বেশ। যত কাল্পনিক সমস্যা, তার গোড়ায় আছে এই মন। মনকে খুঁজলে তুমি পদে পদে অ্যাম্বিগুইটির ফাঁদে পড়তে থাকবা, হিসাব মিলাইতে মিলাইতে জীবন যাইব গা।”

“অ্যাম্বিগুইটি?”

“হ্যাঁ। দ্ব্যর্থকতা। প্রেমিক-প্রেমিকার প্রতিটি আচরণের সাধারণ লক্ষণ এটা। যদি কোনো মোক্ষম মুহূর্তে বুঝতে ভুল করো আর অ্যাম্বিগুইটির ফাঁদে পা দাও, তাইলে এমনও হইতে পারে যে, জীবন দিয়া তোমারে এই ভুলের মাশুল গুনতে হচ্ছে।”

“বুঝলাম। দেহ আর মন এক হইলে কি দ্ব্যর্থকতা দূর হয়া যাইব গা?”

“হ্যাঁ। তুমি বাগানবাড়িগুলাতে দেখবা, সেখানে সবার সব আচরণই নির্দিষ্ট, যারে তুমি পছন্দ করলা, কাছে গিয়া তাকে কফি অফার করলা। সে ওই ইশারা বুইঝা যাইব গা। কারণ এটাই ওখানে নিয়ম। এখানে সম্পর্কগুলা খুব স্পষ্ট। এইখানকার সব কথাবার্তা হয় দেহের ভাষায়। খুবই স্পষ্ট সব চুক্তি হইতেছে, কিন্তু চুক্তির কাঠখোট্টা ব্যাপার কিছুই নাই।”

“কিন্তু দেহ আর দেহের টানই কি সব?”

“হ্যাঁ, দেহের বাইরে বইলা কিছু নাই। একটা ফ্রেমওয়ার্ক থাকে যা দিয়া আমরা দেহের ঘটনাকে বুঝি।”

“আমি ঠিক বুঝতে পারি না, এক রাত্রির চুক্তিগুলার কী মূল্য!”

“কিন্তু যখন এক জীবনের নামে আমরা চুক্তি করি, ধরো বিয়ে, সেখানে তো পরদিন থিকাই শুরু হয় পরস্পরকে অধীনস্ত করার লড়াই।”

“কিন্তু যখন কমিটমেন্ট থাকে?”

“হ্যাঁ। তখন খুব আলাদা ব্যাপার ঘটে অবশ্যই। তখন ভালোবাসার নামে এক্সপ­য়টেশন খুব সহজ হয়। আমরা ভালোবাইসা আনুগত্যই চাই, দাসত্বই চাই।”

পিন্টু দা’র কথা শুনে মঞ্জুর মনে পড়ল, সেদিন রেস্তরাঁয় নাজনীন এ রকমই কিছু বলছিল। তখন এক যুবক আংটি পরাচ্ছিল খুব সাজগোজ করা এক মেয়েকে।

মঞ্জুর কাছে মনে হয় পিন্টু দা’র অভিজ্ঞতা তাকে এমন একটা জগতে প্রবেশ করিয়ে দিয়েছে যেখানে নিয়মগুলো আলাদা। কেমন একটা নিয়ম যেখানে দেহের ভাষাই একমাত্র ভাষা আর দেহের সব ইশারাই দ্ব্যর্থকতাহীন! কেমন হয় যখন প্রত্যেক রাত্রি পেছনে রেখে যেতে থাকে একেকটি দেহ যার কোনো স্মৃতি নেই? তেমন একটা জগতে যাদের বাস, তাদের যুক্তি-পদ্ধতিও ধরতে পারে না মঞ্জু। কিন্তু নাজনীন কিভাবে বলছিল, আংটি হচ্ছে ছদ্মবেশে আনুগত্যের শৃক্সখল? তার এরকম চিন্তার কাছে সে কিভাবে পৌঁছাবে?

মঞ্জু ভাবে, কারো মনের জটিল হিসাব কষার সময় পিন্টু দা’র এখন আর নেই। তিনি ক্লান্ত। দ্ব্যর্থকতার জগৎ থেকে নেমে এসে তাই হাতে নিয়েছেন সহজ হিসাবের খাতা, যেখানে প্রতিটি আচরণ নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য-বিধেয়, বিশেষ্য-বিশেষণ নির্দিষ্ট সবই। প্রতিটি হাত নাড়া, প্রতিটি হাসি, প্রতিটি অনুরোধ আর প্রতিটি দীর্ঘশ্বাসও নির্দিষ্ট। মনের জটিল হিসাব মেলাবার প্রয়োজন সেখানে ফুরিয়ে গেছে। কিন্তু নাজনীনের মনের হিসাব মেলাতে মঞ্জুর কোনো অসুবিধা লাগে না। তার সঙ্গে স্মৃতির ভাঁড়ারকে সে শূন্য করতে চায় না কখনোই।


অদৃশ্য ও অপসৃয়মাণ সীমানা

পরের সপ্তাহে নাজনীন এলে মঞ্জু তাকে গদারের ছবিগুলো দেবার সময় পাসপোর্টের কথাটা তুলল এবং যেদিন তার পাসপোর্ট ডেলিভারির তারিখ সেদিন নাজনীনকেও সঙ্গে নিয়ে গেল। ফেরার সময় তারা রিকশাতে ফিরছিল, দুপুরে খেয়েছিল আইডিবি ভবনে মঞ্জু যে ক্যাফেতে পিন্টু দা’র সঙ্গে প্রথম বার এসে খেয়েছিল। সেদিন পরে যা যা ঘটবে তা হয়তো ওই সময়েই নির্ধারিত হয়ে যাচ্ছিল, কারণ মঞ্জু তার মনের ভেতর অস্পষ্ট একটা ইঙ্গিত টের পেয়েছিল ক্যাফেতে খেতে খেতে যখন চাঁদনী উদ্যানের মুখোমুখি দাঁড়ানো রহস্যময় শাদা বাড়িটার কথা তার মনে পড়েছিল। সে আর নাজনীন আবারও পাসপোর্ট অফিসে গিয়ে কাজ শেষে রিকশায় করে যখন ফিরছিল ততক্ষণে সন্ধ্যার দিকে ঝুঁকে পড়েছিল বিকাল আর চাঁদনী উদ্যানের পাশ দিয়ে যাবার সময় মঞ্জুর ইচ্ছা হয়েছিল, উদ্যানের বেঞ্চিতে কিছুক্ষণ নিরিবিলিতে বসবে। মঞ্জু সে-কথা বলতেই নাজনীন রাজি হয়ে গিয়েছিল এবং উদ্যানে গিয়ে বসেই ডেকেছিল চীনাবাদামঅলাকে। নাজনীন তখন ছিল খুবই উচ্ছল। সে বাদাম কিনে এমন সুন্দর ভঙ্গিতে জিভে লবণ মেখে সেই বাদাম ছুলে খাচ্ছিল যে তা দেখে মঞ্জুর খুব ভালো লাগছিল এবং সে তার মুখের দিকে তাকিয়ে দেখছিল। তখন নাজনীনের মুখের দিকে তাকিয়ে মঞ্জুর মনে হয়েছিল যে, জায়গাটা মোটেও নিরিবিলি নয়। এত লোক আজকাল পার্কে আসে যে একেবারে হাট বসে যায়। এসব লোকদের অনেকেই খুব অশিষ্ট ভঙ্গিতে মেয়েদের দিকে তাকিয়ে থাকে। ভিখিরি আর হকারদের উৎপাত তো আছেই। মঞ্জুর মনে পড়ল, তার এমনই দুর্ভাগ্য যে, বাসাতেও দাদির পাহারার কারণে সে নাজনীনের কাছ ঘেঁষে বসতে পর্যন্ত পারে না। এসব ভাবতে ভাবতে পার্কের মুখোমুখি দাঁড়ানো শাদা আর রহস্যময় বাড়িটা তার চোখে পড়ল, ছাদের উপর কবুতর বসার মাচান। বাড়িটার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতেই মঞ্জুর মনে কেমন একটা শিহরণ জন্মাল। সে কি তার ইন্দ্রিয়ের গভীরে টের পেয়ে গেছে যে নাজনীনকে সে নিয়ে যাচ্ছে ওই বাড়িতে? সে ভালোবাসে নাজনীনকে। নিজের মনে এ নিয়ে একবিন্দু দ্বিধা বা সংশয় নেই। নাজনীনও তাকে বিশ্বাস করে। তাদের মধ্যে এই যে বোঝাপড়া আর নাজনীনের প্রতি তার যে প্রেমের আস্থা তার উপর ভর করেই সে ওই বাড়িটাতে যাবার সিদ্ধান্ত নিলো। সে বলল, “নাজ। চলো, ওই বাড়িটাতে যাই। এখানে খুব ভিড়।”

“কাদের বাড়ি ওইটা?”

“পিন্টু দা চিনিয়েছিল। ওখানে নিরিবিলিতে গিয়া বসি, চলো।”

“আইচ টি বা কফি পাওয়া যাবে?”

“পাওয়া যাইতে পারে। আমি তো যাইনি আগে।”

“আচ্ছা, চলো।”


উদ্যানের মূল ফটক দিয়ে বেরিয়ে পিন্টু দা যে পথে বাড়িটাতে গিয়েছিল সেই পথ ধরেই নাজনীনকে নিয়ে এগোল মঞ্জু। উদ্যানের শূন্য বেঞ্চিতে বসে অদৃশ্য পিন্টু দা যেন মিটিমিটি হাসতে থাকলেন ওদের দিকে তাকিয়ে। কোনো নিষিদ্ধ বস্তুর চারদিকে থাকা সীমানায় পা রেখে মঞ্জু যে শিহরণ টের পায় সেই শিহরণ তখন তার সমস্ত দেহে। নিষেধের অদৃশ্য সীমানাটা তার পায়ের নিচে কাঁপছে। মাথার ভেতর গদারের নানা ছবিতে দেখা ফরাসী প্রোস্টিউশনগুলোর ফ্ল্যাশ-ছবি পার হয়ে যাচ্ছে ক্রমাগত। সিসা লাউঞ্জে বসে মুহূর্তে যে শিহরণটা শিরদাঁড়া বেয়ে নেমে গিয়েছিল সেটা স্থির হয়ে আছে দেহে। এ অবস্থায় সে ভুল বাড়িতে গিয়ে উঠতে পারে ভেবে শাদা বাড়িটার অবস্থান আবারও মিলিয়ে নিলো। দেখল যে পিওর ড্রিংকিং ওয়াটারের বড় বিলবোর্ডটার পাশেই বাড়িটা আর ছাদের উপর কবুতরের মাচান। সামান্য পথটুকু হাঁটতে গিয়ে ঘাম ছুটে গেল মঞ্জুর, আর নাজনীন কত স্বাভাবিক! সে যদি জানতো কোথায় তারা যাচ্ছে, কী ভাবতো সে এখন?

মঞ্জুর মনে এই বাড়ির অভ্যন্তরের যে কাল্পনিক ছবিগুলো ছিল, ভেতরটা মোটেও সে রকম নয়। ফরাসী ছবির প্রোস্টিটিউশনগুলোর মতোও নয় এটা। বাড়িটার ভেতরে ঢুকে মঞ্জু বুঝতে পারল তার বুক কাঁপছে, কৌতহলী চোখে সে দেখছিল চারদিকে। বুঝে উঠতে চেষ্টা করছিল কখন কী করতে হবে। কল্পনার কোনো ফ্রেমের সঙ্গে না মেলায় পরিস্থিতি অনুযায়ী তাকে সিদ্ধান্তগুলো নিতে হবে, এটা সে নিজেকেই বোঝালো মনে মনে। নাজনীন চারদিক দেখতে দেখতে বলল, “আমরা তো একটা হোটেলে এসে পড়ছি মনে হচ্ছে। রেস্টুরেন্টটা কি ছাদে?” মঞ্জু কিছু না বলে উপরের দিকে উঠতে থাকল যেন ছাদের দিকেই সে যাচ্ছে। কয়েকটা লোক তাদেরকে পার হয়ে নেমে গেল নিচে। তারা এমন ভঙ্গিতে নাজনীনের দিকে তাকাচ্ছিল যে, মঞ্জু ভেতরে ভেতরে মরমে মরে গেল। নাজনীনের চোখে এর কিছুই ধরা পড়ল না হয়তো। দুটো মেয়েও নিচে নেমে গেল। তাদের চাহনি পড়তে পারল মঞ্জু। পিন্টু দা’র কথা তার মনে পড়ল। সিসা লাউঞ্জে বসে তিনি বলেছিলেন, এখানকার ভাষায় কোনো দ্ব্যর্থকতা নেই। মেয়ে দুটোর চোখের ভাষাকে মনে মনে সে যখন বাক্যে রূপান্তর করছিল তখনই নির্লিপ্ত চোখের এক তরুণ নেমে এলো মেয়ে দুটোর পেছন পেছন। সে মঞ্জুর চোখের ভাষা পড়ে বুঝল এবং তাকে অনুসরণ করতে বলল। কয়েকটা সিঁড়ি এবং একটা দুটো করিডোর পার হয়ে সেই তরুণ ওদের দুজনকে একটা কক্ষ দেখিয়ে দিয়ে বলে গেল ফেরার সময় যেন ২০১ নম্বর ক্যাশে দেখা করে যায়। নির্লিপ্ত চোখের তরুণ অদৃশ্য হয়ে গেলে কক্ষটাতে ঢুকল দুজন। তারা দেখতে পেল ভেতরটা হোটেল-কক্ষের মতো করেই সাজানো। নিভাঁজ বিছানায় দুটো বালিশ, একটা আলনা, চেয়ার সমেত একটা টেবিল, একদিকের দেয়ালের শেষে বাথরুমের দরজা। তবে ঘরটার সাথে কোনো বারান্দা নেই। এরই মধ্যে নাজনীনের উচ্ছাস কৌতহলে বদলে গেছে। সে যা যা বুঝেছে তার কিছুই মঞ্জুকে বুঝতে না দিয়ে বলল, “এটা তো একটা রাতে থাকার হোটেল।” সে বিছানায় বসতে বসতে বলল, “আমরা আইচ টি খাব নাকি কফি?”

“কেউ তো নাই, কাকে যে বলি আনতে!”

“তুমি তো নিরিবিলি জায়গাই খুঁজতেছিলা, তাই না?” নাজনীন হাসল।

“হ্যাঁ। একদম নিরিবিলি!” দরজার ছিটকিনি বন্ধ করতে করতে বলল মঞ্জু।

নাজনীন বিছানা থেকে উঠে ঘরটার চারদিকে তাকাল। ড্রেসিং টেবিলটার সামনে দাঁড়িয়ে আপদমস্তক দেখল নিজেকে। ওড়নাটা খুলে রাখল চেয়ারে এবং কি ভেবে বাথরুমের দরজা খুলে উঁকি দিয়ে দেখল ভেতরে। তারপর আবারও এসে বসল বিছানায়। যে বালিশ দুটো সেখানে রাখা তার একটা খানিকটা সরিয়ে নিয়ে গা এলিয়ে দিয়ে মাথা রাখল তাতে। মঞ্জু ড্রয়ারগুলো কৌতহল বশত খুলে দেখতে গিয়ে তাতে কনডমের প্যাকেট খুঁজে পেল একটা। থেমে গেল নাজনীনকে সেটা বলতে গিয়ে। এই ঘরে ঢোকার পর থেকেই তার অভিব্যক্তির দিকে খেয়াল রাখছিল মঞ্জু, সে দেখেছে নাজনীনের ভেতরের উচ্ছাসটা কৌতহলে বদলে গিয়ে এখন সেখানে জমাট বাঁধা একটা ভাবনার ছায়া, যে ভাবনাটাকে সে পড়তে পারছে না। এই দুর্বোধ্য অভিব্যক্তির কারণে সে খানিকটা ঘাবড়ে গেল। পিন্টুদার কথা তার আবারও মনে পড়ল। তিনি বলেছিলেন, “মনের পেছনে ছুটলে তুমি সমুদ্রের ভেতর হাবুডুবু খাবা।” নাজনীন যেন নিজের ভেতর গুটিয়ে গেছে হঠাৎ। এমন হতে পারে যে, সে কুণ্ঠিত বোধ করছে। মঞ্জুর মনে পড়ল, দাদির পাহারা এড়িয়ে আগেও দু’একবার নাজনীনের নগ্নতা সে দেখেছে, তখন এমন একটা উৎকণ্ঠা আর উত্তেজনা ছিল যে তার অভিব্যক্তি বুঝতে চেষ্টা করার কোনো সময় ছিল না। কিন্তু আজকে তার মন বুঝতে গিয়ে সত্যিই সাগরে পড়ল মঞ্জু। সে জিগ্যেস করল, “কী হয়েছে, নাজ?” সে উল্টো দিকে পাশ ফিরতে ফিরতে বলল, “এরকম একটা জায়গার কথা আমি ভাবতে পারি না।”

“কী ভাবতে পারো না?”

“এরকম কোনো জায়গা আমি চাই না। আমি ভাবি জায়গাটা হবে অন্য রকম। আমাদের বিশ্বাসের মতো, খুব স্বাচ্ছন্দ আর উজ্জ্বল। এ রকম মোটেও না।”

মঞ্জু দুর্বোধ্য একটা দেয়ালের সামনে বসে থাকে। কী করবে বুঝতে পারে না। সে যখন নাজনীনের পাশের বালিশে শুয়ে পড়ে তার মনে হয় গভীর একটা সমুদ্রের পাশে শুয়েছে। নাজনীনের একটা হাত ধরে সে সেই সমুদ্রের স্বর শুনতে চেষ্টা করে। বুঝতে চেষ্টা করে দুর্বোধ্য সংকেতগুলো এবং খেয়াল করে উত্তাল ঢেউগুলো দূর থেকে তার দিকে এগিয়ে আসছে ক্রমশ।

২০১ নম্বর ক্যাশে যাবার কথা মনে ছিল মঞ্জুর। সেখানে গিয়ে সবদিক বুঝে ওঠার আগেই পরিস্থিতি খানিকটা বিপজ্জনক দিকে ঝুঁকে গেল। বাড়ির নিয়মগুলো সহজ হলেও মঞ্জুর বাস্তব কোনো অভিজ্ঞতাই ছিল না। ঘরটাতে নির্র্লিপ্ত চোখের সেই তরুণ ছাড়াও আরও দুজন লোক ছিল। তাদেরই একজন টেন পার্সেন্ট কথাটা উচ্চারণ করে আর অন্যজন নাজনীনের দিকে ইঙ্গিত করে তার নাম আর ফোন নম্বর রেখে যেতে বলে, যেমনটা তারা নতুন সব মেয়ের ক্ষেত্রেই করে। চোখের ইশারায় মঞ্জু নিষেধ করেছিল লোকটাকে। কিন্তু ততক্ষণে তার গলা শুকিয়ে এসেছে আর চেহারা ফ্যাকাশে হতে শুরু করেছে। সে স্পষ্ট দেখল, নাজনীনের অভিব্যক্তিতে কৌতহলের ছায়াটা কালো মেঘে ঢেকে গেছে।


দেখতে থাকা চোখ

আষাঢ়ের আকাশে মেঘ জমেছে অনেক কিন্তু বৃষ্টির দেখা নেই। ক্যাম্পাসের পদ্মপাতা ভরা লেকের ধারে একটা কালভার্টের উইং-এ স্তব্ধ হয়ে বসে আছে দুজন আর মঞ্জুর মনে পড়ছে এক বর্ষার দিনে তারা দীর্ঘক্ষণ বৃষ্টিতে ভিজেছিল। মঞ্জুর মনের ভাবনাগুলো নানা গলি-ঘুঁপচিতে ঘুরে বেড়াতে থাকলেও বাইরে বেরুবার কোনো পথ পেল না। অনেকটা সময় গড়িয়ে গেল তবু একটা বাক্যও গজিয়ে উঠল না তার মুখে। নাজনীনও বাকরুদ্ধ হয়ে বসে আছে। কোনো কথাই সে বলছে না। আগের দিন ওই বাড়িটা থেকে ফেরার পর থেকে সে আর কথা বলেনি মঞ্জুর সঙ্গে। নিজের মধ্যে একেবারে শামুকের মতো গুটিয়ে গেছে। রাতে যে ঘুমায়নি তা তার বিধ্বস্ত চেহারা আর চোখের নিচে ছায়া-পড়া দেখেই বোঝা যাচ্ছে। হয়তো তারপর থেকে এখন অব্দি খায়ওনি কিছু। রাতে সে ফোন ধরছিল না। সকালবেলায়ও না। তখন ওদের বাসায় গিয়ে মঞ্জু শুনল, সে ক্যাম্পাসে চলে গেছে। তখনই সেও চলে এলো ক্যাম্পাসে। হল গেটে দাঁড়িয়ে মেসেজ পাঠাল, “আমি তোমার হলের গেটে অপেক্ষা করছি।” নাজনীন হল থেকে বেরুবার পর হাঁটতে হাঁটতে তারা এই লেকের পাড়ে কালভার্টের উপর এসে বসেছে। কিন্তু তখনও পর্যন্ত তাদের মধ্যে কোনো কথা হয়নি। স্তব্ধ হয়ে বসে আছে দুজন। নানা ভাবনার খেয়া বাইতে বাইতে অবশেষে মঞ্জু ঘাটে এসে পৌঁছাল একটি মাত্র বাক্য নিয়ে, “কী হয়েছে, বলবা না?” নাজনীন আরও কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে বসে থেকে শেষে অশ্র ভেজা চোখে তাকে প্রশ্নটা করল, “আমার কত দাম ধরে পার্সেন্টেজ দিছিলা কাল?” নাজনীনের চোখের দিকে তাকাতে পারল না মঞ্জু। দৃষ্টিটাকে সরিয়ে নিলো অন্যত্র। তখন লেকের পানিতে একটা ডাহুক পদ্মপাতার ভেতর থেকে মাথা ঘুরিয়ে তাকাল নাজনীনের দিকে। জঙ্গলের ভেতর থেকে বেরিয়ে লেকের পাড় ধরে যেতে যেতে ফিরে তাকাল একটা গুইসাপ। জলের দিকে ঝুঁকে থাকা বনকাঁঠালের গাছটা যেন কত সচেতন, ছায়াচ্ছন্ন চোখে তাকিয়ে আছে নাজনীনের দিকে। জলের ধারে জন্মানো মানকচুর তরুণ সবুজ পাতা যেন সবুজ চোখে দেখছে নাজনীনকে। সবাই যেন অপেক্ষা করছে কখন নাজনীনের চোখ থেকে গড়িয়ে পড়বে এক ফোটা অশ্রু।



লেখক পরিচিতি
রায়হান রাইন

জন্ম: ১৯৭১ সালের ৮ মার্চ, সিরাজগঞ্জ।
অধ্যয়ন: বি এল সরকারী উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি, রাজশাহী সরকারী কলেজ থেকে এইচএসসি। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর, দর্শন বিষয়ে।
পেশা: শিক্ষকতা, সহযোগী অধ্যাপক, দর্শন বিভাগ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।

প্রকাশিত গ্রন্থগ্রন্থ: আকাশের কৃপাপ্রার্থী তরু, পাতানো মায়ের পাহাড়, স্বপ্নের আমি ও অন্যরা, কবিতা: তুমি ও সবুজ ঘোড়া।
উপন্যাস: আগুন ও ছায়া।
সম্পাদনা: বাংলার ধর্ম ও দর্শন। অনুবাদ: মনসুর আল-হাল্লাজের কিতাব আল-তাওয়াসিন, পাবলো নেরুদার প্রশ্নপুস্তক।

আগুন ও ছায়া উপন্যাসটি প্রথম আলো বর্ষসেরা বই-১৪২০ পুরস্কার লাভ করে।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ