শিপা সুলতানা'র গল্প : কবি

আমি তাকে বলেছিলাম শৈশবের সব খেলা শেষ হলে যেন আমার কাছে ফিরে আসে।

তারপর নিয়তি-পাহাড়ের মেঘ উড়ে গেছে কোহেকাফের দেশে। ডানকিনে মাছের গর্ভ ভরে উঠেছে অফুরন্ত স্বর্ণবিন্দুতে। পাঁচ পীরের মাজারের পথে উড়ে গেছে বড় পোতার বক। রাখাল বৈরাগীর ভাবে ভর করেছে নিধুরাণি বৈষ্ণবী। এক জোড়া চড়ুই ঘর বেঁধেছিল টিমটিমে এক মনগাছে, এবার তাদের কোল ভরে বালবাচ্চা এসেছে।


আর আমি তাকে বলেছিলাম খেলনাগুলো পরিপাট করে যেন আমার কাছে ফিরে আসে সে।

পাহাড়ের মাথা ছাড়িয়ে দূর দূর আকাশে তাকাই। তূর-পাহাড়ের আঁধার ঘনিয়ে আসছে। সূর্য ডুবতে বসেছে, গরুগুলো বাড়ি ফিরে যাচ্ছে, আলসে-ভরা নতুন বউয়ের মত গাছগুলো এলিয়ে পড়ছে ঘুমে, বদলে যাচ্ছে ডেফল পাতার রং, তারপর ঝড় আসবে... অনেক অনেক কালো কালো ঝড়। পিঠে চাবুক মেরে রক্ত ছিঁড়ে নিয়ে যাবে আকাশের মেঘ, সে কি ঝড়ের আগেই আমার কাছে ফিরে আসবে না?

একজন এসে বললো, আমার কাছ থেকে কী যেন হারিয়ে গেছে। একজনের বয়স উনিশ। উনিশ বছর সাত মাস। কী তোমার চোখ, তোমার বাগানের গেন্ডা ফুল, মায়ের হাতে রাঁধা পুঁটি মাছের পেটি, শিশিতে ভরে রাখা তুকমার বিচি ছিপি খুলে নিয়ে গেছে কেউ, নাম না-জানা সেই সুগন্ধী রমণী ট্রান্সফার নিয়ে চলে গেছে মহেশখালি, জামার বোতাম, তোমার না-লেখা ভূগোলের খাতা, বয়াম ভেঙে এলাচ ফলের ঘ্রাণ উড়িয়ে দিয়েছে কেউ, তোমার কী এক সহপাঠি প্রেমিকা, বাঁশবনের খরানি, পুকুর ঘাটের সিঁড়ি, পরশু রাতের ঘুম? বই চাপা দিয়েছিলে যে সু-সংবাদ, উত্তর পাড়ার হরি পাগলা, কাকেশ্বরীর ডানকিনে?

এক একুশ বছর এসে বললো, বাছা, তবে কি তোমার কাছ থেকে তুমি হারিয়ে গেছ? সে বললো, বুক পকেটে জমানো জলপাই পাতা...

শব্দটাকে কি চেস্ট-ড্রয়ারে রেখেছিলাম? গহনার বাক্সে, আলমিরাতে রাখা বিবাহ-রং শাড়ির ভাঁজে, অনেক খুঁজছি। অনেক অনেক খুঁজলে পানির তেষ্টা পায়, অনেক অনেক ঘুম পায়। প্রচণ্ড শব্দটা কি গ্লাসের তলায় চাপা দিয়েছিলাম? শব্দটা কি ঘুমের পুরিয়া ভেবে গিলে ফেলেছি? গুছিয়ে মোমবাতির মাথায়ও জ্বালিয়ে রাখতে পারি, বোশেখের বাতাস কি খানখান করে ভেঙে ফেলেছে শব্দটি? উঠান জুড়ে পাট পাট করে রাখা এক ঝাঁকা বাবলার কাঁটা, শব্দটা কি কাঁটার আগায় গেঁথে আছে? ঘুমের ভেতর অনেক অনেক ক্ষিধে পায়, তবে কি খেয়ে ফেলেছি ঘুমের ভেতর? ফের চেস্ট-ড্রয়ার দেখি, চিঠিযুগের কিছু ক্ষয়া অক্ষর আছে, একেকটা অক্ষর উল্টে দেখি পাল্টে দেখি, শব্দটা তবে খালের ওপারে গেছে ধানবান্নির হাটে? পুরনো জুতার ভেতর খুঁজি, পুরনো ভ্যানিটি ব্যাগের ভেতর, যদি বেড়াতে যায় পুকুরের ঘাটে, নিঘ্যাৎ বোয়ালের পেটে গেছে। বোয়াল বড় হারামজাদা! দুর্দান্ত শব্দটা কি যুদ্ধ যুদ্ধ খেলতে গেছে সদরের পথে? খড় পুড়িয়ে রোদ পোহাচ্ছিলাম, শব্দটা কি প্রবল শব্দে ফেটে গেছে খইয়ের মতন?

বসে বসে কী করছি? রাণিমাতার জন্য জাতিসাপের পোনা ভুনা হচ্ছে, রাঁধুনির ঘাড়ে বসে চিনির বয়াম পাহারা দিচ্ছি।

পাশের বাড়ির খোকা আগুন কুড়াতে বেরিয়েছে, মেয়েরা যেন তার কোমরের ঘুনসি ধরে টানাটানি করতে না-পারে, ঘুনসি জোড়া দুধের দরে কেনা।

বসে বসে কী করছি! চারদিক থেকে বেরিয়ে দশ দিকে ছড়িয়ে পড়েছে শূকরেরা। তাদের লাখে লাখে পুত্রকন্যা। তারা আগে ধান কেটে নিয়ে যেত। তারা আগে হাওরের মাছ তুলে নিয়ে যেত। তারা এখন রক্ত খাচ্ছে। তারা আজকাল মানুষের কলিজায় দাঁত বসিয়েছে।

এই পথে সাগর-রুনি’র বিবাহের বরযাত্রী যাবে, তাই ধূলা থেকে কাঁটা বাছছি, রাজার লেঠেল পাহারা দিচ্ছি। পুরনো ভাই-বেরাদরের কবরে বসে গান শুনাচ্ছি। তারা যেতে চায়নি, অথচ রাণিমাতাদের লেঠেল তাদের ঘাড় ধরে জঙ্গলে পাঠিয়েছিলো, শেষে জ্যান্ত কবর দিয়েছে। কারণ তারা যুদ্ধের কৌশল জেনে গিয়েছিলো। তারা যুদ্ধ বাতিল করেছিলো। একজনের খুব এলার্জি হচ্ছে, এ তার গ্রামের মাটি নয়, একজনের খুব দম বন্ধ লাগছে, তাঁর গাঁয়ের কবরখানা অনেক গাছগাছালিতে ভরভরন্ত। একজনের মন খারাপ আর কমছেই না, এ তাঁর মায়ের কবর থেকে অনেক অনেক দূরের কবর।

গান তাদের পছন্দ হচ্ছে না, তারা সুর বুঝছে না। ভূ-খণ্ডই কি বদলে গেছে? কবরবাসীদের গান শোনানো সহজ হচ্ছে না।

বসে বসে কী করছি? কলিজা কেটে শুকাতে দিয়েছিলাম রোদে। বসে বসে মাছি তাড়াচ্ছি...সাগর-রুনির বিবাহের বরযাত্রীর জন্য দুধ-ভাত জ্বাল দিচ্ছি...

আমি কেবল খুঁড়ছি...খুঁড়তে খুঁড়তে চলে গেছি কপিল মুনির দেশে। অনেক অনেক ভেতর খুঁড়ে দেখি এ-মাটি কি পৃথিবীর? খুঁড়তে খুঁড়তে বাল্যবন্ধুর বাড়ির উঠান পর্যন্ত পৌঁছে গেছি। আমি জন্ম জন্ম থেকে কেবল কবরই খুঁড়ছি...একদা খুঁড়তে খুঁড়তে প্রতিবেশিদের কবরে মাথা গলিয়ে ফেলেছি। তারা জানতে চাইলো : আটকুড়া সেই কাঁঠাল গাছে কোনো ফল এসেছিলো কি কোনো কালে? বউয়ের গর্ভে যে-পুত্র রেখে যুদ্ধে গিয়েছিলো, দেখতে কি সে বঙ্গবন্ধুর মত হয়েছিলো? ইলিশ কিনতে গিয়ে অহেতুক গাড়ি চাপা পড়েছিলো যে মছন দাদা, জানতে চাইলো: গাড়িওয়ালাদের বিলেতে নাকি অনেক ভাতের হোটেল আছে? পাতি আলাপ পছন্দ হলেও কবর পছন্দ হলো না...

তোমরা আমাকে ঘরে ফিরতে বলো না, পৃথিবীর বুক খুঁড়ে খুঁড়ে আমি হয়রান হয়ে গেছি। আমার কবরের মাটি আমার পছন্দ হচ্ছে না।

আমি তাকে বলেছিলাম শৈশব শৈশব খেলা কোনও খানদানি খেলা নয়। শৈশব শৈশব খেলায় রক্ত থাকে, লেবু গন্ধ থাকে, আরো আরো কী থাকে, আর থাকে জলপাই পাতা। আমি তাকে বলেছিলাম শৈশব শৈশব খেলা আদৌ কোনও স্বাস্থ্যসম্মত খেলা নয়। কিছুটা দুধেল কফি থাকে, চিনি মাখা তেঁতুল থাকে, কিছু নিমফুলের বড়া থাকে। কুশিয়ারার ইলিশ থাকে, আরো আরো কী থাকে, আরো থাকে ঈশান কোণের মেঘ। আমি তাকে বলেছিলাম শৈশব শৈশব খেলা কোনও নিরাপদ খেলা নয়, এ-খেলায় বর্ডার বর্ডার থাকে, চোরাই কিছু ফুল থাকে, এক ফালি রাত থাকে, ঝরনাতলার পাথর থাকে, অচল কিছু সিকি থাকে, আরো আরো কী থাকে, আর থাকে শানানো তলোয়ার।

মেয়েরা অজগরের পিঠে চড়ে বাপের বাড়ি নাইওর আসছে খুব, আর আমি বেরিয়েছি কী যেন ধরতে। আমায় কেউ একজন জানতে চাইলো, তুমি কি রাজধানীতে যাচ্ছ? সেখানে নাকি গরম গরম তেলে আগুনের বড়া হচ্ছে খুব? মানুষের জুতা হারিয়ে যাচ্ছে হামেশাই? সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড বেড়ে গেছে খুব। খুব বাড় বেড়েছে ফুল-সুন্দরীদের। তুমি কি ছাৎলা পাহাড়ের চূড়ায় যাচ্ছ? সেখানে নাকি আজকাল মাঘাইমা আর বাঘেদের বৈঠক হচ্ছে ঘন ঘন? একমাঠ ধানশিশু মাথা হেলিয়ে জানতে চাইলো আমি কি আহমদ ছফার বাড়ি যাচ্ছি? সে-বাড়িতে নাকি থরে থরে জলরাশি ইস্ত্রি করে পরিপাট আছে? তুমি কি পিছে পিছে ছায়া ধরতে যাচ্ছ মিতুয়ার? কুকুর মিতুয়া আর তছিরদা, মোকাম টিলার পেঁচা আর বাঁশবনের খরানি, সজারুদের বেটি আর লুকটি বনের ফুল, আর তাদের সাথে আহমদ ছফার কী সংযোগ? তুমি কি গোছল করাতে নিয়ে যাচ্ছ জাতীয় সংসদ ভবনকে? কুমোরদের খুব কান পড়া দিচ্ছ, তুমি কি বহুতল ভবন নির্মাণ করবে পদ্মার পারে?

আজকাল ঘন ঘন টক রাঁধছো...তুমি কি সংসার সংসার খেলবে না আর? ঘরের খুঁটি উপড়ে পায়েস রাঁধলে, আর বুঝি বাড়ি ফিরবে না ভাবছো তুমি? আমলকি গাছটা বেঁচেই দিলে, তুমি বুঝি জন্ম জন্ম খেলবে না আর? শুনেছি নদী বিক্রি হচ্ছে জোড়ায় জোড়ায়। ঘরদোর পরিপাট করলে, তুমি কি নদী কিনতে হাটে যাছ এবার?

তুমি নাকি কথাটথা অল্পই বলছো, বুঝি মাছেদের সাথে ইস্কুলে যাবে ডুবোজাহাজের ডেকে? শুনলাম হাঁসেদের সাথে ভাবসাব হচ্ছে না আর, একখণ্ড মেঘ খরিদ করবে বলে জলপাই পাতা কুড়াচ্ছ? সাপেদের খোল জমাচ্ছ প্রধানমন্ত্রীর জন্য উপহার সাজাবে বলে? তোমার নাকি বাড় বেড়েছে খুব, দূর্বা পুষছো উঠানে উঠানে? আর নাকি আস্থা রাখা যাচ্ছে না ভোরের বৃষ্টিতে? চখাচখির বিয়ে দেবে বলে খড় জমাচ্ছ জোরেসোরে?

কারা যেন রাতবিরাতে ঘুরতে আসে তোমার বাড়ি। তারা কি তোমার দুধভাই, দুধবোন, যারা নাকি দারাশুকোর কবিসভার সভ্য ছিলো একদা? তুমি নাকি জলের দরে বিক্রি করে দিচ্ছ পুকুরের জল? এবার বুঝি বৃক্ষ-হন্তারক হবে? জোর শলাপরামর্শ করছো কবুতদের নিয়ে, এবার নির্ঘাৎ মন্ত্রী-মিনিস্টার হবে তুমি?

তাকে জিজ্ঞেস করলাম আত্মহত্যার আগে তুমি কী কী করেছিলে (জানতে চাইনি কেন সে আত্মহত্যা করেছিলো, হাস্যকর হতো তাহলে)? সে হেসে বললো: আমার বোনকে ফোন করেছিলাম, তার ফোন এনগেজড ছিলো, আমার ভাবিকে ফোন করেছিলাম, তারা সব বিয়েবাড়িতে ছিলো। আমার পুরোনো বন্ধুকে ফোন করেছিলাম বহুদিন পর, সে আমাকে আপনি আপনি করছিলো। আমার স্বামীর ফোন মিউট ছিলো...আমার পাথরকুচি পাতায় পচন ধরেছিলো। পর্দার ফাঁক দিয়ে ভোরের আগেই ভোরের রোদ আসছিলো। লেখার কাগজ খুঁজে পাচ্ছিলাম না। ড্রয়ার ভরে বোতাম জমাচ্ছিলাম। রোদগুলো শুকাতে দিয়েছিলাম ছাদে। পাখিগুলো উড়ে উড়ে বিরক্ত করছিলো। পোস্ট অফিসে কর্মী ছাটাই হচ্ছিল। গুদাম ঘরে উঁই ধরছিলো সাদা কাগজের ভাঁজে ভাঁজে, পানি বেচে বেচে ফতুর হয়ে যাচ্ছিলাম।...পরের নামগুলো হলুদ হয়ে যাচ্ছিলো ধীরে ধীরে, তরকারীতে লবণ বাড়ছিলো, অসময়ে বৃষ্টি হচ্ছিলো জোরসে। পাঠশালার বন্ধুদের নাম মনে করতে পারছিলাম না। প্রিয় উপন্যাসের অক্ষরগুলো ছোট হয়ে আসছিলো, পুরনো ভিখারি লবঙ্গ বেচতে আসছিলো না আর, জুতো জোড়া ঢিলে লাগছিলো হঠাৎ। আমের আঁশ দাঁতে বাঁধছিলো খুব! চায়ের দুধ ছিঁড়ে গিয়েছিলো ভোরে, চিনিতে টক বাড়ছিলো তরতর...



লেখক পরিচিতি
শিপা সুলতানা 
জন্ম সিলেট জেলার গোলাপগঞ্জ উপজেলার ধারাবহর গ্রামে.১৯৮২ সালের ৮ নভেম্ভর. বনিক পরিবারে.গল্প লেখার শুরু ৯ বছর বয়সে,গ্রাম জড়িয়ে থাকা চাতলা পাহাড়,নিয়াতি পাহাড়,মাঘাইমা পাহাড়,পাহাড় থেকে নেমে আসা নাব্তলার পানি আর ঠাকুর বাড়ি থেকে হাতে খড়ি,কোনদিন তাদের কাছ থেকে অনুমতি আদায় হলে প্রকাশিত হবে উপন্যাস' ঠাকুর বাড়ি'. সেই অপেক্ষায়......২০০৩ থেকে স্বামী মুজিব ইরম এবং পুত্র অন্য ইরম কন্যা ইনকা ইরম এর সাথে ইংল্যান্ড এ বসবাস।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

2 মন্তব্যসমূহ

  1. আলমগীর হোসেন১৭ জুন, ২০১৫ এ ১২:২১ PM

    সাহিত্যে আমি মোটেই পারদর্সি নই। আগে যাও ছিলাম এখন তা হারিয়ে ফেলেছি। লেখাটায় গভীরতা আছে। আছে প্রখর emotion, imaginations and mixing of both reality and imaginations. ছন্দময় লেখাটার মধ্যে আছে romantic ও শৈল্পিক ছোয়া পাঠক কে কাছে টানে নেশার মত।। আসলে এ লেখার মন্তব্য করার মত ক্ষমতা আমার নাই ...

    উত্তরমুছুন
  2. লেখার পরতে পরতে ভাবের খেলা। নষ্টালজিয়ায় আচ্ছন্ন হল মন। ঠিক যেন ছোটবেলায় রান্নাঘর থেকে দুধের সর থেকে ঘি করার সময় মা তাতে লেবুর পাতা দিলে যে গন্ধ পেতাম তার সুবাস নাকে লাগলো। হারিয়ে গেলাম.... দূরে বহু দূরে......।

    উত্তরমুছুন