১
ডাক্তার নতুন, ইন্টার্নশীপ শেষ করেছে দুই বছর। এখন দিনে দুইটা, কখনও একটা ক্লিনিক করে জীবিকা নির্বাহ করতেছে; সাথে এফসি পি এস প্রথম পার্ট চলতেছে। ক্লিনিকে শিফট রেটে টাকা, মাস শেষে মন্দ না। নিজের চলে যায়, বউ নাই, প্রেমিকার সাথে সময় ভাল যাচ্চে না; যায় যায় করেও যায় না, কয়েক বছর ধরেই এমন।
তবে ডাক্তার নতুন মানে এই না যে সে এমন কেস বা তার চেয়ে ভয়াবহ কিছু আগে দেখে নাই। ডাক্তার হওয়ার প্রথম ধাপই হল ভয়ংকর দেখা; ভয়ংকর দেখে দেখে ভোতা হয়ে যাওয়া।
রোগীর বয়স নিজে বলতেছে পয়ত্রিশ, তবে আটত্রিশ কি চল্লিশও হতে পারে। দু-এক বছর এমন কিছু না, বিশেষত যেখানে আমাদের জাতীয় সংষ্কৃতিই হল স্কুলে রেজিস্ট্রেশন করার সময় ছেলে মেয়ে উভয়েরই বয়স দু-এক বছর কমিয়ে দেয়া। এখনকি সেই সংষ্কৃতি পাল্টাচ্ছে? কে জানে! একটা সময় ছিল যখন সব অভিবাবকই মনে করত ছেলেটার বা মেয়েটার বয়স দু-এক বছর কমিয়ে দিলে, চাকরি বাকরির যে বাজার, কিছু সুবিধা হয়ত বয়স থেকে নিতে পারবে। রোগীর উচ্চতা মাঝারি, হাসি সুন্দর; সে হাসি না দেখে উপায় নাই, কারন সে এখানে আসার পর থেকেই দাঁত কেলিয়ে হাসতেছে, দাঁত ভাল আছে, মানিয়ে গেছে।
ডাক্তার রোগীর আঙুলগুলো দেখতেছে মনযোগ দিয়ে। রান্নাঘরের একটা ময়লা ন্যাকড়া জড়ানো, রোগী নিজেই অন্য হাত দিয়ে চেপে ধরে রেখেছে। কনুয়ের কাছেও বেশ একটু যায়গা পুড়ে গেছে। আঙুলে জড়ানো ন্যকড়াটা সরানোর পর ডাক্তার আরেক দফা অবাক। দুইটা পুরোপুরি আর অন্য তিনটা আঙুল ছোট ছোট করে কয়েক যায়গায় পুড়ে গেছে। ময়লা ন্যকাড়ার ধুলা, রান্না ঘরের কালিঝুলি সব লেগে আছে ক্ষতের ওপর। মারাত্বক ব্যথা হওয়ার কথা অথচ এই লোক হে হে করে হাসতেছে।
ডাক্তার- নড়বেন না, আঙুলগুলি সোজা করে আর যতটা সম্ভব স্থির করে রাখেন।
রোগী- হে হে, শিউর।
ডা- ব্যথা করতেছে না?
রো- ব্যথা ত অবশ্যই করতেছে।
ডা- আপনের হাসি দেখে ত মনে হচ্ছে ব্যথা নাই, আপনি বেশ মজাই পাইতেছেন।
রো- না, হে হে ব্যথা করতেছে তবে মজাও পাইতেছি।
ডাক্তার ভাল করে দেখে স্থির করতে পারে না, কিভাবে ক্লিনিং শুরু করবে। সতর্ক হয়ে না করলে ব্যথায় এই লোক চিৎকার শুরু করতে পারে। তার ওপর আছে ইনফেকশনের ভয়। যে ময়লা ন্যকড়া দিয়ে রোগী এতক্ষণ চেপে ধরে রেখেছিল, ডাক্তার নিশ্চিত কম করে হলেও এক লাখ ব্যাকটেরিয়া সেখানে কিলবিল করতেছে। ভাগ্য ভাল খালি চোখে এইসব দেখা যায় না; খালি চোখে ব্যাকটেরিয়া দেখা গেলে যে জীবন আমরা যাপন করি, পুরো অচলই হয়ে যেত মনে হয়। আঙুল বাদ দিয়ে এবার ডাক্তার কনুইয়ের দিকে নজর দেয়। কনুইয়ের ভাঁজের উপরে নিচে দুই দিকেই বেশ পুড়েছে।
ডা- শুনেন, আপনার পুড়া অনেক গভীর। এই যে দেখতেছেন, চামড়া পুড়ে গিয়ে সাদা মাংশপেশি দেখা যাচ্ছে?
রো- হুম্ম, আচ্ছা একটা ব্যপার বলেন ত মানুষের মাংশ কি শাদা নাকি? আমি ত ভাবছিলাম লাল হবে, যেমন ধরেন মুরগীর মাংশ, খাসীর মাংস বা অন্য যেকোন প্রাণির মাংশ যেমন হয়।
ডা- মুরগীর মাংশ কি পুরোপুরি লাল হয়?
রো- শিট, তাই ত। আসলে ত মাংশ পুরা লাল না, একটু সাদাটে।
ডা- লাল হয় রক্তে, রক্ত মুছে দিলে মাংস দেখায় সাদাটে। শুনেন, যেমন বললাম আপনার পুড়া গভীর, তার ওপর এই ময়লা ন্যকড়া দিয়া জড়ায়ে রাখছেন এতক্ষণ, খুব সম্ভাবনা আছে ইনফেকশনের। এখন পুরোটা ক্লিন করে, আপনাকে ড্রেস করে দিলে পরে কিছু দিন এন্টিবায়েটিক খেতে হবে।
রো- (পুরোই হতাশ) এই, আর কিছু না? ক্লিনিকে থাকা টাকা লাগবে না?
ডা- সেরকম সম্ভাবনা নাই। আর আপনি থাকতে চান কেন? অফিসের ব্যপার থাকলে সমস্যা নাই প্রেসক্রিপশনে লেখা থাকবে তিন দিন কমপ্লিট বেড রেস্ট। এখন টের না পেলেও পরে হয়ত ব্যথা থেকে জ্বরও আসবে।
রো- না, অফিসের কাগজপত্র বিষয়ক সমস্যা নাই। প্রেসক্রিপশনে বেড রেস্ট লেখা না থাকলেও ইচ্ছা করেলেই কয়েকদিন অফ নেয়া যাবে; এটা সমস্যা না।
ডা- আচ্ছা, এখন আমি ক্লিনিং শুরু করব। পুড়া আরেকটু কম হলে বলতাম না কিন্তু এই অবস্থায় আপনার আঙুলগুলো অবশ করে নিলেই ভাল হবে কারণ ময়লা ধুলা আপনার মাংশপেশির সাথে মিশে গেছে, পরিষ্কার করার সময় ব্যথা এখন যেমন আছে তার চেয়েও কয়েকগুণ বেশি হবে।
রো- ধুর কি বলেন! না না অবশ টবশ করার দরকার নাই। আপনি কাজ শুরু করেন। আপনি কাজ করতে করতে আমি আপনাকে আমার গল্পটা বলি।
ডাক্তার রোগীর মুখের দিকে তাকিয়ে কিছুটা বিরক্ত হয়ে কাজ শুরু করে।
রো- আপনি মনে হয় ভাবতেছেন আমার কিছু মানসিক সমস্যা আছে। হা হা, শুনে রাখেন আমার কিন্তু ঐ রকম কোন সমস্যা নাই। আমি সম্পূর্ণ সুস্থ এবং কর্মক্ষম। সত্তর জন ইঞ্জিনিয়ার আর তাদের জন্য চার জন ম্যানেজার, সব মিলিয়ে চুরাশি জন এমপ্লয়ি আমার আন্ডারে কাজ করে। বস হিসেবে আমি অনেক জনপ্রিয়, একি সঙ্গে অনেক ইফেক্টিভ। এটা কিন্তু সহজে পাবেন না, যেসব বস জনপ্রিয় হয়, কাজের ক্ষেত্রে এরা হয় কম ইফেক্টিভ কিন্তু আমার দুইটাই আছে।
ডাক্তার মধ্যমার বেশ গভীরে জমে থাকা ময়লা খুঁচিয়ে পরিষ্কার করতে থাকে, আঙ্গুলগুলো একটু কেঁপে ওঠে। ব্যাটা বোধ হয় এখন টের পাচ্ছে ব্যাথা কী জিনিশ।
রো- কী ফালতু ওয়েদার করছে এখন খেয়াল করছেন। বৃষ্টির কোন মা বাপ নাই, এই নামে ধুমধাম আবার এই নাই। আমি থাকি চারতলার একটা ফ্ল্যাটে। বাড়ির অন্যপাশে এখনো ডোবা আছে বুচ্ছেন, যদিও চারপাশ দেয়াল দিয়ে ঘেরা কারণ বড় বিল্ডিং হবে সেখানে, অর্ধেক ফ্লাট নাকি এখনি বিক্রি হয়ে আছে। ধুমধাম বৃষ্টি নামলে দেখতে আরাম লাগে। আমি ত মফস্বল থেকে আসছি, ডোবা পুকুরের জলে ঝুম বৃষ্টি পড়া দেখতে যে কী আরাম, কী বলব। অফিস থেকে এসে সেটাই করতেছিলাম, আর একা থাকি ত কিছু রান্নাও করতেছিলাম তখন। বৃষ্টি দেখে খিচুরি আর কড়কড়া বেগুন ভাজা খাইতে ইচ্ছা করল বুচ্ছেন। বেগুন ভাজতে ত অনেক তেল লাগে জানেন, আমি মোটামুটি আধা কড়াই তেল দিয়া বেগুন ভাজা শুরু করছি। তখন হটাৎ মনে হইল বুচ্ছেন, বুরবুর করে তেলের ভিতর বেগুন ভাজা অনেকটা ডোবার জলের উপর বৃষ্টির ফোঁটা পড়ার মত। আমি তখন বায়ে, জানালা দিয়া দেখি ডোবার জলে বৃষ্টি আর সামনে ননস্টিকি ফ্রাইং পেনে তেলের ভেতর ফালি ফালি বেগুনের বুরবুর। হঠাৎ মনে হইল আসলে কী ফালতু জীবন আমরা যাপন করতেছি!!! আসলেই!
ডা-(একটু বিরক্ত হয়ে রোগীর দিকে তাকিয়ে) আঙুলগুলো সোজা করে রাখেন। প্রত্যেকটা আলাদা আলাদাভাবে ব্যান্ডেজ করতে হবে।
রো- হা হা হা, ভাই আপনি যে বিরক্ত হইতেছেন। হা হা হা। শুনেন আমি সর্বশেষ কবে অসুস্থ হইছিলাম জানেন? ইউনিভার্সিটিতে পড়ার সময়; তাও মাত্র ২ দিনের জন্য। আমার তখন জন্ডিস হইছিল, খুব মাইনর। দুই দিন দিলাম দিন-রাইত টানা ঘুম, তৃতীয় দিন লাফ দিয়া নামলাম বিছানা ছাইড়া। বাসার সামনের মোড়ে আলা ভাইয়ের টং দোকানে গিয়া কইলাম দেন একটা বেনসন আর কাপটা ভাল কইরা ধুইয়া চিনি কমাইয়া একটা চা। ব্যাস এই। তারপরে সব ক্লিন। এই গত দশ বছরে একদিন এমনকি জ্বরও হয় নাই আমার।
ডা- (আরো বিরক্ত) ওকে বুঝলাম। এখন হাত আর কনুই পুড়াইছেন কেমনে বলেন, কেস হিস্টরি তে রাখতে হবে। যদিও আমি মোটামুটি আন্দাজ করতে পারতেছি।
রো- হা হা হা, এইবার একটু বোঝা যাচ্ছে, আপনার কিছুটা আগ্রহ আছে। এনিওয়ে ব্যাপার আসলে জটিল কিছু না। আমার হটাৎ মনে হইল ধুত্তোরি কী ফালতু চক্রবদ্ধ দিন রাত। ঝড় বৃষ্টি তুফান যাই হোক আমি এখন পর্যন্ত কোনদিন অফিস কামাই করি নাই, মারপিট কইরা রাস্থায় পইড়া থাকি নাই, কাউরে রাস্তায় দৌড়ানি দেই নাই, নিজেও দৌড়ানি খাই নাই, বুঝতে পারতেছেন? মানে এমন না যে ঠিক এই কাজগুলোই জীবনে করা দরকার বা ঠিক ঠিক এইগুলা না করা মানেই জীবন ব্যর্থ। এইগুলা যাস্ট উদাহরন আর কি। ত হটাৎ আমার মনে হইল এই যে ঘরে বাইরে প্রতিদিন আমরা তেলে ভাজা হইতে হইতে পুড়া মাকাল হইয়া যাইতেছি, দেই সেই তেলে নিজেরে ডুবাইয়া। সামনে ত তখন ধরেন তেল ভরতি সুইমিংপুল নাই, ত নিজেরে ডুবানো অসম্ভব, ধুত্তোরি শালার জীবন বইলা দিলাম একটা হাতই ডুবাইয়া। তবে বডিও আজিব কারখানা, আমার ত ধরেন কোন দ্বিধা ছিল না কিন্তু দেখলাম বডি নিজেই সেলফ ডিফেন্স আর্মি চালাইয়া দিল। অটো রিফ্লেক্সে পুরো হাতটা তেলে ডুবার আগে নিজে নিজেই বিদ্রোহ করে সরে গেল আর সরে যাওয়ার সময় লেগে গেল কড়াইয়ের হাতলটায়, ফলে কিছুটা তেল ছিটকে পড়ে গেল এই হাতের কনুইয়ে।
ডা- আপনার আঙ্গুলের ড্রেসিং শেষ। কনুইটা এইদিকে আনেন, করে দিচ্ছি। আর যত যাই বলেন তেলের মধ্যে কেউ নিজের হাত ডুবাইয়া দেয় না।
রো- কিছু ত করে, হয়ত অন্য কিছু। হে হে হে, আসলেই কি করে না কিছু!
ডাক্তার কোনরকম বাধা বিঘ্ন ছাড়াই কনুয়ের ড্রেসিং শেষ করে।
ডা- এই যে দুইটা অসুধ লিখে দিছি। একটা এন্টিবায়েটিক আরেকটা পেইন কিলার। পেইন কিলারটা চাইলে পরেও কিনতে পারেন। ওটা হইল যদি ব্যথা খুব বেশি মনে হয় তাইলে রাতে ঘুমানোর আগে একটা খেয়ে নেবেন কিন্তু এণ্টিবায়েটিকটা অবশ্যই পুরো কোর্স খাবেন।
রো- কি মনে হয়, ইনফেকশনের ভয় আছে এখনো?
ডা- না, অসুধটা খেলে আর সমস্যা হবে না। তবে চামড়া টানার সময় অনেক চুলকাবে আর ব্যথাও করবে।
এমন সময় সেই শিফটের সিও এসে ডাক্তারকে একটা লিস্টি ধরিয়ে দিয়ে বলে গেল যাওয়ার আগে সেই কেবিনগুলো একবার ভিসিট করে যেতে। ডাক্তার বিরক্তমুখে তালিকাটা হাতে নিল।
রোগীকে বিদায় দিয়ে সে গেল কেবিনগুলো ভিসিট করতে। কেবিনগুলো তার নয়, অন্য এক ডাক্তারের; সেই ডাক্তার সরকারি দলের নেতা। ইচ্ছামত ক্লিনিকে আসে যায়, অন্যদের তার ডিউটি করে দিতে হয়। কাগজেপত্রে তার নাম রাখতে হয়।
২
বৃষ্টি একটু ধরে আসছিল; ডাক্তারের ধারনা ছিল আর হয়ত নামবে না। নামল ঠিক তার বেরুবার সময়ে। ইভিনিং শিফট, ক্লিনিকের গাড়ি বাসায় পৌছে দিবে। সে বের হয়ে দেখে গাড়ি গেটের সামনেই আছে; ড্রাইভার মাখন মিয়া। সবাই ডাকে, সে নিজেও তার নাম বলে মাক্ষন। মাক্ষনের একটাই সমস্যা, পেচাল পাড়ে বেশি।
ডা- মিরপুর রোডে আর কেউ আছে নাকি মাখন ভাই?
মাক্ষন- জি স্যার। শাকিল স্যার যাইব, দশ নম্বর।
কথা বলতে বলতে শাকিল এসে ওঠে। গাড়ি ছাড়লে মাক্ষন তার রেগুলার প্যাচাল শুরু করে।
মাক্ষন- বুইচ্ছেন স্যার, হাসিনা সরকার ত মনে হয় আর বেশি দিন টিকবার পারব না। তুর্কি দেশের প্রেসিডেন্ট সব মুসলিম দেশে চিডি লিখছে।
শ্রোতা দুইজনই মাঝে মাঝে একটু আধটু হু হা করে যায়। সবাই জানে এই ক্লিনিকের পাঁচজন মালিকের তিনজন জামাতি। এতে এদের ব্যবসার ক্ষতি হচ্ছে না, শুধু কিছু ছাত্রনেতাকে চাকরি দিতে হয়েছে আর মাসে মাসে নিয়মিত একটা নির্দিষ্ট অফিসে চাঁদা দিতে হয়। চাঁদা এদিক অদিক সব সময়েই দিতে হয়; এইগুলা সমস্যা না।
গাড়ি দশ নম্বরের মোড়ে আসলে ডাক্তার শাকিল ড্রাইভারকে এক নম্বরে যেতে বলে, সে বাসায় যাবে না, এক নম্বরে কিছু কাজ আছে, সেখানে নামিয়ে দিতে হবে। ড্রাইভার এক নম্বরের দিকে যেতে শুরু করে।
শাকিলকে এক নম্বরে নামিয়ে দিয়ে মাক্ষন মিয়া পল্লবীর রাস্তা ধরে। বৃষ্টির তোড় তখনো বেড়েই চলেছে; ঢাকা শহর আজকে পানির নিচেই যাবে মনে হয়। ডাক্তারের মনে হঠাৎ একটা আশংকা হয় যে আজকে তার বাসায় যাওয়া হবে না। ইতিমধ্যেই রাত সাড়ে এগারোটা; বারোটা বাজলে বাড়িওয়ালা গেট বন্ধ করে দিবে, তখন বাসায় ঢোকা অনেক হাঙ্গামা। প্রেমিকা এরমধ্যেই দুইবার কল দিয়েছে তার ধরতে ইচ্ছা করে নাই। আজকেও রাত যাবে সেই একই, কী কর, কেন কর, কেন কর না, কবে হবে ইত্যাদি ইত্যাদি ঘ্যানঘ্যান করতে করতে।
মাক্ষন মিয়া ও বিরক্ত; সে তার প্যাচাল চালিয়ে যায়।
মাক্ষন - বুচ্ছেন সার, আমরার হইল সব দিকে সমস্যা। এই যে শাকিল স্যার দশ নম্বর থাইকা এক নম্বরে নিয়া আসলেন, এখন নিচে এক ঘন্টা সময় বেশি লাগব আমার অফিসে ফিরা যাইতে। গেলেই সুপারভাইজার কইব অন্য যায়গায় টিপ মারছি নাইলে আওয়ার সময় পেসেঞ্জার লইছি; নাইলে অত সময় লাগব কই। আবার আপনেরা স্যার কোন খানে যাইতে চাইলে আমরা ত না করতে পারি না।
গাড়ি দশ নম্বর মোড়ে এসে পড়ে গেল ওয়াসার গর্তে। একদিকে কাত হয়ে গেছে। মাক্ষন মিয়া এক্সিলেরেটর চেপেই যাচ্ছে, গাড়ি নড়তেছে না। বৃষ্টির তোড় আরো বেড়েছে। এত বড় মিরপুর দশ নম্বর মোড় অথচ কোথাও কোন মানুষ নাই, গাড়িও নাই। বৃষ্টির কারনেই মানুষ নাই, গাড়িও নাই হয়ত একটানা তিনদিন ছুটির প্রথম দিন হওয়াতে। মাক্ষন মিয়া অফিসে ফোন করে, অন্য গাড়ির খোঁজে; খোঁজ নিয়া জানায় অন্য আরেকটা গাড়ি নারায়ণগঞ্জ আছে, আসতে কমসে কম দুই ঘন্টা লাগব।
ডাক্তার জানালার কাচে বৃষ্টির ঝুম দেখে। তারপর কিছু না বলে হুট করে গাড়ির দরজা খুলে রাস্তায় বেড়িয়ে যায়। প্রথম কদমেই ফচ করে পা দেবে যায় একটা ছোট গর্তে। দৌড়ে গিয়ে মোড় পেড়িয়ে এইচএসবিসি এটিএমের পাশে কিছুদিন আগে এক মোবাইল কোম্পানির গড়ে দেয়া যাত্রী ছাওনির নিচে আশ্রয় নেয়। অল্প বৃষ্টিতে মানুষ কাক-ভেজা হয়, এই বৃষ্টিতে পুরাই মানুষ-ভেজা, সে তিরিশ সেকেন্ডের দৌড়ই হোক না কেন। বৃষ্টি তার ভাল লাগে না। ঠাণ্ডা জল তার ওপরে প্রচণ্ড বাতাস তার সারা শরীরে কাঁপুনি ধরিয়ে দেয়। তার পকেটে আবারো মোবাইল বেজে ওঠে। ভাইব্রেশনে দেয়া ছিল; মোবাইল বিরতিহীন কাপ্তেই থাকে। শরীরের কাঁপুনির সাথে ভেজা প্যান্টের পকেটে থাইয়ের সাথে চুপসে লেগে থাকে মোবাইলের কাঁপন তাকে আরো বেশি শীত লাগিয়ে দেয়। সে চিৎকার করে ওঠে 'ধুত্তোরি শালার জীবন'। বলে সে পকেট থেকে মোবাইল বের করে অন্য প্রান্তের মানুষকে কথা বলার সুযোগ না দিয়েই বলে ওঠে
'দেখো প্রত্যেকদিন সেই একি প্যাচাল আর ভাল্লাগে না। একি তেলে প্রতিদিন প্রতিমুহুর্তে ভাজা হওয়া আর কত সহ্য করা যায়?'
পরের দিন পত্রিকায় একটা ইন্টারেস্টিং খবর আসল; অত বড় কিছু না বলে প্রায় কারোরই চোখে পড়ল না।
লেখক পরিচিতি
আলেক সরকার
ডাক্তার নতুন, ইন্টার্নশীপ শেষ করেছে দুই বছর। এখন দিনে দুইটা, কখনও একটা ক্লিনিক করে জীবিকা নির্বাহ করতেছে; সাথে এফসি পি এস প্রথম পার্ট চলতেছে। ক্লিনিকে শিফট রেটে টাকা, মাস শেষে মন্দ না। নিজের চলে যায়, বউ নাই, প্রেমিকার সাথে সময় ভাল যাচ্চে না; যায় যায় করেও যায় না, কয়েক বছর ধরেই এমন।
তবে ডাক্তার নতুন মানে এই না যে সে এমন কেস বা তার চেয়ে ভয়াবহ কিছু আগে দেখে নাই। ডাক্তার হওয়ার প্রথম ধাপই হল ভয়ংকর দেখা; ভয়ংকর দেখে দেখে ভোতা হয়ে যাওয়া।
রোগীর বয়স নিজে বলতেছে পয়ত্রিশ, তবে আটত্রিশ কি চল্লিশও হতে পারে। দু-এক বছর এমন কিছু না, বিশেষত যেখানে আমাদের জাতীয় সংষ্কৃতিই হল স্কুলে রেজিস্ট্রেশন করার সময় ছেলে মেয়ে উভয়েরই বয়স দু-এক বছর কমিয়ে দেয়া। এখনকি সেই সংষ্কৃতি পাল্টাচ্ছে? কে জানে! একটা সময় ছিল যখন সব অভিবাবকই মনে করত ছেলেটার বা মেয়েটার বয়স দু-এক বছর কমিয়ে দিলে, চাকরি বাকরির যে বাজার, কিছু সুবিধা হয়ত বয়স থেকে নিতে পারবে। রোগীর উচ্চতা মাঝারি, হাসি সুন্দর; সে হাসি না দেখে উপায় নাই, কারন সে এখানে আসার পর থেকেই দাঁত কেলিয়ে হাসতেছে, দাঁত ভাল আছে, মানিয়ে গেছে।
ডাক্তার রোগীর আঙুলগুলো দেখতেছে মনযোগ দিয়ে। রান্নাঘরের একটা ময়লা ন্যাকড়া জড়ানো, রোগী নিজেই অন্য হাত দিয়ে চেপে ধরে রেখেছে। কনুয়ের কাছেও বেশ একটু যায়গা পুড়ে গেছে। আঙুলে জড়ানো ন্যকড়াটা সরানোর পর ডাক্তার আরেক দফা অবাক। দুইটা পুরোপুরি আর অন্য তিনটা আঙুল ছোট ছোট করে কয়েক যায়গায় পুড়ে গেছে। ময়লা ন্যকাড়ার ধুলা, রান্না ঘরের কালিঝুলি সব লেগে আছে ক্ষতের ওপর। মারাত্বক ব্যথা হওয়ার কথা অথচ এই লোক হে হে করে হাসতেছে।
ডাক্তার- নড়বেন না, আঙুলগুলি সোজা করে আর যতটা সম্ভব স্থির করে রাখেন।
রোগী- হে হে, শিউর।
ডা- ব্যথা করতেছে না?
রো- ব্যথা ত অবশ্যই করতেছে।
ডা- আপনের হাসি দেখে ত মনে হচ্ছে ব্যথা নাই, আপনি বেশ মজাই পাইতেছেন।
রো- না, হে হে ব্যথা করতেছে তবে মজাও পাইতেছি।
ডাক্তার ভাল করে দেখে স্থির করতে পারে না, কিভাবে ক্লিনিং শুরু করবে। সতর্ক হয়ে না করলে ব্যথায় এই লোক চিৎকার শুরু করতে পারে। তার ওপর আছে ইনফেকশনের ভয়। যে ময়লা ন্যকড়া দিয়ে রোগী এতক্ষণ চেপে ধরে রেখেছিল, ডাক্তার নিশ্চিত কম করে হলেও এক লাখ ব্যাকটেরিয়া সেখানে কিলবিল করতেছে। ভাগ্য ভাল খালি চোখে এইসব দেখা যায় না; খালি চোখে ব্যাকটেরিয়া দেখা গেলে যে জীবন আমরা যাপন করি, পুরো অচলই হয়ে যেত মনে হয়। আঙুল বাদ দিয়ে এবার ডাক্তার কনুইয়ের দিকে নজর দেয়। কনুইয়ের ভাঁজের উপরে নিচে দুই দিকেই বেশ পুড়েছে।
ডা- শুনেন, আপনার পুড়া অনেক গভীর। এই যে দেখতেছেন, চামড়া পুড়ে গিয়ে সাদা মাংশপেশি দেখা যাচ্ছে?
রো- হুম্ম, আচ্ছা একটা ব্যপার বলেন ত মানুষের মাংশ কি শাদা নাকি? আমি ত ভাবছিলাম লাল হবে, যেমন ধরেন মুরগীর মাংশ, খাসীর মাংস বা অন্য যেকোন প্রাণির মাংশ যেমন হয়।
ডা- মুরগীর মাংশ কি পুরোপুরি লাল হয়?
রো- শিট, তাই ত। আসলে ত মাংশ পুরা লাল না, একটু সাদাটে।
ডা- লাল হয় রক্তে, রক্ত মুছে দিলে মাংস দেখায় সাদাটে। শুনেন, যেমন বললাম আপনার পুড়া গভীর, তার ওপর এই ময়লা ন্যকড়া দিয়া জড়ায়ে রাখছেন এতক্ষণ, খুব সম্ভাবনা আছে ইনফেকশনের। এখন পুরোটা ক্লিন করে, আপনাকে ড্রেস করে দিলে পরে কিছু দিন এন্টিবায়েটিক খেতে হবে।
রো- (পুরোই হতাশ) এই, আর কিছু না? ক্লিনিকে থাকা টাকা লাগবে না?
ডা- সেরকম সম্ভাবনা নাই। আর আপনি থাকতে চান কেন? অফিসের ব্যপার থাকলে সমস্যা নাই প্রেসক্রিপশনে লেখা থাকবে তিন দিন কমপ্লিট বেড রেস্ট। এখন টের না পেলেও পরে হয়ত ব্যথা থেকে জ্বরও আসবে।
রো- না, অফিসের কাগজপত্র বিষয়ক সমস্যা নাই। প্রেসক্রিপশনে বেড রেস্ট লেখা না থাকলেও ইচ্ছা করেলেই কয়েকদিন অফ নেয়া যাবে; এটা সমস্যা না।
ডা- আচ্ছা, এখন আমি ক্লিনিং শুরু করব। পুড়া আরেকটু কম হলে বলতাম না কিন্তু এই অবস্থায় আপনার আঙুলগুলো অবশ করে নিলেই ভাল হবে কারণ ময়লা ধুলা আপনার মাংশপেশির সাথে মিশে গেছে, পরিষ্কার করার সময় ব্যথা এখন যেমন আছে তার চেয়েও কয়েকগুণ বেশি হবে।
রো- ধুর কি বলেন! না না অবশ টবশ করার দরকার নাই। আপনি কাজ শুরু করেন। আপনি কাজ করতে করতে আমি আপনাকে আমার গল্পটা বলি।
ডাক্তার রোগীর মুখের দিকে তাকিয়ে কিছুটা বিরক্ত হয়ে কাজ শুরু করে।
রো- আপনি মনে হয় ভাবতেছেন আমার কিছু মানসিক সমস্যা আছে। হা হা, শুনে রাখেন আমার কিন্তু ঐ রকম কোন সমস্যা নাই। আমি সম্পূর্ণ সুস্থ এবং কর্মক্ষম। সত্তর জন ইঞ্জিনিয়ার আর তাদের জন্য চার জন ম্যানেজার, সব মিলিয়ে চুরাশি জন এমপ্লয়ি আমার আন্ডারে কাজ করে। বস হিসেবে আমি অনেক জনপ্রিয়, একি সঙ্গে অনেক ইফেক্টিভ। এটা কিন্তু সহজে পাবেন না, যেসব বস জনপ্রিয় হয়, কাজের ক্ষেত্রে এরা হয় কম ইফেক্টিভ কিন্তু আমার দুইটাই আছে।
ডাক্তার মধ্যমার বেশ গভীরে জমে থাকা ময়লা খুঁচিয়ে পরিষ্কার করতে থাকে, আঙ্গুলগুলো একটু কেঁপে ওঠে। ব্যাটা বোধ হয় এখন টের পাচ্ছে ব্যাথা কী জিনিশ।
রো- কী ফালতু ওয়েদার করছে এখন খেয়াল করছেন। বৃষ্টির কোন মা বাপ নাই, এই নামে ধুমধাম আবার এই নাই। আমি থাকি চারতলার একটা ফ্ল্যাটে। বাড়ির অন্যপাশে এখনো ডোবা আছে বুচ্ছেন, যদিও চারপাশ দেয়াল দিয়ে ঘেরা কারণ বড় বিল্ডিং হবে সেখানে, অর্ধেক ফ্লাট নাকি এখনি বিক্রি হয়ে আছে। ধুমধাম বৃষ্টি নামলে দেখতে আরাম লাগে। আমি ত মফস্বল থেকে আসছি, ডোবা পুকুরের জলে ঝুম বৃষ্টি পড়া দেখতে যে কী আরাম, কী বলব। অফিস থেকে এসে সেটাই করতেছিলাম, আর একা থাকি ত কিছু রান্নাও করতেছিলাম তখন। বৃষ্টি দেখে খিচুরি আর কড়কড়া বেগুন ভাজা খাইতে ইচ্ছা করল বুচ্ছেন। বেগুন ভাজতে ত অনেক তেল লাগে জানেন, আমি মোটামুটি আধা কড়াই তেল দিয়া বেগুন ভাজা শুরু করছি। তখন হটাৎ মনে হইল বুচ্ছেন, বুরবুর করে তেলের ভিতর বেগুন ভাজা অনেকটা ডোবার জলের উপর বৃষ্টির ফোঁটা পড়ার মত। আমি তখন বায়ে, জানালা দিয়া দেখি ডোবার জলে বৃষ্টি আর সামনে ননস্টিকি ফ্রাইং পেনে তেলের ভেতর ফালি ফালি বেগুনের বুরবুর। হঠাৎ মনে হইল আসলে কী ফালতু জীবন আমরা যাপন করতেছি!!! আসলেই!
ডা-(একটু বিরক্ত হয়ে রোগীর দিকে তাকিয়ে) আঙুলগুলো সোজা করে রাখেন। প্রত্যেকটা আলাদা আলাদাভাবে ব্যান্ডেজ করতে হবে।
রো- হা হা হা, ভাই আপনি যে বিরক্ত হইতেছেন। হা হা হা। শুনেন আমি সর্বশেষ কবে অসুস্থ হইছিলাম জানেন? ইউনিভার্সিটিতে পড়ার সময়; তাও মাত্র ২ দিনের জন্য। আমার তখন জন্ডিস হইছিল, খুব মাইনর। দুই দিন দিলাম দিন-রাইত টানা ঘুম, তৃতীয় দিন লাফ দিয়া নামলাম বিছানা ছাইড়া। বাসার সামনের মোড়ে আলা ভাইয়ের টং দোকানে গিয়া কইলাম দেন একটা বেনসন আর কাপটা ভাল কইরা ধুইয়া চিনি কমাইয়া একটা চা। ব্যাস এই। তারপরে সব ক্লিন। এই গত দশ বছরে একদিন এমনকি জ্বরও হয় নাই আমার।
ডা- (আরো বিরক্ত) ওকে বুঝলাম। এখন হাত আর কনুই পুড়াইছেন কেমনে বলেন, কেস হিস্টরি তে রাখতে হবে। যদিও আমি মোটামুটি আন্দাজ করতে পারতেছি।
রো- হা হা হা, এইবার একটু বোঝা যাচ্ছে, আপনার কিছুটা আগ্রহ আছে। এনিওয়ে ব্যাপার আসলে জটিল কিছু না। আমার হটাৎ মনে হইল ধুত্তোরি কী ফালতু চক্রবদ্ধ দিন রাত। ঝড় বৃষ্টি তুফান যাই হোক আমি এখন পর্যন্ত কোনদিন অফিস কামাই করি নাই, মারপিট কইরা রাস্থায় পইড়া থাকি নাই, কাউরে রাস্তায় দৌড়ানি দেই নাই, নিজেও দৌড়ানি খাই নাই, বুঝতে পারতেছেন? মানে এমন না যে ঠিক এই কাজগুলোই জীবনে করা দরকার বা ঠিক ঠিক এইগুলা না করা মানেই জীবন ব্যর্থ। এইগুলা যাস্ট উদাহরন আর কি। ত হটাৎ আমার মনে হইল এই যে ঘরে বাইরে প্রতিদিন আমরা তেলে ভাজা হইতে হইতে পুড়া মাকাল হইয়া যাইতেছি, দেই সেই তেলে নিজেরে ডুবাইয়া। সামনে ত তখন ধরেন তেল ভরতি সুইমিংপুল নাই, ত নিজেরে ডুবানো অসম্ভব, ধুত্তোরি শালার জীবন বইলা দিলাম একটা হাতই ডুবাইয়া। তবে বডিও আজিব কারখানা, আমার ত ধরেন কোন দ্বিধা ছিল না কিন্তু দেখলাম বডি নিজেই সেলফ ডিফেন্স আর্মি চালাইয়া দিল। অটো রিফ্লেক্সে পুরো হাতটা তেলে ডুবার আগে নিজে নিজেই বিদ্রোহ করে সরে গেল আর সরে যাওয়ার সময় লেগে গেল কড়াইয়ের হাতলটায়, ফলে কিছুটা তেল ছিটকে পড়ে গেল এই হাতের কনুইয়ে।
ডা- আপনার আঙ্গুলের ড্রেসিং শেষ। কনুইটা এইদিকে আনেন, করে দিচ্ছি। আর যত যাই বলেন তেলের মধ্যে কেউ নিজের হাত ডুবাইয়া দেয় না।
রো- কিছু ত করে, হয়ত অন্য কিছু। হে হে হে, আসলেই কি করে না কিছু!
ডাক্তার কোনরকম বাধা বিঘ্ন ছাড়াই কনুয়ের ড্রেসিং শেষ করে।
ডা- এই যে দুইটা অসুধ লিখে দিছি। একটা এন্টিবায়েটিক আরেকটা পেইন কিলার। পেইন কিলারটা চাইলে পরেও কিনতে পারেন। ওটা হইল যদি ব্যথা খুব বেশি মনে হয় তাইলে রাতে ঘুমানোর আগে একটা খেয়ে নেবেন কিন্তু এণ্টিবায়েটিকটা অবশ্যই পুরো কোর্স খাবেন।
রো- কি মনে হয়, ইনফেকশনের ভয় আছে এখনো?
ডা- না, অসুধটা খেলে আর সমস্যা হবে না। তবে চামড়া টানার সময় অনেক চুলকাবে আর ব্যথাও করবে।
এমন সময় সেই শিফটের সিও এসে ডাক্তারকে একটা লিস্টি ধরিয়ে দিয়ে বলে গেল যাওয়ার আগে সেই কেবিনগুলো একবার ভিসিট করে যেতে। ডাক্তার বিরক্তমুখে তালিকাটা হাতে নিল।
রোগীকে বিদায় দিয়ে সে গেল কেবিনগুলো ভিসিট করতে। কেবিনগুলো তার নয়, অন্য এক ডাক্তারের; সেই ডাক্তার সরকারি দলের নেতা। ইচ্ছামত ক্লিনিকে আসে যায়, অন্যদের তার ডিউটি করে দিতে হয়। কাগজেপত্রে তার নাম রাখতে হয়।
২
বৃষ্টি একটু ধরে আসছিল; ডাক্তারের ধারনা ছিল আর হয়ত নামবে না। নামল ঠিক তার বেরুবার সময়ে। ইভিনিং শিফট, ক্লিনিকের গাড়ি বাসায় পৌছে দিবে। সে বের হয়ে দেখে গাড়ি গেটের সামনেই আছে; ড্রাইভার মাখন মিয়া। সবাই ডাকে, সে নিজেও তার নাম বলে মাক্ষন। মাক্ষনের একটাই সমস্যা, পেচাল পাড়ে বেশি।
ডা- মিরপুর রোডে আর কেউ আছে নাকি মাখন ভাই?
মাক্ষন- জি স্যার। শাকিল স্যার যাইব, দশ নম্বর।
কথা বলতে বলতে শাকিল এসে ওঠে। গাড়ি ছাড়লে মাক্ষন তার রেগুলার প্যাচাল শুরু করে।
মাক্ষন- বুইচ্ছেন স্যার, হাসিনা সরকার ত মনে হয় আর বেশি দিন টিকবার পারব না। তুর্কি দেশের প্রেসিডেন্ট সব মুসলিম দেশে চিডি লিখছে।
শ্রোতা দুইজনই মাঝে মাঝে একটু আধটু হু হা করে যায়। সবাই জানে এই ক্লিনিকের পাঁচজন মালিকের তিনজন জামাতি। এতে এদের ব্যবসার ক্ষতি হচ্ছে না, শুধু কিছু ছাত্রনেতাকে চাকরি দিতে হয়েছে আর মাসে মাসে নিয়মিত একটা নির্দিষ্ট অফিসে চাঁদা দিতে হয়। চাঁদা এদিক অদিক সব সময়েই দিতে হয়; এইগুলা সমস্যা না।
গাড়ি দশ নম্বরের মোড়ে আসলে ডাক্তার শাকিল ড্রাইভারকে এক নম্বরে যেতে বলে, সে বাসায় যাবে না, এক নম্বরে কিছু কাজ আছে, সেখানে নামিয়ে দিতে হবে। ড্রাইভার এক নম্বরের দিকে যেতে শুরু করে।
শাকিলকে এক নম্বরে নামিয়ে দিয়ে মাক্ষন মিয়া পল্লবীর রাস্তা ধরে। বৃষ্টির তোড় তখনো বেড়েই চলেছে; ঢাকা শহর আজকে পানির নিচেই যাবে মনে হয়। ডাক্তারের মনে হঠাৎ একটা আশংকা হয় যে আজকে তার বাসায় যাওয়া হবে না। ইতিমধ্যেই রাত সাড়ে এগারোটা; বারোটা বাজলে বাড়িওয়ালা গেট বন্ধ করে দিবে, তখন বাসায় ঢোকা অনেক হাঙ্গামা। প্রেমিকা এরমধ্যেই দুইবার কল দিয়েছে তার ধরতে ইচ্ছা করে নাই। আজকেও রাত যাবে সেই একই, কী কর, কেন কর, কেন কর না, কবে হবে ইত্যাদি ইত্যাদি ঘ্যানঘ্যান করতে করতে।
মাক্ষন মিয়া ও বিরক্ত; সে তার প্যাচাল চালিয়ে যায়।
মাক্ষন - বুচ্ছেন সার, আমরার হইল সব দিকে সমস্যা। এই যে শাকিল স্যার দশ নম্বর থাইকা এক নম্বরে নিয়া আসলেন, এখন নিচে এক ঘন্টা সময় বেশি লাগব আমার অফিসে ফিরা যাইতে। গেলেই সুপারভাইজার কইব অন্য যায়গায় টিপ মারছি নাইলে আওয়ার সময় পেসেঞ্জার লইছি; নাইলে অত সময় লাগব কই। আবার আপনেরা স্যার কোন খানে যাইতে চাইলে আমরা ত না করতে পারি না।
গাড়ি দশ নম্বর মোড়ে এসে পড়ে গেল ওয়াসার গর্তে। একদিকে কাত হয়ে গেছে। মাক্ষন মিয়া এক্সিলেরেটর চেপেই যাচ্ছে, গাড়ি নড়তেছে না। বৃষ্টির তোড় আরো বেড়েছে। এত বড় মিরপুর দশ নম্বর মোড় অথচ কোথাও কোন মানুষ নাই, গাড়িও নাই। বৃষ্টির কারনেই মানুষ নাই, গাড়িও নাই হয়ত একটানা তিনদিন ছুটির প্রথম দিন হওয়াতে। মাক্ষন মিয়া অফিসে ফোন করে, অন্য গাড়ির খোঁজে; খোঁজ নিয়া জানায় অন্য আরেকটা গাড়ি নারায়ণগঞ্জ আছে, আসতে কমসে কম দুই ঘন্টা লাগব।
ডাক্তার জানালার কাচে বৃষ্টির ঝুম দেখে। তারপর কিছু না বলে হুট করে গাড়ির দরজা খুলে রাস্তায় বেড়িয়ে যায়। প্রথম কদমেই ফচ করে পা দেবে যায় একটা ছোট গর্তে। দৌড়ে গিয়ে মোড় পেড়িয়ে এইচএসবিসি এটিএমের পাশে কিছুদিন আগে এক মোবাইল কোম্পানির গড়ে দেয়া যাত্রী ছাওনির নিচে আশ্রয় নেয়। অল্প বৃষ্টিতে মানুষ কাক-ভেজা হয়, এই বৃষ্টিতে পুরাই মানুষ-ভেজা, সে তিরিশ সেকেন্ডের দৌড়ই হোক না কেন। বৃষ্টি তার ভাল লাগে না। ঠাণ্ডা জল তার ওপরে প্রচণ্ড বাতাস তার সারা শরীরে কাঁপুনি ধরিয়ে দেয়। তার পকেটে আবারো মোবাইল বেজে ওঠে। ভাইব্রেশনে দেয়া ছিল; মোবাইল বিরতিহীন কাপ্তেই থাকে। শরীরের কাঁপুনির সাথে ভেজা প্যান্টের পকেটে থাইয়ের সাথে চুপসে লেগে থাকে মোবাইলের কাঁপন তাকে আরো বেশি শীত লাগিয়ে দেয়। সে চিৎকার করে ওঠে 'ধুত্তোরি শালার জীবন'। বলে সে পকেট থেকে মোবাইল বের করে অন্য প্রান্তের মানুষকে কথা বলার সুযোগ না দিয়েই বলে ওঠে
'দেখো প্রত্যেকদিন সেই একি প্যাচাল আর ভাল্লাগে না। একি তেলে প্রতিদিন প্রতিমুহুর্তে ভাজা হওয়া আর কত সহ্য করা যায়?'
পরের দিন পত্রিকায় একটা ইন্টারেস্টিং খবর আসল; অত বড় কিছু না বলে প্রায় কারোরই চোখে পড়ল না।
লেখক পরিচিতি
আলেক সরকার
জন্ম ২৬ জুলাই, ১৯৭৯, সিলেটের সুনামগঞ্জে। ছোটবেলা থেকেই সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত। পড়াশোনা করেছেন শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে। সবধরনের পাঠে সীমাহীন আগ্রহ। বর্তমানে, চাকুরিসুত্রে দক্ষিণ আফ্রিকায় আছেন। আবৃত্তি করেন। মঞ্চ নাটকে কাজ করেন।
0 মন্তব্যসমূহ