ঢোল সমুদ্র

সাধন চট্টোপাধ্যায়

দামোদর পেরিয়ে দলটা বাঁকুড়ায় ঢুকল। চৈত্রের মাঝামাঝি, ক্ষীণস্রোতা তটিনীর বিশাল বালুকাবক্ষে পায়ের ছাপ ফেলে ফেলে উঁচু মাটির ঢিপিতে উঠতেই সর্দার একটু থমকে দাঁড়ায়। সামনে ধূ ধূ রুক্ষ মাঠ। ঢেউ-খেলা। ইতস্তত কয়েকটা বাজ-পোড়া তালগাছ। ঝাঁ ঝাঁ রোদ্দুরে চতুর্দিক ঝিমঝিম।

    সর্দার কি যেন ঠাহর করছে। লালচে চোখজোড়া চতুষ্পার্শ্ব নিরীক্ষণ করে নিল। শেষে মৃদু মাথা দুলিয়ে বলল, 'নাঃ, আর একটু পা চালাতে হবে গুণিন... ... ... এ মাঠটা পেরিয়ে গেলে মনে হয় জায়গা মিলবে।' গুণিন কিছু ভেবে জবাব দেবার আগেই সর্দার পা বাড়াল। পিছনে তাকিয়ে একটু তাড়া দিয়ে বলল, 'চটপট পা চালাও সব... ... ক্রোশটাক পথ সেরে ফেলি।'
    ঝোলাঝুলি কাঁধে নিঃশব্দে দল এগোল। কেবল কয়েকজনের মুখে মৃদু লয়ে শিস আর রহস্যময় হু.ড.ড. হু.ড.ড আওয়াজ।
    দলের অনেকেই হাঁটতে পারছে না। সারাদিন পা চালিয়ে ক্লান্ত। মস্ত বাঁকটা কাঁধে প্রহ্লাদ রাগে সরদারের পিছন দিকটায় তাকায়। ধুলোয় ভরা মস্ত একমাথা চুল। মোটা গর্দান। সামনে একটু ঝুঁকে থপ থপ করে এগিয়ে চলেছে।
    'আর কত দূর সর্দার?' প্রহ্লাদের গলাটা রুক্ষ। সর্দার নিঃশব্দে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল। উত্তর করল না। প্রহ্লাদের ফৌজি-মেজাজটা একটু গরম হয়ে ওঠে।
    দল এগিয়ে চলেছে। চারদিক স্তব্ধ, কেবল হিস হিস হু.ড.ড. হু.ড.ড আওয়াজ। জনা ছয়েকের মতো লোকের কাঁধে বাঁক, মাথায় মস্ত টোকা--সঙ্গে খস খস আওয়াজ করে চলেছে পাঁশুটে এক টুকরো মেঘের মতো একপাল শুয়োর।
    দলটা উত্তরের জেলা থেকে নেমে আসছে। সাঁওতাল পরগণার পথ বেয়ে বীরভূম। কত মাঠ-ঘাট, গ্রাম-গ্রামান্ত পাড়ি দিয়ে বর্ধমান ছাড়িয়ে ধুকেছে দামোদর পেরিয়ে বাঁকুড়ার লাল মাটিতে। রুক্ষ কঠিন মাটি। এমনিভাবে ঘুরে ঘুরে হুগলীর ভিতর হয়ে গঙ্গা পেরিয়ে দল চলে যাবে নিজেদের আস্তানায়। আষাঢ়ে গৃহত্যাগী হয়ে চৈত্রের শেষে ফিরে যায়। কত দেশদেশান্তর যে পাড়ি দিতে হয়!
    ক্রমে ক্রমে মাঠটা শেষ হয়ে গেল। অসংখ্য চড়াই-উতরাই। একটা প্রশস্ত ঢালু জমিতে নেমে সর্দার আবার থমকে দাঁড়াল। চতুর্দিক চোখ বুলিয়ে গুণিনকে বলল, 'ঠিক জায়গা বটে। দেখত, ওদিকের নয়ানজুলিতে জল-টল আছে কিনা।' একটা ঢ্যাঙা মতো লোক এগিয়ে যায়।
    যে যার কাঁধের বোঝা, টোকা মাটিতে রেখে ধপ করে বসে পড়ল। প্রহ্লাদের সমস্ত মাংসপেশির মধ্যে যন্ত্রণা। কাঁধ থেকে বাঁকটা নামিয়ে সে সটান শুয়ে পড়ল।
    বড়পাল বলল, 'ভুঁইয়ে গড়িয়ে পড়লে যে? ... ... ... মাল পত্তর বার করো।'
    'করে নাও ... ... ... পাইরছি না।'
    বড়পাল মৃদু হেসে বাঁকের মধ্য থেকে খন্তা, তোবড়ান হাঁড়ি, থালা, চার পাঁচটে শিশি কৌটো বার করতে করতে বলল, 'উনুনটা খোঁড়ো ... ... ... টোকাগুলো পুঁতে নাও।'
    সর্দার একটা বিড়ি ধরাল। চোখজোড়া আধ-বোজা অবস্থায় মোলায়েম গলায় হুকুম করতে লাগল। নইলে যত দেরি হবে, দলটা ততই পড়বে এলিয়ে।
         গুণিন গর্ত খুঁড়তে লাগল; বড়পাল, যাদব এবং সোমরাকে নিয়ে সর্দার চলে গেল লোকালয়ে সওদা করতে। চাল, ডাল, আলু, তেল, নুন। প্রহ্লাদ পড়ে রইল। সর্দার একবার আড়চোখে তাকাল প্রহ্লাদের দিকে, শেষে ছায়ার মতো চারটে মানুষ শিশি, থলি নিয়ে অন্ধকারে মিলিয়ে গেল।
    উনুন খুঁড়তে খুঁড়তে গুণিন বলল, 'ওঠ দেখি একটু। জলটা আনত।' প্রহ্লাদ প্রতিবাদ করল না এবার। ভুষো-কালি পড়া, টিম-টিমে হ্যারিকেনটা দুলিয়ে ভাঙা কলস হাতে চলল জলের সন্ধানে।
    সেই পাঁশুটে মেঘের দলটা টুকরো টুকরো ছিন্ন বিচ্ছিন্ন হয়ে ততক্ষণে মাটি চালতে চালতে পুকুরের দিকে নানান মূলের সন্ধানে চলে গেছে। প্রহ্লাদ একবার ডাকবার চেষ্টা করল হু.ড.ড. হু.ড.ড কিন্তু শব্দটা খুব ভাল রপ্ত হয়নি। গুণিন গলা দিয়ে শিসের মতো অদ্ভুত আওয়াজ বের করতেই দলটা ঘোঁত ঘোঁত করে উনুনের খানিকটা দূরে ঘেঁষাঘেঁষি শুয়ে পড়ল।
    হাওয়া রহস্যময় আওয়াজ তোলে। একটু বাদেই দেখা গেল আগুনের জিহ্বা। চতুষ্পার্শ্বে ঘন অন্ধকারেরব মধ্যে লিকলিক করছে। প্রহ্লাদ ফিরে দূরে বসে সেদিকে তাকিয়েছিল। ভাবছিল সর্দারের সঙ্গে বীরভূমে অমনভাবে ঝগড়া করা উচিত হয়নি। কিন্তু দাপা-খ্যাপা মেজাজটা নিয়ে করবে কি সে? অমন পাঁশুটে আকাশ, আর রোদ্দুর দেখেই প্রহ্লাদ বুঝেছিল চোত মাস। বাড়ির টানে মনটা তার আনচান করছে। সর্দারকে বলেছিল, 'আর নয় গো সরদার! হুগলীর পথে নেমে পড়ি। বাড়ি যেতে যেতে চোত মাস কাবার হয়ে যাবে।' সর্দার গম্ভীর হয়ে জবাব দিয়েছিল, 'বন্যাডা কেমন দেখলা?... ... কত জানোয়ার মারা পড়ল! ব্যবসা লাটে উঠবে... ... বাঁকুড়ার মাটিতে জানোয়ারগুলো একটু চরুক।'
    'যেতে তালে জষ্টিমাস?... ... ... ও বছর না হয় ভাল করে চরিও।'
    'বেশি কথা কওনাত প্রহ্লাদ, ছোকরা বয়সে অমন ঘরটানের কি আছে?'
    'বেশ, তুমি থাকেন! দামোদর পার হব না আমরা'--প্রহ্লাদ কথাটা মুখে আনতেই সর্দারের চোখজোড়া কেমন নিথর হয়ে গেল। নাকের পেটিজোড়া ঈষৎ ফুলিয়ে হেসে উঠল, 'বেশি বাড় ভাল নয় প্রহ্লাদ।' গুণিন মাঝখানে পড়ে উভয়কে থামিয়ে দেওয়ায় ব্যাপারটা আর গড়াল না।
    বড়পাল, যাদব, সোমরা ফিরে এসেছে। সর্দার আসবে পরে। জিনিসপত্তর ওদের দিয়ে পাঠিয়ে দিয়েছে। সুতরাং মস্ত এক হাঁড়িতে ভাত চাপান হল। গুণিন উনুনে কাঠ ঠেলতে ঠেলতে প্রহ্লাদকে বলল, হোমনে কিচু ডাল-পাতা আছে... ...কুড়িয়ে বাড়িয়ে আনত, যা হাওয়া।' উঠে গিয়ে বুকে পেঁচিয়ে আনলে, গুণিন আগুনে গুঁজতে লাগল।
    এ তিনজন ঝিমুচ্ছে। গুণিন আড়-চোখে তাকিয়ে ডাক দেয়, 'ও বড়পাল?'
    'উ--'
    'বলি, ঘুমুয়ে পড়লা যে?'
    'বড্ড কেলান্ত।'
    'ভাতটা হলি ডাল চাপাব।'
    বড়পাল উত্তর করে না। গুণিন একটা কাঠ গুঁজে আবার আড়চোখে তাকাল।
    'বড়পাল, এডা কোন দেশ?'
    'পশ্চিমে।'
    'লোকজন কেমন দেখলা?'
    উত্তর দেবার আগেই একটা ছাইরঙা শুয়োরের বাচ্চাকে একটা কালোধাড়ি মুখ দিয়ে চেপে ধরতেই চিঁ চিঁ চিৎকার শুরু হয়ে যায়। গুণিন ছুটে গিয়ে থামিয়ে দেয়। নইলে বেচারাকে হয়ত মেরেই ফেলবে।
    খানিকবাদেই টিনের থালাগুলো ধুয়ে ওরা খেতে বসার আয়োজন করতে লাগল। ডাল, ভাত আর থালায় মস্ত একতাল আলুভাতে। যে যার ছোট ছোট দলায় খাবলে নিচ্ছে। ঠিক এই সময় নিঃশব্দে সর্দার এসে হাজির। একটা ঢেঁকুর তুলে বলল, 'খেয়ে নাও তোমরা... ... আমি খাব না।'
    গুণিন বলল, 'চাড্ডি খানিক খাও।'
    'না'--বলেই সর্দার উনুনের ওপাশটায় অন্ধকারে বসে বিড়ি টানতে লাগল।
    খেয়েদেয়ে একটু বাদেই যে যার গড়িয়ে পড়ে। প্রহ্লাদের কোন হুঁশ নেই। টোকার তলায় কাঁথাটা মেলেই পা জোড়া টানটান করে দিল। শুকনো ঘাসের ডগাগুলো ফুটছে শরীরে। একটু বাদেই চোখের পাতাজোড়ায় রাজ্যের ঘুম নেমে এল।
    যখন হঠাৎ জেগে উঠল, কত রাত বোঝা যাচ্ছে না। ঘন অন্ধকার, হু হু বাতাসের শব্দ আর উজ্জ্বল এক ঝাঁক তারা। পাশের টোকাগুলো থেকে শোনা যাচ্ছে ঘুমের মধ্যে বোবা যন্ত্রণার গোঙানি। প্রহ্লাদের মন মুহূর্তের জন্য ছমছমিয়ে উঠল। আস্তে ঘাড়টা তুলল। পাঁশুটে মেঘের দলটা গোল হয়ে শুয়ে পরস্পরের ঠেলাঠেলি আর ঘোঁত ঘোঁত আওয়াজ করছিল।
    উঠে বসল প্রহ্লাদ। একটু এধার ওধার তাকিয়ে অবাক হয়ে যায়। দুজন জেগে আছে। হাঁটু গেড়ে গুণিন বিড়বিড় করে মন্ত্র আওড়াচ্ছে আর হসহাস শূন্যে কি যেন তাড়াচ্ছে। এপাশে বসে সর্দার। অন্ধকারে শুধু মুখের আকারটা বোঝা যাচ্ছে তার, কিন্তু কর্কশ রূপ দেখা যাচ্ছে না। বিড়ির আগুনে অনুমান হয় চোখজোড়া ঘোলাটে লাল। তাকিয়ে আছে প্রহ্লাদের দিকে।
    'গুণিন... ...গুণিন', দুবার ডেকেও কোন সাড়া পাওয়া গেল না। সর্দার মোলায়েম গলায় বলল, 'জেগে উঠলে হে প্রহ্লাদ?'
    'পা-টা টান ধরেছে সর্দার। ঘুমটা ছুটে গেল।' 
    সর্দারকে প্রহ্লাদের এই মুহূর্তে ভয় করছে। ওর ভেতর চাপা আগুন যেন।
    হাতের একটা ছায়া এগিয়ে এল প্রহ্লাদের সামনে।
    'ধরো বিড়ির টান দাও'--সর্দারের গলা।
    প্রহ্লাদ খানিক আশ্বস্ত হয়ে বিড়ি টানতে থাকে। গুণিনের কোন ভ্রূক্ষেপ নেই। একইভাবে বিড়বিড় করে যাচ্ছে।
    সর্দারই আগাম বলল, 'গুণিন। জড়ি-বুটি, মন্ত্রতন্ত্রের কাজ চলছে... ...এলাকাটা ভাল নয়।'
    প্রহ্লাদ ভুতুরে তালগাছগুলোর দিকে তাকিয়ে বলল, 'শরীরটা ভারি ভারি লাগছে।' 
    সর্দার খানিক ভেবে বলে উঠল, 'ঢোল সমুদ্দুরের তাবিজটা আছে ত কোমরে?'
    প্রহ্লাদ কোমরটা হাতিয়ে ছোট্ট বস্তুটার অস্তিত্ব অনুভব করে নিল। এতক্ষণ তার কোন খেয়াল ছিল না। এবার শরীর হাল্কা হয়ে গেল। কী এক শক্তি ভর করল দেহে।
    সেই গত আষাঢ়ে পথে বেরোবার কালে মালিক যুগল দাস এটি বেঁধে দিয়েছিল। সর্দার, গুণিন সবাই ছিল পাশে। নদীর ধারে যে ঢোল সমুদ্রের পাতা পাওয়া যায়, তারই তাবিজ কোমরে থাকলে নাকি মানুষ সর্বশক্তিমান। যুগল দাস হাতে তুলে দিয়ে বলেছিল, 'এটা তোর সম্পত্তি, আমার জিনিস হল শুয়োরের পাল। ফিরে এলে আমি আমার সম্পত্তি যাচাই করে নেব আর তোর সম্পত্তির হিসেব পথেঘাটেই তুই টের পাবি।' সর্দার বলেছিল, 'এবার তুমি শক্ত-সমত্থ পুরুষ... ...পথে চোর দাকাত, দুষ্ট প্রকৃতি তোমার দেহ স্পর্শ করতে পারবে না।' গুণিন তার লম্বা জুলফি, গোল গোল চোখজোড়া মেলে সায় দিয়েছিল।
    তারপর পথের মানুষ প্রহ্লাদ পথেই প্রমাণ পেয়েছে সে সর্ব-শক্তিমান। কত আওড়-বাওড়, মাঠ- ঘাট, লোকালয় পেরিয়ে গেছে, কত চোর ছ্যাঁচোড় লেগেছে, বাউণ্ডুলে ভবঘুরে দেখেছে, কত কামিনী; ডাইনি-ডাকিনীর দেশ--শীত, গ্রীষ্ম, বর্ষ, এই কালো কুচকুচে শরীরটার উপর দিয়ে বয়ে গেছে। কিছুই হয়নি দলটার। সেবার বীরভূমের এক মাঠে কয়েকটা শুয়োর চোরকে কী মার! দলটা টের পায় কার কোন মতলব। সর্দার মাঝে মাঝেই বলে, 'ঢোল সমুদ্দুরের তাবিজটা আছে'তো!'
    আজও, এই মুহূর্তে কোমরটা হাতড়ে প্রহ্লাদ স্বস্তিতে বিড়ি টানতে লাগল। ভাবল কয়েকবছর আগে এই ঢোল সমুদ্রের তাবিজ কাছে পেলে ফৌজের চাকরিটা যেত না। ঘরে ফিরেও কি দাদার অমন চাবুক খেতে হত? ঘরের কথা মনে আসতেই চিন্তা ফিকে হয়ে যায়। হৃদয় কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগে। হঠাৎ সর্দারকে জিজ্ঞেস করে বসল, 'চোত মাসের শেষ কবে সর্দার?' সর্দার গম্ভীর গলায় বলে উঠল, 'শুয়ে পড়... ... রাত ভোর হতে চলল।'
    সকালে উঠে দল আবার কাজে বেরিয়ে পড়ে। এটাকে তাড়িয়ে, ওটাকে সরিয়ে হুডড আওয়াজ করতে করতে মস্ত মাঠটায় ঘুরে বেড়াতে লাগল। প্রহ্লাদের মাথায় মস্ত টোকা, হাতে লাঠি। ঘুরতে ঘুরতে অবাক চোখে এ দেশটার লোকজনের দিকে নজর করতে থাকে।
    এই নিয়ে দু বছর হল সে দলে বেরোচ্ছে। অল্প বয়সে ফৌজে যোগ দেয়। বুড়ো বাপ অন্ধ হয়ে যাওয়ায় দাদা বলেছিল, 'এবার কাজ খোঁজ... ... গরীবের ঘরে কেউ বসে খায় না।' প্রহ্লাদ বরাবরের অভিমানী ও স্বাধীনচেতা। পাড়ার অনেকের কাছেই প্রিয়।
    'লেখা পড়া হবে না তালি?'
    ওঘর থেকে বুড়ো বাপ জবাব দিয়েছিল, 'না, না, গরীবের আবার বিদ্যের দরকারডা কি শুনি?' প্রহ্লাদের ঠোঁটজোড়া কী জবাব দিতে থরথর কেঁপে উঠেছিল।
    তারপর বাড়ি থেকে বেরিয়ে ফৌজের চাকরি। কিন্তু প্রহ্লাদের স্বাধীন মেজাজে তাও টিকল না। পালিয়ে এল। রাগে দাদা চাবুক দিয়ে পিটল। প্রহ্লাদ কাঁদল না এক ফোঁটা। কাজের ধান্ধায় ঘুরতে লাগল। অবশেষে যুগল দাসের কাছে এক মাস কাজ শিখে নেমে পড়েছে দশবছরের দাদনে। মাসোহারা পঞ্চাশ টাকা অন্ধ বাপের কাছে যুগল দাস পাঠিয়ে দেয়।
    ঘুরতে ঘুরতে প্রহ্লাদ এক সময় একটা পুকুরের কাছে ছায়ায় দাঁড়াল। জল পান করতে গিয়ে সে অবাক হয়ে যায়। লজ্জাও পায় খানিক। প্রতিটি মানুষ--কি ব্যাটাছেলে কি মেয়েছেলে উলঙ্গ জলে নামছে। পুরুষদের হাতপাগুলো কাঠি, পেট উঁচু। মেয়েরা মোটামুটি স্বাস্থ্যবতী। প্রহ্লাদ দৃশ্য দেখে দূরে সরে যায়। দেশের মাটিতে মা, দিদিমার কাছে গল্প শুনেছিল এই পৃথিবীতে কোথায় যেন ন্যাংটা দেশ আছে। মানুষ সেখানে উলঙ্গভাবে চলাফেরা করে। এই কি তবে সেই স্থান? কথাটা না জিজ্ঞেস করা পর্যন্ত তার কৌতূহল নিবৃত্ত হচ্ছিল না। শেষকালে এক বৃদ্ধা তার একমাত্র সম্বল কাপড়খানি ছেড়ে স্নান সেরে উঠে যাবার কালে, প্রহ্লাদ কাঁচুমাচু হয়ে জিজ্ঞেস করে, 'মা, একটা কথা জিজ্ঞেস করব?'
    'বলো--'
    'আপনারা সবাই বস্ত্র খুলে স্নান করেন দেখলাম-- কারণটা কী?'
    বৃদ্ধা তার দীন হীন মলিন মুখে ম্লান হাসি টেনে বেদনাটুকু ঢেকে বলল, 'আমরা সব যে গোপিনী বাবা... কালা চোরা যে আমাদের বস্ত্র হরণ করেছিল।'
    প্রহ্লাদ অবাক হয়ে শোনে। আর কিছু জিজ্ঞেস করার সাহস হয় না। এলাকার অসাধারণ দারিদ্র্যের ব্যাপারটা বুঝতে পারে। গ্রামের লোকেরা প্রহ্লাদের চেহারাটাকে কালাচোরা আখ্যা দিয়েছিল। কিসের ভাবনায় মনটা তার নিবিড় হয়ে যায়।
    সন্ধ্যার আগেই লোকগুলো পাঁশুটে মেঘের দলটাকে তাড়াতে তাড়াতে আস্তানায় ফিরে এল। সর্দার গেছে লোকালয়ে। বড় পাল, সোমরা এবং যাদব হাতমুখ ধুয়ে আবার শিশি, থলি ঝুলিয়ে চলল বাজারের দিকে। বসেছিল গুণিন আর প্রহ্লাদ। ওরা ফিরে এসে উনুনে আগুন দেবে।
    লালচে, ছাইরঙা, কালো-- নানা রঙের প্রাণীগুলো নিজেদের মধ্যে হুটোপুটি করছে। কচি কচি বাচ্চারা ধাড়িদের ঠ্যাঙের ভেতর মাথা গলিয়েছে। ঝাপটাঝাপটি, কোঁয়ৎ কোঁয়ৎ আওয়াজ। গুণিন চারিদিকে ঘুরে ঘুরে মৃদু লয়ে শিস দিতে থাকলে জানোয়ারগুলো ধীরে ধীরে ছুঁচলো মুখটা এগিয়ে মাটিতে শুয়ে পড়ে।
    প্রহ্লাদ দেখে বিশাল প্রান্তরটাকে। রুক্ষ, অসীম। একটা অব্যক্ত যন্ত্রণা বুকের মধ্যে গুমরে গুমরে ওঠে।
    হঠা ৎ দূর থেকে জনাচারেক মেয়েকে আসতে দেখা গেল। শ্লথগতি, লাস্যময়ী, পরস্পর গা ঠেলাঠেলি করে কিসের সব রসের কথা বলছে। প্রহ্লাদ হাঁ করে তাকিয়ে থাকে। গুণিনের কোনোদিকে ভ্রূক্ষেপ নেই, রান্নার আয়োজনে ব্যস্ত।
    'কি করছিস, ভিনদেশের মানুষরা সব?'
    একটা বাচ্চা শুয়োর তিরতির করে মাঠের মধ্য দিয়ে ছুটল। গুণিন লাঠি হাতে এগিয়ে যায়। কালো কুচকুচে শরীরের এক ঝাঁক ফুল যেন মেয়েগুলো।
    'তোমাদের চিনতে পারলাম না ত?' প্রহ্লাদ হাসে।
    একজন আর একজনকে ঠেলা দিয়ে বলল, শোন লো মতি, কোন দেশের পুরুষ সব?'
    মতির পিটোন স্বাস্থ্য, পাটি করে চুল আঁচড়ান, ঈষৎ ভুরুটা কাঁপিয়ে বলল, 'তুই চুপ করত।'
    গুণিন এদের আগমনে খুশি হলো না। কলস হাতে জল আনতে গেল।
    প্রহ্লাদ ওদের বসতে দিল। মতি মৃদু হেসে বলল, তোরা কেমন দল সব, গান গাইতে লারিস?' একজন মতিকে ঠেলা দিয়ে চাপা হাসিতে ফিসফিসিয়ে বলল, 'কালা কেষ্ট বাঁশি জানে কিনা জিজ্ঞেস করত?' এতগুলো হাসির মাঝে প্রহ্লাদ কেমন অস্বস্তি বোধ করে। হেসে বলল, 'তোমাদের নিবাস?'
    মতি বলে, 'হোথায় গো? ঐ মাঠটা পেরিয়ে।'
    এই মাঠটা পেরিয়ে, সর্দার যেখানে সওদা করতে যায়, সেখানে এদের বাস। জনাদশেক স্বৈরিণীর ঘর। অনেকের পড়ন্ত যৌবন। তা ছাড়া এ তো বলতে গেলে পুরুষবিহীন দেশ। অভাবে, রোগে সব পৌরুষ হারিয়ে রোগা, টিংটিঙে হয়ে উঠেছে। স্বৈরিণীদের তাই অভিসারে নামতে হয়। কোনোদিন পেট চলে, কোনোদিন চলে না।
    প্রতিবার শুয়োর চড়াবার দল হাজির হলে এরা আসে।
    প্রহ্লাদ মতির মুখের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে ছিল। 'কি দেখছ গো অমন করে?' প্রহ্লাদ বোকার মতো আকর্ণবিস্তৃত হাসি দিয়ে বলল, না। এমনি। মেয়েদের মুখগুলো থমথমে হয়ে ওঠে।
    খানিক পরে সর্দার ফিরে আসে। স্বৈরিণীদের দেখেই মেজাজটা গরম হয়ে যায়। মোটা গলায় বলল, এখানে আসবেন না আপনারা। গুণিনের দিকে তাকিয়ে বলে উঠল, এসব হচ্ছে কি গুণিন? গুণিন প্রহ্লাদের দিকে কটমট করে তাকায়।
    মেয়েরা উঠে গেল। যেতে যেতে মতি কোমর বেঁকিয়ে প্রহ্লাদের দিকে মুচকি হেসে ফেলল। প্রহ্লাদের ভেতরটা কেঁপে ওঠে।
    খেতে খেতে সর্দার গুণিনকে বলল, 'কাল-পরশু রওনা দেব গুণিন। আরও দক্ষিণে নামব... ... ... বন্যাডায় কেমন মার খেলাম। দুশো জানোয়ার নিয়ে বেরিয়ে মোটে পাঁচশো নিয়ে ফিরেছি।'
    'রওনা দিলেই হয়... ... ... টোকা কাঁধে বাঁক নিয়ে আমরাও শোরের মতো ঘোঁত ঘোঁত করে চলব।' গুণিন হাসে।
    'নাঃ, আজকাল তোমরা বড্ড বেচাল করছ।
    বলেই সর্দার প্রহ্লাদের সিকে তাকায়। প্রহ্লাদ বিশেষ তোয়াক্কা করল না। পাশেই দুটো শুয়োরের মৈথুন দেখে বড়পাল স্তব্ধ হয়ে থাকে। চোখজোড়া কাঁপে, নাকের মাথাটা নড়ে, ঘন ঘন নিঃশ্বাস ফেলতে ফেলতে মনের অগোচরেই ঘাসের বুকে পা ঘষতে থাকে। এই কথাবার্তায় তার মন নেই। গুণিন হঠাৎ দেখতে পেয়ে হেসে বলল, 'ও বড়পাল।'
    'উঁ--'
    'মানুষের কয় জন্ম জান?--'
    'না--'
    'সাত জন্মের পর মুক্তি। শেষ জন্ম হল শোর চরান। ওসব ভেবে লাভ নেই, এখন শোও।' বড়পালের নাক থেকে একটা মস্ত নিঃশ্বাস বেরিয়ে এল।


    পরদিন বিকালে প্রহ্লাদ খুঁজতে খুঁজতে মতিদের পাড়ায় হাজির। গতকাল মতির বিদায়কালের হাসিটা ভুলতে পারেনি।
    কে একজন দেখতে পেয়েই চেঁচিয়ে উঠল, 'মতি লো মতি, কালা কেষ্ট যে তোর দোর খুঁজছে।' মতি উঠানে বসে চুল আঁচড়াচ্ছিল। বাটিতে জল, আয়না-চিরুনি, আলতার শিশি। তড়িঘড়ি উঠে দাঁড়াল। প্রহ্লাদের সঙ্গে চোখাচুখি হতেই হেসে ফেলে। পাশের ঘরের দুটো মেয়ে রেগে বলে উঠল, 'মুখ পুড়ির ঢং কত।'
    দাওয়ায় বসতেই মতি এক বালতি জল এনে দিল। প্রহ্লাদ বলে, তোমার জলে পা ধোব কী করে? আমরা যে চাঁড়াল, শোর চরাই।'
    ধোওনা, সেত আমার পুণ্যি।
    প্রহ্লাদ হেসে বলে, এমন বল্লে মনডা যে কেমন করে। আমরা যে পথের মানুষ পথেই হারিয়ে যাব।'
    মতি চোখ নামিয়ে বলল, 'মনের মানুষ যে পথে পথেই ঘোরে... ... রাধি মুখপুড়িও পথের দিকে চেয়ে দিন কাটাত।'
    এরপর দুজনের অনেক কথা হয়। প্রহ্লাদ কাঁপতে থাকে। হু হু হাওয়ার অন্ধকার নামছে। হঠাৎ কাঁধে হাত রাখতেই মতি হেসে ওঠে।
    'চলগো ঠাকুর, তোমার সঙ্গেই বেরিয়ে পড়ি। এমন করে আর মন টেঁকে না।'
    'মোদের ঘর ত এ দেশে নয়।--'
    'হোক... তোমার সঙ্গে পথে পথেই নয় জীবনটা কাটাব।'
    প্রহ্লাদ অবাক। মৃদু হেসে মতিকে বলে, 'তা হয় না। ... ... ... আমরা ত বেজাত, গাঁয়ের লোক ঘর করতে দেবে কেন?'
       'তুমি ত ঠাকুর কালা কেষ্ট, রঙটুকু দেখেই বুঝেছিলাম। ... আমায় ফাঁকি দিও না।'
    প্রহ্লাদ ভাবে একি জ্বালা। মতিকে নিয়ে সে কোথায় যাবে? যন্ত্রণা নিয়ে সে আস্তানায় ফিরে এল।
    সর্দার বসেছিল অন্ধকারে; মেঘের টুকরোগুলোর পাশে। বিড়ির আগুনে অনুমান হয় চোখজোড়া ঘোলাটে, মদির। প্রহ্লাদকে বলল না কিছু, শুধু আড়চোখে ওর দেহটার দিকে নজর রেখে গেল।
    আগুনের ছোবল নিভে গেছে। গুণিন মস্ত থালায় মাখছে আলুভাতে। প্রহ্লাদ একটা থালা ধুয়ে পাখলে বসে পড়ল। কেউ কথা বলছে না, শুধু খাওয়ার শব্দ। হঠাৎ সর্দার বলল, 'গুণিন, তোমার বীরভূমের ওদল গাঁয়ের কথা মনে আছে?'
    'আছে--'
    চাষি দুটোর কী হাল হয়েছিল?'
    গুণিন চুপ করে থাকে। সর্দার নিজেই জবাব দিয়ে দিল, 'হাতের পাঞ্জাদুটো কেটে নেয়া হয়েছিল। আমি হলে চোখ দুটোও উপড়ে গরম জল ঢেলে দিতাম। ... ... ভয়ে অন্য চাষিরা কোনোদিন ধানগোলার দিকে চাইতে সাহস পেত না। ... এ হলো বেতাল পাকাবার উপযুক্ত শাস্তি।'
    সর্দার এবং প্রহ্লাদ পরস্পরের দিকে কঠোরভাবে তাকিয়ে থাকে। সেও ঘটনাটা জানে। বীরভূমের ওদল গ্রামে সেবার দেখেছিল গ্রামের কয়েকজন চাষি জতদারের গোলা লুঠ করতে দিয়ে ধরা পড়ে যায়। শাস্তি হিসাবে প্রাণে না মেরে কিংবা থানায় না দিয়ে জোতদার প্রকাশ্য তাদের পাঞ্জা দুটো কেটে নেয়। প্রহ্লাদ বোঝে ইঙ্গিতটা তার উদ্দেশ্যে। তাকে নিয়ে নিশ্চয়ই সর্দারের মনে ভয়ঙ্কর তোলপাড় হচ্ছে। চরম শাস্তির কথা সর্দার ভাবছে। লোকটা পশু। দলের শৃঙ্খলা ছাড়া অন্য কিছু মনে আসে না।
    প্রহ্লাদ খাচ্ছে। কোমরে ঢোল-সমুদ্রের তাবিজটার অস্তিত্ব অনুভব করে, আবার কটমট করে তাকায় সর্দারের দিকে।
    সারারাত ঘুম হলো না প্রহ্লাদের। উন্মুক্ত প্রান্তরে হু হু বাতাসের মধ্যে পড়ে থেকে নানান চিন্তায় হৃদয়টা তোলপাড় হতে থাকে। মতিকে যেন সে ভুলতে পারছে না।
    পরদিন রোদে রোদে শুয়োর চরিয়ে, বিকেলের দিকে আবার মতির বাড়ি হাজির। উদাসভাবে মতি দাওয়ায় বসেছিল। প্রহ্লাদকে দেখতে পেয়েই হেসে বলে, 'কী ভাগ্যি আমার! এস ঠাকুর।'
    'ঘুরতে ঘুরতে এসে পড়লেম-- কবে আবার দেখা হবে কে জানে?'
    মতি জবাব দেয় না।
    'আওড়-বাওড়ের মানুষ মরা... ... ... বেঁচে থাকলে ও বছর... ... ...
    মতি হঠাৎ প্রহ্লাদের পা-জোড়া জড়িয়ে ফুঁপিয়ে উঠল, 'আমায় নে চল... তোমার সঙ্গে থাকব ঠাকুর।'
    'তা কেমন করে হয়?... আমার দেশের অন্য আচার বিচার।'
    মতি ঠোঁট ফুলায়, 'এই তোমার মনে ছিল ঠাকুর?'
    'তুমি থাকতে পারবে?... মোরা দশ মাস শোর নে মাঠে ময়দানে থাকি। বর্ষাবাদলশীত মোদের শরীরের পর দে যায়। মনে সাধ হলেও বাড়ি ফেরা যায় না।'
    মতি মাথা নাড়ে। সে পারবে। এদেশ ছেড়ে বেরিয়ে পড়তে চায়। আর তার কী আছে জীবনে?
    থেকে থেকে সময় বয়ে যাচ্ছিল। আকাশে মেঘের ছটা। বাতাস থমকানো। অন্ধকার যেন চোখ ধাঁধিয়ে দেয়। অনেক কিছু ভাবতে ভাবতে প্রহ্লাদ নিঃশ্বাস ছাড়ল।
    'বেশ, তবে কাল দুপুরে ইস্টিশানে থেকো... বিকেলের ডাকগাড়িতে চেপে বসব।'
    'ডাকগাড়ি? কত দূর গো? ... সত্যি বলছ? ভুলে যাবে না তো?'  
    প্রহ্লাদ মাথা নাড়িয়ে বলল, 'না গো না, অমন ভুলো মন নয়... ... ... রোদ্দুর চড়তে না চড়তে যেও...টিকিটবাবুর ঘরের সামনে থেকো, আমি চলে আসব।'
    মতির চোখজোড়া ভিজে। প্রহ্লাদের চোখেমুখে কীসের আশঙ্কা।
    ওকে ফিরে আসতে দেখে সর্দার কোনো কথা বলল না। সেও আজ বিকেলে স্টেশনে গেছল। বীরভূমে প্রহ্লাদের সঙ্গে তার বচসা ও এখানে মতির ঘটনাটা 'তার' করেছিল যুগল দাসকে, জবাব এসে গেছে। তাই জানতে গেছল।
    প্রহ্লাদ খেয়ে দেয়ে উঠতেই সর্দার আচমকা বলে উঠল, 'আজ শেষরাতে রওনা দেব, প্রহ্লাদ।'
    'কোথায়?'
    'আরও দক্ষিণে--'
    'কেন?'
    'বন্যায় ব্যবসায় ক্ষতি হয়েছে... ... ... পালে আরও নতুন শোর আসুক যুগল দাস 'তার' করেছে।
    'আমাদের ঘর বাড়ি দুবে গেল কিনা, সে খবর? বাপ ভাই-এর সংবাদ? তা আসেনি?'
    সর্দার গম্ভীর হয়ে বলে, 'মালিকের সম্পত্তি হলো শোর... ... তোর বাপ ভাই-এর সংবাদ পয়সা খরচ করে 'তার' করবার কি দরকার? বেচে বত্তে নিশ্চয়ই আছে এক রকম।'
    'আমায় তবে ছাড়ান দাও... আমি টেরেনে চেপে বসি।'
    সর্দার ঘাড় বেঁকিয়ে কর্কশ মুখটা ঘোরাল। ভুষোকালিপড়া টিমটিমে হ্যারিকেনের আলোয় লাগছে আরও নিষ্ঠুর।
    'যে যার খুশি দল থেকে চলে যাবে? সর্দারের গলায় জ্বালাধরা হাসি।
    'কেন, চোত মাসের পর বোশেখ জষ্টি ছুটি', প্রহ্লাদের গলাটা গরম হয়ে ওঠে।
    সর্দার অদ্ভুত হাসি তুলে বলল, 'ছুটি? দাদনের ছুটি তো দশ বছরের আগে নয়।'
    প্রহ্লাদ মুহূর্তের জন্য থমকে থাকে। শেষে টোকার মধ্য থেকে কাপড় জামার পুঁটলিটা টেনে বলল, 'দেখো, যেতে পারি কিনা।'
    একবার কোমর হাতিয়ে ঢোল সমুদ্রের তাবিজটা দেখে নিল। সর্বশক্তিমান সে। সর্দারের মত কত বদরাগী বেয়াড়া লোককে পথে ঘাটে টিট করেছে। এটা কোমরে থাকলে ভয় কি তার? সর্দার ছুটে এসে পথ আগলাতেই প্রহ্লাদ বলল, 'ছাড়ো, যেতে দাও।'
    পাশ কাটিয়ে দু পা যেতেই সর্দার জাপটে ধরল। প্রহ্লাদ চেঁচিয়ে উঠল, ছাড়ো।
    শেষে লাফ দিয়ে চেপে ধরল সর্দারের গর্দানটা। যেমন করে বীরভূমে দুটো ছিঁচকেকে শায়েস্তা করেছিল। আচমকা সর্দার নিচে পড়ে যায়। প্রহ্লাদের মূর্তিটা ভয়ানক। গলাটা চেপে সরোষে মাটিতে ঠুকে দিতে দিতে বলল, 'এইবার আমি চললাম, আটকাও।'
    গুণিন ছুটে এল। বড়পাল বলল, 'কী সব্বনাশ। তোমরা সব খেপে গেলে যে।'
    সোমরা চেঁচিয়ে উঠল, 'ছেড়ে দে প্রহ্লাদ, সব্বনাশ করিসনি।'
    উন্মুক্ত প্রান্তরে চলছে দাপাদাপি। শক্ত কাঁকুরে মাটি এবং দগ্ধ ঘাস দলে-মলে গেল। হঠাৎ সর্দার এক ঝটকায় উঠে পড়ে। প্রহ্লাদ গড়িয়ে যায়। বাঘের মত বুকটা খামচে এবার সর্দার চেপে বসল। আওয়াজ উঠল গোঁ গোঁ।
    শুয়োরের পাল নিশ্চুপ। শুধু একটা বাচ্চা ভয়ে মায়ের দুধের বাঁটে মুখ লাগিয়ে চুকচুক আওয়াজ করতে লাগল। ঠাণ্ডা বাতাসের ঝাপটা জানান দিয়ে গেল জল নামছে।
    সর্দার ডেকে উঠল, 'গুণিন... ছুরিখানা দাও।' গুণিন বুঝেছে সর্বনাশ। সর্দারকে সে বহুদিন থেকে চেনে। এবার কণ্ঠনালিটা ফেড়ে দিয়ে, দল চলে যাবে। পড়ে থাকবে প্রহ্লাদের দেহ। গুণিন তাই হাতজোড় করে বলল, 'একি সর্দার। তুমিও অমন বেচাল হয়ে গেলে?'
    'তোমার ওদল গ্রামের কথা মনে নাই?'
    এবার গুণিনও একটু খেপে যায়, 'ছেড়ে দাও সর্দার। অমন করলে কেউ শুয়োর নিয়ে বেরোবে না।'
    প্রহ্লাদ ক্রমে দুর্বল হয়ে পড়ছে। শক্ত হাঁটুর চাপে বুকটা গুঁড়ো হয়ে যাচ্ছে। চোখজোড়া ঠেলে বেরোচ্ছে। নিশ্বাস নিতে কষ্ট হয়। সে যেন গভীর অন্ধকারে তলিয়ে যাচ্ছে।
    অনেকক্ষণ গুণিনের মুখের দিকে তাকিয়ে সর্দার বলল, 'তুমি বলছ?... বেশ। তবে একদম ছাড়তে নেই।'
    নিচে নেমে এসে তলপেটের একপাশে এমন কায়দায় দুটো চাপ দিল, প্রহ্লাদের চোখ ফেটে জল বেরিয়ে আসে। সর্দার পা দিয়ে একটা গুঁতো মেরে উঠে পড়ে।
    এরপর বৃষ্টি নামল। রাত্রিজ মেঘ রাঢ়ের মাটিতে বর্ষণ ঢালে। সঙ্গে বাতাস। ক্ষণেক আগের রুক্ষ মল্লভূমিটুকু পিছল হয়ে ওঠে। আচ্ছাদনহীন বিশাল প্রান্তরে পাঁশুটে মেঘের টুকরোটার পাশে জীববিবর্তনের উন্নততম পর্যায়ের কয়েকটি প্রাণী জল-বাতাসে একাকার হয়ে গেছে।

    শেষরাতের দিকে দল এগিয়ে চলেছে। টোকার পর বড় বড় জলের ফোঁটা। অন্ধকার। কাঁচা সড়ক ধরে স্টেশন পেরিয়ে নেমে যাবে দক্ষিণে, আরও দক্ষিণে। রাঙাধুলোর কাদা জড়িয়ে তুরতুর করে চলেছে লোমভেজা শুয়োরের পালটা। প্রহ্লাদের কাঁধে বাঁক, মাথায় টোকা, হাতে ভুষোপড়া টিমটিমে হ্যারিকেন। ক্লান্ত শরীরে থপথপ করে চলেছে।
    ক্রমে লোকালয় ছাড়িয়ে, লাইন পেরিয়ে দলটা ঢালু মাঠের মধ্যে নেমে পড়ল। অন্ধকার, দূরে সিগন্যালের লাল আলো, অস্পষ্ট টিকিট ঘরটার দিকে নজর পড়তেই প্রহ্লাদ থমকে দাঁড়াল। নিশ্চয়ই ভোরের আলো ফুটলে ওখানে একজন দাঁড়িয়ে থাকবে। হৃদয়টা কে যেন খামচাতে লাগল। হাত দিয়ে কোমরটা অনুভব করল। অতিরিক্ত বোঝা হিসাবে কী যেন ঝুলছে। কোনো বিশ্বাস নেই আর তার। একটানে ছিঁড়ে ঢোল সমুদ্রের তাবিজটা হাতের মুঠোয় পিষতে লাগল। তারপর রাগে দূরে ছুঁড়ে দিল অন্ধকারে। যেখান থেকে কোনোদিন আর খুঁজে পাওয়া যাবে না।
    দুলে উঠল হাতের আলো, গায়ে এল বর্ষার ছাঁট, বাঁকটা কাঁধ বদল করে মাঠ ভেঙে সেও চলল দক্ষিণে, আরও দক্ষিণে। 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ