খোলা বারান্দা। লাল রঙের মেঝে, সাদা থামের পাশে বসে আছেন বাবা। গায়ে হাফহাতা গেঞ্জি। হেলান দেননি। মেরুদন্ড সোজা। ভর্ৎসনার দৃষ্টিতে চেয়ে আছেন আমার দিকে। চতুর্ভুজ মেঝেতে কালো সীমানা আঁকা। চোখে আর কিছু পড়ছে না। মাথা নীচু। বাবা আর আমার চারপাশে বাড়ির সমস্ত সদস্যের ভীড়। কাঁদছি না। তবু দু’চোখ জলে ভরে আসছে। ধীরে ধীরে বাবা অস্পষ্ট ঝাপসা হয়ে যাচ্ছেন। শুনতে পেলাম, অনেক দূর থেকে বলছেন –মেয়ে তুমি ঠিক করেছো। বিয়ে করতেই পারো। ।
সকালের রোদ্দুর, তেরচা হয়ে পড়েছে বাবার গায়ে, অর্ধেক পড়েছে উঠোনে। পুরো রোদ্দুরে আমিই ডুবে আছি। বাকিরা আধা খামচা। একটু আগে ছোটোপিসি উঠোন ধুয়ে গেছে। ভিজে উঠোন রোদ্দুরে ঝিলিক দিয়ে উঠলো।
বাবা বলছেন - বিয়ের ব্যবস্থা তোমাদের দু’জনকেই করতে হবে। বিয়ে আমি দেবো না।
ছোটোপিসি এক বালতি জল আর ঝাঁটা নিয়ে ঘরে যাচ্ছিলো। পা পিছলে পড়ে গেলো উঠোনে। বালতির জল লাফিয়ে উঠলো। আমি আর পিসি ভিজে গেলাম। পিসি আমাকে খুব ভালবাসে। খ্যাংরাকাঠি ফুটে গেলো পিসির পায়ে। আর্তনাদ করে উঠোলো। মা কলতলায় দাঁড়িয়ে আড়ে আড়ে শুনছিলেন, দেখছিলেন। পিসিকে তুলতে কেঊ এগিয়ে গেলো না।
ওখান থেকে তীব্র স্বরে মা বলে উঠলেন –কানার মরন। দেখে পা ফেলতে পারো না! বালতিখানা আস্ত থাকলে হয়।
উঠোনে আমার পা পুঁতে গেছে। সমস্ত শরীর ভারী লাগছে। ইচ্ছে থাকলেও তোলার ক্ষমতা নেই। সকলের সামনে পিসি নিজেই উঠে দাঁড়ালো। তখন একটু হলেও বুকের মধ্যে বাতাস সহজ হলো। পিসি জোর আঘাত পেয়েছে। কষ্টে ঠোঁটদুটো মুখের ভিতর ঠেসে ধরেছে। পিসির চোখে জল! কি জানি, বালতি থেকে ছিটকেও লাগতে পারে।
বাবা আরো বললেন – বিয়ে বাড়িতেও করতে পারো। কাকা পিসিদের যেমন জমজমাট বিয়ে দিয়েছি, অমন জাঁক করতে হবে। বাড়ির মান-সম্মান খোয়াতে পারবো না। পয়সা কড়ি দেবো না। বিয়েতে থাকবোও না। যদি খরচা করতে না পারো, রেজিষ্ট্রি পারো, কালিবাড়ি পারো, যেখান থেকে খুশি সিঁদুর পরিয়ে এসো দেখতে যাবো না। মেয়ে ঘরে তুলে নেবো। মেয়ে আমার পছন্দ।
বালতি ঝ্যাঁটা গুছিয়ে পিসি মায়ের আড়ালে আশ্রয় নিলো।
মনে মনে উত্তর দিলাম –মাইনের সবটাই সংসারে ধরে দিই। হাত খরচের টাকা দিয়ে জাঁকিয়ে বিয়ে হয় না।
মুখে কিছু বললাম না। বলার স্পর্ধা নেই। অফিসের ট্রেন ধরতে বেড়িয়ে পড়লাম। মাকে বললাম –আসছি।
যেখানে দাঁড়িয়ে ছিলাম, ছোটোকাকার বিয়েতে প্যান্ডেলের ভার রাখার জন্যে একজোড়া বাঁশ ওখানে পোঁতা হয়েছিলো। তখন সবে কিশোর। তখনও আমি হাফপ্যান্ট। রান্নাঘর থেকে ছুটে বেরুবার মুখে জোড়াবাঁশে ঠোক্কর খেয়ে বাঁ চোখের ভ্রু কেটে রক্তারক্তি কান্ড।
মা বলেছিলো – শুভকাজে ছোটোখাটো রক্তপাত, ভালো লক্ষণ।
বাঁ দিকের ভ্রুতে দু’ফাঁক কাটাদাগটা এখনো আছে কিনা, দেখার জন্যে হাঁটতে হাঁটতে কপালে হাত তুললাম। দেখতে চেয়ে ছিলাম, খ্যাংড়া ফুটে ছোটোপিসির কতোখানি লেগেছে। পুরনো ব্যথা বুঝি ফের জেগে উঠলো। কাটা জায়গাটুকু নিজের অজান্তেই হাত বুলোচ্ছিলাম।
বাবা সৃজাকে পছন্দ করেন। ডাকেন –ঝুম। ওর ডাক নাম। ঝুমের পায়ে বাবার দেওয়া নুপুর সারা বাড়িময় বাজে। ঝুম ঝুম, ঝুম ঝুম। বাবা আমাকে পছন্দ করেন না। ঝুমকে করেন। আমি তাতেই খুশি। মা আমাকে পছন্দ করেন। ঝুমকে করেন না। আমার কষ্ট হয়। সৃজা মানে ঝুম আমার কাছে পড়তে আসে সকাল বেলা। পড়া হয়ে গেলে বাবার চারপাশে ঘুর ঘুর করে। মা ওকে তীব্র অপছন্দ করেন। তবুও জানিনা কেনো, হয়তো আমাকে ভালবাসেন বলে। গরম গরম ফেনাভাত, মাখন, আলুশেদ্ধ মেখে ঝুমকে খাইয়ে দেন। ঝুমের বাবা গরীব। হয়তো দয়া করেন। মা খুব দয়ালু। তবু মনে মনে সহ্য করতে পারেন না। বিয়ের পরের কথা ভাবলে আমার দুশ্চিন্তা হয়। ভয় করে।
তবু বাবা বিয়ের অনুমতি দিয়েছেন। অফিস থেকে ফেরার পথটুকু পড়ন্ত কনেদেখা আলোয় খুশিতে ভরে থাকে। নরম রোদ্দুর আদুরে বাতাসে অশত্থের মগডালে ঝিলমিল খায়। অফিস ফেরত বাড়ির পথ ধরেছি। পথ গিয়েছে বাড়ি হয়ে ঝুমের দরোজায়। আলো নেই, ছায়া নেই, নিভন্তবেলা ছড়িয়ে পড়ে আছে পাড়াময়। পথের ধারে সবুজে সবুজ মাঠ। বালক বালিকারা খেলছে। বালকদের পা থেকে বল ছুটে পালিয়ে গেলো রাস্তার ওপারে। ঠিক আমার পায়ের নাগাল পেরিয়ে। ইচ্ছে থাকলে থামাতে পারতাম। আমার নিমগ্ন উদাসীনতায় বল চলে গেলো রাস্তা পেরিয়ে, আশশেওড়ার জঙ্গলে। ছুটন্ত পায়ে পথ বেঁধে হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেলো যে বালকটি, তাকে আমি চিনি। ওর নাম খুদে। খুব বদমাস। ঝুমেদের পাশের বাড়ির ছেলে। বদমায়েসির শাস্তি দিতে একরাশ অবহেলা আমাকে পেয়ে বসলো। ওকে তুলিনি। ওকে তুলবো, সেই অপেক্ষায় শুয়ে থাকার ছোকরা ও নয়। পথের উপর মুখথুবড়ে পড়া খুদে টুক করে উঠে দাঁড়ালো। নিজের হাঁটু দেখলো। ছাল-চামড়া উঠে গেছে। রক্ত-মাটি মাখামাখি। ঘাড় ঘুড়িয়ে আমার দিকে তাকিয়ে ফিক করে হাসলো। দু’হাতে রক্ত-ধুলো ঝেড়ে বলের পিছনে ছুটলো। যেনো কিছুই হয়নি। কিন্তু রক্ত পড়ছে আমি দেখেছি।
আমি জানি, ও কেনো হাসলো। ওর পড়ার জানালার উল্টোদিকে ঝুমের ঘর। ঝুমের জানালা খোলা থাকে। ঘর অন্ধকার রেখে শয়তান খুদে চুপিচুপি একচিলতে জানালা খোলে, ছোট্ট ফাঁকে চোখ রেখে, ঝুমের জানালায় পর্দা টানা থাকলেও, ওৎ পেতে বসে থাকে। বাতাসের ফাঁক গলিয়ে কিংবা পর্দা ভেদ করে দেখে, আমি ঝুমকে অঙ্ক শেখাবার অছিলায় কখন আদর করি।
একদিন পথে পাকড়াও করেছিলাম। বলেছিলো, ওর দিদিকে গান শেখানো হয় না। কারণ, গানের মাষ্টারমশাইরা গান শেখাবার সময় মেয়েদের গায়ে হাত দেয়। গানের মাষ্টাররা খারাপ লোক। অঙ্কের মাষ্টাররা ভালো। তারা এসবকিছু করে না। এ পাড়ার গুডবয়, আমি নাকি এর উদাহরণ। এসব করতেই পারি না। জিজ্ঞেস করেছিলাম –কে বলেছে?
খুদে বলেছিলো –মা।
-তুই খারাপ কাজ দেখিস কেনো?
-সত্যি কিনা, মা দেখতে বলেছে।
-সত্যি?
খুদে মাথা নিচু বলেছে –সত্যি, না না সত্যি না।
মুখ লুকিয়ে, ঘাড় কাত করে আমার দিকে তাকায়। আমি তখন ক্রুদ্ধ চোখে ওরদিকে তাকিয়েছিলাম।
প্রায় কেঁদে ফেলে বলেছে –দেখতে আমার ভাল্লাগে।
-ফাজিল ছোকরা কোথার। এবার দেখবিতো তোর বাবাকে বলে দেবো।
ফাজিল ছোকরা বল নিয়ে ফেরার পথে এই জন্যেই মাথা নিচু করে চলে গেলো। একটুকরো খোয়া, যাকে বলে পথের কাঁটা, ছুটন্ত পায়ের ধাক্কায় যে খুদেকে উল্টে ফেলেছে, নিচু হয়ে সেটা তুলে ফেলে দিলাম দূরে।
ঠিক তখনই দেখতে পেলাম, আমাদের বাড়ির দোতালায় গোলমিটিং বসেছে। বারান্দা জুড়ে খুড়তুতো বোনেরা, নিজের বোন, পাড়ার দু’চার জন মাতব্বর বৌঝিরা মিলে গম্ভীর আলোচনায় ব্যস্ত। ওদেরদিকে পিছনফিরে ঝুম দাঁড়িয়ে আছে কার্ণিশে। ঝুম আজ সাদা ভয়েলের কালোচেক শাড়িখানা পরেছে। ওকে বেশ লম্বা দেখাচ্ছে। ওদের, মানে, ওর আর ওর মায়ের বাইরে পরার একখানায় সাধারণ শাড়ি। সেটাই পরে এসেছে। সাধারণত ও প্যান্ট-শার্ট পরে। দু’জোড়া প্যান্ট-শার্টে ভাই-বোনের দিব্যি চলে যায়। তখন ওকে আরো লম্বা লাগে। একফালি তলোয়ারের মতো দিনের বিশেষ আলোয় ওকে সুন্দর দেখাচ্ছে। আলসের গায়ে একটু ঝুঁকে আছে। মনে হলো, আলোর মগডালে আকাশের কাছাকাছি দাঁড়িয়ে আছে। এখুনি উড়ে যাবে।
সিঁড়ি বেয়ে দোতালায় ওঠার সময় কান খাড়া রেখেছিলাম, গোলমিটিংএ কী কী খারাপ কথা ওকে শোনানো হয় জানার জন্যে। ঝুম এসময় আমাদের বাড়ি আসে না। আমি নিশ্চিত, ওকে ডেকে আনা হয়েছে। মা’র দেওয়া সাহসে ওকে আকথা কুকথা শোনানো হচ্ছে। মিটিংএ পাশের বাড়ির কাকিমার গলা শুনতে পেলাম –পাড়ারমুখে আর চুন-কালি মাখিও না। হয় বিয়ে করো, না হয় মানে মানে সরে দাঁড়াও।
হাঁড়ি আলাদা, তবু ছোটো কাকিমা বললেন –ছেলে আর ফেলে রাখবো না। তোমার মা-বাবার যদি সময় না থাকে বলুক, অন্য মেয়ে দেখি।
তখন সত্যিই সিঁড়ির নীচে পড়ে আছি। ওঠার ক্ষমতা নেই। বাড়িতে আমি যেনো অপাঙক্তেয়। আমার অস্তিত্ব লুটপাট হয়ে গেছে। পা অসাড়, ভারি। ওদের পাশ কাটিয়ে ঘরে ঢুকতে হবে। আমাকে দেখলে না জানি, মুখের ধার কমে টেপাঠোঁট আর চোখের তীক্ষ্ণতা কতগুন বেড়ে যায়!
ওদের আকথা কুকথা অন্তত বন্ধ করা দরকার। এই কারণে আমাকে উঠতে হবে। ওঠার প্রস্তুতি নিচ্ছি। আঁচলের খুঁট মুখে ঝড়ের গতিতে নেমে আসছিলো ঝুম, আমাকে দেখে একপলক থমকে দাঁড়ালো। চোখে চোখ রাখলো। চোখ দুটো জলে ভরা। চোখের কোল গড়িয়ে নেমেছে অশ্রুর দাগ। কিছু বললো না। যেমন নামছিলো, ছুটে পালিয়ে গেলো। উঠোনে ওর মিলিয়ে যাওয়া চটির শব্দ পেলাম।
জামা-প্যান্ট ছাড়তে ছাড়তে ভাবছিলাম, সৃজাকে কতক্ষণ ডেকে আনা হয়েছে? তখন আমি কোথায়? ট্রেনে? স্টেশানে? নাকি পথে? কতক্ষণ ওকে আটকে রেখে কাঁদানো হচ্ছে? জানি, এ সবই মা’র ইন্ধনে। ছোট্টবেলা থেকে মা সৃজাকে স্নেহ করেন, ঘরে-দোরে সে বাড়ির মেয়ের মতো পায়ে পায়ে ঘুরে বেড়ায়। ভুল করলে বকেন। কাঁদলে মাথায় হাত বুলিয়ে দেন। খিদে পেলে খাইয়ে দেন, উলুডুলু, চুল ছাড়া থাকলে বেঁধে দিতেও দেখেছি। রাগ করে বলতে শুনাছি –চুলনা তো শিবের জটা। ঝিটকি টেনে দেবো ছিঁড়ে। তোর মায়ের একটু তেলও জোটে না।
যেদিন জেনেছেন, আমার প্রেমিকা, সেদিন থেকে আর সহ্য করতে পারেন না। কী এমন মহাভারত অশুদ্ধ হলো, এই একটা মাত্র খবরে!
তারপরও বাবা ওকে পছন্দ করেন। বাবার এই শত্রুতাও মায়ের সহ্য হচ্ছে না। স্নেহ-মমতা সব উড়ে গেলো!
এতো দিন বুকে পুষে রাখা মেয়ে শত্রু হয়ে যায়, এ কেমন মমতা?
ঘরের বাইরে এসে, আলসেয় মুখ রেখে চিৎকার করে বললাম –মা, খেতে দাও, পড়াতে যাবো।
ঝুমকে নিয়ে কষ্ট হলে এটুকুই বলতে পারি। পড়াতে যাবো মানেই ঝুমদের বাড়ি যাবো।
মায়ের প্রতি, এ বাড়ির প্রতি, এটুকুই আমার রাগ, অভিমান, প্রতিশোধ। আলসের হাতলে সেই তলোয়ার মাখা রোদ্দুর আর নেই। খুব তাড়াতাড়ি সন্ধের আধাঁর এসে দাঁড়িয়েছে । মনে হলো, সন্ধের আধাঁর নয়, ঝুমের ছায়া। এখনো দাঁড়িয়ে কাঁদছে ।
বাড়ির মেয়েরা আজ যে দূর্ব্যবহার করেছে লজ্জায় মুখ পুড়ে আছে। কোন আনন্দে যাবো সৃজার কাছে! সে শক্ত মেয়ে। অভাবের আগুনে পুড়ে নিখাদ নিটুট। আমাদের বাড়িকে অপমান ফিরিয়ে দিতে পারতো। দেয়নি। আমাদের প্রেমই তার কারণ। আমি জানি, ঘরে ফিরে দরোজা বন্ধ করে কাঁদছে। আজ গেলে দরোজা খুলবে না। যদি খোলে, অঙ্ক শেখাবার সময়, কিছুই বলবে না। নিঃশব্দে কেবলই অঙ্ক কষে যাবে। অনর্গল কষে যাবে। ভুল হলে বারবার চেষ্টা করবে। আমাকে বলবে না। আমি জানতেও পারবো না ভুলের মাহাত্ম কোথায়! ওর সামনে চেয়ারে বসে নিজেকে, অসহায়, দুর্বল একা মনে হবে। আদর পর্যন্ত হাতে উঠবে না। ঝুম প্রস্তুত হয়ে আছে, এভাবেই কষ্ট দেবে আমাকে। বুঝবে না, আজ ও কিছুতেই বুঝবে না। আর ঝুম অবুঝ হলে, আমার অপরাধ বোধ আরো বেড়ে যায়।
এই শহরে আমার দ্বিতীয় প্রেমিকার নাম শ্রীমতি। আমি তখন শ্রীমতির কাছে যাই। সন্ধ্যায় শ্রীমতি এক স্নিগ্ধার নাম। এক প্রশান্তির নাম। আমি তার পাশে বসি। সে আমাকে ভাসিয়ে নিয়ে যায়, সমুদ্রের দিকে, আকাশের দিকে। তার অন্যনাম ইছামতি। ‘সৃজা’ উচ্চারণের ‘শ্রী’ টুকু নিয়েছি। ইছামতির ‘মতি’তে মিশিয়ে নাম দিয়েছি শ্রীমতি। সে তাতেই খুশি। তার জল থেকে উঠে আসে শীতল বাতাসের হাত। সে আমাকে আদর করে। ভালবাসে। দুঃখ ভুলিয়ে দেয়। আমাকে সৃজার কথা বলে। অনেক রাত পর্যন্ত আমরা দু’জন কথা বলি। কথা বলতে বলতে ভুলে যায় আমাদের কথা। বলি, শুধু সৃজার কথা, সৃজাদের কথা। কথাদের সৃজারা যখন শান্ত হয়। আমার প্রতি প্রসন্ন হয়। অপরাধবোধ জল হয়ে আসে। মিশে যায় শ্রীমতির বুকে। শিয়রে তখন জেগে থাকে কৃষ্ণা তৃতীয়ার চাঁদ। শ্রীমতির মুখে কুচিকুচি ঢেউ, আবছায়া হাসে। তার কুলুকুলু শব্দ শোনা যায়। অনুভব করি, শ্রীমতির বুকে জোয়ার এসেছে।
অপরাধবোধ নরম হয়ে আসে। ভেসে যায় হৃদি ইছামতিমূলে।
দূরে শ্রীমতির শরীরে যেখানে বাঁক, ওই শহরের দিকে , নদীর পাড়ে সৃজাদের বাড়ি। এখান থেকে দেখা যায়। খোলা চতুর্ভূজ জানালায় একজোড়া চোখ জেগে আছে। আলো জ্বলছে। ওই আলোয় বসে সে অঙ্ক কষে। গভীর রাত পর্যন্ত বই পড়ে। যখন সে মনোযোগ দিয়ে কিছু করে, খুব সিরিয়াস। মনে হয়, ওর আসল নাম সৃজা। যখন হেসে ওঠে, কেঁদে ফেলে, ওকে ছুঁতে পারি, আদর করি, হয়ে ওঠে আমার একান্ত ঝুম। আজো কি পড়ছে! না, পড়ার ভান করে আলো জ্বেলে অপেক্ষা করে আছে ‘কেউ আসবে’। অপেক্ষায় কে আছে আছে ঝুম, না সৃজা? সৃজা না ঝুম? নাকি ঝুম আর সৃজা মিলে মিশে দূর্বোধ্য কেউ, যাকে আমি চিনতে পারি না, বুঝতে পারি না, ভয় পাই।
তখন চেয়ে থাকি ওই আলোর দিকে। রাতের আকাশে ওই আমার ধ্রুবতারা। জানি, তখন সে কাঁদে। জানালার দৃশ্যপথে ধ্রুবতারার অশ্রু নেমে আসে শ্রীমতির বুকে। উজানে বয়ে আসে চোখের জলে ভিজে যাওয়া অঙ্কের সংখ্যারা। ভেসে যায় হৃদি ইছামতিমূলে। স্পষ্ট দেখি, ভুল যোগ, ভুল গুনে ভরে আছে অঙ্কের শরীর। ভেসে যায় খোলা ভূগোলের পাতা, ইতিহাস বই, মনে পড়ে, রবিঠাকুরের কবিতাখানা ‘যখন যেমন ইচ্ছে করি, তাই হতে পাই যদি, তবে আমি এক্ষুণি হই ইচ্ছামতি নদী.. ..
কান্নায় গড়া শ্রীমতিও সৃজার মতো। চোখের জল সহ্য করে না। আমাকে একা করে দেয়। কিছু বলে না। নিশ্বাসে প্রশ্বাসে বাতাস স্থির হয়ে এলে, তার নিস্তব্ধ গাম্ভীর্য আমাকে বসিয়ে রাখে বুকের নিস্পন্দ কিনারে। নিস্প্রভ হয়ে আসে আকাশের তারা। জ্যোস্না করুণ হয়। আমি মানুষ। প্রেমিক আমি। একাকীত্ব সহ্য করি না। মনুষ্যত্বের অহংকার আহত হলে উঠে পড়ি। রাত্রি আরো নিস্তব্ধ হয়। অস্থির লাগে। অন্তরঙ্গতার খোঁজে এগিয়ে যাই। হাঁটতে শুরু করি, অন্য এক রমনীর দিকে। এই শহরের হৃদপিণ্ড বরাবর আর এক প্রেমিকা আছে আমার। ভীষণ খোলা মেলা। তার কাছে উদারতা শিখি। তার বুকে আশ্রয় নিলে ভুলে যাই দুঃখ, ব্যথা, যন্ত্রণা। সে আমার একাকীত্ব ম্লান করে দেয়। অন্যতমা সে প্রেমিকার নাম বনশ্রী। আমারই দেওয়া নাম। আমিই আদর করে ডাকি শ্রী।
ইছামতি নদীর পাড় ধরে হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছে যাই শহরের পথে। আমি তখন শ্রীর খুব কাছাকাছি এক স্ট্রিটল্যাম্পের নীচে দাঁড়িয়ে। ধোঁয়াশা ভেদ করে আলো নেমেছে। রাত ভারি হয়ে এসেছে । সারি সারি দোকান-পাট বন্ধ। কিছুকাল আগে শহরে বুলডোজার ঢুকেছিলো। রাস্তার দু’পাশে বে-আইনি দখল মুক্ত হয়েছে। ফুটপাথ জুড়ে সারি সারি দোকানের কিছু ধ্বংশস্তুপ এখনো পড়ে আছে। একটা নেড়িকুত্তা ঘুমাইনি। শুঁকে শুঁকে ধ্বংশস্তুপে কিছু খুঁজছে। তার ছায়া কখনো লম্বা, কখনো চিঁড়েচ্যাপ্টা, কখনো বেঁকেচুরে কুন্ডলি পাকানো মানুষের আকার নিচ্ছে। রাতেরবেলা মানুষেরা খোয়াব দেখে। আমিও দেখছি। অনেক সময় তাকিয়ে থাকার পর বুঝলাম ওটা নেড়িকুত্তা নয়, একজন উবু হয়ে বসা মানুষ। কিছু খুঁজছেন। দোকানঘরের ভাঙা ইট, টুকরো
সিমেন্টের দলা হাত বুলিয়ে বুলিয়ে দেখছেন। দোকানের দেওয়ালে গোপন কুঠুরিতে কেউ কেউ সোনা-দানা, দামি কিছু লুকিয়ে রাখেন। দোকানঘর ভাঙার আগে মানুষটা সে সব হয়তো বের করে নিতে পারেননি। ভাঙাচোরা চুকেবুকে গেছে অনেকদিন হলো। ফুটপাথে যাদের দোকান ভাঙা পড়েছে, তারা মরা গরীব। তাদের দোকানটুকুই সার। কী আর থাকতে পারে! ধ্বংবশেষের নীচে। কী খুঁজছেন উনি? আগ্রহ নিয়ে মানুষটির দিকে এগিয়ে যাই। মানুষটি উঠে দাঁড়ালেন। চিনতে পারলাম, উনি সৃজার বাবা। বৈজুকাকু। পাঁচফুট আটইঞ্চি লম্বা। দোকান ভাঙার পর বুড়িয়ে বেঁটে হয়ে কেমন সন্ন্যাসী গোছের হয়ে গেছেন। উদাসীন। নীচের বোতাম খোলা ফ্লায়িংশার্ট। বাতাসে উড়ছে। ইস্ত্রী করা প্যান্ট ঢলঢলে পাতলুন হয়ে গেছে। নির্নিমেষ চেয়ে আছেন ধ্বংশস্তুপের দিকে। বিরল দু’একগাছি মাথার চুল লিক লিক করে উড়ছে। ছেলে-মেয়ে আর দোকানঅন্ত জীবন মানুষটার। মেয়ের নাম সৃজা, দোকানের নাম রেখেছিলেন সৃজান।
দোকান আগে। মেয়ে বড়ো হলেও সৃজানের চেয়ে বয়সে ছোটো। সৃজান তাঁর জেষ্ঠ সন্তান। ওকে খুঁজছেন। ভালবাসা মানুষকে চিনতে শেখায়। সৃজাকে ভালবেসে বুঝতে পারি, ভ্যাবলা হয়ে আসা ওই মানুষটা আস্তপ্রেমিক। ভালবাসেন একখণ্ড বায়বীয় শুন্যস্থানকে। ওইখানে দাঁড়িয়ে ছিলো সৃজান। এখন কেবল শূণ্যতা, কেবল হাহাকার।
আমার সৃজা আছে, শ্রীমতি আছে, শ্রী আছে। ওনার সম্বল ওই বায়বীয় স্থানটুকু। আমার দেখা একজন শ্রেষ্ঠ প্রেমিক। উনি এখন সৃজানের স্মৃতিতে মগ্ন। দূর থেকে ডাকি না। যদি প্রেমের মগ্নতা ভেঙে যায়। ভাঙা সিমেন্টের টুকরোয় দাঁড়িয়ে আছেন। যদি টলে পড়ে যান? কাছে যাই। পায়ের শব্দে জেগে ওঠেন। মৃদু স্বরে ডাকি
–-কাকু।
যেনো অনেক দূর থেকে শুনেছেন। উনিও আমাকে চেনার চেষ্টা করেন।
-ভাঙা ইট-পাটকেলের উপর দাঁড়ানো যায়! পড়ে যাবেনতো। নীচে নেমে দাঁড়ান।
-ও, তুমি! তা এখন? সব মঙ্গলতো!
-আমিও খুঁজতে বেরিয়েছি।
অশ্বত্থামা হত ইতি গজর মতো বললাম, যেনো ওনাকেই খুঁজছি।
বললাম –অনেক রাত হয়েছে। চলুন। আপনার সাইকেল কৈ?
বুলডোজার এক থাপ্পড়ে গুটিয়ে একটা দোকানকে বোঁচকা বানিয়ে দিয়েছে। অন্ধকারের এককোনা থেকে বোঁচকা পেছনে সাইকেলখানা বেরিয়ে এলো।
-কেনো, বাবা? আমিতো রোজই সৃজানকে একবার দেখতে আসি।
দু’জনে একই পথের পথিক। যশোহর রোডের ফুটপাথ ধরে পাশাপাশি হাঁটি। দুই প্রেমিক। কাকু সাইকেল হাতে হাঁটছেন। আমি শ্রীর বুকের পাশ দিয়ে হেঁটে চলেছি। অনুভব করছি, তাঁর বুকের স্পন্দন। বিস্তীর্ণ উদারতা। উদাসীনতা। আমার তৃপ্তি কাকু অনুভব করতে পারছেন না। সৃজানের দুঃখ ভোলার জন্য কাকুর আর একজন প্রেমিকা থাকা উচিত। উনি নিরীহ, প্রাচীন রীতিতে একক প্রেমে বিশ্বাসী। প্রেম নষ্ট হয়ে গেছে। কষ্ট ওনাকে ঘিরে আছে। ভোলার জন্যে কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই।
আমার তৃতীয় প্রেমিকা এই শহর, বনগাঁ। বনশ্রী, আমার শ্রী। সৃজা, শ্রীমতির সাথে আমি শ্রীকেও ভালবেসেছি, শ্রীর তারা ভর্তি আকাশ, আলো ভরা পথ, ধোঁয়াশার মৃদু রহস্য মেখে শ্রীর সঙ্গে হেঁটে চলেছি।
সাইকেলের পিছনে একবোঁচকা বই। বইয়ের ঝুল সামলাতে গিয়ে হঠাৎ পড়ে যাচ্ছিলেন কাকু। সাইকেলে ভর রেখে দাঁড়িয়ে গেলেন। আমি ধরতে যাচ্ছিলাম। উনি একাই সামলে নিলেন। একটু দাঁড়িয়ে, দু’জনে আবার চলতে শুরু করলাম। চুপচাপ। বড়ো একটা কথা কেউ বলছি না। হাঁটছি। সৃজানকে হারিয়ে কাকু ভাঙা সাইকেলখানাকে বোধ হয় ভালবেসেছেন। নিজেও জানেন না। প্রেমিক মানুষ নিজের অজান্তেও ভালবাসাহীন থাকে না।
মগ্নতার গভীর থেকে জিজ্ঞেস করেন –ইছামতির গভীরতা বলতে পারো?
প্রশ্নের তল খুঁজে পাই না। বলি –চল্লিশ পঞ্চাশ হাত হবে।
-মাঝে মাঝে ইচ্ছে হয়, ইছামতির গভীরে নেমে যাই।
ভয় পাই। অভাবের জ্বালায় উনি কি আত্মহত্যার কথা ভাবছেন? জিজ্ঞাসু ইচ্ছা নিয়ে নিশ্চুপ থাকি। নিস্তব্ধতার প্রশ্ন উনি বুঝতে পারেন। আর একবার সাইকেলের টাল সামলে, উত্তর দেন –তুমি বাবা দ্যাখোনি। ভাঙা দোকানের চুন বালি সিমেন্টের সাথে গাদা গাদা বই ময়লা ফেলা গাড়ি ভর্তি করে মাঝ নদীতে ফেলে দিয়েছে। শ’য়ে শ’য়ে বই ডুবে আছে ইছামতির গভীরে।
বইকে ভালবেসেই সৃজানের জন্ম দিয়েছিলেন। অন্যমনস্ক হয়ে খানিকক্ষণ পথ হাঁটেন। আবার বলেন –সৃজা বলে, বই নাকি ভেসে যায়। ও জানে না, বই জ্ঞানের আঁধার। কতো ভারি হয়। তুমি বাবা ওকে একটু বুঝিও।
আমি স্মৃতির ভাষাতেই বলি –কাকু, ও ঠিকই বলে। ইছামতি চোখের জলের নদী। চোখের জল বইয়ের চেয়ে ভারি হয়।
সৃজার বই, অঙ্কের খাতা, শ্রীমতির জলে ভেসে যায়। শ্রীর বুকে হাঁটতে হাঁটতে টের পাই চোখের জলের গভীরতা পাশে পাশে হেঁটে চলেছে।
কাকু বলেন – মেয়েটা আর কতো কাঁদবে? চোখের জলে আর কতো বই ভাসবে, বলো? পেট ভরে খেতে পেলে ছেলে-মেয়েদুটো বই মাথায় করে রাখে। তুমি বাবা ওকে একটা চাকরি দেখে দিতে পারো?
বুঝতে পারি প্রেমিক মানুষেরা আত্মহত্যার কথা ভাবে না।
বুঝতে পারিনি বাবা পাহারায় থাকবেন। ফিরেছিলাম, তখন রাত্রি তৃতীয় প্রহর। বৈজুকাকুকে খানিক সঙ্গ দিয়ে হারিয়ে গিয়েছিলাম বনশ্রীর বুকে। মা সদর
ভেজিয়ে রাখতেন। বাবা সে রাতে নিজে হাতে দরোজায় খিল এঁটে দিয়েছেন। নিজের বাড়িতে নিজেই পাঁচিল টপকে নেমে বাবার মুখোমুখি। চোর দায়ে ধরা পড়ে গেলাম। অন্ধকারে চেয়ার পেতে বসে আছেন।
-এতো রাত কোথায় ছিলে?
মাথা নীচু করে ছিলাম। উত্তর দিইনি।
-বৈজু সামন্তর বাড়ি?
-না।
-মিথ্যে বলতেও শিখে গেছো।
কোনো উত্তর দিইনি।
-নিজের মান-সম্মানতো খুইয়ে বসে আছো। তোমার জন্যে আমাদেরটুকু বিসর্জণ দিতে পারবো না। যা দরকার গুছিয়ে নিয়ে কাল সকালে বাড়ি থেকে বিদেয় হও। তোমার মাও ঘুমিয়ে বাঁচবেন। বাড়ির মান-সম্মান নিয়ে যেদিন ফিরতে পারবে, ফিরে এসো।
বাবার সামনে আমি আর দাঁড়াইনি। নিঃশব্দে সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠে গিয়েছিলাম। ওঠার আগে দেখেছিলাম, মা দরোজার আড়ালে মুখে আঁচল চেপে দাঁড়িয়ে আছেন। আমার অপরাধে তাঁর মুখ মাটির দিকে মিশে গেছে। মৃদু অথচ আকুল উচ্চারণে শুনেছিলাম মা ডাকছেন –খোকা, ফিরে আয়। খেয়ে যা।
মায়ের সেই কান্নাভেজা কণ্ঠস্বরে বাবার কতোখানি নিষ্ঠুরতা মিশে ছিলো, বুঝেছিলাম, যখন বাকি রাত মায়ের দেখা পেলাম না। সন্তানকে অভুক্ত রাখার কষ্টে মা তার খিদে ঘুম হারিয়ে বসে ছিলেন বাবার পায়ের কাছে। নীচের চতুষ্কোণ ঘরখানা কবে যেনো জেলখানা হয়ে গেছে, জানতেও পারেননি। কতো রাত তাঁর অনিদ্রায় অনাহারে কেটেছে, আমিও হিসেব রাখিনি।
ভোররাতে ঘুমিয়ে পড়েছিলেম। নেওয়াপাতি পাতলা ঘুম, ঠুক ঠুক শব্দে ভেঙে গেলো।
ভাবলাম, এতক্ষণে মা আসার সুযোগ পেয়েছেন। উঠে, দরোজা খুলে দেখি, হ্যাঁ মা, সঙ্গে সৃজা। সৃজার হাতে ঝোলানো ঢাউস একটা ব্যাগ। । ওকে দুয়োরে রেখে মা নীচে নেমে গেলেন। আমি আর সৃজা মুখোমুখি। কালকের অপরাধবোধ ফিরে এলো। গলা নামিয়ে বললাম –ভিতরে এসো।
নতমুখ সৃজা পাখির মতো নিশঃব্দে ঢুকে পড়লো ঘরে। জড়িয়ে ধরলাম বুকের মধ্যে। হাত থেকে ব্যাগ পড়ে গেলো। আশ্চর্য, আমাকে ঠেলে ফেলে দিলো না।
চোখ পাকিয়ে বললো না –যাঃ, ছাড়ো!
কোনো রাগ, অভিমান, প্রতিবাদ কিছুই জানালো না। নরম গলে যাওয়া পাখির মতো বুকের মধ্যে মিশে গেলো। এমন ভাবে এক হয়ে যাওয়া জীবনে এই প্রথম। যেনো এক বেহিসেবি সময় পার হয়ে যাচ্ছি। সুখে তবু উৎকণ্ঠায় তীব্র উদগ্রীব। রাত মাথায় করে কেনো, কিসের ব্যাগ? জিজ্ঞেস করলাম -কী হয়েছে ?
উত্তর দিলো না। বিছানায় বসলো। ইশারায় দুয়ার বন্ধ করে দিতে বললো। তখনও সৃজার দিকে পিছন ফিরে দুয়ার বন্ধ করছি। বললো –পালিয়ে এলাম।
দরোজা এবং দম বন্ধ হয়ে এলো। জানি, সাংঘাতিক একটা কিছু হয়েছে ।
আমাকে নয়, সৃজা ধীরে ঘাড় হেঁট করে মেঝের সঙ্গে কিছু কথা বলছে -বিকেলে মিটিং হয়েছে তোমাদের বাড়ি। রাতে হলো আমাদের বাড়ি। বাড়ির লোকেরা সন্দেহ করছে আমার পেটে তোমার বাচ্চা আছে। নিজের জ্যাঠা, কাকা, দাদারা –ছিঃ! এমনকি পাড়ার হরি জ্যাঠাও ছিলেন। বাবা কাল অনেক রাতে বাড়ি ফিরেছিলো।
-আমি জানি।
- ওরা বাবার জন্যে অপেক্ষা করেনি। হুমকি দিয়েছে, পাড়া থেকে তুলে দেবে। মাকে অপদস্ত করেছে। মা নাকি আসল কালপ্রিট। মার আস্কারাতেই চাকরি করা ছেলে ধরতে বেরিয়েছি। ওরা নিশ্চিত, আমার পেটে একটা আছেই। তার নাকি ঠিকঠিকানা নেই।
এবার সৃজা কেঁদে ফেললো।
-এরা আমার দাদা, কাকা, জ্যাঠা প্রিয়জন! কাল সকালেই এক দাদা জোর করে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবে, পেটে বাচ্চা আছে কিনা পরীক্ষা করাতে।
আমি ওর পাশে বসি। সৃজা মেরুদণ্ড সোজা রেখে বসে আছে। আমাকে স্পর্শ করে না।
বলে – ঘরে ফিরে সব শুনেছেন বাবা। কিছুই বলেননি। গরীব বলে মা-বাবা মুখ বুঁজে সব সহ্য করছেন আর অসহায় চোখে আমার দিকে তাকিয়ে থাকেন। সহ্য করতে পারিনি। পালিয়ে এসেছি।
ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিই। বলি –ঠিক করেছো।
আদর পেয়ে ডুকরে কেঁদে ওঠে সৃজা। বলি –চুপ, চুপ। পাশের ঘরে কাকা-কাকিমারা। শুনে ফেলবে।
-ফেলে ফেলুক। আর পারছি না।
কী করি? আমারও বিদেয় বাজনা বেজে গেছে। বাবা বলেছেন, মান-সম্মান নিয়ে ফিরে এসো। বাবার সম্মানতো সৃজার একসিঁথি সিঁদুর। একপাতা সিঁদুরের দাম। দু’টাকা। বাবার সম্মান।
গোবরডাঙ্গা জমিদারবাড়ির বড়ো তরফে শিবলিঙ্গের যেমন মন্দির আছে, পার্বতিলিঙ্গেরও মন্দির আছে। পাশাপাশি। দু’টাকার সিঁদুর, দু”টাকার সন্দেশ, আর ষোলোআনার দক্ষিণা দিয়ে পাঁচটাকার বিয়েটা সেরে ফেললাম। তারপর আমাদের সামনে অথৈ নীল আকাশ। হৈ হৈ বাতাস। আর হাজা মজা নাম-গোত্রহীন এক যমুনার ঢেউ। একটা ভ্যানরিকসা ভাড়া করে ফেললাম । সারাদিন শুধু বনবন, সারাদিন শুধু চরকি, আমবাগান, ম্যাটিনি শো সিনেমা, তারপর মান-সম্মান নিয়ে বাড়ি ফেরা। ট্রেনে কুড়িমিনিটের পথ।
কিন্তু ফিরিনি। অভিমানে, অহংকারে, অপমানের প্রতিশোধ নিলাম।
সেদিনই বিকেলবেলা, দু’জন দাঁড়িয়ে ছিলাম, গোবরডাঙ্গা স্টেশনে রেলওয়ে ব্রীজের অনেক উঁচুতে। এখান থেকে বহুদূর দেখা যায়। রেললাইন চলে গেছে আমাদের দুজনেরই বাড়ির দিকে। তাকিয়ে আছি। জন্মভিটে এক আশ্চর্য চুম্বক। একমুখে অসহ্য টানে অন্য মুখে নিদারুণ ঠেলছে, কষ্ট দিচ্ছে, কিছুতেই কাছে ঘেঁষতে দিচ্ছে না।
অন্যদিন পথে আঙুলের মাথাটুকুও সৃজা ছুঁতে দেয় না। আজ সে আমার বিবাহিতা স্ত্রী। দু’জনে হাত ধরাধরি করে দাঁড়িয়ে আছি। আজ না হোক কাল, কাল না হোক পরশু, একদিন না একদিন বাবা ডেকে পাঠাবেনই। তক্ষণি যে ট্রেন প্রথম আসুক, সব ফেলে-ঝেলে বাড়ি চলে যাবো। জানালায় দু’জনে পাশাপাশি বসবো। হু হু বাতাসের গতিতে ছুটে যাবো মায়ের কাছে। বাবা বারান্দায় বসে থাকবেন, হাতলওয়ালা সেই শক্ত কাঠের চেয়ারে।
বলবেন –এইতো বাপকো বেটা, সিপাইকো ঘোড়া, কুছ নেহিতো থোড়া থোড়া। মান-সম্মান লেকে লৌট আয়া।
মা হিন্দি-পিন্ডি কিছু বুঝতে না পেরে বলবেন –সারাদিন কিছু খায়নি। এখন ওদের আর বোকো না। দুটো খেয়ে নিক। তারপর মারতে হয় মেরো, কাটতে হয় কেটো। আয়, ঝুম দুটো আসন পেড়েনেতো মা। দু’জনে পাশাপাশি বোস। যা হোক চাড্ডি মুখে দে।
ঝুমও কি তাই ভাবছে! ওর মুখের দিকে তাকালাম। এক মাথা কপাল নতুন সিঁদুরে মাখামাখি। আমাদের পিছন দিয়ে ট্রেনের প্যাসেঞ্জার যাচ্ছে আসছে। কতো হকার, ফেরিওয়ালা। এপার থেকে ওপারে মানুষেরা যাওয়া আসা করছে। ঝুম একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে নীচে প্লাটফর্মে। ওভারব্রীজের নীচ দিয়ে একজন ফেরিওয়ালা হেঁকে যাচ্ছে।
-শ্লেট, পেনসিল, হাতেখড়ি, বর্ণবোধ.. ..
আমি আর ঝুম মুখ চাওয়া-চাওয়ি করলাম। কেঊ কাঊকে কিছু বললাম না। পিছন থেকে ফেরিওয়ালাটিকে দেখতে অবিকল বৈজুকাকার মতো। চুলহীন মাথার মাঝখান। চকচক করছে। পিছনে বাবরি চুলের দু’একগাছি উড়ছে। ঝুমের গলা ভারি ঠেকলো। বললে - আমাদের সাইকেলটা কাল রাতে বিক্রি হয়ে গেছে। বেরুবার মুখে বিক্রির দুশোটাকা বাবা আমায় দিয়েছিলেন। আজ থেকে পায়ে হেঁটে হকারি করবেন।
ওভারব্রীজের সিঁড়ি ভেঙে হুড়মুড়িয়ে নামতে শুরু করলাম। নতুন বঊ ঝুমও দুপ-দাপ শব্দে নামছে আমার পিছন পিছন। একছুটে দু’জনে দাঁড়িয়ে গেলাম ফেরিওয়ালার সামনে। না, বৈজুকাকা নয়। অবিকল, অবিকল বৈজুকাকার মতো দেখতে। কতো যে বৈজুকাকা আছে, কে জানে! ঝুম খুব বোকা। একদম বোঝে না। স্বচক্ষে দেখছে তার বাবা নয়। তবু ছলছল হয়ে এলো চোখ। হঠাৎ ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো। কান্না খুব ছোঁয়াচে। চোখের দু’কুল ছাপিয়ে কান্না আমাকেও ধাক্কা দিচ্ছে। বুঝতে পারছি বুক ভারি হয়ে উঠছে। চোখের পিছনে বাষ্প জমে উঠেছে। ভেবেছিলাম, প্রেমিক কাকু বিরহ সহ্য করতে পারেননি। তার প্রথম প্রেমসৃজান। হারিয়ে গেছে। পিতার প্রেম তার সন্তানেরা। দ্বিতীয় প্রেমিকা সৃজা। সেও হারিয়ে যেতে বসেছে। খোয়া যেতে যেতে যদি আর একবার দেখা হয় তার সাথে, সেই আশায় ছুটে এসেছেন। কণ্ঠস্বর শক্ত করে বললাম –ঝুম, কেঁদো না।
ফেরিওয়ালা অচেনা দু’জন নবদম্পতির অবরোধে হকচকিয়ে গেছেন। থমকে দাঁড়িয়ে, জিজ্ঞেস করলেন –কী চাই?
দু’জনেই ঢিপ করে প্রণাম ঠুকে দিলাম। শশব্যস্ত হয়ে বেচারি দু’পা পিছিয়ে দাঁড়ায়। -আমাকে কেনো? আমাকে কেনো?
সৃজা বলে ওঠে –আশির্বাদ করুন বাবা।
-সেকি, আমি কেনো, মা?
আমি বলে উঠি –নতুন বিয়ে করে আসছি। দেখা হলো। আপনারা গুরুজন। আশির্বাদ করবেন না?
-নিশ্চয়, নিশ্চয় আশির্বাদ করবো।
ফেরিওয়ালা হতবাক। নির্ণিমেষ চোখে চেয়ে আছেন আমাদের দিকে। কী জানি, দূরে, ঘরে দোরে পৃথিবীর কোথাও না কোথাও তার কোনো প্রেমিকার কান্না ভরা মুখ চোখের সামনে ভেসে উঠলো কিনা, কে জানে?
-কিন্তু কী আশির্বাদ করি বাবা। আমারতো কিছুই নেই।
হঠাৎ কী যেনো মনে পড়ে গেছে, কাঁধে সাততালি মারা আলাদীনের আশ্চর্য ব্যাগ। হাতড়াতে শুরু করেছেন। ব্যাগ থেকে বের করে সৃজার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললেন -শ্লেট, পেনসিল, বিদ্যাসাগরের এই বর্ণপরিচয়খানা নাও মা। তোমাদেরতো পারলাম না। তোমার সন্তানদের আশির্বাদ করছি।
সৃজা তখন ডুকরে কেঁদে উঠেছে। ফেরিওয়ালা একটু থেমে কী ভাবলেন। তারপর বললেন –বিনিপয়সায় আশির্বাদ করতে পারলে খুশি হতাম। তিনটাকা বারোআনা।
চুপ করে, আবার ভাবলেন। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন – না থাক, নেবো না। তোমাদের মঙ্গল হোক।
-অমঙ্গল হবে না। আপনি এটা রাখুন।
দিলাম। জোর করেই পয়সাক’টা দিলাম।
কান্না লুকাতে আমরা তখন ওভারব্রীজে ফের উঠে এসেছি। ফেরিওয়ালা স্টেশনের প্লাটফর্ম পেরিয়ে, রেললাইনের সমান্তরাল ধরে, এগিয়ে চলেছেন। ওদিকে জঙ্গল, যমুনানদীর হাজামজা খাল, মানুষের গতিগম্যা নেই, লোকালয় নেই, ওখানে তার পশরা কে কিনবে?
হাঁকতে হাঁকতে চলে যাচ্ছেন – শ্লেট, পেনসিল, হাতেখড়ি, বর্ণবোধ .. .. ..
আমি তাকিয়ে আছি, বৈজুকাকাদের ছাড়িয়ে, দূরে, ভবিষ্যতের দিকে।
সৃজা বললো –কেনা দামে দিয়ে গেলো মানুষটা। বাবা বেচলে দাম পেতো চারটাকা দু’আনা। আটগণ্ডা পয়সা জলে গেলো।
দৃষ্টি না ফিরিয়ে জিজ্ঞেস করি –তাই কি?
চোখের জলের উত্তর শোনা যায় না।
সকালের রোদ্দুর, তেরচা হয়ে পড়েছে বাবার গায়ে, অর্ধেক পড়েছে উঠোনে। পুরো রোদ্দুরে আমিই ডুবে আছি। বাকিরা আধা খামচা। একটু আগে ছোটোপিসি উঠোন ধুয়ে গেছে। ভিজে উঠোন রোদ্দুরে ঝিলিক দিয়ে উঠলো।
বাবা বলছেন - বিয়ের ব্যবস্থা তোমাদের দু’জনকেই করতে হবে। বিয়ে আমি দেবো না।
ছোটোপিসি এক বালতি জল আর ঝাঁটা নিয়ে ঘরে যাচ্ছিলো। পা পিছলে পড়ে গেলো উঠোনে। বালতির জল লাফিয়ে উঠলো। আমি আর পিসি ভিজে গেলাম। পিসি আমাকে খুব ভালবাসে। খ্যাংরাকাঠি ফুটে গেলো পিসির পায়ে। আর্তনাদ করে উঠোলো। মা কলতলায় দাঁড়িয়ে আড়ে আড়ে শুনছিলেন, দেখছিলেন। পিসিকে তুলতে কেঊ এগিয়ে গেলো না।
ওখান থেকে তীব্র স্বরে মা বলে উঠলেন –কানার মরন। দেখে পা ফেলতে পারো না! বালতিখানা আস্ত থাকলে হয়।
উঠোনে আমার পা পুঁতে গেছে। সমস্ত শরীর ভারী লাগছে। ইচ্ছে থাকলেও তোলার ক্ষমতা নেই। সকলের সামনে পিসি নিজেই উঠে দাঁড়ালো। তখন একটু হলেও বুকের মধ্যে বাতাস সহজ হলো। পিসি জোর আঘাত পেয়েছে। কষ্টে ঠোঁটদুটো মুখের ভিতর ঠেসে ধরেছে। পিসির চোখে জল! কি জানি, বালতি থেকে ছিটকেও লাগতে পারে।
বাবা আরো বললেন – বিয়ে বাড়িতেও করতে পারো। কাকা পিসিদের যেমন জমজমাট বিয়ে দিয়েছি, অমন জাঁক করতে হবে। বাড়ির মান-সম্মান খোয়াতে পারবো না। পয়সা কড়ি দেবো না। বিয়েতে থাকবোও না। যদি খরচা করতে না পারো, রেজিষ্ট্রি পারো, কালিবাড়ি পারো, যেখান থেকে খুশি সিঁদুর পরিয়ে এসো দেখতে যাবো না। মেয়ে ঘরে তুলে নেবো। মেয়ে আমার পছন্দ।
বালতি ঝ্যাঁটা গুছিয়ে পিসি মায়ের আড়ালে আশ্রয় নিলো।
মনে মনে উত্তর দিলাম –মাইনের সবটাই সংসারে ধরে দিই। হাত খরচের টাকা দিয়ে জাঁকিয়ে বিয়ে হয় না।
মুখে কিছু বললাম না। বলার স্পর্ধা নেই। অফিসের ট্রেন ধরতে বেড়িয়ে পড়লাম। মাকে বললাম –আসছি।
যেখানে দাঁড়িয়ে ছিলাম, ছোটোকাকার বিয়েতে প্যান্ডেলের ভার রাখার জন্যে একজোড়া বাঁশ ওখানে পোঁতা হয়েছিলো। তখন সবে কিশোর। তখনও আমি হাফপ্যান্ট। রান্নাঘর থেকে ছুটে বেরুবার মুখে জোড়াবাঁশে ঠোক্কর খেয়ে বাঁ চোখের ভ্রু কেটে রক্তারক্তি কান্ড।
মা বলেছিলো – শুভকাজে ছোটোখাটো রক্তপাত, ভালো লক্ষণ।
বাঁ দিকের ভ্রুতে দু’ফাঁক কাটাদাগটা এখনো আছে কিনা, দেখার জন্যে হাঁটতে হাঁটতে কপালে হাত তুললাম। দেখতে চেয়ে ছিলাম, খ্যাংড়া ফুটে ছোটোপিসির কতোখানি লেগেছে। পুরনো ব্যথা বুঝি ফের জেগে উঠলো। কাটা জায়গাটুকু নিজের অজান্তেই হাত বুলোচ্ছিলাম।
বাবা সৃজাকে পছন্দ করেন। ডাকেন –ঝুম। ওর ডাক নাম। ঝুমের পায়ে বাবার দেওয়া নুপুর সারা বাড়িময় বাজে। ঝুম ঝুম, ঝুম ঝুম। বাবা আমাকে পছন্দ করেন না। ঝুমকে করেন। আমি তাতেই খুশি। মা আমাকে পছন্দ করেন। ঝুমকে করেন না। আমার কষ্ট হয়। সৃজা মানে ঝুম আমার কাছে পড়তে আসে সকাল বেলা। পড়া হয়ে গেলে বাবার চারপাশে ঘুর ঘুর করে। মা ওকে তীব্র অপছন্দ করেন। তবুও জানিনা কেনো, হয়তো আমাকে ভালবাসেন বলে। গরম গরম ফেনাভাত, মাখন, আলুশেদ্ধ মেখে ঝুমকে খাইয়ে দেন। ঝুমের বাবা গরীব। হয়তো দয়া করেন। মা খুব দয়ালু। তবু মনে মনে সহ্য করতে পারেন না। বিয়ের পরের কথা ভাবলে আমার দুশ্চিন্তা হয়। ভয় করে।
তবু বাবা বিয়ের অনুমতি দিয়েছেন। অফিস থেকে ফেরার পথটুকু পড়ন্ত কনেদেখা আলোয় খুশিতে ভরে থাকে। নরম রোদ্দুর আদুরে বাতাসে অশত্থের মগডালে ঝিলমিল খায়। অফিস ফেরত বাড়ির পথ ধরেছি। পথ গিয়েছে বাড়ি হয়ে ঝুমের দরোজায়। আলো নেই, ছায়া নেই, নিভন্তবেলা ছড়িয়ে পড়ে আছে পাড়াময়। পথের ধারে সবুজে সবুজ মাঠ। বালক বালিকারা খেলছে। বালকদের পা থেকে বল ছুটে পালিয়ে গেলো রাস্তার ওপারে। ঠিক আমার পায়ের নাগাল পেরিয়ে। ইচ্ছে থাকলে থামাতে পারতাম। আমার নিমগ্ন উদাসীনতায় বল চলে গেলো রাস্তা পেরিয়ে, আশশেওড়ার জঙ্গলে। ছুটন্ত পায়ে পথ বেঁধে হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেলো যে বালকটি, তাকে আমি চিনি। ওর নাম খুদে। খুব বদমাস। ঝুমেদের পাশের বাড়ির ছেলে। বদমায়েসির শাস্তি দিতে একরাশ অবহেলা আমাকে পেয়ে বসলো। ওকে তুলিনি। ওকে তুলবো, সেই অপেক্ষায় শুয়ে থাকার ছোকরা ও নয়। পথের উপর মুখথুবড়ে পড়া খুদে টুক করে উঠে দাঁড়ালো। নিজের হাঁটু দেখলো। ছাল-চামড়া উঠে গেছে। রক্ত-মাটি মাখামাখি। ঘাড় ঘুড়িয়ে আমার দিকে তাকিয়ে ফিক করে হাসলো। দু’হাতে রক্ত-ধুলো ঝেড়ে বলের পিছনে ছুটলো। যেনো কিছুই হয়নি। কিন্তু রক্ত পড়ছে আমি দেখেছি।
আমি জানি, ও কেনো হাসলো। ওর পড়ার জানালার উল্টোদিকে ঝুমের ঘর। ঝুমের জানালা খোলা থাকে। ঘর অন্ধকার রেখে শয়তান খুদে চুপিচুপি একচিলতে জানালা খোলে, ছোট্ট ফাঁকে চোখ রেখে, ঝুমের জানালায় পর্দা টানা থাকলেও, ওৎ পেতে বসে থাকে। বাতাসের ফাঁক গলিয়ে কিংবা পর্দা ভেদ করে দেখে, আমি ঝুমকে অঙ্ক শেখাবার অছিলায় কখন আদর করি।
একদিন পথে পাকড়াও করেছিলাম। বলেছিলো, ওর দিদিকে গান শেখানো হয় না। কারণ, গানের মাষ্টারমশাইরা গান শেখাবার সময় মেয়েদের গায়ে হাত দেয়। গানের মাষ্টাররা খারাপ লোক। অঙ্কের মাষ্টাররা ভালো। তারা এসবকিছু করে না। এ পাড়ার গুডবয়, আমি নাকি এর উদাহরণ। এসব করতেই পারি না। জিজ্ঞেস করেছিলাম –কে বলেছে?
খুদে বলেছিলো –মা।
-তুই খারাপ কাজ দেখিস কেনো?
-সত্যি কিনা, মা দেখতে বলেছে।
-সত্যি?
খুদে মাথা নিচু বলেছে –সত্যি, না না সত্যি না।
মুখ লুকিয়ে, ঘাড় কাত করে আমার দিকে তাকায়। আমি তখন ক্রুদ্ধ চোখে ওরদিকে তাকিয়েছিলাম।
প্রায় কেঁদে ফেলে বলেছে –দেখতে আমার ভাল্লাগে।
-ফাজিল ছোকরা কোথার। এবার দেখবিতো তোর বাবাকে বলে দেবো।
ফাজিল ছোকরা বল নিয়ে ফেরার পথে এই জন্যেই মাথা নিচু করে চলে গেলো। একটুকরো খোয়া, যাকে বলে পথের কাঁটা, ছুটন্ত পায়ের ধাক্কায় যে খুদেকে উল্টে ফেলেছে, নিচু হয়ে সেটা তুলে ফেলে দিলাম দূরে।
ঠিক তখনই দেখতে পেলাম, আমাদের বাড়ির দোতালায় গোলমিটিং বসেছে। বারান্দা জুড়ে খুড়তুতো বোনেরা, নিজের বোন, পাড়ার দু’চার জন মাতব্বর বৌঝিরা মিলে গম্ভীর আলোচনায় ব্যস্ত। ওদেরদিকে পিছনফিরে ঝুম দাঁড়িয়ে আছে কার্ণিশে। ঝুম আজ সাদা ভয়েলের কালোচেক শাড়িখানা পরেছে। ওকে বেশ লম্বা দেখাচ্ছে। ওদের, মানে, ওর আর ওর মায়ের বাইরে পরার একখানায় সাধারণ শাড়ি। সেটাই পরে এসেছে। সাধারণত ও প্যান্ট-শার্ট পরে। দু’জোড়া প্যান্ট-শার্টে ভাই-বোনের দিব্যি চলে যায়। তখন ওকে আরো লম্বা লাগে। একফালি তলোয়ারের মতো দিনের বিশেষ আলোয় ওকে সুন্দর দেখাচ্ছে। আলসের গায়ে একটু ঝুঁকে আছে। মনে হলো, আলোর মগডালে আকাশের কাছাকাছি দাঁড়িয়ে আছে। এখুনি উড়ে যাবে।
সিঁড়ি বেয়ে দোতালায় ওঠার সময় কান খাড়া রেখেছিলাম, গোলমিটিংএ কী কী খারাপ কথা ওকে শোনানো হয় জানার জন্যে। ঝুম এসময় আমাদের বাড়ি আসে না। আমি নিশ্চিত, ওকে ডেকে আনা হয়েছে। মা’র দেওয়া সাহসে ওকে আকথা কুকথা শোনানো হচ্ছে। মিটিংএ পাশের বাড়ির কাকিমার গলা শুনতে পেলাম –পাড়ারমুখে আর চুন-কালি মাখিও না। হয় বিয়ে করো, না হয় মানে মানে সরে দাঁড়াও।
হাঁড়ি আলাদা, তবু ছোটো কাকিমা বললেন –ছেলে আর ফেলে রাখবো না। তোমার মা-বাবার যদি সময় না থাকে বলুক, অন্য মেয়ে দেখি।
তখন সত্যিই সিঁড়ির নীচে পড়ে আছি। ওঠার ক্ষমতা নেই। বাড়িতে আমি যেনো অপাঙক্তেয়। আমার অস্তিত্ব লুটপাট হয়ে গেছে। পা অসাড়, ভারি। ওদের পাশ কাটিয়ে ঘরে ঢুকতে হবে। আমাকে দেখলে না জানি, মুখের ধার কমে টেপাঠোঁট আর চোখের তীক্ষ্ণতা কতগুন বেড়ে যায়!
ওদের আকথা কুকথা অন্তত বন্ধ করা দরকার। এই কারণে আমাকে উঠতে হবে। ওঠার প্রস্তুতি নিচ্ছি। আঁচলের খুঁট মুখে ঝড়ের গতিতে নেমে আসছিলো ঝুম, আমাকে দেখে একপলক থমকে দাঁড়ালো। চোখে চোখ রাখলো। চোখ দুটো জলে ভরা। চোখের কোল গড়িয়ে নেমেছে অশ্রুর দাগ। কিছু বললো না। যেমন নামছিলো, ছুটে পালিয়ে গেলো। উঠোনে ওর মিলিয়ে যাওয়া চটির শব্দ পেলাম।
জামা-প্যান্ট ছাড়তে ছাড়তে ভাবছিলাম, সৃজাকে কতক্ষণ ডেকে আনা হয়েছে? তখন আমি কোথায়? ট্রেনে? স্টেশানে? নাকি পথে? কতক্ষণ ওকে আটকে রেখে কাঁদানো হচ্ছে? জানি, এ সবই মা’র ইন্ধনে। ছোট্টবেলা থেকে মা সৃজাকে স্নেহ করেন, ঘরে-দোরে সে বাড়ির মেয়ের মতো পায়ে পায়ে ঘুরে বেড়ায়। ভুল করলে বকেন। কাঁদলে মাথায় হাত বুলিয়ে দেন। খিদে পেলে খাইয়ে দেন, উলুডুলু, চুল ছাড়া থাকলে বেঁধে দিতেও দেখেছি। রাগ করে বলতে শুনাছি –চুলনা তো শিবের জটা। ঝিটকি টেনে দেবো ছিঁড়ে। তোর মায়ের একটু তেলও জোটে না।
যেদিন জেনেছেন, আমার প্রেমিকা, সেদিন থেকে আর সহ্য করতে পারেন না। কী এমন মহাভারত অশুদ্ধ হলো, এই একটা মাত্র খবরে!
তারপরও বাবা ওকে পছন্দ করেন। বাবার এই শত্রুতাও মায়ের সহ্য হচ্ছে না। স্নেহ-মমতা সব উড়ে গেলো!
এতো দিন বুকে পুষে রাখা মেয়ে শত্রু হয়ে যায়, এ কেমন মমতা?
ঘরের বাইরে এসে, আলসেয় মুখ রেখে চিৎকার করে বললাম –মা, খেতে দাও, পড়াতে যাবো।
ঝুমকে নিয়ে কষ্ট হলে এটুকুই বলতে পারি। পড়াতে যাবো মানেই ঝুমদের বাড়ি যাবো।
মায়ের প্রতি, এ বাড়ির প্রতি, এটুকুই আমার রাগ, অভিমান, প্রতিশোধ। আলসের হাতলে সেই তলোয়ার মাখা রোদ্দুর আর নেই। খুব তাড়াতাড়ি সন্ধের আধাঁর এসে দাঁড়িয়েছে । মনে হলো, সন্ধের আধাঁর নয়, ঝুমের ছায়া। এখনো দাঁড়িয়ে কাঁদছে ।
বাড়ির মেয়েরা আজ যে দূর্ব্যবহার করেছে লজ্জায় মুখ পুড়ে আছে। কোন আনন্দে যাবো সৃজার কাছে! সে শক্ত মেয়ে। অভাবের আগুনে পুড়ে নিখাদ নিটুট। আমাদের বাড়িকে অপমান ফিরিয়ে দিতে পারতো। দেয়নি। আমাদের প্রেমই তার কারণ। আমি জানি, ঘরে ফিরে দরোজা বন্ধ করে কাঁদছে। আজ গেলে দরোজা খুলবে না। যদি খোলে, অঙ্ক শেখাবার সময়, কিছুই বলবে না। নিঃশব্দে কেবলই অঙ্ক কষে যাবে। অনর্গল কষে যাবে। ভুল হলে বারবার চেষ্টা করবে। আমাকে বলবে না। আমি জানতেও পারবো না ভুলের মাহাত্ম কোথায়! ওর সামনে চেয়ারে বসে নিজেকে, অসহায়, দুর্বল একা মনে হবে। আদর পর্যন্ত হাতে উঠবে না। ঝুম প্রস্তুত হয়ে আছে, এভাবেই কষ্ট দেবে আমাকে। বুঝবে না, আজ ও কিছুতেই বুঝবে না। আর ঝুম অবুঝ হলে, আমার অপরাধ বোধ আরো বেড়ে যায়।
এই শহরে আমার দ্বিতীয় প্রেমিকার নাম শ্রীমতি। আমি তখন শ্রীমতির কাছে যাই। সন্ধ্যায় শ্রীমতি এক স্নিগ্ধার নাম। এক প্রশান্তির নাম। আমি তার পাশে বসি। সে আমাকে ভাসিয়ে নিয়ে যায়, সমুদ্রের দিকে, আকাশের দিকে। তার অন্যনাম ইছামতি। ‘সৃজা’ উচ্চারণের ‘শ্রী’ টুকু নিয়েছি। ইছামতির ‘মতি’তে মিশিয়ে নাম দিয়েছি শ্রীমতি। সে তাতেই খুশি। তার জল থেকে উঠে আসে শীতল বাতাসের হাত। সে আমাকে আদর করে। ভালবাসে। দুঃখ ভুলিয়ে দেয়। আমাকে সৃজার কথা বলে। অনেক রাত পর্যন্ত আমরা দু’জন কথা বলি। কথা বলতে বলতে ভুলে যায় আমাদের কথা। বলি, শুধু সৃজার কথা, সৃজাদের কথা। কথাদের সৃজারা যখন শান্ত হয়। আমার প্রতি প্রসন্ন হয়। অপরাধবোধ জল হয়ে আসে। মিশে যায় শ্রীমতির বুকে। শিয়রে তখন জেগে থাকে কৃষ্ণা তৃতীয়ার চাঁদ। শ্রীমতির মুখে কুচিকুচি ঢেউ, আবছায়া হাসে। তার কুলুকুলু শব্দ শোনা যায়। অনুভব করি, শ্রীমতির বুকে জোয়ার এসেছে।
অপরাধবোধ নরম হয়ে আসে। ভেসে যায় হৃদি ইছামতিমূলে।
দূরে শ্রীমতির শরীরে যেখানে বাঁক, ওই শহরের দিকে , নদীর পাড়ে সৃজাদের বাড়ি। এখান থেকে দেখা যায়। খোলা চতুর্ভূজ জানালায় একজোড়া চোখ জেগে আছে। আলো জ্বলছে। ওই আলোয় বসে সে অঙ্ক কষে। গভীর রাত পর্যন্ত বই পড়ে। যখন সে মনোযোগ দিয়ে কিছু করে, খুব সিরিয়াস। মনে হয়, ওর আসল নাম সৃজা। যখন হেসে ওঠে, কেঁদে ফেলে, ওকে ছুঁতে পারি, আদর করি, হয়ে ওঠে আমার একান্ত ঝুম। আজো কি পড়ছে! না, পড়ার ভান করে আলো জ্বেলে অপেক্ষা করে আছে ‘কেউ আসবে’। অপেক্ষায় কে আছে আছে ঝুম, না সৃজা? সৃজা না ঝুম? নাকি ঝুম আর সৃজা মিলে মিশে দূর্বোধ্য কেউ, যাকে আমি চিনতে পারি না, বুঝতে পারি না, ভয় পাই।
তখন চেয়ে থাকি ওই আলোর দিকে। রাতের আকাশে ওই আমার ধ্রুবতারা। জানি, তখন সে কাঁদে। জানালার দৃশ্যপথে ধ্রুবতারার অশ্রু নেমে আসে শ্রীমতির বুকে। উজানে বয়ে আসে চোখের জলে ভিজে যাওয়া অঙ্কের সংখ্যারা। ভেসে যায় হৃদি ইছামতিমূলে। স্পষ্ট দেখি, ভুল যোগ, ভুল গুনে ভরে আছে অঙ্কের শরীর। ভেসে যায় খোলা ভূগোলের পাতা, ইতিহাস বই, মনে পড়ে, রবিঠাকুরের কবিতাখানা ‘যখন যেমন ইচ্ছে করি, তাই হতে পাই যদি, তবে আমি এক্ষুণি হই ইচ্ছামতি নদী.. ..
কান্নায় গড়া শ্রীমতিও সৃজার মতো। চোখের জল সহ্য করে না। আমাকে একা করে দেয়। কিছু বলে না। নিশ্বাসে প্রশ্বাসে বাতাস স্থির হয়ে এলে, তার নিস্তব্ধ গাম্ভীর্য আমাকে বসিয়ে রাখে বুকের নিস্পন্দ কিনারে। নিস্প্রভ হয়ে আসে আকাশের তারা। জ্যোস্না করুণ হয়। আমি মানুষ। প্রেমিক আমি। একাকীত্ব সহ্য করি না। মনুষ্যত্বের অহংকার আহত হলে উঠে পড়ি। রাত্রি আরো নিস্তব্ধ হয়। অস্থির লাগে। অন্তরঙ্গতার খোঁজে এগিয়ে যাই। হাঁটতে শুরু করি, অন্য এক রমনীর দিকে। এই শহরের হৃদপিণ্ড বরাবর আর এক প্রেমিকা আছে আমার। ভীষণ খোলা মেলা। তার কাছে উদারতা শিখি। তার বুকে আশ্রয় নিলে ভুলে যাই দুঃখ, ব্যথা, যন্ত্রণা। সে আমার একাকীত্ব ম্লান করে দেয়। অন্যতমা সে প্রেমিকার নাম বনশ্রী। আমারই দেওয়া নাম। আমিই আদর করে ডাকি শ্রী।
ইছামতি নদীর পাড় ধরে হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছে যাই শহরের পথে। আমি তখন শ্রীর খুব কাছাকাছি এক স্ট্রিটল্যাম্পের নীচে দাঁড়িয়ে। ধোঁয়াশা ভেদ করে আলো নেমেছে। রাত ভারি হয়ে এসেছে । সারি সারি দোকান-পাট বন্ধ। কিছুকাল আগে শহরে বুলডোজার ঢুকেছিলো। রাস্তার দু’পাশে বে-আইনি দখল মুক্ত হয়েছে। ফুটপাথ জুড়ে সারি সারি দোকানের কিছু ধ্বংশস্তুপ এখনো পড়ে আছে। একটা নেড়িকুত্তা ঘুমাইনি। শুঁকে শুঁকে ধ্বংশস্তুপে কিছু খুঁজছে। তার ছায়া কখনো লম্বা, কখনো চিঁড়েচ্যাপ্টা, কখনো বেঁকেচুরে কুন্ডলি পাকানো মানুষের আকার নিচ্ছে। রাতেরবেলা মানুষেরা খোয়াব দেখে। আমিও দেখছি। অনেক সময় তাকিয়ে থাকার পর বুঝলাম ওটা নেড়িকুত্তা নয়, একজন উবু হয়ে বসা মানুষ। কিছু খুঁজছেন। দোকানঘরের ভাঙা ইট, টুকরো
সিমেন্টের দলা হাত বুলিয়ে বুলিয়ে দেখছেন। দোকানের দেওয়ালে গোপন কুঠুরিতে কেউ কেউ সোনা-দানা, দামি কিছু লুকিয়ে রাখেন। দোকানঘর ভাঙার আগে মানুষটা সে সব হয়তো বের করে নিতে পারেননি। ভাঙাচোরা চুকেবুকে গেছে অনেকদিন হলো। ফুটপাথে যাদের দোকান ভাঙা পড়েছে, তারা মরা গরীব। তাদের দোকানটুকুই সার। কী আর থাকতে পারে! ধ্বংবশেষের নীচে। কী খুঁজছেন উনি? আগ্রহ নিয়ে মানুষটির দিকে এগিয়ে যাই। মানুষটি উঠে দাঁড়ালেন। চিনতে পারলাম, উনি সৃজার বাবা। বৈজুকাকু। পাঁচফুট আটইঞ্চি লম্বা। দোকান ভাঙার পর বুড়িয়ে বেঁটে হয়ে কেমন সন্ন্যাসী গোছের হয়ে গেছেন। উদাসীন। নীচের বোতাম খোলা ফ্লায়িংশার্ট। বাতাসে উড়ছে। ইস্ত্রী করা প্যান্ট ঢলঢলে পাতলুন হয়ে গেছে। নির্নিমেষ চেয়ে আছেন ধ্বংশস্তুপের দিকে। বিরল দু’একগাছি মাথার চুল লিক লিক করে উড়ছে। ছেলে-মেয়ে আর দোকানঅন্ত জীবন মানুষটার। মেয়ের নাম সৃজা, দোকানের নাম রেখেছিলেন সৃজান।
দোকান আগে। মেয়ে বড়ো হলেও সৃজানের চেয়ে বয়সে ছোটো। সৃজান তাঁর জেষ্ঠ সন্তান। ওকে খুঁজছেন। ভালবাসা মানুষকে চিনতে শেখায়। সৃজাকে ভালবেসে বুঝতে পারি, ভ্যাবলা হয়ে আসা ওই মানুষটা আস্তপ্রেমিক। ভালবাসেন একখণ্ড বায়বীয় শুন্যস্থানকে। ওইখানে দাঁড়িয়ে ছিলো সৃজান। এখন কেবল শূণ্যতা, কেবল হাহাকার।
আমার সৃজা আছে, শ্রীমতি আছে, শ্রী আছে। ওনার সম্বল ওই বায়বীয় স্থানটুকু। আমার দেখা একজন শ্রেষ্ঠ প্রেমিক। উনি এখন সৃজানের স্মৃতিতে মগ্ন। দূর থেকে ডাকি না। যদি প্রেমের মগ্নতা ভেঙে যায়। ভাঙা সিমেন্টের টুকরোয় দাঁড়িয়ে আছেন। যদি টলে পড়ে যান? কাছে যাই। পায়ের শব্দে জেগে ওঠেন। মৃদু স্বরে ডাকি
–-কাকু।
যেনো অনেক দূর থেকে শুনেছেন। উনিও আমাকে চেনার চেষ্টা করেন।
-ভাঙা ইট-পাটকেলের উপর দাঁড়ানো যায়! পড়ে যাবেনতো। নীচে নেমে দাঁড়ান।
-ও, তুমি! তা এখন? সব মঙ্গলতো!
-আমিও খুঁজতে বেরিয়েছি।
অশ্বত্থামা হত ইতি গজর মতো বললাম, যেনো ওনাকেই খুঁজছি।
বললাম –অনেক রাত হয়েছে। চলুন। আপনার সাইকেল কৈ?
বুলডোজার এক থাপ্পড়ে গুটিয়ে একটা দোকানকে বোঁচকা বানিয়ে দিয়েছে। অন্ধকারের এককোনা থেকে বোঁচকা পেছনে সাইকেলখানা বেরিয়ে এলো।
-কেনো, বাবা? আমিতো রোজই সৃজানকে একবার দেখতে আসি।
দু’জনে একই পথের পথিক। যশোহর রোডের ফুটপাথ ধরে পাশাপাশি হাঁটি। দুই প্রেমিক। কাকু সাইকেল হাতে হাঁটছেন। আমি শ্রীর বুকের পাশ দিয়ে হেঁটে চলেছি। অনুভব করছি, তাঁর বুকের স্পন্দন। বিস্তীর্ণ উদারতা। উদাসীনতা। আমার তৃপ্তি কাকু অনুভব করতে পারছেন না। সৃজানের দুঃখ ভোলার জন্য কাকুর আর একজন প্রেমিকা থাকা উচিত। উনি নিরীহ, প্রাচীন রীতিতে একক প্রেমে বিশ্বাসী। প্রেম নষ্ট হয়ে গেছে। কষ্ট ওনাকে ঘিরে আছে। ভোলার জন্যে কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই।
আমার তৃতীয় প্রেমিকা এই শহর, বনগাঁ। বনশ্রী, আমার শ্রী। সৃজা, শ্রীমতির সাথে আমি শ্রীকেও ভালবেসেছি, শ্রীর তারা ভর্তি আকাশ, আলো ভরা পথ, ধোঁয়াশার মৃদু রহস্য মেখে শ্রীর সঙ্গে হেঁটে চলেছি।
সাইকেলের পিছনে একবোঁচকা বই। বইয়ের ঝুল সামলাতে গিয়ে হঠাৎ পড়ে যাচ্ছিলেন কাকু। সাইকেলে ভর রেখে দাঁড়িয়ে গেলেন। আমি ধরতে যাচ্ছিলাম। উনি একাই সামলে নিলেন। একটু দাঁড়িয়ে, দু’জনে আবার চলতে শুরু করলাম। চুপচাপ। বড়ো একটা কথা কেউ বলছি না। হাঁটছি। সৃজানকে হারিয়ে কাকু ভাঙা সাইকেলখানাকে বোধ হয় ভালবেসেছেন। নিজেও জানেন না। প্রেমিক মানুষ নিজের অজান্তেও ভালবাসাহীন থাকে না।
মগ্নতার গভীর থেকে জিজ্ঞেস করেন –ইছামতির গভীরতা বলতে পারো?
প্রশ্নের তল খুঁজে পাই না। বলি –চল্লিশ পঞ্চাশ হাত হবে।
-মাঝে মাঝে ইচ্ছে হয়, ইছামতির গভীরে নেমে যাই।
ভয় পাই। অভাবের জ্বালায় উনি কি আত্মহত্যার কথা ভাবছেন? জিজ্ঞাসু ইচ্ছা নিয়ে নিশ্চুপ থাকি। নিস্তব্ধতার প্রশ্ন উনি বুঝতে পারেন। আর একবার সাইকেলের টাল সামলে, উত্তর দেন –তুমি বাবা দ্যাখোনি। ভাঙা দোকানের চুন বালি সিমেন্টের সাথে গাদা গাদা বই ময়লা ফেলা গাড়ি ভর্তি করে মাঝ নদীতে ফেলে দিয়েছে। শ’য়ে শ’য়ে বই ডুবে আছে ইছামতির গভীরে।
বইকে ভালবেসেই সৃজানের জন্ম দিয়েছিলেন। অন্যমনস্ক হয়ে খানিকক্ষণ পথ হাঁটেন। আবার বলেন –সৃজা বলে, বই নাকি ভেসে যায়। ও জানে না, বই জ্ঞানের আঁধার। কতো ভারি হয়। তুমি বাবা ওকে একটু বুঝিও।
আমি স্মৃতির ভাষাতেই বলি –কাকু, ও ঠিকই বলে। ইছামতি চোখের জলের নদী। চোখের জল বইয়ের চেয়ে ভারি হয়।
সৃজার বই, অঙ্কের খাতা, শ্রীমতির জলে ভেসে যায়। শ্রীর বুকে হাঁটতে হাঁটতে টের পাই চোখের জলের গভীরতা পাশে পাশে হেঁটে চলেছে।
কাকু বলেন – মেয়েটা আর কতো কাঁদবে? চোখের জলে আর কতো বই ভাসবে, বলো? পেট ভরে খেতে পেলে ছেলে-মেয়েদুটো বই মাথায় করে রাখে। তুমি বাবা ওকে একটা চাকরি দেখে দিতে পারো?
বুঝতে পারি প্রেমিক মানুষেরা আত্মহত্যার কথা ভাবে না।
বুঝতে পারিনি বাবা পাহারায় থাকবেন। ফিরেছিলাম, তখন রাত্রি তৃতীয় প্রহর। বৈজুকাকুকে খানিক সঙ্গ দিয়ে হারিয়ে গিয়েছিলাম বনশ্রীর বুকে। মা সদর
ভেজিয়ে রাখতেন। বাবা সে রাতে নিজে হাতে দরোজায় খিল এঁটে দিয়েছেন। নিজের বাড়িতে নিজেই পাঁচিল টপকে নেমে বাবার মুখোমুখি। চোর দায়ে ধরা পড়ে গেলাম। অন্ধকারে চেয়ার পেতে বসে আছেন।
-এতো রাত কোথায় ছিলে?
মাথা নীচু করে ছিলাম। উত্তর দিইনি।
-বৈজু সামন্তর বাড়ি?
-না।
-মিথ্যে বলতেও শিখে গেছো।
কোনো উত্তর দিইনি।
-নিজের মান-সম্মানতো খুইয়ে বসে আছো। তোমার জন্যে আমাদেরটুকু বিসর্জণ দিতে পারবো না। যা দরকার গুছিয়ে নিয়ে কাল সকালে বাড়ি থেকে বিদেয় হও। তোমার মাও ঘুমিয়ে বাঁচবেন। বাড়ির মান-সম্মান নিয়ে যেদিন ফিরতে পারবে, ফিরে এসো।
বাবার সামনে আমি আর দাঁড়াইনি। নিঃশব্দে সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠে গিয়েছিলাম। ওঠার আগে দেখেছিলাম, মা দরোজার আড়ালে মুখে আঁচল চেপে দাঁড়িয়ে আছেন। আমার অপরাধে তাঁর মুখ মাটির দিকে মিশে গেছে। মৃদু অথচ আকুল উচ্চারণে শুনেছিলাম মা ডাকছেন –খোকা, ফিরে আয়। খেয়ে যা।
মায়ের সেই কান্নাভেজা কণ্ঠস্বরে বাবার কতোখানি নিষ্ঠুরতা মিশে ছিলো, বুঝেছিলাম, যখন বাকি রাত মায়ের দেখা পেলাম না। সন্তানকে অভুক্ত রাখার কষ্টে মা তার খিদে ঘুম হারিয়ে বসে ছিলেন বাবার পায়ের কাছে। নীচের চতুষ্কোণ ঘরখানা কবে যেনো জেলখানা হয়ে গেছে, জানতেও পারেননি। কতো রাত তাঁর অনিদ্রায় অনাহারে কেটেছে, আমিও হিসেব রাখিনি।
ভোররাতে ঘুমিয়ে পড়েছিলেম। নেওয়াপাতি পাতলা ঘুম, ঠুক ঠুক শব্দে ভেঙে গেলো।
ভাবলাম, এতক্ষণে মা আসার সুযোগ পেয়েছেন। উঠে, দরোজা খুলে দেখি, হ্যাঁ মা, সঙ্গে সৃজা। সৃজার হাতে ঝোলানো ঢাউস একটা ব্যাগ। । ওকে দুয়োরে রেখে মা নীচে নেমে গেলেন। আমি আর সৃজা মুখোমুখি। কালকের অপরাধবোধ ফিরে এলো। গলা নামিয়ে বললাম –ভিতরে এসো।
নতমুখ সৃজা পাখির মতো নিশঃব্দে ঢুকে পড়লো ঘরে। জড়িয়ে ধরলাম বুকের মধ্যে। হাত থেকে ব্যাগ পড়ে গেলো। আশ্চর্য, আমাকে ঠেলে ফেলে দিলো না।
চোখ পাকিয়ে বললো না –যাঃ, ছাড়ো!
কোনো রাগ, অভিমান, প্রতিবাদ কিছুই জানালো না। নরম গলে যাওয়া পাখির মতো বুকের মধ্যে মিশে গেলো। এমন ভাবে এক হয়ে যাওয়া জীবনে এই প্রথম। যেনো এক বেহিসেবি সময় পার হয়ে যাচ্ছি। সুখে তবু উৎকণ্ঠায় তীব্র উদগ্রীব। রাত মাথায় করে কেনো, কিসের ব্যাগ? জিজ্ঞেস করলাম -কী হয়েছে ?
উত্তর দিলো না। বিছানায় বসলো। ইশারায় দুয়ার বন্ধ করে দিতে বললো। তখনও সৃজার দিকে পিছন ফিরে দুয়ার বন্ধ করছি। বললো –পালিয়ে এলাম।
দরোজা এবং দম বন্ধ হয়ে এলো। জানি, সাংঘাতিক একটা কিছু হয়েছে ।
আমাকে নয়, সৃজা ধীরে ঘাড় হেঁট করে মেঝের সঙ্গে কিছু কথা বলছে -বিকেলে মিটিং হয়েছে তোমাদের বাড়ি। রাতে হলো আমাদের বাড়ি। বাড়ির লোকেরা সন্দেহ করছে আমার পেটে তোমার বাচ্চা আছে। নিজের জ্যাঠা, কাকা, দাদারা –ছিঃ! এমনকি পাড়ার হরি জ্যাঠাও ছিলেন। বাবা কাল অনেক রাতে বাড়ি ফিরেছিলো।
-আমি জানি।
- ওরা বাবার জন্যে অপেক্ষা করেনি। হুমকি দিয়েছে, পাড়া থেকে তুলে দেবে। মাকে অপদস্ত করেছে। মা নাকি আসল কালপ্রিট। মার আস্কারাতেই চাকরি করা ছেলে ধরতে বেরিয়েছি। ওরা নিশ্চিত, আমার পেটে একটা আছেই। তার নাকি ঠিকঠিকানা নেই।
এবার সৃজা কেঁদে ফেললো।
-এরা আমার দাদা, কাকা, জ্যাঠা প্রিয়জন! কাল সকালেই এক দাদা জোর করে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবে, পেটে বাচ্চা আছে কিনা পরীক্ষা করাতে।
আমি ওর পাশে বসি। সৃজা মেরুদণ্ড সোজা রেখে বসে আছে। আমাকে স্পর্শ করে না।
বলে – ঘরে ফিরে সব শুনেছেন বাবা। কিছুই বলেননি। গরীব বলে মা-বাবা মুখ বুঁজে সব সহ্য করছেন আর অসহায় চোখে আমার দিকে তাকিয়ে থাকেন। সহ্য করতে পারিনি। পালিয়ে এসেছি।
ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিই। বলি –ঠিক করেছো।
আদর পেয়ে ডুকরে কেঁদে ওঠে সৃজা। বলি –চুপ, চুপ। পাশের ঘরে কাকা-কাকিমারা। শুনে ফেলবে।
-ফেলে ফেলুক। আর পারছি না।
কী করি? আমারও বিদেয় বাজনা বেজে গেছে। বাবা বলেছেন, মান-সম্মান নিয়ে ফিরে এসো। বাবার সম্মানতো সৃজার একসিঁথি সিঁদুর। একপাতা সিঁদুরের দাম। দু’টাকা। বাবার সম্মান।
গোবরডাঙ্গা জমিদারবাড়ির বড়ো তরফে শিবলিঙ্গের যেমন মন্দির আছে, পার্বতিলিঙ্গেরও মন্দির আছে। পাশাপাশি। দু’টাকার সিঁদুর, দু”টাকার সন্দেশ, আর ষোলোআনার দক্ষিণা দিয়ে পাঁচটাকার বিয়েটা সেরে ফেললাম। তারপর আমাদের সামনে অথৈ নীল আকাশ। হৈ হৈ বাতাস। আর হাজা মজা নাম-গোত্রহীন এক যমুনার ঢেউ। একটা ভ্যানরিকসা ভাড়া করে ফেললাম । সারাদিন শুধু বনবন, সারাদিন শুধু চরকি, আমবাগান, ম্যাটিনি শো সিনেমা, তারপর মান-সম্মান নিয়ে বাড়ি ফেরা। ট্রেনে কুড়িমিনিটের পথ।
কিন্তু ফিরিনি। অভিমানে, অহংকারে, অপমানের প্রতিশোধ নিলাম।
সেদিনই বিকেলবেলা, দু’জন দাঁড়িয়ে ছিলাম, গোবরডাঙ্গা স্টেশনে রেলওয়ে ব্রীজের অনেক উঁচুতে। এখান থেকে বহুদূর দেখা যায়। রেললাইন চলে গেছে আমাদের দুজনেরই বাড়ির দিকে। তাকিয়ে আছি। জন্মভিটে এক আশ্চর্য চুম্বক। একমুখে অসহ্য টানে অন্য মুখে নিদারুণ ঠেলছে, কষ্ট দিচ্ছে, কিছুতেই কাছে ঘেঁষতে দিচ্ছে না।
অন্যদিন পথে আঙুলের মাথাটুকুও সৃজা ছুঁতে দেয় না। আজ সে আমার বিবাহিতা স্ত্রী। দু’জনে হাত ধরাধরি করে দাঁড়িয়ে আছি। আজ না হোক কাল, কাল না হোক পরশু, একদিন না একদিন বাবা ডেকে পাঠাবেনই। তক্ষণি যে ট্রেন প্রথম আসুক, সব ফেলে-ঝেলে বাড়ি চলে যাবো। জানালায় দু’জনে পাশাপাশি বসবো। হু হু বাতাসের গতিতে ছুটে যাবো মায়ের কাছে। বাবা বারান্দায় বসে থাকবেন, হাতলওয়ালা সেই শক্ত কাঠের চেয়ারে।
বলবেন –এইতো বাপকো বেটা, সিপাইকো ঘোড়া, কুছ নেহিতো থোড়া থোড়া। মান-সম্মান লেকে লৌট আয়া।
মা হিন্দি-পিন্ডি কিছু বুঝতে না পেরে বলবেন –সারাদিন কিছু খায়নি। এখন ওদের আর বোকো না। দুটো খেয়ে নিক। তারপর মারতে হয় মেরো, কাটতে হয় কেটো। আয়, ঝুম দুটো আসন পেড়েনেতো মা। দু’জনে পাশাপাশি বোস। যা হোক চাড্ডি মুখে দে।
ঝুমও কি তাই ভাবছে! ওর মুখের দিকে তাকালাম। এক মাথা কপাল নতুন সিঁদুরে মাখামাখি। আমাদের পিছন দিয়ে ট্রেনের প্যাসেঞ্জার যাচ্ছে আসছে। কতো হকার, ফেরিওয়ালা। এপার থেকে ওপারে মানুষেরা যাওয়া আসা করছে। ঝুম একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে নীচে প্লাটফর্মে। ওভারব্রীজের নীচ দিয়ে একজন ফেরিওয়ালা হেঁকে যাচ্ছে।
-শ্লেট, পেনসিল, হাতেখড়ি, বর্ণবোধ.. ..
আমি আর ঝুম মুখ চাওয়া-চাওয়ি করলাম। কেঊ কাঊকে কিছু বললাম না। পিছন থেকে ফেরিওয়ালাটিকে দেখতে অবিকল বৈজুকাকার মতো। চুলহীন মাথার মাঝখান। চকচক করছে। পিছনে বাবরি চুলের দু’একগাছি উড়ছে। ঝুমের গলা ভারি ঠেকলো। বললে - আমাদের সাইকেলটা কাল রাতে বিক্রি হয়ে গেছে। বেরুবার মুখে বিক্রির দুশোটাকা বাবা আমায় দিয়েছিলেন। আজ থেকে পায়ে হেঁটে হকারি করবেন।
ওভারব্রীজের সিঁড়ি ভেঙে হুড়মুড়িয়ে নামতে শুরু করলাম। নতুন বঊ ঝুমও দুপ-দাপ শব্দে নামছে আমার পিছন পিছন। একছুটে দু’জনে দাঁড়িয়ে গেলাম ফেরিওয়ালার সামনে। না, বৈজুকাকা নয়। অবিকল, অবিকল বৈজুকাকার মতো দেখতে। কতো যে বৈজুকাকা আছে, কে জানে! ঝুম খুব বোকা। একদম বোঝে না। স্বচক্ষে দেখছে তার বাবা নয়। তবু ছলছল হয়ে এলো চোখ। হঠাৎ ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো। কান্না খুব ছোঁয়াচে। চোখের দু’কুল ছাপিয়ে কান্না আমাকেও ধাক্কা দিচ্ছে। বুঝতে পারছি বুক ভারি হয়ে উঠছে। চোখের পিছনে বাষ্প জমে উঠেছে। ভেবেছিলাম, প্রেমিক কাকু বিরহ সহ্য করতে পারেননি। তার প্রথম প্রেমসৃজান। হারিয়ে গেছে। পিতার প্রেম তার সন্তানেরা। দ্বিতীয় প্রেমিকা সৃজা। সেও হারিয়ে যেতে বসেছে। খোয়া যেতে যেতে যদি আর একবার দেখা হয় তার সাথে, সেই আশায় ছুটে এসেছেন। কণ্ঠস্বর শক্ত করে বললাম –ঝুম, কেঁদো না।
ফেরিওয়ালা অচেনা দু’জন নবদম্পতির অবরোধে হকচকিয়ে গেছেন। থমকে দাঁড়িয়ে, জিজ্ঞেস করলেন –কী চাই?
দু’জনেই ঢিপ করে প্রণাম ঠুকে দিলাম। শশব্যস্ত হয়ে বেচারি দু’পা পিছিয়ে দাঁড়ায়। -আমাকে কেনো? আমাকে কেনো?
সৃজা বলে ওঠে –আশির্বাদ করুন বাবা।
-সেকি, আমি কেনো, মা?
আমি বলে উঠি –নতুন বিয়ে করে আসছি। দেখা হলো। আপনারা গুরুজন। আশির্বাদ করবেন না?
-নিশ্চয়, নিশ্চয় আশির্বাদ করবো।
ফেরিওয়ালা হতবাক। নির্ণিমেষ চোখে চেয়ে আছেন আমাদের দিকে। কী জানি, দূরে, ঘরে দোরে পৃথিবীর কোথাও না কোথাও তার কোনো প্রেমিকার কান্না ভরা মুখ চোখের সামনে ভেসে উঠলো কিনা, কে জানে?
-কিন্তু কী আশির্বাদ করি বাবা। আমারতো কিছুই নেই।
হঠাৎ কী যেনো মনে পড়ে গেছে, কাঁধে সাততালি মারা আলাদীনের আশ্চর্য ব্যাগ। হাতড়াতে শুরু করেছেন। ব্যাগ থেকে বের করে সৃজার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললেন -শ্লেট, পেনসিল, বিদ্যাসাগরের এই বর্ণপরিচয়খানা নাও মা। তোমাদেরতো পারলাম না। তোমার সন্তানদের আশির্বাদ করছি।
সৃজা তখন ডুকরে কেঁদে উঠেছে। ফেরিওয়ালা একটু থেমে কী ভাবলেন। তারপর বললেন –বিনিপয়সায় আশির্বাদ করতে পারলে খুশি হতাম। তিনটাকা বারোআনা।
চুপ করে, আবার ভাবলেন। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন – না থাক, নেবো না। তোমাদের মঙ্গল হোক।
-অমঙ্গল হবে না। আপনি এটা রাখুন।
দিলাম। জোর করেই পয়সাক’টা দিলাম।
কান্না লুকাতে আমরা তখন ওভারব্রীজে ফের উঠে এসেছি। ফেরিওয়ালা স্টেশনের প্লাটফর্ম পেরিয়ে, রেললাইনের সমান্তরাল ধরে, এগিয়ে চলেছেন। ওদিকে জঙ্গল, যমুনানদীর হাজামজা খাল, মানুষের গতিগম্যা নেই, লোকালয় নেই, ওখানে তার পশরা কে কিনবে?
হাঁকতে হাঁকতে চলে যাচ্ছেন – শ্লেট, পেনসিল, হাতেখড়ি, বর্ণবোধ .. .. ..
আমি তাকিয়ে আছি, বৈজুকাকাদের ছাড়িয়ে, দূরে, ভবিষ্যতের দিকে।
সৃজা বললো –কেনা দামে দিয়ে গেলো মানুষটা। বাবা বেচলে দাম পেতো চারটাকা দু’আনা। আটগণ্ডা পয়সা জলে গেলো।
দৃষ্টি না ফিরিয়ে জিজ্ঞেস করি –তাই কি?
চোখের জলের উত্তর শোনা যায় না।
1 মন্তব্যসমূহ
শ্রীমতি আরো গভীর হল। লেখক, সৃজার হাত ধরে ভাসলাম। বৈজুকাকার সাথে তলিয়ে গেলাম। অনবদ্য।
উত্তরমুছুন