সাদিক হোসেনের গল্প : ললিপপ লাগিলু

তো, এই বাজারেও সিপিএম থেকে দাঁড়িয়ে, কাউন্সিলর ভোটে জিতেও, আলতাফ মোল্লা কিন্তু যেই-কী-সেই নট্ নড়নচড়ন থাকতে পারলেন। তাঁর চোখেমুখে নেতা ভাব ফুটে উঠল না। ওনাকে দেখলেই আমার, তাই, মনে পড়ে, হরলিক্সের অ্যাডটার কথা – ঐ যে, আছে না, আমি তো এমনি এমনি খাই! সেইরকম।

আমাদের এখানে পুকুরটুকুর বুজিয়ে, খালবিল সব সাঁটিয়ে ঘরবাড়ি উঠে গেছে বেশ। এখন একটুখানি পানি হলেই চারদিক থইথই করে। তা, এই রকম পানিতে চিকুর চিকুর ছেলেরা কিলবিলিয়ে নাচনকোদন করবে নাই বা কেন? মেয়ে দেখলে ললিপপ লাগিলু বলে উঠবে নাই বা কেন?


সেদিন হলো কী, একজন ছোকরাকে দলিজে বসে থাকতে দেখে তাঁর হেভি সেন্টু জেগে উঠল। তিনি এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করলেন, তা ভাইপো, কী করা হয়?

ছোকরাটা তৃণমূল করত। সে ভাবল আলতাফ মোল্লা বুঝি তাকে ঠেস মেরে কথা শোনাচ্ছে। সে বলল, ভাবতিছি বিজনেস লাগাব।

কিরম বিজনেস?

এই এত পানি চারদিকে। এখেনে মাছের মীন ছাড়তে পারলেই তো কেল্লাফতে। একেবারে ফাউ ইনভেস্টে লাভ হয়ে যাবে। আপনি কী বলেন?

ব্যস, আলতাফ মোল্লার মনটা মিইয়ে গেল। তবে এতে তিনি অবাক হলেন না। এরকম গরম খাবার অভ্যেস তাঁর আগে থেকেই আছে। বউ, পার্টি তাকে ঠাপ দেবে সে-তো জানা কথা, কিন্তু ইদানিং মেয়েটাও তাকে ছেড়ে কথা কইছে না। সুযোগ পেলেই রিজুয়ানুরের কেসটা নিয়ে খোঁচা মারে। আলতাফ মোল্লা তাই থাকতে থাকতে নিজের মনেই মনিষীদের উক্তি আওড়ান। এতে তাঁর মনটা শুদ্ধ হয়ে আসে। যেমন, এইমাত্র তিনি বললেন, তুমি অধম বলিয়া আমি উত্তম হইব না কেন?

যা হোক, এইসব আলবাল কথা তেমন কোন ইমপর্টেন্ট নয়। গল্পটাকে কোথাও থেকে তো একটা শুরু করাতে হবে, তাই বলা। বুদ্ধিমান পাঠক উপরেরটুকু স্কিপও করে যেতে পারেন। তবে নীচেরটুকু খাঁটি। ওখানে টুইস্ট আইল রাত্তিরবেলা। এক্কেবারে চুপকে চুপকে।

আলতাফ মোল্লা স্বপ্নে দেখলেন, একজন হিরোইন টাইপের মাগী দুধ দোলাতে দোলাতে তাঁর দিকে এগিয়ে আসছে। পেছনে হানি সিং-এর গান বাজছে। আবার গানটা মিউট হয়ে গেলে চুঁচি চুঁচি করে তিনি নিজেই যেন চেঁচিয়ে উঠছেন। বকরিরা ব্যা ব্যা করছে। টুপটুপ করে ডুমুর পড়ছে। মাগীটা দুলুনি দিচ্ছে। তিনি লাফিয়ে উঠলেন। তাঁর ঘুম ভেঙে গেল। তিনি তাকিয়ে দেখলেন তাঁর ঐটা ডাঁটার মত খাড়া হয়ে আছে।

সকাল থেকেই আলতাফ মোল্লার মনটা খারাপ হয়ে গেল।

তিনি জানতেন, আমাদের মনের সিক্রেটগুলিই খোয়াবের সময় ফাঁকা জায়গা পেয়ে ভকভক করে বেরিয়ে আসে। তার মানে, এইসব হেজিপেজি ভুলভাল এতদিন তাঁর মনেই ছিল? তিনি নিজেকেই সন্দেহ করলেন। অথচ, তিনি ভেবে দেখলেন, মেয়েটাকে প্যারা-টিচারের চাকরিটায় ঢোকানো ছাড়া তিনি বিশেষ কোন দু-নম্বরি করেননি। আবার স্বপ্নের মাগীটাকেও তিনি চিনতে পারছেন না। হলো কী তাঁর?

আলতাফ মোল্লা নিজের মেয়ের দিকে তাকালেন। বৌ-এর দিকে তাকালেন। আত্মীয়স্বজন, পাড়াপ্রতিবেশী, বন্ধুদের বউদের কথা ভাবলেন। না, স্বপ্নে দেখা মালটার সাথে এদের কারোরই মুখের মিল পেলেন না তিনি।

আলতাফ মোল্লা আযব প্রবলেমে পড়লেন।

নিজের মনেই বিড়বিড় করলেন, জীবে প্রেম করে যেই জন, সেই জন সেবিছে ঈশ্বর।

তাঁর মনটা আদ্ধেক শুদ্ধ হয়ে এলো। তিনি গরীব মানুষদের কথা ভাবলেন। গরীব গরীব পেট ফোলা বাচ্চাদের তিনি যেন দেখতে পেলেন। আগের মতই তাঁর মনে স্যাডনেস জেগে উঠল। এতে তিনি বেশ আশ্বস্ত হলেন। না, তবে সব ঠিকঠাক আছে। তিনি বাইরে বেরিয়ে পড়লেন।

পার্টি অফিসে দুটো পেপার নেওয়া হয় – গনশক্তি আর আনন্দবাজার। তিনি দুটো পেপারেই চোখ বোলালেন। কদিন ধরেই গাজাতে হেবি বম পড়ছে। আজকের পেপারে একটা ফর্সা ছেলের মরে যাবার ছবি বেরিয়েছে। তাঁর মনটা নাজুক হয়ে এল। কিন্তু পরক্ষণেই তিনি আবার নিজেকে সন্দেহ করলেন। আমি মুসলমান বলেই কী বেশী বেশী দুঃখ পাচ্ছি? তিনি এবার ইরাকের খবরে চোখ রাখলেন যেখানে সুন্নুরা শিয়াদের উদুম কেলাচ্ছে। বোঝার চেষ্টা করলেন, দুটো খবরেই তিনি সমান দুঃখ পাচ্ছেন কি না।

কিন্তু আলতাফ মোল্লা নিজেকে ঠিকঠাক বিশ্লেষণ করতে পারলেন না। এই না পারার পেছনে তাঁর পড়াশুনার খামতিটাই যে দায়ী – সে-ব্যাপারে তিনি নিশ্চিত হলেন। তিনি সুমন মুখোপাধ্যায়ের কথা ভাবলেন। কবীর সুমনের প্রতি তাঁর হিংসা জন্মাল। এমনকি বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের মতনও তিনি কেন গুছিয়ে ভাবতে পারছেন না তা বুঝে ফেলে বুঝে-ফেলার হিউমিডিটিতে ঘামতে শুরু করলেন।

ক’মাস আগে তাঁর পেটে আলসার ধরা পড়েছিল। ডাক্তার নিদান দিয়েছিলেন, খালি পেটে থাকা যাবে না। সেই কারণে তিনি কাঁধে ঝোলা ব্যাগটাতে সব সময় টাইগার বিস্কুটের প্যাকেট রেখে দেন। এখন তিনি বিস্কুটের প্যাকেটটা খুলে দু’টো বিস্কুট একসাথে গালে পুরে চিবোতে লাগলেন। কিন্ত এতেও তিনি বিশেষ সুবিধা করতে পারলেন না। ভেতর ভেতর কেমন অগোছালো হয়ে যেতে থাকলেন।

থাকতে থাকতে স্বপ্নে দেখা মেয়েটার অমন হারামিপনা তাকে বিরক্ত করে দিতে থাকল। জাতখানকি! তিনি গাল পাড়লেন। পরক্ষণেই আবার জিভ কেটে বললেন, মানুষের উপর বিশ্বাস হারানো পাপ!

আলতাফ মোল্লা আর দেরী করলেন না। সটান চেয়ার থেকে উঠে আলমারির সামনে এসে দাঁড়ালেন। লাল রঙের মলাট করা মোটা বইটার দিকেই তাঁর চোখ গেল প্রথমে। বইটির নাম ‘কার্ল মার্ক্স – পুঁজির উদ্ভব’। তিনি বইটি নিয়ে আবার চেয়ারে ফিরে এলেন।

আমরা দেখেছি টাকা পরিবর্তিত হয় পুঁজিতে; পুঁজি মারফত উদ্বৃত্ত মূল্য গড়ে ওঠে, এবং উদ্বৃত্ত মূল্য থেকে আসে আরো পুঁজি। কিন্তু পুঁজি সঞ্চয় মানে আগে ধরে নিতে হয় উদ্বৃত্ত মূল্য, উদ্বৃত্ত মূল্যের ক্ষেত্রে আগে পুঁজিবাদী উৎপাদন, পুঁজিবাদী উৎপাদনের ক্ষেত্রে আবার আগে পণ্যবাদী-কর্তাদের হাতে যথেষ্ট পরিমাণ পুঁজি ও শ্রমশক্তির অস্তিত্ব ধরে নিতে হয়।

আলতাফ মোল্লা এইটুকুতেই কেস খেয়ে গেলেন। সাত-সাতটা ‘পুঁজি’ তাঁর মগজে পাক খেতে শুরু করল। তিনি বইটি বন্ধ করে আবার আলমারিতে এমনভাবে গুছিয়ে রাখলেন যাতে কেউ তাকে সন্দেহ করতে না পারে।

বাইরে তখন বৃষ্টি নেমেছে। যেন আকাশ ছ্যাদা করে আল্লা পানি ঢেলে দিচ্ছে উপর থেকে। কড়াৎ করে বাজ পড়ল কাছেই। আলতাফ মোল্লা চমকে উঠলেন।

তিনি ছাতা মাথায় দিয়ে বাইরে বেরিয়ে এলেন। একেবারে মেইন রোড ধরে হাঁটতে থাকলেন।

ঐ দূরে, গ্যারেজটার সাঁমনে, পেট ফোলা ছাবালরা কিলবিলিয়ে নাচছে। তাদের কীসের এত মস্তি তিনি বুঝতে পারলেন না। ভোডাফনের হোর্ডিংটা ইতিমধ্যে ছিঁড়ে গেছে। চায়ের দোকানদার স্টোভ বন্ধ করে তাঁর দিকে তাকিয়ে রয়েছে। তার দোকানে এখন আর কোন খরিদ্দার নেই। একজন মেয়েছেলে থলি হাতে তাঁর পাশ দিয়ে হেঁটে গেল।

এই কী জীবনের সত্য? আলতাফ মোল্লা ঘেঁটে গেলেন। আবার এটাই যদি সত্য হয়, তবে এই সত্য কী জীবন নিরপেক্ষ কোন সত্য? আলতাফ মোল্লা কাৎ হয়ে পড়লেন। তাঁর খামোকা সখ হল, রোজ রোজ সেদ্ধ ডিম আর ব্রেডের উপর মাখন লাগানো ছুরি চালিয়ে এডুকেটেড মানুষেরা যেমন করে ব্রেকফাস্ট সারে, তারপর ব্রেকফাস্ট সেরে যেমন করে অফিসে যায়, সেইরকম কোন কাচ লাগানো অফিসে গিয়ে তিনিও যদি তেমনি কোন বিজি লাইফ কাটিয়ে যেতে পারতেন। তাঁর নিজের মেয়ের কথা মনে পড়ল। মেয়ের সাকসেসে তাঁর সিনা চওড়া হয়ে উঠল।

এদিকে রাস্তার জমা পানিতে ঢেউ তুলে বাসটা এগিয়ে আসছে দ্রুত। আলতাফ মোল্লা এখন রাস্তার মধ্যিখানে দাঁড়িয়ে রয়েছেন। বাসটা আসার আগেই তাঁকে যে-করে হোক ফুটপাথে উঠে আসতে হবে। তা না হলে তিনি কাদাজলে পুরো গা ধুয়ে ফেলবেন। তিনি বাসটার দিকে তাকালেন।

রাস্তাটাও বেশি চওড়া নয়। এখুনি দু-পা লাফালে তিনি অনায়াসে ফুটপাথে উঠে যেতে পারেন। তবু তিনি একটুও সরলেন না। তাঁর মধ্যে খামোকা দেমাক গেঁজিয়ে উঠল। তিনি চ্যালেঞ্জ নিয়ে নিলেন। দেখি, এই আমলেও সিপিএমের কাউন্সিলর হওয়া লোকটাকে বাসটা ভিজিয়ে দিতে পারে কিনা।

আলতাফ মোল্লা মাথায় কেসি পালের ছাতা নিয়ে ঠিক ছত্রপতির মত দাঁড়িয়ে থাকলেন।

কিন্তু তখনি তাঁর পেটটা গুলিয়ে উঠল। আর কী অনায়াসে তিনি একটি নিখুঁত বাতকর্ম সেরে ফেললেন। তিনি নিঃশ্বাস নিলেন। সেদ্ধ ডিম খাবার পর যেরম গন্ধ বেরোয়, ঠিক সেই রকমই গন্ধ পেলেন তিনি। আচমকা তাঁর চোখমুখ পাল্টে গেল। মনটা শুদ্ধ হয়ে এল। বাসটা তাকে ভিজিয়ে দেবার আগেই, তিনি এডুকেটেড মানুষদের মত দু-দিক দেখে নিয়ে ফুটপাথে উঠে এলেন।




লেখক পরিচিতি
সাদিক হোসেন
জন্ম - ১১ই ডিসেম্বর, ১৯৮১

প্রকাশিত বই -
দেবতা ও পশুপাখি (কবিতা), ২০০৮
সম্মোহন (ছোট গল্প), ২০১০
মোমেন ও মোমেনা (উপন্যাস), ২০১১
গিয়াস আলির প্রেম ও তার নিজস্ব সময় (ছোট গল্প), ২০১৩

পুরস্কার সাহিত্য আকাদেমি যুব পুরস্কার, ২০১২
নমিতা চট্টোপাধ্যায় স্মৃতি পুরস্কার, ২০১৫






একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

7 মন্তব্যসমূহ

  1. এই মন্তব্যটি লেখক দ্বারা সরানো হয়েছে।

    উত্তরমুছুন
  2. গল্পটা পড়তে পড়তে মনের পর্দায় আমাদের আশে পাশের ’ফুলের মত পবিত্র’ রাজনৈতিক নেতা-নেত্রীদের চেহাড়াটা ভেসে উঠলো। শুধু ঐ প্রজাতিই বা কেন? উপর দিয়ে শিক্ষিতের ভাব নিয়ে নাকের ডগায় চশমা ঝুলিয়ে, কাঁধে কায়দা করে শাল জড়িয়ে সাহিত্য সভায় মাইকের সামনে দুটো কথা বলে সমাজের বাহবা কুড়ানোর বাসনাসিদ্ধ মানুষের সংখ্যাও কম কিসে? মানুষ তার এই দ্বৈত চরিত্র নিয়েই হয়তো বাস করে। চরিত্রের সাথে নিজেই প্রতিনিয়ত হোচট খায়। অনেক সময় নিজের চেনা পরিচিত জগৎটাও অনেক অচেনা মনে হয়ে যায়। মিথ্যা, অভিনয় এমনকি মেকি লোক দেখানো সমাজের সব চর্বিত চর্চা তখন মানুষকে অন্য আরেকটি মানুষে পরিনত করে তোলে। তখন সেই মানুষটি আর নিজের মানুষ থাকে না। সাদেক হোসেনের গল্প এটাই আমার প্রথম পড়া। প্রথম পড়াতেই তার গল্পের প্রেমে আমি নিমজ্জিত পাঠক হয়ে গেলাম। ধন্যবাদ গল্পকারকে।

    উত্তরমুছুন
  3. এই মন্তব্যটি লেখক দ্বারা সরানো হয়েছে।

    উত্তরমুছুন
  4. সাব্বাশ ! কী পর্যবেক্ষণ আর তেমনিই লেখা...
    শ্রাবণী দাশগুপ্ত।

    উত্তরমুছুন
  5. এই মন্তব্যটি লেখক দ্বারা সরানো হয়েছে।

    উত্তরমুছুন
  6. খাপছাড়া গল্প। একমুখী অনুসঙ্গ রক্ষা করা হয়নি

    ।তাই যথাযথ জীবন বিকাশ সম্ভব হয়ে ওঠে নি

    উত্তরমুছুন