হেলাল হাফিজ এর একটা বিখ্যাত কবিতা আছে কষ্ট নিয়ে। ছোটবেলায় পড়া কবিতাটির ঠিক মানে বুঝিনি আমি। কষ্ট আবার লাল বা নীল হয় কেমন করে! তবে পাথরের চাপে পড়ে সবুজ ঘাস আলো বাতাসের অভাবে সাদা হয়ে যাওয়ার কষ্ট বুঝেছিলাম গাছের প্রতি অতিরিক্ত ভালবাসা থেকে। আমাদের বাড়ীর সামনে ছিলো একচিলতে জায়গা।
সেখানে মনের মাধুরি মিশিয়ে তৈরি করেছিলাম বাগান। পুরো জায়গা জুড়ে পরিপাটি করে কাটা সবুজ ঘাস। মাঝে মাঝে নানা মৌসুমি ফুলের কেয়ারি। শীতের শুরুতেই নানা জাতের রঙ্গিন ফুলে ঝলমল করতো সে বাগান। বাগানের প্রতিটি গাছের সাথে আমার ছিলো সখ্য। দুটি পাতার ছোট চারা থেকে ফুল ঝড়ে পড়া পর্যন্ত গাছের প্রতিটি পরিবর্তন লক্ষ্য করতাম মুগ্ধতা আর বিস্ময় নিয়ে। কেউ গাছের ক্ষতি করলে কেঁদে ভাসিয়ে দিতাম আমি। মাঝে মাঝে আমার অনুপস্থিতিতে প্রাচীরের ইট খসে পড়ে সবুজ ঘাস হলুদ হয়ে গেলে কষ্টের সীমা থাকতো না। হলুদের আভা যে কারনে এখনও আমার কাছে কষ্টের প্রতীক হয়ে ধরা দেয়। নিবিড় পরিচর্যায় হলুদ ঘাসকে আবার সবুজ করে তুলতাম। সেই সবুজের সান্নিধ্য মনকে আবার সতেজ করে তুলতো। সবুজ আর রঙ্গিন বাগানের দীপ্তির টানে প্রতিদিন চলে আসতো অনেকেই। রঙ লাগা বয়সের কারনে তখন পছন্দের কাউকে লক্ষ্য করে আপন মনে হয়তো গাইতাম কুমার বিশ্বজিতের সেই গান- তুমি রোজ বিকেলে আমার বাগানে- - - - ।
দশ বছরের সংসার জীবন পাড় করে বুঝেছি কবি আসলে ভালবাসাহীন জীবনে ইচ্ছার বিরুদ্ধে চলতে চলতে জীবনী শক্তি নিঃশেষ হয়ে যাওয়া নর বা নারীর কষ্টকে বোঝাতে চেয়েছেন কবিতায়। আমার জীবনের কষ্ট আসলে পাথর চাঁপা সাদা ঘাসের মতোই বর্ণহীন।
মফস্বল শহরের মেয়ে আমি। নাম অহনা। নিজে যতোটা না আধুনিক তার চেয়ে আধুনিক আমার নাম। শিল্প সংস্কৃতির সাথে জড়িত বাবা পছন্দ করে রেখেছিলেন এ নামটি। বুদ্ধি হওয়ার পর বাবার কাছে জানতে চেয়েছিলাম অহনা শব্দের মানে কি? বাবা কাব্য করে বলেছিলেন-অহনা, নিজের নামের মানে কাউকে কহ না।
আমার গায়ের রং কালো, তবে বাবা মার মুখে কখনও শুনিনি আমি কালো। তাঁরা প্রায়ই গর্ব করে বলতেন-শ্যাম বর্নের মেয়েটি আমাদের শান্ত আর বুদ্ধিমান। স্কুলের বন্ধুরা সুযোগ পেলেই আমাকে লক্ষ্য করে সুরে সুরে গাইতো-কৃষ্ণ কলি আমি তরে বলি---। তবে কালো বা শ্যামা যাই হই না কেন আমি যে কিছুটা সুন্দরি তা টের পাই মাঝে মাঝে। পারিবারিক বা সামাজিক অনুষ্ঠানে যেখানে সেজে গুজে যাওয়ার একটু সুযোগ থাকে সেখানে অনেকেই বলে-ভাবী আপনার রঙটা শ্যামা তবে আড়ং এর মডেল কন্যাদের মতো আপনার একটা আলাদা সৌন্দর্য আছে, যাকে বলে কৃষ্ণ সুন্দরি, রবীন্দ্রনাথের ভাষায় কৃষ্ণকলি। এসব কথায় আমি আনন্দিত বা পুলকিত হই না, আমার মাঝে সবসময় ভর করে কষ্ট, পাথর চাপা সাদা ঘাসের কষ্ট।
উচ্চ মাধ্যমিকে পড়ার সময়টায় আমার বিয়ের কথা হয়। সে সময়টা কল্পনার জগতে ভেসে বেড়ানো প্রজাপতির বয়স। মার কাছে বিয়ের ব্যাপারে মৃদু আপত্তি করি ঠিকই কিন্তু শীতের সকালে শিশির বিন্দুর স্নিগ্ধ পরশ গাছের ডগায় যেমন আলতো করে ছুঁয়ে থাকে ঠিক তেমনি করে সে খবর আমার টগবগে কচি মনে শিহরণ জাগায়। ভিতরে ভিতরে রোমাঞ্চিত হই, কল্পনার সংসার সাজাই মনে মনে।
পরীক্ষার পরপরই বিয়ে হয়ে যায় সিভিল সার্ভিস পাশ করা এক চাকুরিজীবির সাথে। পাতলা ফর্সা রুচিশীল আমার বর। সবসময় পরিপাটি পোষাক পড়া মার্জিত রুচির কারনে বাবার পছন্দের পাত্র আমারও পছন্দ হয়ে যায় খুব অল্প সময়ে। ভালবাসা আর ভালো থাকার প্রত্যয় নিয়ে গড়ে ওঠে সুখের সংসার।
ভালোই চলছিলো আমার জীবন। কোন বদ অভ্যাস নেই আমার স্বামীর। চা খায় না, সিগারেট খায় না, রঙিন পানির স্পর্শ কোনদিন পেয়েছিলেন তেমনটি মনে হয় না। ভাল কিংবা খারাপ বন্ধুও নেই। অফিস শেষ করে সরাসরি বাসায় চলে আসে। পড়ন্ত বিকেলের সময়টা দুকাপ চা নিয়ে এক চিলতে বারান্দায় কাটিয়ে দেই। মাঝে মাঝে শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতির পাঠ নেই তার কাছে। অপরিচিত কিছু শব্দ - কবিতার ছন্দ, কথা সাহিত্যের ম্যাজিক রিয়ালিজম, প্রবন্ধ ও নিবন্ধের নিগুঢ় পার্থক্য শুনতে শুনতে আত্নস্থ করে ফেলি। নিজেকে শিল্প বোদ্ধা না হলেও শিল্প সাহিত্যের নবীন ছাত্রী ভাবতে ভালোই লাগে।
অফিসে সৎ ও দক্ষ কর্মকর্তা হিসেবে পরিচিতি আছে তার। তাই মাঝে মাঝে বাসায় যখন নথি খুলে বসে তখন আপত্তি করি না, কাজের প্রতি নিষ্ঠা আর সততার জন্য গর্ববোধ করি। মাসিক বেতনের নির্ধারিত টাকায় সংসার চালানোর সাধ্যমতো চেষ্টা করি। লাউ কিংবা পটলের তরকারি রান্নার পর ছোলাটা ফেলি না। তা দিয়ে পরের দিন মজাদার কিছু রান্না করে চমকে দেই। অফিস শেষের সময়টাতে দরজার পাশে কলিং বেলের শব্দের অপেক্ষায় থাকি। প্রাচুর্য না থাকলেও আমর ছিলো ঐশ্বর্য, ছিমছাম গোছানো সংসার, পড়তে পড়তে যত্নের ছাপ।
কম কথা বলার অভ্যেস তার। বই পত্রিকা পড়ে সময় কাটায়। মাঝে মাঝে লেখালেখি করে। এক প্যারা লিখতে গিয়ে বারবার ডিকশনারি খোঁজে, লেখা যথাসম্ভব নির্ভুল করার চেষ্টা করে। আমার ভালোই লাগে। সৃষ্টিশীল মানুষের সৃজনশীল চিন্তা চেতনার সাথে নিজকে খাপ খাওয়ানোর চেষ্টা করি। নিজের সুকুমার বৃত্তিগুলো প্রকাশে সচেষ্ট হই। স্কুল কলেজে রচনা লিখে অনেকবারই প্রথম হয়েছি। এখন বাসায় কেউ না থাকলে সাদা দিস্তায় গল্প কবিতা লিখে লুকিয়ে রাখি। এক চিলতে বারান্দায় তৈরি করি বাগান, মনের মাধুরি মিশিয়ে। সে বাগানে লকলক করে বেড়ে ওঠে পছন্দের গাছ। খুব কম সময়ে সে বাগানে সবুজের মাঝে দেখা দেয় দুএকটা রঙ্গিন ফুল। সে ফুলের সুবাস আমাদের দুজনের মনকে রাঙ্গিয়ে তোলে।
হাসি-কান্না, সুখ-দুঃখ, বেদনা-ভালবাসা নিয়ে ভালোই চলছিলো আমার জীবন। মাঝে মাঝে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা কাটাকাটি, ঝগড়া বিবাদ যে হতো না তা নয়, ভালোবাসা দিয়ে সবকিছু মানিয়ে নেয়ার চেষ্টা করতাম। তবে প্রথম থেকেই একটা জিনিস খটকা লাগতো। নিপাট ভদ্রলোক স্বামী আমার সেলফোনে প্রচুর কথা বলতো। কার সাথে কথা বলছো, কি কথা বলছো জিজ্ঞেস করলে তার কোন জবাব দেয় না। কান পাতলে কথা বন্ধ করে দেয়, রাগ করলেও চুপচাপ থাকে। গভীর রাতে ফোন আসলে বিছানা থেকে উঠে বারান্দায় গিয়ে মৃদু স্বরে কথা বলে। তার এ আচরণ আমার সন্দেহ হয়। সে সন্দেহ দুর করার চেষ্টা করি। নিজেকে অনেকবার বোঝাই-মনের মাঝে একবার সন্দেহ ঢুকলে সে সন্দেহ দুর করা কষ্টকর। আমার স্বামীকে নিয়ে পাশের ফ্লাটের ভাবীরা আলোচনা করে। এ কান ও কান হয়ে সে কথা আমার কানেও আসে। আমি পাত্তা দেই না, আবার মন থেকে তা মুছেও ফেলতে পারি না।
তবে তার কিছু বিষয় আমার কাছে অস্বাভাবিক লাগে। আগের দিন ঠিক হলো সংসারের কিছু কেনাকাটার জন্য মার্কেটে যাব। সে আসবে অফিস থেকে পাঁচটার পরে আমিও বাসা থেকে রওনা দেব পাঁচটায়। আমি মার্কেটে পৌঁছে যাই সাড়ে পাঁচটায়, তখনও সে আসেনি। মোবাইলে ফোন করি সে ফোন বন্ধ পাই। অফিসের নম্বরে ফোন করি, সে ফোন বেজেই চলে, কেউ ধরে না। ধৈর্যের সীমা অতিক্রান্ত হওয়ার পর রাত আটায় মার্কেট থেকে বাসায় ফিরি একা একা। সে আসে রাত দশটায়, হাতমুখ ধুয়ে খেতে বসে যায় টেবিলে যেন স্বাভাবিক একটি সন্ধ্যা। আমার সহ্যের বাঁধ ভেঙ্গে যায়-উত্তেজিতভাবেই জিজ্ঞেস করি-
-আজ বসুন্ধরায় যাওয়ার কথা ছিলো না?
-অফিসে কাজ ছিল।
-সেলফোন বন্ধ কেন?
কোন জবাব না দিয়ে খাওয়া বন্ধ করে চরম বিরক্তি নিয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে থাকে।
-অফিসে ছিলে না অন্য কোথাও ছিলে?
-অফিসে ছিলাম।
-অফিসের ফোন ধরলে না কেন?
এ কথারও কোন জবাব না দিয়ে খাওয়া শেষ করে বিছানায় যায়। সারারাত পাশে শুয়ে নির্দাহীন রাত কাটাই। একবIরও জানতে চায় না মার্কেটে আমি কতোক্ষন ছিলাম। মার্কেটে না আসার ব্যাখ্যাও সে দেয় না।
আমার ছোটবোন পরী। অষ্টম শেনির পরীক্ষার পর এসেছে আমার বাসায় বেড়াতে। একাকী সংসারে তাকে নিয়ে আমার সময় ভালোই কাটছে। অফিস থেকে ফেরার পর আমার স্বামীও সময় দেয় তাকে। এখানে ওখানে বেড়াতে যাই তিনজন। সে ব্যস্ত থাকলে ছোটবোনটিকে নিয়ে মার্কেটে যাই, হয়তো কোন পার্কে ঘুরি। সন্ধ্যার কিছু আগে রিক্সায় করে ছোট বোনটিকে নিয়ে ধানমন্ডি লেকে যাচ্ছিলাম আমি। লেকের পাশে মুল রাস্তার ধারে রিক্সা থেকে নামছিলাম। পাশ দিয়ে লাল রঙের জীপ গাড়ী চলে যায়। রিক্সায় বসেই আমার ছোট বোন চিৎকার দেয়-
-দুলাইয়ের গাড়ী।
আমিও খেয়াল করি। গাড়ীতে বসা আমার স্বামীর পাশে আর একজন।
ছোটবোনের কাছে নিজেকে লুকাই, লজ্জায়, অপমানে।
রাতে বাসায় আসার পর স্বাভাবিক ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করি -
-অফিস থেকে কোথাও বের হয়েছিলে?
সে সরাসরি না বলে দেয়।
বাংলা একাডেমির বইমেলায় আমার এক বান্ধবীর সাথে দেখা হয়ে যায় তার। সাথে এক মহিলা। সে কথা চলে আসে আমর কাছে। বান্ধবীর কাছে মহিলার অন্য পরিচয় দিয়ে আমি আমার স্বামীকে উঁচুতে তুলে ধরি, মনের কষ্টকে চাপা দিয়ে।
মাঝখানে কাউকে না বলে নিঃশব্দে চলে গিয়েছিলাম বাসা ছেড়ে। তিনদিন ছিলাম বান্ধবীর বাসায়। এর মাঝে সে অফিস করেছে, নিজে রান্না করে খেয়েছে। স্ত্রীর প্রতি দায়িত্ব যেটুকু পালন করেছে, তা হলো বাবার কাছে আমার নিখোঁজ হওয়ার খবর জানিয়ে। বান্ধবীর মনে সন্দেহের দানা বাঁধার আগেই আবার ফিরে এসেছি আমার অন্ধকার ঘরে। নিরুত্তাপ স্বামী আমার স্বাভাবিক; যেন সকালে অফিস গিয়ে বিকেলে বাসায় ফেরা।
জীবন সংসার আমার আর ভাল লাগেনা, বারান্দার বাগানের গাছ চৌত্রের খরদাহে শুস্ক, পাতা বিবর্ণ, ধুসর। ঘরের চতুর্দিকে অযত্নের ছাপ, রান্নার পাতিলের তলায় থিকথিকে ঝোল শুঁকিয়ে ইউকেলিপটাসের বাঁকলের মতো বাঁকা হয়ে উঠে থাকে। স্বামীকে নিয়ে গর্ব করার পরিবর্তে আমি এখন নিশ্চুপ থাকি। বিশ্বাস ভঙ্গের কষ্টে রাতে এখন আর ঘুম আসে না, চির সবুজ আমি ভালবাসা আর বিশ্বাসহীনতার দোলাচালে ফ্যাকাসে হয়ে যাচ্ছি। কষ্টের পাথর আমার উপর চেপে বসে আলো বাতাস আর অক্সিজেন সরবরাহে বাঁধা দিচ্ছে। আমি হয়ে যাচ্ছি পাথর চাপা সাদা ঘাস, অচিরেই মিলিয়ে যাব মাটির সাথে।
এরমাঝে একদিন একাকী বাসায় ঞ্জানহীন পড়েছিলাম কতটা সময়। স্বামী আমার অফিস থেকে দেরি করে ফিরে দরজা ভেঙ্গে উদ্ধার করে নিয়ে যায় হাসপাতালে। হাসপাতালে অবশ্য থাকতে হয়নি। কিছু পরীক্ষা নিরিক্ষার পর ছেড়ে দিয়েছে সেদিনই।
দুদিন পরের ঘটনা। স্বামী আমার বরাবরের মতোই অফিস থেকে ফিরলেন দেরিতে, সন্ধার অনেক পর। হাতে বড় একটি মিষ্টির প্যাকেট, তার উপর ছোট একটি প্যাকেট, নীল রঙের গিফট পেপারে মোড়ানো। মিষ্টি কেন, গিফট কার বললেও সে কোন জবাব দিল না। অফিসের কাপড় বদলিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে ঢুকে গেল ওয়াসরুমে। খামটি হাতে নিলাম, বাসর রাতে স্বামী আমার যে নামে সন্মোধন করেছিল সে নামটি লেখা। সাহস করে নীল কাগজে মোড়ানো প্যাকেটটি খুললাম। যে হাসপাতালে গিয়েছিলাম সে হাসপাতালের বেশ কিছু রিপোর্ট। সে রিপোর্টের উপর আমার স্বামীর সুন্দর হস্তাক্ষরে লেখা- পিতৃত্বের চেয়ে অন্য কোন সম্পর্ক বড় হতে পারে না।
আমি বিস্মিত আনন্দিত, পাশাপাশি একটি নীল কষ্টের বোঝার ভারে নুয়ে পড়ার অবস্থা। এতোদিন ছিলো অবৈধ সম্পর্কের সত্য মিথ্যার দ্বন্ধ। সরল স্বীকারোক্তির পর জগদ্বল পাথরের মতো তা আরও চেঁপে বসলো বুকের উপর। জানিনা সে পাথর সরিয়ে আলো বাতাসে তা সবুজ হতে কত সময়ের প্রয়োজন।
লেখক পরিচিতি
মোমিনুল আজম
জন্মেছেন - ১৯৬৫ সালে, গাইবান্ধায়
পড়াশুনা করেছেন- শের ই বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে
কাজ করেন- বাংলাদেশ ডাক বিভাগে
বর্তমানে- কানাডায় থাকেন
ফিলাটেলি- ডাকটিকিট সংগ্রহের শখ নামে একটি প্রকাশনা আছে।
সেখানে মনের মাধুরি মিশিয়ে তৈরি করেছিলাম বাগান। পুরো জায়গা জুড়ে পরিপাটি করে কাটা সবুজ ঘাস। মাঝে মাঝে নানা মৌসুমি ফুলের কেয়ারি। শীতের শুরুতেই নানা জাতের রঙ্গিন ফুলে ঝলমল করতো সে বাগান। বাগানের প্রতিটি গাছের সাথে আমার ছিলো সখ্য। দুটি পাতার ছোট চারা থেকে ফুল ঝড়ে পড়া পর্যন্ত গাছের প্রতিটি পরিবর্তন লক্ষ্য করতাম মুগ্ধতা আর বিস্ময় নিয়ে। কেউ গাছের ক্ষতি করলে কেঁদে ভাসিয়ে দিতাম আমি। মাঝে মাঝে আমার অনুপস্থিতিতে প্রাচীরের ইট খসে পড়ে সবুজ ঘাস হলুদ হয়ে গেলে কষ্টের সীমা থাকতো না। হলুদের আভা যে কারনে এখনও আমার কাছে কষ্টের প্রতীক হয়ে ধরা দেয়। নিবিড় পরিচর্যায় হলুদ ঘাসকে আবার সবুজ করে তুলতাম। সেই সবুজের সান্নিধ্য মনকে আবার সতেজ করে তুলতো। সবুজ আর রঙ্গিন বাগানের দীপ্তির টানে প্রতিদিন চলে আসতো অনেকেই। রঙ লাগা বয়সের কারনে তখন পছন্দের কাউকে লক্ষ্য করে আপন মনে হয়তো গাইতাম কুমার বিশ্বজিতের সেই গান- তুমি রোজ বিকেলে আমার বাগানে- - - - ।
দশ বছরের সংসার জীবন পাড় করে বুঝেছি কবি আসলে ভালবাসাহীন জীবনে ইচ্ছার বিরুদ্ধে চলতে চলতে জীবনী শক্তি নিঃশেষ হয়ে যাওয়া নর বা নারীর কষ্টকে বোঝাতে চেয়েছেন কবিতায়। আমার জীবনের কষ্ট আসলে পাথর চাঁপা সাদা ঘাসের মতোই বর্ণহীন।
মফস্বল শহরের মেয়ে আমি। নাম অহনা। নিজে যতোটা না আধুনিক তার চেয়ে আধুনিক আমার নাম। শিল্প সংস্কৃতির সাথে জড়িত বাবা পছন্দ করে রেখেছিলেন এ নামটি। বুদ্ধি হওয়ার পর বাবার কাছে জানতে চেয়েছিলাম অহনা শব্দের মানে কি? বাবা কাব্য করে বলেছিলেন-অহনা, নিজের নামের মানে কাউকে কহ না।
আমার গায়ের রং কালো, তবে বাবা মার মুখে কখনও শুনিনি আমি কালো। তাঁরা প্রায়ই গর্ব করে বলতেন-শ্যাম বর্নের মেয়েটি আমাদের শান্ত আর বুদ্ধিমান। স্কুলের বন্ধুরা সুযোগ পেলেই আমাকে লক্ষ্য করে সুরে সুরে গাইতো-কৃষ্ণ কলি আমি তরে বলি---। তবে কালো বা শ্যামা যাই হই না কেন আমি যে কিছুটা সুন্দরি তা টের পাই মাঝে মাঝে। পারিবারিক বা সামাজিক অনুষ্ঠানে যেখানে সেজে গুজে যাওয়ার একটু সুযোগ থাকে সেখানে অনেকেই বলে-ভাবী আপনার রঙটা শ্যামা তবে আড়ং এর মডেল কন্যাদের মতো আপনার একটা আলাদা সৌন্দর্য আছে, যাকে বলে কৃষ্ণ সুন্দরি, রবীন্দ্রনাথের ভাষায় কৃষ্ণকলি। এসব কথায় আমি আনন্দিত বা পুলকিত হই না, আমার মাঝে সবসময় ভর করে কষ্ট, পাথর চাপা সাদা ঘাসের কষ্ট।
উচ্চ মাধ্যমিকে পড়ার সময়টায় আমার বিয়ের কথা হয়। সে সময়টা কল্পনার জগতে ভেসে বেড়ানো প্রজাপতির বয়স। মার কাছে বিয়ের ব্যাপারে মৃদু আপত্তি করি ঠিকই কিন্তু শীতের সকালে শিশির বিন্দুর স্নিগ্ধ পরশ গাছের ডগায় যেমন আলতো করে ছুঁয়ে থাকে ঠিক তেমনি করে সে খবর আমার টগবগে কচি মনে শিহরণ জাগায়। ভিতরে ভিতরে রোমাঞ্চিত হই, কল্পনার সংসার সাজাই মনে মনে।
পরীক্ষার পরপরই বিয়ে হয়ে যায় সিভিল সার্ভিস পাশ করা এক চাকুরিজীবির সাথে। পাতলা ফর্সা রুচিশীল আমার বর। সবসময় পরিপাটি পোষাক পড়া মার্জিত রুচির কারনে বাবার পছন্দের পাত্র আমারও পছন্দ হয়ে যায় খুব অল্প সময়ে। ভালবাসা আর ভালো থাকার প্রত্যয় নিয়ে গড়ে ওঠে সুখের সংসার।
ভালোই চলছিলো আমার জীবন। কোন বদ অভ্যাস নেই আমার স্বামীর। চা খায় না, সিগারেট খায় না, রঙিন পানির স্পর্শ কোনদিন পেয়েছিলেন তেমনটি মনে হয় না। ভাল কিংবা খারাপ বন্ধুও নেই। অফিস শেষ করে সরাসরি বাসায় চলে আসে। পড়ন্ত বিকেলের সময়টা দুকাপ চা নিয়ে এক চিলতে বারান্দায় কাটিয়ে দেই। মাঝে মাঝে শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতির পাঠ নেই তার কাছে। অপরিচিত কিছু শব্দ - কবিতার ছন্দ, কথা সাহিত্যের ম্যাজিক রিয়ালিজম, প্রবন্ধ ও নিবন্ধের নিগুঢ় পার্থক্য শুনতে শুনতে আত্নস্থ করে ফেলি। নিজেকে শিল্প বোদ্ধা না হলেও শিল্প সাহিত্যের নবীন ছাত্রী ভাবতে ভালোই লাগে।
অফিসে সৎ ও দক্ষ কর্মকর্তা হিসেবে পরিচিতি আছে তার। তাই মাঝে মাঝে বাসায় যখন নথি খুলে বসে তখন আপত্তি করি না, কাজের প্রতি নিষ্ঠা আর সততার জন্য গর্ববোধ করি। মাসিক বেতনের নির্ধারিত টাকায় সংসার চালানোর সাধ্যমতো চেষ্টা করি। লাউ কিংবা পটলের তরকারি রান্নার পর ছোলাটা ফেলি না। তা দিয়ে পরের দিন মজাদার কিছু রান্না করে চমকে দেই। অফিস শেষের সময়টাতে দরজার পাশে কলিং বেলের শব্দের অপেক্ষায় থাকি। প্রাচুর্য না থাকলেও আমর ছিলো ঐশ্বর্য, ছিমছাম গোছানো সংসার, পড়তে পড়তে যত্নের ছাপ।
কম কথা বলার অভ্যেস তার। বই পত্রিকা পড়ে সময় কাটায়। মাঝে মাঝে লেখালেখি করে। এক প্যারা লিখতে গিয়ে বারবার ডিকশনারি খোঁজে, লেখা যথাসম্ভব নির্ভুল করার চেষ্টা করে। আমার ভালোই লাগে। সৃষ্টিশীল মানুষের সৃজনশীল চিন্তা চেতনার সাথে নিজকে খাপ খাওয়ানোর চেষ্টা করি। নিজের সুকুমার বৃত্তিগুলো প্রকাশে সচেষ্ট হই। স্কুল কলেজে রচনা লিখে অনেকবারই প্রথম হয়েছি। এখন বাসায় কেউ না থাকলে সাদা দিস্তায় গল্প কবিতা লিখে লুকিয়ে রাখি। এক চিলতে বারান্দায় তৈরি করি বাগান, মনের মাধুরি মিশিয়ে। সে বাগানে লকলক করে বেড়ে ওঠে পছন্দের গাছ। খুব কম সময়ে সে বাগানে সবুজের মাঝে দেখা দেয় দুএকটা রঙ্গিন ফুল। সে ফুলের সুবাস আমাদের দুজনের মনকে রাঙ্গিয়ে তোলে।
হাসি-কান্না, সুখ-দুঃখ, বেদনা-ভালবাসা নিয়ে ভালোই চলছিলো আমার জীবন। মাঝে মাঝে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা কাটাকাটি, ঝগড়া বিবাদ যে হতো না তা নয়, ভালোবাসা দিয়ে সবকিছু মানিয়ে নেয়ার চেষ্টা করতাম। তবে প্রথম থেকেই একটা জিনিস খটকা লাগতো। নিপাট ভদ্রলোক স্বামী আমার সেলফোনে প্রচুর কথা বলতো। কার সাথে কথা বলছো, কি কথা বলছো জিজ্ঞেস করলে তার কোন জবাব দেয় না। কান পাতলে কথা বন্ধ করে দেয়, রাগ করলেও চুপচাপ থাকে। গভীর রাতে ফোন আসলে বিছানা থেকে উঠে বারান্দায় গিয়ে মৃদু স্বরে কথা বলে। তার এ আচরণ আমার সন্দেহ হয়। সে সন্দেহ দুর করার চেষ্টা করি। নিজেকে অনেকবার বোঝাই-মনের মাঝে একবার সন্দেহ ঢুকলে সে সন্দেহ দুর করা কষ্টকর। আমার স্বামীকে নিয়ে পাশের ফ্লাটের ভাবীরা আলোচনা করে। এ কান ও কান হয়ে সে কথা আমার কানেও আসে। আমি পাত্তা দেই না, আবার মন থেকে তা মুছেও ফেলতে পারি না।
তবে তার কিছু বিষয় আমার কাছে অস্বাভাবিক লাগে। আগের দিন ঠিক হলো সংসারের কিছু কেনাকাটার জন্য মার্কেটে যাব। সে আসবে অফিস থেকে পাঁচটার পরে আমিও বাসা থেকে রওনা দেব পাঁচটায়। আমি মার্কেটে পৌঁছে যাই সাড়ে পাঁচটায়, তখনও সে আসেনি। মোবাইলে ফোন করি সে ফোন বন্ধ পাই। অফিসের নম্বরে ফোন করি, সে ফোন বেজেই চলে, কেউ ধরে না। ধৈর্যের সীমা অতিক্রান্ত হওয়ার পর রাত আটায় মার্কেট থেকে বাসায় ফিরি একা একা। সে আসে রাত দশটায়, হাতমুখ ধুয়ে খেতে বসে যায় টেবিলে যেন স্বাভাবিক একটি সন্ধ্যা। আমার সহ্যের বাঁধ ভেঙ্গে যায়-উত্তেজিতভাবেই জিজ্ঞেস করি-
-আজ বসুন্ধরায় যাওয়ার কথা ছিলো না?
-অফিসে কাজ ছিল।
-সেলফোন বন্ধ কেন?
কোন জবাব না দিয়ে খাওয়া বন্ধ করে চরম বিরক্তি নিয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে থাকে।
-অফিসে ছিলে না অন্য কোথাও ছিলে?
-অফিসে ছিলাম।
-অফিসের ফোন ধরলে না কেন?
এ কথারও কোন জবাব না দিয়ে খাওয়া শেষ করে বিছানায় যায়। সারারাত পাশে শুয়ে নির্দাহীন রাত কাটাই। একবIরও জানতে চায় না মার্কেটে আমি কতোক্ষন ছিলাম। মার্কেটে না আসার ব্যাখ্যাও সে দেয় না।
আমার ছোটবোন পরী। অষ্টম শেনির পরীক্ষার পর এসেছে আমার বাসায় বেড়াতে। একাকী সংসারে তাকে নিয়ে আমার সময় ভালোই কাটছে। অফিস থেকে ফেরার পর আমার স্বামীও সময় দেয় তাকে। এখানে ওখানে বেড়াতে যাই তিনজন। সে ব্যস্ত থাকলে ছোটবোনটিকে নিয়ে মার্কেটে যাই, হয়তো কোন পার্কে ঘুরি। সন্ধ্যার কিছু আগে রিক্সায় করে ছোট বোনটিকে নিয়ে ধানমন্ডি লেকে যাচ্ছিলাম আমি। লেকের পাশে মুল রাস্তার ধারে রিক্সা থেকে নামছিলাম। পাশ দিয়ে লাল রঙের জীপ গাড়ী চলে যায়। রিক্সায় বসেই আমার ছোট বোন চিৎকার দেয়-
-দুলাইয়ের গাড়ী।
আমিও খেয়াল করি। গাড়ীতে বসা আমার স্বামীর পাশে আর একজন।
ছোটবোনের কাছে নিজেকে লুকাই, লজ্জায়, অপমানে।
রাতে বাসায় আসার পর স্বাভাবিক ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করি -
-অফিস থেকে কোথাও বের হয়েছিলে?
সে সরাসরি না বলে দেয়।
বাংলা একাডেমির বইমেলায় আমার এক বান্ধবীর সাথে দেখা হয়ে যায় তার। সাথে এক মহিলা। সে কথা চলে আসে আমর কাছে। বান্ধবীর কাছে মহিলার অন্য পরিচয় দিয়ে আমি আমার স্বামীকে উঁচুতে তুলে ধরি, মনের কষ্টকে চাপা দিয়ে।
মাঝখানে কাউকে না বলে নিঃশব্দে চলে গিয়েছিলাম বাসা ছেড়ে। তিনদিন ছিলাম বান্ধবীর বাসায়। এর মাঝে সে অফিস করেছে, নিজে রান্না করে খেয়েছে। স্ত্রীর প্রতি দায়িত্ব যেটুকু পালন করেছে, তা হলো বাবার কাছে আমার নিখোঁজ হওয়ার খবর জানিয়ে। বান্ধবীর মনে সন্দেহের দানা বাঁধার আগেই আবার ফিরে এসেছি আমার অন্ধকার ঘরে। নিরুত্তাপ স্বামী আমার স্বাভাবিক; যেন সকালে অফিস গিয়ে বিকেলে বাসায় ফেরা।
জীবন সংসার আমার আর ভাল লাগেনা, বারান্দার বাগানের গাছ চৌত্রের খরদাহে শুস্ক, পাতা বিবর্ণ, ধুসর। ঘরের চতুর্দিকে অযত্নের ছাপ, রান্নার পাতিলের তলায় থিকথিকে ঝোল শুঁকিয়ে ইউকেলিপটাসের বাঁকলের মতো বাঁকা হয়ে উঠে থাকে। স্বামীকে নিয়ে গর্ব করার পরিবর্তে আমি এখন নিশ্চুপ থাকি। বিশ্বাস ভঙ্গের কষ্টে রাতে এখন আর ঘুম আসে না, চির সবুজ আমি ভালবাসা আর বিশ্বাসহীনতার দোলাচালে ফ্যাকাসে হয়ে যাচ্ছি। কষ্টের পাথর আমার উপর চেপে বসে আলো বাতাস আর অক্সিজেন সরবরাহে বাঁধা দিচ্ছে। আমি হয়ে যাচ্ছি পাথর চাপা সাদা ঘাস, অচিরেই মিলিয়ে যাব মাটির সাথে।
এরমাঝে একদিন একাকী বাসায় ঞ্জানহীন পড়েছিলাম কতটা সময়। স্বামী আমার অফিস থেকে দেরি করে ফিরে দরজা ভেঙ্গে উদ্ধার করে নিয়ে যায় হাসপাতালে। হাসপাতালে অবশ্য থাকতে হয়নি। কিছু পরীক্ষা নিরিক্ষার পর ছেড়ে দিয়েছে সেদিনই।
দুদিন পরের ঘটনা। স্বামী আমার বরাবরের মতোই অফিস থেকে ফিরলেন দেরিতে, সন্ধার অনেক পর। হাতে বড় একটি মিষ্টির প্যাকেট, তার উপর ছোট একটি প্যাকেট, নীল রঙের গিফট পেপারে মোড়ানো। মিষ্টি কেন, গিফট কার বললেও সে কোন জবাব দিল না। অফিসের কাপড় বদলিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে ঢুকে গেল ওয়াসরুমে। খামটি হাতে নিলাম, বাসর রাতে স্বামী আমার যে নামে সন্মোধন করেছিল সে নামটি লেখা। সাহস করে নীল কাগজে মোড়ানো প্যাকেটটি খুললাম। যে হাসপাতালে গিয়েছিলাম সে হাসপাতালের বেশ কিছু রিপোর্ট। সে রিপোর্টের উপর আমার স্বামীর সুন্দর হস্তাক্ষরে লেখা- পিতৃত্বের চেয়ে অন্য কোন সম্পর্ক বড় হতে পারে না।
আমি বিস্মিত আনন্দিত, পাশাপাশি একটি নীল কষ্টের বোঝার ভারে নুয়ে পড়ার অবস্থা। এতোদিন ছিলো অবৈধ সম্পর্কের সত্য মিথ্যার দ্বন্ধ। সরল স্বীকারোক্তির পর জগদ্বল পাথরের মতো তা আরও চেঁপে বসলো বুকের উপর। জানিনা সে পাথর সরিয়ে আলো বাতাসে তা সবুজ হতে কত সময়ের প্রয়োজন।
লেখক পরিচিতি
মোমিনুল আজম
জন্মেছেন - ১৯৬৫ সালে, গাইবান্ধায়
পড়াশুনা করেছেন- শের ই বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে
কাজ করেন- বাংলাদেশ ডাক বিভাগে
বর্তমানে- কানাডায় থাকেন
ফিলাটেলি- ডাকটিকিট সংগ্রহের শখ নামে একটি প্রকাশনা আছে।
0 মন্তব্যসমূহ