বাণী বসু
ন’টা বা সওয়া ন’টার ট্রেনটা তাকে ধরতেই হবে৷ মাধবী তাড়াতাড়ি শাড়ির ভাঁজ ঠিক করে৷ সালোয়ার-কামিজ কী প্যান্ট পরলেই সুবিধে হত, কিন্তু যে কাজে যাচ্ছে তাতে ওগুলো ঠিক…৷
ঠিক সময়েই শেষ পর্যম্ত ঢুকতে পারল সে হাওড়া স্টেশনে, কিন্তু এ যে জনসমুদ্র? কোথায় টিকিট ঘর কোথায় কী, কিছুতেই ঠাহর হয় না৷ অথচ এককালে তারা বন্ধুরা দল বেঁধে কোথাও বেড়াতে গেলে জড়ো হওয়ার জায়গা ছিল আদি অকৃত্রিম বড় ঘড়ির তলা৷ কত টিকিট কেটেছে! কত ট্রেন মিস করেছে! সেই স্মৃতির মধ্যে প্রাণপণে ডুব দিয়ে সে দিকদিশা খুঁজতে লাগল এবং উত্তাল সাগরের মধ্যে দিয়ে সাঁতরে সাঁতরে কোনও কালের চেনা টিকিট ঘরে পৌঁছে ঈপ্সিত টিকিটটি দিব্যি কিনে ফেলল৷
প্ল্যাটফর্ম আবার আরেক হার্ডল৷ সত্যি, কত বছর যে তার এমন ভিড় দ্যাখা অভ্যেস নেই! সবাই ছুটছে, মুখচোখের ভাব দেখে মনে হয় না অফিস-কাছারির উদ্দেশ্যে, মনে হয় বুঝি সব কোনও এল ডোরাডোর হদিশ পেয়েছে৷
— মাধু! মাধু! এ কী, কেউ কি তাকেই ডাকছে? সম্ভব নয়৷ কিন্তু সম্ভবই হল৷ পিছন থেকে হাঁফাতে হাঁফাতে এসে কেউ তার কাঁধে হাত রাখল, নব্বই ডিগ্রি কোণে ঘুরে মাধবী প্রথমে তাকায়, চিনি চিনি করে তবু চিনতে পারে না, তারপরে চিকরে ওঠে যাকে বলে!
— আরে চিনু না! সত্যি তুই! সত্যি! বিস্ময়ে, আহ্লাদে ফেটে পড়ে মাধু৷
— দূর থেকে তুই-তুই মনে হচ্ছিল, চিনু বলল, কিন্তু বিশ্বাস করতে পারিনি৷ এক যুগ পরে….৷
সে-ই হাওড়ার ইস্টিশনে পাঁচ নম্বর প্ল্যাটফর্মে হম্তদম্ত হয়ে মাধবী দত্ত! এ রকম সারপ্রাইজ আমি….৷
— সারপ্রাইজ তো আমার রে, মাধু গালগলা ভরে হেসে ফেলল, কোথায় না কোথায় থাকি, গ্লোবের উল্টো দিকে, এ অক্ষাংশ দ্রাঘিমায় আমার কোনও বন্ধু আর টিকে আছে বলে ভাবিনি৷
— হ্যাঁ, কানেকটিকাট-এ থাকা মানেই তো সব কানেকশন কাট করে দেওয়া, চিন্ময়ীর গলায় কি অভিমানের সুর? কত দিন পর পর কলকাতার বুড়ি ছুঁতে আসিস রে?
— বলেছিস ঠিকই, মাধু একটু গম্ভীর হয়ে বলে— মা চলে যাওয়ার পর আসা একদমই কমে গেছে৷ ছুটি পাওয়াও তো শক্ত! তবে এবার অনেক কষ্টে হপ্তা দুইয়ের ছুটি ম্যানেজ করেছি৷ একটা বিশেষ কাজে আসতে হয়েছে৷ দুজনে চলতে চলতে ভীষণ উত্তেজিত গলায় কথা বলেই যাচ্ছে বলেই যাচ্ছে, অর্ধেক শুনতে পাচ্ছে না প্ল্যাটফর্মের গোলমালে, কিন্তু তাতে কী?
একটু পরে চিনু কিন্তু-কিন্তু করে বলেই ফেলল—
— কী বিশেষ কাজ রে? যদি কিছু মনে না করিস!
— মনে করার কিছু নেই, মাধু কী রকম নেবা নেবা গলায় বলল, ব্যাপারখানা হল, আমার হাজব্যান্ডের যে কী এক অসুখ হল কেউ ধরতে পারে না৷ মাথায় অসম্ভব যন্ত্রণা, যখন হয় অজ্ঞান হয়ে যায়৷ বোর্ড বসিয়ে চিকিৎসা হল, সার্জারি হল, এখন একটু ভালর দিকে, কিন্তু ধরবার-ছোঁবার মতো কিছু নেই, নো ডায়াগনোসিস৷ যে কোনও দিন জিনিসটা রেকার করতে পারে৷ কাঁটা হয়ে থাকি সবাই৷ ও দিকে এই, আর এদিকে আমি একটার পর একটা স্বপ্ন দেখে চলেছি৷ কখনও দেখছি কালীঘাট, সারে সারে রক্তজবা সাজানো রয়েছে, যেন ডাকছে, কখনও দেখছি তারকেশ্বরের মাথায় জল ঢালছি, অমনি সব জল লাল হয়ে যাচ্ছে, রক্ত না কী জানি না বাবা! কখনও আবার দক্ষিণেশ্বর….৷ নাটমন্দিরে দাঁড়িয়ে আছি….৷ ভীষণ ভিড়….৷ কিছুতেই ভবতারিণীর মুখটা দেখতে পাচ্ছি না৷ কী রকম মিনিংফুল স্বপ্ন বল….৷ যেমন করে পারি ছুটি নিয়ে চলে এলাম৷
চিনু বলল— এগো এগো মাধু, অফিসটাইম, ঠ্যালা খেতে খেতে যে প্রাণ গেল….৷ তা তুই কি এ সব বিশ্বাস করিস? এই কালী৷…৷ ভোলে বাবা৷…৷ ভবতারিণী৷…৷
মাধু নিঃশ্বাস ফেলে বলল, কেন জিগ্যেস করছিস জানি৷ পরীক্ষার সময়ে তোর কপালে দইয়ের ফোঁটা আর রুমালে ঠাকুরের ফুল নিয়ে কি কম খেপিয়েছি! কী জানিস চিনু, সে থেমে থেমে বলে, এখন বুঝি মানুষ সে ভাবে র্যাশন্যাল হয় না, হতে পারে না, প্রিয়জনের বিপদ হলে মানুষ সব মানে, জ্যোতিষ, মন্ত্রতন্ত্র, ভর, স্বপ্নদর্শন৷…৷ সব….৷ সব৷ সুখের কথা কালীঘাট নির্বিঘ্নে সারা হয়ে গেছে, দক্ষিণেশ্বরও পরশু কমপ্লিট করেছি৷ আজ তারকেশ্বর৷ তোর সঙ্গে দেখা হয়ে যে কী ভাল লাগছে! সে হেসে বলল, তা তুই-ই বা এত সকালে হম্তদম্ত হয়ে যাচ্ছিস কোথায়?
চিনু হেসে বলল, তুইও যেখানে আমিও সেখানে, তুই যাচ্ছিস বাবার মাথায় জল ঢালতে, আর আমি যাচ্ছি মায়েদের শ্রীমস্তকে কিঞ্চিৎ ঘৃত সিঞ্চন করতে৷
মাধু অবাক হয়ে বলল, মানে?
আরে ওখানে মেয়েদের স্কুলে পড়াই, বুঝলি না?
স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে মাধু— তাই বল৷ একই রকমের ফাজিল….৷ রয়ে গেলি….৷ তা রোজ এই ডেলি প্যাসেঞ্জারি করিস? বলিস কী রে?
চিনু হাসতে লাগল, ডেলি প্যাসেঞ্জারিটা রোজই করতে হয়, জানিস না?
— ভাল বলেছিস৷
মাধু মনে মনে ভাবল, তাই চিনুটার চেহারাটা এত খারাপ হয়ে গেছে, এই ভিড় ঠেলে প্রতিদিন যাওয়া আসা! চেহারার কথা বললে মনে বড্ড কষ্ট হয়, সে বলল, স্বাস্হ্যের দিকে নজর দে চিনু৷
চিনু ভিড় ঠেলতে ঠেলতে বলল, আর স্বাস্হ্য! ডেলি প্যাসেঞ্জারি আছে ডেলি রাঁধুনিগিরি আছে, নার্সগিরি, দাসীগিরি সবই তো চলছে আদ্যিকালের মতো৷ কোথাও কি কোনও ছাড় আছে আমাদের?
এই সময়ে ইলেকট্রিক ট্রেনের শাঁখের মতো আওয়াজটা পাওয়া গেল, চিনু বলল, এই রে! গল্প করতে করতে ট্রেনটা না মিস করি৷ পা চালিয়ে আয় মাধু, সে প্রায় কনুই ধরে টানতে টানতে নিয়ে চলল তার বন্ধুকে, সামনে যে কামরাটা পেল উঠে পড়ল৷
মাধু বলল, দ্যাখ হাজার হাজার মাইল প্লেনে একলা যাতায়াত করি ভয় করে না, এ দেশে এসে সামান্য ট্রাম ট্রেনে চড়তে কেমন নার্ভাস হয়ে যাই৷ কালীঘাটেও কী ভিড়! দক্ষিণেশ্বরটা বরঞ্চ কম্পেয়ারেটিভলি বেটার৷
তারকেশ্বরের মন্দিরটন্দির জীবনে কখনও যাইনি৷ ভালই হল, তোকে পেয়ে গেলাম৷
এই সময়ে চিনু অবাক হয়ে বলে উঠল— আরে! এমন ফাঁকা কামরা তো জন্মে দেখিনি৷
সত্যিই কামরাটাতে একটি প্যাসেঞ্জারও এখনও পর্যম্ত নেই৷ সে মাধুকে সাবধান করে দিল, ফেরবার সময়ে আমি থাকব না, তখন কিন্তু লোকজনওয়ালা কামরা দেখে উঠিস৷
দুজনে মৌজ করে জানলার ধারে বসল মুখোমুখি৷ মুখ হাসিতে ঝলমল করছে৷ এই মুহূর্তের জন্যে সব ভাবনা চিম্তা উদ্বেগ নালিশ দুজনেই ভুলে গেছে৷
মাধবী বলল, তুই ছিলি বলেই এত আরামে যেতে পারছি৷ আফটার অল তুই ডেলি কমিউটার, ঘোঁতঘাঁত সব জানিস৷
চিন্ময়ী ঠোঁট উল্টোল, ছাই জানি৷ তোর পয়েই এমন ফাঁকা কামরা পাওয়া৷ আহ, কী আরাম!
ট্রেন ছাড়ল৷
হুশ হুশ করে ট্রেন গতি নেয়, আর দূরে সরে সরে যায় প্ল্যাটফর্মের কোলাহল৷ ফাঁকা কামরা, দুজন শুধু দুজনকে ঘিরে যেন সময় পাক খায়৷ সুতো ছাড়ে, আস্তে আস্তে খুলতে থাকে সময়ের জট৷
— কী ব্যাপার বল তো? কোনও গণ্ডগোল আছে নাকি কামরাটাতে? মাধু একবার ভুরু কুঁচকে বলেছিল৷ তাদের ওখানে শেলটন থেকে নিউ ইয়র্ক তারা অ্যামট্রেকের ট্রেনে হামেশাই যাচ্ছে-আসছে, এই রকমই শব্দহীন, ভিড়হীন, কিন্তু এ তো আর কানেকটিকাট নয়! এখানে ট্রেন ট্রাভল, শুধু ট্রেন কেন যে কোনও পাবলিক ট্রান্সপোর্টে যাতায়াত যে কী দুর্ভোগ যাত্রা, সেটা প্রতিবার এসে নতুন করে বুঝতে হয়!
— কেন এমন ফাঁকা কে জানে! হতে পারে ইলেকট্রিসিটি আসছে না, ফ্যানট্যানগুলো খারাপ কিংবা অন্য কিছু, চিনু তাকে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করে, ফটফটে দিনের বেলা, ভয়ের কী আছে? তেমন কিছু অসুবিধে থাকলে রেলওয়ের লোকেরাই আমাদের সাবধান করে দিত…৷
আর সত্যিই তো তারা কামরাটাতে একা হতে পারে কিন্তু বাইরে তো মানুষ দ্যাখা যাচ্ছে! ঝাঁকা মাথায়, টোকা মাথায়, থলে হাতে৷ শটাশট সরে যাচ্ছে, না-ই বা হল চেনাজানা, মানুষই তো!
তবে, চিনু বেশিক্ষণ এ সব নিয়ে মাথা ঘামাবার পাত্র নয়, সে টুক করে স্মৃতির কোটরে ঢুকে যায়— আচ্ছা মাধু, সেই দুপুরগুলোর কথা তোর মনে আছে? তোদের অভয় গুহ রোডের চিলেকুঠুরি? কী রোম্যান্টিক ছিল না? কত প্রাণের কথা মনের কথা! দুপুরগুলো যেন অলৌকিক ছিল রে!
মাধুর চোখের দৃষ্টি সে সব দিনের কথায় ততক্ষণে মুড বদল করেছে৷ সে বলল, তুই বললি তাই৷ নইলে….৷ একেবারে ভুলে গিয়েছিলাম৷ সত্যি কী দিনই ছিল! সে বাড়ি আর নেই, জানিস? বিক্রি হয়ে গেছে বাবা চলে যাওয়ার পর৷ আহা কী বাড়িই ছিল! কেমন স্মৃতিজাগানিয়া, সুখজাগানিয়া তার আনাচকানাচগুলো! চিলেকোঠাটায় বসলে মনে হত পৃথিবী থেকে একদম আলাদা কোনও গ্রহে চলে এসেছি৷ কাঁ কাঁ করে কাকের বাচ্চা ডাকত৷…৷ চিল উড়ত ডানা ছড়িয়ে, দূরে দূরে তাল, নারকেল, পায়রা ওড়ানোর শিস শীতের দিনে…৷
— এই তো মুডে এসে গেছিস, চিনু হেসে বলল, মনে আছে? একদিন আমাকে বলেছিলি, শ্রাবণ মাসে একদিন তোকে দুপুরের জ্যোৎস্না দেখাব৷
মাধু এই সব রোমান্টিক রোমম্হনে একটুও লজ্জা পেল না, বলল, আসলে বর্ষাকালে, সূর্য মেঘের আড়ালে গেলে একটা অদ্ভুত আলো ফোটে, সেটাকেই জোছনা বলতাম….৷ চিনু প্লিজ অন্য কথা বল, আমার সে সব মনে করতে ভাল লাগছে না৷
তার বিষন্ন মুখের দিকে তাকিয়ে একটু ইতস্তত করে চিনু আস্তে বলল, তোর কি আরও অনেক কথা মনে পড়ে যাচ্ছে?
মাধু মাথাটা একবার ঝাঁকিয়ে নিল, তার মনটা হঠাৎ হু হু করে উঠেছে৷
চিনুর কথার কোনও উত্তর হয় না৷ দুজনেই সেটা জানে৷ সে অবশেষে ছোট্ট গলায় জিগ্যেস করল—
— পরাশর এখন কোথায় রে?
— প্রশ্নটা এ’পে’ করছিলুম, চিনু থেমে থেমে বলল, না জিগ্যেস করলে খুব দুঃখ পেতুম৷ কোথায় থাকতে পারে? তুই-ই বল!
— কেন রে? ভীষণ উদ্বেগের গলায় মাধু বলল, কিছু হয়েছে? চিনু সত্যি কথা বল৷ মারা গেছে? মারা গেছে, না? এ আমি জানতাম!
— দূর দূর, তুই তো আচ্ছা বোকা মেয়ে! ব্রঙ্কিয়্যাল অ্যাজমায় কেউ মরে না মাধু, পরাশর পুরুলিয়ার দিকে ট্রাইব্যাল বেল্টে কী একটা সরকারি প্রজেক্টে কাজ করে৷ এ দিকে আর আসেই না৷ আর মজা কী জানিস? শুকনো জায়গায় থেকে থেকে ওর ও রোগ কবেই সেরে গেছে! তাগড়াই স্বাস্হ্য হয়েছে শুনেছি৷ ভালই আছে,
….৷ আর তা যদি বলিস ভাল না থাকলেই বা তোর কী? কত লোক তো ভাল নেই, কত লোক নিত্য মারা যাচ্ছে৷ নিঃসম্পর্ক লোকের ভালমন্দের কথা ভাবতে গেলে চলে?
মাধু একেবারে চুপ করে গেল৷ দুজনেই এখন চুপ করে শুধু ট্রেনের চলার আওয়াজ শুনছে বা শুনছে না৷
কিছুক্ষণ পরে চিনু বলল, সর্যি মাধু, প্লিজ রাগ করিস না৷ ছাড় ও সব কথা৷ ….৷ এই তোর মনে আছে, তোর সঙ্গে আমার কী কম্পিটিশন ছিল? যত ঝগড়া তত ভাব!
মাধুর মুখ থেকে বিষন্নতা এবার আস্তে আস্তে সরে গেল, সে জায়গায় একটু মজা পাওয়া হাসি ফুটে উঠল, সে বলল, মনে আবার নেই? আমি বেশি মার্কস পেলে তুই যা রাগান রেগে যেতিস!
— ভ্যাট, কক্ষনো না৷ চিনুর মুখ লাল৷
— ভ্যাট মানে? মনে নেই আমি ইনডাকটিভ লজিক বুঝতে পারছিলাম না, কলেজে সেই রেন ট্রি-টার তলায় বসে বসে তুই বুঝিয়ে দিলি, স্যাটারডে টেস্টে বেশি মার্কস পেয়ে গেলাম আমি! তিনদিন তুই আমার সঙ্গে বাক্যালাপ করিসনি৷ বললে হবে?
চিনু লজ্জা পেয়ে বলল, দূর দূর, কোন কালের ছেলেমানুষি সব, তোর মনেও তো আছে! দ্যাখ তো কী স্টেশন এল?
মাধু মুখ বাড়িয়ে নামটা পড়ে বলল, দূরগ্রাম৷
চিনু একটু অবাক হয়ে গেল, দূরগ্রাম! কী জানি! আমার অবশ্য তিন বছরেও স্টেশনের নামগুলো সব মুখস্ত হল না৷ খাতা দেখতে দেখতে যাই, খাতা দেখতে দেখতে ফিরি! কিন্তু এ নামের কোনও স্টেশনের কথা৷…৷
— অত ভাবছিস কেন? মাধু বলল, লাস্ট স্টেশন তো তারকেশ্বরই রে বাবা! মাথা ঘামাবার দরকার কীঞ্জ….৷ তার পরেই সে গলার স্বর একেবারে পাল্টে বলে, আচ্ছা চিনু হঠাৎ একটা কথা মনে হল, ধর যদি আমরা সেই সময়টা আবার ফেরত পেতুম? ভুলগুলো সব বেশ শুধরে নেওয়া যেত, তাই না?
চিনু বলল, নিশ্চয়ই! এবার আর বেশি মার্কস পেলে তোর সঙ্গে ঝগড়া করছি না৷ কিন্তু জীবন কী অদ্ভুত দ্যাখ, পরাশরকে তুই ওর রোগের জন্যেই বিয়ে করলি না, অথচ তোর স্বামী এখন কী দুরারোগ্য ব্যাধিতে ভুগছেন!
দুজনের মধ্যে একটা নীরবতা নামল৷ বাইরে দৃশ্যপট বদলাচ্ছে, গ্রামাঞ্চলের সবুজ, লালচে মাটি, পাখিদের ডিগবাজি কিন্তু সে দিকে কেন কে জানে কারোই মন নেই৷
মাধু অন্যমনস্ক গলায় বলল, পরাশর তা হলে সেরে গেল? আসলে আমি সরে যেতেই সেরে গেল! ডেসটিনি!
….৷ তারপরে হঠাৎ একটু ঝুঁকে পড়ে বলল, তা তুই এ নিয়ে এত মাথা ঘামাচ্ছিস কেন বল তো? তুই আলাপ করিয়ে দিয়েছিলি বলে? বলতে বলতে সে সামান্য একটু তেতোমতো হাসল৷
— বলতে পারিস! নৈতিক দায় তো একটা থেকেই যায়! ভগ্নদূতের রোলটাও তো আমাকেই প্লে করতে হল কিনা! নিজের বন্ধু সম্পর্কে প্রতারক ঠগ শুনতেই কি কারও ভাল লাগেঞ্জ
মাধু চমকে উঠে বলল, তাই বলেছে না কী?
— বলতেই পারে! বললে দোষ কোথায়?
মাধু আস্তে আস্তে কেটে কেটে বলল— জানি না, হয় তো নেই৷ আচ্ছা আমি না হয় ওরকম কাওয়ার্ডের মতো একটা কাজ করেই ফেলেছি, বুকে হাত দিয়ে বলতে পারিস তুই, ও রকম কিছু করিসনি!
চিনু হাঁ হাঁ করে উঠল, আমি ও সব লাইনে নেই ভাই৷ ছাপোষা মানুষ, নিজের সাধ্যমতো লেখাপড়া করে গেছি, বাবা-মা একটা ভূতের মতো দেখতে রামভুলো লোকের সঙ্গে বিয়ে দিয়ে দিয়েছে৷ যা করণীয় তাই করে যাচ্ছি প্রাণপণে৷ আর এখন পঞ্চাশে ধাক্কা দিতে চললুম, অন্য কিছু ভাবতেই হাসি পায়৷
মাধু একটু যেন দম নিয়ে বলতে লাগল, তবু যদি তোর সাউথ ইন্ডিয়ান পেন ফ্রেন্ড বেচারা আমার কাছে এসে নাকে কান্না না কাঁদত! সে এখন আমাদের শহরেই থাকে তো! মেম বিয়ে করেছিল, সে বিয়ের আয়ু জাস্ট আড়াই বছর৷ এখন একদম একা৷ দেখলে এত কষ্ট হয়! তা চিনু, সে বয়সে ফিরে গেলে আয়েঙ্গারের ওপর সুবিচার করতিস নিশ্চয়!
চিনু কি দীর্ঘশ্বাস ফেলল একটা? একটু পরে বলল, সুবিচার? সত্যি বলতে কি আয়েঙ্গারকে ফিরিয়ে দিয়ে কী-ই বা পেয়েছি! দিনগত পাপক্ষয় ছাড়া কিছু না! কুঁড়ে স্বামী, বদরাগী শাশুড়ি, চূড়াম্ত স্বার্থপর সব দেওর৷ আমাকে ঠিক আমের আঁটির মতো চুষে ছিবড়ে করে একে একে কেটে পড়েছে৷ কী পরিশ্রম করেছি রে মাধু, কী প্রাণাম্তকর জীবন৷…৷ যদি জানতিস! পুরো জীবনটাই দাসত্বে কেটে গেল৷ অথচ বাইরে থেকে দেখলে মনে হবে, বাহ, কী স্বাধীনা রমণী! কিন্তু সে মন সে বয়স তো আর ফিরে পাব না! তোতে-আমাতে সেই সব ঝগড়া সে-ও যে এখন কী মধুর লাগে! এ কে বি-র ক্লাসে সামনে বসা নিয়ে, মিসেস দে-র পক্ষপাতিত্ব নিয়ে, কলেজ ড্রামায় মেন রোল পাওয়া নিয়ে….৷
— সত্যি ব্যাপারগুলো তখন কী সিরিয়াস লাগত! মাধু হাসতে লাগল, আচ্ছা আচ্ছা অত শোক করার মতো কিছু হয়নি, কথা তো হয়েই রইল, আবার যদি সে সময়ে ফিরে যাই তবে সব শুধরে নেবো৷ দুজনেই৷ চিনু হঠাৎ হলল, আচ্ছা মাধু, আমরা কীরকম প্রাণের আনন্দে চিৎকার করে গল্প করতে করতে যাচ্ছি দ্যাখ! এটা কী করে সম্ভব হল বল তো? একটিও তৃতীয় ব্যক্তি উঠল না সারা পথ, আমরা দুই বন্ধু অনেক দিন পরে মিলেছি জানতে পেরে কি লোকে দয়া করে কামরাটা আমাদের ছেড়ে দিয়ে গেল?
— ট্রেনটা কী রকম মারাত্মক স্পিড নিয়েছে, বাইরে শুধু একটা টানা নীলসবুজ রেখা ছাড়া কিছুই বোঝা যাচ্ছে না৷ মাধু একই রকম উদ্বেগের সুরে বলল, তা ছাড়া তুই কিন্তু বলেছিলি এটা অল স্টপ ট্রেন! এত গল্পের মধ্যেও আমি খেয়াল রেখেছি তোর ট্রেন একটাও স্টেশনে দাঁড়ায়নি৷ একটু স্লো ডাউন করছে যেন থামবে থামবে কিন্তু আবার স্পিড নিচ্ছে৷ আর কী সব নাম স্টেশনগুলোর! দূরগ্রাম, নিকটগ্রাম, সময়পুর….৷ উজানগড়….৷
— দাঁড়া দাঁড়া মাধু তুই কি স্বপ্ন দেখছিস? চিনু হাঁ হাঁ করে উঠল, এ সব নাম তারকেশ্বর লাইনের কোত্থাও নেই৷ একটা ভুল হতে পারে, কিন্তু এতগুলো…৷ ইয়ারকি মারার আর জায়গা পাসনি, না? আচ্ছা ঠিক আছে, যত ইচ্ছে ইয়ারকি মার৷ অনেকক্ষণ ধরে তোকে একটা কথা জিগ্যেস করব ভাবছিলুম, ….৷ সে একটু অম্তরঙ্গ গলায় এবার জিগ্যেস করল, তুই কী মাখিস রে?
মাধু বলল, হঠাৎ?
— না তোর চেহারাটা কেমন ইয়াং ইয়াং রয়ে গেছে৷ সেই বিজ্ঞাপনে বলে না? সাম কমপ্লে’সন নেভার গ্রো!
প্রথমটা মনে হয়েছিল একটু মোটা হয়ে গেছিস, চুলগুলোও তোর কেমন পাতলা হয়ে গেছে, সেই বিখ্যাত চুল তোর! দ্যাখ, তেলে-জলে চেহারা আমাদের, পশ্চিমীরা তেল মাখে না বলে কি প্রোডিউসও করবে না? এই সব সাতপাঁচ ভাবছিলুম, তা দেখছি দিব্যি তো চুল রে তোর, কী যে ছাই দেখলুম!
মাধু বলল, তোকেও আমি ঠিক এই কথাটাই অনেকক্ষণ ধরে বলব বলব করছিলাম৷ প্রথমটা তোকে দেখে একটু ডিস্যাপয়েন্টেড হয়েছিলাম, এত রোগা আর কালো লাগছিল! কে জানে আশপাশের লোকেদের দেখতে দেখতে চোখটাই ও রকম হয়ে গিয়েছিল কিনা! এখন দেখছি পঁচিশ-ছাব্বিশ বছর আগেকার চিনুর সঙ্গে তোর তেমন কিছু বেসিক তফাত হয়ইনি৷ সেই খেলোয়াড়ি সটান ফিগার, সেই ঝকঝকে চোখ, আমাকে কী বলছিস! তোর চামড়ার বয়স একদিনও বেড়েছে বলে মনে হচ্ছে না৷ এটা কিন্তু খুব ক্রেডিট তোর!
— দ্যাখ দ্যাখ মাধু, চিনু চেঁচিয়ে উঠল, ওই ছেলেটাকে দ্যাখ, বাঁধের ওপর সাইকেলটা নিয়ে কীরকম শনশন করে চলেছে, ইচ্ছে করছে না ওর হাত থেকে সাইকেলটা ছিনিয়ে নিই, দেখিয়ে দিই স্পিড কাকে বলে!
মাধু সোৎসাহে বলে উঠল, মনে আছে আমরা ক্লাস কেটে সমানে সাইকেলে ক্যাম্পাস টহল দিতাম!
জামসেদপুরের কৃষ্ণা তৃষ্ণা দুই বোন বাগে পেলে কিছুতেই ছাড়ত না তো! না পেতাম টেবল টেনিস বোর্ড না সাইকেল!
— এস পি-র ক্লাস কেটে আমরা কেমন লরেন্স অব অ্যারেবিয়া দেখতে গিয়েছিলাম! ….৷ কী কী সব নাম রাখতাম রে প্রোফেসরদের….৷ ঘুমম্ত পুলিস, গ্যাক্সো বেবি, প্রেসার কুকুর….৷ নামগুলো কিন্তু দারুণ!
— আর ইকোয়ালি লাগসই! উফ্ফ, হাসতে হাসতে দুজনের পেট ফাটার জোগাড়৷
— এই মাধু আমি উল্টো দিকে বসেছি, দ্যাখ তো এবার কী স্টেশন এলো?
মাধু কোনওমতে হাসি থামিয়ে মুখ বাড়াল, তারপর বলল— ইচ্ছেপাড়া!
— ইচ্ছেপাড়া? চিনু প্রায় লাফিয়ে উঠল, সর্বনাশ মাধু! আমরা ভুল ট্রেনে উঠেছি, ভুল জায়গায় যাচ্ছি….৷
— ভুল জায়গা! ভুল ট্রেন? মাধুর মুখ উদ্বেগে কেমন হয়ে গেছে, সে বলল, — বলিস কীরে? ওরা যে বলল তারকেশ্বর লোকাল! তুই বললি, তোর চেনা ট্রেন! এখন কী হবে? কাল ভোরেই যে আমার ফ্লাইট!
চিনু চুপ৷ এক্কেবারে চুপ৷ তারপর সে অদ্ভুত চোখে চাইল, বলল— কিন্তু দুজনের তো টিকিট কাটতে গিয়ে একই ভুল হবে না! আমার অবশ্য মাম্হলি৷ ঠিক এই সময়ে ছাড়ে, বারো মাস তিরিশ দিন নটা পনেরোয় পাঁচ নম্বর প্ল্যাটফর্ম থেকে ট্রেন ধরছি৷
একটু পরে সে খুব শাম্ত গলায় বলল— চেনা? চেনা বলেই তো জানতুম! চেনাই তো ছিল৷ তুই আসতেই কি তবে সব হিসেব উল্টে গেল? চেনাটা অচেনা হয়ে গেল? যা কাছে ছিল তা দূরে, যা ছিল সামনে তা উজানে৷…৷ আমরা তবে কোথায় যাচ্ছি!
— কোথায়? মাধুর স্বরে এবার স্পষ্টই আতঙ্ক৷
— বোধহয় অনেক দূরে যাচ্ছি রে মাধু, সময় অসময়, দুঃসময় উজানে পেরিয়ে, অনেক অনেক দূর, তবে পরিচিত এক দূর বোধহয়৷ লাস্ট স্টেশন এলেই চিনতে পারব, ঠিক যেমন তোকে চিনতে পারছি পঁচিশ বছর আগেকার মাধবী বলে….৷
— কী আশ্চর্য চিনু, তুইও আমাকে ইয়াং দেখছিস! মাধু থেমে থেমে বলল, তোর যে বয়সটা কী রকম কমে গেল, কামরায় যে কেউ উঠল না এই আশ্চর্যটা আমরা এতক্ষণ খেয়ালই করিনি? ব্যাপারটা কী বল তো? আমার কেমন গা শিরশির করছে!
গভীর উদ্বেগে চিনু বলল, বিজ্ঞান আমি ভাল জানি না, কিন্তু সেই ফোর্থ ডাইমেনশনের কথা তো শুনেছি অনেক৷ আমরা কি তবে কোনও ভাবে সময়ের কোনও ফাঁকফোকরে পড়ে গেছি?
মাধবীর মুখে কোনও কথা ফুটছে না৷ চিনু বলল, লাস্ট স্টপ এলে কি তবে ওদের সব্বাইকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখব? তোর পরাশর, আমার আয়েঙ্গার, অঙ্কের মাস্টারমশাই, লজিকের দিদি, স্টেট বাসে এক ভদ্রলোককে ভুল বুঝে থাপ্পড় মেরেছিলুম, অন্যান্য যাত্রীদের হাতেও উনি মার খেলেন৷…৷ মাধু ওরা বলবে না তো যা যা ভুল করেছিলে এখন স-ব শোধরাও! ওহ্ আবার সেই যন্ত্রণা, সেই আশা, সেই আশাভঙ্গ…!
মাধু মুখ নিচু করে বলল— সেই আবেগ, যা প্রাণ চায় দুম করে করে ফেলা, আবারও অমনি করে চাইব পাব না, পাব চাইব না৷…৷ দেখতে দেখতে তার স্বর কান্নায় বুজে আসতে লাগল— আমার স্বামী, আমার বিজন শুয়ে শুয়ে আমার আশায় দিন গুনছে রে! কচি মেয়েটা একা হাতে সব সামলাচ্ছে৷ ওরা সবাই আমায় বিশ্বাস করে, বিশ্বাস করে আমি ফিরব….৷ ফিরতে আমাকে হবেই ….৷ চিনু …চিনু
— বেশি রাত হয়ে গেলে আমার বাড়িতেই কি কম ভাবনা করে রে? চিনুর গলায় কান্নার ডেলা৷
আজ আমার ভোলানাথ নির্ঘাৎ থানায় যাবে৷ আমি দেখতে পাচ্ছি রাত হচ্ছে, আমার ফেরার সময় পার হয়ে গেল, ও চুলগুলো দু হাতে আঁকড়ে বসে আছে, চোখ দুশ্চিম্তায় কোটরে ঢুকে গেছে৷ দিব্যটা লেখাপড়ায় তেমন চৌখস হয়নি রে, কিন্তু চেষ্টা করে, চেষ্টাটাই তো আসল বল! আহা, ছেলেটা নতুন বড় হচ্ছে, মেজাজ সবসময়ে ঠিক থাকে না, কত বকেছি! আমি যাব না মাধু, কিছুতেই যাব না, যত ক্লাম্তিই থাক, তবু এই শ্রাম্ত শরীর এই ক্লাম্ত মন নিয়ে এই সময়েই থাকব৷ যৌবনে ফিরতে চাই না আর, অনেক মূল্য দিয়ে এখানে পৌঁছেছি৷ তার চোখ দিয়ে এবার জল গড়াতে লাগল, সেই দিকে তাকিয়ে মাধু বলল— চেনটা কোথায়? চিনু চেনটা কোথায়? একটা চেন থাকে না?
নিমেষের মধ্যে চিন্ময়ী অপর দিকে চেনটার দিকে লাফ দিয়ে এগিয়ে গেল, প্রাণপণে টেনে ধরল৷ মাধবী বাইরের দিকে মুখ করে চেঁচিয়ে উঠল— এই ড্রাইভার, এই গার্ডসাহেব, রোকো রোকো৷ ইচ্ছের বিরুদ্ধে তোমরা আমাদের কোত্থাও নিয়ে যেতে পার না৷ আমরা যাব না৷
ট্রেন ঘস ঘস করতে করতে থেমে যায়৷ তুমুল কোলাহল ঢুকে আসে জানলার মধ্যে দিয়ে৷ শেষ স্টেশন!
তারকেশ্বর! তারকেশ্বর! কে কোথায় তারস্বরে ঘোষণা করতে থাকে৷
ন’টা বা সওয়া ন’টার ট্রেনটা তাকে ধরতেই হবে৷ মাধবী তাড়াতাড়ি শাড়ির ভাঁজ ঠিক করে৷ সালোয়ার-কামিজ কী প্যান্ট পরলেই সুবিধে হত, কিন্তু যে কাজে যাচ্ছে তাতে ওগুলো ঠিক…৷
ঠিক সময়েই শেষ পর্যম্ত ঢুকতে পারল সে হাওড়া স্টেশনে, কিন্তু এ যে জনসমুদ্র? কোথায় টিকিট ঘর কোথায় কী, কিছুতেই ঠাহর হয় না৷ অথচ এককালে তারা বন্ধুরা দল বেঁধে কোথাও বেড়াতে গেলে জড়ো হওয়ার জায়গা ছিল আদি অকৃত্রিম বড় ঘড়ির তলা৷ কত টিকিট কেটেছে! কত ট্রেন মিস করেছে! সেই স্মৃতির মধ্যে প্রাণপণে ডুব দিয়ে সে দিকদিশা খুঁজতে লাগল এবং উত্তাল সাগরের মধ্যে দিয়ে সাঁতরে সাঁতরে কোনও কালের চেনা টিকিট ঘরে পৌঁছে ঈপ্সিত টিকিটটি দিব্যি কিনে ফেলল৷
প্ল্যাটফর্ম আবার আরেক হার্ডল৷ সত্যি, কত বছর যে তার এমন ভিড় দ্যাখা অভ্যেস নেই! সবাই ছুটছে, মুখচোখের ভাব দেখে মনে হয় না অফিস-কাছারির উদ্দেশ্যে, মনে হয় বুঝি সব কোনও এল ডোরাডোর হদিশ পেয়েছে৷
— মাধু! মাধু! এ কী, কেউ কি তাকেই ডাকছে? সম্ভব নয়৷ কিন্তু সম্ভবই হল৷ পিছন থেকে হাঁফাতে হাঁফাতে এসে কেউ তার কাঁধে হাত রাখল, নব্বই ডিগ্রি কোণে ঘুরে মাধবী প্রথমে তাকায়, চিনি চিনি করে তবু চিনতে পারে না, তারপরে চিকরে ওঠে যাকে বলে!
— আরে চিনু না! সত্যি তুই! সত্যি! বিস্ময়ে, আহ্লাদে ফেটে পড়ে মাধু৷
— দূর থেকে তুই-তুই মনে হচ্ছিল, চিনু বলল, কিন্তু বিশ্বাস করতে পারিনি৷ এক যুগ পরে….৷
সে-ই হাওড়ার ইস্টিশনে পাঁচ নম্বর প্ল্যাটফর্মে হম্তদম্ত হয়ে মাধবী দত্ত! এ রকম সারপ্রাইজ আমি….৷
— সারপ্রাইজ তো আমার রে, মাধু গালগলা ভরে হেসে ফেলল, কোথায় না কোথায় থাকি, গ্লোবের উল্টো দিকে, এ অক্ষাংশ দ্রাঘিমায় আমার কোনও বন্ধু আর টিকে আছে বলে ভাবিনি৷
— হ্যাঁ, কানেকটিকাট-এ থাকা মানেই তো সব কানেকশন কাট করে দেওয়া, চিন্ময়ীর গলায় কি অভিমানের সুর? কত দিন পর পর কলকাতার বুড়ি ছুঁতে আসিস রে?
— বলেছিস ঠিকই, মাধু একটু গম্ভীর হয়ে বলে— মা চলে যাওয়ার পর আসা একদমই কমে গেছে৷ ছুটি পাওয়াও তো শক্ত! তবে এবার অনেক কষ্টে হপ্তা দুইয়ের ছুটি ম্যানেজ করেছি৷ একটা বিশেষ কাজে আসতে হয়েছে৷ দুজনে চলতে চলতে ভীষণ উত্তেজিত গলায় কথা বলেই যাচ্ছে বলেই যাচ্ছে, অর্ধেক শুনতে পাচ্ছে না প্ল্যাটফর্মের গোলমালে, কিন্তু তাতে কী?
একটু পরে চিনু কিন্তু-কিন্তু করে বলেই ফেলল—
— কী বিশেষ কাজ রে? যদি কিছু মনে না করিস!
— মনে করার কিছু নেই, মাধু কী রকম নেবা নেবা গলায় বলল, ব্যাপারখানা হল, আমার হাজব্যান্ডের যে কী এক অসুখ হল কেউ ধরতে পারে না৷ মাথায় অসম্ভব যন্ত্রণা, যখন হয় অজ্ঞান হয়ে যায়৷ বোর্ড বসিয়ে চিকিৎসা হল, সার্জারি হল, এখন একটু ভালর দিকে, কিন্তু ধরবার-ছোঁবার মতো কিছু নেই, নো ডায়াগনোসিস৷ যে কোনও দিন জিনিসটা রেকার করতে পারে৷ কাঁটা হয়ে থাকি সবাই৷ ও দিকে এই, আর এদিকে আমি একটার পর একটা স্বপ্ন দেখে চলেছি৷ কখনও দেখছি কালীঘাট, সারে সারে রক্তজবা সাজানো রয়েছে, যেন ডাকছে, কখনও দেখছি তারকেশ্বরের মাথায় জল ঢালছি, অমনি সব জল লাল হয়ে যাচ্ছে, রক্ত না কী জানি না বাবা! কখনও আবার দক্ষিণেশ্বর….৷ নাটমন্দিরে দাঁড়িয়ে আছি….৷ ভীষণ ভিড়….৷ কিছুতেই ভবতারিণীর মুখটা দেখতে পাচ্ছি না৷ কী রকম মিনিংফুল স্বপ্ন বল….৷ যেমন করে পারি ছুটি নিয়ে চলে এলাম৷
চিনু বলল— এগো এগো মাধু, অফিসটাইম, ঠ্যালা খেতে খেতে যে প্রাণ গেল….৷ তা তুই কি এ সব বিশ্বাস করিস? এই কালী৷…৷ ভোলে বাবা৷…৷ ভবতারিণী৷…৷
মাধু নিঃশ্বাস ফেলে বলল, কেন জিগ্যেস করছিস জানি৷ পরীক্ষার সময়ে তোর কপালে দইয়ের ফোঁটা আর রুমালে ঠাকুরের ফুল নিয়ে কি কম খেপিয়েছি! কী জানিস চিনু, সে থেমে থেমে বলে, এখন বুঝি মানুষ সে ভাবে র্যাশন্যাল হয় না, হতে পারে না, প্রিয়জনের বিপদ হলে মানুষ সব মানে, জ্যোতিষ, মন্ত্রতন্ত্র, ভর, স্বপ্নদর্শন৷…৷ সব….৷ সব৷ সুখের কথা কালীঘাট নির্বিঘ্নে সারা হয়ে গেছে, দক্ষিণেশ্বরও পরশু কমপ্লিট করেছি৷ আজ তারকেশ্বর৷ তোর সঙ্গে দেখা হয়ে যে কী ভাল লাগছে! সে হেসে বলল, তা তুই-ই বা এত সকালে হম্তদম্ত হয়ে যাচ্ছিস কোথায়?
চিনু হেসে বলল, তুইও যেখানে আমিও সেখানে, তুই যাচ্ছিস বাবার মাথায় জল ঢালতে, আর আমি যাচ্ছি মায়েদের শ্রীমস্তকে কিঞ্চিৎ ঘৃত সিঞ্চন করতে৷
মাধু অবাক হয়ে বলল, মানে?
আরে ওখানে মেয়েদের স্কুলে পড়াই, বুঝলি না?
স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে মাধু— তাই বল৷ একই রকমের ফাজিল….৷ রয়ে গেলি….৷ তা রোজ এই ডেলি প্যাসেঞ্জারি করিস? বলিস কী রে?
চিনু হাসতে লাগল, ডেলি প্যাসেঞ্জারিটা রোজই করতে হয়, জানিস না?
— ভাল বলেছিস৷
মাধু মনে মনে ভাবল, তাই চিনুটার চেহারাটা এত খারাপ হয়ে গেছে, এই ভিড় ঠেলে প্রতিদিন যাওয়া আসা! চেহারার কথা বললে মনে বড্ড কষ্ট হয়, সে বলল, স্বাস্হ্যের দিকে নজর দে চিনু৷
চিনু ভিড় ঠেলতে ঠেলতে বলল, আর স্বাস্হ্য! ডেলি প্যাসেঞ্জারি আছে ডেলি রাঁধুনিগিরি আছে, নার্সগিরি, দাসীগিরি সবই তো চলছে আদ্যিকালের মতো৷ কোথাও কি কোনও ছাড় আছে আমাদের?
এই সময়ে ইলেকট্রিক ট্রেনের শাঁখের মতো আওয়াজটা পাওয়া গেল, চিনু বলল, এই রে! গল্প করতে করতে ট্রেনটা না মিস করি৷ পা চালিয়ে আয় মাধু, সে প্রায় কনুই ধরে টানতে টানতে নিয়ে চলল তার বন্ধুকে, সামনে যে কামরাটা পেল উঠে পড়ল৷
মাধু বলল, দ্যাখ হাজার হাজার মাইল প্লেনে একলা যাতায়াত করি ভয় করে না, এ দেশে এসে সামান্য ট্রাম ট্রেনে চড়তে কেমন নার্ভাস হয়ে যাই৷ কালীঘাটেও কী ভিড়! দক্ষিণেশ্বরটা বরঞ্চ কম্পেয়ারেটিভলি বেটার৷
তারকেশ্বরের মন্দিরটন্দির জীবনে কখনও যাইনি৷ ভালই হল, তোকে পেয়ে গেলাম৷
এই সময়ে চিনু অবাক হয়ে বলে উঠল— আরে! এমন ফাঁকা কামরা তো জন্মে দেখিনি৷
সত্যিই কামরাটাতে একটি প্যাসেঞ্জারও এখনও পর্যম্ত নেই৷ সে মাধুকে সাবধান করে দিল, ফেরবার সময়ে আমি থাকব না, তখন কিন্তু লোকজনওয়ালা কামরা দেখে উঠিস৷
দুজনে মৌজ করে জানলার ধারে বসল মুখোমুখি৷ মুখ হাসিতে ঝলমল করছে৷ এই মুহূর্তের জন্যে সব ভাবনা চিম্তা উদ্বেগ নালিশ দুজনেই ভুলে গেছে৷
মাধবী বলল, তুই ছিলি বলেই এত আরামে যেতে পারছি৷ আফটার অল তুই ডেলি কমিউটার, ঘোঁতঘাঁত সব জানিস৷
চিন্ময়ী ঠোঁট উল্টোল, ছাই জানি৷ তোর পয়েই এমন ফাঁকা কামরা পাওয়া৷ আহ, কী আরাম!
ট্রেন ছাড়ল৷
হুশ হুশ করে ট্রেন গতি নেয়, আর দূরে সরে সরে যায় প্ল্যাটফর্মের কোলাহল৷ ফাঁকা কামরা, দুজন শুধু দুজনকে ঘিরে যেন সময় পাক খায়৷ সুতো ছাড়ে, আস্তে আস্তে খুলতে থাকে সময়ের জট৷
— কী ব্যাপার বল তো? কোনও গণ্ডগোল আছে নাকি কামরাটাতে? মাধু একবার ভুরু কুঁচকে বলেছিল৷ তাদের ওখানে শেলটন থেকে নিউ ইয়র্ক তারা অ্যামট্রেকের ট্রেনে হামেশাই যাচ্ছে-আসছে, এই রকমই শব্দহীন, ভিড়হীন, কিন্তু এ তো আর কানেকটিকাট নয়! এখানে ট্রেন ট্রাভল, শুধু ট্রেন কেন যে কোনও পাবলিক ট্রান্সপোর্টে যাতায়াত যে কী দুর্ভোগ যাত্রা, সেটা প্রতিবার এসে নতুন করে বুঝতে হয়!
— কেন এমন ফাঁকা কে জানে! হতে পারে ইলেকট্রিসিটি আসছে না, ফ্যানট্যানগুলো খারাপ কিংবা অন্য কিছু, চিনু তাকে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করে, ফটফটে দিনের বেলা, ভয়ের কী আছে? তেমন কিছু অসুবিধে থাকলে রেলওয়ের লোকেরাই আমাদের সাবধান করে দিত…৷
আর সত্যিই তো তারা কামরাটাতে একা হতে পারে কিন্তু বাইরে তো মানুষ দ্যাখা যাচ্ছে! ঝাঁকা মাথায়, টোকা মাথায়, থলে হাতে৷ শটাশট সরে যাচ্ছে, না-ই বা হল চেনাজানা, মানুষই তো!
তবে, চিনু বেশিক্ষণ এ সব নিয়ে মাথা ঘামাবার পাত্র নয়, সে টুক করে স্মৃতির কোটরে ঢুকে যায়— আচ্ছা মাধু, সেই দুপুরগুলোর কথা তোর মনে আছে? তোদের অভয় গুহ রোডের চিলেকুঠুরি? কী রোম্যান্টিক ছিল না? কত প্রাণের কথা মনের কথা! দুপুরগুলো যেন অলৌকিক ছিল রে!
মাধুর চোখের দৃষ্টি সে সব দিনের কথায় ততক্ষণে মুড বদল করেছে৷ সে বলল, তুই বললি তাই৷ নইলে….৷ একেবারে ভুলে গিয়েছিলাম৷ সত্যি কী দিনই ছিল! সে বাড়ি আর নেই, জানিস? বিক্রি হয়ে গেছে বাবা চলে যাওয়ার পর৷ আহা কী বাড়িই ছিল! কেমন স্মৃতিজাগানিয়া, সুখজাগানিয়া তার আনাচকানাচগুলো! চিলেকোঠাটায় বসলে মনে হত পৃথিবী থেকে একদম আলাদা কোনও গ্রহে চলে এসেছি৷ কাঁ কাঁ করে কাকের বাচ্চা ডাকত৷…৷ চিল উড়ত ডানা ছড়িয়ে, দূরে দূরে তাল, নারকেল, পায়রা ওড়ানোর শিস শীতের দিনে…৷
— এই তো মুডে এসে গেছিস, চিনু হেসে বলল, মনে আছে? একদিন আমাকে বলেছিলি, শ্রাবণ মাসে একদিন তোকে দুপুরের জ্যোৎস্না দেখাব৷
মাধু এই সব রোমান্টিক রোমম্হনে একটুও লজ্জা পেল না, বলল, আসলে বর্ষাকালে, সূর্য মেঘের আড়ালে গেলে একটা অদ্ভুত আলো ফোটে, সেটাকেই জোছনা বলতাম….৷ চিনু প্লিজ অন্য কথা বল, আমার সে সব মনে করতে ভাল লাগছে না৷
তার বিষন্ন মুখের দিকে তাকিয়ে একটু ইতস্তত করে চিনু আস্তে বলল, তোর কি আরও অনেক কথা মনে পড়ে যাচ্ছে?
মাধু মাথাটা একবার ঝাঁকিয়ে নিল, তার মনটা হঠাৎ হু হু করে উঠেছে৷
চিনুর কথার কোনও উত্তর হয় না৷ দুজনেই সেটা জানে৷ সে অবশেষে ছোট্ট গলায় জিগ্যেস করল—
— পরাশর এখন কোথায় রে?
— প্রশ্নটা এ’পে’ করছিলুম, চিনু থেমে থেমে বলল, না জিগ্যেস করলে খুব দুঃখ পেতুম৷ কোথায় থাকতে পারে? তুই-ই বল!
— কেন রে? ভীষণ উদ্বেগের গলায় মাধু বলল, কিছু হয়েছে? চিনু সত্যি কথা বল৷ মারা গেছে? মারা গেছে, না? এ আমি জানতাম!
— দূর দূর, তুই তো আচ্ছা বোকা মেয়ে! ব্রঙ্কিয়্যাল অ্যাজমায় কেউ মরে না মাধু, পরাশর পুরুলিয়ার দিকে ট্রাইব্যাল বেল্টে কী একটা সরকারি প্রজেক্টে কাজ করে৷ এ দিকে আর আসেই না৷ আর মজা কী জানিস? শুকনো জায়গায় থেকে থেকে ওর ও রোগ কবেই সেরে গেছে! তাগড়াই স্বাস্হ্য হয়েছে শুনেছি৷ ভালই আছে,
….৷ আর তা যদি বলিস ভাল না থাকলেই বা তোর কী? কত লোক তো ভাল নেই, কত লোক নিত্য মারা যাচ্ছে৷ নিঃসম্পর্ক লোকের ভালমন্দের কথা ভাবতে গেলে চলে?
মাধু একেবারে চুপ করে গেল৷ দুজনেই এখন চুপ করে শুধু ট্রেনের চলার আওয়াজ শুনছে বা শুনছে না৷
কিছুক্ষণ পরে চিনু বলল, সর্যি মাধু, প্লিজ রাগ করিস না৷ ছাড় ও সব কথা৷ ….৷ এই তোর মনে আছে, তোর সঙ্গে আমার কী কম্পিটিশন ছিল? যত ঝগড়া তত ভাব!
মাধুর মুখ থেকে বিষন্নতা এবার আস্তে আস্তে সরে গেল, সে জায়গায় একটু মজা পাওয়া হাসি ফুটে উঠল, সে বলল, মনে আবার নেই? আমি বেশি মার্কস পেলে তুই যা রাগান রেগে যেতিস!
— ভ্যাট, কক্ষনো না৷ চিনুর মুখ লাল৷
— ভ্যাট মানে? মনে নেই আমি ইনডাকটিভ লজিক বুঝতে পারছিলাম না, কলেজে সেই রেন ট্রি-টার তলায় বসে বসে তুই বুঝিয়ে দিলি, স্যাটারডে টেস্টে বেশি মার্কস পেয়ে গেলাম আমি! তিনদিন তুই আমার সঙ্গে বাক্যালাপ করিসনি৷ বললে হবে?
চিনু লজ্জা পেয়ে বলল, দূর দূর, কোন কালের ছেলেমানুষি সব, তোর মনেও তো আছে! দ্যাখ তো কী স্টেশন এল?
মাধু মুখ বাড়িয়ে নামটা পড়ে বলল, দূরগ্রাম৷
চিনু একটু অবাক হয়ে গেল, দূরগ্রাম! কী জানি! আমার অবশ্য তিন বছরেও স্টেশনের নামগুলো সব মুখস্ত হল না৷ খাতা দেখতে দেখতে যাই, খাতা দেখতে দেখতে ফিরি! কিন্তু এ নামের কোনও স্টেশনের কথা৷…৷
— অত ভাবছিস কেন? মাধু বলল, লাস্ট স্টেশন তো তারকেশ্বরই রে বাবা! মাথা ঘামাবার দরকার কীঞ্জ….৷ তার পরেই সে গলার স্বর একেবারে পাল্টে বলে, আচ্ছা চিনু হঠাৎ একটা কথা মনে হল, ধর যদি আমরা সেই সময়টা আবার ফেরত পেতুম? ভুলগুলো সব বেশ শুধরে নেওয়া যেত, তাই না?
চিনু বলল, নিশ্চয়ই! এবার আর বেশি মার্কস পেলে তোর সঙ্গে ঝগড়া করছি না৷ কিন্তু জীবন কী অদ্ভুত দ্যাখ, পরাশরকে তুই ওর রোগের জন্যেই বিয়ে করলি না, অথচ তোর স্বামী এখন কী দুরারোগ্য ব্যাধিতে ভুগছেন!
দুজনের মধ্যে একটা নীরবতা নামল৷ বাইরে দৃশ্যপট বদলাচ্ছে, গ্রামাঞ্চলের সবুজ, লালচে মাটি, পাখিদের ডিগবাজি কিন্তু সে দিকে কেন কে জানে কারোই মন নেই৷
মাধু অন্যমনস্ক গলায় বলল, পরাশর তা হলে সেরে গেল? আসলে আমি সরে যেতেই সেরে গেল! ডেসটিনি!
….৷ তারপরে হঠাৎ একটু ঝুঁকে পড়ে বলল, তা তুই এ নিয়ে এত মাথা ঘামাচ্ছিস কেন বল তো? তুই আলাপ করিয়ে দিয়েছিলি বলে? বলতে বলতে সে সামান্য একটু তেতোমতো হাসল৷
— বলতে পারিস! নৈতিক দায় তো একটা থেকেই যায়! ভগ্নদূতের রোলটাও তো আমাকেই প্লে করতে হল কিনা! নিজের বন্ধু সম্পর্কে প্রতারক ঠগ শুনতেই কি কারও ভাল লাগেঞ্জ
মাধু চমকে উঠে বলল, তাই বলেছে না কী?
— বলতেই পারে! বললে দোষ কোথায়?
মাধু আস্তে আস্তে কেটে কেটে বলল— জানি না, হয় তো নেই৷ আচ্ছা আমি না হয় ওরকম কাওয়ার্ডের মতো একটা কাজ করেই ফেলেছি, বুকে হাত দিয়ে বলতে পারিস তুই, ও রকম কিছু করিসনি!
চিনু হাঁ হাঁ করে উঠল, আমি ও সব লাইনে নেই ভাই৷ ছাপোষা মানুষ, নিজের সাধ্যমতো লেখাপড়া করে গেছি, বাবা-মা একটা ভূতের মতো দেখতে রামভুলো লোকের সঙ্গে বিয়ে দিয়ে দিয়েছে৷ যা করণীয় তাই করে যাচ্ছি প্রাণপণে৷ আর এখন পঞ্চাশে ধাক্কা দিতে চললুম, অন্য কিছু ভাবতেই হাসি পায়৷
মাধু একটু যেন দম নিয়ে বলতে লাগল, তবু যদি তোর সাউথ ইন্ডিয়ান পেন ফ্রেন্ড বেচারা আমার কাছে এসে নাকে কান্না না কাঁদত! সে এখন আমাদের শহরেই থাকে তো! মেম বিয়ে করেছিল, সে বিয়ের আয়ু জাস্ট আড়াই বছর৷ এখন একদম একা৷ দেখলে এত কষ্ট হয়! তা চিনু, সে বয়সে ফিরে গেলে আয়েঙ্গারের ওপর সুবিচার করতিস নিশ্চয়!
চিনু কি দীর্ঘশ্বাস ফেলল একটা? একটু পরে বলল, সুবিচার? সত্যি বলতে কি আয়েঙ্গারকে ফিরিয়ে দিয়ে কী-ই বা পেয়েছি! দিনগত পাপক্ষয় ছাড়া কিছু না! কুঁড়ে স্বামী, বদরাগী শাশুড়ি, চূড়াম্ত স্বার্থপর সব দেওর৷ আমাকে ঠিক আমের আঁটির মতো চুষে ছিবড়ে করে একে একে কেটে পড়েছে৷ কী পরিশ্রম করেছি রে মাধু, কী প্রাণাম্তকর জীবন৷…৷ যদি জানতিস! পুরো জীবনটাই দাসত্বে কেটে গেল৷ অথচ বাইরে থেকে দেখলে মনে হবে, বাহ, কী স্বাধীনা রমণী! কিন্তু সে মন সে বয়স তো আর ফিরে পাব না! তোতে-আমাতে সেই সব ঝগড়া সে-ও যে এখন কী মধুর লাগে! এ কে বি-র ক্লাসে সামনে বসা নিয়ে, মিসেস দে-র পক্ষপাতিত্ব নিয়ে, কলেজ ড্রামায় মেন রোল পাওয়া নিয়ে….৷
— সত্যি ব্যাপারগুলো তখন কী সিরিয়াস লাগত! মাধু হাসতে লাগল, আচ্ছা আচ্ছা অত শোক করার মতো কিছু হয়নি, কথা তো হয়েই রইল, আবার যদি সে সময়ে ফিরে যাই তবে সব শুধরে নেবো৷ দুজনেই৷ চিনু হঠাৎ হলল, আচ্ছা মাধু, আমরা কীরকম প্রাণের আনন্দে চিৎকার করে গল্প করতে করতে যাচ্ছি দ্যাখ! এটা কী করে সম্ভব হল বল তো? একটিও তৃতীয় ব্যক্তি উঠল না সারা পথ, আমরা দুই বন্ধু অনেক দিন পরে মিলেছি জানতে পেরে কি লোকে দয়া করে কামরাটা আমাদের ছেড়ে দিয়ে গেল?
— ট্রেনটা কী রকম মারাত্মক স্পিড নিয়েছে, বাইরে শুধু একটা টানা নীলসবুজ রেখা ছাড়া কিছুই বোঝা যাচ্ছে না৷ মাধু একই রকম উদ্বেগের সুরে বলল, তা ছাড়া তুই কিন্তু বলেছিলি এটা অল স্টপ ট্রেন! এত গল্পের মধ্যেও আমি খেয়াল রেখেছি তোর ট্রেন একটাও স্টেশনে দাঁড়ায়নি৷ একটু স্লো ডাউন করছে যেন থামবে থামবে কিন্তু আবার স্পিড নিচ্ছে৷ আর কী সব নাম স্টেশনগুলোর! দূরগ্রাম, নিকটগ্রাম, সময়পুর….৷ উজানগড়….৷
— দাঁড়া দাঁড়া মাধু তুই কি স্বপ্ন দেখছিস? চিনু হাঁ হাঁ করে উঠল, এ সব নাম তারকেশ্বর লাইনের কোত্থাও নেই৷ একটা ভুল হতে পারে, কিন্তু এতগুলো…৷ ইয়ারকি মারার আর জায়গা পাসনি, না? আচ্ছা ঠিক আছে, যত ইচ্ছে ইয়ারকি মার৷ অনেকক্ষণ ধরে তোকে একটা কথা জিগ্যেস করব ভাবছিলুম, ….৷ সে একটু অম্তরঙ্গ গলায় এবার জিগ্যেস করল, তুই কী মাখিস রে?
মাধু বলল, হঠাৎ?
— না তোর চেহারাটা কেমন ইয়াং ইয়াং রয়ে গেছে৷ সেই বিজ্ঞাপনে বলে না? সাম কমপ্লে’সন নেভার গ্রো!
প্রথমটা মনে হয়েছিল একটু মোটা হয়ে গেছিস, চুলগুলোও তোর কেমন পাতলা হয়ে গেছে, সেই বিখ্যাত চুল তোর! দ্যাখ, তেলে-জলে চেহারা আমাদের, পশ্চিমীরা তেল মাখে না বলে কি প্রোডিউসও করবে না? এই সব সাতপাঁচ ভাবছিলুম, তা দেখছি দিব্যি তো চুল রে তোর, কী যে ছাই দেখলুম!
মাধু বলল, তোকেও আমি ঠিক এই কথাটাই অনেকক্ষণ ধরে বলব বলব করছিলাম৷ প্রথমটা তোকে দেখে একটু ডিস্যাপয়েন্টেড হয়েছিলাম, এত রোগা আর কালো লাগছিল! কে জানে আশপাশের লোকেদের দেখতে দেখতে চোখটাই ও রকম হয়ে গিয়েছিল কিনা! এখন দেখছি পঁচিশ-ছাব্বিশ বছর আগেকার চিনুর সঙ্গে তোর তেমন কিছু বেসিক তফাত হয়ইনি৷ সেই খেলোয়াড়ি সটান ফিগার, সেই ঝকঝকে চোখ, আমাকে কী বলছিস! তোর চামড়ার বয়স একদিনও বেড়েছে বলে মনে হচ্ছে না৷ এটা কিন্তু খুব ক্রেডিট তোর!
— দ্যাখ দ্যাখ মাধু, চিনু চেঁচিয়ে উঠল, ওই ছেলেটাকে দ্যাখ, বাঁধের ওপর সাইকেলটা নিয়ে কীরকম শনশন করে চলেছে, ইচ্ছে করছে না ওর হাত থেকে সাইকেলটা ছিনিয়ে নিই, দেখিয়ে দিই স্পিড কাকে বলে!
মাধু সোৎসাহে বলে উঠল, মনে আছে আমরা ক্লাস কেটে সমানে সাইকেলে ক্যাম্পাস টহল দিতাম!
জামসেদপুরের কৃষ্ণা তৃষ্ণা দুই বোন বাগে পেলে কিছুতেই ছাড়ত না তো! না পেতাম টেবল টেনিস বোর্ড না সাইকেল!
— এস পি-র ক্লাস কেটে আমরা কেমন লরেন্স অব অ্যারেবিয়া দেখতে গিয়েছিলাম! ….৷ কী কী সব নাম রাখতাম রে প্রোফেসরদের….৷ ঘুমম্ত পুলিস, গ্যাক্সো বেবি, প্রেসার কুকুর….৷ নামগুলো কিন্তু দারুণ!
— আর ইকোয়ালি লাগসই! উফ্ফ, হাসতে হাসতে দুজনের পেট ফাটার জোগাড়৷
— এই মাধু আমি উল্টো দিকে বসেছি, দ্যাখ তো এবার কী স্টেশন এলো?
মাধু কোনওমতে হাসি থামিয়ে মুখ বাড়াল, তারপর বলল— ইচ্ছেপাড়া!
— ইচ্ছেপাড়া? চিনু প্রায় লাফিয়ে উঠল, সর্বনাশ মাধু! আমরা ভুল ট্রেনে উঠেছি, ভুল জায়গায় যাচ্ছি….৷
— ভুল জায়গা! ভুল ট্রেন? মাধুর মুখ উদ্বেগে কেমন হয়ে গেছে, সে বলল, — বলিস কীরে? ওরা যে বলল তারকেশ্বর লোকাল! তুই বললি, তোর চেনা ট্রেন! এখন কী হবে? কাল ভোরেই যে আমার ফ্লাইট!
চিনু চুপ৷ এক্কেবারে চুপ৷ তারপর সে অদ্ভুত চোখে চাইল, বলল— কিন্তু দুজনের তো টিকিট কাটতে গিয়ে একই ভুল হবে না! আমার অবশ্য মাম্হলি৷ ঠিক এই সময়ে ছাড়ে, বারো মাস তিরিশ দিন নটা পনেরোয় পাঁচ নম্বর প্ল্যাটফর্ম থেকে ট্রেন ধরছি৷
একটু পরে সে খুব শাম্ত গলায় বলল— চেনা? চেনা বলেই তো জানতুম! চেনাই তো ছিল৷ তুই আসতেই কি তবে সব হিসেব উল্টে গেল? চেনাটা অচেনা হয়ে গেল? যা কাছে ছিল তা দূরে, যা ছিল সামনে তা উজানে৷…৷ আমরা তবে কোথায় যাচ্ছি!
— কোথায়? মাধুর স্বরে এবার স্পষ্টই আতঙ্ক৷
— বোধহয় অনেক দূরে যাচ্ছি রে মাধু, সময় অসময়, দুঃসময় উজানে পেরিয়ে, অনেক অনেক দূর, তবে পরিচিত এক দূর বোধহয়৷ লাস্ট স্টেশন এলেই চিনতে পারব, ঠিক যেমন তোকে চিনতে পারছি পঁচিশ বছর আগেকার মাধবী বলে….৷
— কী আশ্চর্য চিনু, তুইও আমাকে ইয়াং দেখছিস! মাধু থেমে থেমে বলল, তোর যে বয়সটা কী রকম কমে গেল, কামরায় যে কেউ উঠল না এই আশ্চর্যটা আমরা এতক্ষণ খেয়ালই করিনি? ব্যাপারটা কী বল তো? আমার কেমন গা শিরশির করছে!
গভীর উদ্বেগে চিনু বলল, বিজ্ঞান আমি ভাল জানি না, কিন্তু সেই ফোর্থ ডাইমেনশনের কথা তো শুনেছি অনেক৷ আমরা কি তবে কোনও ভাবে সময়ের কোনও ফাঁকফোকরে পড়ে গেছি?
মাধবীর মুখে কোনও কথা ফুটছে না৷ চিনু বলল, লাস্ট স্টপ এলে কি তবে ওদের সব্বাইকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখব? তোর পরাশর, আমার আয়েঙ্গার, অঙ্কের মাস্টারমশাই, লজিকের দিদি, স্টেট বাসে এক ভদ্রলোককে ভুল বুঝে থাপ্পড় মেরেছিলুম, অন্যান্য যাত্রীদের হাতেও উনি মার খেলেন৷…৷ মাধু ওরা বলবে না তো যা যা ভুল করেছিলে এখন স-ব শোধরাও! ওহ্ আবার সেই যন্ত্রণা, সেই আশা, সেই আশাভঙ্গ…!
মাধু মুখ নিচু করে বলল— সেই আবেগ, যা প্রাণ চায় দুম করে করে ফেলা, আবারও অমনি করে চাইব পাব না, পাব চাইব না৷…৷ দেখতে দেখতে তার স্বর কান্নায় বুজে আসতে লাগল— আমার স্বামী, আমার বিজন শুয়ে শুয়ে আমার আশায় দিন গুনছে রে! কচি মেয়েটা একা হাতে সব সামলাচ্ছে৷ ওরা সবাই আমায় বিশ্বাস করে, বিশ্বাস করে আমি ফিরব….৷ ফিরতে আমাকে হবেই ….৷ চিনু …চিনু
— বেশি রাত হয়ে গেলে আমার বাড়িতেই কি কম ভাবনা করে রে? চিনুর গলায় কান্নার ডেলা৷
আজ আমার ভোলানাথ নির্ঘাৎ থানায় যাবে৷ আমি দেখতে পাচ্ছি রাত হচ্ছে, আমার ফেরার সময় পার হয়ে গেল, ও চুলগুলো দু হাতে আঁকড়ে বসে আছে, চোখ দুশ্চিম্তায় কোটরে ঢুকে গেছে৷ দিব্যটা লেখাপড়ায় তেমন চৌখস হয়নি রে, কিন্তু চেষ্টা করে, চেষ্টাটাই তো আসল বল! আহা, ছেলেটা নতুন বড় হচ্ছে, মেজাজ সবসময়ে ঠিক থাকে না, কত বকেছি! আমি যাব না মাধু, কিছুতেই যাব না, যত ক্লাম্তিই থাক, তবু এই শ্রাম্ত শরীর এই ক্লাম্ত মন নিয়ে এই সময়েই থাকব৷ যৌবনে ফিরতে চাই না আর, অনেক মূল্য দিয়ে এখানে পৌঁছেছি৷ তার চোখ দিয়ে এবার জল গড়াতে লাগল, সেই দিকে তাকিয়ে মাধু বলল— চেনটা কোথায়? চিনু চেনটা কোথায়? একটা চেন থাকে না?
নিমেষের মধ্যে চিন্ময়ী অপর দিকে চেনটার দিকে লাফ দিয়ে এগিয়ে গেল, প্রাণপণে টেনে ধরল৷ মাধবী বাইরের দিকে মুখ করে চেঁচিয়ে উঠল— এই ড্রাইভার, এই গার্ডসাহেব, রোকো রোকো৷ ইচ্ছের বিরুদ্ধে তোমরা আমাদের কোত্থাও নিয়ে যেতে পার না৷ আমরা যাব না৷
ট্রেন ঘস ঘস করতে করতে থেমে যায়৷ তুমুল কোলাহল ঢুকে আসে জানলার মধ্যে দিয়ে৷ শেষ স্টেশন!
তারকেশ্বর! তারকেশ্বর! কে কোথায় তারস্বরে ঘোষণা করতে থাকে৷
0 মন্তব্যসমূহ