চন্দন মণ্ডলের গল্প : বৃষ্টি এলে কে তোমাকে ডাকে--বাইরে আয়

মিতু আর তার বাবা জানালা দিয়ে আকাশ দেখছিল।

আজ শনিবার। বাবার অফিস বন্ধ। মা-র স্কুল খোলা, মা তাই স্কুলে গেছেন। বাসায় শুধু সে আর বাবা। আর তাদের কাজের মেয়েটা। শুক্রবার অবশ্য মা বাবা দুজনেই বাড়িতে থাকেন। সেদিন মিতুর খুব আনন্দ হয়। সপ্তাহের বাকি দিনগুলো তাকে বাসায় কাজের মেয়েটার কাছেই থাকতে হয়।
তাতে যদিও তেমন সমস্যা নেই। তবু বাসায় একসাথে মা বাবা দুজনে থাকা মানেই অনেক মজা। কেন যে মা-র স্কুলটা বাবার অফিসের মতো শুক্র-শনি দু’দিন ছুটি হয় না!

আকাশ দেখতে মিতুর ভালোই লাগে। বিশেষ করে সাথে যদি বাবা থাকে। কী সুন্দর আকাশ! বাবাই তাকে শিখিয়েছেন। টিভি না দেখ আকাশ দ্যাখো। দ্যাখো, কী সুন্দর আকাশ তার রঙ পাল্টায়!

মিতু এখন সাড়ে চার বছরের। সে রঙ চেনে, প্রত্যেকটা রঙের নাম জানে। রঙ পেনসিল, রঙের বাক্স, তুলি, আঁকার খাতা তার খুব প্রিয়। বাবার সাথে এটা নিয়ে প্রায়ই সে খেলতে বসে যায়। নানা রকম দৃশ্য আঁকে। তার মধ্যে থাকে মাছ, নদী, পাখি, আকাশ, ঘর, গাছ, আকাশে উড়ে যাওয়া পাখির ঝাঁক আরও কত কী!

প্রথম প্রথম রঙ দিয়ে সে শুধু খাতায় হিজিবিজি আঁকত। মানে আঁকতে জানতো না তো, শুধু রঙ পানিতে মিশিয়ে তুলি দিয়ে ইচ্ছামত কাগজে লাগাত। তারপর বাবার কাছে নিয়ে এসে বলত, বাবা দ্যাখো, আমি কী এঁকেছি?

বাবা বলতেন, তুমি একটা সুন্দর দৃশ্য এঁকেছ। তারপর দৃশ্যটায় কী কী কাছে তা তাকে বুঝিয়ে দিতেন। কিন্তু আসলে তো ওগুলো কিছুই হয়নি। শুধু রঙের হিজিবিজি আঁকা। কিন্তু সেটা বাবা কখনও তাকে বলেননি। এভাবেই হিজিবিজি আঁকতে আঁকতে মিতু এখন সুন্দর সুন্দর দৃশ্য আঁকতে পারে। যার ভেতরে মাছ, ফুল, পাখি, নদী, আরও কত কী থাকে! মিতুদের বাসায় এরকম একটা ছবি আছে। বাবা সেটা বাঁধিয়ে রেখেছেন বসার ঘরে।

বাবার সাথে জানালায় দাঁড়িয়ে মিতু দেখছিল কীভাবে আকাশটা একটু একটু করে রঙ পাল্টায়। সে বাবাকে বলল, বাবা, আকাশ কী সব সময় রঙ পাল্টায়?

বাবা বললেন, না, সব সময় না, তবে আকাশ দিনের মধ্যে কয়েকবারই রঙ পাল্টায়। সকালে আকাশটা একরকম তো দুপুরে তার অন্য চেহারা। বিকেলে তো তাকে চেনাই যায় না, একেবারে ভিন্ন! এজন্যই তো আমাদের দেশের আকাশটা এত সুন্দর!

আচ্ছা বাবা, আকাশ কিভাবে রঙ পাল্টায়?

বাবা একটু ভাবলেন। তারপর বললেন, আকাশের রং আসলে নীল। তবে মেঘের কারণে সে তার রঙ পাল্টায়। সূর্যের ভেতরে সাতটা রঙ আছে। সেগুলোই মেঘের সাথে খেলা করে নানা রঙের আকাশ বানায়। তুমি যখন বড় হয়ে অনেক বই পড়বে, তখন আরও ভালো ভাবে জানতে পারবে।

আচ্ছা, বই পড়ে কী অনেক কিছু জানা যায়? বাবা বলেন, নিশ্চয়, বই পড়ে কত কিছু জানা যায়! তাহলে মিতু বড় হয়ে অনেক অনেক বই পড়বে।

জানালায় দাঁড়িয়ে মিতু দেখল আকাশ এখন আর আগের মতো নেই। প্রথমে তো সে ছিল সাদা-সাদা নীল। তারপর আস্তে আস্তে কী রকম যেন লাল হয়ে গেল। আর এখন সে ভীষণ কাল হয়ে এসেছে। চারপাশ অন্ধকার। আর ঠাণ্ডা বাতাস বইতে লাগল। বাবা বললেন, খুব মেঘ করেছে, জোর বৃষ্টি হবে।

বলতে না বলতেই আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নেমে এল। কী বৃষ্টি, কী বৃষ্টি! ভারি মজা লাগল মিতুর। সে জানালার বাইরে হাত বাড়িয়ে দিল। বৃষ্টিতে ভিজতে লাগল। বৃষ্টির সাথে সাথে বরফের কুঁচিও পড়তে লাগল। জানালা দিয়ে উড়ে এসে সেগুলো পড়তে লাগল ঘরে। ঘরের মেঝে ভেসে যেতে লাগল। বাবা বললেন, শিলাবৃষ্টি।

মিতু এর আগে কখনো শিলাবৃষ্টি দেখেনি। সে আরও মজা পেয়ে গেল। লাফালাফি শুরু করে দিল। বলল, বাবা, চলো বৃষ্টিতে আমরা বাইরে যাই। আমার খুব ভিজতে ইচ্ছা করছে।

ক’দিন ধরে প্রচণ্ড গরম পড়েছে। তার উপর থাকে না বিদ্যুৎ। অসহ্য গরমে বৃষ্টি যেন শান্তির পরশ নিয়ে এসেছে। মিতুর কথাটা বাবার খুব পছন্দ হল। তিনি রাজি হলেন। বললেন, তুমি কি এই বৃষ্টিতে ভিজতে বাইরে যেতে চাও?

মিতু বলল, হ্যাঁ, চাই।

বাবা বললেন, বৃষ্টি এলে কে তোমাকে ডাকে বাইরে আয়?

জবাব দিতে মিতুর একটুও দেরি হল না। যেন উত্তরটা তার জানাই ছিল। বলল, বৃষ্টি। বাবা অবাক হয়ে আবারও তাকে জিজ্ঞাসা করলেন। সে অবিকল আগের মতই উত্তর দিল। বাবা আর কথা বাড়ালেন না। মিতুকে নিয়ে বাইরে ভিজতে বেরোলেন।

পথে যেতে যেতে মিতু বাবাকে বলল, আমরা কী একটু একটু না বেশি বেশি ভিজবো, বাবা?


দুরে বৃষ্টিতে ঝাপসা লাগছে সব। ঠাণ্ডা বাতাস। কদম ফুলের ঘ্রাণ ভেসে আসছে। আশে পাশে কোথাও ফুটেছে নিশ্চয়ই। প্রকৃতি তাহলে এল স্বরূপে! বাবা মিতুর দিকে একবার তাকালেন। কিছু বললেন না। হাত ধরে শুধু হাঁটতে লাগলেন।


লেখক পরিচিতি
চন্দন মণ্ডল
কবি। গল্পকার।
কৃষিবিদ।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ