কাল রাত থেকে রেড্ডি বাড়ি ফেরে নি । শৈলজা অনেক রাতে একবার বাড়ি ফিরেছিল ঠিকই, সকাল হতে না হতে আবার চলে এসেছে । জরুরী সিদ্ধান্ত হবে আজ । এই সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করছে সব কিছু ।
এমনিতে রোজ বাড়ি না ফিরলেও ক্ষতি নেই । ছোট দুই ছেলে দেরাদুনে রেসিডেন্সিয়াল স্কুলে পড়ে, বড় ছেলে নাগপুরে ইজ্ঞিনীয়ারিং কলেজে ফাইনাল ইয়ার । ঘর সামলাবার জন্যে চৌকশ লোকও আছে, কুড়ি বছরের ওপর কাজ করছে মহাদেবী । খুব মায়া শৈলজার সংসারের জন্যে ।
দেশে বিদেশে নিশ্চিন্তে ঘুরে বেড়ায় দুজন । নিজের শহরে থাকার সময়ও কম ।
ম্যানেজার মুত্থুস্বামী দলের সঙ্গেই ঘোরে, রেড্ডিরা সঙ্গে না থাকলেও বেশ চালিয়ে নিতে পারে ।
কাল রাত থেকে মুত্থুস্বামীর ঘরেই আছে রেড্ডি । চেন্নাই থেকে গোপিকিশন, উত্তরপ্রদেশ থেকে বিনায়ক, আসাম থেকে সুবোধ .. সবাইকে ডেকে পাঠানো হয়েছে ।
রঘুনাথ আর গণেশ ঘরের বাইরে দাঁড়িয়ে আছে । এ দুজনও অনেক দিনের পুরোনো লোক । ঘরে ঢোকার সময় ইশারায় ডেকে নিল শৈলজা । তারপর সবাই চুপ করে বসেই রইল ।
‘কি করা যায় ?’ অনেকক্ষণ পর, যেন আপনমনে বলে উঠল রেড্ডি ।
আবার সবাই চুপচাপ । তারপর মুত্থুস্বামী মুখ খুলল, ‘আমি তো বলব, আগের কথাটাই থাক । দল তুলে দেওয়াই ভালো ডিসিশন ।‘
রঘুনাথ আর গণেশ একে অন্যের দিকে তাকাল একবার । ব্যাটা বুড়ো ঘুঘু । জেমিনি সার্কাসের সঙ্গে ওর যে কথা হয়ে গেছে, তা জেমিনির পিল্লাই রঘুনাথকে বলে দিয়েছে । এখানের কারবার তুলে দিয়ে জেমিনি সার্কাসে চলে যাবে মুত্থুস্বামী । এর মধ্যেই প্ল্যান করে কতজনকে সরিয়ে নিয়েছে, তা কি আর জানা নেই ? রেখা আর জুগনু দুই সেরা সুন্দরী, এ দলের আকর্ষণ ছিল, শুধু শুধুই জেমিনি সার্কাসে গেছে নাকি ? সব এই বুড়ো ঘুঘুর ব্যবস্থা ।
কেন যে রেড্ডি লোকটাকে এখনো বিশ্বাস করে !
রঘুনাথ ভেবেছিল শৈলজাকে বলবে । গণেশ বারণ করল । মুত্থুর সঙ্গে কিরকম যেন আত্মীয়তা আছে রেড্ডিদের । প্রমাণ ছাড়া কিছু বিশ্বাস করবে না শৈলজা ম্যাডাম । ঘুরিয়ে ফিরিয়ে রূপকুমার রেড্ডিসাহেবকে বলেছিল অবশ্য । কিন্তু লোক-হাসানোর কারিগর রূপকুমারের কথায় কেউ গুরুত্ব দেয় নি ।
শৈলজা একটু বিরক্ত হল, ‘এতগুলো লোকের সংসার চলে, দল বন্ধ করে দাও বললেই হয় নাকি ?’
নড়েচড়ে বসল রঘুনাথ, ‘জি ম্যাডাম । আমিও সেই কথাই বলতে চাই । কারবার বন্ধ করার জন্যে তো এমন গোল-টেবিল বৈঠক করার দরকার নেই । কি করে চালু রাখা যায়, সেটাই বরং সবাই ভাবুক ।‘
নাকের মধ্যে দিয়ে বিরক্তিকর শব্দটা করল মুত্থুস্বামী, ‘দিনের পর দিন লোকের ভিড় কমছে । গত সপ্তাহে একদিনও গ্যালারি ভরে নি । এ সপ্তাহে তো অবস্থা আরো খারাপ । চালু রেখেও কি আর লোকের সংসার চালানো যাবে ?’
রেড্ডির দিকে ফিরল, ‘অফারটা নিয়ে নেওয়াই ভালো । ওরা বলছে, আমাদের লোকজন জন্তুজানোয়ার কাউকে তাড়াবে না । আমাদের জন্যেও একটা অফার দিয়েছে । মেলাগুলোর সঙ্গে আমাদের যোগাযোগগুলো ওরা ব্যবহার করবে । এমনি এমনি তো আর সাতাশ পার্সেন্ট দেবে না ।‘
শৈলজা মুত্থুস্বামীকে উপেক্ষা করল, ‘আমরা কি কমিক সাইডটা নিয়ে ভাবব একটু ? রূপকুমার আছে, গুন্নু-ডুজ্ঞু দুই বামন আছে । একাধারে দারুণ খেলোয়াড় আর জোকার । সবচেয়ে বড় কথা, আমাদের শান্তি আছে । তিনফুটের মেয়ে জোকার আর কোনো দলে নেই ।‘
রঘুনাথ বলল, ‘ভালো আইডিয়া । নতুন মজা, নতুন হুল্লোড় । খেলার মাঠের চিয়ার-লিডারদের মতো মেয়েদের নাচ দিলে কেমন হয় ?’
রেড্ডি জোরে জোরে মাথা নাড়ল, ‘সব বদলে যাচ্ছে । ফ্যাশন বদলে যাচ্ছে । মানুষের রুচি বদলে যাচ্ছে । মন বদলে যাচ্ছে । এখন আর ওসব দিয়ে ভিড় টানা যাবে না । একইরকম ক্লাউন, একইরকম ভাঁড়ামো .. নাহ । চিয়ার-লিডার মেয়েদের মতো ছোট জামা তো আমাদের মেয়েরাও পরছে । নাহ । ওসব দিয়ে হবে না ।‘
অভ্যেসমতো মাথার চুল এলোমেলো করল রেড্ডি, ‘মুত্থু ঠিক বলেছে । শক্ত ডিসিশন নিতেই হবে ।‘
শৈলজা তাকাল স্বামীর দিকে । কত দুঃখে রেড্ডি এ কথা বলছে, একমাত্র সে জানে । কত কষ্টে দাঁড় করিয়েছিল এই দল । শহরে শহরে ঘুরে বেরিয়েছে মাসের পর মাস । গ্রামে গ্রামে ঘুরে খেলোয়াড় জোগাড় করেছে । দিল্লী-হরিয়ানা-কাশ্মীর ঘুরে ঘুরে ছেলেমেয়ে জোগাড় করেছে । তাদের ট্রেনিং নিয়ে কোনো কম্প্রোমাইজ করে নি । রাশিয়া থেকে সিংহের ট্রেনার এল, মাসকট থেকে বাঘের ট্রেনার ।
অ্যাপোলো সার্কাস । রেড্ডির নিজের হাতে গড়া দল । দল বন্ধ করে দিলে ও বাঁচবে কি নিয়ে ?
উপায়ও তো নেই । দিন দিন খরচ বাড়ছে । সেইমতো শো কই ? আজকাল সার্কাস দেখতে আসে না লোকজন । বিনোদনের কত ব্যবস্থা । মাল্টিপ্লেক্স । শপিং মল । ঘরে ঘরে টিভি । হাজারটা চ্যানেল । ইন্টারনেট । ইউটিউব । আদ্যিকালের সার্কাস আর লোক টানতে পারছে না ।
তবু চলছিল । কোনোরকমে ।
গত বছর হায়দ্রাবাদে শো করতে গিয়ে অ্যাক্সিডেন্ট হল । আগুন নিয়ে খেলা দেখাতে গিয়ে পলিনা নামের অসমীয়া মেয়েটা মরে গেল । পুলিশ কেস । কোর্ট উকিল মামলা ।দলের বদনাম হয়ে গেল । অথচ সবাই জানে, দোষ ছিল পলিনারই । পাজ্ঞাব থেকে আসা জশবিন্দর, মোটরবাইক নিয়ে খেলা দেখাত, তার সঙ্গে হৃদয়ঘটিত ব্যাপার । দুদিন ধরে নাকি ঝগড়া চলছিল দুজনের । সেজন্যেই কি অন্যমনস্ক ছিল পলিনা ? কে জানে ।
নেহাৎ অ্যাক্সিডেন্ট । কিন্তু সেই নিয়ে রাজনীতি করেছিল জেমিনি সার্কাস । সব বুঝেও কিছু করার ছিল না । বদনাম হয়েই গেল । আর এখন এমন অবস্থা যে দলটাই তুলে দিতে হবে ।
গণেশ নড়েচড়ে বসল, ‘আমি একটা কথা বলব ?’
গণেশ ট্রাপিজের খেলোয়াড় । চমৎকার ব্যালেন্স-ঞ্জান । ঠান্ডা মাথার গণেশ হেগড়ে সবার প্রিয় । জন্তুজানোয়ারদেরও । সবার দরকারে আছে । মধুশ্রী নামের নেপালী মেয়েটা, রিঙের খেলা দেখাতে দেখাতে বিরক্ত হয়ে গণেশকে ধরেছিল । এখন ট্রাপিজের খেলা দেখায় । দুই রিঙমাস্টার, যশবন্ত কামাথ আর মাইক অরোরা, একে অন্যকে সহ্য করতে পারে না । অথচ এই গণেশের জন্মদিনে দুজন একসঙ্গে পার্টি করে । মোহন নামের রাগী সিংহ, কিরণ নামের সুন্দরী বাঘিনী, হীরা নামের পাজী বাঁদর .. সবার সঙ্গে ওর ভাব । রেড্ডি আর শৈলজাও গণেশকে খুব পছন্দ করে ।
অলস চোখে ফিরে তাকাল রেড্ডি, ‘বলো ।‘
‘নতুন কিছু করা যায় না ? একটা খুব বিপজ্জনক খেলা ?এমন একটা কিছু যা দেখতে লোক আগ্রহী হবে ?’
‘বিপজ্জনক ? অনেক বিপজ্জনক খেলা দেখাই আমরা । দেখাই না ? এই রঘুনাথই যেটা করে, বাঘকে পিঠে নিয়ে মোটরবাইক চালানো, সেই মোটরবাইক আবার আগুনের মধ্যে দিয়ে পার হয় । ট্রাপিজের খেলা, বাঘ সিংহ নিয়ে খেলা । বিপজ্জনক খেলা তো হচ্ছেই । এর মধ্যে নতুনত্ব কোথায় ?’
‘না । আলাদারকম কিছু । সামথিং ভেরি ডিফারেন্ট । শহরের মানুষকে না টানলেও গ্রামে গজ্ঞে মফস্বলে এমন খেলা দেখতে লোকজন ভিড় করবে ।‘
নাকের মধ্যের বিরক্তিকর শব্দটা আবার করল মুত্থুস্বামী, ‘সামথিং ডিফারেন্ট ? তা, অমন ডিফারেন্ট খেলার জন্যে ডিফারেন্ট লোক পাবে কোথায় ? আর তাকে মাইনেই বা দেবে কোথা থেকে ?’
‘সেই তো । সেটাই তো প্রবলেম । আমাদের হাতে এত সময় নেই । নতুন বিপজ্জনক খেলার আইডিয়াটা ভালো । কিন্তু লোক ? লোক খোঁজার মতো সময় নেই আমাদের । তারপর তেমন দক্ষ লোক হলে কত মাইনে চাইবে তা-ই বা কে জানে ..’
রেড্ডির কথা শেষ হল না । রোজ হাতিদের চান করায় ছেলেটা, মানিক, এসে দাঁড়াল দরজায় । ‘বিনায়কসাহেব এসেছেন । অফিসঘরে বসে আছেন । খবর দিতে বললেন আমায় ।‘
বিনায়ক কুমার লাল । অ্যাপোলো সার্কাসের এজেন্ট । নানা জায়গায় ঘুরে শো-এর ব্যবস্থা করা ওর
কাজ । গোপিকিশন, সুবোধও তাই । তিনজনের জন্যেই সাগ্রহে অপেক্ষা করছে রেড্ডি ।
‘নিয়ে এসো এখানেই । কি খবর এনেছে দেখা যাক ।‘
-----
বিনায়ক একা আসে নি । সঙ্গে একটি ছেলে । তেইশ চব্বিশ হবে । বেশ লম্বা । রোগা । গলার হাড় উঁচু হয়ে আছে । এ বয়সে যেমন হওয়া উচিত, একটু ছটফটে একটু উজ্জ্বল, একেবারেই তেমন নয় । কে ছেলেটা ? বিনায়কের আত্মীয় ? চেনা কেউ ?
ঘরে ঢুকে চেয়ারে বসল বিনায়ক । ছেলেটা দাঁড়িয়েই রইল । উৎসুক চোখগুলোর দিকে তাকিয়ে হাসল বিনায়ক, ‘খুব খারাপ খবর নয় । এদিকে বোকারো, আসানসোল, খড়্গপুর .. তারপর টাটা, সিনি, চক্রধরপুর .. রাউরকেলা, বিলাসপুর .. পরপর শো । বুকিং হয়ে গেছে ।‘
রেড্ডি নড়েচড়ে বসল, ‘খড়্গপুর ? টাটা ?’ এই দুই জায়গাতেই গত দু’বছর ধরে জেমিনি আগেভাগে ব্যবস্থা করে ফেলছিল ।
ঘাড় নাড়ল বিনায়ক, ‘খরচাপাতি হয়েছে একটু । শ্রীনিবাসনসাব জানেন ।‘
নিশ্চয় পয়সাকড়ি খাওয়াতে হয়েছে । পুলিশ থেকে সরকারি আমলা, এলাকার বিধায়ক থেকে মাঠের
মালিক । সবার সঙ্গে ব্যবস্থা করেই তো ব্যবসা । শ্রীনিবাসন টাকাকড়ির জিম্মেদার । তাছাড়া তাঁর আর একটা পরিচয়ও আছে । শ্রীনিবাসন শৈলজার বাবা । না বুঝে খরচাপাতির অনুমতি দেবেন না ।
খরচাপাতি নিয়ে মাথা ঘামালো না রেড্ডি । খবর ভালো সত্যিই । পুরোনো জায়গাগুলো যদি ফিরে পাওয়া যায়, একবার শেষ চেষ্টা করতেই হবে ।
শৈলজা তাকিয়েছিল রেড্ডির দিকেই । ওই চোখ তার খুব চেনা । পুরোনো এইরকম একটি দিনে শোনপুরের মেলা থেকে একসঙ্গে তিন তিনটে হাতির বাচ্চা কিনেছিল রেড্ডি । ছোট দল তখন । পুঁজি কম । তবু বারবার এমন রিস্ক নিয়েছে । সেই চোখ । সত্যিই খবরটা ভালো । যদি আর একবার ..
‘তাহলে গণেশের আইডিয়াটা নিয়ে কথা শুরু হোক আবার’, বিনায়কের দিকে ফিরল শৈলজা, ‘তুমি বরং একটু ঘুমিয়ে নাও । সন্ধেবেলা কথা বলব আবার ।‘
‘যাচ্ছি । কিন্তু .. আমাকে হঠাৎ এখানে ডেকে পাঠানো হল কেন ? আমি তো রায়গড় যাচ্ছিলাম । ওখানে একটা দশ-বারোদিনের শো-এর ব্যবস্থা হতে পারে । প্রসাদ বলছিল ..’
মুত্থুস্বামী থামিয়ে দিল, ‘সেই কথাই তো বলছি । তুমি এসেই সাতকাহন নিজের কথা শুরু করলে । শো-এর ব্যবস্থা করে হবেটা কি ? দিনের পর দিন হল, গ্যালারি ফাঁকা থাকছে । পঁচিশ পার্সেন্ট জায়গাও ভরছে না । খরচ চলবে কি করে ? তাই রেড্ডিসাহেব একটা অল্টারনেটিভ ব্যবসার কথা ভাবছেন ।‘
রঘুনাথ আর গণেশ একে অন্যের দিকে তাকালো আবার । দল তুলে না দিলে বুড়োঘুঘুর শান্তি নেই । কে জানে, জেমিনি সার্কাসের সঙ্গে এ নিয়েও ওর চুক্তি হয়েছে কিনা ।
তাড়াতাড়ি শৈলজার দিকে ফিরল রঘুনাথ, ‘গণেশের আইডিয়া নিয়ে কি বলছিলেন ম্যাডাম ?’
শৈলজার উত্তর দেওয়া হল না, বিনায়কের সঙ্গে আসা ছেলেটা কথা বলে উঠল, ‘তাহলে আমি চলে যাই ? শুধুমুধু এতদূর টেনে নিয়ে এলেন ..’ চমৎকার গলা তো ছেলেটার ।
‘ওহো, তোমার কথা তো এদের বলাই হল না । আলাপ করিয়ে দিই । ওর একটা বড় বাংলা নাম আছে । আমি বলতে পারি না । সবাই ওকে ওস্তাদ বলে ডাকে । আমিও ওস্তাদ বলি । ওকে অ্যাপোলোর জন্যে এনেছি আমি ।‘
জহুরীর চোখ বিনায়কের । ঘোরাঘুরি করতে করতে এমন অনেক দক্ষ লোক এনেছে আগেও ।
‘সিনি থেকে চক্রধরপুর যাচ্ছি, দেখি একটা বড় মেলা বসেছে । সেখানে পেয়েছি ওকে । মৌত কা কুঁয়ায় খেলা দেখাচ্ছিল ।‘
মুত্থুস্বামী এতক্ষণ একদৃষ্টিতে চেয়েছিল ছেলেটার দিকে, নাকের আওয়াজ করে মুখ ফেরালো, ‘সে আর এমন কি খেলা ? অমন খেলোয়াড় এখানে অনেক আছে । মাইকেল আছে, জয়রাম আছে, এই রঘুনাথই আছে ..’
ঘাড় নাড়ল বিনায়ক, ‘ওস্তাদ বহুত হিম্মতওয়ালা ছেলে । অনেক কিছু পারবে । পরে আপনিও বলবেন একথা ..’
বড়ছেলে সুদর্শনকে মনে পড়ে গেল শৈলজার । এই ছেলেটা সুদর্শনের বয়সী হবে । হাসল, ‘তোমার নাম কি ? আমিও কি ওস্তাদ বলেই ডাকব তোমায় ?’
একটুও হাসল না ছেলেটা, ‘আমার নাম অনির্বাণ । ওটা বোধহয় আপনি বলতে পারবেন না । আমার মা ডাকতেন, বাপি । আপনি বাপি বলতে পারেন । কিন্তু ডাকবেন আর কখন ? আমি তো এখনই চলে যাচ্ছি ।‘
এতক্ষণে কথা বলল রেড্ডি, ‘যাবার জন্যে ব্যস্ত কেন ? কাজ করবে বলেই তো এসেছ ?’
‘হ্যাঁ । তাই । কিন্তু মনে হচ্ছে এখানে সুবিধে নেই । নো প্রবলেম । আমি চলে যাচ্ছি ।‘
‘আরে, দাঁড়াও ওস্তাদ । দাঁড়াও । যাবে কোথায় ? ও মেলায় তো আর ফিরতে পারবে না । আমি তোমায় কাজের কথা বলে নিয়ে এসেছি । এখানে না হলে তোমার একটা কাজের ব্যবস্থা আমিই করব ।‘ রেড্ডির দিকে ফিরল বিনায়ক, ‘আমি বিকেলে আসব । ওকে নিয়ে যাই এখন ।‘
হাতের ইশারায় বিনায়ককে থামালো রেড্ডি, ছেলেটার দিকেই তাকিয়ে আছে, ‘কিরকম খেলা দেখাবে ? মৌত কা কুঁয়া তো আছেই । আমরাও ও খেলা দেখাই । আর ? বাঘ সিংহ নিয়ে খেলা দেখাতে পারবে ?‘
আলগা একটা হাসি ফুটল ছেলেটার মুখে, ‘পারব ।‘
‘পারবে ? কোনোদিন বাঘ সিংহ নিয়ে খেলা দেখিয়েছ ? শিখেছ ?’
‘না ।‘
‘তাহলে ? না শিখে কিছু হয় ? এই যে মৌত কা কুঁয়া.. মোটরবাইক নিয়ে খেলা.. শিখেছ বলেই না করতে পেরেছ?’
উত্তর না দিয়ে মিটিমিটি হাসতে লাগল ছেলে ।
‘ওটাই তো আসল মজা’, বিনায়ক বলে উঠল, ‘আমি তো দেখে শুনে তাজ্জব । ওস্তাদ নিজে নিজেই একদিন হঠাৎ মৌত কা কুঁয়ার খেল শুরু করেছিল । কারো কাছে শেখে নি । মালিকের সঙ্গে টাকাপয়সা নিয়ে গন্ডগোল.. খেলা দেখাত যারা, সে ছেলে দু’জন একসঙ্গে মেলা ছেড়ে চলে গেল । মালিককে বিপদে ফেলে । মৌত কা কুঁয়ার খেলা বন্ধ । সেদিন আবার কমিশনার-সাহেব খেলা দেখতে আসবেন । মেলার মালিক আমার চেনা । গোবর্ধনজি । আমাকে ডেকে বললেন, যদি লোক জোগাড় হয় । মথুরায় আছে মুন্না, খবর পাঠালাম । আসতেও তো দু’ চারদিন লাগবে ।‘
একটানা কথা বলতে বলতে হাঁফিয়ে উঠল বিনায়ক, হাত দিয়ে কপালের ঘাম মুছে নিল । হাসল তারপর, ‘ওস্তাদ এসে বলল, ও খেলা দেখাবে । রোজ মেলায় এসে দেখে দেখে নাকি খেলা শিখেছে । মথুরা থেকে নতুন লোক আসতেও তো দেরি । গোবর্ধনজি চান্স নিলেন । আমি নিজের চোখে দেখলাম সব । ওর খেলাও দেখলাম । তারপর ওর সঙ্গে কথা বলেছি । কিছুতেই আসবে না । ওর নাকি সার্কাস ভালো লাগে না । বললাম, ভালো না লাগলে কেউ ওকে আটকে রাখবে না । তখন সঙ্গে এল ।‘
----
বিনায়কের কথা আর শুনতে পাচ্ছিল না অনির্বাণ । আবার সেই এক মজা । হেরে গিয়ে পালানো । জ্ঞান হয়ে থেকে সেইরকমই তো দেখছে । হাতের নাগালে সুযোগ আসামাত্র কে যেন টুক করে তা সরিয়ে নেয় । নাগালের মধ্যে আসেই বা কই !
এসময় দাদার কথা মনে আসবেই । কমলা-সাদা জার্সি । সোমনাথকাকা দিয়েছিল পাড়ার টিমের সবাইকে । রাইট-আউটে খেলত দাদা । খুব ছুটতে পারত । সবুজ ঘাসে লাল-সাদা বলটা পায়ে পায়ে নিয়ে । বাঘের মতো ডজ করতে করতে ছুটত দাদা । কি সুন্দর যে লাগত !
আর দ্বিজুদা । বল নিয়ে ছুটতে ছুটতে লাল নিশানের কর্নার-ফ্ল্যাগ পর্যন্ত চলে যাবে, তারপর হঠাৎ ঘুরে সেন্টার করবে । হাততালিতে ভরে যেত চারপাশ ।
মাঠের ধারে বসে থাকত কিশোর অনির্বাণ । একবার যদি সুযোগ পায় !
মা মাঝে মাঝে এসে দাঁড়াত মাঠের ধারে, ‘অ বুড়ো, অ খোকন, অ দ্বিজু, বাপিকে খেলতে নে না তোরা ।‘ মায়ের বড়ছেলে সে ডাক শুনেও শুনত না । মা চলে গেলেই ছেলেরা দুয়ো দিত । গোলকিপার টিটো । শুধু পাড়ার নয়, টিটো এ তল্লাটের নামকরা গোলকিপার । অন্য পাড়ার ছেলেরাও নিয়ে যেত ওকে । দুটো আঙুল গোল করে মুখে পুরে শিস দিত অনির্বাণকে দেখলেই, ‘কি রে বাপি ? খেলবি নাকি ?’ ..
অমনি ছেলেরা হ্যা-হ্যা করে হাসত । দাদাও । ছোটনদা পাড়ার খেলাতেও টিমে বাপির নাম রাখত না ।
বিকেল হলেই পাড়ার মেয়েরা দল বেঁধে রাস্তায় বেড়াত । মাঠের ধারে দাঁড়িয়ে খেলা দেখত । তখন আরো উৎসাহ বেড়ে যেত ছেলেদের । সুমিতা হেসে হেসে বলত টিটোকে, ‘বাপিকে খেলতে নিস না কেন রে ? ওকে অন্তত দুধভাত করে টিমে রাখতে পারিস না ?’
টিটো বলত, ‘বাপির জন্যে খুব মায়া দেখছি ! তোদের সঙ্গে খেলতে নিয়ে নে’ .. তখন সবাই জোরে জোরে হাসত, আর বাপি এক দৌড়ে বাড়ি চলে আসত । সেই থেকেই কি হীনমন্যতা ঢুকে গেল গহীন মনে ? কে জানে ।
তারপরও তো বারবার হার । বারবার পরাজয় । পড়াশোনার মাথা নেই, বলার মতো রেজাল্ট নেই । স্কুলে অঙ্কের ক্লাসের শিবনাথবাবু বলেছিলেন, ‘তোর দ্বারা মাটি কোপানো ছাড়া কোনো কাজ হবে না ।‘
পড়াশোনার মাথা না থাক, ভোম্বল কেমন ফিবছর সাঁতারে প্রাইজ পেত । বাবুয়া রচনা প্রতিযোগিতায় । ছেলেরা কেউ ভালো আবৃত্তি করে, কেউ গান গায়, কেউ ছবি আঁকে । কেউ আর কিছু না পারুক দুর্গাপুজোর প্যান্ডেলে চমৎকার ধুনুচি-নাচ নাচে । বাপি কিছুই পারে না । কিচ্ছুটি না ।
স্কুলের বন্ধুরা, পাড়ার বন্ধুরা সব জয়েন্ট দিয়ে ডাক্তারি ইঞ্জিনীয়ারিং পড়ছে । কোনোরকমে পাশ করে অনির্বাণ কমার্স নিয়ে ভর্তি হয়েছিল । তাও একবারে পাশ করতে পারে নি । দাদা পাশ করে চাকরি পেল । বাবামায়ের মুখে হাসি ।
অনির্বাণের দিকে চোখ পড়লেই বাবার মুখ কঠিন, মায়ের চোখের কোলে দুশ্চিন্তা । সামান্য একটা কমার্স নিয়ে পাশ করতে এত কষ্ট ! এ ছেলে জীবনে করবে কি ! কে চাকরি দেবে ! পুঁজি নেই যে ব্যবসা করবে । আজকাল কিছু না হোক, কলসেন্টারে চাকরি করে কত ছেলেমেয়ে মোটা টাকা রোজগার করছে ।
দিদিরা বলত, ‘একটা কিছু কর বাপি । শ্বশুরবাড়িতে তোর পরিচয় দিতে লজ্জা হয় ।‘
দাদার বিয়ের পর বৌদিরও লজ্জা করত । বাপের বাড়িতে দ্যাওর বলে পরিচয় দিতে লজ্জা করত । দাদা তো কথাই বলত না । বাবা বলত, ‘অকর্মণ্য অপদার্থ ছেলে । অমন ছেলে থাকা না-থাকা সমান ।‘
মা বলত, ‘বালাই ষাট ।‘ ঠাকুর দেবতার দোরে দোরে ঘুরত, ‘আমার বাপিটার একটা হিল্লে করে দাও ।‘
পাড়ার সবচেয়ে গবেট অকর্মণ্য ছেলেটা, কানাই, সে পর্যন্ত এক পয়সাওয়ালা ঘরের মেয়েকে পটিয়ে পাটিয়ে প্রেমের বিয়ে করে হিল্লে করে ফেলল । সেই কানাই প্রোমোটার হয়ে দুহাত্তা রোজগার করছে । ধোপাদের বাড়ির ছেলেটা, গদাই, কানাইয়ের বৌয়ের শাগারেদি করে বিল্ডিং-মেটেরিয়াল সাপ্লাইয়ের ব্যবসা করছে । আর কিছু না হোক, পার্টির দাদাদের সঙ্গে লেগে থেকে রোজগার করছে সব ।
মায়ের চিন্তা হবে না ? অন্তত একটা পয়সাওয়ালা ঘরের মেয়ে যদি বাপিকে পছন্দ করত !
মিনুর কথা অবশ্য মা জানত না । সেই মিনু, যাকে নিয়ে জীবনের প্রথম কবিতা লিখেছিল অনির্বাণ । শেষ কবিতাটাও লিখেছিল মিনুকে নিয়েই, মিনুর বিয়ের দিন । দু’চার লাইন এখনো মনে আছে ..
‘নতুন কোনো জন্মে যদি আসি
নতুন কোনো সূর্যওঠা ভোরে
সাগর হবার স্বপ্ন মনে নিয়ে
শালুকফোটা পুকুর যেন হই
সেই পুকুরে পদ্মপাতা হয়ে তুমি এসো
আমার সাঁঝের বাতি ..’
আবোল তাবোল কবিতা । কবি হবার গুণ কি বাপির আছে ?
মিনুর কথা মনে হলেই আশেপাশের পৃথিবীটা নিস্তব্ধ নিঃশব্দ হয়ে যায় । সারি সারি ব্যর্থতা মনে পড়ে যায় । মিনুও এই ব্যর্থতাকে অবহেলা করে চলে গেছে । বাড়িতে, পাড়ায়, স্কুলে, কলেজে .. কেউ মনে রাখে নি । কেউ না । ভাগ্যিস মা মিনুর কথা জানত না । বাপির সব পরাজয়ের লজ্জা, সব অক্ষমতার লজ্জা বুকে নিয়ে মা মুখ লুকিয়ে ঘুরত । মাকে সেই লজ্জা থেকে মুক্তি দেবার কোনো উপায় সেদিনও ছিল না, আজও হল না ।
তারপর কবে যে বাড়ি থেকে পালিয়েছিল । পীর-ফকির, আউল-বাউল, সাধু-অসাধু .. কত সঙ্গ । কোনো পিছুটান তো নেই ।
যাত্রিক নামের ট্রাভেল এজেন্সির সঙ্গে ঘুরতে ঘুরতে গঙ্গোত্রী গোমুখ । তপন নামের ওষুধের ফেরিওয়ালার সঙ্গে গ্রামে গঞ্জে । রাধাবাউলের সঙ্গে মথুরা বৃন্দাবন । আসল নাম রাধাকান্ত, মুখে মুখে রাধাবাউল । ফকির দরবেশ সাজে কেরালা পর্যন্ত ঘুরে আসা । এলাহাবাদের জটাধারী সাধুদের দলটার সঙ্গে তিব্বত পর্যন্ত যাওয়া হয়েছিল । মানসকৈলাশ যাবার বাসনা ছিল, হল না । বর্ডারে ধরে ফেলেছিল । সেই জেলে থাকার সময় বেদের কাছে জাদু শেখা, তারপর বেদে-বেদেনী দলের সঙ্গে রাজস্থান ।
কোথাও থিতু হতে পারে না অনির্বাণ । কোনো দলের সঙ্গেই বেশিদিন থাকতে ইচ্ছে করে না । কোথাও একটা ঠিকানা তৈরি হয় না । বুকের মধ্যে মায়ের ব্যাকুল চোখদুটোর টান ।
কতরকম নেশা । বাউলের আখড়ায় । ফকিরের থানে । ফুটপাতের অন্ধকারে । শঙ্করপুরের বিচে হিপিদের আড্ডায় । বেনারসে বাবুমহারাজের আখড়ায় । তবু কিচ্ছুটি ভোলা হয় না । মায়ের আকুল চোখদুটো মনে পড়ে বারবার ।
বেনারসে বাবুমহারাজের শাগরেদি করার সময় ছুরি নিয়ে খেলা শেখা । একসঙ্গে বারোটা ছুরি নিয়ে খেলা দেখাত বাবুমহারাজ । বেশ শিখে ফেলেছিল, একদিন খেলা দেখানোর সময় আখড়ার পোষা ছাগলটার গায়ে ছুরি বিঁধে গেল । মেরে ধরে তাড়িয়ে দিল সবাই ।
সব জায়গায় ব্যর্থতা । ঘরেও নহে, পরেও নহে, কেউ আপন করে নি অনির্বাণকে ।
তবে ঘুরে ঘুরে বেড়িয়ে একটা জিনিস শেখা হয়েছে । এই পৃথিবীতে হেরে যাওয়া লোকের সংখ্যাই বেশি । দুটো টাকার জন্যে জীবন বাজি রেখে কত কান্ডই না করে লোকে !
কোথাও শান্তি নেই । সন্তুষ্টি নেই । সংসার ছেড়ে বেরিয়ে পড়া সাধু ফকিরই বলো, আর দোহাত্তা রোজগার করা সংসারী মানুষই বলো ।সব ছুটছে । দৌড় । দৌড় ।
সেদিক দিয়ে দেখতে গেলে, জেতার জন্যেই এত কান্ড ।
----
শৈলজার দিকে তাকাল বিনায়ক, ‘ওকে একবার সুযোগ দিলে হয় না ?’
‘আমরা একটু আগে আলোচনা করছিলাম, যদি কোনো নতুন খেলা দেখানো যায় । সামথিং ডিফারেন্ট । ডেনজারাস । পারবে ?’
‘পারব ।‘ ঘাড় নাড়ল অনির্বাণ ।
‘আরে ! কিরকম খেলা, কেমন ডেনজারাস .. কিছু না শুনেই হ্যাঁ বলে দিচ্ছে যে ! এখন তো শুনছি, মৌত কা কুঁয়ার খেলাটাও ঠিকঠাক জানে না ।‘ মুত্থুস্বামী খুব বিরক্ত ।
এমনিতে বুড়ো ঘুঘুকে পছন্দ না করলেও রঘুনাথের মনে হল, এ কথাটা ঠিকই বলেছে মুত্থুস্বামী । ছেলেটার ওপর এতটা ভরসা করা কি ঠিক হবে ?
না-বলা কথাটা রেড্ডি বুঝে ফেলেছে, ‘এমনিও বন্ধ করে দিতে হবে । মানে, কিছু উপায় না হলে বন্ধ করে তো দিতেই হবে । একটা চান্স নেওয়া যাক ।‘
ছেলেটার দিকে ফিরল, ‘বেশ । মেনে নিলাম, তুমি পারবে । হয়ত ভগবানই তোমায় পাঠিয়েছেন । তোমার হাতে অ্যাপোলোর ভবিষ্যৎ । এবার বলো, কিরকম ডেনজারাস খেলা দেখাবে তুমি ।‘
পেটের মধ্যে হাসি গুবগুবিয়ে উঠছে, অনেকদিন পর বেশ আমোদ হচ্ছে অনির্বাণের । অচল পয়সার ওপর বাজি ধরতে চাইছে লোকটা । আপাদমস্তক অসফল, দৌড়তে না-পারা ঘোড়ার ওপর বাজি । বেড়ে মজা । বুঝবে নিজেই, অনির্বাণের তো আর কিছুই হারাবার নেই ।
জানলা দিয়ে বাইরে চোখ চলে গেল । লম্বা খুঁটি, তাঁবুর খুঁটি । সেদিকে তাকিয়ে বলল, ‘আমি আশি ফুট ওপর থেকে ঝাঁপ দেব । একটা আট বাই ছয় ট্যাঙ্কের মধ্যে ঝাঁপ ।‘
‘আশি ফুট ? বলছ কি ?’ রেড্ডি সোজা হয়ে বসল । ‘ওরকম ট্যাঙ্ক আছে আমাদের ? দেখি তো কেমন পারে ।‘
গণেশ বলল, ‘তা আছে । কিন্তু ডেপথ ? অন্তত দশ ফুট ডেপথ চাই । অত ওপর থেকে পড়বে ।‘
‘দশ না, কম করেও অন্তত বিশ ফুট ।ওর হাইটটা দ্যাখো’, রঘুনাথ বলে উঠল, ‘আশি ফুট উঁচু থেকে ঝাঁপ দেবে .. শরীর কিন্তু সাঁতার দেবার মত হরাইজন্টাল করতে পারবে না । বিশ ফুট ডেপথ চাই । আর আশি না । প্রথমদিন এত রিস্ক নেওয়া ঠিক হবে না । ষাট ফুট উঁচু ওই পাটাতন থেকে ডাইভ দিক ।‘
‘আশি ফুট ওপর থেকে ঝাঁপ । ট্যাঙ্কের চারদিকে আগুন জ্বালিয়ে দেওয়া হবে ।‘ রেড্ডি আপনমনে বলে উঠল, ‘বেশ ডেনজারাস । এমন কোনো দলে দেখায় না ।‘
শৈলজা তাকিয়েছিল অনির্বাণের দিকে, ‘তুমি এমন ঝাঁপ আগে দিয়েছ ? কোথায় দিয়েছ ?’
অনির্বাণের মনে পড়ল, চড়কের মেলাটার কথা । রোগা একটা লোক, পাহাড়ের ওপর থেকে নিচে জলের মধ্যে ঝাঁপ দিচ্ছিল, আর নির্বিকার মুখে উঠে এসে দর্শকদের কাছে হাত পেতে পয়সা নিয়ে কোঁচায় গুঁজে রাখছিল । ইচ্ছে হলেও সেদিন ঝাঁপ দেওয়া হয় নি, আজ খেলাটা জমবে । মহিলা যেমন উতলা মুখে চেয়ে রয়েছে, যদি বলে এই প্রথম, আগে কখনো এমন ঝাঁপ দিই নি, তাহলেই হয়েছে । জবাব না দিয়ে মিটিমিটি হাসল অনির্বাণ ।
শৈলজা জিঞ্জেস করল আবার, ‘কতবার এমন ঝাঁপ দিয়েছ ? কোথায় দিয়েছ ?’
বিনায়কের দিকে তাকাল অনির্বাণ, ‘আমি চেঞ্জ করতে চাই ।‘
‘ও হ্যাঁ হ্যাঁ । কি পরবে তুমি ?’
‘চলো, আমি নিয়ে যাচ্ছি ।‘ গণেশ উঠে দাঁড়াল ।
হাত বাড়িয়ে বাধা দিল রেড্ডি, ‘এখনো ভেবে দ্যাখো । ষাট ফুট । রিয়েলি ডেনজারাস ।‘
‘আপনি ট্যাঙ্ক ভরানোর ব্যবস্থা করুন । যদি না পারি, চলে যাব । ভাবছেন কেন ?’
‘ঠিকই তো । না পারলে চলে যাবে । আমাদের কি ?’ মুত্থুস্বামী ঘনঘন ঘাড় নাড়ছে, ‘তার আগে বলো, কত মাইনে নেবে তুমি ?’
স্পষ্ট বিরক্ত হল শৈলজা, ‘ও এখানে খেলা দেখাবে কিনা তাইই ঠিক হয়নি এখনো ।‘
রেড্ডির দিকে ফিরল, ‘বুঝতে পারছ না তোমরা । যদি একটা সাংঘাতিক কান্ড হয় ! এবার আর পুলিশ ছাড়বে আমাদের ?’
‘আপনি ভাবছেন কেন ? আমি নিজের রিস্কে খেলা দেখাচ্ছি । যদি চান, আমি লিখে সই করে দিচ্ছি । যদি না পারি, আমার হার । যদি পারি, আপনাদের দলের কাজে লাগবে । আপনাদের দলের সামনেও তো বেশ বিপদ ।‘ অনির্বাণ হাসল ।
তবু শৈলজা রাজি নয়, ‘কোথা থেকে এসেছ, বাড়িঘর কোথায়, কিছুই তো বলছ না । এমন রিস্কি খেলা .. না না, কিছুতেই না ..’
‘এক কাজ করি’, গণেশের মাথা এসব সময় বেশ ঠান্ডা থাকে, ‘আপাতত একটা সাপোর্ট দিই । না পারলেও বিপদ হবে না । তারপর যদি দেখা যায়, ও সত্যিই খেলাটা পারে .. দারুণ ব্যাপার হবে কিন্তু । এমন খেলা কেউ কোনো সার্কাসে দেখায় নি ।‘
‘আর এখন আগুন টাগুন জ্বালানোরও দরকার নেই’, রঘুনাথ সায় দিল, ‘দেখা যাক সত্যিই অমন ডাইভ দিতে পারে কিনা । তারপর …’
----
‘ওই ওপরে দ্যাখো, ওখানে একটা পাটাতন আছে । দেখতে পাচ্ছ ? এই দড়ির মইটা ধরে উঠে যাও।‘ রঘুনাথ বলে দিল ।
দারুণ মজা । খেলাটা দেখাতে পেরে বেশ লাগছে । কিন্তু কেনই যে এই খেলাটা দেখানোর ইচ্ছে হল ! পারবে না জেনেও কেন যে বারবার ইচ্ছে হয় ! দাদার মত ফুটবল খেলার ইচ্ছে, বাবুয়ার মত ভালো রচনা লেখার ইচ্ছে, শমিতের মত ভালো রেজাল্টের ইচ্ছে, বাবুমহারাজের মত ছোরা নিয়ে খেলা দেখানোর ইচ্ছে । সাহসী হবার ইচ্ছে, সফল হবার ইচ্ছে । আর বারবার হেরে যাওয়া ।
‘আমার ভালো লাগছে না । আমাদের বিপদ থেকে বাঁচার উপায় করতে এই ছেলেটাকে কাজে লাগাব আমরা ? ওর যদি কিছু হয় .. ওর মা-বাবা .. কাদের বাড়ির ছেলে কিছু জানা নেই .. আমার ভালো লাগছে না ।‘ শৈলজা এখনো রাজি নয় ।
‘আমরা তো কেউ ওকে জোর করি নি । এমন কোনো খেলা আমাদের মাথায়ও আসে নি । ও নিজেই বলেছে খেলাটার কথা । আমরা শুধু একটা চান্স নিচ্ছি । যদি .. বাই চান্স ..’ রেড্ডি চুপ করে গেল ।
নির্বিকার মুখে দড়ি মইটায় হাত দিল অনির্বাণ ।
‘পারবে তো বেটা ? এখনো ভেবে দ্যাখো ..’ বেটা ডাক শুনে ফিরে তাকাল । আকুল দুই চোখ । অচেনা একটা ছেলের জন্যে উদবেগ .. প্রত্যাশা .. সব মায়েরাই বুঝি একরকম ?
‘ঠিক পারবি তুই বাপি, দেখিস সব ঠিক হয়ে যাবে’, মাও এমনি চোখে চেয়েছিল একদিন । বাপির ওপর মায়ের ভরসা ছিল না, তবু চেয়েছিল । অক্ষম ছেলের ওপর মায়া, নাকি দুর্বলের প্রতি করুণা .. মায়ের চোখ থেকে প্রত্যাশার আলো একদিন মুছে গেছিল । শুধুই উদ্বেগ, শুধুই লজ্জা । বাপি মায়ের সহায় হতে পারে নি ।
মা আর বাপির কাছে কিছু চায় নি ।
আর আজ .. অচেনা পরিবেশের অচেনা একদল মানুষ সেই বাপির ওপর ভরসা করতে চাইছে । এর আগে কেউ কোনদিন এমন করে ডাকে নি তাকে । কেউ বলে নি, দূর ভবিষ্যতে তোমারও একটা দাবী আছে । এই প্রথম ।
ওরা কেউ জানে না .. কিন্তু অনির্বাণ জানে । এই খেলাটা .. খেলার মতই । অথচ ঠিক খেলা নয় । এই ছোট্ট খেলাটুকুর মধ্যে জীবন-মৃত্যুর একটা প্রশ্ন জড়িয়ে আছে ।
অক্ষমতার লজ্জায় আবার পালিয়ে যেতে ইচ্ছে হল । পালিয়েই বা যাবে কোথায় ? নিজের কাছ থেকে তো আর পালানো যায় না । তার চেয়ে এই একটা সুযোগ । ঝাঁপ দেবে অনির্বাণ, নিশ্চিত মৃত্যুর মাটিতে । এখানে কেউ চেনা নেই, এই ভালো ।
পাটাতনের ওপর দাঁড়িয়ে একবার আকাশের দিকে তাকাল । কি সুন্দর নীল । মেঘের মধ্যে কেমন সাদা একটা আলো । আকাশ জুড়ে সাদা ছায়াপথ । এই পথ ধরে যেন সে চলে যেতে পারবে আলোর দেশে ।
কোমরে একটা লোহার শেকল আটকে দিয়েছে রঘুনাথ । ওদিকের তাঁবুর পাশে ক্রেনের মত একটা যন্ত্র, জিনিসপত্র তোলার জন্যে লাগে বোধহয় । শেকলের অন্য দিকটা সেখানে লাগানো । রিস্ক নেবে না রেড্ডি ।
পাটাতনের ওপর দাঁড়িয়ে আকাশের সাদা আলোর দিকে তাকিয়ে আস্তে আস্তে কোমর থেকে শেকলটা খুলে নিল অনির্বাণ । তারপর ঝাঁপ দিল । আহ ! মুক্তি ।
খানিকটা আসার পর আপনা আপনি দু’হাত ছড়িয়ে গেল দু’পাশে । ডানার মত । চোখ বন্ধ করল অনির্বাণ । আকাশ জুড়ে ঘন্টাধ্বনি । আর কিছু শুনতে পাচ্ছিল না । শ্যামলা সুন্দর একখানা মুখ, কাপড়ে হলুদের দাগ, কপালে সিঁদুরের গোল টিপ । মায়াবী গলায় ডাকল, ‘বাপি রে ।‘ আহা মা ।
ফরসা লাল লাল একখানা মুখ, ঝলমলে মুখে ডেকে উঠল, ‘অ নি র্বা আ আ আ আ ন ।‘ পরনে লাল বেনারসী, কপালে সিঁথিমৌর, হাতে গাছকৌটো । আহা মিনু ।
অনেকখানি নিচে দু’চোখ বন্ধ করে গলার হারের লকেটটা চেপে ধরল শৈলজা । বালাজি তিরুপতির লকেট । রক্ষা করো প্রভু । হে গোবিন্দা, হে গোপালা, রক্ষা করো ।
জলের স্পর্শে চোখ খুলল অনির্বাণ । ট্যাঙ্কের মধ্যে বুক পর্যন্ত জল ।
‘সাবাশ’, উত্তেজিত মুত্থুস্বামী রঘুনাথের হাত জড়িয়ে ধরেছে, ‘দারুণ খেলা । সাবাশ ।‘
জ্বলজ্বল করছে বুড়ো ঘুঘু মুত্থুস্বামীর দু’চোখ । ‘কনগ্র্যাটস’, হাত বাড়িয়ে রেড্ডির হাত ধরল, ‘চলো, জেমিনি সার্কাসকে দেখিয়ে দিই আর একবার ।‘
রেড্ডির কপালে ঘাম, দু’চোখে চিকচিকে আলো, ‘এইরকম একজনকেই চাইছিলাম আমি । কেমন সন্ন্যাসীর মত নির্লিপ্ত । দেখলে ? ওপর থেকে নেমে এল, ঠিক যেন .. ঠিক যেন .. একটা আকাশের পাখি । ঠিক যেন একজন দেবদূত, না ?’
রঘুনাথের চোখে জল, বিনায়কের দিকে তাকাল, ‘সত্যিই ওস্তাদ । সাপোর্ট না নিয়ে .. এইভাবে ..’
‘ও যে এরকম কিছু করবে, আমিও ভাবিনি । ছেলেটা পাগল’, বিনায়ক এখনো স্বাভাবিক হতে পারে নি ।
গণেশ এগিয়ে গেল অনির্বাণের দিকে, যত্নে হাত ধরে তুলে নিল জলের বুক থেকে ।
অনির্বাণের দু’চোখ লাল হয়ে গেছে, সারা শরীরের রক্ত নেমে এসেছে যেন । ঘোর লাগা চোখে শৈলজার দিকে চাইল । বুকের কাছে দু’হাত জড়ো করা, দুচোখে জল । সব মায়েরাই কি একই রকম ?
কাছে এগিয়ে এল শৈলজা, ‘তুমি বাঁচতে চাও না বেটা ? কোমর থেকে রিঙ খুলে দিলে যখন, আমি ভয় পেয়ে গেছিলাম । তুমি জান লড়িয়ে দিয়েছিলে, না ?’
আলতো হাত রাখল মাথার ভেজা চুলে, ‘মেরা হিম্মতওয়ালা বেটা ।‘
বড় ভাল লাগছে । বড্ড ভাল লাগছে অনির্বাণের । চারদিক থেকে প্রাণ আর জীবন ঘিরে ধরেছে, এখন হঠাৎ করে চলে যাবার উপায় নেই । মাথার ওপর আকাশ, আকাশ জুড়ে সোনালি আলো । অনির্বাণের শরীর জুড়ে আস্তে আস্তে ঘুম নেমে আসছিল ।
-----------------------------
এমনিতে রোজ বাড়ি না ফিরলেও ক্ষতি নেই । ছোট দুই ছেলে দেরাদুনে রেসিডেন্সিয়াল স্কুলে পড়ে, বড় ছেলে নাগপুরে ইজ্ঞিনীয়ারিং কলেজে ফাইনাল ইয়ার । ঘর সামলাবার জন্যে চৌকশ লোকও আছে, কুড়ি বছরের ওপর কাজ করছে মহাদেবী । খুব মায়া শৈলজার সংসারের জন্যে ।
দেশে বিদেশে নিশ্চিন্তে ঘুরে বেড়ায় দুজন । নিজের শহরে থাকার সময়ও কম ।
ম্যানেজার মুত্থুস্বামী দলের সঙ্গেই ঘোরে, রেড্ডিরা সঙ্গে না থাকলেও বেশ চালিয়ে নিতে পারে ।
কাল রাত থেকে মুত্থুস্বামীর ঘরেই আছে রেড্ডি । চেন্নাই থেকে গোপিকিশন, উত্তরপ্রদেশ থেকে বিনায়ক, আসাম থেকে সুবোধ .. সবাইকে ডেকে পাঠানো হয়েছে ।
রঘুনাথ আর গণেশ ঘরের বাইরে দাঁড়িয়ে আছে । এ দুজনও অনেক দিনের পুরোনো লোক । ঘরে ঢোকার সময় ইশারায় ডেকে নিল শৈলজা । তারপর সবাই চুপ করে বসেই রইল ।
‘কি করা যায় ?’ অনেকক্ষণ পর, যেন আপনমনে বলে উঠল রেড্ডি ।
আবার সবাই চুপচাপ । তারপর মুত্থুস্বামী মুখ খুলল, ‘আমি তো বলব, আগের কথাটাই থাক । দল তুলে দেওয়াই ভালো ডিসিশন ।‘
রঘুনাথ আর গণেশ একে অন্যের দিকে তাকাল একবার । ব্যাটা বুড়ো ঘুঘু । জেমিনি সার্কাসের সঙ্গে ওর যে কথা হয়ে গেছে, তা জেমিনির পিল্লাই রঘুনাথকে বলে দিয়েছে । এখানের কারবার তুলে দিয়ে জেমিনি সার্কাসে চলে যাবে মুত্থুস্বামী । এর মধ্যেই প্ল্যান করে কতজনকে সরিয়ে নিয়েছে, তা কি আর জানা নেই ? রেখা আর জুগনু দুই সেরা সুন্দরী, এ দলের আকর্ষণ ছিল, শুধু শুধুই জেমিনি সার্কাসে গেছে নাকি ? সব এই বুড়ো ঘুঘুর ব্যবস্থা ।
কেন যে রেড্ডি লোকটাকে এখনো বিশ্বাস করে !
রঘুনাথ ভেবেছিল শৈলজাকে বলবে । গণেশ বারণ করল । মুত্থুর সঙ্গে কিরকম যেন আত্মীয়তা আছে রেড্ডিদের । প্রমাণ ছাড়া কিছু বিশ্বাস করবে না শৈলজা ম্যাডাম । ঘুরিয়ে ফিরিয়ে রূপকুমার রেড্ডিসাহেবকে বলেছিল অবশ্য । কিন্তু লোক-হাসানোর কারিগর রূপকুমারের কথায় কেউ গুরুত্ব দেয় নি ।
শৈলজা একটু বিরক্ত হল, ‘এতগুলো লোকের সংসার চলে, দল বন্ধ করে দাও বললেই হয় নাকি ?’
নড়েচড়ে বসল রঘুনাথ, ‘জি ম্যাডাম । আমিও সেই কথাই বলতে চাই । কারবার বন্ধ করার জন্যে তো এমন গোল-টেবিল বৈঠক করার দরকার নেই । কি করে চালু রাখা যায়, সেটাই বরং সবাই ভাবুক ।‘
নাকের মধ্যে দিয়ে বিরক্তিকর শব্দটা করল মুত্থুস্বামী, ‘দিনের পর দিন লোকের ভিড় কমছে । গত সপ্তাহে একদিনও গ্যালারি ভরে নি । এ সপ্তাহে তো অবস্থা আরো খারাপ । চালু রেখেও কি আর লোকের সংসার চালানো যাবে ?’
রেড্ডির দিকে ফিরল, ‘অফারটা নিয়ে নেওয়াই ভালো । ওরা বলছে, আমাদের লোকজন জন্তুজানোয়ার কাউকে তাড়াবে না । আমাদের জন্যেও একটা অফার দিয়েছে । মেলাগুলোর সঙ্গে আমাদের যোগাযোগগুলো ওরা ব্যবহার করবে । এমনি এমনি তো আর সাতাশ পার্সেন্ট দেবে না ।‘
শৈলজা মুত্থুস্বামীকে উপেক্ষা করল, ‘আমরা কি কমিক সাইডটা নিয়ে ভাবব একটু ? রূপকুমার আছে, গুন্নু-ডুজ্ঞু দুই বামন আছে । একাধারে দারুণ খেলোয়াড় আর জোকার । সবচেয়ে বড় কথা, আমাদের শান্তি আছে । তিনফুটের মেয়ে জোকার আর কোনো দলে নেই ।‘
রঘুনাথ বলল, ‘ভালো আইডিয়া । নতুন মজা, নতুন হুল্লোড় । খেলার মাঠের চিয়ার-লিডারদের মতো মেয়েদের নাচ দিলে কেমন হয় ?’
রেড্ডি জোরে জোরে মাথা নাড়ল, ‘সব বদলে যাচ্ছে । ফ্যাশন বদলে যাচ্ছে । মানুষের রুচি বদলে যাচ্ছে । মন বদলে যাচ্ছে । এখন আর ওসব দিয়ে ভিড় টানা যাবে না । একইরকম ক্লাউন, একইরকম ভাঁড়ামো .. নাহ । চিয়ার-লিডার মেয়েদের মতো ছোট জামা তো আমাদের মেয়েরাও পরছে । নাহ । ওসব দিয়ে হবে না ।‘
অভ্যেসমতো মাথার চুল এলোমেলো করল রেড্ডি, ‘মুত্থু ঠিক বলেছে । শক্ত ডিসিশন নিতেই হবে ।‘
শৈলজা তাকাল স্বামীর দিকে । কত দুঃখে রেড্ডি এ কথা বলছে, একমাত্র সে জানে । কত কষ্টে দাঁড় করিয়েছিল এই দল । শহরে শহরে ঘুরে বেরিয়েছে মাসের পর মাস । গ্রামে গ্রামে ঘুরে খেলোয়াড় জোগাড় করেছে । দিল্লী-হরিয়ানা-কাশ্মীর ঘুরে ঘুরে ছেলেমেয়ে জোগাড় করেছে । তাদের ট্রেনিং নিয়ে কোনো কম্প্রোমাইজ করে নি । রাশিয়া থেকে সিংহের ট্রেনার এল, মাসকট থেকে বাঘের ট্রেনার ।
অ্যাপোলো সার্কাস । রেড্ডির নিজের হাতে গড়া দল । দল বন্ধ করে দিলে ও বাঁচবে কি নিয়ে ?
উপায়ও তো নেই । দিন দিন খরচ বাড়ছে । সেইমতো শো কই ? আজকাল সার্কাস দেখতে আসে না লোকজন । বিনোদনের কত ব্যবস্থা । মাল্টিপ্লেক্স । শপিং মল । ঘরে ঘরে টিভি । হাজারটা চ্যানেল । ইন্টারনেট । ইউটিউব । আদ্যিকালের সার্কাস আর লোক টানতে পারছে না ।
তবু চলছিল । কোনোরকমে ।
গত বছর হায়দ্রাবাদে শো করতে গিয়ে অ্যাক্সিডেন্ট হল । আগুন নিয়ে খেলা দেখাতে গিয়ে পলিনা নামের অসমীয়া মেয়েটা মরে গেল । পুলিশ কেস । কোর্ট উকিল মামলা ।দলের বদনাম হয়ে গেল । অথচ সবাই জানে, দোষ ছিল পলিনারই । পাজ্ঞাব থেকে আসা জশবিন্দর, মোটরবাইক নিয়ে খেলা দেখাত, তার সঙ্গে হৃদয়ঘটিত ব্যাপার । দুদিন ধরে নাকি ঝগড়া চলছিল দুজনের । সেজন্যেই কি অন্যমনস্ক ছিল পলিনা ? কে জানে ।
নেহাৎ অ্যাক্সিডেন্ট । কিন্তু সেই নিয়ে রাজনীতি করেছিল জেমিনি সার্কাস । সব বুঝেও কিছু করার ছিল না । বদনাম হয়েই গেল । আর এখন এমন অবস্থা যে দলটাই তুলে দিতে হবে ।
গণেশ নড়েচড়ে বসল, ‘আমি একটা কথা বলব ?’
গণেশ ট্রাপিজের খেলোয়াড় । চমৎকার ব্যালেন্স-ঞ্জান । ঠান্ডা মাথার গণেশ হেগড়ে সবার প্রিয় । জন্তুজানোয়ারদেরও । সবার দরকারে আছে । মধুশ্রী নামের নেপালী মেয়েটা, রিঙের খেলা দেখাতে দেখাতে বিরক্ত হয়ে গণেশকে ধরেছিল । এখন ট্রাপিজের খেলা দেখায় । দুই রিঙমাস্টার, যশবন্ত কামাথ আর মাইক অরোরা, একে অন্যকে সহ্য করতে পারে না । অথচ এই গণেশের জন্মদিনে দুজন একসঙ্গে পার্টি করে । মোহন নামের রাগী সিংহ, কিরণ নামের সুন্দরী বাঘিনী, হীরা নামের পাজী বাঁদর .. সবার সঙ্গে ওর ভাব । রেড্ডি আর শৈলজাও গণেশকে খুব পছন্দ করে ।
অলস চোখে ফিরে তাকাল রেড্ডি, ‘বলো ।‘
‘নতুন কিছু করা যায় না ? একটা খুব বিপজ্জনক খেলা ?এমন একটা কিছু যা দেখতে লোক আগ্রহী হবে ?’
‘বিপজ্জনক ? অনেক বিপজ্জনক খেলা দেখাই আমরা । দেখাই না ? এই রঘুনাথই যেটা করে, বাঘকে পিঠে নিয়ে মোটরবাইক চালানো, সেই মোটরবাইক আবার আগুনের মধ্যে দিয়ে পার হয় । ট্রাপিজের খেলা, বাঘ সিংহ নিয়ে খেলা । বিপজ্জনক খেলা তো হচ্ছেই । এর মধ্যে নতুনত্ব কোথায় ?’
‘না । আলাদারকম কিছু । সামথিং ভেরি ডিফারেন্ট । শহরের মানুষকে না টানলেও গ্রামে গজ্ঞে মফস্বলে এমন খেলা দেখতে লোকজন ভিড় করবে ।‘
নাকের মধ্যের বিরক্তিকর শব্দটা আবার করল মুত্থুস্বামী, ‘সামথিং ডিফারেন্ট ? তা, অমন ডিফারেন্ট খেলার জন্যে ডিফারেন্ট লোক পাবে কোথায় ? আর তাকে মাইনেই বা দেবে কোথা থেকে ?’
‘সেই তো । সেটাই তো প্রবলেম । আমাদের হাতে এত সময় নেই । নতুন বিপজ্জনক খেলার আইডিয়াটা ভালো । কিন্তু লোক ? লোক খোঁজার মতো সময় নেই আমাদের । তারপর তেমন দক্ষ লোক হলে কত মাইনে চাইবে তা-ই বা কে জানে ..’
রেড্ডির কথা শেষ হল না । রোজ হাতিদের চান করায় ছেলেটা, মানিক, এসে দাঁড়াল দরজায় । ‘বিনায়কসাহেব এসেছেন । অফিসঘরে বসে আছেন । খবর দিতে বললেন আমায় ।‘
বিনায়ক কুমার লাল । অ্যাপোলো সার্কাসের এজেন্ট । নানা জায়গায় ঘুরে শো-এর ব্যবস্থা করা ওর
কাজ । গোপিকিশন, সুবোধও তাই । তিনজনের জন্যেই সাগ্রহে অপেক্ষা করছে রেড্ডি ।
‘নিয়ে এসো এখানেই । কি খবর এনেছে দেখা যাক ।‘
-----
বিনায়ক একা আসে নি । সঙ্গে একটি ছেলে । তেইশ চব্বিশ হবে । বেশ লম্বা । রোগা । গলার হাড় উঁচু হয়ে আছে । এ বয়সে যেমন হওয়া উচিত, একটু ছটফটে একটু উজ্জ্বল, একেবারেই তেমন নয় । কে ছেলেটা ? বিনায়কের আত্মীয় ? চেনা কেউ ?
ঘরে ঢুকে চেয়ারে বসল বিনায়ক । ছেলেটা দাঁড়িয়েই রইল । উৎসুক চোখগুলোর দিকে তাকিয়ে হাসল বিনায়ক, ‘খুব খারাপ খবর নয় । এদিকে বোকারো, আসানসোল, খড়্গপুর .. তারপর টাটা, সিনি, চক্রধরপুর .. রাউরকেলা, বিলাসপুর .. পরপর শো । বুকিং হয়ে গেছে ।‘
রেড্ডি নড়েচড়ে বসল, ‘খড়্গপুর ? টাটা ?’ এই দুই জায়গাতেই গত দু’বছর ধরে জেমিনি আগেভাগে ব্যবস্থা করে ফেলছিল ।
ঘাড় নাড়ল বিনায়ক, ‘খরচাপাতি হয়েছে একটু । শ্রীনিবাসনসাব জানেন ।‘
নিশ্চয় পয়সাকড়ি খাওয়াতে হয়েছে । পুলিশ থেকে সরকারি আমলা, এলাকার বিধায়ক থেকে মাঠের
মালিক । সবার সঙ্গে ব্যবস্থা করেই তো ব্যবসা । শ্রীনিবাসন টাকাকড়ির জিম্মেদার । তাছাড়া তাঁর আর একটা পরিচয়ও আছে । শ্রীনিবাসন শৈলজার বাবা । না বুঝে খরচাপাতির অনুমতি দেবেন না ।
খরচাপাতি নিয়ে মাথা ঘামালো না রেড্ডি । খবর ভালো সত্যিই । পুরোনো জায়গাগুলো যদি ফিরে পাওয়া যায়, একবার শেষ চেষ্টা করতেই হবে ।
শৈলজা তাকিয়েছিল রেড্ডির দিকেই । ওই চোখ তার খুব চেনা । পুরোনো এইরকম একটি দিনে শোনপুরের মেলা থেকে একসঙ্গে তিন তিনটে হাতির বাচ্চা কিনেছিল রেড্ডি । ছোট দল তখন । পুঁজি কম । তবু বারবার এমন রিস্ক নিয়েছে । সেই চোখ । সত্যিই খবরটা ভালো । যদি আর একবার ..
‘তাহলে গণেশের আইডিয়াটা নিয়ে কথা শুরু হোক আবার’, বিনায়কের দিকে ফিরল শৈলজা, ‘তুমি বরং একটু ঘুমিয়ে নাও । সন্ধেবেলা কথা বলব আবার ।‘
‘যাচ্ছি । কিন্তু .. আমাকে হঠাৎ এখানে ডেকে পাঠানো হল কেন ? আমি তো রায়গড় যাচ্ছিলাম । ওখানে একটা দশ-বারোদিনের শো-এর ব্যবস্থা হতে পারে । প্রসাদ বলছিল ..’
মুত্থুস্বামী থামিয়ে দিল, ‘সেই কথাই তো বলছি । তুমি এসেই সাতকাহন নিজের কথা শুরু করলে । শো-এর ব্যবস্থা করে হবেটা কি ? দিনের পর দিন হল, গ্যালারি ফাঁকা থাকছে । পঁচিশ পার্সেন্ট জায়গাও ভরছে না । খরচ চলবে কি করে ? তাই রেড্ডিসাহেব একটা অল্টারনেটিভ ব্যবসার কথা ভাবছেন ।‘
রঘুনাথ আর গণেশ একে অন্যের দিকে তাকালো আবার । দল তুলে না দিলে বুড়োঘুঘুর শান্তি নেই । কে জানে, জেমিনি সার্কাসের সঙ্গে এ নিয়েও ওর চুক্তি হয়েছে কিনা ।
তাড়াতাড়ি শৈলজার দিকে ফিরল রঘুনাথ, ‘গণেশের আইডিয়া নিয়ে কি বলছিলেন ম্যাডাম ?’
শৈলজার উত্তর দেওয়া হল না, বিনায়কের সঙ্গে আসা ছেলেটা কথা বলে উঠল, ‘তাহলে আমি চলে যাই ? শুধুমুধু এতদূর টেনে নিয়ে এলেন ..’ চমৎকার গলা তো ছেলেটার ।
‘ওহো, তোমার কথা তো এদের বলাই হল না । আলাপ করিয়ে দিই । ওর একটা বড় বাংলা নাম আছে । আমি বলতে পারি না । সবাই ওকে ওস্তাদ বলে ডাকে । আমিও ওস্তাদ বলি । ওকে অ্যাপোলোর জন্যে এনেছি আমি ।‘
জহুরীর চোখ বিনায়কের । ঘোরাঘুরি করতে করতে এমন অনেক দক্ষ লোক এনেছে আগেও ।
‘সিনি থেকে চক্রধরপুর যাচ্ছি, দেখি একটা বড় মেলা বসেছে । সেখানে পেয়েছি ওকে । মৌত কা কুঁয়ায় খেলা দেখাচ্ছিল ।‘
মুত্থুস্বামী এতক্ষণ একদৃষ্টিতে চেয়েছিল ছেলেটার দিকে, নাকের আওয়াজ করে মুখ ফেরালো, ‘সে আর এমন কি খেলা ? অমন খেলোয়াড় এখানে অনেক আছে । মাইকেল আছে, জয়রাম আছে, এই রঘুনাথই আছে ..’
ঘাড় নাড়ল বিনায়ক, ‘ওস্তাদ বহুত হিম্মতওয়ালা ছেলে । অনেক কিছু পারবে । পরে আপনিও বলবেন একথা ..’
বড়ছেলে সুদর্শনকে মনে পড়ে গেল শৈলজার । এই ছেলেটা সুদর্শনের বয়সী হবে । হাসল, ‘তোমার নাম কি ? আমিও কি ওস্তাদ বলেই ডাকব তোমায় ?’
একটুও হাসল না ছেলেটা, ‘আমার নাম অনির্বাণ । ওটা বোধহয় আপনি বলতে পারবেন না । আমার মা ডাকতেন, বাপি । আপনি বাপি বলতে পারেন । কিন্তু ডাকবেন আর কখন ? আমি তো এখনই চলে যাচ্ছি ।‘
এতক্ষণে কথা বলল রেড্ডি, ‘যাবার জন্যে ব্যস্ত কেন ? কাজ করবে বলেই তো এসেছ ?’
‘হ্যাঁ । তাই । কিন্তু মনে হচ্ছে এখানে সুবিধে নেই । নো প্রবলেম । আমি চলে যাচ্ছি ।‘
‘আরে, দাঁড়াও ওস্তাদ । দাঁড়াও । যাবে কোথায় ? ও মেলায় তো আর ফিরতে পারবে না । আমি তোমায় কাজের কথা বলে নিয়ে এসেছি । এখানে না হলে তোমার একটা কাজের ব্যবস্থা আমিই করব ।‘ রেড্ডির দিকে ফিরল বিনায়ক, ‘আমি বিকেলে আসব । ওকে নিয়ে যাই এখন ।‘
হাতের ইশারায় বিনায়ককে থামালো রেড্ডি, ছেলেটার দিকেই তাকিয়ে আছে, ‘কিরকম খেলা দেখাবে ? মৌত কা কুঁয়া তো আছেই । আমরাও ও খেলা দেখাই । আর ? বাঘ সিংহ নিয়ে খেলা দেখাতে পারবে ?‘
আলগা একটা হাসি ফুটল ছেলেটার মুখে, ‘পারব ।‘
‘পারবে ? কোনোদিন বাঘ সিংহ নিয়ে খেলা দেখিয়েছ ? শিখেছ ?’
‘না ।‘
‘তাহলে ? না শিখে কিছু হয় ? এই যে মৌত কা কুঁয়া.. মোটরবাইক নিয়ে খেলা.. শিখেছ বলেই না করতে পেরেছ?’
উত্তর না দিয়ে মিটিমিটি হাসতে লাগল ছেলে ।
‘ওটাই তো আসল মজা’, বিনায়ক বলে উঠল, ‘আমি তো দেখে শুনে তাজ্জব । ওস্তাদ নিজে নিজেই একদিন হঠাৎ মৌত কা কুঁয়ার খেল শুরু করেছিল । কারো কাছে শেখে নি । মালিকের সঙ্গে টাকাপয়সা নিয়ে গন্ডগোল.. খেলা দেখাত যারা, সে ছেলে দু’জন একসঙ্গে মেলা ছেড়ে চলে গেল । মালিককে বিপদে ফেলে । মৌত কা কুঁয়ার খেলা বন্ধ । সেদিন আবার কমিশনার-সাহেব খেলা দেখতে আসবেন । মেলার মালিক আমার চেনা । গোবর্ধনজি । আমাকে ডেকে বললেন, যদি লোক জোগাড় হয় । মথুরায় আছে মুন্না, খবর পাঠালাম । আসতেও তো দু’ চারদিন লাগবে ।‘
একটানা কথা বলতে বলতে হাঁফিয়ে উঠল বিনায়ক, হাত দিয়ে কপালের ঘাম মুছে নিল । হাসল তারপর, ‘ওস্তাদ এসে বলল, ও খেলা দেখাবে । রোজ মেলায় এসে দেখে দেখে নাকি খেলা শিখেছে । মথুরা থেকে নতুন লোক আসতেও তো দেরি । গোবর্ধনজি চান্স নিলেন । আমি নিজের চোখে দেখলাম সব । ওর খেলাও দেখলাম । তারপর ওর সঙ্গে কথা বলেছি । কিছুতেই আসবে না । ওর নাকি সার্কাস ভালো লাগে না । বললাম, ভালো না লাগলে কেউ ওকে আটকে রাখবে না । তখন সঙ্গে এল ।‘
----
বিনায়কের কথা আর শুনতে পাচ্ছিল না অনির্বাণ । আবার সেই এক মজা । হেরে গিয়ে পালানো । জ্ঞান হয়ে থেকে সেইরকমই তো দেখছে । হাতের নাগালে সুযোগ আসামাত্র কে যেন টুক করে তা সরিয়ে নেয় । নাগালের মধ্যে আসেই বা কই !
এসময় দাদার কথা মনে আসবেই । কমলা-সাদা জার্সি । সোমনাথকাকা দিয়েছিল পাড়ার টিমের সবাইকে । রাইট-আউটে খেলত দাদা । খুব ছুটতে পারত । সবুজ ঘাসে লাল-সাদা বলটা পায়ে পায়ে নিয়ে । বাঘের মতো ডজ করতে করতে ছুটত দাদা । কি সুন্দর যে লাগত !
আর দ্বিজুদা । বল নিয়ে ছুটতে ছুটতে লাল নিশানের কর্নার-ফ্ল্যাগ পর্যন্ত চলে যাবে, তারপর হঠাৎ ঘুরে সেন্টার করবে । হাততালিতে ভরে যেত চারপাশ ।
মাঠের ধারে বসে থাকত কিশোর অনির্বাণ । একবার যদি সুযোগ পায় !
মা মাঝে মাঝে এসে দাঁড়াত মাঠের ধারে, ‘অ বুড়ো, অ খোকন, অ দ্বিজু, বাপিকে খেলতে নে না তোরা ।‘ মায়ের বড়ছেলে সে ডাক শুনেও শুনত না । মা চলে গেলেই ছেলেরা দুয়ো দিত । গোলকিপার টিটো । শুধু পাড়ার নয়, টিটো এ তল্লাটের নামকরা গোলকিপার । অন্য পাড়ার ছেলেরাও নিয়ে যেত ওকে । দুটো আঙুল গোল করে মুখে পুরে শিস দিত অনির্বাণকে দেখলেই, ‘কি রে বাপি ? খেলবি নাকি ?’ ..
অমনি ছেলেরা হ্যা-হ্যা করে হাসত । দাদাও । ছোটনদা পাড়ার খেলাতেও টিমে বাপির নাম রাখত না ।
বিকেল হলেই পাড়ার মেয়েরা দল বেঁধে রাস্তায় বেড়াত । মাঠের ধারে দাঁড়িয়ে খেলা দেখত । তখন আরো উৎসাহ বেড়ে যেত ছেলেদের । সুমিতা হেসে হেসে বলত টিটোকে, ‘বাপিকে খেলতে নিস না কেন রে ? ওকে অন্তত দুধভাত করে টিমে রাখতে পারিস না ?’
টিটো বলত, ‘বাপির জন্যে খুব মায়া দেখছি ! তোদের সঙ্গে খেলতে নিয়ে নে’ .. তখন সবাই জোরে জোরে হাসত, আর বাপি এক দৌড়ে বাড়ি চলে আসত । সেই থেকেই কি হীনমন্যতা ঢুকে গেল গহীন মনে ? কে জানে ।
তারপরও তো বারবার হার । বারবার পরাজয় । পড়াশোনার মাথা নেই, বলার মতো রেজাল্ট নেই । স্কুলে অঙ্কের ক্লাসের শিবনাথবাবু বলেছিলেন, ‘তোর দ্বারা মাটি কোপানো ছাড়া কোনো কাজ হবে না ।‘
পড়াশোনার মাথা না থাক, ভোম্বল কেমন ফিবছর সাঁতারে প্রাইজ পেত । বাবুয়া রচনা প্রতিযোগিতায় । ছেলেরা কেউ ভালো আবৃত্তি করে, কেউ গান গায়, কেউ ছবি আঁকে । কেউ আর কিছু না পারুক দুর্গাপুজোর প্যান্ডেলে চমৎকার ধুনুচি-নাচ নাচে । বাপি কিছুই পারে না । কিচ্ছুটি না ।
স্কুলের বন্ধুরা, পাড়ার বন্ধুরা সব জয়েন্ট দিয়ে ডাক্তারি ইঞ্জিনীয়ারিং পড়ছে । কোনোরকমে পাশ করে অনির্বাণ কমার্স নিয়ে ভর্তি হয়েছিল । তাও একবারে পাশ করতে পারে নি । দাদা পাশ করে চাকরি পেল । বাবামায়ের মুখে হাসি ।
অনির্বাণের দিকে চোখ পড়লেই বাবার মুখ কঠিন, মায়ের চোখের কোলে দুশ্চিন্তা । সামান্য একটা কমার্স নিয়ে পাশ করতে এত কষ্ট ! এ ছেলে জীবনে করবে কি ! কে চাকরি দেবে ! পুঁজি নেই যে ব্যবসা করবে । আজকাল কিছু না হোক, কলসেন্টারে চাকরি করে কত ছেলেমেয়ে মোটা টাকা রোজগার করছে ।
দিদিরা বলত, ‘একটা কিছু কর বাপি । শ্বশুরবাড়িতে তোর পরিচয় দিতে লজ্জা হয় ।‘
দাদার বিয়ের পর বৌদিরও লজ্জা করত । বাপের বাড়িতে দ্যাওর বলে পরিচয় দিতে লজ্জা করত । দাদা তো কথাই বলত না । বাবা বলত, ‘অকর্মণ্য অপদার্থ ছেলে । অমন ছেলে থাকা না-থাকা সমান ।‘
মা বলত, ‘বালাই ষাট ।‘ ঠাকুর দেবতার দোরে দোরে ঘুরত, ‘আমার বাপিটার একটা হিল্লে করে দাও ।‘
পাড়ার সবচেয়ে গবেট অকর্মণ্য ছেলেটা, কানাই, সে পর্যন্ত এক পয়সাওয়ালা ঘরের মেয়েকে পটিয়ে পাটিয়ে প্রেমের বিয়ে করে হিল্লে করে ফেলল । সেই কানাই প্রোমোটার হয়ে দুহাত্তা রোজগার করছে । ধোপাদের বাড়ির ছেলেটা, গদাই, কানাইয়ের বৌয়ের শাগারেদি করে বিল্ডিং-মেটেরিয়াল সাপ্লাইয়ের ব্যবসা করছে । আর কিছু না হোক, পার্টির দাদাদের সঙ্গে লেগে থেকে রোজগার করছে সব ।
মায়ের চিন্তা হবে না ? অন্তত একটা পয়সাওয়ালা ঘরের মেয়ে যদি বাপিকে পছন্দ করত !
মিনুর কথা অবশ্য মা জানত না । সেই মিনু, যাকে নিয়ে জীবনের প্রথম কবিতা লিখেছিল অনির্বাণ । শেষ কবিতাটাও লিখেছিল মিনুকে নিয়েই, মিনুর বিয়ের দিন । দু’চার লাইন এখনো মনে আছে ..
‘নতুন কোনো জন্মে যদি আসি
নতুন কোনো সূর্যওঠা ভোরে
সাগর হবার স্বপ্ন মনে নিয়ে
শালুকফোটা পুকুর যেন হই
সেই পুকুরে পদ্মপাতা হয়ে তুমি এসো
আমার সাঁঝের বাতি ..’
আবোল তাবোল কবিতা । কবি হবার গুণ কি বাপির আছে ?
মিনুর কথা মনে হলেই আশেপাশের পৃথিবীটা নিস্তব্ধ নিঃশব্দ হয়ে যায় । সারি সারি ব্যর্থতা মনে পড়ে যায় । মিনুও এই ব্যর্থতাকে অবহেলা করে চলে গেছে । বাড়িতে, পাড়ায়, স্কুলে, কলেজে .. কেউ মনে রাখে নি । কেউ না । ভাগ্যিস মা মিনুর কথা জানত না । বাপির সব পরাজয়ের লজ্জা, সব অক্ষমতার লজ্জা বুকে নিয়ে মা মুখ লুকিয়ে ঘুরত । মাকে সেই লজ্জা থেকে মুক্তি দেবার কোনো উপায় সেদিনও ছিল না, আজও হল না ।
তারপর কবে যে বাড়ি থেকে পালিয়েছিল । পীর-ফকির, আউল-বাউল, সাধু-অসাধু .. কত সঙ্গ । কোনো পিছুটান তো নেই ।
যাত্রিক নামের ট্রাভেল এজেন্সির সঙ্গে ঘুরতে ঘুরতে গঙ্গোত্রী গোমুখ । তপন নামের ওষুধের ফেরিওয়ালার সঙ্গে গ্রামে গঞ্জে । রাধাবাউলের সঙ্গে মথুরা বৃন্দাবন । আসল নাম রাধাকান্ত, মুখে মুখে রাধাবাউল । ফকির দরবেশ সাজে কেরালা পর্যন্ত ঘুরে আসা । এলাহাবাদের জটাধারী সাধুদের দলটার সঙ্গে তিব্বত পর্যন্ত যাওয়া হয়েছিল । মানসকৈলাশ যাবার বাসনা ছিল, হল না । বর্ডারে ধরে ফেলেছিল । সেই জেলে থাকার সময় বেদের কাছে জাদু শেখা, তারপর বেদে-বেদেনী দলের সঙ্গে রাজস্থান ।
কোথাও থিতু হতে পারে না অনির্বাণ । কোনো দলের সঙ্গেই বেশিদিন থাকতে ইচ্ছে করে না । কোথাও একটা ঠিকানা তৈরি হয় না । বুকের মধ্যে মায়ের ব্যাকুল চোখদুটোর টান ।
কতরকম নেশা । বাউলের আখড়ায় । ফকিরের থানে । ফুটপাতের অন্ধকারে । শঙ্করপুরের বিচে হিপিদের আড্ডায় । বেনারসে বাবুমহারাজের আখড়ায় । তবু কিচ্ছুটি ভোলা হয় না । মায়ের আকুল চোখদুটো মনে পড়ে বারবার ।
বেনারসে বাবুমহারাজের শাগরেদি করার সময় ছুরি নিয়ে খেলা শেখা । একসঙ্গে বারোটা ছুরি নিয়ে খেলা দেখাত বাবুমহারাজ । বেশ শিখে ফেলেছিল, একদিন খেলা দেখানোর সময় আখড়ার পোষা ছাগলটার গায়ে ছুরি বিঁধে গেল । মেরে ধরে তাড়িয়ে দিল সবাই ।
সব জায়গায় ব্যর্থতা । ঘরেও নহে, পরেও নহে, কেউ আপন করে নি অনির্বাণকে ।
তবে ঘুরে ঘুরে বেড়িয়ে একটা জিনিস শেখা হয়েছে । এই পৃথিবীতে হেরে যাওয়া লোকের সংখ্যাই বেশি । দুটো টাকার জন্যে জীবন বাজি রেখে কত কান্ডই না করে লোকে !
কোথাও শান্তি নেই । সন্তুষ্টি নেই । সংসার ছেড়ে বেরিয়ে পড়া সাধু ফকিরই বলো, আর দোহাত্তা রোজগার করা সংসারী মানুষই বলো ।সব ছুটছে । দৌড় । দৌড় ।
সেদিক দিয়ে দেখতে গেলে, জেতার জন্যেই এত কান্ড ।
----
শৈলজার দিকে তাকাল বিনায়ক, ‘ওকে একবার সুযোগ দিলে হয় না ?’
‘আমরা একটু আগে আলোচনা করছিলাম, যদি কোনো নতুন খেলা দেখানো যায় । সামথিং ডিফারেন্ট । ডেনজারাস । পারবে ?’
‘পারব ।‘ ঘাড় নাড়ল অনির্বাণ ।
‘আরে ! কিরকম খেলা, কেমন ডেনজারাস .. কিছু না শুনেই হ্যাঁ বলে দিচ্ছে যে ! এখন তো শুনছি, মৌত কা কুঁয়ার খেলাটাও ঠিকঠাক জানে না ।‘ মুত্থুস্বামী খুব বিরক্ত ।
এমনিতে বুড়ো ঘুঘুকে পছন্দ না করলেও রঘুনাথের মনে হল, এ কথাটা ঠিকই বলেছে মুত্থুস্বামী । ছেলেটার ওপর এতটা ভরসা করা কি ঠিক হবে ?
না-বলা কথাটা রেড্ডি বুঝে ফেলেছে, ‘এমনিও বন্ধ করে দিতে হবে । মানে, কিছু উপায় না হলে বন্ধ করে তো দিতেই হবে । একটা চান্স নেওয়া যাক ।‘
ছেলেটার দিকে ফিরল, ‘বেশ । মেনে নিলাম, তুমি পারবে । হয়ত ভগবানই তোমায় পাঠিয়েছেন । তোমার হাতে অ্যাপোলোর ভবিষ্যৎ । এবার বলো, কিরকম ডেনজারাস খেলা দেখাবে তুমি ।‘
পেটের মধ্যে হাসি গুবগুবিয়ে উঠছে, অনেকদিন পর বেশ আমোদ হচ্ছে অনির্বাণের । অচল পয়সার ওপর বাজি ধরতে চাইছে লোকটা । আপাদমস্তক অসফল, দৌড়তে না-পারা ঘোড়ার ওপর বাজি । বেড়ে মজা । বুঝবে নিজেই, অনির্বাণের তো আর কিছুই হারাবার নেই ।
জানলা দিয়ে বাইরে চোখ চলে গেল । লম্বা খুঁটি, তাঁবুর খুঁটি । সেদিকে তাকিয়ে বলল, ‘আমি আশি ফুট ওপর থেকে ঝাঁপ দেব । একটা আট বাই ছয় ট্যাঙ্কের মধ্যে ঝাঁপ ।‘
‘আশি ফুট ? বলছ কি ?’ রেড্ডি সোজা হয়ে বসল । ‘ওরকম ট্যাঙ্ক আছে আমাদের ? দেখি তো কেমন পারে ।‘
গণেশ বলল, ‘তা আছে । কিন্তু ডেপথ ? অন্তত দশ ফুট ডেপথ চাই । অত ওপর থেকে পড়বে ।‘
‘দশ না, কম করেও অন্তত বিশ ফুট ।ওর হাইটটা দ্যাখো’, রঘুনাথ বলে উঠল, ‘আশি ফুট উঁচু থেকে ঝাঁপ দেবে .. শরীর কিন্তু সাঁতার দেবার মত হরাইজন্টাল করতে পারবে না । বিশ ফুট ডেপথ চাই । আর আশি না । প্রথমদিন এত রিস্ক নেওয়া ঠিক হবে না । ষাট ফুট উঁচু ওই পাটাতন থেকে ডাইভ দিক ।‘
‘আশি ফুট ওপর থেকে ঝাঁপ । ট্যাঙ্কের চারদিকে আগুন জ্বালিয়ে দেওয়া হবে ।‘ রেড্ডি আপনমনে বলে উঠল, ‘বেশ ডেনজারাস । এমন কোনো দলে দেখায় না ।‘
শৈলজা তাকিয়েছিল অনির্বাণের দিকে, ‘তুমি এমন ঝাঁপ আগে দিয়েছ ? কোথায় দিয়েছ ?’
অনির্বাণের মনে পড়ল, চড়কের মেলাটার কথা । রোগা একটা লোক, পাহাড়ের ওপর থেকে নিচে জলের মধ্যে ঝাঁপ দিচ্ছিল, আর নির্বিকার মুখে উঠে এসে দর্শকদের কাছে হাত পেতে পয়সা নিয়ে কোঁচায় গুঁজে রাখছিল । ইচ্ছে হলেও সেদিন ঝাঁপ দেওয়া হয় নি, আজ খেলাটা জমবে । মহিলা যেমন উতলা মুখে চেয়ে রয়েছে, যদি বলে এই প্রথম, আগে কখনো এমন ঝাঁপ দিই নি, তাহলেই হয়েছে । জবাব না দিয়ে মিটিমিটি হাসল অনির্বাণ ।
শৈলজা জিঞ্জেস করল আবার, ‘কতবার এমন ঝাঁপ দিয়েছ ? কোথায় দিয়েছ ?’
বিনায়কের দিকে তাকাল অনির্বাণ, ‘আমি চেঞ্জ করতে চাই ।‘
‘ও হ্যাঁ হ্যাঁ । কি পরবে তুমি ?’
‘চলো, আমি নিয়ে যাচ্ছি ।‘ গণেশ উঠে দাঁড়াল ।
হাত বাড়িয়ে বাধা দিল রেড্ডি, ‘এখনো ভেবে দ্যাখো । ষাট ফুট । রিয়েলি ডেনজারাস ।‘
‘আপনি ট্যাঙ্ক ভরানোর ব্যবস্থা করুন । যদি না পারি, চলে যাব । ভাবছেন কেন ?’
‘ঠিকই তো । না পারলে চলে যাবে । আমাদের কি ?’ মুত্থুস্বামী ঘনঘন ঘাড় নাড়ছে, ‘তার আগে বলো, কত মাইনে নেবে তুমি ?’
স্পষ্ট বিরক্ত হল শৈলজা, ‘ও এখানে খেলা দেখাবে কিনা তাইই ঠিক হয়নি এখনো ।‘
রেড্ডির দিকে ফিরল, ‘বুঝতে পারছ না তোমরা । যদি একটা সাংঘাতিক কান্ড হয় ! এবার আর পুলিশ ছাড়বে আমাদের ?’
‘আপনি ভাবছেন কেন ? আমি নিজের রিস্কে খেলা দেখাচ্ছি । যদি চান, আমি লিখে সই করে দিচ্ছি । যদি না পারি, আমার হার । যদি পারি, আপনাদের দলের কাজে লাগবে । আপনাদের দলের সামনেও তো বেশ বিপদ ।‘ অনির্বাণ হাসল ।
তবু শৈলজা রাজি নয়, ‘কোথা থেকে এসেছ, বাড়িঘর কোথায়, কিছুই তো বলছ না । এমন রিস্কি খেলা .. না না, কিছুতেই না ..’
‘এক কাজ করি’, গণেশের মাথা এসব সময় বেশ ঠান্ডা থাকে, ‘আপাতত একটা সাপোর্ট দিই । না পারলেও বিপদ হবে না । তারপর যদি দেখা যায়, ও সত্যিই খেলাটা পারে .. দারুণ ব্যাপার হবে কিন্তু । এমন খেলা কেউ কোনো সার্কাসে দেখায় নি ।‘
‘আর এখন আগুন টাগুন জ্বালানোরও দরকার নেই’, রঘুনাথ সায় দিল, ‘দেখা যাক সত্যিই অমন ডাইভ দিতে পারে কিনা । তারপর …’
----
‘ওই ওপরে দ্যাখো, ওখানে একটা পাটাতন আছে । দেখতে পাচ্ছ ? এই দড়ির মইটা ধরে উঠে যাও।‘ রঘুনাথ বলে দিল ।
দারুণ মজা । খেলাটা দেখাতে পেরে বেশ লাগছে । কিন্তু কেনই যে এই খেলাটা দেখানোর ইচ্ছে হল ! পারবে না জেনেও কেন যে বারবার ইচ্ছে হয় ! দাদার মত ফুটবল খেলার ইচ্ছে, বাবুয়ার মত ভালো রচনা লেখার ইচ্ছে, শমিতের মত ভালো রেজাল্টের ইচ্ছে, বাবুমহারাজের মত ছোরা নিয়ে খেলা দেখানোর ইচ্ছে । সাহসী হবার ইচ্ছে, সফল হবার ইচ্ছে । আর বারবার হেরে যাওয়া ।
‘আমার ভালো লাগছে না । আমাদের বিপদ থেকে বাঁচার উপায় করতে এই ছেলেটাকে কাজে লাগাব আমরা ? ওর যদি কিছু হয় .. ওর মা-বাবা .. কাদের বাড়ির ছেলে কিছু জানা নেই .. আমার ভালো লাগছে না ।‘ শৈলজা এখনো রাজি নয় ।
‘আমরা তো কেউ ওকে জোর করি নি । এমন কোনো খেলা আমাদের মাথায়ও আসে নি । ও নিজেই বলেছে খেলাটার কথা । আমরা শুধু একটা চান্স নিচ্ছি । যদি .. বাই চান্স ..’ রেড্ডি চুপ করে গেল ।
নির্বিকার মুখে দড়ি মইটায় হাত দিল অনির্বাণ ।
‘পারবে তো বেটা ? এখনো ভেবে দ্যাখো ..’ বেটা ডাক শুনে ফিরে তাকাল । আকুল দুই চোখ । অচেনা একটা ছেলের জন্যে উদবেগ .. প্রত্যাশা .. সব মায়েরাই বুঝি একরকম ?
‘ঠিক পারবি তুই বাপি, দেখিস সব ঠিক হয়ে যাবে’, মাও এমনি চোখে চেয়েছিল একদিন । বাপির ওপর মায়ের ভরসা ছিল না, তবু চেয়েছিল । অক্ষম ছেলের ওপর মায়া, নাকি দুর্বলের প্রতি করুণা .. মায়ের চোখ থেকে প্রত্যাশার আলো একদিন মুছে গেছিল । শুধুই উদ্বেগ, শুধুই লজ্জা । বাপি মায়ের সহায় হতে পারে নি ।
মা আর বাপির কাছে কিছু চায় নি ।
আর আজ .. অচেনা পরিবেশের অচেনা একদল মানুষ সেই বাপির ওপর ভরসা করতে চাইছে । এর আগে কেউ কোনদিন এমন করে ডাকে নি তাকে । কেউ বলে নি, দূর ভবিষ্যতে তোমারও একটা দাবী আছে । এই প্রথম ।
ওরা কেউ জানে না .. কিন্তু অনির্বাণ জানে । এই খেলাটা .. খেলার মতই । অথচ ঠিক খেলা নয় । এই ছোট্ট খেলাটুকুর মধ্যে জীবন-মৃত্যুর একটা প্রশ্ন জড়িয়ে আছে ।
অক্ষমতার লজ্জায় আবার পালিয়ে যেতে ইচ্ছে হল । পালিয়েই বা যাবে কোথায় ? নিজের কাছ থেকে তো আর পালানো যায় না । তার চেয়ে এই একটা সুযোগ । ঝাঁপ দেবে অনির্বাণ, নিশ্চিত মৃত্যুর মাটিতে । এখানে কেউ চেনা নেই, এই ভালো ।
পাটাতনের ওপর দাঁড়িয়ে একবার আকাশের দিকে তাকাল । কি সুন্দর নীল । মেঘের মধ্যে কেমন সাদা একটা আলো । আকাশ জুড়ে সাদা ছায়াপথ । এই পথ ধরে যেন সে চলে যেতে পারবে আলোর দেশে ।
কোমরে একটা লোহার শেকল আটকে দিয়েছে রঘুনাথ । ওদিকের তাঁবুর পাশে ক্রেনের মত একটা যন্ত্র, জিনিসপত্র তোলার জন্যে লাগে বোধহয় । শেকলের অন্য দিকটা সেখানে লাগানো । রিস্ক নেবে না রেড্ডি ।
পাটাতনের ওপর দাঁড়িয়ে আকাশের সাদা আলোর দিকে তাকিয়ে আস্তে আস্তে কোমর থেকে শেকলটা খুলে নিল অনির্বাণ । তারপর ঝাঁপ দিল । আহ ! মুক্তি ।
খানিকটা আসার পর আপনা আপনি দু’হাত ছড়িয়ে গেল দু’পাশে । ডানার মত । চোখ বন্ধ করল অনির্বাণ । আকাশ জুড়ে ঘন্টাধ্বনি । আর কিছু শুনতে পাচ্ছিল না । শ্যামলা সুন্দর একখানা মুখ, কাপড়ে হলুদের দাগ, কপালে সিঁদুরের গোল টিপ । মায়াবী গলায় ডাকল, ‘বাপি রে ।‘ আহা মা ।
ফরসা লাল লাল একখানা মুখ, ঝলমলে মুখে ডেকে উঠল, ‘অ নি র্বা আ আ আ আ ন ।‘ পরনে লাল বেনারসী, কপালে সিঁথিমৌর, হাতে গাছকৌটো । আহা মিনু ।
অনেকখানি নিচে দু’চোখ বন্ধ করে গলার হারের লকেটটা চেপে ধরল শৈলজা । বালাজি তিরুপতির লকেট । রক্ষা করো প্রভু । হে গোবিন্দা, হে গোপালা, রক্ষা করো ।
জলের স্পর্শে চোখ খুলল অনির্বাণ । ট্যাঙ্কের মধ্যে বুক পর্যন্ত জল ।
‘সাবাশ’, উত্তেজিত মুত্থুস্বামী রঘুনাথের হাত জড়িয়ে ধরেছে, ‘দারুণ খেলা । সাবাশ ।‘
জ্বলজ্বল করছে বুড়ো ঘুঘু মুত্থুস্বামীর দু’চোখ । ‘কনগ্র্যাটস’, হাত বাড়িয়ে রেড্ডির হাত ধরল, ‘চলো, জেমিনি সার্কাসকে দেখিয়ে দিই আর একবার ।‘
রেড্ডির কপালে ঘাম, দু’চোখে চিকচিকে আলো, ‘এইরকম একজনকেই চাইছিলাম আমি । কেমন সন্ন্যাসীর মত নির্লিপ্ত । দেখলে ? ওপর থেকে নেমে এল, ঠিক যেন .. ঠিক যেন .. একটা আকাশের পাখি । ঠিক যেন একজন দেবদূত, না ?’
রঘুনাথের চোখে জল, বিনায়কের দিকে তাকাল, ‘সত্যিই ওস্তাদ । সাপোর্ট না নিয়ে .. এইভাবে ..’
‘ও যে এরকম কিছু করবে, আমিও ভাবিনি । ছেলেটা পাগল’, বিনায়ক এখনো স্বাভাবিক হতে পারে নি ।
গণেশ এগিয়ে গেল অনির্বাণের দিকে, যত্নে হাত ধরে তুলে নিল জলের বুক থেকে ।
অনির্বাণের দু’চোখ লাল হয়ে গেছে, সারা শরীরের রক্ত নেমে এসেছে যেন । ঘোর লাগা চোখে শৈলজার দিকে চাইল । বুকের কাছে দু’হাত জড়ো করা, দুচোখে জল । সব মায়েরাই কি একই রকম ?
কাছে এগিয়ে এল শৈলজা, ‘তুমি বাঁচতে চাও না বেটা ? কোমর থেকে রিঙ খুলে দিলে যখন, আমি ভয় পেয়ে গেছিলাম । তুমি জান লড়িয়ে দিয়েছিলে, না ?’
আলতো হাত রাখল মাথার ভেজা চুলে, ‘মেরা হিম্মতওয়ালা বেটা ।‘
বড় ভাল লাগছে । বড্ড ভাল লাগছে অনির্বাণের । চারদিক থেকে প্রাণ আর জীবন ঘিরে ধরেছে, এখন হঠাৎ করে চলে যাবার উপায় নেই । মাথার ওপর আকাশ, আকাশ জুড়ে সোনালি আলো । অনির্বাণের শরীর জুড়ে আস্তে আস্তে ঘুম নেমে আসছিল ।
-----------------------------
0 মন্তব্যসমূহ