মাসুদ পারভেজ এর গল্প- ছেঁড়াতারের সুর


অপেক্ষমান সময় ক্রমাগত বাড়তে থাকলে মেয়েটি যার নাম আমাদের জানা নাই সে স্টেশন মাস্টারের চোরা চাহনির শিকার হয় ভয় তার তখনও কাটে নাই কিংবা বাড়তে থাকে ট্রেন আসার কোনও খবর নাই কোথায় রেললাইন উপড়ে গেছে আর কোথায় রেল উল্টে গেছে, যাই হোক একটা খবর হবে তো দেশের এই দুর্যোগে মেয়েটি কেন এভাবে বাড়ি থেকে বের হল সেটা একটা বিষয় তবে সেটা জানার দরকার আমাদের এখন নাই
মেয়েটি স্টেশন মাস্টারের বয়স আন্দাজ করার চেষ্টা করে কিন্তু তাতে সে সফল হয় না আবার স্টেশন মাস্টারের কোনওকিছুই তার কাছে স্বাভাবিক ঠেকেনা বরং সে আবার দেখে মানুষটার কুঞ্চিত কপালের ভাজপড়া চামড়ার পাশে কাঁচা কম পাকা বেশি চুলের সমাহার আর পোড় খাওয়া চেহারার পাশে কালো ফ্রেমের পুরু লেন্সের চশমার দোস্তালি
তখন মেয়েটি বলে, না মানে খুব জরুরি যেতে হবে তাই এভাবে বের হতে হয়েছে কোন খোঁজ খবর না নিয়ে
এই লোকাল স্টেশনে বসে স্টেশন মাস্টারের নির্বিকারত্ব মেয়েটিকে আরও বেশি ভাবায় তবে এই ভাবনা বেশিক্ষণ স্থায়ী হয় না যখন স্টেশন মাস্টার তার পুরু লেন্সের চশমার কাঁচ মুছতে মুছতে বলে_ আজ রাতে আর ট্রেন নাও আসতে পারে মেয়েটি তখন বলে, আসবে না মানে!
স্টেশন মাস্টার আবার নির্বিকার তখন অবস্থা এমন দাঁড়ায় যে, লোকাল স্টেশনটা জনমানবহীন হতে থাকে আর অবস্থা আরও বেগতিক হয়ে পড়ে যখন প্রকৃতিও কিছুটা রহস্যময়ী হয়ে ওঠে তখন ঝড়, ঝড়োবৃষ্টি কিংবা বিজলি চমকানো শুরু হলে স্টেশনের বাল্ব আর জ্বলেনা
তখন চারপাশে কবর সমান অন্ধকার নেমে এলে মেয়েটি তার মোবাইলের সাহায্য চায় মোবাইলও প্রকৃতির মতো রহস্যময় আচরণ করে ফলে মেয়েটি মোবাইল অন করতে না পেরে উশ্খুশ করে তখন স্টেশন মাস্টার বলে, ঝড় বাদলার রাতে কারেন্ট গেলে আর আসে না স্টেশন মাস্টার তার টর্চলাইট খুঁজে কিন্তু টর্চলাইটও রহস্যময় আচরণ শুরু করে তখন মেয়েটি বলে, আপনার কাছে হারিকেন কি মোমবাতি নাই এবার স্টেশন মাস্টার শুধু হু বলে তারপর আবার অন্ধকার আর গাঢ় নীরবতা দুটি মানুষ সেই কোন আমলে তৈরি স্টেশনটার নোনাধরা ইটের দেয়ালের পাশে নিশ্চুপ হয়ে থাকে নীরবতায় আমাদের মনে খেয়াল আসতে পারে প্রকৃতি হয়তো ইচ্ছে করে মানুষ দুটিকে নিয়ে একটা খেলায় মেতেছে মানুষ দুটির মধ্যে মেয়েটি যার নাম আমরা জানিনা তার মনে একধরনের খেয়াল চাপে

মেয়েটি প্রথম অন্ধকারের নীরবতা ভেঙে স্টেশন মাস্টারের উদ্দেশে বলে, এই যে, শুনছেন?
একখন্ড অন্ধকার ধ্বসে পড়ে মেয়েটি স্টেশন মাস্টারকে বলেÑ এই ঘরে কবরের অন্ধকার কবরের অন্ধকার কথাটা বলার আগে মেয়েটি কিছুটা সময় নেয় আর তখন তার মনে হয় মৃত্যু ভাবনা একটা সংক্রামক ব্যাপার এটাতে যদি মানুষকে আচ্ছন্ন রাখা যায় তাহলে তার কাছে আর জাগতিক বিষয় তেমন সাড়া দেয় না তখন সে স্টেশন মাস্টারকে মৃত্যুর গল্প শোনায়
মেয়েটি শুরু করে এভাবে _আমার কিন্তু ছোটকাল থেকে ডাক্তার হওয়ার শখ ছিল কেন ছোটকালে এই শখ ভর করেছিল তা আজও জানা হয় নাই তো আমি যখন মেডিকেল কলেজে ভর্তি হলাম তখন থেকে ডাক্তার ডাক্তার ভাব আনার চেষ্টা করি 
এইপর্যন্ত বলার পর মেয়েটি থামে তারপর স্টেশন মাস্টারকে বলে, এই যে আপনি কি শুনছেন?                               স্টেশন মাস্টার কোন সাড়া না দিলে মেয়েটি বলে আপনি শুনছেন না বুঝি!                                                             
মেয়েটি একটু ভাবে, তারপর সিন্ধান্ত নেয় মৃত্যুর অনুভূতি আনতে এত জাগতিক কথা বলা ঠিক হচ্ছে না        তখন সে গল্পটা আবার শুরু করে
মেয়েটি বলে, ঠিক আছে আসল ঘটনা বলছি                                                                                        
স্টেশন মাস্টার: বলুন                                                                                                                              
মেয়েটি: আমার জীবনের প্রথম লাশকাটা ঘরের ঘটনা এটা                                                            
স্টেশন মাস্টার: তাহলে আপনি ডাক্তার!                                                                                                          
তখন মেয়েটি ভাবে_ যাক গল্পে প্রবেশ করানো যাচ্ছে এভাবে যদি প্রশ্ন করে গল্প শুনতে থাকে তাহলে একটা সময় অন্ধকার কেটে যাবে
মেয়েটি আবার শুরু করেÑ আপনি কি জানেন একটা মানুষলাশকাটা ঘরনামে একটা গল্প লিখেছিল তারপর  সেই মানুষটা কোন একদিন লাশকাটা ঘরের যাত্রী হয়ে যায় মানে মানুষটা আত্মহত্যা করে ভাবতে কেমন লাগে বলুন তো?
আমার লাশকাটা ঘরের অভিজ্ঞতা বলি, এই পর্যন্ত বলার পর মেয়েটি আবার থেমে যায় যার নাম আমরা জানিনা সে এবার নিজেই তার নাম প্রকাশ করে তার আগে সে একটু ভাবে তার এই ভাবানাটা আসলে অন্যখানে তখন সে খোলাসা করে, আমি মিতু আমার কালকে বিয়ে হবে তবে পারিবারিকভাবে না যার সাথে আমার বিয়ে দু-জন ডিসিশান নিয়েই বিয়ে করছি আমার ফ্যামিলি থেকে কিছুতেই মানছিল না কি করব বলুন, ওর এখনও কোন কিছু হয় নাই তাই বলে তো আর সারা জীবন সে বেকার থাকবে না আমার ফ্যামিলি সেটা কিছুতেই মানবে না না মানলে নাই আমরা নিজেরাই বিয়ে করছি কিন্তু কী ভাববে বলুন তো! আমার মোবাইল বন্ধ ওতো খুব টেনশন করছে আর এমন একটা রাতে আপনার ট্রেনের সমস্যা হল আমার আসলে খুব বিরক্ত লাগছে একটানা কথা বলার পর মেয়েটি যার নাম মিতু সে এবার একটু থামে
তখন আমরা বলতে পারি মেয়েটি আসলে একধরনের জটিলতার মধ্যে পড়েছে যা থেকে বের হওয়ার জন্যে সে কিছু একটা করার চেষ্টা করছিল কিন্তু সব কিছুই তার সাথে একধরনের খেলায় মাতে
জটিলতা : মেয়েটি তার পুরো পরিবারকে বিচ্ছিন্ন করে একটি বেকার ছেলেকে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে
জটিলতা : মেয়েটি যে ট্রেনে যাবে সেই ট্রেন আর আসছে না
জটিলতা : মেয়েটির মোবাইলের চার্জ শেষ হয়ে গেছে
জটিলতা : ঝড়-বৃষ্টির রাতে স্টেশন ফাঁকা
জটিলতা : ইলেকট্রিসিটি সারারাত আসার সম্ভাবনা নাই
জটিলতা : মেয়েটি স্টেশন মাস্টারকে অনিরাপদ মনে করে
জটিলতা : মেয়েটি স্টেশন মাস্টারকে ভুলিয়ে ভালিয়ে কিছু বলার চেষ্টা করছিল কিন্তু সে তা পারছে না  
এইসব জটিলতার ভারে মেয়েটি কিছুটা বিমর্ষ হয়ে পড়লে আমরাও কিছুটা বিরক্ত হই যখন আমরা ভাবি, বেকার ছেলেকে বিয়ে করার কী দরকার কিংবা কী দরকার এই সন্ধ্যায় বের হওয়ার কিংবা স্টেশন মাস্টার মেয়েটিকে কী করবে
মেয়েটির বিমর্ষতায় অন্ধকার ক্রমে গাঢ় হয়
স্টেশন মাস্টার তখন কথা বলে, বাপ-মায়ের অমতে বিয়ে করবেন মেয়েটি নীরব কিংবা স্টেশন মাস্টারের উপর কিছুটা বিরক্ত হয়
স্টেশন মাস্টার বলতে থাকে_ অনেক রাত আগের একরাত যে রাত হয়তোবা পৃথিবীতে আর ফিরে আসে না কিংবা আসলেও সবার জন্যে আসে না সেরকম একরাতে একটি যুবক চন্দ্রাহত হয় তখন অবশ্য তার কোন উপায় ছিল না যে মেয়েটির জন্যে সেরাতে যুবক ঘর থেকে বের হয়েছিল মেয়েটিও তাতে সায় দিয়েছিল আসলে যুবককে পিরিতের মরা ছাড়া আর কিছু বলা যায় না কিন্তু পিরিত তো আর সবাইকে আছর করে না সুদীর্ঘকাল ধরে যুবকের মাঝে যে পিরিতের বসত সেরাতে তার আছর ঘটে জগতে কোন কোন মানুষ নির্ভেজাল হওয়ার পরেও তারা জঞ্জাল হয়ে যায় যুবকের ভাগ্যটি ছিল আসলে সেরকম ছোটকালে মায়ের মৃত্যু থেকে শুরু করে চন্দ্রাহত হওয়ার রাত পর্যন্ত কোনওটাই আসলে তার জীবনে স্বাভাবিক না আবার জীবন যে থেমে থেকেছে তাও কিন্তু না যেমন, যে যুবতী তার মধ্যে অনেক দিন বসত গড়েছে এটা যুবক চেয়েছিল কি চাই নি এতে তার কোন হাত ছিল না কিন্তু যুবক শুধু এটা জেনেছিল যে, তার জীবনে কোন স্বাভাবিক কিছু ঘটে না আর তাই সে যুবতীকে নিয়ে নিজের ভেতরে কিছু নির্মাণ করে যেখানে যুবতী আবাস গড়েছিল এভাবেই চলছিল যুবক যুবতীর দিন কিন্তু যুবকের জীবনে তো কোনওকিছুই স্বাভাবিক না তাই একসময় যুবতীর আসা বন্ধ হয়ে যায় যুবক মনে মনে যুবতীকে বিচরায় কিন্তু মুখ ফুটে কিছু বলতে পারে না আসলে যুবক ছিল যুবতীর বাড়িতে আশ্রিত যুবতীর বিয়ের লগন আসে যুবক অপেক্ষায় থাকে যুবতীর মুখ থেকে কিছু শোনার আশায় কিন্তু যুবতী আর আসে না এভাবে কেটে যায় দিন-রাত তারপর যুবতীর বিয়ে যেদিন তার দুইদিন আগে সে যুবকের কাছে আসে যুবকের স্থির দৃষ্টির মাঝে যুবতীর শুধু ঠোঁট কাঁপে কাঁপা কাঁপা ঠোঁট নিয়ে যুবতী শুধু যুবককে চন্দ্রাহত রাতের কথা বলে যুবক দুইরাত পর সেই রাতে ঘর থেকে বের হয়ে যায় তারপর যুবতী তাকে যে জায়গায় যেতে বলেছিল সেখানে সে স্থির হয় এই স্থিরতা যুবকের ভেতরে অস্থিরতা তৈরি করে যুবক তখন চন্দ্রাহত হয় চন্দ্রাহত যুবকের অস্থিরতা বাড়তে থাকলে সে ফ্যাকাশে হতে শুরু করে হয়তোবা তার দেহ থেকে রক্তেরা সব সরে যেতে শুরু করে আর তখন তার চোখ থেকে এক ঘোলাটে দৃষ্টি চাঁদের চারপাশে যুবতীকে খোঁজে যুবতী তাকে কী বলেছিল সেটা যখন অব্যক্ত থেকে যায় তখন সে শুধু বিচ্ছিন্ন হতে থাকে চন্দ্রাহত যুবক যুবতীর দেখা না পেয়ে রেললাইনে নিজেকে সঁপে দেয়              
স্টেশন মাস্টার একদমে কথা শেষ করলে মিতু নামের মেয়েটি তখন কিছুটা আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে তার আচ্ছন্নতা কিছুটা কমলে সে স্টেশন মাস্টারকে প্রশ্ন করেÑ আপনি কি আমার ঘটনা শোনার পর এই গল্পটা বানালেন
স্টেশন মাস্টার কোন জবাব না দিলে মিতু অন্ধকারের অতল তলে তলিয়ে যেতে থাকে তারপর মিতু নিজেকে অন্ধকারে তলিয়ে যাওয়া থেকে আটকানোর জন্যে কিংবা তার মনে যে শঙ্কা স্টেশন মাস্টার তৈরি করেছে তা থেকে বের হওয়ার জন্যে সে বলে, আপনি এই গল্প কোথায় জানলেন?
স্টেশন মাস্টার যথারীতি নির্বিকার মিতু নামের মেয়েটি এবার আরও জোরে চিৎকার করে বলা শুরু করলে, স্টেশন মাস্টার তাকে বলে: আপনার বেকার প্রেমিকটি যদি সারারাত ইস্টিশনে আপনার অপেক্ষায় থেকে চন্দ্রাহত হয় কিংবা আপনার যোগাযোগহীনতাকে অপমান ভেবে রেললাইনে নিজেকে সঁপে দেয়? কথাটা শেষ হবার আগে মেয়েটি চিৎকার দেয় আগে পুরোটা তো শুনুন বলে, স্টেশন মাস্টার আবার শুরু করেÑ তাহলে কি আপনি রেললাইনে নিজেকে সঁপে দিবেন? মেয়েটি এবার আর আগের মত চিৎকার দেয় না তখন আবার নীরবতা আর তুষারের মত ঝুরঝুর করে অন্ধকার নামে
তখন স্টেশন মাস্টার যার নাম আমারা জানি না সে আবার বলেÑ আমি যদি বলি সেই চন্দ্রাহত যুবক আমি তাহলে কি আপনি বিশ্বাস করবেন? মিতু নামের মেয়েটি কিছু বলে না তখন আমরা মনে করতে পারি মেয়েটি অন্ধকারে আহত হয়েছে কিংবা তলিয়ে গেছে

স্টেশন মাস্টার কথা শুরু করে: চন্দ্রাহত যুবকটি যখন রেললাইনে নিজেকে সঁপে দেয় তারপর যুবতী সেখানে আসে কিন্তু সে যুবককে না পেয়ে তার চোখ থেকে যে পানি পড়ে তাতে ইউসুফ-জোলেখা, লাইলী-মজনু, শিরি-ফরহাদ, চন্ডীদাস-রজকিনী সবার আহাজারি মেশে আর তাতে যুবক অভিশপ্ত হয় সেই অভিশাপে যুবকটি যে চন্দ্রাহত হয়েছিল তারপর রেললাইনে নিজেকে সঁপেছিল সে এই নোনাধরা স্টেশনে বন্দি পাথর হয়ে আছে তবে আজ এই ঝড় বাদলার রাতে তার মুক্তি ঘটবে স্টেশন মাস্টার মেয়েটির দিকে তাকিয়ে বলেÑ অভিশাপ তার কেটে গেছে যখন আপনি এখানে এসেছেন
এবারও মেয়েটি কিছু বলে না
লোকাল স্টেশন, খন্ড খন্ড নীরবতা, জমাটবাধা অন্ধকার, দুই মানুষ হয়তোবা একজন, ঝড় কিংবা ঝড়োবৃষ্টি এসবের ভীড়ে আমরা কেবল মেয়েটির বেকার প্রেমিকটির জন্যে নোনতা অনুভূতি জাগাতে পারি             
                          


লেখক পরিচিতি
নাম:                       মাসুদ পারভেজ
জন্ম:                      ২১ জানুয়ারি, ১৯৮৫
জন্মস্থান:                দিনাজপুর
শিক্ষালাভ:             বাংলা বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
পেশা:                      শিক্ষক, বাংলা বিভাগ, শাহজালাল বিজ্ঞান প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট

প্রকাশিত গল্পগ্রন্থ : ঘটন অঘটনের গল্প, বটতলা (২০১১), বিচ্ছেদের মৌসুম (২০১৫)

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ