কামুর ‘আউটসাইডার’ তখন মাত্র পড়ে শেষ করেছি। কিছু বুঝি আর না বুঝি,
‘belong to nowhere’ জাতীয় একটা অস্পষ্ট অমূর্ত ধারণার বিষয়টা
মাথার মধ্যে ভালো করে জেঁকে বসলো। যাকে বলা যায় শক্ত
কামড় হিসেবে। সত্যি কথা বলতে কি, ব্যাপারটা আমার পছন্দ হয়ে গেলো।
যদিও
এটাও খুব পরিষ্কারভাবেই বুঝতে পেরেছিলাম যে, আমার ধোঁয়াশা ধারণাটা অর্থাৎ কারণে বা
কারণ ছাড়াই কোথাও কারো কাছে নিজের অবস্থান খুঁজে বা দেখতে না পাওয়ার মানুষের এই বিশেষ
অনুভূতির ব্যাপারটা মনের সংবেদনশীলতার একটা বিশেষ স্তরে বাস করে এবং এটা নিয়ে যত
কম নিজের মতামত প্রকাশ করা যায় তত মঙ্গল।
কামু পড়ে অল্প বুঝে অথবা কিছু না বুঝেও এরকম
একটা উপলব্ধি কেন আমাকে আচ্ছন্ন করে রাখলো তা নিয়ে তেমন কিছু বলার নেই। তবে যা নির্দ্বিধায় বলা যায়, আমি এই অনুভূতির সাথে যেকোনভাবে হোক নিজের জীবনের বিভিন্ন
সময়ের অবস্থার সম্পর্ক স্থাপন করতে পেরেছিলাম এবং সে কারণে আমি এটা জায়গামতো
প্রয়োগ করতে শুরু করলাম। ফলাফল হলো দারুণ। আমি আমার চিন্তা-ভাবনার সাথে মিলে যায় এরকম দু’একজনকে
পেয়ে গেলাম এবং ভাবলাম, যাক, আমি একাই বহিরাগত নই।
আমার আগে কামু এবং তার মতো কেউ ছিলেন, এখন আমি এদের পেয়ে গেলাম।
বেশ কিছুদিন হলো রাজধানী শহরে এসেছি।একটা ছোট আয়তনের বিভাগীয় শহর থেকে। রাজধানীর
অভিজাত বাসিন্দারা নাক সিঁটকে বলতে ভালোবাসে মফস্বল থেকে, নিদেনপক্ষে হাল আমলে
চালু হওয়া উপশহর। কিন্তু বিভাগীয় শহর, আয়তনে যত ছোটই হোক, কোন যুক্তিতে উপশহর হয়ে যায় তা আমি
শুরুর দিকের সেই সময় বুঝে উঠতে না পারলেও এখন ভালো করেই জানি, এটা ছিল তাদের স্ব-আরোপিত অজ্ঞতা।
ঢাকা শহরের বাইরে থেকে যে কেউই আসুক না কেন,তার আচার-ব্যবহারে-মুখের ভাষায় পরিচয়
প্রকাশ পেয়ে গেলে রক্ষা নেই। আবার যোগ্যতায় যদি সে
কিছুটা উৎকর্ষতার আভাস দিয়ে ফেলে,
তাহলে তাকে যেভাবে সম্ভব পায়ের নিচে পিষে মারার সবরকম অপচেষ্টার অকরুণ অত্যাচার।
এর বেশ আরো কিছুদিন পরে ধানমন্ডি ২৭ নম্বরের
এক ডাক্তারের চেম্বারে ঘটে এক কাকতালীয় ঘটনা।
সেই অভাবিত ঘটনার বদৌলতে ভবিষ্যতে যে ভদ্রলোকটির সাথে
আমি সারা জীবনের জন্য সাত পাকে বাধা পড়বো বলে পরিচিত হই, তিনি আমাকে পরবর্তীতে আরেকটি শব্দ শিখিয়েছিলেন: পেরিফেরি! তো ফেরিতে চড়ে মেঘনা-যমুনা পার হয়ে যারা এ পারে আসে, তাদের সম্পর্কে এ কথা বলাই যায়।
যাই হোক, পেরিফেরি হোক, অথবা অজ্ঞতাপ্রসূত প্রয়োগের উপশহর অথবা মফস্বল, এর বেশি কিছু তারা বলতে
নারাজ। যেনবা রাজধানীতে থাকলেই কেবল আভিজাত্যের তকমা গায়ে লাগানো
যায়; এর বাইরে আর কোথাও থেকে নয়।
রাজধানীতে
না থাকলে কিভাবে বিশ্ব-সাহিত্যের ক্লাসিকগুলোর যথার্থ
রস আস্বাদন সম্ভব হবে? বলাবাহুল্য, বহিরাগত হিসেবে একাধিকবার আমি ওইসব ভ্যানিটি
ফেয়ারের উন্নাসিকদের তথাকথিত প্রচলিত ধারণা ভুল প্রমাণ
করেছিলাম এবং তাদের দিকে একটা অদৃশ্য করুণার দৃষ্টি ছুঁড়ে দিয়ে মনে মনে গভীর পরিতৃপ্তির হাসি হেসেছিলাম। তাদের কারও কারও মানতে ভীষণ অসুবিধা হয়েছিল এই দেখে যে, মফস্বল শহরের
কলেজ পড়ুয়া এক তরুণী কেন ঢাকার নিউ মার্কেটে সেরকমভাবে সহজলভ্য হওয়ার আগেই
অরুন্ধতী রায়ের ‘গড অব স্মল থিংস’ পড়ে ফেলবে অথবা রবার্ট গ্রেভস এর দুই ভলুমের
অসাধারণ কাজ ‘দ্য গ্রিক মিথস’ এর গর্বিত অধিকারী হবে যখন এই দারুণ দুর্লভ বই সারা
জীবন ধরে ঢাকার আনাচে-কানাচে খুঁজতে খুঁজতে তারা হয়রান হয়ে গেলেন! হাতের নাগাল
পাওয়া তো দূরের কথা।
তো ইন জেনারেল রাজধানীবাসিদের কথা যদি ধর্তব্য বলে মানতেই হয়, অর্থাৎ
কিনা রাজধানীতে বাস না করে বিশ্ব-সাহিত্যের অসাধারণ মাস্টারপিসগুলোর সেভাবে নাগাল
পাওয়া সহজসাধ্য ব্যাপার নয় যেখানে এই গরীব দেশের সবকিছুই রাজধানী-কেন্দ্রিক। আমার ক্ষেত্রে যা হয়েছিল, একটা ছোট্ট বিভাগীয়
শহরে বেড়ে উঠতে উঠতেই আমি আকাশ ছুঁতে চাইলাম সম্ভব-অসম্ভবের তোয়াক্কা না করে। হয়তো এর মধ্যেই আমার কানে কেউ ওই ক্লিশে মোটিভেশনাল
বাক্যটি ঢেলে দিয়েছিল: ‘দ্য স্কাই ইজ দ্য
লিমিট’। তবে এটাকে ঠিক আকাশ ছোঁয়ার স্বপ্ন বলা বোধ হয়
সব অর্থে যৌক্তিক হচ্ছেনা। ব্যাপারটা
এরকম যে, আমার ভালো লাগার যে পরিসরটা, সাহিত্য বা বিশ্ব-সাহিত্য বলে যার সাধারণ
পরিচয়, আমি তার সবটুকু,যতটুকু এ স্বল্প মানব-জীবনে আয়ত্ত করা সম্ভব, নিজের মধ্যে
ধারণ করতে চেয়েছিলাম।
সাহিত্যকে নিজের অস্তিত্বের অপরিহার্য অংশ হিসেবে গ্রহণ করবার এই মারাত্মক প্রবণতা
লাভ করেছিলাম জন্মসূত্রে পিতার কাছ থেকে। আপনার নিশ্চয় এ
ব্যাপারে দ্বিমত পোষণের কিছু নেই যে, জন্মসূত্রে যে দোষ বা গুণ আপনি আপনার জিনের
ভেতর বহন করে এনেছেন তা কোনভাবে অস্বীকার করবেন।
কাজেই আমার ক্ষেত্রেও এর অন্যথা হলো না। সাহিত্যের প্রতি
জন্মগত ভালোবাসার কারণে তা কোনভাবে এড়িয়ে যাওয়া বা যেমনতেমনভাবে তার সাথে জড়িয়ে
থাকার কোন অবকাশ ছিলনা। ফলত সিদ্ধান্ত এমনই
দাঁড়ালো যে, আপনি কোন নির্দিষ্ট বিষয়ের প্রতি
ভালোবাসা বা ঘৃণা অথবা এ দুয়ের মাঝামাঝি যা কিছু আছে তা প্রকৃতিপ্রদত্তভাবে অর্জন করে থাকলে তার অপরিহরণীয় পরিণতি সম্পর্কে অনুমান করে নিতে পারেন। আপনাকে ওই চিরন্তন অনুভূতিগুলোর যে কোন একটির ভেতর দিয়ে অনিবার্যভাবে দিনযাপন করে যেতে
হবে ।
যা হোক, যা বলছিলাম কামুর ‘আউটসাইডার’-এর কথা। বইটা পড়বার সময় কাহিনীটার অভিনবত্ব অথবা একটা একটানা
একঘেঁয়েমি আমাকে দস্তভয়েস্কির ‘ক্রাইম অ্যান্ড পানিশমেন্ট’-এর কথা মনে করিয়ে
দিয়েছিল একাধিকবার। কিন্ত্ত সবকিছু ছাপিয়ে একজন বহিরাগত
বা আগন্ত্তক বলতে সাধারণভাবে যা বোঝায় সেই ধারণাটা আমার চেতনায় আস্থা গেঁড়ে বসে ।
রাজধানী শহরে আমাকে আসতে হয় একটা নতুন কর্মক্ষেত্রে যোগ দেবার জন্য।
আমি ওই
ছোট্ট বিভাগীয় শহরে আমার নিজস্ব জগৎ নিয়ে মোটামুটি ভালোই ছিলাম। কিন্ত্ত যেহেতু আমার কাছের দু’একজন মানুষ আমার
মধ্যে একটা ভীষণ সম্ভাবনার আলো দেখতে পেয়েছিলেন, তাই তাদের উৎসাহের চাপে আমাকে
আমার পূর্বের কর্মস্থলে ইস্তফা দিয়ে সম্পূর্ণ
নতুন একটা পরিবেশে নিজের জায়গা করে নেবার জন্য লাইনে দাঁড়াতে হয়। যাকে রীতিমতো অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রাম বলা যেতে পারে।
রাজধানী শহর।
তাই,বলাবাহুল্য, এখানে প্রতিযোগিতা
মরণপন। কেউ এতটুকু ছাড় দিতে রাজি নয়।
যথেষ্ট যোগ্যতা প্রমাণ করতে পারলেই কেবল এই পিচ্ছিল রণক্ষেত্রে আপনার টিকে থাকবার
সুযোগ আছে। তখন আপনি ‘সারভাইভাল অব দ্য ফিটেস্ট’ আপ্তবাক্যটির মোক্ষম
তাৎপর্য উপলব্ধি করবেন মর্মে মর্মে,
সর্বতোভাবে। যা হোক,এরপর থেকে যে এই আপ্তবাক্য এক
যন্ত্রণাপূর্ণ বিভীষিকার মতো আপনার দুঃস্বপ্নে বারবার হানা দিতে থাকবে,
টিকে যাবার প্রাথমিক পদক্ষেপে আপনি তা বুঝে উঠতে পারেননি।
আর তখন থেকেই আপনার মধ্যে, প্রকৃতপক্ষে, আমার মধ্যে ‘আগন্ত্তক’ অনুভূতিটা প্রবলভাবে
নাড়াচাড়া দিয়ে উঠতে শুরু করে।
শহরের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত একটা নামকরা
বেসরকারি স্কুলের সদ্য-সম্প্রসারিত কলেজ সেকশনে ইংরেজির প্রভাষক হিসেবে চূড়ান্ত নিয়োগ
পেলাম প্রতিযোগিতার সবগুলো এক্কা-দোক্কা পার হবার পর। নিজের যোগ্যতায় কোনরকম আপাত ধাক্কা-তদবির ছাড়া। আপাত বলছি এ কারণে যে, একজন সর্বময় সৃষ্টিকর্তার ওপর অগাধ বিশ্বাসের
জোরটাকে আমি আমার জন্য সবসময় সেরা তদবির বলে গণ্য করেছি।
ভ্রু কুঁচকে কিছু ভাবছেন? ভাবুন, আমাকে আমার বিশ্বাসের কথা বলতে দিন। আপনি আপনার অবিশ্বাস নিয়ে থাকুন।
তা নিয়ে আমি কখনো কোন মন্তব্য ছুঁড়ে দেয়া সমীচিন মনে করিনি। যেহেতু, বিশ্বাস করতে শিখেছি, প্রতিটা মানুষের
নিজের মতো করে চিন্তা করবার স্বাধীনতা আছে।
তবে তা কখনোই অন্যের চিন্তার পরিমন্ডলে অযাচিতভাবে প্রবেশ করে তাকে আঘাত না দিয়ে।
ব্যাপারটা বেশি জটিল হয়ে যাচ্ছে। আমি বলতে চাইছিলাম, কখন আমি নিজেকে আগন্ত্তক বা ‘আমাদের
ভুবনে স্বাগতম’ জাতীয় সম্বোধন প্রত্যাশার বাইরে একজন বহিরাগত ভাবতে শুরু করলাম সেই
মন খারাপ করা দূরাগত অতীতের গল্প যখন মানুষ সম্পর্কে আমার
সাধারণ ধারণার দেয়ালে একটা প্রচন্ড শক্তির ধাক্কা খেতে শুরু করলাম। বলা যায় আমার এতদিনের সুবোধ বিশ্বাসের দৃঢ় ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে থাকা দেয়ালটা নড়েচড়ে উঠলো। জীবনের কঠিন দুর্বোধ্য তিক্ত অভিজ্ঞতা রসে সিক্ত-রিক্ত হয়ে
আমি দারুণ অভিজ্ঞ হয়ে উঠতে থাকলাম।
কিছু পেতে হলে কিছু দিতে হয়। মানুষ সম্পর্কে ‘বোধি’ লাভের আমৃত্যু
প্রক্রিয়ায় আমি আমার পুরাতন বিশ্বাসকে বিসর্জন দিলাম।
কিন্ত্ত আমি মনে হয় কোথাও ভুল করে ফেলেছি। মনে হয় বলা আদৌ সঠিক হচ্ছেনা বলেই হোঁচটটা
খেলাম। জীবনের ভালো-মন্দ ভালো করে বুঝে উঠবার দোরগোড়াতেই মানুষ সম্পর্কে ধারণায় আঘাত পেয়েছি
একাধিকবার। কাজেই এই নতুন আঘাত আবার পুরনো ক্ষতের ব্যথাটাকে দ্বিগুণ
তেজের সাথে স্মরণ করিয়ে দিলো এভাবে বললেই সমীচিন হয়।
আমার আগের ছোট্ট শহরটাতেও একটা কলেজে শিক্ষকতা
করে এসেছি। তরুণী প্রভাষিকা। চেহারা থেকে তখনো ছাত্রীর গন্ধ-লেপা ছাপটা দূর হয়নি। ভালো করে না তাকালেও বোঝা যায়।
তাছাড়া, আমি তো তখনও ছাত্রীই। মাস্টার্স পড়তে পড়তেই
লেকচারারের চাকরিটা বাগিয়ে নিয়েছি কলেজ কর্তৃপক্ষকে মেধার দারুণরকম কারিশমা
দেখিয়ে। ভাইভা বোর্ডের প্রধান জনৈক
ব্রিগেডিয়ার সাহেব যখন শেষ প্রশ্নটা দিয়েও আমাকে পরাস্ত করতে ব্যর্থ হলেন, তখন তিনি অতিথি বিশেষজ্ঞ
শিক্ষকের কাছে আমার নিয়োগের ব্যাপারে কি সিদ্ধান্ত নেওয়া যেতে পারে সে বিষয়ে পরামর্শ চাইলেন।
যেহেতু তখন পর্যন্ত মাস্টার্স শেষ না করায় একটা
টেকনিক্যাল সমস্যা থেকেই যাচ্ছিল। বোর্ডের সম্মিলিত অভিমত
অনুসারে আপাতত খন্ডকালীন শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হবে বলে আমাকে জানিয়ে দেওয়া
হলো।
তো কলেজে যোগ দিলাম বটে। তবে সেখানে যাবার প্রথম দিনেই এক অদ্ভূত আচরণের শিকার হলাম। ওই কলেজের রসায়ণ
বিষয়ের ডেমন্সট্রেটরের স্বামীও আমার সাথে ইংরেজির প্রভাষক পদের নিয়োগ পরীক্ষায় অংশ
নিয়েছিল। যা হোক, পরোক্ষ প্রতিক্রিয়ায় সব রাগ গিয়ে শেষমেশ আমার উপর
বর্ষিত হলো। কাজেই সেই কলেজেও
কিছু প্রারম্ভিক প্রতিবন্ধকতা মোকাবিলা করার একটা অপ্রীতিকর ব্যাপার ছিল। তবে ওই নামহীন আগন্ত্তক বা বহিরাগত বোধের উপস্থিতি সেখানে
সরাসরিভাবে ছিলনা। একটা মানিয়ে নেবার ব্যাপার কাজ করেছিল। সময়ের সাথে সাথে সেটা সম্ভবও হয়ে উঠেছিল। কিছু কিছু মানুষ তাদের প্রাথমিক হীনমন্যতাজনিত জড়তার জাল
কাটিয়ে উঠে একসময় আমাকে তাদের ‘ক্লোজ কন্ফিদান্ত’ বানিয়ে ফেলেছিল। বয়সে সবার চেয়ে ছোট
ছিলাম। অথচ একদিন খুব বিস্ময়মিশ্রিত আনন্দের সাথে আবিষ্কার করলাম
যে, আমাকে বিশেষ করে তারা তাদের জীবনের লুকানো অজানা গোপন,কিছু কিছু ক্ষেত্রে
নিষিদ্ধ, গল্পগুলো অবলীলায় বলে যাচ্ছে। যারা নাকি শুরুতে
আমাকে তাদের মাঝে স্বাগত জানাতে ছিল ভীষণ কুন্ঠ।
তাই এ
কারণে এক সময় আমি তাদের ক্ষমা করে দিয়েছিলাম।
কিন্ত্ত
ওই কলেজে কর্মকালীন পুরোটা সময়ের কখনো আমাকে ওই আগন্ত্তক অনুভূতির অক্টোপাস
সেভাবে জড়াতে পারেনি। প্রথম দিকের ইনিশিয়াল
হিক্কাপ ছাড়া ।
অক্টোপাসটা সবলে আমাকে আঁকড়ে ধরতে শুরু করলো
সেদিন থেকে যেদিন আমি দেখলাম, রাজধানী শহরের সেই প্রতিষ্ঠিত
প্রতিষ্ঠানের কলেজ সেকশনের কিছু ছাত্র অতিরিক্ত মাত্রায় বেয়াদবি করছে তাদের
ইংরেজির নতুন শিক্ষকের সাথে। উপেক্ষা করতে থাকলাম
স্বভাবজাত উদাসীনতায়। একদিন দেখলাম, প্রিন্সিপ্যাল মহোদয়া
দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে আমি শ্রেণিকক্ষে কিভাবে পাঠদান করছি তা চোখ
মেলে কান খুলে পর্যবেক্ষণ করছেন। ক্লাসের
বিঘ্ন ঘটিয়েই ডেকে নিয়ে কিছু অমূল্য পরামর্শ দিলেন। সবকিছু না বুঝলেও এতটুকু ঘটে ঢুকতে অসুবিধা
হলো না যে, অ্যান আউটসাইডার অ্যাপ্রোচ ইন অ্যান অ্যাটাকিং ফর্ম ইজ ইন দ্য অফিং…ঠোঁট চেপে দাঁত কামড়ে ভাঙা ক্লাস জোড়া
দেবার চেষ্টায় ফিরে গেলাম।
প্রশ্নপত্র তৈরি, ক্লাস টেস্ট, মডেল টেস্ট-এর
খাতা দেখা, পরীক্ষার হলে টানা ডিউটি সব পালন করে যাচ্ছি বটে, তবে ওই অনুভূতিটা
আমাকে ছেড়ে যায়না। টিচার্স কমন রুমে আমি রাজধানী শহরের শিক্ষকদের
বিত্ত-বৈভবের লোভনীয় সব গল্প শুনি। কেউ নিকেতনের ফ্লাটের
কিস্তির টাকা পরিশোধ করছে, তো আরেকজন অ্যামেরিকায় বাস করা পরিবারের আরেক অংশের
সাথে আগামী রোজার ঈদের
ছুটি কাটানোর পরিকল্পনা করছে। সবকিছু যেন কেমন
কেমন! অ্যা সুপারফিশিয়াল টাচ অব হ্যাপিনেস! আমি ঠিক কোন বোধগম্য
ভাষায় রাজধানীবাসির এই নকল আমোদ-সুখানুভূতি প্রকাশ করতে সক্ষম নই।
আর ওইসব আর্টিফিশিয়াল
গল্প শুনতে শুনতে আমার কেবলি মনে হতে থাকে,
আমাকে এই এখানে ঠিক যেন মানায় না। এই সস্তা চাকচিক্যের
সিস্টেমে। অথচ আমাকে এখানেই জীবিকার জন্য জীবনের জন্য সারভাইভ করার
চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে! মাঝে মাঝেই আমার ভেতর
হাঁশ-ফাঁশ জাতীয় কিছু একটা তড়পাতে থাকে। আমার বুড়ি দাদিটা
গ্রাম ছেড়ে আমাদের বাসায় কিছুদিনের জন্য বেড়াতে এসে কয়দিন যেতে না যেতেই যেমন
বলতো, ‘ফাঁপড় লাগোছেরে বাবা, হামি আর তোদের এখানে থাকবার পারোছিনা, হামাক ব্যাড়িত থুয়ে আয়’।
আমি দাদির মতো করে কারো কাছে বলতে পারিনা।
কেবল দীর্ঘশ্বাসের কুন্ডলি পাক খেয়ে খেয়ে ফুলার রোড থেকে উড়ে উড়ে গিয়ে ঈদগাহ রোডের দিকে মিশে
যেতে থাকে!
আমি এর মধ্যেই সান্ত্বনার খোঁজে এদিক-ওদিক
তাকাই। ফরিদা নামের আমার দু’বছরের সিনিয়র আপা জুওলজি পড়ান। তিনি আপাদমস্তক কালো-মেরুন বোরখায় মোড়ানো। তাকে স্বাভাবিক কারণেই এই অতি আধুনিক শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানে
একটু বেশি রকম বেমানান লাগে। হয়তো সেটা তিনি
বুঝতে পারেন। একদিন আমার সামনে কলেজ ম্যাগাজিনের পুরনো একটা সংখ্যা
বাড়িয়ে দেন। আমি সেটার পাতা উল্টাতে গিয়ে শিক্ষক-মন্ডলীর
ছবির ভেতর তার খোলা মাথার এলোচুলের ছবি দেখে একবার তার দিকে, একবার ছবির দিকে
তাকাই। আমার সেই না মেলাতে পারার অক্ষমতা! বুদ্ধিমতী ফরিদা
আপা আমার দ্বিধান্বিত চোখের ভাষা পড়ে ফেলেন।
হাসতে
হাসতে বলে উঠেন, ‘আগে আমি এরকমই ছিলাম; বিয়ের পর থেকে এরকম। আমার হাজবেন্ড চায় আমি এরকমভাবেই থাকি’। এরকম কিরকম বোঝার ক্ষীণ চেষ্টা করতে গিয়ে আমার আবার সেই
অক্টোপাসের জালে জড়িয়ে যাওয়া। ফরিদা আপার কাছে
আমার কিছু প্রশ্ন করবার ইচ্ছা হয়। কিন্ত্ত নিজেকে
সামলে ফেলি। কথা কোথা থেকে কোনদিকে মোড় নেয় সেই আশঙ্কায়।
আমার মনে হতে থাকে, শুধু আমি নই, আমার চারপাশে
আরও আগন্ত্তক। ভিন্ন চেহারায়, ভিন্ন পরিচ্ছদে।
পার্থক্য একটাই, তাদের অনুভূতি আমার মতো এতটা…এতটা কি?
নিজের সম্পর্কে এত উঁচু ধারণা রেখে কি লাভ যখন ওই অনাহুত
বহিরাগতের বোধ থেকেই নিজেকে মুক্ত করতে পারিনা।
তাই পরীক্ষার হলে ডিউটি করতে গিয়ে যখন স্কুল
সেকশনের ইংরেজির মুমতাহিনা আপার কথা শুনি,তার জীবনের গল্পের অত্যাশ্চর্য যাদুময়তায় আবিষ্ট হয়ে পড়ি, তখন এই বোধ সক্রিয় হয়ে উঠে যে, নিজেকে শুধু যেখানে-সেখানে
আগন্ত্তক ভাবলেই চলবেনা, নিজস্ব বিশ্বাসের যুক্তিতে সেটার ওপর একটা আলাদা
মাহাত্ম্য আরোপ করতে পারলেই কেবল তা সম্মানজনক অনুভূতির মর্যাদা
পাবে। নিজেকে এতটা অসহায় তখন আর মনে হবেনা। কারণ মুমতাহিনা আপার সাথে কথা বলতে গিয়ে আমি অনুধাবন করতে
পারি, কি দৃঢ়তার সাথেই না তিনি তার অর্জিত বিশ্বাসের কথা,
নিজের অস্তিত্বের প্রয়োজনেই নিজেকে অনেকের মাঝে আলাদা করে নেবার কথা বলছেন! আমি হা
হয়ে তার কথা শুনতে থাকি। কেমন একটা ঘোর লাগে, অশরীরী শিহরণ অনুভব করি। আমাদের ভেতর ফিসফিস স্বরে যেসব বাক্য বিনিময়
হয় সেগুলোর মাঝ থেকে তার বলা কথাগুলো আমার কানে মন্ত্রধ্বণির মতো বাজতে থাকে।
‘এই এখনকার বোরখাচ্ছাদিত আমাকে দেখে নিশ্চয়
তুমি বিশ্বাস করবেনা যে, একসময় আমি খুব সাজতাম-টাজতাম।
লিপস্টিক ছাড়া বাইরে বের হবার কথা চিন্তাও করতে পারতাম না (তার
কথা শুনতে শুনতেই তার হাল্কা রঙে রাঙানো ঠোঁটজোড়ার দিকে এক পলক দৃষ্টি ফেলেই আমি
আমার রঙবিহীন শুকনো ফ্যাকাসে ঠোঁটজোড়া জিব দিয়ে আলতো করে ভিজিয়ে নিই এবং নিজের
অবস্থান টের পাই!)। একবার আমার মেয়েটা ভীষণ জ্বরে পড়লো। কিছুতেই ছাড়েনা। এত ডাক্তার-ওষুধ-পরীক্ষা-নিরীক্ষা। কিছুতেই কিছু হয়না।
একদিন হঠাৎ জায়নামাজে পড়ে থাকা অবস্থায় আমার মনে হলো, জীবনের এত আয়োজন, এত রঙ-ঢঙ দিয়ে
কি হবে যদি আমার মেয়েটাকেই বাঁচাতে না পারি? সেদিন থেকেই আমি অতিরিক্ত সাজ-সজ্জা
সব বাদ দিয়ে বোরখা পড়তে শুরু করি। যদিও আমার
হাজবেন্ডের খানিকটা আপত্তি ছিল প্রথম দিকে।
কিন্ত্ত আমার যুক্তির কাছে শেষ পযন্ত সে নতি স্বীকার করে। আমি
আমার মেয়েটাকে ফিরে পাই।’
মুমতাহিনা আপার জীবনের গল্প আমার কাছে রুপকথার
মতোই লাগে। এরপর আমরা আরো অনেক বিষয় নিয়ে কথা বলি। আমি হঠাৎ একবার তাকে বলে ফেলি, ‘জানেন
এখানে এই পরিবেশে আমার নিজেকে কেন জানি সবসময় কামুর আউটসাইডার-এর মতো লাগে। আমি যেন কেমন বেমানান। সেদিন
প্রিন্সিপ্যাল আপার রুমে পরীক্ষার খাতা ডিকোড করবার সময় বারবার শাড়ির আঁচলটা টেনে
নিতে দেখে তিনি আমাকে মৃদু তিরস্কার করলেন এই বলে যে, এখানে সবাই তো মেয়ে, বারবার
এত আঁচল টানতে হচ্ছে কেন। আশ্চর্য, এরকম একটা তুচ্ছ বিষয়েও এমনভাবে বলা যায় আমার
ধারণাতেও ছিলনা! ’
মুমতাহিনা আপা আমার কথা শুনে খুব সুন্দর করে
হাসেন।‘তুমি তোমার মতো থাকবে,
তাতে কার কি বলার আছে। আমাকে নিয়েও কি কম কথা হয়েছে? থোরাই কেয়ার। কারো ক্ষতি না করে
প্রত্যেকের নিজের মতো করে বাঁচার অধিকার আছে।
আমি যদি অন্যের ব্যাপারে নাক না গলাই, তাহলে অন্যের কেন আমার বিষয়ে এত অহেতুক আগ্রহ?’
আমার মনে হতে থাকে, মুমতাহিনা
আপার বলা কথাগুলোর সাথে আমার বিশ্বাসের একটা অদ্ভুত
মিল আছে। নিজেকে আরো একবার ওই আগন্ত্তক বা বহিরাগত ভাবার আগে এই
বিশ্বাসটাকে আরেকবার ঝালিয়ে নেওয়া প্রয়োজন…
লেখক পরিচিতি
মালেকা পারভীন
বাংলাদেশ ফরেন সার্ভিসের কর্মকর্তা। বর্তমানে ব্রাসেলস্থ বাংলাদেশ দূতাবাসে কাউন্সেলর হিসেবে কর্মরত।
মূলত ছোট গল্প লিখে থাকেন। কবিতাও তার আরেক ভালোবাসা। বাংলা এবং ইংরেজি উভয় ভাষাতেই। বাংলাদেশের বিভিন্ন সাহিত্য সাময়িকী ও পত্রিকা এবং অনলাইন ম্যাগাজিনে নিয়মিত লিখে থাকেন।
গল্পগ্রন্থঃ সিদ্ধান্ত ( ২০১২),
অনুধাবনের মতো কিছ(২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারি বইমেলায় জাগৃতি প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত)
মালেকা পারভীন
বাংলাদেশ ফরেন সার্ভিসের কর্মকর্তা। বর্তমানে ব্রাসেলস্থ বাংলাদেশ দূতাবাসে কাউন্সেলর হিসেবে কর্মরত।
মূলত ছোট গল্প লিখে থাকেন। কবিতাও তার আরেক ভালোবাসা। বাংলা এবং ইংরেজি উভয় ভাষাতেই। বাংলাদেশের বিভিন্ন সাহিত্য সাময়িকী ও পত্রিকা এবং অনলাইন ম্যাগাজিনে নিয়মিত লিখে থাকেন।
গল্পগ্রন্থঃ সিদ্ধান্ত ( ২০১২),
অনুধাবনের মতো কিছ(২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারি বইমেলায় জাগৃতি প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত)
0 মন্তব্যসমূহ