চড়াদামে হাইব্রিড ধানের বীজ কিনবে কি কিনবে না, এই দ্বিধায় দুলতে-দুলতে বুড়ো মুন্তু সার-বীজের দোকানের কাছে এসেও থপ্ করে দাঁড়িয়ে পড়ে। সেই সকাল থেকে তার সারা শরীর জুড়ে কেমন একটা ল্যপ্টা-ঝ্যাপ্টা অসাড়তা। মাঝে-মধ্যে তার কানের কাছে কে যেন চেঁচিয়ে-চেঁচিয়ে বলে যায়- সংসারটা মিছে, সত্যি-সত্যিই মিছে।
দোকানের সামনের বেঞ্চে বসে মুন্তু ভুস করে একটা দম ছাড়ে। চোখে ভাসে অকর্মা ছেলে দুটোর মুখ আর তাতেই মুন্তুর মন-মর্জি আরও বিগড়ে যায়। কার জন্য সে খাটবে, কার জন্য এই হাইব্রিড ধানের বীজ? যেন-তেন করে তার জীবনের বাকি দিনগুলো কেটে গেলেই তো হয়।
মানুষটা তার নিজের অজান্তে হাত দুটো কুলের ওপর ভাঁজ করে রেখে দুটো চোখের চাউনি চিলের মত সরু-শাণিত করে বাজারের চারপাশটা দেখে; কী গোপন আমোদেই না অঘ্রাণের এই দুপুরটা উড়াল দিতে চাইছে!
-হুঁ...
মুন্তু হুঁ বলে কিসের জন্য যেন নিজেকে তৈরি করে।
একহারা পিচ রাস্তাটা দু-পাশের ফসলভরা মাঠের মাঝে হঠাৎ হেঁচকি মেরে গজিয়ে ওঠা বাজারটাকে দু-ফালা করে সোজা নাক বরাবর ছুটে গেছে।
অঘ্রাণের এই আমেজি দুপুরে বাজারের দোকানগুলোর ঝাঁপ খোলা থাকলেও লোকজন তেমন একটা নেই। শুধু সার-বীজের একমাত্র দোকানটার সামনে দাঁড়িয়ে আছে আশ-পাশের গেরামের কয়েকটা চাষা। সেও ওদের দলেরই একজন কিন্তু তার মন-মর্জিটা কোনোকালেই ওদের মত হল না।
মুন্তুর শরীরটা কেমন টাল-মাটাল; উদগারের আগে যেমন হয়। তবু সে মাথা তুলে ফের বাজারের সবটা পরখ করে--আজ কতদিন! কতদিন...তার কোনো প্রাপ্তি নেই, সুখ নেই। অর্জনহীন নিষ্ফলা জীবন লবন-লঙ্কা ছাড়া পান্তা-ভাতের মত।
হঠাৎ মুন্তু চমকে ওঠে, বাজারের দক্ষিণ দিকের সেলুনটায় বসে; ও কে? দুই হাত মুঠো করে মুন্তু শিশুর মত চোখ দুটো কচলায়। নজরের জেল্লা অনেক আগেই ভোঁতা হয়ে গেছে। কয় হাত দূরের মানুষের মুখ চিনতে কেমন বেজান বেজান লাগে। সেলুনে বসে ক্ষুরের নিচে গাল পেতে আছে; মানুষটা ক্যাডা...হবিবুল্লা না? চমক-খাওয়া মুন্তুর কোটরাগত চোখ দুটো ঝলকে ওঠে। অনেক দিন আগে শুনা একটা কিচ্ছার মত তার যেন কী মনে পড়ে। আর মুন্তু এও লক্ষ করে, সেলুনে বসে হবিবুল্লা খুব মৌজ করে আলাপ করছে। তার মনে হল; এক্ষণে হবিবুল্লা শুধু আলাপ করছে না, বহুত ক্যারদানি মারছে। গত ক-বছরে ও শালার শরীরের চেকনাই একটু একটু করে বাড়ছে আর সাথে সাথে গপ্পের যোশটাও বেশ লায়েক হয়েছে। আজ-কাল হবিবুল্লা বেশ গুছিয়ে আলাপ চালাতে পারে।
মুন্তু পুচ করে থুথু ফেলে। আঁত-নাড়ির গভীর থেকে তেতু ঢেকুর আসছে। সেই কখন ল্যাড়ের মত পাতলা কয় চামচ ঝাউ খেয়েছে, তাতেও এখনো তার পেটটা টকটক বিস্বাদে ভরে আছে। শাকচুন্নির মত তার বুড়ি মাগীটা খালি কথায় কথায় বিষ ঢালে। ঘরে মুহূর্তের জন্যও মুন্তু টিসকিতে পারে না। আর তার জোয়ান পুলা দুটো...
ছেলেদের কথা মনে পড়তেই মুন্তুর হাত দুটো শিরশির করে ওঠে। কু-পুত্রের রক্তে যদি তার হাত দুটো ভেজাতে পারতো! কিন্তু তা কি-করে হয়?
মুন্তু খক করে বড় একটা কফের দলা ফেলে ফের সেলুনটার দিকে তাকিয়ে আড়ে-আড়ে হবিবুল্লাকে দেখে। বর্তমানে গেরামের অনেকেই হবিবুল্লার মত নগদ মালপানিতে ঝিলঝিলা। মালদ্বীপ, মালয়েশিয়া আর আরবের টাকা এখন তার আশপাশেও কড়-কড় করে নাচে।...আর এই মুহূর্তে সে ঐ টাকার কথা ভাবতে-ভাবতেই কি কিঞ্চিত ভড়কে গেলো? সে কী যেন ভাবছিল...। একটা জটিল স্রোত সময়কে যেন ঠেলা দিয়ে হড়কে যায় আর তাইতো মুন্তুর ভেতরটাও এলোমেলো হয়ে ওঠে। সে আবার হবিবুল্লাকে নিয়ে ভাবতে শুরু করে--হবিবুল্লার দু-দুটো পোলা আরব দেশে, আর ছোটটা ঢাকার কোন ফ্যাক্টরির পিও না এমও পোস্টে। সকাল থেকে সন্ধ্যা তক হবিবুল্লা পাক দিয়ে পাক দিয়ে বাজারে ওঠে। ফিনফিনা পাঞ্জাবির পরতে-পরতে ক্যারদানি ফোটে থাকে। মুন্তু যেন ভেতরে-ভেতরে কিসের একটা তাড়া বোধ করে। কী একটা জিনিস যেন আউলা-ঝাউলা হয়ে আছে; একটু সিযিল করতে হয়।
মানুষটাকে লোকে আগে হাইব্ব্যা বলেই ডাকতো কিন্তু হাতে মাল্পানি আসতে-না-আসতেই সে এখন হবিবুল্লা।
সালামালাইকুম-- মুন্তু সালাম দিয়ে হবিবুল্লার সামনে দাঁড়ায়। তাহলে মুন্তু ট্যাং-ট্যাং করে হাঁটতে-হাঁটতে তার ভাবনার পরিধি ধরতে পেরেছে--এমন চিন্তায় সে মনে-মনে খুশি হয়।
সদ্য চুলদাড়ি-ছাঁটা হবিবুল্লা ঝেড়ে-ঝোড়ে সাফ হচ্ছে; সালামের শব্দে একটু তড়িতে মাথা তুলে মুন্তুকে দেখে। দোমড়ানো শরীরের মুন্তু তিন বেঁকা দিয়ে দাঁড়িয়ে তার দিকে আলাপের গলা বাড়িয়ে আছে দেখে হবিবুল্লা প্রথমে একটু অবাক হয়। মন্তু একটু ধীরিক ধরে জিজ্ঞেস করে-
-কেমুন আছেন?
-ভালাই আছি কিন্তুক তুমি এই দিকে ক্যা?
-না,কয়ডা হাব্রিড বীজ কিনতে আইছিলাম।
-হ, অহনত হাইব্রিডেরই যুগ..., ফলন বেশি, সার বেশি...সব বেশি বেশি লাগে।
হবিবুল্লা লুঙ্গি ঝাড়া দিয়ে মাথা তোলে। আর এই ফাঁকে সেলুনের আয়নায় মুন্তুর নিজের মুখাবয়ব চোখে পড়ে; ভূত দেখার মত সে চমকে ওঠে।
-ক্যাডা এইডা?
আয়নায় চোখ রেখে মনে মনে তালাশ করতে-করতে সে ধরতে পারে মানুষটা কে। তাহলে এই সে! কত বছর, কত যুগ পর সে নিজেকে নিজে দেখে ভেতরে ভেতরে খান খান হয়ে যায়। হলুদ কেঁতুরভরা চোখ দুটোর মাঝে শকুনের ঠোঁটের মত নাকটা। চুল-চামড়া আর শরীরের যা অবস্থা তাতে সে একটা নিখাদ ভিক্ষুক, না একটা শকুন, না, না--একটা উপমাও তার মনমত হলো না; এক নজরে সে আয়নায় যে মূর্তিটা দেখেছে, আসলে সেটা একটা বুড়ো সাপ: ক্রোধহীন বিদ্বেষে ক্লান্ত।
সারবাঁধা দোকানের সামনে দিয়ে হবিবুল্লা বাজারের উত্তর দিকে হাঁটে। একটু বে-ভুলা ছন্দে ডাশ মাছির মত হুলে বিষ ও তৃষ্ণা নিয়ে মুন্তুও পেছন পেছন ট্যাং-ট্যাং করে হাঁটে। কানাইয়ের স্টলের সামনে এসে হবিবুল্লা অপেক্ষা করে, দক্ষিণ থেকে একটা ট্রাক মাটি কাঁপিয়ে আসছে। গাইয়ের পিছে বাছুরের মত সাথে একটা টেম্পুও। উড়ন্ত ধূলা থেকে রক্ষা পেতে হবিবুল্লা বাঁ হাতে নাক চেপে ধরে। মন্তুর কোনো প্রস্তুতি নেই। সে ঝিম মেরে আছে। আসলে বুড়োটা ভিত্তে-ভিত্তে দাঁত ধারাচ্ছে, যা তার নিরীহ মুখ দেখে কেও কস্মিনকালেও ভাবতে পারবে না। হবিবুল্লার ঘাড়ে একটা মাঝারি ভাঁজ পড়েছে; যদিও একটাই তার বর্তমান সুখি জীবনের একমাত্র সাইনবোর্ড নয় কিন্তু মন্তুর কাছে আপাতত এটাই বেশি বিপজ্জনক। হবিবুল্লার এই অর্জনটি যেন চারপাশের গ্রামগুলোর সব মন্তুদেরকে সারাক্ষণ টিটকারি দেয়, আর নিজের সুখের বিস্তর বয়ান করে।
-অ-মন্তু খাড়ায়া রইলা ক্যা, বও।
-জে, জে।
-তোমার পোলারা অহন কোনডা কোন দিকে?
হবিবুল্লার কথায় মন্তু কানাইয়ের স্টলের টুলে বসতে-বসতে চোখ দুটোতে ঝামরি কেটে তীক্ষ্ণ-সচেতন হয়ে ওঠে।
-বুঝলা মন্তু, খালি হাইব্রিড বীজ কিনলে কি অইবো; সার-কীটনাশক-ডিজেলের বাজার দ্যাহনা কত গরম।
-জে, আফনে হাচা কইছেন।
মন্তু অবোধ বালকের মত সম্মতিসূচক মাথা নাড়ে।
-খালি কিনলেত অইতনা, টাইম মত হেগোর খাওন-পানি যুগাইতে অইবো।
-অবশ্যি...অবশ্যি...
মন্তু প্রাজ্ঞ কৃষকের মত মাথা নাড়ে। আসলে সে ভিত্তে-ভিত্তে পুরা প্রস্তুত; এখন শুধু ছোবলের ক্ষেত্রটি তৈরি করতে তাকে যা মুখ-চবলাতে হচ্ছে।
-অ-কানাই দুইডা চা দেচা। রইদে বইবানি মন্তু, রইদডা বড় মজার।
হবিবুল্লার কাছে তামাম দুনিয়াটাই মজার। দামি সোয়েটারটা সে হাতে তুলে নেয়, যেটা চুল কাটার আগেই সে খুলেছিল। ওর খাবলা-ধরা কালচে আঙুলে সোয়েটারটার রঙিন চেকনাই ঝলক দেয়। কত আর হবে, এই সাত-আট সাল আগেও হবিবুল্লা একটা মেইড়-ভাঙা চাষা ছিল, তারও আগে এই পিচ পথটা যখন আধা জংলা-গোপাট, তখন বালক মন্তুরা দুই মাইল দূরের চন্দ্রনাথ বিদ্যানিকেতনে যাওয়ার জন্য এই গোপাটে এসে মিলিত হতো। ঢ্যাঙা-লিকলিকে, ছেঁড়া-ময়লা পোশাক-পরা হ্যাবলা হইব্ব্যা চারপাশের জংলার হিয়াল-বান্দরের ডরে দলের মধ্যে থেকেও কেমুন ভ্যা-ভ্যা করতো। আর অহন...হবিবুল্লার বাড়িটা দালান হয়ে গেছে। মাঠে ফসলের মেলা জমিও কিনেছে; আর ইজ্জতটাই কি কারো চেয়ে কম?
স্টলের ঝাপের নিচের বেঞ্চিতে এসে ওরা রোদের দিকে পিঠ দিয়ে বসে। কচি ছেলের দুধ-দাঁতের কামড়ের মত অঘ্রাণের রোদ ওদের পিঠে তুরতুরি আরাম জাগায়।
-আপনের ছেলেগুলান খুব লায়েকমান।
মন্তু আলাপ জোড়ে। চোখে ভাসে তার নিজের আচুদা পোলা দুটোর মুখ। সর্বদিক দিয়ে একেবারে পয়মাল করে দিলো। সেই রাগেইতো মন্তু আর তেমন করে চাষ-বাস করে না। পেটের দায়ে আর বুড়িটার কুদাম-পাদামে ঘরে টিকতে পারে না বলেই তো সে হাল-গরু নিয়ে মাঠে নামে; না-হলে ঘুরে-ঘেঁটে বাকি জিন্দিগিটা কাটিয়ে দিতো।
-তোমার পোলা দুইডার খবর কী?
-না, আগের মতই। একটা পল্টিফার্মে আছিন, হেইহানত্তেই ছুরতুনের ছেমড়িডারে লইয়া ভাগছে।...অহন আর কোনো তত্ত-তালাশ জানি না। আর ছোট্ট পোলাডা কাঠের কাম ভালাই শিখছিল কিন্তুক কামের চে আড্ডাবাজিই বেশি পছন্দ।
-হ, বাজারেও হেরে বেশি বেশি দ্যাহি; তাইলে কাম করে কোন টাইমে?
হবিবুল্লা মন্তুর কথায় সাক্ষী দেয়। ফের আফসোসও করে: হেইডা আমারেও একটা শোকেস বানায়া দিছিন, জিনিসটা যা সুন্দর অইছে না। পোলাডা যুদিন ঠিকমতন কাম করত...
তারা এখন চায়ে চুমুক দিয়ে চুক-চুক করে স্বাদ নিচ্ছে। গরুর চানার মত লেশমা-লেশমা শেষ বাজারের কড়া চা। আপাত এই পান নীরবতায় উলটা দিকের ফোনের দোকান থেকে একজনের রাগী গলার হাক-ডাক তাদের মাঝে বারবার হামলে পড়ে। মন্তু আন্দাজে ধরে নেয় লোকটা ফোনের ওপাশের মানুষটাকে খুব নিচ্ছে। অপরিচিত সেই ব্যক্তির নাজেহাল চেহারাটা যেন সে দিব্যি দেখতে পাচ্ছে। পোলা দুটোর জন্য সেও কি কম ভুগতেছে। যত মারো কাটো মন্তু কিন্তু পিটপিট করে হাসবে, আর সুবিধা মত ছোবল দেবার জন্য ভিত্তে-ভিত্তে দাঁত ধারাবে। যতদিন না কাম হাসিল হবে ততদিন সে শিকারের পেছনে নিষ্ঠাবান তাপস।
হবিবুল্লা কাপটা ঠাস করে নামিয়ে রাখে। মন্তু চমকে ওঠে। লোকটা কি হুদাহুদিই গরম হয়ে যাচ্ছে? মালধার মানুষের মতিগতি আন্দাজ করা শক্ত।
যেই কথা, সেই কাজ।
হবিবুল্লা বিষাক্ত গলায় বলে, তুমিই পোলা দুইডারে নষ্ট করছ। বাপ হিসাবে তুমি কি শাসনডা করলা। ডাক-ডাক করতে-করতে হেরা পয়মাল হয়ে গেলো। মন্তুর মাথাটা ঝিমঝিম করে, চোখের সামনের সবকিছু কেমন ঝাপসা হয়ে আসে।
-বাদ দেন, বাদ দেন, হেই চেট-মুইক্ষ্যা পোলাগর কথা। আফনার নিজের আলাপ করেন, হুনতেও সুখ। হুনলাম আফনের ছোডো পালারে নাকি ঢাকায় শাদি করাইছেন।
ছোট্ট পুত্রবধুর মিষ্টিমুখ আর বেয়াইয়ের ছবির মত ঝকমকা দালানটার কথা মনে হতেই তৃপ্তির ঢেকুরে হবিবুল্লা শীতল হয়ে আসে। তার ঘাড়ের চর্বির মোটা ভাঁজটি তেল-ময়লাসহ রোদের জেল্লায় চকচক করে ওঠে। মন্তুর ইচ্ছা হয় প্রকাশ্যেই সেখানে দাঁত বসিয়ে দিতে। হবিবুল্লার মুখের পান-সুপারি যুত হয়ে এলে সে পকেট থেকে সিগারেট-ম্যাচ বের করে ধরানোর উজ্জুগ করে।
-হ, হেরা খুব মালদার পাট্টি, হেদের তুল্যে আমি কিচ্ছু না, কিন্তুক আমার পোলারে তারা খুব পছন্দ করছে, হেই ভরসাতেই কামটা সামুটতা পারছি।
-আর বড় দুই জনরে?
মন্তু একটু-একটু করে লক্ষ্যের দিকে এগুচ্ছে।
-বড় দুই ছেলে সামনের সন বাড়িৎ আইলেই...
-হেই দেশটা খুব ধনি মাইনষের, না?
-তুমি যে কি কও, ধনি না হইলে কি আর হেরা সখ কইরা বিদেশতে মানুষ নেয়।
-অইবো...অইবো...।
মন্তু আমতা-আমতা করে আর পিট-পিট করে হাসে। এই হাসিটা তার আসল অস্ত্র। পায়ে উস্টা দিয়ে ফেলে দিলেও ঐ হাবড়া মুখটা থেকে হাসিটা মুছে ফেলা যায় না।
-তে আফনের বড় মেয়ের জামাইয়ের খবর কী?
এই কথায় হবিবুল্লা বজ্ররাহতের মত নির্বাক চেয়ে থাকে।
তার বড় মেয়ের জামাই এখন কারাগারে। বিডিআর বিদ্রোহের অভিযোগে বন্দি। বড় কঠিন বিচারের সন্মুখীন। হবিবুল্লার খাড়া মাথাটা ঝপাস করে বুকের কাছে নুয়ে পড়ে। তার ঘাড়ের মোটা-গম্ভীর ভাঁজটি কেমন মেন্দা মেরে যায়। মন্তু নিজেকে দিয়ে বোঝে, বাপ সন্তানের জন্য কতটুকু দরদ রাখে। হবিবুল্লার সেই গোপন জাগাটার খবর পাওয়া তক্ তার দাঁত শিরশির করছিল। দুই-তিন মাসের মধ্যে এমন বড় শিকার সে ধরতে পারেনি। কষ্ট ছাড়া তার জীবনে আর কিচ্ছু প্রাপ্তি নেই। তার সব গোল্লায় গেছে। দিনে দিনে বুড়ি মাগিটা একটা ঝগড়াটে শাকচুন্নিতে পরিনত হয়েছে। যা কিছু জমি আছে, তাও উপযুক্ত চাষ ও যত্নের অভাবে তামা হয়ে গেছে। কিছু না দেখে, না-পেয়েই সে ফিরে যাবে এটা সে মানতে নারাজ। তাই মুফতে যা মিলে তাতেই সুখ, আর সেটুকুই তার সব না-পাওয়ার পাওয়া।
-তে কইলেন না জামাইয়ের খবর কী?
যুশ-রোষহীন হবিবুল্লা মরা শরীরটা যেন পাথরের মত টেনে তুলে দাঁড়ায়। কাউকে কিছু না বলে নুয়ে-নুয়ে বাড়ির পথ ধরে। চরম প্রশান্তির মাঝে মন্তুর খুব শখ হয় একবার ডাক দিয়ে হবিবুল্লাকে জিজ্ঞেস করে, 'এই মিয়া সাব কিছু হারাইছেন নাকি?' কিন্তু তার পিছনে একটা জিপের কেচ্ করে ব্রেক কষার শব্দে সে ফিরে তাকায়। হাতে দড়ি, হ্যান্ডকাপ আর তেল-তেলা রুল নিয়ে কয়টা পুলিশ জিপ থেকে নামছে। একজন তার দিকে কড়া চোখে চেয়ে জিজ্ঞেস করে, হালিমের বাপ মন্তুর বাড়িটা কোন দিকে বলতে পার? মন্তুর মুখে তৃপ্তি জড়ানো চিল-বিল হাসিটি তখনো লেগে আছে; সেই হাসি নিয়েই ভয়ে-ভয়ে সে উল্টা প্রশ্ন করে; কেন...।
খাটো কিন্তু ধামার মত ভটকা যে লোকটা একপাশে দাঁড়িয়ে তাকে নীরবে পরখ করছিল, সে বলে--কেন, জানসনা? বাইনচুদটারে শ্বশুর বাড়িত নিতাম দাওয়াত খাওয়াইতে, খানকির পুত ক্যাশবাক্স ভাইঙ্গা ট্যাহাও নিছে, লগে কামের ছেমড়িডারেও নিছে।
মন্তু একনিমেষে সব বুঝে নেয় আর চিনে নেয় তার পোলার পল্টিফার্মের মালিককেও। কিন্তু সে নির্বিকার ভাবে বলে, কী যে কন পারতামনা ক্যা, আইয়েন হালিমের বাফের বাড়িডা দ্যাহায়া দিতাছি।
মন্তু সবার আগে ঝুলতে-ঝুলতে হাঁটে, আর তার পেছনে কয়জোড়া প্রশিক্ষিত পা ভারি বুটের মচমচ শব্দ তুলে হালিমের বাপ মন্তুর বাড়ির দিকে এগিয়ে যায় তাদের শিকারটি হস্তগত করার জন্য।
লেখক পরিচিতি
শেখ লুৎফর
জন্ম ১৯৬৬ সালে ময়মনসিংহের গফরগাঁও। পেশায় শিক্ষক শেখ লুৎফরের বর্তমান নিবাস সুনামগঞ্জ জেলায়। দুটি গল্পগ্রন্থ প্রকাশ পেয়েছে, 'উল্টারথে' এবং 'ভাতবউ'। উপন্যাস 'আত্নজীবনের দিবারাত্রি'।
দোকানের সামনের বেঞ্চে বসে মুন্তু ভুস করে একটা দম ছাড়ে। চোখে ভাসে অকর্মা ছেলে দুটোর মুখ আর তাতেই মুন্তুর মন-মর্জি আরও বিগড়ে যায়। কার জন্য সে খাটবে, কার জন্য এই হাইব্রিড ধানের বীজ? যেন-তেন করে তার জীবনের বাকি দিনগুলো কেটে গেলেই তো হয়।
মানুষটা তার নিজের অজান্তে হাত দুটো কুলের ওপর ভাঁজ করে রেখে দুটো চোখের চাউনি চিলের মত সরু-শাণিত করে বাজারের চারপাশটা দেখে; কী গোপন আমোদেই না অঘ্রাণের এই দুপুরটা উড়াল দিতে চাইছে!
-হুঁ...
মুন্তু হুঁ বলে কিসের জন্য যেন নিজেকে তৈরি করে।
একহারা পিচ রাস্তাটা দু-পাশের ফসলভরা মাঠের মাঝে হঠাৎ হেঁচকি মেরে গজিয়ে ওঠা বাজারটাকে দু-ফালা করে সোজা নাক বরাবর ছুটে গেছে।
অঘ্রাণের এই আমেজি দুপুরে বাজারের দোকানগুলোর ঝাঁপ খোলা থাকলেও লোকজন তেমন একটা নেই। শুধু সার-বীজের একমাত্র দোকানটার সামনে দাঁড়িয়ে আছে আশ-পাশের গেরামের কয়েকটা চাষা। সেও ওদের দলেরই একজন কিন্তু তার মন-মর্জিটা কোনোকালেই ওদের মত হল না।
মুন্তুর শরীরটা কেমন টাল-মাটাল; উদগারের আগে যেমন হয়। তবু সে মাথা তুলে ফের বাজারের সবটা পরখ করে--আজ কতদিন! কতদিন...তার কোনো প্রাপ্তি নেই, সুখ নেই। অর্জনহীন নিষ্ফলা জীবন লবন-লঙ্কা ছাড়া পান্তা-ভাতের মত।
হঠাৎ মুন্তু চমকে ওঠে, বাজারের দক্ষিণ দিকের সেলুনটায় বসে; ও কে? দুই হাত মুঠো করে মুন্তু শিশুর মত চোখ দুটো কচলায়। নজরের জেল্লা অনেক আগেই ভোঁতা হয়ে গেছে। কয় হাত দূরের মানুষের মুখ চিনতে কেমন বেজান বেজান লাগে। সেলুনে বসে ক্ষুরের নিচে গাল পেতে আছে; মানুষটা ক্যাডা...হবিবুল্লা না? চমক-খাওয়া মুন্তুর কোটরাগত চোখ দুটো ঝলকে ওঠে। অনেক দিন আগে শুনা একটা কিচ্ছার মত তার যেন কী মনে পড়ে। আর মুন্তু এও লক্ষ করে, সেলুনে বসে হবিবুল্লা খুব মৌজ করে আলাপ করছে। তার মনে হল; এক্ষণে হবিবুল্লা শুধু আলাপ করছে না, বহুত ক্যারদানি মারছে। গত ক-বছরে ও শালার শরীরের চেকনাই একটু একটু করে বাড়ছে আর সাথে সাথে গপ্পের যোশটাও বেশ লায়েক হয়েছে। আজ-কাল হবিবুল্লা বেশ গুছিয়ে আলাপ চালাতে পারে।
মুন্তু পুচ করে থুথু ফেলে। আঁত-নাড়ির গভীর থেকে তেতু ঢেকুর আসছে। সেই কখন ল্যাড়ের মত পাতলা কয় চামচ ঝাউ খেয়েছে, তাতেও এখনো তার পেটটা টকটক বিস্বাদে ভরে আছে। শাকচুন্নির মত তার বুড়ি মাগীটা খালি কথায় কথায় বিষ ঢালে। ঘরে মুহূর্তের জন্যও মুন্তু টিসকিতে পারে না। আর তার জোয়ান পুলা দুটো...
ছেলেদের কথা মনে পড়তেই মুন্তুর হাত দুটো শিরশির করে ওঠে। কু-পুত্রের রক্তে যদি তার হাত দুটো ভেজাতে পারতো! কিন্তু তা কি-করে হয়?
মুন্তু খক করে বড় একটা কফের দলা ফেলে ফের সেলুনটার দিকে তাকিয়ে আড়ে-আড়ে হবিবুল্লাকে দেখে। বর্তমানে গেরামের অনেকেই হবিবুল্লার মত নগদ মালপানিতে ঝিলঝিলা। মালদ্বীপ, মালয়েশিয়া আর আরবের টাকা এখন তার আশপাশেও কড়-কড় করে নাচে।...আর এই মুহূর্তে সে ঐ টাকার কথা ভাবতে-ভাবতেই কি কিঞ্চিত ভড়কে গেলো? সে কী যেন ভাবছিল...। একটা জটিল স্রোত সময়কে যেন ঠেলা দিয়ে হড়কে যায় আর তাইতো মুন্তুর ভেতরটাও এলোমেলো হয়ে ওঠে। সে আবার হবিবুল্লাকে নিয়ে ভাবতে শুরু করে--হবিবুল্লার দু-দুটো পোলা আরব দেশে, আর ছোটটা ঢাকার কোন ফ্যাক্টরির পিও না এমও পোস্টে। সকাল থেকে সন্ধ্যা তক হবিবুল্লা পাক দিয়ে পাক দিয়ে বাজারে ওঠে। ফিনফিনা পাঞ্জাবির পরতে-পরতে ক্যারদানি ফোটে থাকে। মুন্তু যেন ভেতরে-ভেতরে কিসের একটা তাড়া বোধ করে। কী একটা জিনিস যেন আউলা-ঝাউলা হয়ে আছে; একটু সিযিল করতে হয়।
মানুষটাকে লোকে আগে হাইব্ব্যা বলেই ডাকতো কিন্তু হাতে মাল্পানি আসতে-না-আসতেই সে এখন হবিবুল্লা।
সালামালাইকুম-- মুন্তু সালাম দিয়ে হবিবুল্লার সামনে দাঁড়ায়। তাহলে মুন্তু ট্যাং-ট্যাং করে হাঁটতে-হাঁটতে তার ভাবনার পরিধি ধরতে পেরেছে--এমন চিন্তায় সে মনে-মনে খুশি হয়।
সদ্য চুলদাড়ি-ছাঁটা হবিবুল্লা ঝেড়ে-ঝোড়ে সাফ হচ্ছে; সালামের শব্দে একটু তড়িতে মাথা তুলে মুন্তুকে দেখে। দোমড়ানো শরীরের মুন্তু তিন বেঁকা দিয়ে দাঁড়িয়ে তার দিকে আলাপের গলা বাড়িয়ে আছে দেখে হবিবুল্লা প্রথমে একটু অবাক হয়। মন্তু একটু ধীরিক ধরে জিজ্ঞেস করে-
-কেমুন আছেন?
-ভালাই আছি কিন্তুক তুমি এই দিকে ক্যা?
-না,কয়ডা হাব্রিড বীজ কিনতে আইছিলাম।
-হ, অহনত হাইব্রিডেরই যুগ..., ফলন বেশি, সার বেশি...সব বেশি বেশি লাগে।
হবিবুল্লা লুঙ্গি ঝাড়া দিয়ে মাথা তোলে। আর এই ফাঁকে সেলুনের আয়নায় মুন্তুর নিজের মুখাবয়ব চোখে পড়ে; ভূত দেখার মত সে চমকে ওঠে।
-ক্যাডা এইডা?
আয়নায় চোখ রেখে মনে মনে তালাশ করতে-করতে সে ধরতে পারে মানুষটা কে। তাহলে এই সে! কত বছর, কত যুগ পর সে নিজেকে নিজে দেখে ভেতরে ভেতরে খান খান হয়ে যায়। হলুদ কেঁতুরভরা চোখ দুটোর মাঝে শকুনের ঠোঁটের মত নাকটা। চুল-চামড়া আর শরীরের যা অবস্থা তাতে সে একটা নিখাদ ভিক্ষুক, না একটা শকুন, না, না--একটা উপমাও তার মনমত হলো না; এক নজরে সে আয়নায় যে মূর্তিটা দেখেছে, আসলে সেটা একটা বুড়ো সাপ: ক্রোধহীন বিদ্বেষে ক্লান্ত।
সারবাঁধা দোকানের সামনে দিয়ে হবিবুল্লা বাজারের উত্তর দিকে হাঁটে। একটু বে-ভুলা ছন্দে ডাশ মাছির মত হুলে বিষ ও তৃষ্ণা নিয়ে মুন্তুও পেছন পেছন ট্যাং-ট্যাং করে হাঁটে। কানাইয়ের স্টলের সামনে এসে হবিবুল্লা অপেক্ষা করে, দক্ষিণ থেকে একটা ট্রাক মাটি কাঁপিয়ে আসছে। গাইয়ের পিছে বাছুরের মত সাথে একটা টেম্পুও। উড়ন্ত ধূলা থেকে রক্ষা পেতে হবিবুল্লা বাঁ হাতে নাক চেপে ধরে। মন্তুর কোনো প্রস্তুতি নেই। সে ঝিম মেরে আছে। আসলে বুড়োটা ভিত্তে-ভিত্তে দাঁত ধারাচ্ছে, যা তার নিরীহ মুখ দেখে কেও কস্মিনকালেও ভাবতে পারবে না। হবিবুল্লার ঘাড়ে একটা মাঝারি ভাঁজ পড়েছে; যদিও একটাই তার বর্তমান সুখি জীবনের একমাত্র সাইনবোর্ড নয় কিন্তু মন্তুর কাছে আপাতত এটাই বেশি বিপজ্জনক। হবিবুল্লার এই অর্জনটি যেন চারপাশের গ্রামগুলোর সব মন্তুদেরকে সারাক্ষণ টিটকারি দেয়, আর নিজের সুখের বিস্তর বয়ান করে।
-অ-মন্তু খাড়ায়া রইলা ক্যা, বও।
-জে, জে।
-তোমার পোলারা অহন কোনডা কোন দিকে?
হবিবুল্লার কথায় মন্তু কানাইয়ের স্টলের টুলে বসতে-বসতে চোখ দুটোতে ঝামরি কেটে তীক্ষ্ণ-সচেতন হয়ে ওঠে।
-বুঝলা মন্তু, খালি হাইব্রিড বীজ কিনলে কি অইবো; সার-কীটনাশক-ডিজেলের বাজার দ্যাহনা কত গরম।
-জে, আফনে হাচা কইছেন।
মন্তু অবোধ বালকের মত সম্মতিসূচক মাথা নাড়ে।
-খালি কিনলেত অইতনা, টাইম মত হেগোর খাওন-পানি যুগাইতে অইবো।
-অবশ্যি...অবশ্যি...
মন্তু প্রাজ্ঞ কৃষকের মত মাথা নাড়ে। আসলে সে ভিত্তে-ভিত্তে পুরা প্রস্তুত; এখন শুধু ছোবলের ক্ষেত্রটি তৈরি করতে তাকে যা মুখ-চবলাতে হচ্ছে।
-অ-কানাই দুইডা চা দেচা। রইদে বইবানি মন্তু, রইদডা বড় মজার।
হবিবুল্লার কাছে তামাম দুনিয়াটাই মজার। দামি সোয়েটারটা সে হাতে তুলে নেয়, যেটা চুল কাটার আগেই সে খুলেছিল। ওর খাবলা-ধরা কালচে আঙুলে সোয়েটারটার রঙিন চেকনাই ঝলক দেয়। কত আর হবে, এই সাত-আট সাল আগেও হবিবুল্লা একটা মেইড়-ভাঙা চাষা ছিল, তারও আগে এই পিচ পথটা যখন আধা জংলা-গোপাট, তখন বালক মন্তুরা দুই মাইল দূরের চন্দ্রনাথ বিদ্যানিকেতনে যাওয়ার জন্য এই গোপাটে এসে মিলিত হতো। ঢ্যাঙা-লিকলিকে, ছেঁড়া-ময়লা পোশাক-পরা হ্যাবলা হইব্ব্যা চারপাশের জংলার হিয়াল-বান্দরের ডরে দলের মধ্যে থেকেও কেমুন ভ্যা-ভ্যা করতো। আর অহন...হবিবুল্লার বাড়িটা দালান হয়ে গেছে। মাঠে ফসলের মেলা জমিও কিনেছে; আর ইজ্জতটাই কি কারো চেয়ে কম?
স্টলের ঝাপের নিচের বেঞ্চিতে এসে ওরা রোদের দিকে পিঠ দিয়ে বসে। কচি ছেলের দুধ-দাঁতের কামড়ের মত অঘ্রাণের রোদ ওদের পিঠে তুরতুরি আরাম জাগায়।
-আপনের ছেলেগুলান খুব লায়েকমান।
মন্তু আলাপ জোড়ে। চোখে ভাসে তার নিজের আচুদা পোলা দুটোর মুখ। সর্বদিক দিয়ে একেবারে পয়মাল করে দিলো। সেই রাগেইতো মন্তু আর তেমন করে চাষ-বাস করে না। পেটের দায়ে আর বুড়িটার কুদাম-পাদামে ঘরে টিকতে পারে না বলেই তো সে হাল-গরু নিয়ে মাঠে নামে; না-হলে ঘুরে-ঘেঁটে বাকি জিন্দিগিটা কাটিয়ে দিতো।
-তোমার পোলা দুইডার খবর কী?
-না, আগের মতই। একটা পল্টিফার্মে আছিন, হেইহানত্তেই ছুরতুনের ছেমড়িডারে লইয়া ভাগছে।...অহন আর কোনো তত্ত-তালাশ জানি না। আর ছোট্ট পোলাডা কাঠের কাম ভালাই শিখছিল কিন্তুক কামের চে আড্ডাবাজিই বেশি পছন্দ।
-হ, বাজারেও হেরে বেশি বেশি দ্যাহি; তাইলে কাম করে কোন টাইমে?
হবিবুল্লা মন্তুর কথায় সাক্ষী দেয়। ফের আফসোসও করে: হেইডা আমারেও একটা শোকেস বানায়া দিছিন, জিনিসটা যা সুন্দর অইছে না। পোলাডা যুদিন ঠিকমতন কাম করত...
তারা এখন চায়ে চুমুক দিয়ে চুক-চুক করে স্বাদ নিচ্ছে। গরুর চানার মত লেশমা-লেশমা শেষ বাজারের কড়া চা। আপাত এই পান নীরবতায় উলটা দিকের ফোনের দোকান থেকে একজনের রাগী গলার হাক-ডাক তাদের মাঝে বারবার হামলে পড়ে। মন্তু আন্দাজে ধরে নেয় লোকটা ফোনের ওপাশের মানুষটাকে খুব নিচ্ছে। অপরিচিত সেই ব্যক্তির নাজেহাল চেহারাটা যেন সে দিব্যি দেখতে পাচ্ছে। পোলা দুটোর জন্য সেও কি কম ভুগতেছে। যত মারো কাটো মন্তু কিন্তু পিটপিট করে হাসবে, আর সুবিধা মত ছোবল দেবার জন্য ভিত্তে-ভিত্তে দাঁত ধারাবে। যতদিন না কাম হাসিল হবে ততদিন সে শিকারের পেছনে নিষ্ঠাবান তাপস।
হবিবুল্লা কাপটা ঠাস করে নামিয়ে রাখে। মন্তু চমকে ওঠে। লোকটা কি হুদাহুদিই গরম হয়ে যাচ্ছে? মালধার মানুষের মতিগতি আন্দাজ করা শক্ত।
যেই কথা, সেই কাজ।
হবিবুল্লা বিষাক্ত গলায় বলে, তুমিই পোলা দুইডারে নষ্ট করছ। বাপ হিসাবে তুমি কি শাসনডা করলা। ডাক-ডাক করতে-করতে হেরা পয়মাল হয়ে গেলো। মন্তুর মাথাটা ঝিমঝিম করে, চোখের সামনের সবকিছু কেমন ঝাপসা হয়ে আসে।
-বাদ দেন, বাদ দেন, হেই চেট-মুইক্ষ্যা পোলাগর কথা। আফনার নিজের আলাপ করেন, হুনতেও সুখ। হুনলাম আফনের ছোডো পালারে নাকি ঢাকায় শাদি করাইছেন।
ছোট্ট পুত্রবধুর মিষ্টিমুখ আর বেয়াইয়ের ছবির মত ঝকমকা দালানটার কথা মনে হতেই তৃপ্তির ঢেকুরে হবিবুল্লা শীতল হয়ে আসে। তার ঘাড়ের চর্বির মোটা ভাঁজটি তেল-ময়লাসহ রোদের জেল্লায় চকচক করে ওঠে। মন্তুর ইচ্ছা হয় প্রকাশ্যেই সেখানে দাঁত বসিয়ে দিতে। হবিবুল্লার মুখের পান-সুপারি যুত হয়ে এলে সে পকেট থেকে সিগারেট-ম্যাচ বের করে ধরানোর উজ্জুগ করে।
-হ, হেরা খুব মালদার পাট্টি, হেদের তুল্যে আমি কিচ্ছু না, কিন্তুক আমার পোলারে তারা খুব পছন্দ করছে, হেই ভরসাতেই কামটা সামুটতা পারছি।
-আর বড় দুই জনরে?
মন্তু একটু-একটু করে লক্ষ্যের দিকে এগুচ্ছে।
-বড় দুই ছেলে সামনের সন বাড়িৎ আইলেই...
-হেই দেশটা খুব ধনি মাইনষের, না?
-তুমি যে কি কও, ধনি না হইলে কি আর হেরা সখ কইরা বিদেশতে মানুষ নেয়।
-অইবো...অইবো...।
মন্তু আমতা-আমতা করে আর পিট-পিট করে হাসে। এই হাসিটা তার আসল অস্ত্র। পায়ে উস্টা দিয়ে ফেলে দিলেও ঐ হাবড়া মুখটা থেকে হাসিটা মুছে ফেলা যায় না।
-তে আফনের বড় মেয়ের জামাইয়ের খবর কী?
এই কথায় হবিবুল্লা বজ্ররাহতের মত নির্বাক চেয়ে থাকে।
তার বড় মেয়ের জামাই এখন কারাগারে। বিডিআর বিদ্রোহের অভিযোগে বন্দি। বড় কঠিন বিচারের সন্মুখীন। হবিবুল্লার খাড়া মাথাটা ঝপাস করে বুকের কাছে নুয়ে পড়ে। তার ঘাড়ের মোটা-গম্ভীর ভাঁজটি কেমন মেন্দা মেরে যায়। মন্তু নিজেকে দিয়ে বোঝে, বাপ সন্তানের জন্য কতটুকু দরদ রাখে। হবিবুল্লার সেই গোপন জাগাটার খবর পাওয়া তক্ তার দাঁত শিরশির করছিল। দুই-তিন মাসের মধ্যে এমন বড় শিকার সে ধরতে পারেনি। কষ্ট ছাড়া তার জীবনে আর কিচ্ছু প্রাপ্তি নেই। তার সব গোল্লায় গেছে। দিনে দিনে বুড়ি মাগিটা একটা ঝগড়াটে শাকচুন্নিতে পরিনত হয়েছে। যা কিছু জমি আছে, তাও উপযুক্ত চাষ ও যত্নের অভাবে তামা হয়ে গেছে। কিছু না দেখে, না-পেয়েই সে ফিরে যাবে এটা সে মানতে নারাজ। তাই মুফতে যা মিলে তাতেই সুখ, আর সেটুকুই তার সব না-পাওয়ার পাওয়া।
-তে কইলেন না জামাইয়ের খবর কী?
যুশ-রোষহীন হবিবুল্লা মরা শরীরটা যেন পাথরের মত টেনে তুলে দাঁড়ায়। কাউকে কিছু না বলে নুয়ে-নুয়ে বাড়ির পথ ধরে। চরম প্রশান্তির মাঝে মন্তুর খুব শখ হয় একবার ডাক দিয়ে হবিবুল্লাকে জিজ্ঞেস করে, 'এই মিয়া সাব কিছু হারাইছেন নাকি?' কিন্তু তার পিছনে একটা জিপের কেচ্ করে ব্রেক কষার শব্দে সে ফিরে তাকায়। হাতে দড়ি, হ্যান্ডকাপ আর তেল-তেলা রুল নিয়ে কয়টা পুলিশ জিপ থেকে নামছে। একজন তার দিকে কড়া চোখে চেয়ে জিজ্ঞেস করে, হালিমের বাপ মন্তুর বাড়িটা কোন দিকে বলতে পার? মন্তুর মুখে তৃপ্তি জড়ানো চিল-বিল হাসিটি তখনো লেগে আছে; সেই হাসি নিয়েই ভয়ে-ভয়ে সে উল্টা প্রশ্ন করে; কেন...।
খাটো কিন্তু ধামার মত ভটকা যে লোকটা একপাশে দাঁড়িয়ে তাকে নীরবে পরখ করছিল, সে বলে--কেন, জানসনা? বাইনচুদটারে শ্বশুর বাড়িত নিতাম দাওয়াত খাওয়াইতে, খানকির পুত ক্যাশবাক্স ভাইঙ্গা ট্যাহাও নিছে, লগে কামের ছেমড়িডারেও নিছে।
মন্তু একনিমেষে সব বুঝে নেয় আর চিনে নেয় তার পোলার পল্টিফার্মের মালিককেও। কিন্তু সে নির্বিকার ভাবে বলে, কী যে কন পারতামনা ক্যা, আইয়েন হালিমের বাফের বাড়িডা দ্যাহায়া দিতাছি।
মন্তু সবার আগে ঝুলতে-ঝুলতে হাঁটে, আর তার পেছনে কয়জোড়া প্রশিক্ষিত পা ভারি বুটের মচমচ শব্দ তুলে হালিমের বাপ মন্তুর বাড়ির দিকে এগিয়ে যায় তাদের শিকারটি হস্তগত করার জন্য।
লেখক পরিচিতি
শেখ লুৎফর
জন্ম ১৯৬৬ সালে ময়মনসিংহের গফরগাঁও। পেশায় শিক্ষক শেখ লুৎফরের বর্তমান নিবাস সুনামগঞ্জ জেলায়। দুটি গল্পগ্রন্থ প্রকাশ পেয়েছে, 'উল্টারথে' এবং 'ভাতবউ'। উপন্যাস 'আত্নজীবনের দিবারাত্রি'।
0 মন্তব্যসমূহ