বাঙালির হরেক রান্নার মতো তার সাহিত্যেরও বিচিত্র স্বাদ। বাংলা ছোট গল্প ভাষার
ওই রান্নাঘরের এক অমোঘ শিল্পকর্ম। বিশ্বায়নের এই অবাধ বাজারেও, যৎসামান্য উপকরণ
দিয়ে তৈরি গ্রামবাংলার ঐতিহ্যশালী পদগুলি, নিদেন নারকেল-ছোলা-কাঁচালঙ্কা দিয়ে
মুড়িমাখাটি হারিয়ে যায়নি এখনও; স্বপ্নময় চক্রবর্তীর হাতে তৈরি ছোট গল্প থেকে সেই
ঐতিহ্যময়, কাঁচা মাটির ঘ্রাণটি আসে। কাঠকয়লার আঁচে মাটির হাঁড়িতে তৈরি রান্নার
সুঘ্রাণ। আবেগের প্রাবল্য নেই, অতিনাটকীয়তা নেই। বর্ণনা-বিবৃতির ঘনঘটা নেই, আখ্যানধর্মীতারও
বাহুল্য নেই। প্রাত্যহিক জীবনের অবশ্যম্ভাবী অনুভবগুলোকে তিনি এক মোলায়েম নির্লিপ্তিতে
এঁকে দেন পাঠকের সামনে।
গন্ধকাঁথা গল্পের সেজদা এক অবাঞ্ছিত চরিত্র। নিজের চাওয়া এবং না-পাওয়ার ব্যর্থতা যাকে
বাহ্যিক ভাবে রুক্ষ শুষ্ক করে তুলেছে। বড় দাদাদের পরে ব্যাঙ্কে চাকুরিরত সুপাত্র
ছোট ভাইয়েরও বিয়ে হয়ে যায়। নিজগুণেদোষে স্ত্রী-ভাগ্য বঞ্চিত সেজ ভাই তাই সোনাগাছি
থেকে এক ভালবাসার পাত্রীকে এনে বাড়ির একই তলায় নিজের ঘরে এনে ওঠায়; বাজার থেকে
ইচ্ছে করে কিনে আনা পচা মাছ নিয়ে তার সাথে ঝগড়া করে সাংসারিক সুখ পেতে চায়। মধ্যবিত্তের
বাজার যাওয়া, দরাদরি করা, বাসে ঝুলে রোদে কাঠ হয়ে অফিস যাওয়ার বৈচিত্র্যহীন
সংসারধামে ঝগড়ার পুণ্যিটুকুও যে ফেলনা নয়, এমনভাবে কে জানত! ছোটভাইয়ের সদ্যজাত
সন্তানের কাঁথা চুরি করে নিজের বিছানার তোষকের তলায় লুকিয়ে রাখে ‘সেজদা’। নিজ পরিবারের কাছেই যে এক কাঁটা যাকে গেলাও
যায় না, উপড়ে ফেলাও যায় না – তার অন্তরমহলে দুমড়েমুচড়ে গুঁজে
রাখা পিতৃত্বের আকাঙ্খাকে হ্যাঁচকা টান মেরে বারোয়ারি উঠোনে এনে ফেলেন স্বপ্নময়,
যখন লেখেন “- সেজদা একটা গ্লিসারিন সাপোজিটার
বাচ্চাটার পায়ুদেশে ঢোকাচ্ছে। প্যারালিসিস হয়ে যাওয়া বাঁ হাত দিয়ে গ্লিসারিন
স্টিকটা বাচ্চাটার পিছনে ঢোকাবার চেষ্টা করছে। পারছে না, ছিটকে যাচ্ছে। দরজার
ছিটকিনি বন্ধ। দেয়ালে ভূতের ছবি”।
এই বাচ্চা ভদ্র বাড়ির
কুষ্ঠিকৌলিন্যে উজ্জ্বল এক শিশু নয়। সে সেজদার ভালবাসার পাত্রী মধ্যবয়সিনী চম্পার
নাতি। স্টিকটা ঢুকে গেলে বাচ্চাটাকে জড়িয়ে ধরে সেজদা“লালাময় মুখে বলছে, গোপাল আমার, কলজে আমার, ফুসফুস আমার, অক্সিজেন আমার, হেগে
দে সোনা, আমার সারা গায়ে হেগে দে”। বাচ্চাটা সেজদার গায়ে
মলত্যাগ করে দিলে সেজদা নিজের তোষকের নিচে লুকিয়ে রাখা ছোট ভাইয়ের কন্যার কাঁথা
বার করে আনে, গা মোছে। এক অজ্ঞাতকুলশীল শিশুর মলস্পর্শে যেন পবিত্র হয়ে ওঠে
ভদ্রবাড়ির বাচ্চার কাঁথা – আসলে কাঁথা নয়, জন্মসূত্রে পাওয়া
সেই সম্পর্কগুলো যাদের ফাটলে এখন আর মায়ামমতার ছিঁটেফোঁটাও শুকিয়ে নেই। সাজানো
গোছানো সামাজিক ভন্ডামির মুখোশে সপাটে লাথি কষান লেখক। জলের প্রবাহে সব কলঙ্ক ধুয়ে
যায়- “সেজদা মলমাখা হাতিছাপ কাঁথা
জলকাচা করছে। ... থুপথুপ। থুপথুপ। জলের শব্দ। থুপথুপ। জলের ছিটে। ... কাঁথার থেকে
বেরিয়ে আসছে গান। সেজদা গান গাইছে”। (গন্ধকাঁথা, শারদীয়
আনন্দবাজার, ১৯৯৮)
‘নারী
হওয়া’ গল্পটি
অতি সামান্য এক অনাথ গ্রাম্য মেয়ের সাধারণ গল্প; যার মা’
বেবুশ্যেবৃত্তি গ্রহণ করে চলে গেছে, বাবা রঙীন চশমা পরে নারকেল গাছে ডাব পাড়তে উঠে
পড়ে মরেছে, যৌবনের আশকারায় যে স্বামী হিসেবে গ্রহণ করেছিল এক গ্রাম্য যুবককে যে
বিএসএফকে মেয়ে সাপ্লাই দিত; সেই মেয়ের আপাত ভাবে পিতৃপরিচয়হীন সন্তানের জন্মের
কাহিনী। কিন্তু মোচড়টা সেইখানে নয়। কারণ এমনটা সকরুণ হলেও ঘটে থাকে। পাচার
বৃত্তিতে জড়িয়ে যাওয়া নারী আর স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে চায়নি, এমনটাও তো আকছারই ঘটে।
স্বাভাবিক বলে আমরা যা যা কিছু মেনে নিতে নিতে জীবনের ব্যাসকে বাড়িয়ে চলেছি, তার
মধ্যে কোনটা সময়ের আঘাত সামলে আত্মস্থ করা যাবে আর কোনটি যাবে না, সেই দ্বন্দ্বের
সামনে নিরন্তর পাঠককে ফেলে দেন লেখক। পুঁটুর বাচ্চার মাথা আটকে গেছে, হাত বেরিয়ে
এসেছে আগে এবং তাকে কিছুতেই ভূমিষ্ঠ করানো যাচ্ছে না। মা ও শিশু দুজনেই ক্রমশ
নিস্তেজ হয়ে পড়ছে। ভোটের দিন কিচ্ছু পাওয়া যায় না। কোনমতে একটা ভ্যানরিকশাতে
চাপিয়ে পুঁটুকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। “কালিদাসী শায়া উঠিয়ে দেখল রক্তমাখা হাতটা নিস্তেজ ন্যাতন্যাত করছে। কালিদাসী
বুঝল আর নেই সে। ... কালিদাসী, হে বিশ্বনাথ হে বিশ্বনাথ করতে লাগল, হে কালী, হে দুর্গা,
হে কাস্তে হাতুড়ি, হে পদ্মফুল, হে হাত করতে লাগল। ... অন্য ডিপার্টমেন্টের নার্স
এসে পুঁটুর নাকে অক্সিজেন দিল। শায়াটা তুলেই বলল— ওমা, এ যে দেখি প্রতীক চিহ্ন”। হাত না হয়ে
কাস্তে-হাতুড়িও হতে পারত সেই প্রতীক, কিন্তু মানুষের পেট থেকে তো কাস্তেহাতুড়ি বেরোয়
না।
আসলে চামড়ার রঙ নির্বিশেষে
এই হাত সেই ক্ষমতার প্রতীক যা কখনও তার সমান্তরাল জীবনের কোন দায় নেয় না, যে জীবন
দৈনন্দিনের, ক্ষোভ অভিমান আনন্দ হাসিকান্নার। শহরে, গ্রামে বা মফস্বলে - কোথাওই
কোনদিনই মানুষের জীবনের সাথে সম্পৃক্ত হওয়ার কোন দায় তার ছিল না। অথচ, পুঁটুর সাথে
একই ভ্যানরিকশোতে চেপে কিছুদূর গিয়ে মুসলমান পাড়ায় নেমে গিয়েছিল যে বুড়ি, সে
রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে থাকে পোয়াতির খবর জানার জন্য। কাস্তে-হাতুড়ি, পদ্মফুল কিংবা
দুর্গা কালী নয়; মানুষের বিপদে, তার প্রাত্যহিকতায় ধর্মের, রাজনীতির সমস্ত প্রভাব
ও সংষ্কারকে ছাপিয়ে যায় মঙ্গল কামনা— “শুধু একজন পুরনো মেয়েমানুষ কোনও নবীন মেয়েমানুষের খোঁজ নিচ্ছে”। এইটুকু পেলেও জীবন অনেক অপূর্ণতাকে অগ্রাহ্য করে কিছু প্রাপ্তি
অর্জন করে। (নারী হওয়া, পুরশ্রী, ২০০২)
চিড়িয়াখানায় ঘাস কাটার
ফাঁকে পরম বৈষ্ণব কানাই বাঘের খাঁচায় হাত ঢুকিয়ে মাংস চুরি করতে যায়। মেথরপাড়ার
আরতির জন্য। আরতিই তার রাধা। সরকারি হাসপাতালে কনুই থেকে কেটে হাতটা বাদ দিতে হয়।
জ্ঞান ফেরার মুহূর্তে সে বলতে থাকে— হরি বাঘ হরি বাঘ বাঘ বাঘ হরি
হরি। ডাক্তারকে জিজ্ঞাসা করে, “বাঘ এসেছিল?” তারপর বলে,“বাঘের খাঁচায় কত খাবার। আর আরতির
বুকের খাঁচায় পোকা। তখন কী করাটা উচিত? অ্যাঁ!” কী করা উচিত কে জানে! পাঠক তো এইটুকু জানে যে অন্যের যক্ষ্মা সারানোর জন্য বাঘের খাঁচা থেকে মাংস তুলে আনতে চাওয়া
এক অলীক বাস্তব। সেই বাস্তবের ধাক্কায় বাঁশিটি হারিয়ে যায় কানাইয়ের। বাঁশি বাজানোর
আঙুলগুলোও হারায়। ব্যান্ডপার্টির কোট, কাগজের মালা গলায় অলীক ‘রাধাকৃষ্ণ’ মিশে যায়
শহরের ঝকঝকে শরীরে। গল্পের বাইরে তারা কোন চরিত্র নয়, তারা আম-পাঠকের কেউ নয়। (রাধাকৃষ্ণ,
শারদীয় বর্তমান, ২০০৪)
‘ধর্ম’ গল্পটা একান্ত ভাবে আম-পাঠকের। কলকাতা বা শহরতলির এখনকার যা
সামাজিক অবস্থা— সাধারণ মধ্যবিত্ত বাঙালির হাতে পয়সা নেই; তত
পয়সা নেই যা থাকলে ভিন রাজ্য থেকে আসা ব্যবসায়ীকুলের সাথে একটু দামী মাছ কেনার,
কাজের লোক রাখার, জমির কাগজ বার করানোর জন্য কর্পোরেশনের কোনও ডিপার্টমেন্টে ঘুষ
দেয়ার কিংবা বাড়িতে আয়া রাখার প্রতিপত্তিতে পাল্লা দেয়া যায়। সাধ্য নেই কিন্তু দায়
তো আছে, প্রয়োজনও আছে। তাই, জরিনা ‘খাতুন’ নাকি ‘বিশ্বাস’ তার সপক্ষে তেমন কোনো প্রমাণ না থাকলেও ‘হাসিনা’কে মায়ের যত্ন নেয়া থেকে অব্যাহতি দিয়ে সেই
কাজটা জরিনাকে দিতে হয়। দুটি মাত্র মোক্ষম সংলাপ এই টানাপোড়েনের নাড়ি ধরে রাখে— “তুমি যে ঠাকুরের জল দিচ্ছ?
অসুবিধা হচ্ছে না?” এর উত্তরে হাসিনা বলে, “আমার কিসির অসুবিদে! আমার তো অসুবিদে নেই, ঠাকুরের অসুবিদে হলি অন্য কথা”। ঠাকুরের অসুবিধা হয় কেননা হাসিনার গরু খেতে অসুবিধা না থাকলেও শুয়োর খেতে
বিলক্ষণ অসুবিধা আছে, ফলত ঠাকুরের জলটা তাকে দিয়ে দেয়ানোটা উচিতের পর্যায়ে পড়ে না।
অফিসে মেরুদন্ড নিচু করে বাঁচতে বাঁচতে, বাঁচার জন্য হাজারটা মিথ্যা কথা বলতে বলতে
জীবনের কোন এক প্রান্তে এসে সত্যিটার হিসেব মেলানোর দরকার পড়ে বৈকি। উচিত-অনুচিতের
হিসেব মেলানোরও দরকার পড়ে। যতই হোক, মা জানে না যে তার বড় মেয়ে অনু মরে গেছে।
অসুস্থতার ঘোরে মা ভাবে, হাসিনাই অনু। কিন্তু সে তো ঘোরের মধ্যে। ঘোর কেটে গেলে? (ধর্ম,
দুর্বাসা, ২০০২)
আমাদের আগের প্রজন্ম ও
তাদের পূর্ব প্রজন্মের প্রায় প্রত্যেক হিন্দু যাদের জন্ম অবিভক্ত বাংলাদেশ অঞ্চলে
এবং যাদের দেশভাগের পরে এপারে চলে আসতে হয়েছে, সেই মানুষগুলির ব্যক্তিগত জীবনের
কাহিনী, পারিবারিক জীবনের কাহিনী উদ্বাসন কাব্য। ভিটে ছেড়ে এসেছে মানুষ,
ভাষা ছাড়তে পারে নি। মুক্তিযুদ্ধোত্তর সময়েও তাই এপারে থিতু হওয়া উদ্বাস্তু
মানুষের ভাষার মধ্যে আলকুশির মতো লেগে থাকে উর্দু শব্দ। বাড়িতে ইলেকট্রিক আলোর
কানেকশন আসার আনন্দে মেতে ওঠা নাতি-নাতনীদের সাথে চোখ বেঁধে আলোর স্যুইচ জ্বালানোর
খেলা খেলতে থাকা শ্বশুরকে দেখে বৌয়ের মন্তব্য— “একখান মুছিব্বত বাধাইবি তোরা, বুড়া পইর্যা গেলে কি হইব?” ভাষার ধর্মের রাজনীতি এসেছে অনেক পরে। ঔদার্য বা সহনশীলতার কদর্য মুখোশ নয়— একে অপরের হতে গেলে, ধর্ম বর্ণ জাত ভেদে যতখানি কাছের হওয়া চলে, আপোষে—সংঘাতে যতটা নিজের হওয়া চলে, তাই নিয়ে বেঁচে ছিল মানুষ। কিন্তু সে থাকার ফাঁকি
পাকানো রশি হয়ে উঠে দিনে দিনে গলায় ফাঁস লাগিয়ে দেবে— “মোছলমানের মাতাত লবণ থুই হিদুগো বরে খাওনের দিন শ্যাষ। কই দিলাম (...) শুইনছেন
কি কত্তা...”।
যোগেন মন্ডলের সুতীব্র
উল্লেখও দেখি এ গল্পে— “যোগেন
মন্ডলের তখন ছেঁড়া পাঞ্জাবি। মুখে দাড়ি। উনি পশ্চিমবঙ্গে পালিয়ে এসেছেন। উনি
চেষ্টা করছেন পলিটিকাল সাফারারের ভাতাটা যোগাড় করা যায় কি না”-! গান্ধী জিন্না রানি নেহরু মাউন্টব্যাটেন— এইসব
বিসংবাদ ছাড়িয়ে বরিশালের সেনগুপ্ত পরিবারের মেয়ে সুচেতা কৃপালনীর সুললিত কন্ঠে রক্তকে
তাতিয়ে দেয়া ‘বন্দেমাতরম’। মায়ের
চেহারা আমরাই দিনে দিনে পালটে ফেলব, আর তখন— স্বাধীনতার পঁচিশ বছর পরেও
সুভাষের ঘরে ফেরার কামনায় দোয়াতে কলম ডুবিয়ে অন্ধকারে বসে থাকবেন এক বৃদ্ধ। এমন
দুর্ভাগ্যের দিনে সুভাষের ফিরে আসা, ঠিক যেন— ‘রিফিউজি ঘরেও বিজলি বাতির আলো’ অথবা ‘শূন্যতা
জুড়ে আলোময় হয়ে থাকা’। (উদ্বাসন কাব্য, শারদ রাজপথ, ২০০০)
আপাত ভাবে লৌকিক কাহিনী ‘তাল্লাক’।
উপমহাদেশের সামাজিক পটভূমে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করা ধর্মীয় রাজনীতির
প্রত্যক্ষ অনুল্লেখেও, এই কাহিনীর মাধ্যমে লেখক আসলে উপমহাদেশের ইতিহাসে ধর্মীয়
সমন্বয়ের চিরকালীন ঐতিহ্যকে তুলে ধরেন।
রমাপদ মিত্র গ্রামে ঘুরে
ঘুরে মন্দিরের গা থেকে লিপি, গ্রাম-কথা, লোকাচার সংগ্রহ করেন। গল্পটা শুরু হয়
হুগলি জেলার বলাগড়ের কাছে আলমণিপুর গ্রামের এক পরিত্যক্ত মন্দিরগাত্রে খোদিত এরকমই
এক অদ্ভুত লিপি দিয়ে— “এই
শ্রীঁশ্রী বাটিতে কেহ পাদুকা পায়ে দিয়া জাইবেন নাই, যে জাইবেন তাহাকে তাল্লাক।।...” তাল্লাক বা তালাক শব্দটার সঙ্গে হিন্দু লোকাচারের কোন
সম্পর্ক নেই, সুতরাং হিন্দু মন্দিরের গায়ে এই শব্দের খোদাই বিস্ময়কর। গল্পের মধ্যে
আস্তে আস্তে এই বিস্ময়ের আড় ভাঙতে থাকেন লেখক। জানা যায়— “সুবল মিত্রের অভিধানে আছে তালাক মানে হল— ... দিব্যি দেয়া, শপথ, প্রতিজ্ঞা।... ‘নিষেধ’ বোঝাতে গিয়ে ‘শপথ’ শব্দটার ব্যবহার কোথায় যেন
দেখেছেন উনি’। রমাপদর আয়া বীণাপাণি,
আলমণিপুর গ্রামেরই মেয়ে, একটা গান শোনায়, আমানুল্লার কিসসা।“আমানুল্লা বলে আল্লাতালা সর্বত্র রয়েছে/ পানিতে আসমানে গাছে পাথরেও আছে/
আল্লার হুকুমে পির মন্দির রচিল/ আল্লা শিব বলি পির সেজদা করিল...”। ইতিহাসের কাহিনী মনে করতে থাকেন রমাপদ মিত্র। আলমণিপুর নাম
এসে থাকতে পারে আলমোমিনপুর থেকে, মুসলিম শাসক তখ্তে বসার পর বহু গ্রামেরই আসল হিন্দু নাম পালটে গিয়েছিল সে
সময়। সপ্তদশ শতাব্দীর মুসলিম অধ্যুষিত গ্রামে— “শ্বেত শুভ্র দাড়ি শোভিত আমানুল্লাকে যেন দেখতে পান রমাপদ। দেখেন তাঁর নিষেধের
হাত। মন্দির ভাঙতে দেয় নি আমানুল্লা। সে নিজে রক্ষা করেছিল”। এজন্য তাকে খুন করে মৌলবাদী ধর্মান্ধ মুসলিমরা, অথচ পরে
হিন্দুরাও ফিরে এসে সেই মন্দিরকে আর গ্রহণ করেনি। মন্দিরের শিব লিঙ্গকেও গঙ্গায়
বিসর্জন দিয়েছিল তারা।
আমানুল্লার মৃত্যুর চারশো
বছর পরে মৃত্যুশয্যায় শায়িত একজন হিন্দু আলমণিপুর নামের উৎস সন্ধান করতে করতে,
তাল্লাক শব্দের হিন্দু ব্যবহার বুঝতে বুঝতে, মন্দির গাত্রের লিপির বৈশিষ্ট্যের
খোঁজে কী ভাবে যেন এক হয়ে যান আমানুল্লার সঙ্গে, সব ধর্মের মূল সুরটির সঙ্গে, যে
সুর এই উপমহাদেশের বাঁশিতে তবলায় সারেঙ্গিতে, পাখির কন্ঠে শিশুর কলকাকলিতে— “আমানুল্লাকে দেখতে পান রমাপদ। তারপর
সেই আমানুল্লা টেরাকোটার ফলকে বসে যায়। ... রমাপদ তখন নিজেই মন্দির হয়ে উঠছেন
ক্রমশ, সারা গায়ে টেরাকোটা”। সে সুর আত্মস্থ করতে পারলে মানুষ তার উৎসের সঙ্গে একাত্ম হয়ে যায়, কয়েক
শতাব্দী পেরিয়ে এসে সেই মৃত্যুঞ্জয়ের বাণী আচ্ছন্ন করে, আশ্বস্ত করে আমাদের—“এই শ্রীশ্রী বাটিতে হে মরণ তুমি আসিবে নাই। যদি আসিবে তবে তাল্লাক, তাল্লাক,
তাল্লাক”। (তাল্লাক, শারদীয় বর্তমান,
২০০২)।
এই বইয়ে সংকলিত গল্পগুলোর
একটা প্রধান বৈশিষ্ট এদের ভাষা। লোকমুখের ভাষাকে প্রাধান্য দিয়েছেন লেখক তাঁর
অধিকাংশ কাহিনীতে। শহর কলকাতার, বিত্তপ্রধান কলকাতার শিক্ষিত ভাষাকে পাত্তা দেয়ার
কোন চেষ্টা এই লেখাগুলোর মধ্যে নেই। আঙ্গিক ও বিন্যাসও বহুধাবিস্তৃত। গল্পের অনেক
চরিত্র গ্রামাঞ্চলের দিকে ট্রেনে বাসে অথবা নৌকোয় যেতে যেতে দেখা মানুষজনের মতো— জীবনে একবারই দেখা হয় আমাদের, আর হয় না, অথচ শাইনিং ইন্ডিয়ার বাইরে ওই চৌকো
খোপের সমান্তরাল জীবনের পাশ কাটিয়ে হাঁটতে হাঁটতে কখন যেন ঘোড়ার গাড়ি কিংবা নিকনো
উঠান দেখার অছিলায় আমরা সন্তর্পণে ঢুকে পড়ি যৌথ শিকড়ের সেই ঘাসজমিতে। স্বপ্নময়
চক্রবর্তীর কাহিনী ভীষণ ভাবে ওই শিকড়ের কথা বলে, আমাদের পূর্বপুরুষের স্পর্শে শীতল
মাটির গহীন ছায়ার কথা বলে। এক গভীর উপলব্ধির কথা বলে।
আনন্দ পাবলিশার্স থেকে
প্রকাশিত পঞ্চাশটি গল্পের এই সংকলনের অধিকাংশ গল্পগুলোর গায়ে শেষরাত্রির অন্ধকার— এক স্মৃতিবিধুরতার প্রলেপ। এই স্মৃতিবিধুরতা, নকলনবিশ কবিদের স্বভাবজাত
ন্যাকামি নয়। দেশভাগ হওয়ার পরেও, ভিটেমাটি-ছাড়া হওয়ার পরেও, মুখাগ্নি করার পরেও যে
প্রিয়মুখ আমরা কখনও ভুলি না, যে স্নেহস্পর্শ আমাদের অন্তর্লীণ জড়িয়ে থাকে— এই স্মৃতিবিধুরতা কেবল সেইটুকু আচ্ছন্ন করে তার কাহিনীর বুনোটে। ভোর হলে মনে
হবে এর কোনো কিছুই আমার সাথে তো ঘটে নি। অথচ চারপাশেই কোথাও ঘটেছে, ঘটছে— টের পাই।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন