তমাল রায়ের অনুগল্প : বাতিল ক্যারাভান

চমক। সদর দরজার সামনে ক্যারাভান নিয়ে হাজির হাসান চাচা। আমার ডাক্তার দাদুর কষ্টার্জিত অর্থে কেনা গাড়ি। সামনের দিকটা অ্যাম্বাসাডার, পেছন দিকটা সেকেলে। অ্যাম্বুলেন্সের মতো। অনেকটা জায়গা। কালো ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে যখন গ্রামের রাস্তা দিয়ে গাড়ি যেত- পুঁটি, টুম্পা, ভোলারা অবাক। বাবা নাম দিয়েছিল ক্যারাভান।

সামনের দরজা খুলে উঠতে গিয়ে দেখি হাসান চাচার পাশে বসে ডাক্তার দাদু।
- আয় বোস। বলে মুচকি হাসল।
-পায়েসটা খেয়ে নে। অনেক দূরের পথ।
গাড়ির পেছন দিক থেকে মা বাটিটা এগিয়ে দিলেন। ক্রুশ দিয়ে টেবিলের ঢাকা বুনছেন। মা কখনও চুপ করে বসে থাকত না। কিছু-না-কিছু করবেই। মা-র দিকে তাকালাম, মুখ ঘুরিয়ে নিল, চোখে কি জল?
গাড়ি চলছে। ঢেউ-কুচ-কুচ করতে করতে। পায়ের কাছে থেকে হঠাৎ সুরেলা আওয়াজ। চমকে গেছি- হাসান চাচার এই কালো বাকসোতে কী আছে? বাবা বললেন- তোর মা-র হারমোনিয়াম। বাবার পুরোনো অভ্যাস। মা-র কথা কখনও মা-কে বলতে দিত না।
-বাবা, তুমি কখন উঠলে, দেখিনি তো...
-তুমি আর কবে আমাদের খেয়াল করেছ। বাবা উত্তর দিল। অভিযোগ করাটা বাবা আর ছাড়তে পারল না।
ক্যারাভান চলছে... একটা ঝাঁকুনি হঠাৎ... আর সিটের পেছন দিক থেকে ঘেউ ঘেউ করে উঠল কুকুর। ও-মা, তাকিয়ে দেখি আমাদের সেই ভুলু নেড়ি কুকুরটা। এক প্রবল ঝড়-বৃষ্টির রাতে মা-মরা কুকুরটাকে রমা, আমার বোন তুলে নিয়ে এসে আশ্রয় দিয়েছিল।
-ভুলুও উঠেছে?
-শিল নোড়া, পুরোনো বালতি, কৃষ্ণ তুলসীর গাছ, ছেঁড়া মাদুর, বিশ্বাসকাকুর হিসেবের খাতা- সব উঠেছে, ভুলু উঠবে না কেন?
পেছন ফিরে দেখি রমা, আমার বোন। কটমট করে কথা বলা ছিল ওর অভ্যাস।
-রমা, কতদিন পর তোকে দেখলুম। তুই তো আগের থেকে আরও সুন্দর।
রমা লজ্জায় মাথা নিচু করল।
দাদু হেসে বললেন- তোমার দিদিমা থাকলে হামান দিস্তাটাও উঠত।
গাড়ি আস্তে করল হসান চাচা। গাড়িতে উঠল সরলা পিসি, হাতের সাজিতে সাদা জবা। পিসি খুব ফুল ভালোবাসত। বিধবা হয়ে আমাদের বাড়ি ফিরে আসার পর গাছপালা নিয়েই কাটাত সারা দিন। পিসির সঙ্গে উঠল মানদা পিসি, হাতে ঝাঁটা, মুখে পান। ছোটোবেলা থেকেই আমাদের বাড়িতে আছে। স্বামী পরিত্যক্তা মানদা পিসির শুচিবায়ু বাতিক ছিল। খালি ঝাট আর জল দিয়ে মোছা... গাড়িতে উঠেই ঝাট দিতে শুরু করল- অ্যাই রমা, পা তুলে বোস।
রমা তখন আমার হাতে তুলে দিচ্ছে লাল-নীলচে সেই ভাঙা ক্যালিডোস্কোপটা- মিতাদি পাঠিয়েছে...। আমি বললাম- চুপ কর, বাবা শুনে ফেলবে। মিতা আমার ইয়ে ছিল... এক বর্ষার দুপুরে জিজ্ঞেস করেছিল- আমায় বিয়ে করবে? আমি তখন চোদ্দ বছর, মিতা এগারো। ব্বার দিকে তাকালাম, ভাঙা আয়নাটা বুকে জড়িয়ে ঘুমোচ্ছে। মা-র কাঁধের ওপর মাথাটা রাখা। মুখ দিয়ে লালা গড়িয়ে গালের প্রান্তসীমায়। ভাঙা আয়নাটা বাবার একমাত্র অবসেশন...সারাক্ষণ ওই আয়নায় অজস্র মুখ- কেউ হাসছে, কেউ কাঁদছে...বাবা অবাক চোখে তাকিয়ে...মানদা পিসি আবার চিৎকার করল- রমা, পা-টা তুলবি। শুনতে পাস না?
রমা চিৎকার করল- 'তুমি তো সেই কবে গলায় দড়ি দিয়েছ, এখানে এলে কী করে?
দাদু গম্ভীর গলায় বলল- রমা চুপ কর। একদম চুপ। রমা কাঁদছে। মানদা পিসিও কাঁদছে।
হাসান চাচা গাড়ি থামিয়ে দিয়েছে। জানালার কাচ তো সব বন্ধ...বাইরে সন্ধে নামছে।
জানালায় খটখট। তৃণা ডাকছে। আমার স্ত্রী। পাশে সুমিত, তৃণার বয়ফ্রেন্ড। আমাকে নেমে আসতে বলছে ওরা। আমি ইতস্তত করছি। আবার ডাকছে। মা পেছন থেকে বলল- খোকা নাম্বি না। এই নে মুগের নাড়ু খা। আমার শীত করছে। আমার কোলে পুপু। আমার না- হওয়া সন্তান। তৃণার গর্ভে এসেছিল দু'বছরের মাথায়। তৃণা রাজি হয়নি অত তাড়াতাড়ি মা হতে। তৃণা আবার ডাকছে।
আগামীকাল আমাদের, সরি, তৃণার নতুন ফ্ল্যাটের গৃহপ্রবেশ। শর্ত একটাই, বাতিল কোনও জিনিস যেন ওখানে না নিয়ে যাওয়া হয়। আমি সিটে গা এলালাম। পুপু মা'র কোলে।
দাদু বললেন- হাসান গাড়ি চালা। আমাদের অনেকটা যেতে হবে। তৃণা আবার ডাকল। আমি হাসলাম। আর ডেকে লাভ কি! এখন তো অমিয় ডাক্তারকে ডাকতে হবে চার ঘণ্টা পর। ড্রেসিং টেবিলের ওপর চাপা দেওয়া আছে এন.আর.এস হাসপাতালের অ্যানাটমি ডিপার্টমেন্টের নম্বর। গাড়ি চলছে। তৃণা আর সুমিতকে পাশ কাটিয়ে ক্যারাভান এগিয়ে চলেছে।
অন্ধকার নামছে।
দাদু অবশ্য আলোর কথা বলেন। অন্ধকার নাকি আলো। গাড়ি চলছে...





লেখক পরিচিতি
তমাল রায়
ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বরানগরে, ১৯৭০ সালে জন্ম। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেছেন। গল্পকার। সম্পাদক। দীর্ঘদিন ধরে তাঁর সম্পাদনায় বের হচ্ছে সাহিত্যের ছোটকাগজ 'ঐহিক'। প্রকাশিত গল্পের বই দু'টি-
নিঝুমপুরের না-রূপকথা (২০০৯),
তিতিরের নৌকো যাত্রা (২০১৩)।    

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

5 মন্তব্যসমূহ