চন্দন মণ্ডলের গল্প : বাবা দিবস


স্কুলে বাবা দিবস পালিত হল। এ বছরই প্রথম। দিনভর নানা রকম আয়োজনের মধ্য দিয়ে দিনটি কেটে গেল। প্রথমবার করা এ অনুষ্ঠানে অনেক মজা হয়েছিল।

এ উপলক্ষে স্কুল কর্তৃপক্ষ একটি প্রতিযোগীতার আয়োজন করল। বাবা বিষয়ক লেখা প্রতিযোগীতা। ‘আমার বাবা’- এই শিরোনাম ভিত্তিক।


স্কুলে একঝাঁক লিখিয়ে তৈরি হয়েছে। যে কোনও লেখালেখিতে তারা অতি আগ্রহভরে ঝাঁপিয়ে পড়ে। এতে স্কুলের অবদান আছে। জাতীয় দিবস, নববর্ষ কিংবা যে কোনও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে স্মরণিকা প্রকাশ, দেয়ালিকা করা স্কুলের রেওয়াজ। নিয়মিত স্কুল-বার্ষিকী বের হয়। সাহিত্য প্রতিযোগীতা হয়। এসবে গল্প, কবিতা, ছড়া লিখে লিখে এরা ভালোই হাত পাকিয়েছে। তারা প্রচুর বই পড়ে। আর তাই লিখতেও পারে।

ঠিক হল, যারা ভালো লিখবে তাদের লেখা মূল অনুষ্ঠানে পড়ে শোনানো হবে। লিখিয়েরা নিজেরাই পড়বে। উপস্থিত বাবা-মাদের সামনে। সেরা তিনজনের লেখা ছাপা হবে স্কুলের বার্ষিকীতে। এছাড়া পুরস্কার তো থাকছেই।

আকাশ এ উপলক্ষে তার বাবাকে নিয়ে একটা গল্প লিখে ফেলল। লিখিয়ে হিসাবে স্কুলে তার নাম আছে। অনুষ্ঠানের দিন যথাসময়ে তার ডাক পড়ল সেটি পড়ার। গল্পটা এরকম--

‘ছোটবেলায় আমার বাবা’

ছোটবেলায় আমার বাবার খুব মাছ ধরার শখ ছিল। ছিপ-বড়শি নিয়ে প্রায়ই তিনি মাছ ধরতে চলে যেতেন। এ কাজে তার গোসল-খাওয়ার কথা মনেই থাকত না। দুপুরবেলা দেরী করে বাড়িতে ফিরতেন। আর এ জন্য প্রায়ই ঠাকুমার কাছে বুকনি খেতেন।

বাসার সামনেই ছিল এক খাল। খালের উপর কালভার্ট। বর্ষার দিনে ওটাই ছিল বাবার প্রিয় মাছ ধরার জায়গা।

বড়শি দিয়ে তিনি নানারকম মাছ ধরতেন। পুঁটি, চ্যালা, টেংরা, বেলে, কৈ, টাকি, শোল, শিং আরও অনেক মাছ। আষাঢ়-শ্রাবণ মাসে বর্ষার নতুন জলের সাথে এই সব মাছ ভেসে আসত খালে। তখন সেখানে মাছ ধরার ধুম পড়ে যেত। তখনকার দিনের খাল-বিল-নদী-নালা গুলো এই সব মাছে ভরা থাকত।

বাবা মাছ খাওয়ার জন্য ধরতেন না। ধরার আনন্দে ধরতেন। সত্যি বলতে কী, মাছ ধরে তিনি কখনো বাড়িতে নিয়ে আসেননি। ইচ্ছা হতো মাছগুলো আবার খালেই ছেড়ে দেন। কিন্তু লোকে বোকা বলবে এই ভয়ে বিরত থাকতেন। তিনি আসলে মাছ ধরে পুষতেন। কতজনে কতকিছু পোষে! আমার বাবা পুষতেন মাছ।

বাসার সামনে বাইরের উঠানে মস্ত-বড় এক চৌবাচ্চা ছিল। ওটা তেমন কাজে লাগত না। সারা বছর এমনিই পড়ে থাকত। শহরের মিউনিসিপ্যালিটির সাপ্লাইয়ের জল সকাল বিকাল এসে চৌবাচ্চায় ভরে উপচে ড্রেন দিয়ে গড়াত। ওটাই ছিল বাবার পুকুর। আমি বলি অ্যাকুরিয়াম। তখন অবশ্য অ্যাকুরিয়াম কী সেটা বাবা জানতেন না। খাল থেকে মাছ ধরে এনে চৌবাচ্চায় ছেড়ে দিতেন। যখনকার কথা বলছি তখন বাংলাদেশ সবেমাত্র স্বাধীন হয়েছে। বাবার বয়স আট কী নয়।

সমস্যা দেখা দিল শুকনো মৌসুমে। খালের জল গেল শুকিয়ে। কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘আমাদের ছোট নদী’ কবিতার মতো হাঁটুজলে কী মাছ থাকে? বন্ধ হয়ে গেল বাবার মাছ ধরা।

কিন্তু আমার বাবার বুদ্ধি অনেক। খালে জল নেই তো, কী হয়েছে? চৌবাচ্চা আছে না? চৌবাচ্চায় মাছ ধরতে লাগলেন। শখ বলে কথা! বড়শি দিয়ে ধরেন আবার চৌবাচ্চায় ছেড়ে দেন। এভাবেই চলল কিছুদিন।

কিন্তু বেশিদিন দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানো সম্ভব হল না। মাছেরা চালাক হয়ে গেল। বড়শি তারা আর খায় না। আগে বড়শি ফেললেই পড়ি-মরি করে কে-কার আগে ছুটে আসতো। এখন টোপ দেখে পাশ কাটিয়ে যায়। তারা বুঝে গেছে ওটার বিপদ। বাবা তবু হাল ছাড়লেন না। বড়শি-আধার নিয়ে মাছের পেছনে লেগে রইলেন।

একদিন ঠাকুর্দার এক কথায় বাবার সাধের মাছ ধরা বন্ধ হয়ে গেল। তিনি বাবাকে ডেকে বললেন, তুমি যে বড়শি দিয়ে বার বার ওদেরকে ধরো, এতে তো ওরা ব্যথা পায়। তোমার নিজের শরীরে একবার ওরকম করে দেখ তো, কেমন লাগে? তোমার জন্য যেটা মজার ওদের জন্য সেটা ব্যথার, বোঝ সেটা?

ঠিকই তো। মাছেদেরও ব্যথা আছে। একদিন একটা মাছের মুখ থেকে বড়শি ছাড়ানোর সময় মুখ ফেটে রক্ত বের হচ্ছিল। আর একদিন বড়শির হ্যাচকা টানে মাছের পুরো ঠোঁটটাই ছিঁড়ে উঠে এসেছিল। খুবই গর্হিত কাজ।

বাবা নিজের ভুল বুঝতে পারলেন। মাছ ধরা বন্ধ করে দিলেন।

এখন আর সময় কাটে না। মাছ ধরার মত বই পড়া বাবার আরেক নেশা। বই পড়ে একঘেয়েমি কাটাবেন তারও উপায় নেই। এক সময় বাড়িতে প্রচুর বই ছিল। ঠাকুর্দা প্রতি জন্মদিনে গাদা-গাদা বই উপহার দিতেন। এখন একটাও নেই। মুক্তিযুদ্ধের সময় বাড়িতে লুট-পাট হয়েছিল। সব কিছুর সাথে বইগুলোও গেছে। এ দুঃখ বাবার আজও গেল না। সে দুঃখ আমারও আছে। বই আমি খুব ভালোবাসি। বাবার ছেলেবেলার ওই বইগুলো থাকলে আমি এখন পড়তে পারতাম!

ছোটবেলায় পড়া সেই সব বইয়ের গল্প বাবার এখনো মনে আছে। রাতের বেলা বিছানায় শুয়ে আমি বাবার কাছে সে সব গল্প শুনি। হাতি, সিংহ, ভালুক, আকাশের নক্ষত্র, ডাইনোসর, বৃষ্টির সুন্দর সুন্দর গল্প। আমি যখন ছোট ছিলাম বাবার কাছে গল্প না শুনলে আমার ঘুমই হতো না।

যাইহোক, মাছ ধরার কথায় ফিরে আসি। একঘেয়েমিতে কাটতে কাটতে একদিন বাবার মনে হল, দুর ছাই! কী হবে মাছ পুষে? শুধু শুধু ওদেরকে আটকে রেখে কষ্ট দেয়া। তার চেয়ে ছেড়ে দিলে বরং বড় হবে। একদিন তাই মাছগুলোকে ছেড়ে দিলেন। চৌবাচ্চার জল বের হবার মুখটা খুলে দিলেন। প্রবল বেগে জলর ধারার সাথে মাছগুলো কিলবিল করতে করতে ড্রেন দিয়ে খালে গিয়ে পড়ল। মাছগুলোর নাচ দেখে বাবার খুব ভালো লাগল। তার মনটা ভালো হয়ে গেল।

বাবা সম্পর্কে আর দু’টা কথা বলে শেষ করবো। খেলাধূলা প্রিয় ছিল বাবার। ভালো খেলোয়াড় ছিলেন। প্রিয় খেলা ফুটবল। তিনি ছিলেন সেরা খেলোয়াড়। অনেক পুরস্কার আছে তার। মনে হয়, একটু দুরন্তও ছিলেন। কারণ, তাঁদের সময় অনেক পুকুর-মাঠ-নদী-খাল-বিল-বাগান ছিল যেগুলো দুরন্তপনার ক্ষেত্রভূমি। আমাদের এসব কিছুই নেই। আমাদের আছে শুধু কার্টুন, ভিডিও গেম আর স্কুলের হোমওয়ার্ক। প্রসঙ্গক্রমে বলি, বাবা পড়াশুনায় ফাঁকিবাজ ছিলেন। পড়ার বইয়ের নিচে গল্পের বই লুকিয়ে রেখে পড়তেন। তাদের সময় পড়ার এতো চাপ ছিল না। স্কুল কামাই, স্কুল পালানো, পড়ার ফাঁকি দেয়া তেমন দোষের মনে করা হতো না।

আমিও ছিপ বড়শী দিয়ে বাবার মতো মাছ ধরতে চাই। কিন্তু ধরবো কোথায়? খাল-বিল-নদী-নালা-পুকুর এসব কী আমাদের আছে? এজন্য তো সাঁতারটাই শেখা হল না! বৃষ্টির দিনে পুকুরে ঝাপ দিয়ে পড়ে সাঁতার কাটার আনন্দও আজো অজানাই থেকে গেল। বাবার মতো আমিও বই পড়তে ভালোবাসি। বাবা আমাকে অনেক বই কিনে দেয়। আমাকে ছেলেবেলার গল্প, মুক্তিযুদ্ধের সেইসব আগুন-ঝরা দিনের গল্প শোনায়। এ গল্পগুলো শুনতে আমার খুবই ভালো লাগে। বার বার শুনলেও তা পুরানো মনে হয় না।

আমি বাবাকে খুব ভালোবাসি। আমার বাবা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বাবা।

গল্প শেষ হল।

প্রবল করতালির মধ্য দিয়ে আকাশ লজ্জিত মুখে মঞ্চ থেকে নেমে বাবার পাশে গিয়ে বসল। সবাই গল্পের খুব প্রশংসা করতে লাগল। অনেকে উঠে এসে পিঠ চাপড়ে দিল। এত প্রশংসা পাবে আশা করেনি ও।

ফলাফল ঘোষনার পালা এল। শিক্ষক আকাশের নাম ঘোষনা করলেন। প্রথম হয়েছে সে। পুরস্কারের এক গাদা বই তার হাতে তুলে দিলেন।

বইগুলো ধরে আছে হাতে, কিন্তু বিস্ময়ের ঘোর যেন কাটছে না। এতগুলো বই তার? প্রথম হওয়া বলে নয়, এক সংগে এতগুলো বই পাওয়া তার জীবনে এই প্রথম।

কিন্তু রজনী এখনো বাকির মতো বিস্ময়ের তখনো কিছু বাকি ছিল। অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি উঠে দাঁড়িয়ে যখন বই কেনার জন্য তাকে আরও দু’হাজার টাকা পুরস্কার দিলেন, তখন সে বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে গেল! বললেন, গল্পটি তার খুবই ভালো লেগেছে। যেন তার নিজেরই ছেলেবেলার গল্প এটা। তিনি অবশ্য দ্বিতীয় এবং তৃতীয় বিজয়ীকেও পুরস্কৃত করলেন। আকাশ বাবার দিকে তাকাল। বাবা মৃদু হাসছেন। আকাশ যে এ রকম একটা গল্প লিখে ফেলবে তিনি তা ভাবতেও পারেননি।

বাবার কাছে শোনা, বাবারই ছেলেবেলার গল্প লিখে সে এতগুলো বই আর দু’হাজার টাকা পুরস্কার পেল। বাবা দিবসে এর চেয়ে আনন্দের আর কী আছে?


লেখক পরিচিতি
চন্দন মণ্ডল
জন্ম ১৯৬৫। অভয়নগর যশোর।
গল্পকার।
প্রকাশিত গল্পের বই : বাবার কাছে গল্প শোনা। 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ