শাহনাজ মুন্নী
জীবন গল্পহীন, রংবিহীন। মনে হয়, কারো কাছে কোন গল্প নাই, রং-ও নাই। আধাটা সাদা-কালো বাক্য, তিন চারটা ছেড়া-খোঁড়া শব্দ বলে চুপ হয়ে যায় সবাই। একটা গল্পে নিদেনপক্ষে ঘটনার ‘শুরু-মধ্য-শেষ’ তো থাকে। রং-চং মাখিয়ে সাধারণকে অসাধারণ করে তুলতে হয়।
‘মানুষরাই শেষ পর্যন্ত মানুষ-খেকো হয়’ -এমন উদ্ভট একটা কথা বলে কেউ যদি চুপ করে থাকে তাহলে তাকে দিয়ে কি করে আপনি কথা বলাবেন? হয়তো বলতে পারেন, কথাটা ব্যাখ্যা করো। আর এর উত্তরে সে আরেকটি অদ্ভুত মন্তব্য করলো, বললো, ‘মানুষের মধ্যেই মানুষ-খেকো লুকিয়ে থাকে। শুধু আমরা তাদের চিনতে পারি না।’ হয়তো কারো মাথা বিগড়ে গেলে সে এমন সব উদ্ভট মনগড়া কথা বলতে পারে। কিন্তু রবিউল্লাহ বাবুর মাথা যে শতভাগ ঠিক আছে, তা আন্দাজ করা যায় এইভাবে যে, মাথা ঠিক না থাকলে হয়তো একটা শৃঙ্খলা রক্ষাকারী এলিট কোম্পানীতে এত সফল ভাবে দলনেতার দায়িত্ব সে পালন করতে পারতো না। কিন্তু ওর এমন দুম করে বলা কথাটা আমার মাথায় ঘুরতে থাকলো। হঠাৎ সে মানুষখেকোর কথা তুললো কেন, এই জনারণ্যে সে মানুষখেকোই বা পাবে কোথায়? শুনেছি আফ্রিকার জঙ্গলে নাকি একসময় ‘নরখেকো, ক্যানিবল’-দের দেখা মিলতো, তাও সেসব মিথ্য প্রচারণা কিনা কে জানে ? কারণ আফ্রিকান লেখক আমাস তুতুওলা নাকি চিনুয়া আচেব, কে যেন বলেছিলেন, ভুলে গেছি, বলেছিলেন, আফ্রিকাকে যারা চেনে না, জানে না আর বোঝে না তারাই একে অন্ধকারাচ্ছন্ন বলে। আসলে আফ্রিকা তার নিজের কালো আলোয় নিজের মতো আলোকিত।
পিরানহা নামের একজাতের নরখেকো মাছের কথা শুনেছি। যারা দল বেঁধে নিজেদের তীক্ষ্ণ দাঁতে একজন জীবন্ত মানুষ পর্যন্ত শিকার করে ফেলে। জলের ভেতর স্বল্পস্থায়ী ভয়ংকর তোলপাড় আর একটা চিকন রক্ত স্রোত ছাড়া নিহত মানুষটার আর কোন চিন্হই নাকি খুঁজে পাওয়া যায় না।
রবিউল্লাহ বাবু বলে, ‘এখন আমাদের দরকার কয়েকটা নতুন গল্প, কয়েকটা নতুন প্লট, ঘটনার নতুন ধরনের বিন্যাস, বর্ণনার ব্যতিক্রমী ঘনঘটা- বুঝলে, পুরনো গল্প মানুষ ইদানিং আর খাচ্ছে না।’
অবাক হয়ে বলি, ‘খাচ্ছে না তো কি করছে? কেউ কি কোথায়ও কিছু বলছে? বলছে নাকি যে গল্পটা জুৎসই হলো না? উহু, বলছে না তো।’
বাবু বলে, ‘শোন হে গল্পকার, গল্পটা মানুষ খাচ্ছে বাধ্য হয়ে, ঠোটের কোণায় বিদ্রুপের একটা নিঃশব্দ হাসি মিশিয়ে। তোমাদের এই মিথ্যা গল্প , এই বানানো গল্প ধরে ফেলেছি, এমন একটা ভাব মেরে, বুঝলে?’
আমি আবার পুরনো প্রসঙ্গে ফিরে যাই। বলি, ‘তুমি যে মানুষ খেকো না কি বলছিলে ...’
রবিউল্লাহ বাবু আমার কথায় তাচ্ছিল্যের হাসি হাসে। বলে, ‘তোমাকে দিয়ে হবে না। আমাকে একজন নতুন গল্পকারের খোঁজ দাও তো, যে নতুন রং দিয়ে গল্প বানাতে জানে।’
‘কেন লাগবে নতুন গল্পকার, আমাকে বলো না, স্রেফ একটা ক্লু দাও, গল্প শুধু নয়, রীতিমতো গল্পগুচ্ছ বানিয়ে দেবো।’ আমি বলি।
বাবু দুই আঙ্গুলের টোকা দিয়ে তার ইউনিফর্মের পকেটের কছে লেগে থাকা অদৃশ্য ময়লা ঝাড়ে। কোমরের কাছে শার্টটা টেনেটুনে ঠিক করে। যেন আমার কথা শুনতেই পায়নি এমন ভঙ্গী করে কাঁচের জানালার বাইরে এক টুকরো আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে। বাইরে রোদ, গরম, ধূলা, মানুষের কোলাহল। ভেতরে ছায়া ছায়া ঠাণ্ডা পরিস্কার নীরবতা। টেবিলের অন্য পাশ থেকে আমি একটু কেশে তার দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করি।
‘আচ্ছা, বলো তো গল্পটা কি নিয়ে হবে? বিষয়-বস্তু কি? চরিত্র কয়টা? তুমি কি প্রেমের গল্প চাও নাকি রোমাঞ্চকর এ্যাডভেঞ্চার গল্প? সিরিয়াস না হাস্যরসাত্মক? নিরীক্ষাপ্রবণ না ট্র্যাডিশনাল?’
এক সাথে প্রায় ছয়-টা প্রশ্ন করে আমি উত্তরের অপেক্ষায় তার দিকে শকুন দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকি। বাবু আমার এককালের বন্ধু বটে, তবে আমাকে বন্ধু হিসেবে পরিচয় দিতে সে হয়তো ততটা উৎসাহ বোধ করে না যতটা আমি আগ্ বাড়িয়ে মানুষকে জানান দেই রবিউল্লাহ বাবু আমার বিশেষ বন্ধু । আমার বেশি চেনা, স্বল্প চেনা, পাড়া-পড়শি, বাড়ির পাশের মুদি দোকানদার, থানার দারোগা, পত্রিকার হকার, পাড়ার পাহারাদার সবাই জানে বাবু আমার কত ঘনিষ্ঠ বন্ধু। এতে সুবিধা যেমন আছে তেমন অসুবিধাও আছে, সুবিধা হলো মানুষজন সমীহ করে, খাতির করে, পায়ে পা বাঁধিয়ে খামোকা ঝগড়া করে না। আর অসুবিধা হচ্ছে, কেউ কেউ তদবির নিয়ে আসে। বলে, ‘ভাই, অমুকে আমার জায়গা বেআইনি ভাবে দখল করে নিছে, আপনার বন্ধুকে দিয়ে একটা ধমক দিয়ে দেন না, ভাই। যাতে জায়গাটা ছেড়ে দেয়।’
তাদেরকে ধুন ফুন বুঝাই। ঝাড়ি দিয়া বলি, ‘আরে রবিউল্লাহ বাবু এইসব কাজ করে না। জমি দখল হইছে তো মামলা করেন, কোর্ট কাচারি করেন। এই ধরনের ফালতু কাজে আমার বন্ধুকে জড়াবেন না।’
‘ভাই, ওরা পলিটিক্যাল ক্যাডার, মামলা মোকদ্দমা ভয় পায় না।’
আমি এবার প্রমাদ গুণি। ঢোক গিলে বলি, ‘ঠিকাছে, ঠিকাছে, দেখবো নে কি করা যায়! বাবুকে বলবো। কিন্তু ও যা ব্যস্ত ! ফোন ধরার সময় নাই ওর... সপ্তাহখানেক পরে আসেন ভাই।’
তবে, এই কিছুদিন আগে আমাদের পাড়ার এক অল্প বয়সী স্কুল শিক্ষিকা কোথা থেকে জেনেছেন বাবু আমার বন্ধু, তো এসে ধরলেন, তার বড় ভাইকে কে বা কারা নাকি উঠিয়ে নিয়ে গেছে, এক সপ্তাহ ধরে কোন খবর নাই, আমি যেন আমার বন্ধু বাবুকে বলে ওর ভাইকে খুঁজে এনে দেই।
স্কুল শিক্ষিকা মেয়েটি অল্প বয়সী, দেখতে সুন্দরী। কায়দা করে জেনে নিয়েছি সে অবিবাহিত’ও বটে। ফলে তার প্রতি আমার একটা অতিরিক্ত মায়া ও স্নেহ তৈরি হয়। হারিয়ে যাওয়া বড় ভাইয়ের জন্য মেয়েটির আকুল কান্না আমাকেও আপ্লুত করে। আমি তাকে উল্টা-পালটা বুঝ দিয়ে ফিরিয়ে দেই না। সান্ত্বনা দিয়ে বলি, ‘চিন্তা করবেন না। আমি আমার সাধ্যমতো চেষ্টা করবো। দরকার হলে রবিউল্লাহ বাবুর কাছে’ও যাবো।’
সেই ল্যাংটা কাল থেকে বাবু আর আমি একসঙ্গে এক গ্রামে গলাগলি করে বড় হয়েছি। মাঝে হলো ছাড়াছাড়ি, গেলেম কে কোথায়। বাবু পড়তে চলে গেল ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে আর আমি পড়ে রইলাম সদরপুর ডিগ্রি কলেজে। লিটিল ম্যাগাজিন বের করলাম একটা। সিরিয়াস সাহিত্য চর্চা শুরু করলাম। গত কয়েক বছরে পত্র পত্রিকায় বেশ কিছু গল্প ছাপা হয়েছে আমার, একটা গল্পের বই’ও বের হয়েছে গত একুশের বইমেলায়। ওদিকে রবিউল্লাহ বাবু’ও পড়া লেখা শেষ করে পেয়ে গেছে উচ্চমানের ক্ষমতাধর পদ-পদবী। সদরপুরের কৃতি সন্তান হিসেবে এলাকায় একটা সম্বর্ধনা অনুষ্ঠানে বাবুর সঙ্গে আমার পুর্নমিলন। পুরনো বন্ধুকে পেয়ে আমি যার পর নাই খুশী, সেই খুশি আরো কয়েক কোটিগুণ বেড়ে গেল যখন বাবু একদিন আমাকে নিরাপত্তাবেস্টনীতে ঘেরা ওর বহুতল ভবনের শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত অফিসে ডাকলো। তারপর থেকে একঠায় বসে আছি বাবুর সামনে। এক দফা স্যান্ডউইচ আর কফি খাওয়া হয়ে গেছে। সাক্ষাত কাল টেনে-টুনে আরো দুয়েক ঘন্টা বাড়াতে পারলে লাঞ্চটাও হয়তো এখানে সেরে নেয়া যাবে, ভাবলাম আমি। তাছাড়া সময় বুঝে স্কুল শিক্ষিকার নিখোঁজ ভাইয়ের কথাটাও একবার তুলতে হবে। মেয়েটা আমার উপর আশা করে বসে আছে। তার অশ্রু ছল ছল বড় দুটি মায়াবি চোখের কথা মনে পড়ে।
‘একটা গল্প লিখে কত টাকা পাও?’
রবিউল্লাহ বাবু জানালা থেকে চোখ সরিয়ে আমার দিকে তাকায়। অনেকেই এই প্রশ্নটা করেন। আর এর উত্তর দিতে বরাবরই বিব্রত বোধ করি আমি। কারণ বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই লেখকদের যে টাকার প্রয়োজন আছে, এটা যারা লেখা ছাপেন তারা বোঝেন না, অথবা বুঝতে চান না। লেখকের জন্য বরাদ্দ থাকে একেবারে নিম্নতম সম্মানী, তাও সেটা আদায় করতে লেখকদের যে কতবার ঘুরতে হয়! আমি আমতা আমতা করে উত্তর দিই,
‘এই পাই আর কি, যৎসামান্য ..’
‘যত পাও তার দশগুণ দেবো।’
বলে আমার চোখের দিকে খানিকক্ষণ ঠান্ডা শীতল চোখে তাকিয়ে থাকে বাবু। যেন আমার কি প্রতিক্রিয়া হয় সেটা বুঝতে চাইছে। তার তীব্র তীক্ষ্ণ দৃষ্টি বাণে আমি যথারীতি প্রবল অস্বস্তি বোধে জর্জরিত হয়ে টেবিলের নিচে দুই হাত কচলাতে থাকি।
‘আমাদের কয়েকটা গল্প লিখে দেবে, এমন গল্প যাতে যখন যেখানে চাই খাইয়ে দিতে পারি।’
আবার থামে বাবু। আমি কি উত্তর দিবো ভাবতে থাকি।
‘আমাদের সব গল্প একঘেয়ে হয়ে যাচ্ছে, বুঝলে, সব নীরস আর বেরঙ। সরস আর রঙীন গল্প চাই এখন।’
এবার আমি একটা প্রশ্ন করার সুযোগ পাই।
‘গল্পটা কি নিয়ে?’
‘কি নিয়ে গল্প বানাবে সেটা তুমি জানো। আমি শুধু ওপেনিং দৃশ্যটা বলতে পারি।’
‘বলো।’
বাবু নাটকীয় ভঙ্গীতে বলে,
‘একটা ধূ ধূ মাঠ। জন মানবহীন প্রান্তর। সেখানে উপুড় হয়ে পড়ে আছে একটা প্রাণহীন মানুষ। পুরুষ মানুষ। মানুষটি অপরাধি।’
‘তারপর?’
‘তারপর তুমি বানাবে। বানাও।’
হাতে তুড়ি দিয়ে বলে রবিউল্লাহ। অনেকটা ‘খেলা দেখাও’- বলার মতো করে। আমি স্কুল শিক্ষিকার নিরুদ্দেশ ভাইয়ের কথাটা কিভাবে বলা যায় তা নিয়ে ভাবতে থাকি। বাবু তার টেবিলে টোকা দেয়,
‘কি হলো? চুপ মেরে গেলে যে ..’
‘আমি আসলে, মানে একটা মেয়ের ভাই হারিয়ে গেছে, তোমার কাছে তার কোন খোঁজ আছে কিনা .. মানে ..তুমি যদি একটু দেখতে .. ’
বাবু বলে, ‘কত বড় ভাই? বয়স কত?’
‘বয়স আটাশ/ উনত্রিশ হবে।’ বলি আমি।
বাবু হো হো করে হাসে।
‘আটাশ/ উনত্রিশ বছর বয়সের কেউ হারায় নাকি? কোথায় পালিয়েছে দেখো..’
আমি ওর মুখের উপর কি বলবো ভেবে পাই না।
‘আরে মিয়া, গল্পটা বানাও, ওই যে একটা মানুষ একা একটা খোলা প্রান্তরে মরে পড়ে আছে। আর মনে রেখো সে কিন্তু অপরাধী। কে জানে ওই মানুষটাই আবার তোমার সেই মেয়েটার ভাই কিনা ...’
বাবুর কথা শুনে আমার চেহারায় নিশ্চয়ই কোন পরিবর্তন ফুটে উঠেছিল। আর সেজন্যই হয়তো বাবু সাথে সাথে তার কথা ঘুরিয়ে নিয়ে বললো, ‘আরে না, ঠাট্টা করলাম। বলো, গল্পটা বলো.. কিভাবে ঘটনাটা সাজাবে বলো।’
আমি তখন অনেকটা স্বয়ংক্রিয়ভাবে গল্পের পরবর্তী অংশ বলতে শুরু করি, ‘মানুষটির পায়ে ছিল সস্তা কেডস্, পরনে রঙজ্বলা জিনসের প্যান্ট আর একটা বাদামী রঙের দুমড়ানো-মোচড়ানো শার্ট। ঘাসের উপর আলতো করে পড়ে থাকা তার রোমশ হাতের কব্জিতে একটা পাতলা ষ্টেনলেস ষ্টীলের রুপালি বেল্টের ঘড়ি, এখনো টিক্ টিক্ করে ঘড়ির কাঁটা দুটি ঘুরে চলছে, যদিও কিভাবে যেন ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে ঘড়ির উপরের কাঁচটা। পড়ে থাকা মানুষটিকে ঘিরে কৌতুহলী জনতার নিঃশব্দ ভীড়। সবাই তাকিয়ে আছে তার দিকে কিন্তু কেউ কোন কথা বলছে না।’
‘আহ্, বড্ড ডিটেইলে যাচ্ছো তুমি, এরকম না, ঘটনায় মোচড় আনো। মানুষের অতো সময় নাই যে তোমার এইসব ডিটেইলস বর্ণনা পড়বে।’
বাবু বিরক্তি প্রকাশ করে।
‘আহ্, অতো অধৈর্য্য হয়ো না, বন্ধু, একটু অপেক্ষা করো। গল্পকে গল্প হয়ে উঠতে সময় দিতে হয়, গল্প নির্মাণে দালানের মতোই একটার পর একটা ইট গাঁথতে হয়। নইলে গল্পের গাঁথুনি দুর্বল হয়ে যায়।’ আমি বলি।
‘আরে, না, না, শোনো, বুঝলাম, কিন্তু এসব কি বলছো তুমি? নিঃশব্দ ভীড় ? নিঃশব্দ হবে কেন? সশব্দ ভীড়। মানুষের চোখে মুখে তীব্র আনন্দ, কন্ঠে উল্লাস, ভুলে গেছো, পড়ে থাকা মানুষটা অপরাধি?’
‘না ভুলি নাই। বলছি। মানুষটা তাহলে জীবনে অনেক অপরাধ করেছিল। খুন, ধর্ষণ, চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, চাঁদাবাজি, অগ্নি সংযোগ, লুটপাট এমন সব ধরনের জঘন্য অপরাধ। থানায় তার নামে অসংখ্য মামলা ছিল।’
‘মামলা যে থাকবেই, তা নয়, অনেক সময় তো লোকে ভয়ে মামলা করে না, তাই না?’
‘ঠিক আছে। একটা মানুষ যে এতগুলো অপরাধ করে, তার তো আসলে শান্তিতে থাকার কথা না, তার অপকর্মগুলি কিছুতেই তার পিছু ছাড়ে না, সারাক্ষণই সেগুলি তার সঙ্গে ঘুরে বেড়ায়, তাকে উত্যক্ত করে, তার মনকে ভারাক্রান্ত করে রাখে এবং এক সময় সে নিজেই তার মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়ায়। নিজের কৃতকর্মের হাতেই সে খুন হয়। পড়ে থাকে জনহীন প্রান্তরে।’
‘মন্দ নয়। তবে বড্ড বিমূর্ত। মূর্ত করো।’
‘এমন’ও হতে পারে যে, অপরাধি আসলে নিজের কর্মকাণ্ডের জন্য অনুতপ্ত হলো, প্রচন্ড অপরাধবোধে আক্রান্ত হলো। তার মনে হলো, যেসব অপরাধ সে করেছে, সেসব অপরাধের ক্ষমা নেই। তার হয়তো আরো মনে হলো, তার পাহাড় সমান অপরাধের বিচার অন্য কেউ-ই করতে পারবে না, কারণ বিচার ব্যবস্থার উপর তার অবিশ্বাস ছিল, সে রবীন্দ্রনাথের উপন্যাসে পড়েছিল, যে দুর্বল সে সুবিচার করতে সাহস করে না; ন্যায়পরতার দায়িত্ব এড়িয়ে অন্যায়ের দ্বারা সে তাড়াতাড়ি ফল পেতে চায়।’ একারণেই বোধহয় লোকটা নিজের বিচার নিজেই করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। আর তাই, একটা সময় সে নিজেই নিজেকে মৃত্যুদণ্ড দিয়ে দিল।’
‘চমৎকার। সে তাহলে আত্মহত্যা করলো। মাথার পেছনে যে গুলির দাগ, তার জন্য অন্য কেউ নয় বরং সে নিজেই দায়ী। আর কোন আইডিয়া?’
‘আরেকটা আছে। সেটা হলো অপরাধি মানুষটা আসলে পথ হারিয়ে ফেলেছিল। বলতে পারো, পথ হারাতে বাধ্য হয়েছিল। আর পথ হারিয়ে অ-মানুষের জঙ্গলে কিছু মানুষ-খেকোর কবলে পড়েছিল সে। অন্য ভাবে’ও বলা যায়, কিছু প্রাণ-খেকোর কবলে পড়েছিল সে, যারা তার দেহটা রেখে প্রাণ নিয়ে পালিয়ে গেছে।’
রবিউল্লাহ বাবু মাথা ঝাঁকায়, ‘এটাও ঠিক আছে, তবে একটু অবাস্তব, এই যা, ম্যাজিক-রিয়েলিজম করছো নাকি? এই অঞ্চলে মানুষখেকো তুমি পাবে কোথায়?’
আমি বাবুকে তার নিজের কথাই ফিরিয়ে দিয়ে বলি, ‘কেন? তুমিই না বলেছিলে মানুষের মধ্যে মানুষ-খেকোরা লুকিয়ে থাকে। তুমি হয়তো তাদের চিনতে পারো না, কিন্তু কেউ কেউ ঠিকই তাদের চিনতে পারে। বন্ধু, আমার মনে হচ্ছে আমি তাদের চিনেছি।’
জীবন গল্পহীন, রংবিহীন। মনে হয়, কারো কাছে কোন গল্প নাই, রং-ও নাই। আধাটা সাদা-কালো বাক্য, তিন চারটা ছেড়া-খোঁড়া শব্দ বলে চুপ হয়ে যায় সবাই। একটা গল্পে নিদেনপক্ষে ঘটনার ‘শুরু-মধ্য-শেষ’ তো থাকে। রং-চং মাখিয়ে সাধারণকে অসাধারণ করে তুলতে হয়।
‘মানুষরাই শেষ পর্যন্ত মানুষ-খেকো হয়’ -এমন উদ্ভট একটা কথা বলে কেউ যদি চুপ করে থাকে তাহলে তাকে দিয়ে কি করে আপনি কথা বলাবেন? হয়তো বলতে পারেন, কথাটা ব্যাখ্যা করো। আর এর উত্তরে সে আরেকটি অদ্ভুত মন্তব্য করলো, বললো, ‘মানুষের মধ্যেই মানুষ-খেকো লুকিয়ে থাকে। শুধু আমরা তাদের চিনতে পারি না।’ হয়তো কারো মাথা বিগড়ে গেলে সে এমন সব উদ্ভট মনগড়া কথা বলতে পারে। কিন্তু রবিউল্লাহ বাবুর মাথা যে শতভাগ ঠিক আছে, তা আন্দাজ করা যায় এইভাবে যে, মাথা ঠিক না থাকলে হয়তো একটা শৃঙ্খলা রক্ষাকারী এলিট কোম্পানীতে এত সফল ভাবে দলনেতার দায়িত্ব সে পালন করতে পারতো না। কিন্তু ওর এমন দুম করে বলা কথাটা আমার মাথায় ঘুরতে থাকলো। হঠাৎ সে মানুষখেকোর কথা তুললো কেন, এই জনারণ্যে সে মানুষখেকোই বা পাবে কোথায়? শুনেছি আফ্রিকার জঙ্গলে নাকি একসময় ‘নরখেকো, ক্যানিবল’-দের দেখা মিলতো, তাও সেসব মিথ্য প্রচারণা কিনা কে জানে ? কারণ আফ্রিকান লেখক আমাস তুতুওলা নাকি চিনুয়া আচেব, কে যেন বলেছিলেন, ভুলে গেছি, বলেছিলেন, আফ্রিকাকে যারা চেনে না, জানে না আর বোঝে না তারাই একে অন্ধকারাচ্ছন্ন বলে। আসলে আফ্রিকা তার নিজের কালো আলোয় নিজের মতো আলোকিত।
পিরানহা নামের একজাতের নরখেকো মাছের কথা শুনেছি। যারা দল বেঁধে নিজেদের তীক্ষ্ণ দাঁতে একজন জীবন্ত মানুষ পর্যন্ত শিকার করে ফেলে। জলের ভেতর স্বল্পস্থায়ী ভয়ংকর তোলপাড় আর একটা চিকন রক্ত স্রোত ছাড়া নিহত মানুষটার আর কোন চিন্হই নাকি খুঁজে পাওয়া যায় না।
রবিউল্লাহ বাবু বলে, ‘এখন আমাদের দরকার কয়েকটা নতুন গল্প, কয়েকটা নতুন প্লট, ঘটনার নতুন ধরনের বিন্যাস, বর্ণনার ব্যতিক্রমী ঘনঘটা- বুঝলে, পুরনো গল্প মানুষ ইদানিং আর খাচ্ছে না।’
অবাক হয়ে বলি, ‘খাচ্ছে না তো কি করছে? কেউ কি কোথায়ও কিছু বলছে? বলছে নাকি যে গল্পটা জুৎসই হলো না? উহু, বলছে না তো।’
বাবু বলে, ‘শোন হে গল্পকার, গল্পটা মানুষ খাচ্ছে বাধ্য হয়ে, ঠোটের কোণায় বিদ্রুপের একটা নিঃশব্দ হাসি মিশিয়ে। তোমাদের এই মিথ্যা গল্প , এই বানানো গল্প ধরে ফেলেছি, এমন একটা ভাব মেরে, বুঝলে?’
আমি আবার পুরনো প্রসঙ্গে ফিরে যাই। বলি, ‘তুমি যে মানুষ খেকো না কি বলছিলে ...’
রবিউল্লাহ বাবু আমার কথায় তাচ্ছিল্যের হাসি হাসে। বলে, ‘তোমাকে দিয়ে হবে না। আমাকে একজন নতুন গল্পকারের খোঁজ দাও তো, যে নতুন রং দিয়ে গল্প বানাতে জানে।’
‘কেন লাগবে নতুন গল্পকার, আমাকে বলো না, স্রেফ একটা ক্লু দাও, গল্প শুধু নয়, রীতিমতো গল্পগুচ্ছ বানিয়ে দেবো।’ আমি বলি।
বাবু দুই আঙ্গুলের টোকা দিয়ে তার ইউনিফর্মের পকেটের কছে লেগে থাকা অদৃশ্য ময়লা ঝাড়ে। কোমরের কাছে শার্টটা টেনেটুনে ঠিক করে। যেন আমার কথা শুনতেই পায়নি এমন ভঙ্গী করে কাঁচের জানালার বাইরে এক টুকরো আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে। বাইরে রোদ, গরম, ধূলা, মানুষের কোলাহল। ভেতরে ছায়া ছায়া ঠাণ্ডা পরিস্কার নীরবতা। টেবিলের অন্য পাশ থেকে আমি একটু কেশে তার দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করি।
‘আচ্ছা, বলো তো গল্পটা কি নিয়ে হবে? বিষয়-বস্তু কি? চরিত্র কয়টা? তুমি কি প্রেমের গল্প চাও নাকি রোমাঞ্চকর এ্যাডভেঞ্চার গল্প? সিরিয়াস না হাস্যরসাত্মক? নিরীক্ষাপ্রবণ না ট্র্যাডিশনাল?’
এক সাথে প্রায় ছয়-টা প্রশ্ন করে আমি উত্তরের অপেক্ষায় তার দিকে শকুন দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকি। বাবু আমার এককালের বন্ধু বটে, তবে আমাকে বন্ধু হিসেবে পরিচয় দিতে সে হয়তো ততটা উৎসাহ বোধ করে না যতটা আমি আগ্ বাড়িয়ে মানুষকে জানান দেই রবিউল্লাহ বাবু আমার বিশেষ বন্ধু । আমার বেশি চেনা, স্বল্প চেনা, পাড়া-পড়শি, বাড়ির পাশের মুদি দোকানদার, থানার দারোগা, পত্রিকার হকার, পাড়ার পাহারাদার সবাই জানে বাবু আমার কত ঘনিষ্ঠ বন্ধু। এতে সুবিধা যেমন আছে তেমন অসুবিধাও আছে, সুবিধা হলো মানুষজন সমীহ করে, খাতির করে, পায়ে পা বাঁধিয়ে খামোকা ঝগড়া করে না। আর অসুবিধা হচ্ছে, কেউ কেউ তদবির নিয়ে আসে। বলে, ‘ভাই, অমুকে আমার জায়গা বেআইনি ভাবে দখল করে নিছে, আপনার বন্ধুকে দিয়ে একটা ধমক দিয়ে দেন না, ভাই। যাতে জায়গাটা ছেড়ে দেয়।’
তাদেরকে ধুন ফুন বুঝাই। ঝাড়ি দিয়া বলি, ‘আরে রবিউল্লাহ বাবু এইসব কাজ করে না। জমি দখল হইছে তো মামলা করেন, কোর্ট কাচারি করেন। এই ধরনের ফালতু কাজে আমার বন্ধুকে জড়াবেন না।’
‘ভাই, ওরা পলিটিক্যাল ক্যাডার, মামলা মোকদ্দমা ভয় পায় না।’
আমি এবার প্রমাদ গুণি। ঢোক গিলে বলি, ‘ঠিকাছে, ঠিকাছে, দেখবো নে কি করা যায়! বাবুকে বলবো। কিন্তু ও যা ব্যস্ত ! ফোন ধরার সময় নাই ওর... সপ্তাহখানেক পরে আসেন ভাই।’
তবে, এই কিছুদিন আগে আমাদের পাড়ার এক অল্প বয়সী স্কুল শিক্ষিকা কোথা থেকে জেনেছেন বাবু আমার বন্ধু, তো এসে ধরলেন, তার বড় ভাইকে কে বা কারা নাকি উঠিয়ে নিয়ে গেছে, এক সপ্তাহ ধরে কোন খবর নাই, আমি যেন আমার বন্ধু বাবুকে বলে ওর ভাইকে খুঁজে এনে দেই।
স্কুল শিক্ষিকা মেয়েটি অল্প বয়সী, দেখতে সুন্দরী। কায়দা করে জেনে নিয়েছি সে অবিবাহিত’ও বটে। ফলে তার প্রতি আমার একটা অতিরিক্ত মায়া ও স্নেহ তৈরি হয়। হারিয়ে যাওয়া বড় ভাইয়ের জন্য মেয়েটির আকুল কান্না আমাকেও আপ্লুত করে। আমি তাকে উল্টা-পালটা বুঝ দিয়ে ফিরিয়ে দেই না। সান্ত্বনা দিয়ে বলি, ‘চিন্তা করবেন না। আমি আমার সাধ্যমতো চেষ্টা করবো। দরকার হলে রবিউল্লাহ বাবুর কাছে’ও যাবো।’
সেই ল্যাংটা কাল থেকে বাবু আর আমি একসঙ্গে এক গ্রামে গলাগলি করে বড় হয়েছি। মাঝে হলো ছাড়াছাড়ি, গেলেম কে কোথায়। বাবু পড়তে চলে গেল ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে আর আমি পড়ে রইলাম সদরপুর ডিগ্রি কলেজে। লিটিল ম্যাগাজিন বের করলাম একটা। সিরিয়াস সাহিত্য চর্চা শুরু করলাম। গত কয়েক বছরে পত্র পত্রিকায় বেশ কিছু গল্প ছাপা হয়েছে আমার, একটা গল্পের বই’ও বের হয়েছে গত একুশের বইমেলায়। ওদিকে রবিউল্লাহ বাবু’ও পড়া লেখা শেষ করে পেয়ে গেছে উচ্চমানের ক্ষমতাধর পদ-পদবী। সদরপুরের কৃতি সন্তান হিসেবে এলাকায় একটা সম্বর্ধনা অনুষ্ঠানে বাবুর সঙ্গে আমার পুর্নমিলন। পুরনো বন্ধুকে পেয়ে আমি যার পর নাই খুশী, সেই খুশি আরো কয়েক কোটিগুণ বেড়ে গেল যখন বাবু একদিন আমাকে নিরাপত্তাবেস্টনীতে ঘেরা ওর বহুতল ভবনের শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত অফিসে ডাকলো। তারপর থেকে একঠায় বসে আছি বাবুর সামনে। এক দফা স্যান্ডউইচ আর কফি খাওয়া হয়ে গেছে। সাক্ষাত কাল টেনে-টুনে আরো দুয়েক ঘন্টা বাড়াতে পারলে লাঞ্চটাও হয়তো এখানে সেরে নেয়া যাবে, ভাবলাম আমি। তাছাড়া সময় বুঝে স্কুল শিক্ষিকার নিখোঁজ ভাইয়ের কথাটাও একবার তুলতে হবে। মেয়েটা আমার উপর আশা করে বসে আছে। তার অশ্রু ছল ছল বড় দুটি মায়াবি চোখের কথা মনে পড়ে।
‘একটা গল্প লিখে কত টাকা পাও?’
রবিউল্লাহ বাবু জানালা থেকে চোখ সরিয়ে আমার দিকে তাকায়। অনেকেই এই প্রশ্নটা করেন। আর এর উত্তর দিতে বরাবরই বিব্রত বোধ করি আমি। কারণ বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই লেখকদের যে টাকার প্রয়োজন আছে, এটা যারা লেখা ছাপেন তারা বোঝেন না, অথবা বুঝতে চান না। লেখকের জন্য বরাদ্দ থাকে একেবারে নিম্নতম সম্মানী, তাও সেটা আদায় করতে লেখকদের যে কতবার ঘুরতে হয়! আমি আমতা আমতা করে উত্তর দিই,
‘এই পাই আর কি, যৎসামান্য ..’
‘যত পাও তার দশগুণ দেবো।’
বলে আমার চোখের দিকে খানিকক্ষণ ঠান্ডা শীতল চোখে তাকিয়ে থাকে বাবু। যেন আমার কি প্রতিক্রিয়া হয় সেটা বুঝতে চাইছে। তার তীব্র তীক্ষ্ণ দৃষ্টি বাণে আমি যথারীতি প্রবল অস্বস্তি বোধে জর্জরিত হয়ে টেবিলের নিচে দুই হাত কচলাতে থাকি।
‘আমাদের কয়েকটা গল্প লিখে দেবে, এমন গল্প যাতে যখন যেখানে চাই খাইয়ে দিতে পারি।’
আবার থামে বাবু। আমি কি উত্তর দিবো ভাবতে থাকি।
‘আমাদের সব গল্প একঘেয়ে হয়ে যাচ্ছে, বুঝলে, সব নীরস আর বেরঙ। সরস আর রঙীন গল্প চাই এখন।’
এবার আমি একটা প্রশ্ন করার সুযোগ পাই।
‘গল্পটা কি নিয়ে?’
‘কি নিয়ে গল্প বানাবে সেটা তুমি জানো। আমি শুধু ওপেনিং দৃশ্যটা বলতে পারি।’
‘বলো।’
বাবু নাটকীয় ভঙ্গীতে বলে,
‘একটা ধূ ধূ মাঠ। জন মানবহীন প্রান্তর। সেখানে উপুড় হয়ে পড়ে আছে একটা প্রাণহীন মানুষ। পুরুষ মানুষ। মানুষটি অপরাধি।’
‘তারপর?’
‘তারপর তুমি বানাবে। বানাও।’
হাতে তুড়ি দিয়ে বলে রবিউল্লাহ। অনেকটা ‘খেলা দেখাও’- বলার মতো করে। আমি স্কুল শিক্ষিকার নিরুদ্দেশ ভাইয়ের কথাটা কিভাবে বলা যায় তা নিয়ে ভাবতে থাকি। বাবু তার টেবিলে টোকা দেয়,
‘কি হলো? চুপ মেরে গেলে যে ..’
‘আমি আসলে, মানে একটা মেয়ের ভাই হারিয়ে গেছে, তোমার কাছে তার কোন খোঁজ আছে কিনা .. মানে ..তুমি যদি একটু দেখতে .. ’
বাবু বলে, ‘কত বড় ভাই? বয়স কত?’
‘বয়স আটাশ/ উনত্রিশ হবে।’ বলি আমি।
বাবু হো হো করে হাসে।
‘আটাশ/ উনত্রিশ বছর বয়সের কেউ হারায় নাকি? কোথায় পালিয়েছে দেখো..’
আমি ওর মুখের উপর কি বলবো ভেবে পাই না।
‘আরে মিয়া, গল্পটা বানাও, ওই যে একটা মানুষ একা একটা খোলা প্রান্তরে মরে পড়ে আছে। আর মনে রেখো সে কিন্তু অপরাধী। কে জানে ওই মানুষটাই আবার তোমার সেই মেয়েটার ভাই কিনা ...’
বাবুর কথা শুনে আমার চেহারায় নিশ্চয়ই কোন পরিবর্তন ফুটে উঠেছিল। আর সেজন্যই হয়তো বাবু সাথে সাথে তার কথা ঘুরিয়ে নিয়ে বললো, ‘আরে না, ঠাট্টা করলাম। বলো, গল্পটা বলো.. কিভাবে ঘটনাটা সাজাবে বলো।’
আমি তখন অনেকটা স্বয়ংক্রিয়ভাবে গল্পের পরবর্তী অংশ বলতে শুরু করি, ‘মানুষটির পায়ে ছিল সস্তা কেডস্, পরনে রঙজ্বলা জিনসের প্যান্ট আর একটা বাদামী রঙের দুমড়ানো-মোচড়ানো শার্ট। ঘাসের উপর আলতো করে পড়ে থাকা তার রোমশ হাতের কব্জিতে একটা পাতলা ষ্টেনলেস ষ্টীলের রুপালি বেল্টের ঘড়ি, এখনো টিক্ টিক্ করে ঘড়ির কাঁটা দুটি ঘুরে চলছে, যদিও কিভাবে যেন ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে ঘড়ির উপরের কাঁচটা। পড়ে থাকা মানুষটিকে ঘিরে কৌতুহলী জনতার নিঃশব্দ ভীড়। সবাই তাকিয়ে আছে তার দিকে কিন্তু কেউ কোন কথা বলছে না।’
‘আহ্, বড্ড ডিটেইলে যাচ্ছো তুমি, এরকম না, ঘটনায় মোচড় আনো। মানুষের অতো সময় নাই যে তোমার এইসব ডিটেইলস বর্ণনা পড়বে।’
বাবু বিরক্তি প্রকাশ করে।
‘আহ্, অতো অধৈর্য্য হয়ো না, বন্ধু, একটু অপেক্ষা করো। গল্পকে গল্প হয়ে উঠতে সময় দিতে হয়, গল্প নির্মাণে দালানের মতোই একটার পর একটা ইট গাঁথতে হয়। নইলে গল্পের গাঁথুনি দুর্বল হয়ে যায়।’ আমি বলি।
‘আরে, না, না, শোনো, বুঝলাম, কিন্তু এসব কি বলছো তুমি? নিঃশব্দ ভীড় ? নিঃশব্দ হবে কেন? সশব্দ ভীড়। মানুষের চোখে মুখে তীব্র আনন্দ, কন্ঠে উল্লাস, ভুলে গেছো, পড়ে থাকা মানুষটা অপরাধি?’
‘না ভুলি নাই। বলছি। মানুষটা তাহলে জীবনে অনেক অপরাধ করেছিল। খুন, ধর্ষণ, চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, চাঁদাবাজি, অগ্নি সংযোগ, লুটপাট এমন সব ধরনের জঘন্য অপরাধ। থানায় তার নামে অসংখ্য মামলা ছিল।’
‘মামলা যে থাকবেই, তা নয়, অনেক সময় তো লোকে ভয়ে মামলা করে না, তাই না?’
‘ঠিক আছে। একটা মানুষ যে এতগুলো অপরাধ করে, তার তো আসলে শান্তিতে থাকার কথা না, তার অপকর্মগুলি কিছুতেই তার পিছু ছাড়ে না, সারাক্ষণই সেগুলি তার সঙ্গে ঘুরে বেড়ায়, তাকে উত্যক্ত করে, তার মনকে ভারাক্রান্ত করে রাখে এবং এক সময় সে নিজেই তার মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়ায়। নিজের কৃতকর্মের হাতেই সে খুন হয়। পড়ে থাকে জনহীন প্রান্তরে।’
‘মন্দ নয়। তবে বড্ড বিমূর্ত। মূর্ত করো।’
‘এমন’ও হতে পারে যে, অপরাধি আসলে নিজের কর্মকাণ্ডের জন্য অনুতপ্ত হলো, প্রচন্ড অপরাধবোধে আক্রান্ত হলো। তার মনে হলো, যেসব অপরাধ সে করেছে, সেসব অপরাধের ক্ষমা নেই। তার হয়তো আরো মনে হলো, তার পাহাড় সমান অপরাধের বিচার অন্য কেউ-ই করতে পারবে না, কারণ বিচার ব্যবস্থার উপর তার অবিশ্বাস ছিল, সে রবীন্দ্রনাথের উপন্যাসে পড়েছিল, যে দুর্বল সে সুবিচার করতে সাহস করে না; ন্যায়পরতার দায়িত্ব এড়িয়ে অন্যায়ের দ্বারা সে তাড়াতাড়ি ফল পেতে চায়।’ একারণেই বোধহয় লোকটা নিজের বিচার নিজেই করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। আর তাই, একটা সময় সে নিজেই নিজেকে মৃত্যুদণ্ড দিয়ে দিল।’
‘চমৎকার। সে তাহলে আত্মহত্যা করলো। মাথার পেছনে যে গুলির দাগ, তার জন্য অন্য কেউ নয় বরং সে নিজেই দায়ী। আর কোন আইডিয়া?’
‘আরেকটা আছে। সেটা হলো অপরাধি মানুষটা আসলে পথ হারিয়ে ফেলেছিল। বলতে পারো, পথ হারাতে বাধ্য হয়েছিল। আর পথ হারিয়ে অ-মানুষের জঙ্গলে কিছু মানুষ-খেকোর কবলে পড়েছিল সে। অন্য ভাবে’ও বলা যায়, কিছু প্রাণ-খেকোর কবলে পড়েছিল সে, যারা তার দেহটা রেখে প্রাণ নিয়ে পালিয়ে গেছে।’
রবিউল্লাহ বাবু মাথা ঝাঁকায়, ‘এটাও ঠিক আছে, তবে একটু অবাস্তব, এই যা, ম্যাজিক-রিয়েলিজম করছো নাকি? এই অঞ্চলে মানুষখেকো তুমি পাবে কোথায়?’
আমি বাবুকে তার নিজের কথাই ফিরিয়ে দিয়ে বলি, ‘কেন? তুমিই না বলেছিলে মানুষের মধ্যে মানুষ-খেকোরা লুকিয়ে থাকে। তুমি হয়তো তাদের চিনতে পারো না, কিন্তু কেউ কেউ ঠিকই তাদের চিনতে পারে। বন্ধু, আমার মনে হচ্ছে আমি তাদের চিনেছি।’
লেখক পরিচিতি
শাহনাজ মুন্নী
শাহনাজ মুন্নীর জন্ম ১৯৬৯-এর ৮ ফেব্রুয়ারি, ঢাকায়। সমাজবিজ্ঞানে মাস্টার্স করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। তিনি পেশায় টেলিভিশন সাংবাদিক। এটিএন বাংলার নিউজ এডিটর। সাংবাদিক হিসেবে বেশ জনপ্রিয়তা পেলেও তিনি মূলত লেখক। এ পর্যন্ত গল্প উপন্যাস গবেষণা মিলিয়ে তার বইয়ের সংখ্যা আঠারোটি। তার স্বভাবে আছে এক ধরণের নির্মোহতা। শিল্পেও তার প্রভাব দেখা যায়। তার গল্পে সবসময়ই একটা গল্প থাকে। চরিত্রগুলো বিকশিত হয় সহজিয়া প্রেরণায়। জবরদস্তি নয়, সহজাত নির্দেশনা ধরেই যেন তার কথাশিল্পের চরিত্রগুলো নিজস্ব পথে পদচারণা করেন। তার কথাশিল্পের ভাষা রসবোধসম্পন্ন, কাব্যসংলগ্ন ও স্বতস্ফূর্ত। মুন্নীর কবিতাও তার ব্যক্তি স্বভাবের মতোই অউচ্চকিত। মৃদুভঙ্গীতে তিনি মোক্ষম বোধটি ব্যক্ত করে ফেলেন। যার অনুরণন থেকে যায় ঢেউ মিলিয়ে যাবার পরও।
1 মন্তব্যসমূহ
'বন্ধু, আমার মনে হচ্ছে আমি তাদের চিনেছি।’
উত্তরমুছুনআমরা সবাই এখন তাদের চিনি। সমসাময়িক পরিস্থিতির সার্থকভাবে গল্পে প্রতিফলনের কৌশলটি খুবই চমৎকার। খুব ভালো লাগলো ।