‘একদিন অন্য কোনো রঙের সূর্য উঠবে আকাশে, হয়তো বেগুনি, ধূসর কিংবা সাদা!’ – মেয়েটি বলেছিল তাকে। প্রতিদিন সকালে মেয়েটি বেরিয়ে যাওয়ার পর দরজা বন্ধ করে মোটা ব্রাশে চাপানো ঘন রঙের সূর্যাস্তের এই দুই ফুট বাই তিন ফুট ল্যান্ডস্কেপটার সামনে দাঁড়ানোর অভ্যাস হয়েছিল তার একত্রিশ মাস ধরে, ন’শো ত্রিশ দিন, হিসেব করে ছেলেটি। যেসব দিনে মেয়েটা বেরোতো না অর্থাৎ শনি-রবি বা অন্যান্য ছুটির দিনেও সেই ঘন সূর্যাস্তের সামনে দাঁড়াত সে। প্রতিবার যেন ছবিটার ভিতরে ঢুকে যেত, আর থাকত সূর্যাস্তের গোটা প্রক্রিয়াটার মধ্যে অন্ধকার নেমে শীত করা অবধি। তবু সমস্ত ভোরে একটা কৃষ্ণগহ্বরের মতো ছবিটা টানত তাকে আর সারাদিন যতবার এই সূর্যাস্তের ঘটনাটা ঘটত তার চোখের সামনে ততবারই শীত করত তার।
‘হয়তো আর সবুজ রঙের গাছ জন্ম নেবে না কোনোদিন’ – বলেছিল ছেলেটি। লাল আলোটা জ্বলে ওঠবার পর থেকে ছেলেটির চোখের সামনে বার বার সূর্যাস্ত হয়, গাছেরা জন্ম নেয় কিন্তু কোন রং দেখতে পায় না সে। যেদিন প্রথম ছেলেটি জানতে পারে সেই সব গাছেদের কথা যারা কেবল মানুষের অভিশাপেই শুকিয়ে যায় সেইদিন মেয়েটি বেরোয়নি, শনি-রবি বা অন্য কোনো ছুটির দিন না থাকলেও। ছ’তলার ফ্ল্যাটের বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছিল সূর্য ওঠার আগেই এবং একটা অন্তরলীন সম্ভাবনার গল্প বলেছিল ছেলেটিকে দিগন্তের দিকে তাকিয়ে, যা কেবল তার জন্যেই বুনেছিল মেয়েটি। সেদিন সমস্ত মেঘ নেমে এসে ছুঁয়েছিল শহরের আকাশরেখা, সেদিন সূর্যাস্ত হয়নি এবং বৃষ্টিভেজা স্কাইস্ক্র্যাপাররা দাঁড়িয়ে ছিল প্রাচীন রহস্যময় বাওবাবের মতো। আর তার আগে ছ’শো ত্রিশ দিন সূর্যাস্ত হয়েছিল তার ক্যানভাসে। ‘আমরা রোদ্দুর আনতে পারব তো’-- মেয়েটা ভরসা চেয়েছিল।
শহরের সমস্ত স্মৃতিফলকের ছবি ছেলেটি আটকে রাখে তার কিউবিকলের দেওয়ালে। ঔপনিবেশিক ও প্রাক-ঔপনিবেশিক পাথরেরা ধারণ করে রাখে অনেকগুলি শতাব্দী। যে সব মানুষেরা অতীন্দ্রিয় লোকগাথার জন্ম দিয়েছিল অনেকগুলি দশক আগে তাদের কোন স্মৃতিফলক নেই শহরে, সে সন্ধান করেছে সেই সব সূর্য-নিষিদ্ধ কানাগলি যেখানে লোকগাথাগুলির জন্ম অথবা দক্ষিণ সমুদ্র পারে হলুদ নদীর তীরবর্তী সেই সব পলি সমৃদ্ধ ভূমি যেখানে সূর্যালোকের সহায়তায় রাসায়নিকে পরিণত হয়েছিল একষট্টি হাজার আটশো হাড়। সেই দীর্ঘ অস্থিরতার সময়ে মনস্তাত্ত্বিক ছেলেটিকে পরামর্শ দিয়েছিলেন বাগান করতে, তাই মেয়েটি নিয়ে এসেছিল ঘর সাজানোর টব আর বোতল আর ছেলেটি শহরের প্রাচীনতম স্মৃতিফলকের গোড়া থেকে নিয়ে এসেছিল চারা কিন্তু কোনদিনই কোন গাছ সবুজ হয়নি তাদের সাড়ে ছ’শো স্কোয়ার ফিটে, তারপর এক শরতে সমুদ্রপারে ছুটি কাটাতে গিয়ে নিয়ে এসেছিল কিছু লতা এবং সেগুলো বোতলের মধ্যেই পচে কিছু রাসায়নিক বাড়িয়ে দিয়েছিল তাদের ঘরে।
মেয়েটি খুলে ফেলেছিল তার বিষণ্ণ আলোর বেশবাস যখন ছেলেটি হাত রেখেছিল তার উপত্যকায় আর উষ্ণায়নে মেরুপ্রদেশের বরফ গলে ডুবে গিয়েছিল সমুদ্রতীরবর্তী সমস্ত অঞ্চল এবং বিনষ্ট মহাকাশযান বায়ুমণ্ডলের ঘর্ষণে পিণ্ড হয়ে নেমে এসেছিল। তখন মেয়েটি ছেলেটির মাথা ডুবিয়ে দিয়েছিল নিজের আর্দ্র তরাই অঞ্চলে। তারা সাঁতার কেটেছিল পৃথিবীর গভীরে তরল ধাতুর স্রোতের মধ্যে আর অতীত সব অপমান ও পরাজয়ের দাহকে দাফন করে তারা উঠে এসেছিল আগুন পাহাড়ের বিস্ফোরণের মাধ্যমে এবং নীল সমুদ্রের শীতলতায় প্রাচীন গোপন মন্ত্রের মতো তারা উচ্চারণ করেছিল নিজেদের, যদিও ভাঙা আয়নার অস্তিত্বে আবিস্কার করেছিল টুকরো টুকরো ইতিহাস তাদের আলুথালু বিছানায়। কিন্তু অন্ধকার সব সূর্যাস্ত আর মৃত গাছেদের বিষণ্ণতায় মেয়েটি তাকে বলেছিল, ‘এবার তুমি একটা গল্প বল যা একান্তই আমার।’ ছেলেটি বলেছিল, ‘একদিন অন্য কোনো রঙের সূর্য উঠবে আকাশে, হয়তো বেগুনি, ধূসর কিংবা সাদা! – মেয়েটি বলেছিল একটি ছেলেকে...’ এই একটাই মাত্র গল্প সে বলতে পারে।
লাল আলোটা নিভে যাওয়ার পর দরজা খুলে বেরিয়ে এসেছিলেন দুজন ডাক্তার। হাতের ইশারায় ডেকেছিলেন ছেলেটিকে। আর ওয়েটিং রুমের সোফা ছেড়ে উঠতে উঠতে ছেলেটির চোখের সামনে কৃষ্ণগহ্বরের অসংখ্য স্মৃতিফলক ডুবে গিয়েছিল দক্ষিণ সমুদ্রের উষ্ণস্রোতে।
লেখক পরিচিতি
কনিষ্ক ভট্টাচার্য।
‘হয়তো আর সবুজ রঙের গাছ জন্ম নেবে না কোনোদিন’ – বলেছিল ছেলেটি। লাল আলোটা জ্বলে ওঠবার পর থেকে ছেলেটির চোখের সামনে বার বার সূর্যাস্ত হয়, গাছেরা জন্ম নেয় কিন্তু কোন রং দেখতে পায় না সে। যেদিন প্রথম ছেলেটি জানতে পারে সেই সব গাছেদের কথা যারা কেবল মানুষের অভিশাপেই শুকিয়ে যায় সেইদিন মেয়েটি বেরোয়নি, শনি-রবি বা অন্য কোনো ছুটির দিন না থাকলেও। ছ’তলার ফ্ল্যাটের বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছিল সূর্য ওঠার আগেই এবং একটা অন্তরলীন সম্ভাবনার গল্প বলেছিল ছেলেটিকে দিগন্তের দিকে তাকিয়ে, যা কেবল তার জন্যেই বুনেছিল মেয়েটি। সেদিন সমস্ত মেঘ নেমে এসে ছুঁয়েছিল শহরের আকাশরেখা, সেদিন সূর্যাস্ত হয়নি এবং বৃষ্টিভেজা স্কাইস্ক্র্যাপাররা দাঁড়িয়ে ছিল প্রাচীন রহস্যময় বাওবাবের মতো। আর তার আগে ছ’শো ত্রিশ দিন সূর্যাস্ত হয়েছিল তার ক্যানভাসে। ‘আমরা রোদ্দুর আনতে পারব তো’-- মেয়েটা ভরসা চেয়েছিল।
শহরের সমস্ত স্মৃতিফলকের ছবি ছেলেটি আটকে রাখে তার কিউবিকলের দেওয়ালে। ঔপনিবেশিক ও প্রাক-ঔপনিবেশিক পাথরেরা ধারণ করে রাখে অনেকগুলি শতাব্দী। যে সব মানুষেরা অতীন্দ্রিয় লোকগাথার জন্ম দিয়েছিল অনেকগুলি দশক আগে তাদের কোন স্মৃতিফলক নেই শহরে, সে সন্ধান করেছে সেই সব সূর্য-নিষিদ্ধ কানাগলি যেখানে লোকগাথাগুলির জন্ম অথবা দক্ষিণ সমুদ্র পারে হলুদ নদীর তীরবর্তী সেই সব পলি সমৃদ্ধ ভূমি যেখানে সূর্যালোকের সহায়তায় রাসায়নিকে পরিণত হয়েছিল একষট্টি হাজার আটশো হাড়। সেই দীর্ঘ অস্থিরতার সময়ে মনস্তাত্ত্বিক ছেলেটিকে পরামর্শ দিয়েছিলেন বাগান করতে, তাই মেয়েটি নিয়ে এসেছিল ঘর সাজানোর টব আর বোতল আর ছেলেটি শহরের প্রাচীনতম স্মৃতিফলকের গোড়া থেকে নিয়ে এসেছিল চারা কিন্তু কোনদিনই কোন গাছ সবুজ হয়নি তাদের সাড়ে ছ’শো স্কোয়ার ফিটে, তারপর এক শরতে সমুদ্রপারে ছুটি কাটাতে গিয়ে নিয়ে এসেছিল কিছু লতা এবং সেগুলো বোতলের মধ্যেই পচে কিছু রাসায়নিক বাড়িয়ে দিয়েছিল তাদের ঘরে।
মেয়েটি খুলে ফেলেছিল তার বিষণ্ণ আলোর বেশবাস যখন ছেলেটি হাত রেখেছিল তার উপত্যকায় আর উষ্ণায়নে মেরুপ্রদেশের বরফ গলে ডুবে গিয়েছিল সমুদ্রতীরবর্তী সমস্ত অঞ্চল এবং বিনষ্ট মহাকাশযান বায়ুমণ্ডলের ঘর্ষণে পিণ্ড হয়ে নেমে এসেছিল। তখন মেয়েটি ছেলেটির মাথা ডুবিয়ে দিয়েছিল নিজের আর্দ্র তরাই অঞ্চলে। তারা সাঁতার কেটেছিল পৃথিবীর গভীরে তরল ধাতুর স্রোতের মধ্যে আর অতীত সব অপমান ও পরাজয়ের দাহকে দাফন করে তারা উঠে এসেছিল আগুন পাহাড়ের বিস্ফোরণের মাধ্যমে এবং নীল সমুদ্রের শীতলতায় প্রাচীন গোপন মন্ত্রের মতো তারা উচ্চারণ করেছিল নিজেদের, যদিও ভাঙা আয়নার অস্তিত্বে আবিস্কার করেছিল টুকরো টুকরো ইতিহাস তাদের আলুথালু বিছানায়। কিন্তু অন্ধকার সব সূর্যাস্ত আর মৃত গাছেদের বিষণ্ণতায় মেয়েটি তাকে বলেছিল, ‘এবার তুমি একটা গল্প বল যা একান্তই আমার।’ ছেলেটি বলেছিল, ‘একদিন অন্য কোনো রঙের সূর্য উঠবে আকাশে, হয়তো বেগুনি, ধূসর কিংবা সাদা! – মেয়েটি বলেছিল একটি ছেলেকে...’ এই একটাই মাত্র গল্প সে বলতে পারে।
লাল আলোটা নিভে যাওয়ার পর দরজা খুলে বেরিয়ে এসেছিলেন দুজন ডাক্তার। হাতের ইশারায় ডেকেছিলেন ছেলেটিকে। আর ওয়েটিং রুমের সোফা ছেড়ে উঠতে উঠতে ছেলেটির চোখের সামনে কৃষ্ণগহ্বরের অসংখ্য স্মৃতিফলক ডুবে গিয়েছিল দক্ষিণ সমুদ্রের উষ্ণস্রোতে।

লেখক পরিচিতি
কনিষ্ক ভট্টাচার্য।
১৯৭৬ খ্রিস্টাব্দে কলকাতার সুকিয়া স্ট্রিটে জন্ম। বর্তমানেও কলকাতাতেই থাকেন। হেয়ার স্কুল-যাদবপুর আর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা। বিষয় সাহিত্য। পেশা শিক্ষকতা। কবিতা দিয়ে শুরু হলেও বর্তমানে কবিতা খুব একটা লেখেন না। স্কুল-কলেজ-পাড়ার পত্রিকা পেরিয়ে শুরু ‘প্রমা’ পত্রিকা থেকে। সম্পাদক ছিলেন সুরজিত ঘোষ। সংবাদ প্রতিদিনে বইয়ের রিভিয়ু ইত্যাদি হয়ে এখন প্রধানত গল্প আর প্রবন্ধ লেখেন, লেখা না এলে অনুবাদ করেন, একটিমাত্র উপন্যাস আজ অবধি লিখে উঠতে পেরেছেন, সেটা প্রকাশিত হয়েছিল অশোক ভট্টাচার্য -সাগর বিশ্বাস সম্পাদিত ‘সংকেত’ পত্রিকার শারদ সংখ্যায়। অনূদিত উপন্যাস প্রকাশিত হয়েছে মহাশ্বেতা দেবী সম্পাদিত বর্তিকায়। এছাড়া গোটা দশেক ছোটো পত্রিকায় লিখেছেন। ‘কৃষ্ণগহ্বরের স্মৃতিফলক’ গল্পটি কলকাতা থেকে প্রকাশিত ‘ভোর’ পত্রিকায় মার্চ ২০০৮ সংখ্যায় বেরিয়েছিল। যোগাযোগঃ ৯৮৩৬৮৯৪১০১
22 মন্তব্যসমূহ
Opurbo!!!
উত্তরমুছুনDhanyo -jog
মুছুনOpurbo.surjodoye sompoker uran
উত্তরমুছুনএই মন্তব্যটি লেখক দ্বারা সরানো হয়েছে।
মুছুনDhonyobad debo na Nandita Di ... Asole tomra porle BHORSA pai ...
মুছুনOpurbo.surjodoye sompoker uran
উত্তরমুছুনOpurbo.surjodoye sompoker uran
উত্তরমুছুনGalper shorir jure kobitar mayabi ghraan. Sundar. Shuvechchha, aaro lekhar jonnyo.
উত্তরমুছুনGalper shorir jure kobitar mayabi ghraan. Sundar. Shuvechchha, aaro lekhar jonnyo.
উত্তরমুছুনBhalobasa ... Rehan
মুছুনজ্ঞদ্য ও কবিতার বেড়া ভেবগে দিয়েছেন কনিষ্ক । সারা শরীর কবিতায় মোড়া মায়াবী লেখা । সুখপাঠ্য ।
উত্তরমুছুনKrritaggata ...
মুছুনগল্প না বলে অনুরণন বললে হয়তো বেশী ভালো লাগবে আমার। গদ্যটি সত্যিই খুব মায়াবী, স্বচ্ছ। শুভেচ্ছা।
উত্তরমুছুনDhonyobad ...
মুছুনচেতন অবচেতনের সীমানায় দাঁড় করিয়ে দেয় লাখাটা। ভালো লাগলো বেশ।
উত্তরমুছুনDhonyobad Avik ...
মুছুনমনে হল, কবিতা পড়লাম!
উত্তরমুছুনধন্যবাদ।
মুছুনমনে হল, কবিতা পড়লাম!
উত্তরমুছুনঅজস্র ধন্যবাদ
মুছুনgolper akare thake ek kobita
উত্তরমুছুনmone mone enke dey koto ronga chobi ta!!
আখররেখায় কন্ট্যুর ছুঁয়ে গেছে দিনগত যাপনের ছায়াপথ। অভিনন্দন ...
উত্তরমুছুন