উছলে পড়ে অন্ধকার

নাহার মনিকা

১.

-‘শক্ত হওয়া ছাড়া যখন কোন উপায় থাকেনা, তখন আপনা আপনিই মানুষের শক্ত হওয়ার ক্ষমতা হয়,’… শুকনো মুখে কথাগুলো বলে মেসো তার মোবাইলে কারো ফোন নম্বর খুঁজতে থাকে। আমি মুখে ওড়নার কোনা চেপে বসে থাকি। কাঠের লম্বা কেদারাটা বসে থাকার সময়টার মত দীর্ঘ, তার চেয়েও টানা লম্বা বারান্দা। বড় বড় থাম হাঁটু অব্ধি লাল সিমেন্টের বেড়ী পরে নিজের বৃত্তে ঘুরে ঘুরে স্থির।
আমার চোখ বারে বারে সামনের অপরিস্কার চিলতে জমিতে উপুড় হয়ে পড়ে, বাগানের প্রয়াসে কিছু ফুলগাছের সঙ্গে ইতস্তত অপেক্ষমান মানুষ, সাথে ছেড়া ময়লা ঠোঙ্গা, কলার খোসা, কুকুর, বেড়াল। আমার গা ঘিন ঘিন করে ।

চটচটে গা, একটু ধুতে পারলে ভালো লাগতো। দু দিন হলো চান টান হয়নি। বোলপুর থেকে শনিবার এসেছিলাম মীনাক্ষীর কাছে। ওর ফ্ল্যাটে স্নান সেরে দুপুরে খেয়ে একটু গড়িয়ে নিচ্ছিলাম। সন্ধ্যেবেলায় রবীন্দ্র সদনে ওস্তাদ রশীদ খান বাজাবেন। মীনাক্ষী টিকেট জোগাড় করে আসতে বলেছিল।

মেসোর ফোনটা দু ঘন্টা পরে এলে বেশী বিপদে পড়তাম নাকি এখন পড়েছি, ভাবছি। গড়িয়া থেকে দমদম। ব্যস্ত কলকাতার ধোঁয়াটে বিকেল পেছনে ফেলে ছুটে গেল ট্যাক্সী। এয়ারপোর্টে একা বসে থাকলাম ঝাড়া তিন ঘণ্টা। মীনাক্ষিরাও প্রোগ্রাম দেখাটা… শুধু শুধু ওদের আটকে রেখে কি লাভ? সবগুলো জমানো টাকা দিয়ে এয়ার ইন্ডিয়ার টিকেট, ষ্ট্যান্ড বাই একটা পাওয়া গেলো যাহোক। টাকার কথা সে সময় ভাবার উপায় নেই। ফ্লাইটে দেয়া স্ন্যাকপ্যাকটা ঠেসে হাতব্যাগে ঢুকিয়ে দিই, খেতে ইচ্ছে করে না। এত দিনের মধ্যে এই দ্বিতীয়বার প্লেন যাত্রা। প্রথমবার বিয়ের পরে, নিলয়ের সঙ্গে, হানিমুন। কলকাতা, তারপর দার্জিলিং। নিউমার্কেটের কাছে একটা হোটেল, হেঁটে হেঁটে দোকান পাট, ঘুপচি হোটেলে রুটি তরকা। জীবনে প্রথম একটা লং স্কার্ট, নিলয় পছন্দ করে কিনেছিল, সেটা প’রে হোটেলের ঘরে…!

-‘দীপা চক্রবর্তী’?

মেসোও মোবাইল বন্ধ করে উঠে দাঁড়ায়। কনষ্টেবল আমাদেরকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যায়। ডিউটি অফিসার এস আই। ভদ্রই। তবু উর্দি এদেরকে কেমন কনফিডেন্স বাড়িয়ে দেয়, কথা বলতে ভয় ভয় লাগে। কোন অপরাধ না করেও আমারও কেমন বুকের ভেতরে খামচে ধরা শংকা লাগে।

-‘নিলয় চক্রবর্তীর কে হন?’

-‘আমার স্বামী…’

-‘বলেন, তার সম্পর্কে কিছু বলেন…’

কি বলবো? এ কথার কি উত্তর দিই? দূরে থাকি। ছয় সাত মাস পর পর ওই আসে। গত মাসে এলো দু দিনের জন্য। ফোন করি, ই-মেইল করি। এটুকু লং ডিসটেন্স রিলেশনশীপ তো অস্বাভাবিক কিছু না। আর তাছাড়া ক’টা বছর মাত্র। ফেসবুকে ফটো আপলোড করি, বিভিন্ন প্রোগ্রামের, আমার নাচের ভিডিওর লিঙ্ক পাঠাই, এই-ই সব। নিলয় কমেণ্ট করে, উচ্ছসিত প্রশংসা করে। কবিতা, সাহিত্য পড়ে। গান বাজনা বোঝে, খুব বেশী ক্ল্যাসিকাল কিছু না, রবীন্দ্রসঙ্গীতের বেশী ভক্ত। ওর উৎসাহ তাজা ঘাসের গন্ধের মত আমাকে চনমনে ক‘রে তোলে।

-‘আপনে ওখানে থাকেন কেন?’

সামনে কোন চ্যালেঞ্জ থাকলে আট ঘাট বেঁধে নেমে পড়া মানুষ নিলয়। আমার এপ্লিকেশন নিয়ে কী দৌড়া দৌড়িই না করেছে…‘স্কলারশীপ পেতে হলে প্রথম শর্ত হলো সব রিক্যয়ারমেন্টস ফুল-ফিল করা’…। আমার নাচের রেফারেন্স হিসেবে শিল্পকলা তো আছেই, শেষ পর্যন্ত আরো দু তিনটে টিভি চ্যানেলের প্রশংসাপত্র জোগাড় করে ছাড়লো।

-‘কি মনে হয়, আপনার স্বামীর কোন শত্রু ছিল? কোন পারিবারিক রেষারেষি?...’

নিলয় হাসিখুশী মানুষ। হিসেবী। কোন শখ ওর সামর্থ ছাড়িয়ে যায়না। ওর মানিয়ে চলা স্বভাব দেখে আমার তৃপ্তি হয়। মেসোর ওপর কেন জানি খাপ্পা ছিল সে, মেসোর রমরমা চাকরী, টাকার গরম ভালো লাগতো না ওর। আড়ালে শালাও ডেকেছে- পি ডব্লিউ ডি’র ইঞ্জিনিয়ার।…‘রাশিয়ার ডিগ্রী…, ঘুষ দিয়া চাকরী পায়া …শালা এখন সেই টাকা ঘুষ খায়া উশুল করে’,- সেই মেসোর সাথেও সামনা সামনি কি মধুর ব্যবহার!

-‘আপনি কি জানেন…আপনের স্বামীর দ্বিতীয় বিয়ের কথা জানতেন’?

ঢাকেশ্বরী মন্দিরে আমাদের বিয়ের দিন, নিলয়ের মাথায় শোলার মুকুট ঢল ঢল করছিল। মানুষজন, শাঁখ আর উলুধ্বনির মধ্যে সে একহাত দিয়ে চেপে রাখছিল, তাই দেখে বড় মামী টিস্যু পেপারের গুটলি করে কানের দুপাশ থেকে গুজে দিয়ে টাইট করে দিলো। কপালের চন্দনের ফোটা একটু ঘষটে গিয়ে বরবেশী নিলয়কে ফটোতে কমিক দেখায়। শোলার মুকুটের মত আমাদের বিয়েটাও কি ফিট হয়নি ওর? আমি টের পেলাম না কেন? আচ্ছা, এই এস আইয়ের কথা আমার বিশ্বাস করতে হবে কেন? সিঁথিতে সিঁদূর পরিয়ে, অগ্নি সাক্ষী রেখে আমরা দুজন পবিত্র, স্বর্গীয় বন্ধনে আবদ্ধ। সে সম্পর্কটার কোন ক্ষমতা নিশ্চয়ই আছে, কোথাকার কে আবোল তাবোল কিছু বললেই হলো?


২.

-‘আপনি নিলয় চক্রবর্তীকে কেন বিয়ে করলেন?’…..

নিলয় তো কোন চাপের মুখে না, নিজেই স্বতস্ফূর্ত, বলতেছিল-‘…চিন্তা কইরো না। সেই কবে ১৮৭২ সালে য়্যাক্ট পাশ হইছে। আমরা এমনিতেই বিয়া করতে পারি, কিন্তু আমি যে তোমারে ভালোবাসি তা প্রমান করতে হবে না? আজকে থেইকা আমি নিলয় রহমান’…

শরৎকালের বিকালবেলা দীর্ঘ ট্র্যাফিক জ্যামে আটকায়া গেলো। আমি রিক্সায় বইসাছিলাম। নিলয় রাস্তা ক্রস করতে গিয়া আমারে দেইখা থামে।। আগের পরিচয় ছিল, দেখলে দুই চার মিনিট কথা বলছি। তো সেইদিন তেমন কথা বার্তা ছাড়াই ‘কাছাকাছিই যাইতেছি’ বইলা চইড়া বসলো আমার রিক্সায়! ওর চশমার ফ্রেম, কানের কাছের নীল ত্বক আমারে, মিথ্যা বইলা লাভ কি, আকর্ষণ করতেছিলো। বিকালের নানারকম আওয়াজ- রিক্সা, সি এন জি, প্রাইভেট কার, ঠেলা আর মানুষের কলহ গুঞ্জন উধাও কইরা আমরা কথা বলতে বলতে একটা দুই রুমের বাসার প্রসঙ্গে চইলা আসছিলাম। গ্যাস পানির কানেকশান আর এক টুকরা বারান্দা হইলেই হবে। কাজের লোক লাগবে না, গায়ে খাটতে আমার আইলসামী লাগেনা। কিন্তু নিলয় বললো- ‘লাগবে,’ একজনের জায়গায় দুইজন একসঙ্গে থাকলে নাকি কামকাজ বাড়ে। তারপর, ইষ্টার্ণ প্লাজার কাছে রিক্সা থেইকা লাফ দিয়া নাইমা আমারে একরকম জোর কইরাই নামায়া নিয়া গেলো শাড়ির দোকানে, আর চোখ কাড়া শাড়িটা কিইনা দিলো। তারপর চাইনিজে।

বেইলী রোডের কর্মজীবি মহিলা হোষ্টেলে আমার মত ট্রাভেল এজেন্সির ক্লার্কের সিট পাওয়া কিন্তু ভাগ্যের কথা, লম্বা ওয়েটিং লিষ্ট পার হইয়া শেষমেষ ক্যামনে যে পাইলাম! নিলয় যদি মুসলমান হয়- তাইলে আমার এই অসাধ্যের আবাস ছাড়তে আপত্তি কি? আব্বা বাইচা থাকলে প্রথমে রাজি হইতো না, মুসুল্লী মানুষ, কিন্তু আমি জানি তারে রাজী করানো যাইতো। একজন বিধর্মীরে পথে আনলে কত সোয়াব! আর আমি চাপ না দিয়াও নিলয় যখন নিজে থেইকাই রাজী।

-‘নিলয় চক্রবর্তী কোন শত্রু বা তার সাথে কারো ঝগড়া ছিল? কাউকে আপনার সন্দেহ হয়?’

নিলয়রে তো কখনো মেজাজ করতে দেখি নাই। তবে একদিন তাওয়ার উপরে গরম বালুর মত গনগনে রাগ দেখছি। তখনো মাসখানেক হয় নাই সিভিল কোর্টে রেজিষ্ট্রি হইছে আমাদের। আমি বেবী আপারে বইলা ওইদিন অফিস থেইকা আগেই বের হইছিলাম, সাড়ে তিনটা টিনটা হবে। নিলয় বরাবর সন্ধ্যাবেলা টিউশনিতে যায়। তো আমি আসতেছিলাম…, মোড়ের মাথায়, কাবাবের দোকানের সামনে ভীড়, আমার রিক্সাওয়ালা নিজেই প্যাডেল মারা বন্ধ কইরা ভীড়ের ওপর দিয়া রাতা মোরগের মত গলা বাড়ায়। ছোট খাট নিলয়ের কোকড়া চুল রাগে খাড়া হইয়া গেছে, সে একটা সি এন জি ড্রাইভাররে শার্টের কলার ধইরা বাইরে টাইনা লাগাতার ঘুষি। প্রথমে বুঝি নাই, যখন বুঝলাম, হঠাৎ ঝাঁপায়া মাঝখানে গিয়া না থামাইলে মারমুখী নিলয় বোধহয় লোকটারে মাইরাই ফেলতো। তিতা কড়া রোদ্রে নিলয়ের চুলে চুপচুপা ঘাম। আমার খুব রাগ আর মায়া দুইটাই লাগলো। আর আশ্চর্য দাঁড়ায়া থাকা ভীড়ও কেমন নির্বিবাদে চাইরদিক খালি কইরা চইলা গেল।

‘…কী হইছে’…র জবাব পাই নাই, সেই কারণে আমার ভিতরে নতুন শাড়ির মত খসখসা অভিমান পুরান হইয়া গেলেও নিলয় কখনো সেইটা ভাঙ্গাইলো না!

শুধু এক জায়গায় খটকা, আমারে সাথে নিয়ে বেড়াইতে বাইর হইলে নিলয়ের একটু তটস্থ ভাব, কেউ দেইখা ফেলবে। যে লোকটা আমার জন্য এক কথায় ধর্ম ছাড়লো, সেই আমারে নিয়াই সংকোচ!

-‘ইনি যে আগে আরো একবার বিবাহিত ছিলেন জানতেন?’…

আমিও যেমন এক স্যুটকেস, নিলয়ও তেমন, বাড়তি খালি কম্পিউটারটা। হাড়ি পাতিল থালাবাসন তো একসঙ্গেই কিইনা আনলাম। কোন কোন ভ্যাপ্সা দুপরে ফ্যানের স্পীড বাড়ায়া বাপ-মায়ের আর স্কুলের গল্প বলতো, কিছু কিছু গল্প শুইনা আমি কুটিপাটি হাসতাম। আর কোন চিহ্ন তো আমি পাই নাই! না কি ছিল, সব চিহ্ন, পরিচয় সঙ্গে সঙ্গে ছিল, আমিই দেখি নাই!


৩.

-‘হ্যাগোরে বোঝাইতে হবে যে আমরা ভাইসা আসি নাই, বোজলা? নাম করা ব্যারিষ্টারের লগে আমার পরিচয় আছে, ছাইড়া দিমু ক্যান? আমাগো সঙ্গে ডিসক্রিমিনেশন কি নতুন?,’…খানিকটা আমার দিকে, আর খানিকটা প্রায় ফাঁকা ঘরের স্থির বাতাসের দিকে ফিস ফিস হুমকি ছুঁড়ে মেসো আমাকে অপেক্ষায় বসিয়ে অন্য কোন কাজ সেরে আসতে যায়। অপেক্ষার প্রহরগুলো সেই অনাদিকাল থেকে হয়তো এ রকম ভারী আর বিষাদগ্রস্থ। ব্যারিষ্টার সাহেব একজন মক্কেলের সাথে আছেন। আমার সঙ্গে আরো দু জন বসে আছেন। দৈনিক পত্রিকার পাতা উলটে যেতে বাড়তি মনযোগ দরকার হয় না। হেলাফেলা করে মৃত্যু আর খুনের সংবাদ খুঁজি।

হাল ছেড়ে দেবার প্রশ্ন উঠছে না। কেন ছাড়বো? কার জন্য ছাড়বো?

না দেখা মেয়েটির প্রতি যে মনোভাব নিয়ে বসে থাকি তা কিন্তু অন্তসারশূন্য না, আমার হৃদপিণ্ড গলিত গরম মোম দিয়ে মোড়ানো অনুভব করি, পুরোটা না পুড়লে আমার বোধ অপবিত্র থেকে যাবে।

বেশ খানিকক্ষণ মেসো হন্ত দন্ত হয়ে ঢুকে স্বস্তি নিয়ে হাসে, এখনো অপেক্ষা করছি।

অভিজ্ঞ ল’ইয়ার তার কাঁচাপাকা চুল ঠেলে আমাকে আমার গ্রাউণ্ডে স্থির থাকতে বলেন। সংখ্যালঘু ইস্যুতে বিষয়টা বিবেচনার প্রবল সম্ভাবনার কথায় পায়ের নিচে খানিকটা শক্ত মাটি পাই।

শাশ্ত্রীয় মতে মন্দিরে বিয়ে, কাগজপত্র থাকেনা। আমার পাসপোর্টে স্বামী নিলয় চক্রবর্তী।

‘এই নিলয় যে সেই নিলয়, প্রমান কি?’

প্রমান কি? সত্যি তো!

-‘বৌমা নিলয়ের অন্নপ্রাশনে পাওয়া থাল, এইডায় আইজকা তুমি খাও’… ঝক ঝকে কাঁসার থালায় খোদাই করা নিলয়ের নাম আর জন্মতারিখ। হঠাৎ খুব আপন মনে হওয়া সেই থালাটা গ্রামের বাড়ির কোথায় রেখে গেছে নিলয়ের মা? ওটা কি কোন প্রমান হতে পারে? শহরে না জন্মালে জন্ম সনদ কোথায় এ পোড়ার দেশে, শহরেও কি সব সময় থাকে?

পুলিশ রিপোর্ট, ময়না তদন্ত নিয়ে মেসো আর ব্যারিষ্টার সাহেব কথা শুরু করলে আমার গা গুলিয়ে বমি আসে। সামনে মসৃণ কাঠের টেবিলে চোখ রেখেও বানভাসির মত বমি আটকানো কঠিন হয়ে পড়ে। অযথাই নিলয়ের শার্ট আর আফটার-সেভের গন্ধ নাক বন্ধ ক’রে দিচ্ছে…। “কোন বন্ধন দ্বিতীয়বার বন্ধন করিলে পূর্বের বন্ধন শিথিল হইয়া যায়”,…আমার বেলা এই মহাসত্য কেন প্রমাণ হচ্ছে না? কেন আমার দশ আঙ্গুল নিলয়ের বন্ধ চোখ ছুঁয়ে দেখার জন্য ব্যকুল হয়ে আছে?

পিটিশনের খসড়া তৈরী করেছেন ল’ইয়ার। গত শুনানির বিরুদ্ধে আপীল করেছিলাম। মনুষ্যদেহ অগ্নিস্পর্শে জলে, স্থলে প্রকৃতিতে মিশে যাবে, তারপর পূর্ণজন্ম, এ বিশ্বাস বুকে স্থান দিয়ে কোন প্রাণে বিচারকের খেয়ালী রায় মেনে নিই? মেসো থুতু ফেলে বিদ্রুপ করে,…‘এহ, কাজীর বিচার কঅরতে আইছে…উচ্চবর্ণ হিন্দুর দেহ সৎকার না কইরা ছাত্ররা দ্যাহ নিয়া কাটা ছেঁরা কঅরবে, ফাইজলামী পাইছো?’

আমার আবারো বমি ভাব হয়, সহসা এক চিরল বিদ্যুতের মত ক্ষীণ আশা জাগে, আচ্ছা আমার শরীরে কোন প্রমাণ অপেক্ষা করে নেইতো যে নিলয় আমার ধর্ম সাক্ষী স্বামী! এক ঝটকায় শত শত ভাবনার ডালপালা অক্টোপাসের মত বেঁধে ফেললে আমি ফ্রিজ হয়ে বসে থাকি সিএনজিতে। তাহলে তো যে কোন মূল্যে আমার জানতে হবে কে নিলয়কে হত্যা করলো? সেই, মেয়েটি? যার ছায়ার কথা ভাবলে আমার মাথায় চিতা জ্বলে ওঠে?


৪.

দুই বৎসর তিন মাস এত অল্প সময়! মনে হয় সেইদিন ঠেলাওয়ালা আরো দুই তিনজন নিয়া জাহাজের ফার্নিচার থেইকা কেনা ডাইনিং টেবিল তুইলা দিলো তিন তলায়। দুইজনে বইসা খাই, বাকী দুইটা চেয়ার নিলয়ের ব্যাগ আর খাতাপত্রের বাসা। নিলয় আগোছালো ঘরদুয়ার পছন্দ করতো না, কতদিন নিজেই ঝুল ঝাড়তে লাইগা গেছে।

এখন আমারে এই প্রশ্নের জবাবও দিতে হবে যে ও নিয়মিত ধর্মকর্ম পালন করতো কিনা? বেবীআপা সাক্ষী, ওনার বরের সঙ্গে ঈদের নামাজ পড়তে গেছে নিলয়, আর আমাকে তো কখনো বাঁধা দেয় নাই। আমি যে আয়তুল কুরসী পইড়া বুকে ফু দিতাম, ও কোনদিন ঠাট্টা করে নাই তো?

এত পরিকল্পনা কার? সেই সি এন জি ড্রাইভার? ঐ এক ঘটনা ছাড়া সাতে পাঁচে নাই এমন নিলয়কে নিয়া কার কি লাভ? …ও আল্লাহ, আমি আর ভাবতে পারি না। টিউশনি থেইকা ফিরতে দেরী তো হতই, এইটা নিয়া অত চিন্তা করতাম না। একসাথে থাকা শুরু করার পরে, হ্যা পাঁচ ছয় মাস পরে পরেই সে ওপার গেছে, আত্মীয় স্বজন আছে… দুশ্চিন্তা?… স্বীকার না গিয়া লাভ কি? ক্ষয় কইরা ফেলা পোকা কাটার মত দুশ্চিন্তা আর মন খারাপ হইতো, আমি স্বার্থপর হইলে যদি সে আমার কাছে না থাকে!

নিলয় নাই, বুকের মধ্যে শূণ্যতার হাহাকার দম আটকায়া বইসা থাকে। কারা এত কষ্ট দিয়া ওর জান কবজ কইরা ফেললো! আমি চোখ হাতের তালুতে মুছি, তারপর উইঠা দাঁড়াই। এখন যত তাড়াতাড়ি ওরে এই আজাব থেকে মুক্তি দেওয়া দরকার, দাফন কাফন দিয়া আমার নিলয়কে চিরশান্তির মাটিতে রাখার বন্দোবস্ত করা দরকার।

দুনিয়ার মানুষ আমার মত মেয়েলোকের কথার দুই পয়সা দাম না দিলে কি? কোর্টে সই করা রেজিষ্ট্রির কাগজ আমার কাছে আছে, সাক্ষী আছে। বেবী আপা সাহস দেয়,‘কোন চিন্তা করিস না শাহানা… হাদিস কোরান মরে না…’ তার বাইরেও কি কি সব এন জি ও’র নাম বলে, নারী অধিকারের জন্য লড়াই করার লোক এখন দুস্প্রাপ্য না। আমার স্বামী স্বেচ্ছায় ধর্মান্তরিত হইয়া আমার সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হইছে, তার পায়ের নিচে আমার বেহেস্ত, কোন আক্কেলে তাকে আমি বিধর্মীর হাতে সোপর্দ করতে পারি?

বেবী আপা তার পার্টির লিডারের কাছ থেইকা কতগুলো ইসলামিক জার্নালের আর্টিকেল আইনা দিছে। গতকালকে এডভোকেট মেরিনা হোসেনের সঙ্গেও দেখা হইলো। নিলয়ের আত্মা কষ্ট পাইতেছে…তাড়াতাড়ি এর সুরাহা হওয়া দরকার।

সারাক্ষণ ঐ রাত্রের কথা মনে পড়ে…বেলের শব্দে দরজা খুলি, কোথায় কি কেউ নাই। রাত জাগার অনভ্যাস আমার চোখে ঘুম দাপায়া আনে, আমি ঘুম চোখে অনবরত নিলয়ের ফোনে ট্রাই করতে থাকি। দরজায় ঠক ঠক, নিলয়তো বেল বাজাবে, হয়তো ক্লান্ত হাতে বেলের বোতামে চাপ দিতে ইচ্ছা করতেছে না, আমি আবার বিছানা থেইকা নাইমা দরজা খুলি, কেউ নাই তো! এইবার আমার ভয় লাগে, ঘড়িতে ভোর তিনটা, কী আশ্চর্য, কোথায় যাইতে পারে? আমার ঘুমের ঘোর তড়াং কইরা উধাও হয়া যায়, কোলাপ্সিবল গেইট খুইলা নিচের রাস্তায় দাঁড়াইলে শরীল ছম ছম করে। বাড়িওয়ালার ড্রাইভারটা গেটের আংটায় ঝুইলা থাকা তালা হাতে নিয়া বাইরে আসে,…‘চিন্তা কইরেন না, আইসা পড়বো…অত বড় মানুষ হারায়া যাইবো কই?’ ভোরের বেলায় ফিচকা টাইপের ড্রাইভারের চোখ, মনে হয় সত্যি কথা বলতেছে। মনে একটু শান্তনা নিয়া আবার তিন তলায় উইঠা আসি। চুপচাপ ভোর তছনছ কইরা ফজরের আজান শুনি। কেউ একটা ফোন করেনা, বেল বাজায় না। এইবার বিছানায় গা ডুবানো মাত্র তলায়া গেলাম ঘুমে। যখন ফোন আসে, ততক্ষণে সকাল। খবর পাই, পাগলের মত দৌড়ায়া সি এন জি ধরি…নিলয় চক্রবর্তী গভীর রাতে সন্ত্রাসীদের হাতে নৃশংস ভাবে খুন হইছে। পুলিশ কেমনে খবর পাইলো, ওর লাশের ময়নাতদন্ত হবে, এসব কথাবার্তা ফাঁকা মাথার এপাশে ওপাশে ধুপধাপ বাড়ি খায়। লাশ মর্গে রাখতে হয় এই প্রথম জানলাম আর নিলয়ের দুই একজন আত্মীয়ও এই প্রথম, তাচ্ছিল্য নিয়া আমারে দেইখা গেল।


৫.

…“ডানা ভেঙে ঘুরে-ঘুরে প’ড়ে গেলো ঘাসের উপরে;
কে তার ভেঙেছে ডানা জানে না সে;-আকাশের ঘরে”


দীর্ঘ পথ পরিক্রমার চক্রে পড়ে গেলাম…ঠান্ডা অন্ধকারে বিশালাকার নীল গোলক আমার চোখের মনির মধ্যে ঠেসে দিয়ে কে যেন ছেড়ে দেয়, আর আমি লাটিমের মত ঘুরতে থাকি। সে লাটিম সুতো দিয়ে না, লম্বা দীর্ণ চিত্রময় এক ফিতেয় মোড়া। চিৎকার করে কাউকে ডাকতে ইচ্ছে করে। কতগুলো চেনা মুখের আবছায়া ঘোরাফেরা করে। হিসেবের বাইরে শক্তি জুটিয়ে হাত প্রসারিত করি, আবছায়ারা আমাকে চেনে কিনা বোঝা যায় না। এই আবছায়াদের মধ্যে আমার জীবনের নারী আছে, পুরুষ আছে, আছে চেনা বৃক্ষ, কান্ড, পাতা, পাখপাখালী। সেই গুইসাপ, ভয় আর রং ছড়ানো জীবন…পছন্দ হয় তো মাথা উঁচিয়ে হাঁটো, না হয় তো খোলস বদলিয়ে দাও।

হাজার রশি দিয়ে আমি দোটানায় বাঁধা। এর মধ্যে দিয়ে বের হয়ে আবার এখানে ফিরে আসি। নিজেই ঠাহর করার আগে কেউ না হয়ে মিলিয়ে যাই, আবার কখনো ভুস করে ভেসে উঠি যেন বিশাল তিমিমাছ, জলের মধ্যে মাথা নাড়িয়ে চারপাশে বিশালাকার মুক্তোদানার উচ্চাভিলাসী কিছু ব্যর্থ বুদ্বুদ বানিয়ে চলি।

মা মাখা ভাত ঠেসে মুখে গুজে দিয়ে আক্ষেপে গলা চড়ায়,…‘যাবিনা খবর্দার, পিপড়া টিইপা টিইপা মারবি না’…আমি যাই, রাস্তার ঢালে জাম গাছের কালো, খয়েরী কোটর জুড়ে থই থই তাদের যাত্রাভঙ্গ ক’রে বুড়ো আঙ্গুলের নখ উল্টিয়ে টিপে টিপে মারি। সন্ধ্যেবেলা বাঁশের চিকন কঞ্চির সাথে পিঠ শক্ত করে পাল্লা দিই।


“…ঘনায়ে এসেছে তার? জানে না সে, আহা,
সে যে আর পাখি নয়-রঙ নয়-খেলা নয়-তাহা”


…শ্বাস বন্ধ দৌড়ের সীমানায় পৌঁছে গেলে কিছু কিছু আবছায়া মুখ আবারো স্পষ্ট হয়। দীপার ঘুঙ্গুরের শব্দ কানে বাজে, দুই পায়ের যাদু ছোঁয়ানো পাতায় ঘাত প্রতিঘাত তুলে সে নাচে। আমি শুধু হাত পায়ের আঙ্গুলের কারুকাজ দেখতে পাই। দীপার সব মনোবেদনা পায়ের পাতায় জমা হয়, নয় তো আঙ্গুল ফেটে রক্ত গড়ায় কেন? নাচের তালে তালে মাথা নুয়ে সে হাতে সেই রক্ত তুলে সিঁথিতে ঠেকায়। তার ঘাম জমা টিকালো নাক দেখে মুদি দোকানদারও ঘোর লাগা চোখে তাঁকানো শুরু করলে আমারই উদ্যোগটা নিতে হয়। উপড়ে দিলাম দীপার শেকড়। ওকে ওর স্বপ্নসহ বড়সড় একটা টবে বুনে দিতে চাইছিলাম, হলো না যে, সেটা, সে অত পূংখানুপুংখ ধরতে পারেনি।


“…জানে না সে; ঈর্ষা নয়- হিংসা নয়- বেদনা নিয়েছে তারে কেড়ে!
সাধ নয়, স্বপ্ন নয় – একবার দুই ডানা ঝেড়ে…”


আসা যাওয়ার সম্ভাবনা সময়কে নারকোল কুড়ুনীর মত বুকে নিয়ে কোড়ায়। শাহানা পিঠ খুঁটতে জানে, মনযোগী এলো মেলো আঙ্গুলের চিরল বিরল আঁকে। কাবাবের দোকানে ঢুকলে ওর চকচকে চোখ আমাকে নিজের ভেতরে লুকোতে উৎসাহী করে। তবু শাহানা আমাকে পূনর্বার গেঁথে দেয়, মাটির সঙ্গে। এই মাটি আমার চেনা, কিন্তু আমি নিজে গুইসাপের মত, খোলস পাল্টেছি, মাটি আমাকে চেনে কিনা বুঝিনা। কিন্তু বোঝা পড়াটা খুব জরুরী। বকেয়া বিলের মত ফেলে রাখতে ইচ্ছে করে না।

“…কোনোদিন- কোনোদিন আর তার হবে না প্রবেশ?
জানে না সে; কোনো-এক অন্ধকার হিম নিরুদ্দেশ”…


ফাল্গুন চৈত্র মাসের কোন কোন প্রবল বাতাসে পাতা ঝড়ে পড়ে, সবাই বয়স্ক, পরিণত না। কোন কোন কচি সবুজ পাতাও বাতাসের চপেটাঘাতে মাটিতে লুটিয়ে নামে, তেমনি কোন অপরিনত পাতাকে নিয়ে দু সারি পিঁপড়ের টানাটানি খেলা দেখেছিলাম একবার। টানাটানির তোড়ে পাতাটির সবুজ কিনার কুকড়ে মুকড়ে, ঘষটে যাচ্ছিল। আমি কি সেই পাতা? যাকে ঘিরে আলো আর অন্ধকারের কোন রং নেই। রংহীন পাস্তুরিত সময় দিয়ে আমাকে মুড়ে দিয়েছে কিছু আবছায়া মুখ?




------------------------
কবিতা- ‘মৃত লাশ’- জীবনানন্দ দাশ।

লেখক পরিচিতি
নাহার মনিকা
কানাডা প্রবাসী

কবি। গল্পকার। 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

1 মন্তব্যসমূহ