দিলওয়ার হাসান
সকাল ন’টার ঢাকা। বোশেখের ফুরফুরে মিষ্টি সকাল। মাত্র ক’দিন আগেই বোশেখ এসেছে। দাবদাহ কেটে স্বস্তির শাওয়ার নেমেছে গতকাল। ঝকঝক করছে চারদিক।
এয়ারপোর্টের দিকে যেতে ডানপাশে বিশাল আলমগীর টাওয়ার। গ্রাউন্ড ফ্লোরে ঢোকার মুখে ছোট্ট একটা ফুলের তোরণ হয়ত আপনাদের চোখে পড়েছিল। ওটা বানানো হয়েছিল ‘হ্যাভেনলি লাভ গ্রুপ অব কোম্পানি’র দশম বর্ষপূর্তি উপলক্ষে। কোম্পানির চেয়ারম্যান সম্পদ কিশোর রোজারিও নিজে ডিরেকশন দিয়ে তোরণটি বানিয়েছিলেন। অন্য ফুলের সঙ্গে বারো জাতের গোলাপ ছিল। গোলাপের সুবাসে মৌ মৌ করছিল চারদিক।
সেদিন রাস্তায় জানজট ছিল না মোটেও- ট্রাফিক মুভমেন্টে তাই ছিল চাঞ্চল্য। হ্যাভেনলি লাভ গ্রুপের দফতর তিন তলায়। সিঁড়িগুলো লাল গালিচায় মোড়ানো হয়েছিল। আয়োজন দেখে মনে হয়েছিল রাজা-বাদশাদের পা পড়বে তাদের দফতরে। সকাল থেকে সাজ সাজ রব। মি. রোজারিওর নির্দেশনায় দফতর সাজান হয়েছিল কাচা ফুল দিয়ে। ওখানে ছিল বেলির জয়জয়কার। নারী কর্মকর্তাদের খোঁপাতেও ছিল বেলির সমারোহ। তাঁরা পড়েছিল বাসন্তী রঙের শাড়ি আর লাল ব্লাউজ। ছেলেরা পড়েছিল পিংক শার্ট আর কালো প্যান্ট- স্মার্ট ক্যাজুয়েল।
কর্মকর্তা কর্মচারীরা সকালের নাশতা করেছিল দফতরে বসে। মেন্যুতে ছিল পরোটা, সবজি, মুরগির মাংস, বাকরখানি, রসগোল্লা আর লেমন টি। লাঞ্চও হবে অফিসের তত্ত্বাবধানে- পাঁচ রকমের মাছ, তিন রকমের মাংস, সবজির নানা পদ। ডেজার্টে আইসক্রিম, মিষ্টি দই আর হরেক রকমের দেশি ফল। বিকেলে সিলেকটেড গেস্টদের উপস্থিতিতে টি পার্টি। বুফেতে কুড়ি পদের আইটেমের আয়োজন- খাবার আসবে পাঁচতারা হোটেল ইস্ট ইন থেকে।
সকাল তখন ১০টা। সাউন্ড বক্সে নিচু স্বরে বাজছে রবীন্দ্রনাথের গান। মোহন সিং, ইফফাত আরা, জয়তী, শ্রাবণী, অদিতি মহসীন, রেজওয়ানা বন্যা একের পর এক সবাই গাইছেন। ওটাও মি. রোজারিওর পরিকল্পনা। তিনি সঙ্গীত পাগল মানুষ। পূর্ব ও পশ্চিম, ভোকাল ও ইনস্ট্রুমেন্টাল সব সঙ্গীতেই তার অপার আগ্রহ ও সমঝদারি।
তখন সিঁড়িতে মৃদু পায়ের শব্দ। তারপর ঝুম ঝুম, ঝুম ঝুম ঝুম। হৈ হৈ করে গেটের সামনে এসে দাঁড়িয়েছিল ওরা করতালি দিয়ে। একেবারে পেইন্ট করা, নাচের পোশাকে হাজির। কোথাও পারফর্ম করে এসেছিল কি? অফিস অ্যাটেনডেন্ট মকবুল ছিল না। কাজে বাইরে গিয়েছিল। না হলে ওরা মকবুলের সঙ্গে খানিকটা খুনসুটি করত- অ্যাই মকবুল বাই আমাগো সবিতা রানীরে বিবাহ করবা? মকবুল হয়ত বলত- দুরদুর কী সব খারাপ কতা। সবিতারে আমি ক্যান বিয়া করুম, আমার বউ আচে না? ওপাশ থেকে হয়ত সবিতা চেঁচিয়ে উঠত, মকবুইলার লাহান বাটুল ব্যাটারে আমি বিয়া করতাম না, ছাড়ান দেও চে, ...’
সেদিন ওসব কিছুই হলো না। চারপাশে তখন হিজড়া আর হিজড়া। ছোট, বেঁটে, নাদা-মোটা, রোগা, মেয়ে-ছেলে। কদিন আগে সিকিউরিটি গার্ড এসেছে নাথান অ্যান্ড কোম্পানি থেকে। টগবগে যুবক। স্মার্টও খুব। সে চিৎকার করে উঠল, ‘খবরদার কেউ ভেতরে আসবে না। আজ আমাদের অফিসের প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী, ...’
ওদের মধ্যে যে সবচেয়ে লম্বা, ছিপছিপে, ফর্সা, কোকড়া চুল, চোখে মোটা কাজল, টুকটুকে ঠোঁট, কানে কানপাশা বলল, ‘তুমাগো অফিসের হাঙ্গা নাহি আইজ? তা আমাগো দাওয়াত দিলা না যে। আমরা কি মানুষ না?’
‘হ, তুমরা আবার মানুষ? তুমরা হইলা হিজড়া, হি হি হি হিজড়া। তুমাগো নুনু নাই, .... হো হো হো।’
এ কথা শুনে ছিপছিপে মেয়েটা চেঁচিয়ে উঠল, ‘হ, আমরা হিজড়া। তর মায়ের হাঙ্গা দেখছি আমি। বেশি কতা কবি না। পাঁচশ ট্যাকা দিবার ক তগো মালিকেরে।’
‘পাঁচশ? ট্যাকা তো গাবাইচে।’
‘ওই মাঙ্গির পুলা তরে যা কইলাম তা-ই কর।’ হুকুম জারি করে সে।
সিকিউরিটি অফিসার আব্দুল হক ছুটে আসেন।
‘এ্যাই এতো গোলমাল কিসের? পাঁচশ টাকা চাইছ কেন? আমরা তো প্রতি মাসে তোমাদের দুইশ দেই। তোমাদের শেফালি কোথায়? সে-ই আসে প্রতি মাসে, ...’
‘শেফালি নাই। আমার নাম রূপালী। পাঁচশ চাইচি, পাঁচশই দিবি। নাইলে মুইতা তগো অফিস ভাসাইয়া দিমু।’
‘বললেই হলো? মগের মুল্লুক পেয়েছ? বেশি তেড়িবেড়ি করলে পুলিশ ডাকব কিন্তু।’
‘পুলিশ ক্যান? তগো বাপগো ডাক না। পুলিশের ডর দেখাস আমাগো? হ্যারা চিনে আমাগো, আমরাও তাগো। কী বুঝলি?’
আবদুল হককে ধাক্কা মেরে পাঁচটা তাগড়া শরীর অফিসের ভেতর ঢুকে পড়ল। ঝুম ঝুম, ঝুম ঝুম ঝুম।
কারা ওরা? পোশাকি নাম হেরমাফ্রোডাইট। আরও নাম আছে- ইউনাখ, ক্লীব, কীমপুরুষ, বৃহন্নলা। ইমাসকুলেশনের মাধ্যমে এদের অনেকেরই বীর্য হরণ করা হয়েছে হয়ত। ফলে খোজা হয়ে গেছে। সবাই এক রকম ভয় পায় ওদের, আবার মস্করা করতেও ছাড়ে না সুযোগ পেলে। ভ্রুকুটি করে ওদের দিকে তাকায়, হাসাহাসি করে। কী করে ওরা? কখনো হোমাসেক্সুয়াল প্রস। আবার কোনো সময় হারমোনিয়াম গলায় ঝুলিয়ে গান গায়। কারও বাড়িতে ছেলে-সন্তান হলে নর্তন কুর্তন করে টাকা আদায় করে। নতুন দালান উঠলে তার বালাই দুর করতে ডাক পড়ে ওদের। ভিক্ষে করে, চাঁদা তোলে। নারকেলের মালা বুকে বেঁধে মেয়ে সাজে। শাড়ি পরে ঘুরে বেড়ায়। পান খেয়ে ঠোঁট লাল করে। বিড়ি-সিগ্রেট খায়।
ওদের সবার পায়ে সেদিন নূপুর ছিল। ওদের লিডার রূপালী চিৎকার করে ওঠে, ‘তগো বড় সাব কোথায়? হালার পুরে জিগামু আমাগোর ট্যাকা দিতাছে না ক্যান।’
হঠাৎ সমবেত হাততালির শব্দ- ছট ছট, ছট ছট ছট।
অফিসের নারী স্টাফরা ভয়ে ও লজ্জায় জড়োসড়ো। ঝড়ের বেগে মি. রোজারিওর চেম্বারের দিকে ছুটে যায়। তিনি ওদের শান্ত করার চেষ্টা নেন। সিকিউরিটির লোক ডাকেন। বলেন, ‘তোমাদের লিডার যে সে ছাড়া আর সবাই বাইরে যাও। এমন অসভ্যতা করছ কেন? প্রতি মাসেই তো আসো তোমরা, কখনোই খালি হাতে ফিরিয়ে দিই না।’
‘ধানাই পানাই কতা রাখেন সাহেব, অক্ষণই ট্যাকা ভাও করেন।’ একজনও বাইরে যায় না, ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থাকে। মি. রোজারিও ধৈর্য ধারণের চেষ্টা করেন। লিডারের দিকে তাকান। দীর্ঘ এক হারা শরীর। ধবধবে ফরসা রং। ডিম্বাকৃতি মুখের গড়ন। হাল ফ্যাশনের ব্লাউজ গায়, লাল টকটকে শাড়ি পড়েছে, ফলে ঘরের ভেতর কৃঞ্চচূড়ার খেলা। কণ্ঠস্বরের পুরুষালি কথা বাদ দিলে একে পক্ক যুবতী বলা যায়। তীক্ষ্ম চোখে মি. রোজারিওর দিকে তাকিয়ে থাকে। বলে, ‘হুনলাম আপনেগো অফিসের হাঙ্গা আইজ । তা আমাগো ডাকলেই তো পারতেন, নাচ-গানে ভাসাইয়া দিতাম। আমাগো নাচ-গান ভালো লাগে না? দেহেন না একটা, ...’
সে মুদ্রা তোলে। চারজন পেছন থেকে গান ধরে। ঝুম ঝুম, ঝুম ঝুম ঝুম:
বন্দি বাবা এক দন্তা নাদা পেট হরি।
সকল হিজড়ার বাপ জগৎ প্রহরী।।
না দিয়াছ যোনী মোরে লিঙ্গহীন ফুটা।
কত ফুটে গন্ধ পুষ্প সব লাগে ঝুটা।।
মাগী-মদ্দ জানোয়ার খায়দায় নাচে।
আমাদের নাচ থাকে তাহাদের পাছ...
মাগীরে সাজায় মদ্দ ফলে ফুলে ধূপে।
কে সাজায় আমাদের দেখে চুপে চুপে।।
তুমি বাপ্প শুঁড়পতি জগৎ জীবন।
সকল দিয়াছ সুখ বিছানার মন।।
.... ঝুম ঝুম, ঝুম ঝুম ঝুম।
মি. রোজারিও ক্রমাগত বিব্রত হতে থাকেন। আব্দুল হককে ডেকে বলেন, ‘টাকা দিয়ে শিগগির বিদায় করো ওদের।’
‘পাঁচশ টাকা চায় স্যার। আমরা বরাবর দুশো দেই।’
‘বাদ দাও হক, পাঁচশই দিয়ে দাও। আপদ বিদেয় কর। আমাদের এমন একটা শুভ দিনে ...।’
‘কী বলেন স্যার। আস্কারা পেয়ে যাবে। মাথায় চড়ে বসবে। পরের মাসে এক হাজার টাকা দাবি করবে। এদের চেনেন না স্যার। ধাড়ি পাজি একেকটা।’
সব কথা কান পেতে শোনে রূপালী। হকের দিকে তেড়ে যায়, ‘কী কইলি হারামজাদা, আমরা ধাড়ি পাজি? পাজি আমরা না, তুরা, তগো বাপ-মা, তগো চোদ্দ গুষ্টি, ....।’
মি. রোজারিওর বিরক্তি চরমে ওঠে। ধৈর্যের বাধ ভেঙে যেতে চায়। বলেন, ‘তোমরা আমাদের সঙ্গে এ রকম করছ কেন? আমরা তো সব সময়ই তোমাদের প্রতি সহানুভূতিশীল। দেশের সবাই আজ তোমাদের নিয়ে ভাবছে। এই তো সেদিন কাগজে পড়ছিলাম- ইন অ্যা ল্যান্ডমার্ক ডিসিশন, দ্য গভর্নমেন্ট অব বাংলাদেশ হ্যাজ অ্যাপপ্রুভড অ্যা প্রপোজাল অব দ্যা সোস্যাল ওয়েলফেয়ার মিনিস্ট্রি টু আইডেনটিফাই হিজড়া অ্যাজ অ্যা থার্ড পসিবল জেন্ডার আইডেনটিটি... তোমরা তো এখন পাসপোর্টও পাবে। তোমাদের নেত্রী আমিনা সুলতানা সিতুকে আমি চিনি। সেদিন দেখা হয়েছিল ইস্ট ইন হোটেলে একটা সেমিনারে, আমরা তোমাদের ...।’
মি. রোজারিওর কথা শেষ না হতেই হক বলে ওঠে, ‘ওদের এসব কথা বলে লাভ নেই স্যার। ওদের মতো খারাপ এলিমেন্ট সোসাইটিতে আর খুঁজে পাবেন না। নরকের কীট, নরকের কীট। সমাজটাকে একেবারে কলুষিত করে ফেলছে।’
মি. রোজারিও হককে নিবৃত্ত করতে চাইলেন, ‘এ সব এখন রাখ হক, টাকা দিয়ে দাও, চলে যাক ওরা। অ্যাই কত চাও তোমরা, আমি দিচ্ছি, ...’
‘আমি আপনেগো ট্যাকায় মুতি।’ রূপালী হুঙ্কার দিয়ে ওঠে। নিজের ব্লাউজটা পট পট করে খুলে ফেলে চোখের নিমেষে। তুলো কিংবা নারকেলের মালা নেই। ছোট একটা কালো ব্রেসিয়ার বেরিয়ে আসে, তার নিচে কিশোরীদের মতো ছোট স্তন। পেটিকোট উঠিয়ে প্রশ্রাব করার ভঙ্গিতে বসে পড়ে। নিম্নাঙ্গ যুবতী মেয়েদের মতো। মি. রোজারিও চোখ বন্ধ করে ফেলেন। কানে ভেসে আসে নারীদের ধারা বর্ষণের শোঁ শোঁ শব্দ। তিনি দু’হাতে কান চেপে ধরেন। তারপর চিৎকার করে ওঠেন, ‘এ তুমি কী করলে হক? কী লজ্জা। কী লজ্জা, ....।’
নীল কার্পেট ততক্ষণে ভিজে কাই। মোবাইল ফোনে পুলিশে খবর দিচ্ছে হক।
দশটি পা ত্রস্তে দরজার দিকে এগিয়ে যায়- ঝুম ঝুম, ঝুম ঝুম ঝুম। মি. রোজারিও তখনও চোখ বুজে আছেন। তার কানে ভেসে আসে এক হিজড়ার ফ্যাসফেসে কণ্ঠের ক্রন্দনের স্বর- জগন্নাথ হে, আর জনমে ছাইলা কইরো হে। ... জগন্নাথ হে আর জনমে মাইয়া কইরো হে। ... জনম ঘুরাইয়া লাও হে, হাত লাও পা লাও, মুন্ডু লাও হে।...
কী বীভৎস সেই কান্না! অসহনীয়। এ কি কোনো প্রেতলোকের দৃশ্য না কিন্নর উপত্যকার নাটভূম থেকে ভেসে আসছে ওই কান্নার শব্দ, কে জানে? ০
লেখক পরিচিতি
দিলওয়ার হাসান
গল্পকার। অনুবাদক।
সকাল ন’টার ঢাকা। বোশেখের ফুরফুরে মিষ্টি সকাল। মাত্র ক’দিন আগেই বোশেখ এসেছে। দাবদাহ কেটে স্বস্তির শাওয়ার নেমেছে গতকাল। ঝকঝক করছে চারদিক।
এয়ারপোর্টের দিকে যেতে ডানপাশে বিশাল আলমগীর টাওয়ার। গ্রাউন্ড ফ্লোরে ঢোকার মুখে ছোট্ট একটা ফুলের তোরণ হয়ত আপনাদের চোখে পড়েছিল। ওটা বানানো হয়েছিল ‘হ্যাভেনলি লাভ গ্রুপ অব কোম্পানি’র দশম বর্ষপূর্তি উপলক্ষে। কোম্পানির চেয়ারম্যান সম্পদ কিশোর রোজারিও নিজে ডিরেকশন দিয়ে তোরণটি বানিয়েছিলেন। অন্য ফুলের সঙ্গে বারো জাতের গোলাপ ছিল। গোলাপের সুবাসে মৌ মৌ করছিল চারদিক।
সেদিন রাস্তায় জানজট ছিল না মোটেও- ট্রাফিক মুভমেন্টে তাই ছিল চাঞ্চল্য। হ্যাভেনলি লাভ গ্রুপের দফতর তিন তলায়। সিঁড়িগুলো লাল গালিচায় মোড়ানো হয়েছিল। আয়োজন দেখে মনে হয়েছিল রাজা-বাদশাদের পা পড়বে তাদের দফতরে। সকাল থেকে সাজ সাজ রব। মি. রোজারিওর নির্দেশনায় দফতর সাজান হয়েছিল কাচা ফুল দিয়ে। ওখানে ছিল বেলির জয়জয়কার। নারী কর্মকর্তাদের খোঁপাতেও ছিল বেলির সমারোহ। তাঁরা পড়েছিল বাসন্তী রঙের শাড়ি আর লাল ব্লাউজ। ছেলেরা পড়েছিল পিংক শার্ট আর কালো প্যান্ট- স্মার্ট ক্যাজুয়েল।
কর্মকর্তা কর্মচারীরা সকালের নাশতা করেছিল দফতরে বসে। মেন্যুতে ছিল পরোটা, সবজি, মুরগির মাংস, বাকরখানি, রসগোল্লা আর লেমন টি। লাঞ্চও হবে অফিসের তত্ত্বাবধানে- পাঁচ রকমের মাছ, তিন রকমের মাংস, সবজির নানা পদ। ডেজার্টে আইসক্রিম, মিষ্টি দই আর হরেক রকমের দেশি ফল। বিকেলে সিলেকটেড গেস্টদের উপস্থিতিতে টি পার্টি। বুফেতে কুড়ি পদের আইটেমের আয়োজন- খাবার আসবে পাঁচতারা হোটেল ইস্ট ইন থেকে।
সকাল তখন ১০টা। সাউন্ড বক্সে নিচু স্বরে বাজছে রবীন্দ্রনাথের গান। মোহন সিং, ইফফাত আরা, জয়তী, শ্রাবণী, অদিতি মহসীন, রেজওয়ানা বন্যা একের পর এক সবাই গাইছেন। ওটাও মি. রোজারিওর পরিকল্পনা। তিনি সঙ্গীত পাগল মানুষ। পূর্ব ও পশ্চিম, ভোকাল ও ইনস্ট্রুমেন্টাল সব সঙ্গীতেই তার অপার আগ্রহ ও সমঝদারি।
তখন সিঁড়িতে মৃদু পায়ের শব্দ। তারপর ঝুম ঝুম, ঝুম ঝুম ঝুম। হৈ হৈ করে গেটের সামনে এসে দাঁড়িয়েছিল ওরা করতালি দিয়ে। একেবারে পেইন্ট করা, নাচের পোশাকে হাজির। কোথাও পারফর্ম করে এসেছিল কি? অফিস অ্যাটেনডেন্ট মকবুল ছিল না। কাজে বাইরে গিয়েছিল। না হলে ওরা মকবুলের সঙ্গে খানিকটা খুনসুটি করত- অ্যাই মকবুল বাই আমাগো সবিতা রানীরে বিবাহ করবা? মকবুল হয়ত বলত- দুরদুর কী সব খারাপ কতা। সবিতারে আমি ক্যান বিয়া করুম, আমার বউ আচে না? ওপাশ থেকে হয়ত সবিতা চেঁচিয়ে উঠত, মকবুইলার লাহান বাটুল ব্যাটারে আমি বিয়া করতাম না, ছাড়ান দেও চে, ...’
সেদিন ওসব কিছুই হলো না। চারপাশে তখন হিজড়া আর হিজড়া। ছোট, বেঁটে, নাদা-মোটা, রোগা, মেয়ে-ছেলে। কদিন আগে সিকিউরিটি গার্ড এসেছে নাথান অ্যান্ড কোম্পানি থেকে। টগবগে যুবক। স্মার্টও খুব। সে চিৎকার করে উঠল, ‘খবরদার কেউ ভেতরে আসবে না। আজ আমাদের অফিসের প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী, ...’
ওদের মধ্যে যে সবচেয়ে লম্বা, ছিপছিপে, ফর্সা, কোকড়া চুল, চোখে মোটা কাজল, টুকটুকে ঠোঁট, কানে কানপাশা বলল, ‘তুমাগো অফিসের হাঙ্গা নাহি আইজ? তা আমাগো দাওয়াত দিলা না যে। আমরা কি মানুষ না?’
‘হ, তুমরা আবার মানুষ? তুমরা হইলা হিজড়া, হি হি হি হিজড়া। তুমাগো নুনু নাই, .... হো হো হো।’
এ কথা শুনে ছিপছিপে মেয়েটা চেঁচিয়ে উঠল, ‘হ, আমরা হিজড়া। তর মায়ের হাঙ্গা দেখছি আমি। বেশি কতা কবি না। পাঁচশ ট্যাকা দিবার ক তগো মালিকেরে।’
‘পাঁচশ? ট্যাকা তো গাবাইচে।’
‘ওই মাঙ্গির পুলা তরে যা কইলাম তা-ই কর।’ হুকুম জারি করে সে।
সিকিউরিটি অফিসার আব্দুল হক ছুটে আসেন।
‘এ্যাই এতো গোলমাল কিসের? পাঁচশ টাকা চাইছ কেন? আমরা তো প্রতি মাসে তোমাদের দুইশ দেই। তোমাদের শেফালি কোথায়? সে-ই আসে প্রতি মাসে, ...’
‘শেফালি নাই। আমার নাম রূপালী। পাঁচশ চাইচি, পাঁচশই দিবি। নাইলে মুইতা তগো অফিস ভাসাইয়া দিমু।’
‘বললেই হলো? মগের মুল্লুক পেয়েছ? বেশি তেড়িবেড়ি করলে পুলিশ ডাকব কিন্তু।’
‘পুলিশ ক্যান? তগো বাপগো ডাক না। পুলিশের ডর দেখাস আমাগো? হ্যারা চিনে আমাগো, আমরাও তাগো। কী বুঝলি?’
আবদুল হককে ধাক্কা মেরে পাঁচটা তাগড়া শরীর অফিসের ভেতর ঢুকে পড়ল। ঝুম ঝুম, ঝুম ঝুম ঝুম।
কারা ওরা? পোশাকি নাম হেরমাফ্রোডাইট। আরও নাম আছে- ইউনাখ, ক্লীব, কীমপুরুষ, বৃহন্নলা। ইমাসকুলেশনের মাধ্যমে এদের অনেকেরই বীর্য হরণ করা হয়েছে হয়ত। ফলে খোজা হয়ে গেছে। সবাই এক রকম ভয় পায় ওদের, আবার মস্করা করতেও ছাড়ে না সুযোগ পেলে। ভ্রুকুটি করে ওদের দিকে তাকায়, হাসাহাসি করে। কী করে ওরা? কখনো হোমাসেক্সুয়াল প্রস। আবার কোনো সময় হারমোনিয়াম গলায় ঝুলিয়ে গান গায়। কারও বাড়িতে ছেলে-সন্তান হলে নর্তন কুর্তন করে টাকা আদায় করে। নতুন দালান উঠলে তার বালাই দুর করতে ডাক পড়ে ওদের। ভিক্ষে করে, চাঁদা তোলে। নারকেলের মালা বুকে বেঁধে মেয়ে সাজে। শাড়ি পরে ঘুরে বেড়ায়। পান খেয়ে ঠোঁট লাল করে। বিড়ি-সিগ্রেট খায়।
ওদের সবার পায়ে সেদিন নূপুর ছিল। ওদের লিডার রূপালী চিৎকার করে ওঠে, ‘তগো বড় সাব কোথায়? হালার পুরে জিগামু আমাগোর ট্যাকা দিতাছে না ক্যান।’
হঠাৎ সমবেত হাততালির শব্দ- ছট ছট, ছট ছট ছট।
অফিসের নারী স্টাফরা ভয়ে ও লজ্জায় জড়োসড়ো। ঝড়ের বেগে মি. রোজারিওর চেম্বারের দিকে ছুটে যায়। তিনি ওদের শান্ত করার চেষ্টা নেন। সিকিউরিটির লোক ডাকেন। বলেন, ‘তোমাদের লিডার যে সে ছাড়া আর সবাই বাইরে যাও। এমন অসভ্যতা করছ কেন? প্রতি মাসেই তো আসো তোমরা, কখনোই খালি হাতে ফিরিয়ে দিই না।’
‘ধানাই পানাই কতা রাখেন সাহেব, অক্ষণই ট্যাকা ভাও করেন।’ একজনও বাইরে যায় না, ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থাকে। মি. রোজারিও ধৈর্য ধারণের চেষ্টা করেন। লিডারের দিকে তাকান। দীর্ঘ এক হারা শরীর। ধবধবে ফরসা রং। ডিম্বাকৃতি মুখের গড়ন। হাল ফ্যাশনের ব্লাউজ গায়, লাল টকটকে শাড়ি পড়েছে, ফলে ঘরের ভেতর কৃঞ্চচূড়ার খেলা। কণ্ঠস্বরের পুরুষালি কথা বাদ দিলে একে পক্ক যুবতী বলা যায়। তীক্ষ্ম চোখে মি. রোজারিওর দিকে তাকিয়ে থাকে। বলে, ‘হুনলাম আপনেগো অফিসের হাঙ্গা আইজ । তা আমাগো ডাকলেই তো পারতেন, নাচ-গানে ভাসাইয়া দিতাম। আমাগো নাচ-গান ভালো লাগে না? দেহেন না একটা, ...’
সে মুদ্রা তোলে। চারজন পেছন থেকে গান ধরে। ঝুম ঝুম, ঝুম ঝুম ঝুম:
বন্দি বাবা এক দন্তা নাদা পেট হরি।
সকল হিজড়ার বাপ জগৎ প্রহরী।।
না দিয়াছ যোনী মোরে লিঙ্গহীন ফুটা।
কত ফুটে গন্ধ পুষ্প সব লাগে ঝুটা।।
মাগী-মদ্দ জানোয়ার খায়দায় নাচে।
আমাদের নাচ থাকে তাহাদের পাছ...
মাগীরে সাজায় মদ্দ ফলে ফুলে ধূপে।
কে সাজায় আমাদের দেখে চুপে চুপে।।
তুমি বাপ্প শুঁড়পতি জগৎ জীবন।
সকল দিয়াছ সুখ বিছানার মন।।
.... ঝুম ঝুম, ঝুম ঝুম ঝুম।
মি. রোজারিও ক্রমাগত বিব্রত হতে থাকেন। আব্দুল হককে ডেকে বলেন, ‘টাকা দিয়ে শিগগির বিদায় করো ওদের।’
‘পাঁচশ টাকা চায় স্যার। আমরা বরাবর দুশো দেই।’
‘বাদ দাও হক, পাঁচশই দিয়ে দাও। আপদ বিদেয় কর। আমাদের এমন একটা শুভ দিনে ...।’
‘কী বলেন স্যার। আস্কারা পেয়ে যাবে। মাথায় চড়ে বসবে। পরের মাসে এক হাজার টাকা দাবি করবে। এদের চেনেন না স্যার। ধাড়ি পাজি একেকটা।’
সব কথা কান পেতে শোনে রূপালী। হকের দিকে তেড়ে যায়, ‘কী কইলি হারামজাদা, আমরা ধাড়ি পাজি? পাজি আমরা না, তুরা, তগো বাপ-মা, তগো চোদ্দ গুষ্টি, ....।’
মি. রোজারিওর বিরক্তি চরমে ওঠে। ধৈর্যের বাধ ভেঙে যেতে চায়। বলেন, ‘তোমরা আমাদের সঙ্গে এ রকম করছ কেন? আমরা তো সব সময়ই তোমাদের প্রতি সহানুভূতিশীল। দেশের সবাই আজ তোমাদের নিয়ে ভাবছে। এই তো সেদিন কাগজে পড়ছিলাম- ইন অ্যা ল্যান্ডমার্ক ডিসিশন, দ্য গভর্নমেন্ট অব বাংলাদেশ হ্যাজ অ্যাপপ্রুভড অ্যা প্রপোজাল অব দ্যা সোস্যাল ওয়েলফেয়ার মিনিস্ট্রি টু আইডেনটিফাই হিজড়া অ্যাজ অ্যা থার্ড পসিবল জেন্ডার আইডেনটিটি... তোমরা তো এখন পাসপোর্টও পাবে। তোমাদের নেত্রী আমিনা সুলতানা সিতুকে আমি চিনি। সেদিন দেখা হয়েছিল ইস্ট ইন হোটেলে একটা সেমিনারে, আমরা তোমাদের ...।’
মি. রোজারিওর কথা শেষ না হতেই হক বলে ওঠে, ‘ওদের এসব কথা বলে লাভ নেই স্যার। ওদের মতো খারাপ এলিমেন্ট সোসাইটিতে আর খুঁজে পাবেন না। নরকের কীট, নরকের কীট। সমাজটাকে একেবারে কলুষিত করে ফেলছে।’
মি. রোজারিও হককে নিবৃত্ত করতে চাইলেন, ‘এ সব এখন রাখ হক, টাকা দিয়ে দাও, চলে যাক ওরা। অ্যাই কত চাও তোমরা, আমি দিচ্ছি, ...’
‘আমি আপনেগো ট্যাকায় মুতি।’ রূপালী হুঙ্কার দিয়ে ওঠে। নিজের ব্লাউজটা পট পট করে খুলে ফেলে চোখের নিমেষে। তুলো কিংবা নারকেলের মালা নেই। ছোট একটা কালো ব্রেসিয়ার বেরিয়ে আসে, তার নিচে কিশোরীদের মতো ছোট স্তন। পেটিকোট উঠিয়ে প্রশ্রাব করার ভঙ্গিতে বসে পড়ে। নিম্নাঙ্গ যুবতী মেয়েদের মতো। মি. রোজারিও চোখ বন্ধ করে ফেলেন। কানে ভেসে আসে নারীদের ধারা বর্ষণের শোঁ শোঁ শব্দ। তিনি দু’হাতে কান চেপে ধরেন। তারপর চিৎকার করে ওঠেন, ‘এ তুমি কী করলে হক? কী লজ্জা। কী লজ্জা, ....।’
নীল কার্পেট ততক্ষণে ভিজে কাই। মোবাইল ফোনে পুলিশে খবর দিচ্ছে হক।
দশটি পা ত্রস্তে দরজার দিকে এগিয়ে যায়- ঝুম ঝুম, ঝুম ঝুম ঝুম। মি. রোজারিও তখনও চোখ বুজে আছেন। তার কানে ভেসে আসে এক হিজড়ার ফ্যাসফেসে কণ্ঠের ক্রন্দনের স্বর- জগন্নাথ হে, আর জনমে ছাইলা কইরো হে। ... জগন্নাথ হে আর জনমে মাইয়া কইরো হে। ... জনম ঘুরাইয়া লাও হে, হাত লাও পা লাও, মুন্ডু লাও হে।...
কী বীভৎস সেই কান্না! অসহনীয়। এ কি কোনো প্রেতলোকের দৃশ্য না কিন্নর উপত্যকার নাটভূম থেকে ভেসে আসছে ওই কান্নার শব্দ, কে জানে? ০
লেখক পরিচিতি
দিলওয়ার হাসান
গল্পকার। অনুবাদক।
জন্মসাল – ১৯৫৭, জন্মস্থান – মানিকগঞ্জ, বর্তমান আবাসস্থল – ঢাকা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে অনার্স সহ এম.এ। স্কুল জীবন থেকে লেখালিখি ও সাংবাদিকতা শুরু। কর্মজীবন শুরু ১৯৮১ সালে দৈনিক সংবাদের সহ সম্পাদক হিসেবে । বর্তমান পেশা - বেসরকারি চাকরি ও লেখালেখি। গল্প, প্রবন্ধ, ভ্রমণ কাহিনি, অনুবাদ।
প্রথম আলো, আলোকিত বাংলাদেশ, কালি ও কলম, উত্তরাধিকার, শব্দঘর ও অনলাইন পত্রিকা নিয়মিত লেখেন।
প্রকাশিত গ্রন্থ – অন্য দেশের গল্প, (অনুবাদ গল্প সংকলন), টু উইমেন, (অনুবাদ উপন্যাস), আদম এবং ইভের গল্প(ছোট গল্প), সর্ট স্টোরিজ, আইজ্যাক সিঙ্গার (অনুবাদ গল্প সংকলন), ওস্তাদ নাজাকাত আলি কর্নেলকে একটা চিঠি লিখেছিলেন (ছোট গল্প), হারুকি মুরাকামির শ্রেষ্ঠ গল্প (অনুবাদ গল্প)
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে অনার্স সহ এম.এ। স্কুল জীবন থেকে লেখালিখি ও সাংবাদিকতা শুরু। কর্মজীবন শুরু ১৯৮১ সালে দৈনিক সংবাদের সহ সম্পাদক হিসেবে । বর্তমান পেশা - বেসরকারি চাকরি ও লেখালেখি। গল্প, প্রবন্ধ, ভ্রমণ কাহিনি, অনুবাদ।
প্রথম আলো, আলোকিত বাংলাদেশ, কালি ও কলম, উত্তরাধিকার, শব্দঘর ও অনলাইন পত্রিকা নিয়মিত লেখেন।
প্রকাশিত গ্রন্থ – অন্য দেশের গল্প, (অনুবাদ গল্প সংকলন), টু উইমেন, (অনুবাদ উপন্যাস), আদম এবং ইভের গল্প(ছোট গল্প), সর্ট স্টোরিজ, আইজ্যাক সিঙ্গার (অনুবাদ গল্প সংকলন), ওস্তাদ নাজাকাত আলি কর্নেলকে একটা চিঠি লিখেছিলেন (ছোট গল্প), হারুকি মুরাকামির শ্রেষ্ঠ গল্প (অনুবাদ গল্প)
1 মন্তব্যসমূহ
দারুন
উত্তরমুছুন