শামিম আহমেদের গল্প : কুরবানি


অন্ধকারে ঠিক ভাল করে ঠাহর করা গেল না ছায়ামূর্তিটিকে। রাতের একটা নির্দিষ্ট সময়ে সে এই পথ দিয়ে যায়। প্রায় প্রতিদিনই হিরু ভাবে, মূর্তিটির পিছু নেবে, কিন্তু তার সাহসে কুলোয় না। তার উপর দিন কয়েক আগে শুনেছে, গাছের শুকনো ডাল ভাঙতে গিয়ে লাবলুর বউয়ের তিন-তিনটে দাঁত উপড়ে নিয়ে গেছে জ্বিনে। ভাগ্য ভাল যে, জানে শেষ করে দেয়নি। এ মতো অবস্থায় হিরু যদি বেশি পাকামি করতে যায়, তার ফল যে সুখকর হবে না, এটা ভাল মতোই টের পায় সে। তার উপর আশ্বিনের এই সময়টা ভাল নয়, সবে দুর্গাপূজা শেষ হয়েছে, দিন দুই পরেই কুরবানি; এই সময়ে নিজের জান কুরবান করতে ক জন মানুষ চায়! কিন্তু ছায়ামূর্তিটি তাকে এত টানে কেন! তার দিকে যেন বার বার ইশারা করে বলে, আয় আয়! আমার সঙ্গে চল। তোকে আমি নিয়ে যাব সেই পাহাড়ে যেখানে হজরত ইব্রাহিম নিয়ে গিয়েছিলেন তার কিশোর পুত্র ইসমাইলকে।

মৌলবির কাছে হিরু শুনেছে, কেন ইসমাইলকে নিয়ে গিয়েছিলেন ওই নবি। এই তো গত জুম্মায় মৌলবি সাহেব বললেন, সে প্রায় হাজার চারেক বছর আগেকার কথা। মক্কা তখন ছিল পাথুরে শুষ্ক একটা জায়গা। মানুষের বসবাসের অযোগ্য। আল্লাহতালা হজরত ইব্রাহিমকে বললেন, ওহে ইব্রাহিম! যাও, তুমি তোমার বিবি হাজেরা আর ব্যাটা ইসমাইলকে এখানে নিয়ে এসো। নবি খোদার আদেশে ফিলিস্তাইন থেকে বিবি-বাচ্চাকে আনলেন এবং তাঁদেরপ্রচুর খাদ্য আর পানি দিয়ে সেখানে রেখে চলে গেলেন। কয়েক দিনের মধ্যে সব খাবার আর পানি শেষ হয়ে গেল। বিবি হাজেরা আর শিশুপুত্র ইসমাইল খাদ্য আর পানির অভাবে মরিয়া হয়ে উঠলেন। সাফা পাহাড় থেকে মারওয়া পর্বত পর্যন্ত সাত বার ছুটে গেলেন বিবি হাজেরা। কিন্তু কোথাও পানি পেলেন না। আল্লাহর কী শান, শিশুপুত্র ইসমাইলের পায়ের আঘাতে সেখানে একটি কূপ তৈরি হয়ে গেল। পানির ফোয়ারা বেরিয়ে এল সেখান থেকে। সেই পানির মতো মিষ্ট আর বরকতওয়ালা পানি এই দুনিয়ায় আর নেই। সকলে বলেন, সুভানাল্লাহ।

সবার সঙ্গে হিরুও সুভানাল্লাহ বলেছিল। তখন সে জানত না, এই শিশুকেই তার বাপ কুরাবানি দিতে যাবেন আল্লাহতালার আদেশে। হিরুর বাপ নেই। সেই ছোটবেলায় মারা গিয়েছে। কিন্তু হিরুর মনে একটা আবছায়া মূর্তি আছে তার বাপজানের। বাপকে সে খোয়াবে দেখেছে বহু বার। প্রায় প্রতিটি খোয়াবে তিনি যেন পালটে পালটে যান বার বার। কিন্তু জেগে থাকা অবস্থায় হিরুর মনে যে ছবিটা ভেসে আসে সে অনেকটা ওই ছায়ামূর্তির মতো। তার বাপ তাকে রাতের এই সময়টাতে ডাকেন কেন! সে রাতে ভাত খাওয়ার পরে বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে যখন সেদিনের শেষ বিড়িটা ধরায়, তখন ধোঁয়া বেরোতে না বেরোতে কী রকম একটা কুণ্ডলী পাকিয়ে ওই মূর্তিটার আবির্ভাব ঘটে। মাকে বলবে বলে ভেবেছিল, কিন্তু নিজের মনেই ঠিক করল, কী দরকার এর মধ্যে মাকে জড়িয়ে! ভালোই তো হচ্ছে, এ ভাবে বাপ তাকে রোজ দেখা দিয়ে যাচ্ছেন; এ তো বেশ আনন্দের ব্যাপার। 

কিন্তু ধোঁয়ার কুণ্ডলীটা তাকে কুরবানি দিতে চায় কেন! মৃত মানুষের কাছে কি খোদাতালার আদেশ আসে!আর তার বাপ তো নবি নয় যে তাঁর কাছে আদেশ-ফাদেশ আসবে! গাঁ-গেরামের খেটে খাওয়া একটা মানুষ, হঠাৎ তিন-চার দিন জ্বরে ভুগে পগার পার হয়ে গেছে। একটা ওষুধ অব্দি জোটেনি, আর সেই মৃত মানুষের মরণের পর এমন কি লেজ না ছুরি গজালো যে সে নিজের ব্যাটাকে কুরবানি দেওয়ার জন্য রোজ রাতে এসে হানা দেয়! মৌলবির কথা হিরুর কানে পুনরায় ভেসে আসে।

তার পর একদিন ইব্রাহিম নবির কাছে আদেশ আসে, হে ইব্রাহিম! তোমার সবচেয়ে প্রিয় জিনিস আমাকে উৎসর্গ করো। নবি একের পর এক পশু কুরবানি দিলেন; কিন্তু খোদাতালা বললেন, তুমি সবচেয়ে ভালবাসো এমন জিনিস কুরবানি দাও। ইব্রাহিম নবি ভাবলেন, কী তাঁর প্রিয় জিনিস! সে তো তাঁর নয়নের মণি ব্যাটা ইসমাইল। এ কী ভাবে সম্ভব! কিন্তু তিনি আল্লাহ-র বান্দা, তাই পুত্রকে নিয়ে চললেন এক পর্বতের দিকে। পুত্র পিতাকে বললেন, আব্বাজান! আপনি চক্ষু বন্ধন করুন তার পর আমাকে জবাই করুন। পিতৃস্নেহে অন্ধ পিতা সেভাবেই ছুরি চালালেন পুত্রের গলে, কিন্তু চোখের বাঁধন খুলে দেখেন, সেই জায়গায় কুরবানি হয়েছে একটি দুম্বা, আরব দেশের ভেড়া। পাশে পুত্র ইসমাইল দাঁড়িয়ে আছেন। বলেন সুভানাল্লাহ। হিরু এ বারে সবার সঙ্গে তাল মিলিয়ে সুভানাল্লাহ বলতে ভুলে গেল।

হিরুর ছোট্ট এক ফালি জমি আছে। তাতে সে নানা ধরনের সবজি চাষ করে। এতে যে তার সম্বৎসরের খোরাকি হয় তা নয়। তবে এই সবজি চাষের ফলে তার বাড়িতে কোনও দিন হাট বা বাজার থেকে সবজি কিনে আনতে হয়নি। আর সে অন্যের ধানের জমিতে দিনমজুরি খাটে। গ্রামে কাজ না থাকলে দখিনে, বালি-বেলুড়ে গিয়ে ইটভাটায় কাজ করে। এ ভাবেই তাদের দিন চলে যায়। তারা বলতে সে আর তার মা। এখনো সে বিয়ে করেনি। গ্রামে তার বয়সী কোনও ছেলেই আইবুড়ো নেই। সে কেন এখনো বিয়ে করেনি তা সে নিজেও জানে না। তবে বিয়ে করবে না, এমন কোনও পণ সে করেনি।

কুরবানির ঠিক দু দিন আগে বাপের মতো সেই ছায়ামূর্তিটি এক বার এসেই ক্ষান্ত হল না। রাত একটু গভীর হলে সে দ্বিতীয় বার হিরুকে বলে গেল, নিজে যদি কুরবানি হতে না চাস তো তোর সবচেয়ে প্রিয় জিনিস আমার উদ্দেশ্যে দান কর। আমি মরে গিয়েও ভাল নেই রে বাপজান!

কিন্তু হিরু কী দিতে পারে তার বাপ-জাতীয় ওই মুর্তিটাকে! কী তার প্রিয় জিনিস! বিড়ি! ধুর! বিড়ি কি ওই ধোঁয়াটে লোকটা পছন্দ করবে! তবে কী! তার একটা পিরহান আছে! খুব সুন্দর! লিলুয়ায় স্টেশনের পাশে যে হাট বসে সেখান থেকে কিনেছিল। জিনিসটা পুরনো হলে কী হবে, অত্যন্ত দামি জিনিস। মাত্র এক শো টাকায় কিনেছিল সে, তার পর একটি মেয়ের হাত ধরে ওই পিরহান পরে গঙ্গার লীলুয়া বাতাসে হেঁটেছিল। মেয়েটির সঙ্গে হাত ধরে সে শুধুই হেঁটেছিল, সেই মেয়েও ইটভাঁটায় কাজ করত। পরে আর কোনও দিন তার সঙ্গে দেখা হয়নি, কিন্তু ওই পিরহান পরলেই নীলা না লীলা কী যেন নাম মেয়েটার তার কথা মনে পড়ে যায় আর পিরহানটা যেন আরও লীলাময় হয়ে ওঠে। আজ সে ওই পিরহানটাই পরে আছে। সে ছায়ামূর্তিটাকে বলে বসল, তুমি আমার পিরহানটা গায়ে দিবা বাপ! এটাকেই যদি আমি কুরবানি দিই, তুমি কি খুশি হবা বাপ?

ছায়ামূর্তিটা যেন রাগে ফেটে পড়ল কিম্বা অট্টহাসিতে দুমড়ে গেল। আর তার পিরহান থেকে বেরোতে লাগল লাল নীল গোলাপী সব কবুতর। ছায়ামূর্তি এ বার খুব খুশি, সে বলে উঠল এই তো! একটা কবুতর আমাকে দে। হিরু বল, এ কবুতর আমার নয়! আমার জমিতে ফসল ফলেছে, কুমড়ো হয়েছে অনেক। তোমাকে আমি কুমড়ো দেব। নেবে বাপজান!

ছায়ামূর্তি রেগে গিয়ে বলল, কুমড়ো কেউ কুরবানি দেয় না বাপ! তবে দুটো পা-অলা জন্তুও কুরবানি দেওয়া নিষেধ। তুমি আমাকে চতুষ্পদ কোনও পশু দাও। কুকুর-বেড়াল হলে চলবে না, দামি পশু চাই। আমি তার মেদ-চর্বির আঘ্রাণে আপ্লুত হব।মনে নেই, হজরত আদমের দুই ছেলে কাবিল আর হাবিল। তাঁদের উপর আদেশ হল, কুরবানি দাও। তখন কুরবানির মাল পাহাড়ের নীচে রেখে আসার নিয়ম ছিল। কাবিল চাষবাস করতেন, তিনি তাঁর জমির ফসল রেখে এলেন; আর হাবিল পশুপালন করতেন, তিনি রেখে এলেন একটি পশু। খোদাতালা হাবিলের কুরবানি কবুল করলেন, কাবিলের নয়। এতে করেই বুঝতে হবে, পশু উৎসর্গ করাই নিয়ম, নইলে যে বাপ ধর্ম পালন হয় না! আগেকার দিনে রাজারা ঘোড়া জবাই করে তার বুকের চর্বি আগুনে পুড়িয়ে ঘ্রাণ নিত আর তাতেই তাদের অনেক নেকি হত রে বাপ! তাকে অশ্বমেধ যজ্ঞ বলে। তুই আমার উদ্দেশ্যে একটা জায়েজ পশু কুরবানি দে, নইলে তোর কপালে মরণ নাচবে। তোমাকেই আমি কুরবানি দেব ব্যাটা। যে রকম সোমক রাজা তার ব্যাটা জন্তুকে বলি দিয়েছিল। 

হিরু একটু মুষড়ে পড়ল। ভেবেছিল, কুমড়ো দিয়ে সে তার কাজ চালিয়ে নেবে। অনেক হিন্দু-বাড়িতে পাঁঠা বলি না দিয়ে কুমড়ো বলি দেওয়ার রেওয়াজ আছে। চতুষ্পদ প্রাণী কেনার সামর্থ্য তার নেই। উপরন্তু হাতে আছে মাত্র একটা দিন। সকাল হলে সিদ্ধান্ত নেবে, এ কথা ভেবে ঘুমোতে গেল হিরু। কিন্তু ঘুম আর আসতেই চায় না।


নিজের এক ফালি জমি বন্ধক রেখে হিরু পশু কিনতে গেল। গ্রামের এক ফাঁকা জায়গায় হাট থেকে অনেক পশু কিনে রাখা হয়েছে। যারা হাটে যেতে পারে না, তারা একটু বেশি দাম দিয়ে এখান থেকেই কুরবানির গরু কেনে। কিন্তু সেখানে পৌঁছে হিরু পড়ল মহা মুশকিলে। সারি-সারি অনেক চতুষ্পদ পশু, তাদের অনেক দাম। তার উপর আজকেই কুরবানির পশু কেনার শেষ দিন। সে একের পর পশু দেখতে লাগল। সাদা-কালো-বিচিত্রবর্ণের কত পশু। আগামী কাল তাদের লাল রক্তে ভেসে যাবে কত উঠোন আর লোকের বাহির বাড়ি। তার পর সেই সব মাংস-রান্নার উৎসব চলবে বিকেল-সাঁঝ পর্যন্ত। হিরুর পকেটে যা টাকা আছে তাতে তাকে রোগাভোগা কোনও পশু কিনতে হবে। তার উপর সে শুনেছে, কুরবানির পশুকে নিখুঁত হতে হবে। যদি জেনেশুনে কেউ খুঁতওয়ালা পশু জবাই করে, তা হলে তার কুরবানি মঞ্জুর হবে না।সারি-সারি বাঁধা পশুগুলোকে সে দেখতে লাগল। কারো শিং ভাঙা, কেউ বা একটু খুঁড়িয়ে হাঁটে। আর প্রত্যেকটি পশুকেই মনে হয় অনাহারে ক্লিষ্ট। সে কী করবে, বুঝে উঠতে পারে না। অবশেষে তার পছন্দ হল একটি বলদ। বেশ তরতাজা। কিন্তু তার মনে খটকা লাগল, এই পশুও তো খুঁতঅলা—কারণ তার কাটান দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ, এই বলদ ঠিক পুরুষ গরু নয়; আবার সে গাভী বা বকনাও নয়। তাহলে! হিরু বলদের দাম জিজ্ঞাসা না করেই চলে আসে বাড়ি। খামোখা পয়সা করে খুঁতঅলা জন্তু কিনে কী হবে! অবশ্য চাষের জন্য কিনলে এই বলদই তাকে কিনতে হত, ষাঁড় দিয়ে হালচাষ হয় না, তারা এতটাই বেয়াড়া যে লাঙল টানা বা গাড়ি বয়ে নিয়ে যাওয়া তাদের ধাতে সয় না। ষাঁড় সব সময় গাভী খোঁজে, কাম ছাড়া তাদের অন্য কাজ নেই। হিরু হাঁটতে লাগল। লাবলু দোকানির বাড়ির পাশ দিয়ে সে হাঁটছে। একটা গাছ, তার নীচ দিয়ে যেতে যেতে তার গা ছমছম করতে লাগল। এই সেই গাছ, যার শুকনো ডাল ভাঙতে গিয়ে লাবলুর বউয়ের তিন-তিনটে দাঁত উপড়ে নিয়ে গেছে জ্বিনে। ভাগ্য ভাল যে, জানে শেষ করে দেয়নি। তবে কি সে জ্বিনের শরণাপন্ন হবে! মৌলবি সাহেবের কাছে সে শুনেছে, মানুষ তৈরির আগে খোদাতালা জ্বিন বানিয়েছিলেন। আগুন থেকে বানানো সেই জ্বিনেরা নিজেদের মধ্যে দাঙ্গা-ফ্যাসাদ বাধিয়ে আল্লাহতালার না-ফরমানি করল। আগুনের মতো তাদের উদ্ধত স্বভাব। আল্লাহতালা তাদের ধ্বংস করার জন্য ফেরেশতা পাঠালেন। সেই ফেরেশতারা যাকে সামনে পেল তাকেই হত্যা করল। কেউ কেউ পালিয়ে বাঁচল।খোদার ফেরেশতারা একটি জ্বিন-শিশুকে হত্যা করতে পারল না। বড় মায়া হল ওই সুন্দর শিশুটিকে দেখে। তারা তাকে কোলে নিয়ে বেহেশতে চলে গেল। সেই শিশুর নাম ইবলিশ। সে ফেরেশতাদের মতো আল্লাহ-র ইবাদত-বন্দেগি করতে লাগল। হাজার হাজার হাজার বছর কাটার পর সে হল ফেরেশতাদের নেতা। ফেরেশতারা নুরের তৈরি, কিন্তু ইবলিশ আগুনের সৃষ্টি। তাই যখন আদমকে বানানো হল, তখন ফেরেশতারা খোদার হুকুমে তাঁকে সেজদা করলেও ইবলিশ করল না। সে বলল, আগুনের গতি উর্ধ্বমুখী আর মাটি থাকে নীচে। আমি খোদার আদেশ মানব না। ইবলিশকে তাড়িয়ে দেওয়া হল বেহেশত থেকে। কিন্তু আল্লাহ-র নির্দেশে সে বেঁচে থাকবে কেয়ামতের দিন পর্যন্ত। ইবলিশ ভাবল, আদমের জন্য তার এই দুর্দশা। তাই সে ঠিক করল, আদম ও তার বংশধর মানুষকে ছেড়ে কথা বলবে না। তাদের কুপথে নিয়ে যাবে। হজরত আদমের ঔরসে মা হাওয়ার গর্ভে প্রথম জন্মায় যমজ সন্তান—তাদের একটি ছেলে, নাম তার কাবিল; অন্যটি মেয়ে, আকলিমা। তার পর হল হাবিল আর লিমুজা। হাবিলের সঙ্গে আকলিমার আর কাবিলের সঙ্গে লিমুজার বিয়ে ঠিক হল। কাবিল তাতে রাজি নয়। সে তার গর্ভবোন আকলিমাকে বিয়ে করতে চায় কারণ আকলিমা লিমুজার চেয়ে সুন্দরী। কিন্তু পিতা তাতে সম্মত নন। তার উপর খোদাতালা কাবিলের কুরবানি কবুল না করে হাবিলের পক্ষ নিলেন। আকলিমার সঙ্গে হাবিলের বিয়েও হল। কাবিলের মনে প্রচণ্ড রাগ আর ক্ষোভ বাসা বাঁধল। সে হাবিলকে হত্যার পরিকল্পনা করতে লাগল। কিন্তু কী ভাবে খুন করতে হয়, সে জানে না। এ দিকে ইবলিশ কাবিলকে বেশ পছন্দ করে ফেলেছে। কি সুন্দর, উদ্ধত আর বদমেজাজি এই মানুষ। আবার সে পরস্ত্রীর প্রতি জুলজুল করে চেয়ে থাকে। এই না হলে ছেলে! হে কাবিল, তোমাকে দেখিয়ে দেব, কুরবানি কাকে বলে! কাকে বলে হত্যা, কী করে করতে হয় খুন! এই দেখো।

ইবলিশ কাবিলের সামনে নিরীহ মানুষের রূপ নিয়ে আবির্ভূত হল। তার এক হাতে একটি মোরগ, অন্য হাতে পাথর। হঠাৎ সে মোরগের মাথায় বসিয়ে দিল পাথরের আঘাত। ছটফট করতে করতে মারা গেল মোরগটি। কাবিল বুঝে নিল, এই ভাবে খুন করতে হয়। সেও হাবিলকে একই কায়দায় খুন করে কাকের কাছে কবর দেওয়ার নিয়ম শিখে ভাইকে গোরস্ত করে ইয়েমেনের দিকে পালিয়ে গেল! সেখানে সে বাস করতে লাগল একা, একদম খাঁ খাঁ শূন্যতায়। তার সঙ্গী শুধু ইবলিশ। সে আরও খুন করতে চায়। খুনের নেশা তাকে পেয়ে বসেছে। তার চাই প্রাণ। প্রাণীরক্তের ধারা বয়ে দিতে চায় এই শুকনো মাটিতে।



গাছের পাতার মধ্যে কী যেন একটা নড়ে উঠল। আগুনের মতো কি একটা দেখা যাচ্ছে! হিরু উপরের দিকে তাকিয়ে দেখল, গাছ থেকে এক আগুন-রঙা লোক নেমে এল। তার হাতে ছুরি। এ মতো অবস্থায় হিরু যদি বেশি পাকামি করতে যায়, তার ফল যে সুখকর হবে না, এটা ভাল মতোই টের পায় সে। তার উপর আশ্বিনের এই সময়টা ভাল নয়, সবে দুর্গাপূজা শেষ হয়েছে;এক দিন পরেই কুরবানি, এই সময়ে নিজের জান কুরবান করতে ক জন মানুষ চায়! কিন্তু আগুন-রঙা লোকটা তাকে এত টানে কেন! তার দিকে যেন বার বার ইশারা করে বলে, আয় আয়! আমার সঙ্গে চল। তোকে আমি নিয়ে যাব সেই পাহাড়ে যেখানে হজরত ইব্রাহিম নিয়ে গিয়েছিলেন তার কিশোর পুত্র ইসমাইলকে। এই লোকটা কি তাকেই ইসমাইল বানাতে চায়! না, না, হিরু ইসমাইল হতে চায় না। তিনি ছিলেন খোদার অনুগ্রহের পাত্র, হিরু হল গরিব-গুরবো মানুষ; তার গলায় ছুরি চালালে কোনও গায়েবি দুম্বা বা ছাগল নেমে এসে তাকে বাঁচাবে না, তা সে ভাল করেই জানে। অতএব এখান থেকে পালিয়ে যাওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ। হাত-পা যে চলে না! হিরু মন্ত্রমুগ্ধের মতো লোকটাকে অনুসরণ করতে লাগল।

একটি পাহাড়ের নীচে হিরুকে নিয়ে গেল আগুন-রঙা লোকটি। হিরু কিছুই চিনতে পারছে না। এই লোকটি কি তবে ইবলিশ! সে কেন তাকে কুরবানি দিতে চায়! হিরুর চোখ বাঁধা হল। বড় কষ্ট, তার মায়ের কথা মনে পড়ছে। বেচারি মা, বাপ তো কবেই তাকে ছেড়ে চলে গিয়েছে। অবশ্য বাপের আর কি দোষ! সব খোদার হুকুম। কিন্তু সে না থাকলে তার মায়ের কি হবে! আর এই লোকটি তাকে কুরবানি দেবেই বা কেন! একজন মানুষ হয়ে আর এক মানুষের গলায় ছুরি চালানো কি খুব গর্বের ব্যাপার! হিরুর ইচ্ছে করছে দৌড়ে পালাতে, কিন্তু তার হাত-পা সব অসাড়। ইবলিশ তাকে এ কি জাদু করল! 

রে হিরু! মানুষের বদলে দুম্বা কুরবানি হয়েছিল এক সময়ে, খোদার আদেশে। আজ পশুর বদলে মানুষ হত্যা করা হবে, আমার আদেশে। আমি ইবলিশ, পশুদের দেবতা। আমিই নানা বেশ ধারণ করে নরবলি দিই সারা দুনিয়ায়। পশুদের খুন-ফোরাত বয়ে গেলে তোমাদের যেমন কোনও দুঃখ হয় না, তেমনি মানুষের রক্ত-গঙ্গা বয়ে গেলে আমার খুব আনন্দ হয়। তুমি প্রস্তুত হও।

গলাটা যেন চেনা-চেনা মনে হয় হিরুর। এ কি তার বাপের কন্ঠস্বর! কিন্তু আগুন-রঙা লোকটি তাকে বলছে, সে ইবলিশ। খোদাতালা মৃত্যুর পরে মানুষকে যে কী বানান, তা কি আর মূর্খ হিরু জানে! 

তার গলায় নেমে এল ছুরি, নাকি ইবলিশের লেজ! কন্ঠদেশে সেটি ঠেকানোর পরেও লোকটিকে বড় ভালবেসে ফেলল হিরু।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

1 মন্তব্যসমূহ

  1. ২ পর্বের শেষ দিকে আনেকটা মুসলিম ধর্মের কাহিনী বলা হয়েছে। কিছুটা দরকার ছিল গল্পের অনুসঙ্গে, তবুও ছোটগল্পের একমুখীনতা কিছুটা নষ্ট হয়েছে বলে মনে হচ্ছে। এই লেখকের আরো ভালো লেখা পড়েছি।

    উত্তরমুছুন