আজ বকরীদ। আজ কুরবানি। খুশি খুশি খুব ভোর ভোর ঘুম ভাঙে ইসমাইলের। মাকে জিজ্ঞেস করে, মা গে আইজ বকরীদ লয়? মা বলে, হ’ বাপ- আইজহি তো কুরবানি।
- বকরীদে কী হইবে গে মা?
মা মশারি গুটোতে গুটোতে বলে, আইজ কুরবানি হইবে।
- কী কুরবানি হইবে গে মা? বিছানায় উঠে বসে মাকে জিজ্ঞেস করে ইসমাইল।
মা বিরক্ত হয় না, ধৈর্য ধরে উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করে। আজ পরবের দিন। আজ আল্লাকে ইয়াদ করবার দিন। সেই সঙ্গে আজ ত্যাগেরও দিন। আল্লার কাছে সবকিছু সঁপে দেওয়ার দিন। আজ তো ধৈর্য ধরতেই হবে।
কিন্তু আজকের দিনের তাৎপর্য মনে পড়তেই মায়ের কলিজা কেঁপে ওঠে। ভাগ্যিস আল্লাতালা সেদিন হজরত ইসমাইলের জায়গায় দুম্বা স্বীকার করেছিলেন! না হলে ...
- কী কুরবানি হইবে গে মা? ইসমাইল আবার জিজ্ঞেস করে।
- হাঁরঘের খাসিটো কুরবানি হইবে বাপ। কথাটা বলে স্বস্তি পায় মা।
- খাসিটো কেনে কুরবানি হইবে?
মায়ের মনের কথা মুখে উচ্চারিত হয়, কুরবানি হইবে তুমার লেইগ্যা বাপ! তুমার বদলে ওই খাসিটো কুরবানি হইবে আইজ।
- হামার লেইগ্যা খাসিটো কুরবানি হইতে যাইবে কেনে?
- আল্লার হুকুম যে তেমনই বাপ!
- আল্লা হুকুম করলেই মানতে হইবে?
- হ’ বাপ। হুকুম করলেই মানতে হইবে। না মেনে হাঁরঘের কুনু গতি নাই।
- গতি নাই কেনে? কেনে গতি নাই গে মা?
- হামরা যে তাঁর উম্মত হই বাপ।
মায়ের কথা কী বুঝল না বুঝল, ইসমাইল বিছানা ছেড়ে দৌড়ে বাইরে বেরিয়ে দেখল তার আব্বা খাসিটাকে টানতে টানতে কলতলার দিকে নিয়ে যাচ্ছে। সে তার আব্বাকে জিজ্ঞেস করল, আব্বা- কুন্ঠে লিয়ে জেছেন জী খাসিটোকে?
- খাসিটোকে গোসুল করাতে হইবে না বেটা? আইজ যে বকরীদ! আব্বা বলল।
সে তখন তার আব্বাকে আবার জিজ্ঞেস করল, খাসিটোকে কেনে গোসুল করাতে হইবে আব্বা?
- আল্লার ওয়াস্তে অর কুরবানি হইবে যে আইজ। তাই অকে গোসুল করিয়ে পাকপবিত্র করাতে হইবে।
ততক্ষণে আব্বা আর খাসিটার সঙ্গে সঙ্গে ইসমাইল নিজেও কলতলায় পৌঁছে গেছে। কল টিপতে শুরু করেছে। খাসিটা কুরবানি হবে। সেজন্য খাসিটাকে পাকপবিত্র করতে গোসুল করাতে হবে। এটা তার কাছে যেমন জরুরী, তেমনি খুশির। যদিও কুরবানি ব্যাপারটা ঠিক কী, সে জানে না। তাই বোধহয় তার এত আগ্রহ। কিন্তু এমন শীতের সকালে এত ঠান্ডায় খাসিটাকে গোসুল করালে খাসিটার ঠান্ডা লেগে যায় যদি! মাথায় পানি জমে যায় যদি! মাথায় পানি জমলে খাসি আবার বাঁচে না।
আব্বাকে জিজ্ঞেস করে ইসমাইল, খাসিটোকে জাড় লাগবে না জী আব্বা? জাড় লেগে খাসিটোর মাথায় পানি জমবে না?
আব্বা বলে, জাড় তো এট্টু লাগবেই বেটা। মাথায় পানি জমলেও জমতে পারে! কিন্তুক কী করা যাবে জাড়ের সুমায় যখুন বকরীদ!
খাসিটার গায়ে ভাল করে সাবান ঘষছে ইসমাইলের আব্বা। ইসমাইল কল টিপতে টিপতে দেখছে। আজ পনেরো দিন হল খাসিটা এসেছে তাদের বাড়ি। এই পনেরো দিন ধরে সে দেখছে বাড়িতে খাসিটার যত্নআত্তি। মা ভাতের ফ্যানের সঙ্গে ভাত খেতে দিয়েছে রোজ। তা বাদেও গম, ছোলা, চাল – কিছুই বাদ যায়নি। আর আব্বা তো রোজ কাম থেকে বাড়ি ফেরার সময় এক আঁটি করে কাঁঠালপাতা কিনে এনেছে। বাঁধপুলের মোড়ে কুড়ি টাকা আঁটি কাঁঠালপাতা বিক্রি হয়। কুরবানির সিজিনে এলাকায় নতুন ব্যবসা। একদিন সে নিজেও কিনে এনেছিল।
শুধু কি তাই, আব্বা-মায়ের দেখাদেখি সে নিজেও এই শেষের কটা দিন রোজ বিকালবেলা খাসিটাকে চরাতে নিয়ে গেছে। বাড়ির সামনেই বিশাল মাঠ। সেই মাঠে একেক দিন একেক দিকে গেছে। কোনোদিন সোজাসুজি একেবারে সিমলা গ্রামের মাথা বরাবর। কোনোদিন বাঁদিকে শিসারমজানপুর-কুলগাছির সীমানা বরাবর। আবার কোনোদিন ধানঘোরার কোলে বিল-ডোমকুলে নহরের পাড় পর্যন্ত। আর গতকাল তো সে এমন জায়গায় গিয়েছিল, সেখানে বেঁচে থাকতে কখনও যাওয়া যায়, তা সে জানতই না।
কী করে খাসিটার গলার দড়ি তার হাত থেকে ছুটে গিয়েছিল। তারপর খাসিটার সে কী দৌড়! সে কী দৌড়! সেও পিছু পিছু ছুটতে শুরু করেছিল। কোনদিকে ছুটছে, ভাবার অবকাশ ছিল না তখন। যখন অবকাশ পেল, দেখল- সে দাঁড়িয়ে আছে বাসুমাটির গোরস্থানে। পাশেই বিশাল ঘাসের জঙ্গল!
ঘাসের জঙ্গলটাকে মনে করতে গিয়েও মনে করতে পারল না, আব্বা বলে উঠল, জলদি কর বেটা- বকরীদের নামাজ পড়হিতে ইদ্গাহা যাইতে হইবে আবার!
দুই
কিছুদিন আগে ইদ্গাহায় সবার সঙ্গে ঈদের নামাজ পড়েছিল যেভাবে, বকরীদের নামাজও সেভাবেই পড়ল ইসমাইল। সেই সঙ্গে মোলবীসাহেবের মুখে কুরবানির অনেক কথা শুনল। যেন একটা গল্প! হজরত ইব্রাহিমের কাছে তাঁর প্রিয় জিনিষ কুরবানি চাইছেন আল্লা। হজরত ইব্রাহিম আল্লাকে খুশি করতে এটা কুরবানি দিচ্ছেন, ওটা কুরবানি দিচ্ছেন। কিন্তু আল্লা সন্তুষ্ট হচ্ছেন না। শেষে আল্লা একদিন খোয়াবে হুকুম করলেন এই বলে, তুমি কি জান না তোমার সবচেয়ে প্রিয় হল তোমার পুত্র ইসমাইল! তাহলে তাকে তুমি আমার উদ্দেশে উৎসর্গ করছো না কেন?
ভয়ঙ্কর খোয়াব! কিন্তু আল্লার হুকুম! অমান্য করবেন কী করে? হজরত ইব্রাহিম মহাচিন্তায় পড়ে গেলেন। আর তাতেই তাঁর ঘুম ভেঙে গেল। বিবি হাজেরাকে ভয়ে শঙ্কায় বললেন সদ্য দেখা খোয়াবের কথা। বিবি হাজেরা যদি রাজী না হন! যদি আপত্তি করেন! এমন সব ভয়, শঙ্কা। কিন্তু না হজরত ইব্রাহিমের এমন সব ভয়-শঙ্কা মিথ্যা প্রমাণ করে বিবি হাজেরা আল্লাতালাকে খুশি করতে রাজী হয়ে গেলেন।
মোলবীসাহেবের শোনা কুরবানির গল্পটা স্মরণ করতে করতে ইদ্গাহা থেকে বাড়ি ফিরছে ইসমাইল। তার বাপের নামও হজরত এব্রাহিম। তার নাম ইসমাইল। তাহলে আল্লাতালা তার আব্বাকেও যদি খোয়াবে এমন হুকুম করেন? বুক কেঁপে ওঠে ইসমাইলের। তার আব্বা কি তাহলে তাকেও কুরবানি দেবে?
সকালে গোসুল করার সময় ঠান্ডা মালুম পায়নি ইসমাইল। কিন্তু এখন পাচ্ছে। তার শরীরের ভেতর-বাহির থরথর করে কাঁপছে। সে আর দেরী করে না, চট জলদি পা চালিয়ে কোনোরকমে বাড়ি পৌঁছে ঘরের ভেতর লেপমুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়ে। শরীরের কাঁপুনি থামে না তবু, যেন আরও বাড়ে।
তিন
মা সংসারের বাসি কাম সামটে কলতলায় গোসুল করছিল, অন্য কোনোদিকে তার খেয়াল ছিল না। ইসমাইল যে বাড়ি ঢুকেছে, টের পায়নি। ঠান্ডার দিন হলে কী হবে? আজকের দিনটা যে একটা বিশেষ দিন! মনের সঙ্গে শরীরটাকেও পাকপবিত্র করতে হয়। কলতলার পাশে চট টাঙানো গোসুলখানায় আপন মনে সেই কাজটাই করছিল সে। একটু পরেই আবার ব্যস্ত হয়ে পড়বে। খাসিটা কুরবানির গোস্ত হয়ে বাড়িতে আসবে যখন, সেই গোস্তের তিনভাগের একভাগ পাড়াপড়শি-আত্মীয়স্বজনদের মধ্যে বিলোতে হবে। আর একভাগ ফকির-মিশকিনদের মধ্যে বিলোতে হবে। বাকি একভাগ থাকবে নিজেদের জন্যে। যদিও পাড়াপড়শি-আত্মীস্বজনদের তরফ থেকেও গোস্ত আসবে। শেষপর্যন্ত ঘুরিয়ে নিজেদের দুভাগ থেকে যাবে। হয়ত তার চেয়েও বেশি।
আসমানে কুয়াশা-ঢাকা সূর্য। দিনের চাঁদের মতো মিটমিট করছে। অথচ মা নতুন শাড়ি পরে আঙিনাতে এসে দাঁড়িয়েছে। চুল শুকোবে। পাশে পেয়ারা গাছের গোঁড়ায় খাসিটা পাকপবিত্র হয়ে দাঁড়িয়ে আছে সেই সকালের গোসুলের পর। মা এবং খাসিটা দুজনেই আশা করছে কুয়াশা সরে গিয়ে তাদের ওপর রোদ এসে পড়ুক। কিন্তু তাদের ওপর রোদ এসে পড়ছে না। মা মুখে কিছু বলছে না। তবে খাসিটার অর্থহীন ব্যা ব্যা ডাক বাতাসে মিশে যাচ্ছে।
চার
ইদ্গাহায় সবার সঙ্গে সালাম-মুসাফা, বুকাবুকি করে বাড়ি ফিরতে হজরতের একটু দেরী হয়। স্বভাবতই হন্তদন্ত হয়ে সে বাড়ি ঢোকে। মুখে ডাক দেয়, ইসমাইলের মা! ও ইসমাইলের মা!
বিবিকে সে নাম ধরে ডাকে না। ডাকবে কী করে, বিবির নাম যে মা হাজেরার নামে। সেই পবিত্র নাম যখন তখন মুখে নিলে গুনাহ হয় যদি!
ইতিমধ্যে বিবি ছুটে এসে তার পা ছুঁয়ে কদমবুসি করে। মনে মনে তা স্বীকার করে সে জিজ্ঞেস করে, ইসমাইল কই? অকে জী দেখতে পেছি না!
বিবি বলল, কেনে- উ তো আপনার সুথেই নামাজ পড়হিতে গেলছিল!
- হামার সুথেই গেলছিল। কিন্তুক কখুন চল্যা এস্যাছে, মালুম পাইনি খো।
- চল্যা এস্যাছে! কখুন? কই না তো!
এমন সময় ঘরের ভেতর থেকে কার কাতরানির আওয়াজ ভেসে আসে। মিঞাবিবি দুজনেই সচকিত হয়। দুজন দুজনের দিকে তাকায়। ক্ষণিকের জন্য। তারপর দুজনেই পড়িমরি ঘরের দিকে ছোটে।
পাঁচ
ইসমাইল ঘোরের মধ্যে স্বপ্ন দেখছে, ভয়ানক স্বপ্ন! নাকি ঘটনা বাস্তব? সে তাড়া খেয়ে ছুটছে বাসুমাটির শ্মশানঘাটের দিকে। তাকে তাড়া করছে তার আব্বা হজরত এব্রাহিম। আব্বার হাতে একটা বড় ছোরা। লহুমাখা ছোরা! আব্বা তাকে কুরবানি দেবে। আল্লার হুকুম নাকি এমনই। কিন্তু সে কুরবানি হতে চায় না। তাড়া খেয়ে ছুটতে ছুটতে সেকথায় চিৎকার করে বলছে, আব্বা- হামি কুরবানি হব না। হামাকে কুরবানি দিয়েন না আব্বা! ও আব্বা, আব্বা গো!
ছেলের বিড়বিড়ানি ওরা মিঞাবিবি বুঝতে পারছে না। তবে এটা বুঝতে পারছে, ছেলের শরীরে প্রচন্ড জ্বর। জ্বরের প্রকোপে ছেলে তাদের বিকার বকছে।
মা ছেলের কপালে হাত দিয়ে সেটা টের পায়। আর যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ছেলের কপালে পানিপটি দেওয়া যায় তার ব্যবস্থায় লেগে পড়ে। আর আব্বা ছুটে বেরিয়ে যায় গ্রামের হাতুড়ে ডাক্তার নরেণচামারকে ডেকে আনতে।
ততক্ষণে কুয়াশা কেটে গিয়ে বাইরে চড়বড়িয়ে রোদ উঠেছে। খাসিটা আর ব্যা ব্যা ডাকছে না। গলার দড়ি কীভাবে খুলে গিয়ে পেয়ারাতলা ছেড়ে বেরিয়ে এসেছে রোদে। চুপচাপ দাঁড়িয়ে নিজের ভেজা মাথা সহ পুরো শরীরটা শুকিয়ে নিচ্ছে। সেই সঙ্গে গতকালের দেখা গোরস্থানের পাশের ঘাসের জঙ্গলটাকে স্মরণ করছে ...
লেখক পরিচিতি
নীহারুল ইসলাম
‘সাগরভিলা’ লালগোলা, মুর্শিদাবাদ, ৭৪২১৪৮ পঃ বঃ, ভারতবর্ষ।
জন্ম- ১২ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৭, মুর্শিদাবাদ জেলার সাগরদিঘী থানার হরহরি গ্রামে (মাতুলালয়)।
শিক্ষা- স্নাতক (কলা বিভাগ), কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়। পেশা- শিক্ষা সম্প্রসারক।
সখ- ভ্রমণ। বিনোদন- উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত শ্রবণ।
রৌরব, দেশ সহ বিভিন্ন লিটিল ম্যাগাজিনে লেখেন নববই দশক থেকে।
প্রকাশিত গল্পগ্রন্থঃ
পঞ্চব্যাধের শিকার পর্ব (১৯৯৬), জেনা (২০০০), আগুনদৃষ্টি ও কালোবিড়াল (২০০৪), ট্যাকের মাঠে, মাধবী অপেরা (২০০৮), মজনু হবার রূপকথা (২০১২)।
দু’টি নভেলা--, জনম দৌড় (২০১২), উপন্যাস।
২০০০ থেকে ‘খোঁজ’ নামে একটি অনিয়মিত সাহিত্য সাময়িকী’র সম্পাদনা।
পুরস্কার :
লালগোলা ‘সংস্কৃতি সংঘ’ (১৯৯৫)এবং শিলিগুড়ি ‘উত্তরবঙ্গ নাট্য জগৎ’ কর্তৃক ছোটগল্পকার হিসাবে সংবর্ধিত
(২০০৩)। সাহিত্য আকাদেমি’র ট্রাভেল গ্রান্ট পেয়ে জুনিয়র লেখক হিসাবে কেরালা ভ্রমণ (২০০৪)। বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ কর্তৃক “ইলা চন্দ স্মৃতি পুরস্কার” প্রাপ্তি (২০১০)। ‘ট্যাকের মাঠে মাধবী অপেরা’ গল্পগ্রন্থটির জন্য পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি প্রবর্তিত “সোমেন চন্দ স্মারক পুরস্কার” প্রাপ্তি (২০১০)। ভারত বাংলাদেশ সাহিত্য সংহতি সম্মান “উত্তর বাংলা পদক” প্রাপ্তি (২০১১)। রুদ্রকাল সম্মান (২০১৩) প্রাপ্তি।
0 মন্তব্যসমূহ