কুমারেশ রায়ের বয়স আন্দাজ পঁয়ত্রিশ।ছত্রিশ কিংবা সাঁইত্রিশও হতে পারে।আসলে কুমারেশের চেহারা দেখে তার বয়স বোঝা মুশকিল।গায়ের রং ফরসা,উচ্চতা প্রায় ছ’ফুট,মাথা ভর্তি কোঁকড়ানো চুল।চোখ,মুখ,নাক,কান সব যেন সযত্নে খোদাই করে বানানো।এককথায় সুপুরুষ টাইপ।কুমারেশ এম.এ. পাশ এবং পেশায় অভিনেতা।
খুব ছোট বেলায় বাবা মা মারা যাওয়ার পর থেকে কলকাতায় মামার বাড়িতে মানুষ।বিয়ের পর থেকে যদিও সস্ত্রীক কুমারেশের ঠিকানা কলকাতার শহরতলিতে।মালার সঙ্গে বিয়ে বছর পাঁচেক হল।মালা পি.এইচ.ডি হলেও তার মধ্যে কোন অহংকার নেই।মালার বাবার বাড়ি মালদা।মালার বাবা মালদা শহরের নামকরা ডাক্তার।মালাদের পূর্ব পুরুষ এক কালে মালদার কিছু গ্রামের জমিদার ছিল।বেশ বড় বংশ।এরকম ঘরের মেয়ে হয়েও মালা আর পাঁচটা সাধারণ গৃহস্থ বাড়ির মেয়ের মত সংসারের সবরকমের কাজে চটপটে।এপর্যন্ত শুনে কুমারেশের জীবনটা বেশ সুখের মনে হলেও বাস্তবে এতটা সুখের ছিল না।
কুমারেশের অভিনেতা হয়ে যাওয়াটা আরেকটা গল্প।সে যখন খুব ছোট,সবে পা ছড়িয়ে বসতে শিখেছে, তখনই একটা ছবিতে অভিনয় করে ফেলেছে।একটা মাত্র সিন।গভীর জঙ্গলে ভেসে আসছে এক শিশুর কান্না।পথ চলতি কাঠুরিয়া কান্নার আওয়াজ শুনে খুঁজে বের করে সেই শিশুকে।দেবশিশুর মত দেখতে বাচ্চাটাকে বনে ফেলে দিয়ে গেছে কেউ।কাঠুরিয়া বাচ্চাটাকে কোলে তুলে বাড়ি নিয়ে যায় সঙ্গে করে।সেই বাচ্চাটাই বড় হলে সিনেমার নায়ক হয়- লালকমল।সিনেমার নামও লালকমল।সিনেমাটা আদৌ চলেছিল বলে যেমন জানা যায় না তেমনি জানা যায় না কুমারেশ কি করে এই সিনেমাতে ঢুকে গিয়েছিল। শুধু শুটিংয়ের একটা হলদে ছবি থেকে গেছে।কিন্তু অর্দৃষ্ট সেই দিন থেকে কুমারেশের নামের সাথে সিনেমাকে জুড়ে দিয়েছিল আড়াল থেকে।ছোট থাকতে বাবা মা কে হারানোর পর থেকেই মামারবাড়িতে থাকা।মামারা তখনও অবিবাহিত।একমাত্র ভাগ্নে কে স্কুলে ভর্তি করলেও কুমারেশের পড়াশুনোয় মন ছিল না কোন কালেই।যদিও মাথাটা সত্যিই শার্প ছিল গোড়া থেকেই।কিন্তু বয়সের সাথে সাথে আভিনয়ের নেশাটা রক্তে জাল ছড়াচ্ছিল দিনে দিনে।কলেজ শেষ হতে না হতেই সে নেশা তাকে গ্রাস করল পুরোপুরি।অন্যান্য বন্ধুরা যখন চাকরির খোঁজে ব্যস্ত তখন কুমারেশকে পাওয়া যেত টালিগঞ্জের স্টুডিও পাড়ায়।তার দুচোখ তখন স্বপ্নে ভরপুর।অভিনয়,সিনেমা।স্বপ্ন যদিও আরও একটা ছিল।মালা।কলেজে পড়তে পড়তেই মালার সাথে আলাপ।মালদার মেয়ে।পড়াশুনোয় তুখোড়।হিস্ট্রি নিয়ে পড়ে।দুজনের আলাপ কলেজের নাটকে।কুমারেশ নাটকে নায়ক।মালা ছিল কোরাস গানের দলে।প্রথম প্রথম রির্হাসালে একটা দুটো কথা।দেখতে দেখতে আলতো আলাপ বন্ধুত্বে গড়ায়।সে বন্ধুত্বও গাঢ় হয় ধীরে ধীরে।মালা তখন পি.এইচ.ডি করছে।আর দেরি করা ঠিক হবে না ভেবে বাড়িতে সবটুকু জানিয়ে দেয় মালা।বাবা মা রাজি হন না যদিও।কারণ কুমারেশ তখনও বেকার।তারপর যা হয় আর কি আর পাঁচটা বাঙালি ঘরে।প্রথমে বাবা মা,তারপর আত্মীয়-স্বজন সবাই মালাকে বোঝাতে নেমে পড়ে একে একে।বাংলার এই সমস্ত প্রেম কাহিনীর ছকটা একই রকমের হয়।মালা সবার কথা অগ্রাহ্য করে কুমারেশকে বিয়ে করে ফেলে একদিন।সংসার চালাতে একটা ছোটখাট প্রাইভেট কোম্পানীতে চাকরি নেয়।বাড়ি,পরিবার ছেড়ে আসতে কষ্ট হয়েছিল ঠিকই,কিন্তু কুমারেশকে পাওয়ার আনন্দ সেই কষ্টকে ভুলিয়ে দিতে পেরেছিল।কুমারেশের স্বপ্ন নিয়ে নিজের খুব ভরসাও ছিল মালার।সেও বিশ্বাস করত কুমারেশ সত্যি সত্যি একদিন খুব বড় অভিনেতা হবে।কিন্তু এই পাঁচ বছরে সেই বিশ্বাসে অনেকটা ফাটল ধরে গেছে।কারণ এখনও অবধি গোটা পাঁচেক ছবিতে সাইড রোল ছাড়া কুমারেশ বিশেষ কিছু করতে পারে নি।ছবিগুলোও তেমন বড় কিছু নয়।ফলে টাকার পরিমাণ যতসামান্যই।প্রথম প্রথম এসব নিয়ে কোন ঝামেলাই ছিল না দুজনের মধ্যে।দিনে দিনে সংসারের দায় দায়িত্ব বাড়ার সাথে সাথে বিশ্বাস আর ভালোবাসার লৌহবাসরে ছোট ছোট ছিদ্র জন্ম নিয়েছে নিজেদের অজান্তেই।এখন মাঝে মধ্যেই কথার মধ্যে সে সব ছিদ্র বেরিয়ে পড়ে।আগেকার মিষ্টি সম্পর্কই তেতো লাগে সময় সময়।সুখের খবর একটাই।অন্য অগুনতি প্রেমের গল্পের মতই মালার বাড়ি অনেকটা সহজ হয়েছে গত দু-বছরে।
শিয়ালদা থেকে কুমারেশের বাড়ি ট্রেনে পাক্কা এক ঘন্টা।সামনেই দুর্গা পুজো।গরমটা যদিও তেমন একটা কমেনি এখনও।তার উপর সমস্ত লোকাল ট্রেনে এই সময় কেনাকাটা করে ফেরার লোকজনের ভিড়।মাথাটা ধরে গেছিল কুমারেশের।ট্রেন থেকে নেমে ষ্টেশনের ঘড়ি জ্বল জ্বল করে সময় জানান দিচ্ছে।সন্ধ্যে আটটা।মালা এতক্ষণ অফিস থেকে ফিরে গেছে।মেজাজটাও খিঁচড়ে আছে আজ।আজকেই একটা টেলিফিল্মের অ্যাডভান্স পাওয়ার কথা ছিল।শালা প্রোডিউসারই এসে পৌছল না সারা দিনে।সামনেই পুজো।কেনা কাটা এখনো কিছুই হয় নি।গত দু বছর ধরে মালার বাড়িতে নিয়ম করে সবাই কে জামা কাপড় দিতে হচ্ছে।মালার আয়ের টাকা সংসারের খরচ চালাতেই শেষ হয়ে যায়।আজ সকালেই বাড়ি থেকে বেরনোর আগে মালাকে কথা দিয়ে গিয়েছিল ফিরে এসে মালার হাতে কেনাকাটার টাকা তুলে দেবে ঠিক।হল না।মনে মনে কুমারেশ সতর্ক হয়- আজ বড়সড় ঝামেলা হতে পারে।
চারতলা ফ্ল্যাটের টপ ফ্লোরে থাকে মালা-কুমারেশ।ছ’শ স্কোয়ার ফুটের ছোট্ট ফ্ল্যাট।কলিং বেল বাজাতেই দরজা খুলে দেয় মালা।কানে মোবাইল।টুকরো টুকরো কথা কানে ভেসে আসে কুমারেশের।পুজোর কেনাকাটা নিয়ে কথা হচ্ছে নিজের বোনের সঙ্গে।মালার বোনও বিবাহিত।কানপুরে থাকে।ভগ্নীপতি রেলের অফিসার।
অফিস থেকে ফিরেই সোজা স্নানে চলে যায় কুমারেশ।বাথরুম থেকে বেরিয়ে চা খায় এক কাপ।তারপর দুজনে টিভি দেখতে দেখতে এটা ওটা গল্প করে বেশ কিছু সময়।রাত দশটায় ডিনার।আজকেও বাথরুম থেকে বার হতেই চা নিয়ে তৈরিই ছিল মালা।টিভিটাও চলছে রোজকার মত।এতক্ষণে কান থেকে ফোন নামিয়ে রেখেছে মালা।চা নিয়ে কুমারেশ বসে পড়ে টিভির সামনে।মালা এঘর ওঘর করে কাজ করছে ঘুরে ঘুরে।অন্য দিন হলে মালাকে এই সময় কাছে বসতে বলে নিজেই।আজ মনটা ভালো নেই।একসময় মালা নিজেই এসে বসে কুমারেশের পাশে।
‘কত দিল গো?’, মালার গলায় কৌতুহল।
‘দেয় নি আজ’।
‘দেয় নি মানে’?
‘দেয় নি মানে দেয় নি।প্রোডিউসারই এসে পৌছল না সারা দিন’।
মালা কথা না বাড়িয়ে উঠে যায় কুমারেশের পাশ থেকে।অবাক হয় কুমারেশ।আরও বেশি কিছু আশঙ্কা করেছিল সে।কি করবে ভেবে না পেয়ে চুপ করে টিভি দেখে কুমারেশ।মালা তার সামনেই ঘুরে ঘুরে কাজ করে আগের মত।দুএকবার ডেকেও সাড়া পায় না কুমারেশ।ঠিক দশটায় খেতে ডাকে মালা।অন্যান্য দিনের মতই।ডাইনিং টেবিলের একদিকে মালা,উল্টো দিকে সে নিজে।নিশব্দে খেয়ে চলেছে মালা।কোন কথা নেই মুখে।ভাত নিয়ে নাড়াচাড়া করতে করতে পরিস্থিতি একটু স্বাভাবিক করতেই বলে ওঠে কুমারেশ, ‘হয়ে যাবে,চিন্তা কর না।প্রোডিউসার আজ এল না,কোন জরুরি কাজে আটকে গেছে হয়ত।কাল ঠিক আসবে দেখ।আর পুজো ত এখনও দেরি আছে কয়েকদিন।অত চিন্তা করছ কেন’?উত্তর পাওয়ার জন্য কিছুক্ষণ চুপ করে মালার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে কুমারেশ।মালা একই ভাবে খেয়ে চলেছে।যেন এতগুলো কথা কানে পৌছয় নি একটাও।একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভাত মাখতে শুরু করে শেষে।
ভাতের মধ্যে কিছুটা ডাল ঢেলেই থেমে যায় কুমারেশ।
‘তোমাকে বলেছি না ডালে ধনেপাতা দেবে না।আমি পারি না খেতে।বমি আসে’।
‘বমি হয়ে মর না কেন?একপয়সা রোজকারের ক্ষমতা নেই উনি আবার ধনে পাতা বাছছেন’।তীরের মত ঝাঁঝালো কথা গুলো বেরিয়ে আসে মালার মুখ থেকে।
হঠাৎ এরকম আক্রমণে কিছুটা দিশেহারা হয়ে যায় কুমারেশ।নিজেকে সামলে নিয়ে বলে, ‘এর মধ্যে রোজকার টোজকার কোথা থেকে আসছে?বললাম ত হয়ে যাবে’।মালাকে শান্ত করার চেষ্টা করে কুমারেশ।
আগুন কিন্তু শান্ত হয় না এতে।বরং জ্বলে ওঠে আবার।
‘কাকে বোঝাচ্ছ এসব ছেলে ভুলানো কথা?কবে হবে?কবে হবে আর বলতে পার?বোন কানপুর থেকে তোমার জন্য ব্লেজার কিনেছে।আমার জামদানি।বাবা মার কেনাকাটা সারা।তুমি একটা ধুতি দিতে পারবে ত এদের?নাকি সেটাও তোমার অভিনয়ের মত স্বপ্নই থেকে যাবে’?
অভিনয়কে ব্যঙ্গ করায় কিছুটা রেগে ওঠে কুমারেশ।
‘খবরদার অভিনয় নিয়ে কিছু বলবে না বলে দিলাম।ভাল হবে না’।
‘কি করবে তুমি,কি করবে?একশ বার বলব।বাবার কথা তখন যদি শুনতাম।বাড়ির প্রত্যেকে বলেছিল এরকম ভ্যাগাবন্ডকে বিয়ে না করতে।পাঁচ বছর হয়ে গেল বিয়ের।টাকার চিন্তায় এখনও একটা বাচ্চার কথা ভাবতে পারি না আমি।তুমি মাণূষ?তোমার মত মাণুষের মরে যাওয়া উচিৎ’।কান্না দলা পাকায় মালার গলায়।
কুমারেশের মাথার কিন্তু ঠিক থাকে না আর।হাতের ঠেলায় সরিয়ে দেয় ভাতের থালা।ডালের বাটি থেকে কিছুটা ডাল উথলে পরে টেবিলে।চেয়ার থেকে উঠে বেসিনে চলে যায় সোজা।মালা তখনও কেঁদে চলেছে।হাত ধুয়ে মানি ব্যাগটা নিয়ে দরজা খুলে বেরতে যায় কুমারেশ।
‘ভাল হবে না কিন্তু বাড়ির বাইরে গেলে।পছন্দ মত কথা না হলেই বাইরে চলে যাওয়া চাই তোমার না?কাপুরুষ’।
কথা কানে নেয় না কুমারেশ।দরজা খুলে নিচে নেমে যায় সোজা।সত্যিই অনেকবার রেগে বাড়ি থেকে এরকম বেরিয়ে গেছে আগেও।ফিরেও এসেছে কিছুক্ষণ পরেই।আজ কিন্তু মনে মনে ঠিক করে আর ফিরে আসবে না এই নরকে।
ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়েই সামনে একটা চারদিক খোলা মাঠ।লোকে বলে সতীর মাঠ।এক সময় এখানে নাকি সতীদাহ হত।শহরতলি বলেই এই মাঠগুলো এখনও বেঁচে আছে।অন্য দিন এসময় মাঠের পাশে হাঁটলে হয়ত মনটা ভাল হত।আজ কিন্তু তা হয় না।মনে সব সময় ঘুরপাক খায় মালার বিষ মেশানো কথাগুলো।যত মনে পড়ে ভেতরটা গরম হয়ে ওঠে তত।অন্য অনেক দিনে এতক্ষণে হয়ত বাড়ি ফিরে যেত কুমারেশ।কিন্তু আজ মন বিদ্রোহ করে ওঠে।আজ এমন কিছু করতে হবে যা কুমারেশ জীবনেও করে নি।তাকে যা করতে দেখলে মালা রেগে যাবে আরও।মন এখন কাঁটা দিয়ে কাঁটা তুলতে চাইছে।
হঠাৎ চোখে জোরালো আলো পড়ায় চিন্তার জটগুলো আলগা হয়ে যায় কুমারেশের।রাস্তার পাশেই একটা ওয়াইনশপ কাম বার।দোকানটা বন্ধ হয়ে গেলেও বারটা এখনো খোলা।সাইনবোর্ডে নামটায় চোখ আটকে যায়।ফোয়ারা।বারের ভেতরে ঢুকে পড়ে কুমারেশ।কোথায় যেন পড়েছিল একবার মদ্যপানও নাকি বিদ্রোহ জানানোর এক উপায়।
দরজা ঠেলতেই মদের অনভ্যস্ত গন্ধ এসে লাগে নাকে।ঘরের ভেতর হালকা আলোয় ভেতরটা পুরোপুরি ঠাওর করা যায় না।ওয়েটার এগিয়ে এসে একটা টেবিলে বসিয়ে দেয় কুমারেশকে।দুটো চেয়ারের একটায় আরও একজন বসে আছে।টেবিলের পাশে অর্ডারের জন্য ওয়েট করে হাসি হাসি মুখের ওয়েটার।কুমারেশ মাঝে মধ্যে আড্ডায় নানান মদের নাম শুনেছে ঠিকই।কিন্তু এখন তার একটা নামও মনে পড়ছে না।ওয়েটার তার দিকে তাকিয়ে হাসতেই থাকে একভাবে।কিছুক্ষণ এভাবে কাটার পর পাশের লোকটা বলে ওঠে
‘কি বস নতুন না কি’?
লোকটার দিকে তাকায় কুমারেশ।উত্তর দেয় না।মিলিটারির মত শক্ত চেহারা লোকটার।গালে এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত একটা কাটা দাগ এতক্ষণে চোখে পড়ে কুমারেশের।তার উত্তরের জন্য কিছু সময় অপেক্ষা করে দুটো ভদকার অর্ডার দেয় লোকটা নিজে থেকেই।নিজের জন্যও কিছু অর্ডার দেয়।নামগুলো অচেনা ঠেকে কুমারেশের।
‘ভদকা বললাম বস।প্রথম ত,হালকাই হোক’।গলা জরিয়ে আসে অচেনা লোকটার।
কুমারেশ কষ্ট করে হাসে।চোখের পলকেই চলে এসেছে পান পাত্র।পানীয় সহ।পাশে বসা লোকটা নিজে থেকেই বানিয়ে দিয়েছে পেগ।প্রথম ছোট্ট চুমুকেই কুমারেশের বেশ পছন্দ হয় মিষ্টি মিষ্টি পানীয়টা।পরের চুমুকটা একটু বড় করেই লাগায় কুমারেশ।মাথাটা ঝিম ঝিম করে ওঠে সাথে সাথে।কেউ যেন ছোটবেলার নাগরদোলায় চড়িয়ে দিয়েছে তাকে।
‘থ্যাঙ্ক ইউ’ লোকটার দিকে তাকিয়ে হেসে বলে কুমারেশ।
লোকটাও উত্তরে বেসামাল হাসে।
‘তা ব্যাপার কি বস?আগে তো দেখি নি কোনদিন?চেহারাটা তো বেশ,ওরকম বেজার মুখ করে কেন গুরু?গার্ল ফ্রেন্ড?হাফ সোল কেস’?কুমারেশের জন্য আরও একটা পেগ বানাতে বানাতে জিগ্যেস করে লোকটা।
কথাটায় খুব হেসে ওঠে কুমারেশ।মনে পড়ে কোথায় যেন পড়েছিল মদ খেলে কেউ কেউ বেশি বেশি হাসে।কথাটা মনে পড়তেই আরও জোরে হেসে ওঠে।
‘না,না,তেমন কিছু না...ওই বউয়ের সাথে একটু ঝামেলা আর কি’। হাসি থামে না কুমারেশের।
‘ও ও ও বউয়ের সাথে ঝামেলা’? হেসে ওঠে লোকটাও।
‘তো কি করা হয় আপনার? নায়ক টায়ক নাকি?চেহারাটা ত সে রকমই’।বলতে বলতে আরও মদের অর্ডার দেয় লোকটা।
‘হ্যাঁ,আমি অভিনয় করি’।হেসে উত্তর দেয় কুমারেশ।
‘সে কি?তাহলে তোমাকে আমি গুরু বলে ডাকব’।টলমল করতে করতে টেবিলের নীচে কুমারেশের পা খুঁজতে থাকে লোকটা।
নিজের পা’টা কোনরকমে সরিয়ে নিয়ে জিজ্ঞাসা করে কুমারেশ
‘আপনি কি করেন’? গলা জরিয়ে আসে কুমারেশেরও।
‘আপনি না....উঁ হু আপনি না....তুমি...বল গুরু...তুমি বল আগে’।
‘আচ্ছা তুমি’।জিভের আড় কাটাতে সময় লাগে কুমারেশের।
‘আমি ছোটখাট কন্ট্রাকটরি করি।বুঝলে’?
কন্ট্রাকটর কুমারেশ অনেক দেখেছে।না বোঝার কিছু নেই।আলসে মেরে যাওয়া জিভটাকে লাগামে আনতে কষ্ট হয় একটু।অস্ফুটে বলে, ‘বুঝেছি’।
‘বোঝনি গুরু,বোঝনি।আরে বাবা এটা সেই কন্ট্রাকটরি না...এই ধর তোমার বউ তোমাকে জ্বালাচ্ছে...তুমি আমায় কন্ট্রাক্ট দিলে আর আমি তোমার বউকে সাবাড় করে দিলাম’।কথাগুলো বলেই লোকটা হেসে ওঠে আবার।
এরকম লোকের কথা কুমারেশ সিনেমার স্ক্রিপ্টে পড়েছে।সামনে থেকে দেখেনি কোনদিন।লোকটা হাসতে হাসতে বলে চলে, ‘দরকার হলে বলবে গুরু।ওসব মেয়েমানুষের জ্বালা হেভি কেলো।আমি আছি তোমার জন্য।তবে পয়সা টয়সা নেব না কিন্তু,তোমাকে গুরু ডেকেছি আমি’।কথাগুলো যেন বহু দূর থেকে ভেসে আসে কুমারেশের কানে।দিনের পর দিন চলতে থাকা ঝামেলার স্মৃতি মিষ্টি পানীয়কে তেতো করে তোলে।কষ্ট করে চোখ টেনে খুলে ধরে কুমারেশ।লোকটার দিকে তাকিয়ে বলে, ‘পারবে? পারবে আমার বউকে...’
কথাটা শেষ করতে দেয় না মিলিটারি চেহারা।কুমারেশের গলা জরিয়ে বলে, ‘ তুমি শুধু বলে দেখ গুরু...শুধু কোথায় পাব বলে দাও আর একটা ছবি...ব্যস’।কুমারেশের গলাটা আরও শক্ত করে জরিয়ে ধরেছে তার শিষ্য।
কুমারেশ পকেট থেকে কাঁপা কাঁপা হাতে মানিব্যাগ বের করে প্যান্টের পকেট থেকে।তার মানি ব্যাগে মালার একটা পাসপোর্ট সাইজ ছবি থাকে সবসময়।ছবিটা লোকটার হাতে দিয়ে কোনমতে টাল সামলে বলে কুমারেশ, ‘সকাল ন’টার বাস ধরে বাসস্ট্যান্ড থেকে।কিন্তু একেবারে শেষ করতে হবে না ভাই’।
‘ওসব তুমি ভেব না গুরু।কাল থেকে তোমার প্রবলেম খতম’।গলার ফাঁস আরও একটু শক্ত হয় কুমারেশের।
ঘুমের মাঝে পাশ ফেরে কুমারেশ।স্বপ্নটা তার বহুবার দেখা।এমনকি এই স্বপ্নটা তার জীবনে ঘটেছে অনেকবার।তাই স্বপ্নটা আরও স্পষ্ট দেখায় যেন।স্বপ্নের মধ্যেই কুমারেশ বাড়ি থেকে রাগ করে বেরিয়ে যায় মালার সঙ্গে ঝগড়া করে।সামনে ভাতের থালা পড়ে।বেশ কিছুক্ষণ ঘুরে ফিরে বাড়ি ফিরে আসে কুমারেশ।ঘড়িতে মাঝরাত।দরজা খুলে দেয় মালা।কেঁদে কেঁদে চোখদুটো ফুলে গেছে।ঘরে ঢুকতেই কুমারেশকে হাত ধরে খাওয়ার টেবিলে বসায়।ফেলে যাওয়া থালা থেকে ভাত তুলে মুখে গুঁজে দিতে থাকে মালা।চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়তে থাকে জল।চুপচাপ খেয়ে চলে কুমারেশ।তার চোখও ছলছল করে।
হঠাৎ পায়ে কিছু নরম নরম ঠেকতেই ঘুম ভেঙে যায় কুমারেশের।পায়ের পাতায় একটা কুকুর নাক ঘষছে বসে।ধড়মড়িয়ে উঠে বসে কুমারেশ।সকাল হচ্ছে সবে।সে সতীর মাঠে শুয়ে।খোলা মাঠে হিম পড়ছে।কুয়াশায় বেশিদূর অবধি দেখা যায় না ভাল করে।ঠান্ডা ঠান্ডা লাগে বেশ।হঠাৎ কালকের রাতের ঘটনা মনে পড়ে কুমারেশের।ঠান্ডা শরীর থেকে উধাও হয়ে যায় মুহুর্তে।গলা বেয়ে ঘাম নামতে থাকে পিঠে।ভয়ে গলাটা কাঠ হয়ে আসে।এতক্ষণ স্বপ্নে যা যা দেখল কালকের রাতের লোকটাকে বলা হয় নি কুমারেশের।
খুব ছোট বেলায় বাবা মা মারা যাওয়ার পর থেকে কলকাতায় মামার বাড়িতে মানুষ।বিয়ের পর থেকে যদিও সস্ত্রীক কুমারেশের ঠিকানা কলকাতার শহরতলিতে।মালার সঙ্গে বিয়ে বছর পাঁচেক হল।মালা পি.এইচ.ডি হলেও তার মধ্যে কোন অহংকার নেই।মালার বাবার বাড়ি মালদা।মালার বাবা মালদা শহরের নামকরা ডাক্তার।মালাদের পূর্ব পুরুষ এক কালে মালদার কিছু গ্রামের জমিদার ছিল।বেশ বড় বংশ।এরকম ঘরের মেয়ে হয়েও মালা আর পাঁচটা সাধারণ গৃহস্থ বাড়ির মেয়ের মত সংসারের সবরকমের কাজে চটপটে।এপর্যন্ত শুনে কুমারেশের জীবনটা বেশ সুখের মনে হলেও বাস্তবে এতটা সুখের ছিল না।
কুমারেশের অভিনেতা হয়ে যাওয়াটা আরেকটা গল্প।সে যখন খুব ছোট,সবে পা ছড়িয়ে বসতে শিখেছে, তখনই একটা ছবিতে অভিনয় করে ফেলেছে।একটা মাত্র সিন।গভীর জঙ্গলে ভেসে আসছে এক শিশুর কান্না।পথ চলতি কাঠুরিয়া কান্নার আওয়াজ শুনে খুঁজে বের করে সেই শিশুকে।দেবশিশুর মত দেখতে বাচ্চাটাকে বনে ফেলে দিয়ে গেছে কেউ।কাঠুরিয়া বাচ্চাটাকে কোলে তুলে বাড়ি নিয়ে যায় সঙ্গে করে।সেই বাচ্চাটাই বড় হলে সিনেমার নায়ক হয়- লালকমল।সিনেমার নামও লালকমল।সিনেমাটা আদৌ চলেছিল বলে যেমন জানা যায় না তেমনি জানা যায় না কুমারেশ কি করে এই সিনেমাতে ঢুকে গিয়েছিল। শুধু শুটিংয়ের একটা হলদে ছবি থেকে গেছে।কিন্তু অর্দৃষ্ট সেই দিন থেকে কুমারেশের নামের সাথে সিনেমাকে জুড়ে দিয়েছিল আড়াল থেকে।ছোট থাকতে বাবা মা কে হারানোর পর থেকেই মামারবাড়িতে থাকা।মামারা তখনও অবিবাহিত।একমাত্র ভাগ্নে কে স্কুলে ভর্তি করলেও কুমারেশের পড়াশুনোয় মন ছিল না কোন কালেই।যদিও মাথাটা সত্যিই শার্প ছিল গোড়া থেকেই।কিন্তু বয়সের সাথে সাথে আভিনয়ের নেশাটা রক্তে জাল ছড়াচ্ছিল দিনে দিনে।কলেজ শেষ হতে না হতেই সে নেশা তাকে গ্রাস করল পুরোপুরি।অন্যান্য বন্ধুরা যখন চাকরির খোঁজে ব্যস্ত তখন কুমারেশকে পাওয়া যেত টালিগঞ্জের স্টুডিও পাড়ায়।তার দুচোখ তখন স্বপ্নে ভরপুর।অভিনয়,সিনেমা।স্বপ্ন যদিও আরও একটা ছিল।মালা।কলেজে পড়তে পড়তেই মালার সাথে আলাপ।মালদার মেয়ে।পড়াশুনোয় তুখোড়।হিস্ট্রি নিয়ে পড়ে।দুজনের আলাপ কলেজের নাটকে।কুমারেশ নাটকে নায়ক।মালা ছিল কোরাস গানের দলে।প্রথম প্রথম রির্হাসালে একটা দুটো কথা।দেখতে দেখতে আলতো আলাপ বন্ধুত্বে গড়ায়।সে বন্ধুত্বও গাঢ় হয় ধীরে ধীরে।মালা তখন পি.এইচ.ডি করছে।আর দেরি করা ঠিক হবে না ভেবে বাড়িতে সবটুকু জানিয়ে দেয় মালা।বাবা মা রাজি হন না যদিও।কারণ কুমারেশ তখনও বেকার।তারপর যা হয় আর কি আর পাঁচটা বাঙালি ঘরে।প্রথমে বাবা মা,তারপর আত্মীয়-স্বজন সবাই মালাকে বোঝাতে নেমে পড়ে একে একে।বাংলার এই সমস্ত প্রেম কাহিনীর ছকটা একই রকমের হয়।মালা সবার কথা অগ্রাহ্য করে কুমারেশকে বিয়ে করে ফেলে একদিন।সংসার চালাতে একটা ছোটখাট প্রাইভেট কোম্পানীতে চাকরি নেয়।বাড়ি,পরিবার ছেড়ে আসতে কষ্ট হয়েছিল ঠিকই,কিন্তু কুমারেশকে পাওয়ার আনন্দ সেই কষ্টকে ভুলিয়ে দিতে পেরেছিল।কুমারেশের স্বপ্ন নিয়ে নিজের খুব ভরসাও ছিল মালার।সেও বিশ্বাস করত কুমারেশ সত্যি সত্যি একদিন খুব বড় অভিনেতা হবে।কিন্তু এই পাঁচ বছরে সেই বিশ্বাসে অনেকটা ফাটল ধরে গেছে।কারণ এখনও অবধি গোটা পাঁচেক ছবিতে সাইড রোল ছাড়া কুমারেশ বিশেষ কিছু করতে পারে নি।ছবিগুলোও তেমন বড় কিছু নয়।ফলে টাকার পরিমাণ যতসামান্যই।প্রথম প্রথম এসব নিয়ে কোন ঝামেলাই ছিল না দুজনের মধ্যে।দিনে দিনে সংসারের দায় দায়িত্ব বাড়ার সাথে সাথে বিশ্বাস আর ভালোবাসার লৌহবাসরে ছোট ছোট ছিদ্র জন্ম নিয়েছে নিজেদের অজান্তেই।এখন মাঝে মধ্যেই কথার মধ্যে সে সব ছিদ্র বেরিয়ে পড়ে।আগেকার মিষ্টি সম্পর্কই তেতো লাগে সময় সময়।সুখের খবর একটাই।অন্য অগুনতি প্রেমের গল্পের মতই মালার বাড়ি অনেকটা সহজ হয়েছে গত দু-বছরে।
শিয়ালদা থেকে কুমারেশের বাড়ি ট্রেনে পাক্কা এক ঘন্টা।সামনেই দুর্গা পুজো।গরমটা যদিও তেমন একটা কমেনি এখনও।তার উপর সমস্ত লোকাল ট্রেনে এই সময় কেনাকাটা করে ফেরার লোকজনের ভিড়।মাথাটা ধরে গেছিল কুমারেশের।ট্রেন থেকে নেমে ষ্টেশনের ঘড়ি জ্বল জ্বল করে সময় জানান দিচ্ছে।সন্ধ্যে আটটা।মালা এতক্ষণ অফিস থেকে ফিরে গেছে।মেজাজটাও খিঁচড়ে আছে আজ।আজকেই একটা টেলিফিল্মের অ্যাডভান্স পাওয়ার কথা ছিল।শালা প্রোডিউসারই এসে পৌছল না সারা দিনে।সামনেই পুজো।কেনা কাটা এখনো কিছুই হয় নি।গত দু বছর ধরে মালার বাড়িতে নিয়ম করে সবাই কে জামা কাপড় দিতে হচ্ছে।মালার আয়ের টাকা সংসারের খরচ চালাতেই শেষ হয়ে যায়।আজ সকালেই বাড়ি থেকে বেরনোর আগে মালাকে কথা দিয়ে গিয়েছিল ফিরে এসে মালার হাতে কেনাকাটার টাকা তুলে দেবে ঠিক।হল না।মনে মনে কুমারেশ সতর্ক হয়- আজ বড়সড় ঝামেলা হতে পারে।
চারতলা ফ্ল্যাটের টপ ফ্লোরে থাকে মালা-কুমারেশ।ছ’শ স্কোয়ার ফুটের ছোট্ট ফ্ল্যাট।কলিং বেল বাজাতেই দরজা খুলে দেয় মালা।কানে মোবাইল।টুকরো টুকরো কথা কানে ভেসে আসে কুমারেশের।পুজোর কেনাকাটা নিয়ে কথা হচ্ছে নিজের বোনের সঙ্গে।মালার বোনও বিবাহিত।কানপুরে থাকে।ভগ্নীপতি রেলের অফিসার।
অফিস থেকে ফিরেই সোজা স্নানে চলে যায় কুমারেশ।বাথরুম থেকে বেরিয়ে চা খায় এক কাপ।তারপর দুজনে টিভি দেখতে দেখতে এটা ওটা গল্প করে বেশ কিছু সময়।রাত দশটায় ডিনার।আজকেও বাথরুম থেকে বার হতেই চা নিয়ে তৈরিই ছিল মালা।টিভিটাও চলছে রোজকার মত।এতক্ষণে কান থেকে ফোন নামিয়ে রেখেছে মালা।চা নিয়ে কুমারেশ বসে পড়ে টিভির সামনে।মালা এঘর ওঘর করে কাজ করছে ঘুরে ঘুরে।অন্য দিন হলে মালাকে এই সময় কাছে বসতে বলে নিজেই।আজ মনটা ভালো নেই।একসময় মালা নিজেই এসে বসে কুমারেশের পাশে।
‘কত দিল গো?’, মালার গলায় কৌতুহল।
‘দেয় নি আজ’।
‘দেয় নি মানে’?
‘দেয় নি মানে দেয় নি।প্রোডিউসারই এসে পৌছল না সারা দিন’।
মালা কথা না বাড়িয়ে উঠে যায় কুমারেশের পাশ থেকে।অবাক হয় কুমারেশ।আরও বেশি কিছু আশঙ্কা করেছিল সে।কি করবে ভেবে না পেয়ে চুপ করে টিভি দেখে কুমারেশ।মালা তার সামনেই ঘুরে ঘুরে কাজ করে আগের মত।দুএকবার ডেকেও সাড়া পায় না কুমারেশ।ঠিক দশটায় খেতে ডাকে মালা।অন্যান্য দিনের মতই।ডাইনিং টেবিলের একদিকে মালা,উল্টো দিকে সে নিজে।নিশব্দে খেয়ে চলেছে মালা।কোন কথা নেই মুখে।ভাত নিয়ে নাড়াচাড়া করতে করতে পরিস্থিতি একটু স্বাভাবিক করতেই বলে ওঠে কুমারেশ, ‘হয়ে যাবে,চিন্তা কর না।প্রোডিউসার আজ এল না,কোন জরুরি কাজে আটকে গেছে হয়ত।কাল ঠিক আসবে দেখ।আর পুজো ত এখনও দেরি আছে কয়েকদিন।অত চিন্তা করছ কেন’?উত্তর পাওয়ার জন্য কিছুক্ষণ চুপ করে মালার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে কুমারেশ।মালা একই ভাবে খেয়ে চলেছে।যেন এতগুলো কথা কানে পৌছয় নি একটাও।একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভাত মাখতে শুরু করে শেষে।
ভাতের মধ্যে কিছুটা ডাল ঢেলেই থেমে যায় কুমারেশ।
‘তোমাকে বলেছি না ডালে ধনেপাতা দেবে না।আমি পারি না খেতে।বমি আসে’।
‘বমি হয়ে মর না কেন?একপয়সা রোজকারের ক্ষমতা নেই উনি আবার ধনে পাতা বাছছেন’।তীরের মত ঝাঁঝালো কথা গুলো বেরিয়ে আসে মালার মুখ থেকে।
হঠাৎ এরকম আক্রমণে কিছুটা দিশেহারা হয়ে যায় কুমারেশ।নিজেকে সামলে নিয়ে বলে, ‘এর মধ্যে রোজকার টোজকার কোথা থেকে আসছে?বললাম ত হয়ে যাবে’।মালাকে শান্ত করার চেষ্টা করে কুমারেশ।
আগুন কিন্তু শান্ত হয় না এতে।বরং জ্বলে ওঠে আবার।
‘কাকে বোঝাচ্ছ এসব ছেলে ভুলানো কথা?কবে হবে?কবে হবে আর বলতে পার?বোন কানপুর থেকে তোমার জন্য ব্লেজার কিনেছে।আমার জামদানি।বাবা মার কেনাকাটা সারা।তুমি একটা ধুতি দিতে পারবে ত এদের?নাকি সেটাও তোমার অভিনয়ের মত স্বপ্নই থেকে যাবে’?
অভিনয়কে ব্যঙ্গ করায় কিছুটা রেগে ওঠে কুমারেশ।
‘খবরদার অভিনয় নিয়ে কিছু বলবে না বলে দিলাম।ভাল হবে না’।
‘কি করবে তুমি,কি করবে?একশ বার বলব।বাবার কথা তখন যদি শুনতাম।বাড়ির প্রত্যেকে বলেছিল এরকম ভ্যাগাবন্ডকে বিয়ে না করতে।পাঁচ বছর হয়ে গেল বিয়ের।টাকার চিন্তায় এখনও একটা বাচ্চার কথা ভাবতে পারি না আমি।তুমি মাণূষ?তোমার মত মাণুষের মরে যাওয়া উচিৎ’।কান্না দলা পাকায় মালার গলায়।
কুমারেশের মাথার কিন্তু ঠিক থাকে না আর।হাতের ঠেলায় সরিয়ে দেয় ভাতের থালা।ডালের বাটি থেকে কিছুটা ডাল উথলে পরে টেবিলে।চেয়ার থেকে উঠে বেসিনে চলে যায় সোজা।মালা তখনও কেঁদে চলেছে।হাত ধুয়ে মানি ব্যাগটা নিয়ে দরজা খুলে বেরতে যায় কুমারেশ।
‘ভাল হবে না কিন্তু বাড়ির বাইরে গেলে।পছন্দ মত কথা না হলেই বাইরে চলে যাওয়া চাই তোমার না?কাপুরুষ’।
কথা কানে নেয় না কুমারেশ।দরজা খুলে নিচে নেমে যায় সোজা।সত্যিই অনেকবার রেগে বাড়ি থেকে এরকম বেরিয়ে গেছে আগেও।ফিরেও এসেছে কিছুক্ষণ পরেই।আজ কিন্তু মনে মনে ঠিক করে আর ফিরে আসবে না এই নরকে।
ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়েই সামনে একটা চারদিক খোলা মাঠ।লোকে বলে সতীর মাঠ।এক সময় এখানে নাকি সতীদাহ হত।শহরতলি বলেই এই মাঠগুলো এখনও বেঁচে আছে।অন্য দিন এসময় মাঠের পাশে হাঁটলে হয়ত মনটা ভাল হত।আজ কিন্তু তা হয় না।মনে সব সময় ঘুরপাক খায় মালার বিষ মেশানো কথাগুলো।যত মনে পড়ে ভেতরটা গরম হয়ে ওঠে তত।অন্য অনেক দিনে এতক্ষণে হয়ত বাড়ি ফিরে যেত কুমারেশ।কিন্তু আজ মন বিদ্রোহ করে ওঠে।আজ এমন কিছু করতে হবে যা কুমারেশ জীবনেও করে নি।তাকে যা করতে দেখলে মালা রেগে যাবে আরও।মন এখন কাঁটা দিয়ে কাঁটা তুলতে চাইছে।
হঠাৎ চোখে জোরালো আলো পড়ায় চিন্তার জটগুলো আলগা হয়ে যায় কুমারেশের।রাস্তার পাশেই একটা ওয়াইনশপ কাম বার।দোকানটা বন্ধ হয়ে গেলেও বারটা এখনো খোলা।সাইনবোর্ডে নামটায় চোখ আটকে যায়।ফোয়ারা।বারের ভেতরে ঢুকে পড়ে কুমারেশ।কোথায় যেন পড়েছিল একবার মদ্যপানও নাকি বিদ্রোহ জানানোর এক উপায়।
দরজা ঠেলতেই মদের অনভ্যস্ত গন্ধ এসে লাগে নাকে।ঘরের ভেতর হালকা আলোয় ভেতরটা পুরোপুরি ঠাওর করা যায় না।ওয়েটার এগিয়ে এসে একটা টেবিলে বসিয়ে দেয় কুমারেশকে।দুটো চেয়ারের একটায় আরও একজন বসে আছে।টেবিলের পাশে অর্ডারের জন্য ওয়েট করে হাসি হাসি মুখের ওয়েটার।কুমারেশ মাঝে মধ্যে আড্ডায় নানান মদের নাম শুনেছে ঠিকই।কিন্তু এখন তার একটা নামও মনে পড়ছে না।ওয়েটার তার দিকে তাকিয়ে হাসতেই থাকে একভাবে।কিছুক্ষণ এভাবে কাটার পর পাশের লোকটা বলে ওঠে
‘কি বস নতুন না কি’?
লোকটার দিকে তাকায় কুমারেশ।উত্তর দেয় না।মিলিটারির মত শক্ত চেহারা লোকটার।গালে এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত একটা কাটা দাগ এতক্ষণে চোখে পড়ে কুমারেশের।তার উত্তরের জন্য কিছু সময় অপেক্ষা করে দুটো ভদকার অর্ডার দেয় লোকটা নিজে থেকেই।নিজের জন্যও কিছু অর্ডার দেয়।নামগুলো অচেনা ঠেকে কুমারেশের।
‘ভদকা বললাম বস।প্রথম ত,হালকাই হোক’।গলা জরিয়ে আসে অচেনা লোকটার।
কুমারেশ কষ্ট করে হাসে।চোখের পলকেই চলে এসেছে পান পাত্র।পানীয় সহ।পাশে বসা লোকটা নিজে থেকেই বানিয়ে দিয়েছে পেগ।প্রথম ছোট্ট চুমুকেই কুমারেশের বেশ পছন্দ হয় মিষ্টি মিষ্টি পানীয়টা।পরের চুমুকটা একটু বড় করেই লাগায় কুমারেশ।মাথাটা ঝিম ঝিম করে ওঠে সাথে সাথে।কেউ যেন ছোটবেলার নাগরদোলায় চড়িয়ে দিয়েছে তাকে।
‘থ্যাঙ্ক ইউ’ লোকটার দিকে তাকিয়ে হেসে বলে কুমারেশ।
লোকটাও উত্তরে বেসামাল হাসে।
‘তা ব্যাপার কি বস?আগে তো দেখি নি কোনদিন?চেহারাটা তো বেশ,ওরকম বেজার মুখ করে কেন গুরু?গার্ল ফ্রেন্ড?হাফ সোল কেস’?কুমারেশের জন্য আরও একটা পেগ বানাতে বানাতে জিগ্যেস করে লোকটা।
কথাটায় খুব হেসে ওঠে কুমারেশ।মনে পড়ে কোথায় যেন পড়েছিল মদ খেলে কেউ কেউ বেশি বেশি হাসে।কথাটা মনে পড়তেই আরও জোরে হেসে ওঠে।
‘না,না,তেমন কিছু না...ওই বউয়ের সাথে একটু ঝামেলা আর কি’। হাসি থামে না কুমারেশের।
‘ও ও ও বউয়ের সাথে ঝামেলা’? হেসে ওঠে লোকটাও।
‘তো কি করা হয় আপনার? নায়ক টায়ক নাকি?চেহারাটা ত সে রকমই’।বলতে বলতে আরও মদের অর্ডার দেয় লোকটা।
‘হ্যাঁ,আমি অভিনয় করি’।হেসে উত্তর দেয় কুমারেশ।
‘সে কি?তাহলে তোমাকে আমি গুরু বলে ডাকব’।টলমল করতে করতে টেবিলের নীচে কুমারেশের পা খুঁজতে থাকে লোকটা।
নিজের পা’টা কোনরকমে সরিয়ে নিয়ে জিজ্ঞাসা করে কুমারেশ
‘আপনি কি করেন’? গলা জরিয়ে আসে কুমারেশেরও।
‘আপনি না....উঁ হু আপনি না....তুমি...বল গুরু...তুমি বল আগে’।
‘আচ্ছা তুমি’।জিভের আড় কাটাতে সময় লাগে কুমারেশের।
‘আমি ছোটখাট কন্ট্রাকটরি করি।বুঝলে’?
কন্ট্রাকটর কুমারেশ অনেক দেখেছে।না বোঝার কিছু নেই।আলসে মেরে যাওয়া জিভটাকে লাগামে আনতে কষ্ট হয় একটু।অস্ফুটে বলে, ‘বুঝেছি’।
‘বোঝনি গুরু,বোঝনি।আরে বাবা এটা সেই কন্ট্রাকটরি না...এই ধর তোমার বউ তোমাকে জ্বালাচ্ছে...তুমি আমায় কন্ট্রাক্ট দিলে আর আমি তোমার বউকে সাবাড় করে দিলাম’।কথাগুলো বলেই লোকটা হেসে ওঠে আবার।
এরকম লোকের কথা কুমারেশ সিনেমার স্ক্রিপ্টে পড়েছে।সামনে থেকে দেখেনি কোনদিন।লোকটা হাসতে হাসতে বলে চলে, ‘দরকার হলে বলবে গুরু।ওসব মেয়েমানুষের জ্বালা হেভি কেলো।আমি আছি তোমার জন্য।তবে পয়সা টয়সা নেব না কিন্তু,তোমাকে গুরু ডেকেছি আমি’।কথাগুলো যেন বহু দূর থেকে ভেসে আসে কুমারেশের কানে।দিনের পর দিন চলতে থাকা ঝামেলার স্মৃতি মিষ্টি পানীয়কে তেতো করে তোলে।কষ্ট করে চোখ টেনে খুলে ধরে কুমারেশ।লোকটার দিকে তাকিয়ে বলে, ‘পারবে? পারবে আমার বউকে...’
কথাটা শেষ করতে দেয় না মিলিটারি চেহারা।কুমারেশের গলা জরিয়ে বলে, ‘ তুমি শুধু বলে দেখ গুরু...শুধু কোথায় পাব বলে দাও আর একটা ছবি...ব্যস’।কুমারেশের গলাটা আরও শক্ত করে জরিয়ে ধরেছে তার শিষ্য।
কুমারেশ পকেট থেকে কাঁপা কাঁপা হাতে মানিব্যাগ বের করে প্যান্টের পকেট থেকে।তার মানি ব্যাগে মালার একটা পাসপোর্ট সাইজ ছবি থাকে সবসময়।ছবিটা লোকটার হাতে দিয়ে কোনমতে টাল সামলে বলে কুমারেশ, ‘সকাল ন’টার বাস ধরে বাসস্ট্যান্ড থেকে।কিন্তু একেবারে শেষ করতে হবে না ভাই’।
‘ওসব তুমি ভেব না গুরু।কাল থেকে তোমার প্রবলেম খতম’।গলার ফাঁস আরও একটু শক্ত হয় কুমারেশের।
ঘুমের মাঝে পাশ ফেরে কুমারেশ।স্বপ্নটা তার বহুবার দেখা।এমনকি এই স্বপ্নটা তার জীবনে ঘটেছে অনেকবার।তাই স্বপ্নটা আরও স্পষ্ট দেখায় যেন।স্বপ্নের মধ্যেই কুমারেশ বাড়ি থেকে রাগ করে বেরিয়ে যায় মালার সঙ্গে ঝগড়া করে।সামনে ভাতের থালা পড়ে।বেশ কিছুক্ষণ ঘুরে ফিরে বাড়ি ফিরে আসে কুমারেশ।ঘড়িতে মাঝরাত।দরজা খুলে দেয় মালা।কেঁদে কেঁদে চোখদুটো ফুলে গেছে।ঘরে ঢুকতেই কুমারেশকে হাত ধরে খাওয়ার টেবিলে বসায়।ফেলে যাওয়া থালা থেকে ভাত তুলে মুখে গুঁজে দিতে থাকে মালা।চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়তে থাকে জল।চুপচাপ খেয়ে চলে কুমারেশ।তার চোখও ছলছল করে।
হঠাৎ পায়ে কিছু নরম নরম ঠেকতেই ঘুম ভেঙে যায় কুমারেশের।পায়ের পাতায় একটা কুকুর নাক ঘষছে বসে।ধড়মড়িয়ে উঠে বসে কুমারেশ।সকাল হচ্ছে সবে।সে সতীর মাঠে শুয়ে।খোলা মাঠে হিম পড়ছে।কুয়াশায় বেশিদূর অবধি দেখা যায় না ভাল করে।ঠান্ডা ঠান্ডা লাগে বেশ।হঠাৎ কালকের রাতের ঘটনা মনে পড়ে কুমারেশের।ঠান্ডা শরীর থেকে উধাও হয়ে যায় মুহুর্তে।গলা বেয়ে ঘাম নামতে থাকে পিঠে।ভয়ে গলাটা কাঠ হয়ে আসে।এতক্ষণ স্বপ্নে যা যা দেখল কালকের রাতের লোকটাকে বলা হয় নি কুমারেশের।
0 মন্তব্যসমূহ