কৌশিক বাজারী'র গল্প : হাওয়া মানুষ

সুতনু এই গঞ্জ-শহরে নতুন । নতুন মানে প্রায় বছর তিনেক হল এই নতুন গড়ে ওঠা গঞ্জশহরের বাসিন্দা সে। সতনু যখন খুব ছোট ছিল বা তারপরে যখন ইস্কুল-কলেজে পড়েছে, তখন বাসে এই পথে যাওয়া আসার সময় দেখেছে –শহর বলে কিছু নেই । একটাই শীর্ণরাস্তা, একটা সামান্য জনবসতি এফোঁড় –ওফোঁড় করে চলে গেছে পূব থেকে পশ্চিমের দিকে। রাস্তা মাঝে মাঝে বেঁকেছে, মাঝে মাঝে গ্রাম, বাস স্টপেজ, একটা শিরিশগাছের নিচে খড়ের ছাউনি দেওয়া চা-দোকান, দুজন লোক কাঁধে গামছা ফেলে চা খাচ্ছে, দুপাশে কোথাও খরায় জ্বলে যাওয়া মাঠ, কোথাও পুরন্দর নামে ছোট্ট শীর্ণ খালের উপর প্রাচীন সেতু। পথের ধারে ধারে পথ অন্ধকার করে কৃষ্ণচুড়া আর প্রাচীন শিরিশের ছাদ। মধ্যদুপুরে রাস্তার উপর ডালপালার ফাঁক দিয়ে গোল গোল আলোর বল লাফিয়ে বেড়াচ্ছে।


একটা ভাঙাচোরা খোয়া ওঠা রাস্তা ক্রমে কেমন করে চার-লেনের চওড়া ঝকঝকে এক রাস্তা হয়ে উঠলো, সে সতনুর চোখের উপর দেখা। দুপাশের অজস্র প্রাচীন গাছ কেটে ফেলে আকাশ ফাঁকা করে ধুলো উড়লো কত। কত নাম না জানা বিশালাকার কাঁকড়া বিছের মতো যন্ত্র সেই সব গাছেদের শবদেহ তুলে নিয়ে গেল। ভিটে মাটি উপড়ে ফেলা গভীর ক্ষতগুলো ভারী পাথরে ভরে ফেলল আরেক বিষম, গম্ভীর-ধীর অথচ নিশ্চিত এক যন্ত্র এসে, সে সব ঘটনাও পুরনো হয়ে গেল। এখন এই গঞ্জ শহরের মাঝখান দিয়ে মসৃণ ঝকঝকে রাস্তা। রাস্তায় কোথাও কোনো বাঁক নেই, সারা দিনরাত গতিশীল বহুচক্র ট্রাকগুলি ছুটে যায়। সতনু ভাবে এরা কোথায় যায়? কোথা থেকে বা আসে ? যখন রাস্তাটি ছিলো না তখন এদের দ্রুত ছুটে চলাগুলি কোথায় ছিল ?

নতুন গজিয়ে ওঠা জনবসতির যেমন কোনো নিজস্ব রূপ থাকেনা, অর্জুনপুরেরও তেমন কোনো স্বরূপ নেই এখনো। নতুন জনবসতির বেশীর ভাগই ফেরো-এ্যলয় কারখানার শ্রমিকের বাস। এইসব কারখানায় যে পদার্থ তেরী হয় তার নাম হাইকার্বন ফেরোক্রম। সে কি বস্তু সতনু জানে না। একবার এক বন্ধু তাকে এই নাম বলেছিল, সেটা মনে রয়ে গেছে। ওটা ইস্পাত তৈরীতে কাজে লাগে। এইসব সস্তার কারখানা থেকে সেই পদার্থ চলে যায় দুর্গাপুর বার্ণপুরের কারখানায়। আর অর্জুনপুর ধুসর ছায়ের আস্তরনে ঢাকা পড়ে যায়। আগে বছরে দুবার চাষ হতো, বর্ষায় জল জমে কাদা হত হেথা হোথা, সেইসব জমি কারখানার বর্জে চাপা পড়ে থাকে। কুৎসিত কালো ধুসর বর্জ।

অর্জুনপুর আসলে এখনও এক গ্রাম্য গঞ্জ ভিতরে ভিতরে। বড়রাস্তা থেকে উত্তর ও দক্ষিণ দুই দিকে দুটো গ্রামীন রাস্তা চলে গেছে ভেতরের দিকে। এই রাস্তাগুলিও পাকা। সম্প্রতি লালমাটি ঢেকে পিচ পড়েছে প্রধানমন্ত্রী সড়ক যোজনার। সেই রাস্তা চলে গেছে ভেতরের গভীর সুদূর গ্রামগুলির দিকে। উত্তরে দ্বারকেশ্বর নদ পেরিয়ে নদী পারের গ্রামগুলির দিকে । আর দক্ষিণে ঘন শালের জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে আরো আরো গভীর জঙ্গুলে গ্রামগুলির দিকে। মাঝখানে এই অর্জুনপুরগ্রাম, ফেরো-এ্যলয়ের ধুসরতা মেখে অধুনা সে শহর সেজেছে।

সুতনু বিকেলে তার তিন বছরের ছেলেকে নিয়ে বেড়াতে বেরিয়ে উল্টো দিকে হাঁটে, যে রাস্তা জঙ্গলের দিকে গেছে। যেদিকে সব্জি ক্ষেতের সবুজ দিগন্ত রয়ে গেছে এখনো। এক এক দিন ফিরতে ফিরতে সন্ধে হয়ে যায়। নামহীন শীর্ণ একটা সোঁতা এদিকে বয়ে গেছে। একলাফে পার হওয়া যায়, লোকে বলে খালপার। গ্রামের রাস্তায় সেই সোঁতার উপর একটা ছোটো পুল। সেখানে সতনু তার ছেলকে নিয়ে দাঁড়ায়। খুব সরু ক্ষীণ একটা জলের ধারা এই শীত শেষে বয়ে যাচ্ছে পুলের নিচ দিয়ে। সতনু ছেলেকে দেখায়। ছেলে চোখ গোল গোল করে অস্তসুর্যের আলোয় ক্ষীণ স্বল্পায়ু ‘নদী’টিকে দেখে, শরতের কাশ গুলো এখন দুপাশে মৃত ও ধুসর হয়ে আছে। সতনুর ছেলে বলে—‘বাবা এটাই কি সেই আমাদের ছোটো নদী ? ‘সুতনু হাসে, বলে—‘না রে টাবু, এটা তার চেয়েও আরো ছোটো নদী, এত ছোটো নদীর কথা কেউ জানে না...’। টাবু জিঞ্জাসে—‘বাবা, এই নদীর নাম কি ?’ —‘তাই তো, এই নদীর তো কেউ নাম দেয় নি রে এখনো, তুই তাহলে একটা নাম দে বরং...’। সতনু মনে মনে ভাবে টাবু যখন বড় হয়ে উঠবে, তখনো কি এই মেঠো খাল থাকবে এখানে ? নাকি হারিয়ে যাবে ।

এমন সময়, সূর্য তখন অস্তমিত, খানিক দূরে লোকটাকে দেখা যায়। এই অদ্ভুত লোকটাকে সতনু প্রায় দেখে থাকে। অর্জুনপুরের রাস্তায় আনমনে হাঁটছে, সব্জি বাজারে একটা মহুল গাছের নিচে দাঁড়িয়ে আছে, পঞ্চায়েত অফিসের বারান্দায় ভিড়ের মধ্যে একা, সব জায়গায় তাকে দেখা যায়। একটা আধময়লা সাদা পাজামা, একটা নীল হাফশার্ট গায়ে, কাঁধে একটা পুরনো গামছা, মুখে না কামানো দাড়ি, উদাসীন বোকা বোকা একটা লোক। কারো সাথে কথা বলেনা, কেউ তার সাথে কথা বলে না, একটা অপ্রয়োজনীয় মানুষের মতো সে ঘুরে বেড়ায় সারা গঞ্জ জুড়ে, অথচ পাগল টাগল নয় সে। সেই লোক, উবু হয়ে বসে আছে। যেখানে খালটা বেঁকেছে, সেখানে একটা ঝোপের পাশে তার নীল শার্ট আবছা দেখা যায় । দুপাশে দিগন্ত অবদি খাঁ-খাঁ ফসল কেটে নেওয়া ক্ষেত। অবাক অন্যমনস্ক সুতনু টাবুর হাত ধরে বাড়ির দিকে ফেরে।

সকালটা সুতনুর ব্যাস্ততার মধ্যে কাটে। টাবুকে স্কুলের জন্য তৈরী করা, স্নান করানো। সে সদ্য নতুন ইস্কুলে ভর্তি হয়েছে। টাবুর মায়ের ইস্কুল একটু দূরে, দ্বারকেশ্বরের কাছে একটা হাইস্কুলে তার মা পড়ায়। টাবু আর তার মাকে স্কুটারে চড়িয়ে পৌঁছে দেয় সুতনু। তারপর তার ছুটি, যতক্ষণ না দুপুরে টাবু বাড়ি ফিরছে। এই সময়টা সুতনুর একার।

বৌকে ইস্কুলে পৌঁছে ফেরার পথে রেলওয়ে-ক্রসিং পেরিয়ে সুতনু তার স্কুটার একটা গাছের ছায়ায় দাঁড় করায়। একটা সিগারেট ধরিয়ে গাছের শেকড়ের উপরে বসে। সামনেই অর্জুনপুর রেলস্টেশন। এই ফাঁকা স্টেশনটি সুতনুর খুব প্রিয় জায়গা। ছোট্ট স্টেশনে সারাদিনে কয়েকটা ট্রেন দাঁড়ায়। কয়েকটা মালগাড়ি যায়। এখন এগারোটা বাজে। গোমো প্যাসেঞ্জারের সময় হল। কিছু মানুষ প্লাটফর্মের ধারে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে। সাধারণ গ্রাম্য মানুষ সব। তাদের রংচঙে শাড়ি, প্লাস্টিকের ব্যাগ হাতে কেউ একজন নতুন বৌ, স্বামীটি পাশে অপ্রস্তুত। সপ্রতিভ ঝালমুড়িওয়ালা। সুতনু দেখে সেই নীলশার্ট পরা লোকটা। প্লাটফর্মের একেবারে প্রান্তে দাঁড়িয়ে উপরের দিকে মুখ তুলে দাঁড়িয়ে আছে। কি দেখছে ও? সুতনু ওর দৃষ্টিপথের দিকে চায়—দূরে কারখানার চিমনি থেকে ধোঁয়া উড়ছে...। সুতনু কি এক আকর্ষণে ধীর পায়ে উঠে দাঁড়িয়ে হাঁটতে থাকে। লাইন পেরিয়ে প্লাটফর্মের উপর লাফ দিয়ে ওঠে। দূরে একেবারে শেষ মাথায় লোকটাকে দেখতে পায়। পায়ে পায়ে তার পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। লোকটা শূন্যদৃষ্টিতে একবার চায়। মুখ ফিরিয়ে উল্টো দিকে চেয়ে থাকে। সুতনু পকেট থেকে সিগারেট বার করে লোকটার দিকে বাড়িয়ে ধরে। লোকটা মুখ তুলে মৃদু হেসে বলে—‘ছাই উড়ছে, ছাই’ এই ব’লে সে প্লাটফর্মের মোরামের উপর হাঁটতে থাকে। সুতনু চেয়ে থাকে , ভাবে—কী ছাই, কোথায় ? বোকার মতো চেয়ে থাকে লোকটার চলে যাওয়ার দিকে, বাড়ানো সিগারেটটা নিজের ঠোঁটে চেপে ধরে দেশলাই জ্বালায়। এমন সময় ঘটনাটা ঘটলো। লোকটা প্লাটফর্ম থেকে একটা ছোট লাফ দিয়ে নেমে লাইন ধরে হাঁটতে থাকে স্টেশনের অন্য প্রান্তের দিকে। আর প্লাটফর্মের উপর মানুষের হালকা ভিড় নড়ে চড়ে ওঠে। পিছন থেকে সহসা গোমো প্যাসেঞ্জার একটা ভোঁ বাজিয়ে স্টেশনে ঢোকে। সামনেই লাইনের উপর উদাসীন নীল শার্ট পরা লোকটা । ইষৎ টলতে টলতে হাঁটছে। মানুষের ব্যাস্ত চলাফেরায় সে আড়াল হয়ে যায়। আর গোমো প্যাসেঞ্জারের ইঞ্জিন গমগম শব্দে ঝাঁপিয়ে পড়ে। লোকটাকে আর দেখতে পায় না সুতনু। চাপা পড়লো নাকি! কৈ, কোনো হৈ হৈ রব তো নেই? তাহলে অন্য পাশের লাইনে সরে গেছে নিশ্চয় । সুতনু উতলা হয়ে ওঠে, অথচ কৈ, আর কেউ তো কিছুই দেখছে না ! মিনিট দুই থেমে থাকার পর ট্রেনটা দুলে উঠে ছেড়ে দেয়, সুতনু অপেক্ষা করতে থাকে সমস্ত ট্রেনটা চলে যাওয়া অবদি।

ব্যাস্ততাহীন, ঢিমে তালের গোমো প্যাসেঞ্জার স্টেশন ছেড়ে চলে গেলে পুরো প্লাটফর্ম সুনসান হয়ে যায়। সুতনু অন্য পারে চায়, লোকটা কে দেখা যায় না। যে দু-একজন মানুষ ট্রেন থেকে নেমে ছিল তারা মাথায় বোঝা নিয়ে মাঠের পথে হাঁটা দিয়েছে। গাছতলার রিক্সো দুটোও সওয়ারী পেয়ে চলে গেছে। ফাঁকা জনহীন প্লাটফর্ম থেকে লাইনে নামে সুতনু। তখনি দেখতে পায় লোকটা কে আবার। প্লাটফর্ম ছাড়িয়ে পশ্চিমে অনেক দূরে লাইন ধরে হেঁটে চলেছে । একটা ফুটকির মতো তার নীল জামা দেখা যায়, এই লাইনেই তো, হ্যাঁ, এইমাত্র চলে গেছে গোমো প্যাসেঞ্জার! সুতনু দুটো লাইনের মধ্যিখানে দাঁড়িয়ে থাকে হতভম্ব। ট্রেনটা কি লোকটার শরীর ভেদ করে চলে গেল !

২.

শেখ সাজাহানের মুদিখানার দোকানটা জাতীয় সড়ক সম্প্রসারনের আওতায় চলে এল। সাজাহান সরকারী চিঠি পেয়েছে একখানা। চিঠি লিয়ে পঞ্চায়েত অফিসে গেছল। পধান বলে দিয়েচে এটা উয়াদের হাতের বাইরে, কিচ্ছু করার নাই, দোকানটা সরিয়ে লে জলদি, নাইলে কিছুই আদায় পাবি নাই। দোকান সরিয়ে লিয়ে কুথায় যাবেক, ভাবে সাজান। দক্ষিণে গাঁয়ের লালমাটির পথ ধরে খানিকটা এগুলেই জঙ্গল। সিখেনে অনেক জায়গা। উখেনে সরিয়ে লিয়ে যাবেক? উখেনে কে কিনবেক জিনিষ ? ভুতে ?

আকাশের দিকে পেশীবহুল কালো কালো হাতগুলো বাড়িয়ে ধরা বিশাল প্রাচীন শিরিশগাছগুলো কাটা শুরু হয়ে গেছে। আঁকা বাঁকা সরু রাস্তাটার উপর ডালপালার ছাদ ভেঙে পড়ছে মড়মড় শব্দে। ধূলো আর ধ্বংসস্তুপের উপর এসে পড়ছে তীব্র রোদ। সাজাহান ফাঁকা দোকানে বসে দেখে; বিশাল কাঁকড়া বিছার মতন যন্ত্রদানবগুলা সেই সব গাছেদের লাশ তুলে লিয়ে যাচ্চে। যে আশুদগাছটার তলায় পীরের মাজার ছিল সেটা আজ সকালে ভাঙা হল। মৌলবী সাহেব নিজে দাঁড়িয়ে থেকে দেখলেন সব। মৌলবী সাহেবের ছেলা মনিরুল পঞ্চায়েতের মেম্বর। আর সবার সাথে সেও দেশের উন্নয়নে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। সামনের ১২তারিখ মঙ্গলবার ওরা ডেট দিয়েছে। তার আগে দোকান সরিয়ে লিতে হবেক। কিন্তু সরিয়ে লিয়ে কুথায় যাবেক সাজান, এখনো ঠিক করতে পারে নাই। দোকানের লাগোয়া এক কুটরী মাটির ঘরে তার বিবি ফতেমা আর দু বছরের ছেলাটাকে লিয়ে সংসার। আর ত জায়গা নাই কুথাও যাবার। দোকানটা সাজানের বাপের ছিল, এই দোকান লাগোয়া কুটরিতেই সেও মানুষ হইচে। বাপের সঙ্গে খালপারে যেয়ে চান করে আইচে। পাঠশাল পালিয়ে বাপের মার খেইচে। আজ বাপ নাই। আশুদগাছটাও কেটে ফেলা হল। এখন ধূ-ধূ শুকনা রোদ। মাথার উপর কেউ নাই ।

সাজাহান তার অন্দর মহলের দিকে মুখ বাড়িয়ে বলে—অনেকদিন রসুলপুর যাওয়া হয়নি, বাপ মা কেমন আছে দেখবার মন চায় নাই তর ?

ফতেমা আকাশ থেকে পড়ে, হল কি মানুষটার, বাপের ঘর যাবার কথা বললেই মুখ গোঁজ করে যে লোক সে নিজে থেকে বাপের কাছে লিয়ে যেতে চায় ! সে মুখে কিছু বলে না। অন্দর থেকে একবার উঁকি মেরে খদ্দেরহীন ফাঁকা দোকানটা দেখে লেয় শুধু।

--কি গো কথা বলচু নি যে ?

মেঝেতে পাতা চাটায়ের উপর বসে ফতেমা কোলের বাচ্চাটাকে মায় দেয় চুপচাপ। ভাবে , কি উত্তর দিয়া যায়। বাপের কাছে যেতে মন চায়, কিন্তু এই অবস্থায় লোকটাকে ফেলে যেতে মন চায় নাই। দোকানঘর ভাঙা হবেক, সে শুনেছে, তারপর কি হবেক জানে নাই।

বহুদূরে রাস্তাটা যেখানে গিয়ে বেঁকেছে, সেখানে চৈত্রের ধূ-ধূ রোদ, অদৃশ্য গরম বাতাস ধোঁয়ার মতো ঝিলমিল করে উপরের দিকে উড়ে যায়,তার অস্তিত্ব জানান দেয়। সেদিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলে চোখে নেশা লাগে। সাজাহান সেইদিকে চেয়ে চুপ করে বসেছিল।

গতবছর এমন সময় পঞ্চায়েতের পধান শিবতোষ ভটচাজ্যি আর মনিরুল তার খোড়ো চালের দোকানে এসে বসেছিল। সাজাহান মনে মনে ভাবে শিবতোষ মনিরুলদের মুদির মালপত্ত আসে বাজারের ঘোষদের বড় দোকান থেকুন। ইখেনে তারা কুনুদিন মাল কিনে নাই। উয়াদের মাল আসে প্যকেট প্যাকেট, বস্তা বস্তা, সাইকেল ভ্যানে চড়ে । অদের একমাসের বাজার খরচায় সাজাহানের মতন পাঁচটা দোকান কিনা যায়। থাইলে কি কথা থাকতে পারে ইখেনে। শিবতোষ ভাঙা মোড়াটা টেনে বসে পড়ে। বলে—একটা কথা ছিল সাজান...। সাজাহান চুপ করে অপেক্ষা করে।

--লাইনধারের জমিতে কারখানা উঠচে, শুনেচু ত ?

সাজাহান শোনে চুপ করে।

--তর দোকানে বসে কত হয় রোজ ? পঞ্চাশ, একশ ?

সাজাহান বুঝতে পারেনা।

--কারখানায় কাজ করতে চাইলে আমাকে জানাবি, তর পাড়ার অনেকেই ত যাচ্চে। রোজ একশ পঁচিশ টাকা দিয়ে শুরু। লেবারের কাজ , খাটুনি আছে, টাকাও আছে,...

মনিরুল ফস করে একটা সিগরেট ধরায়, বলে—আমার সাথে চলে আসবি সোমবার সকালে, কথা পাকা করে লুব। তারপর শিবতোষের দিকে ঘুরে বলে—দাদা, সাজানের সামান্য জমি, ওতে কারখানাওয়ালাদের কতাটা লাভ হবেক কে জানে, তবু তুমি অদের একটু বলে রাইখবে। থাইলে সাজানের একটা গতি হয়। আমার পাড়ার ছেলা, বুজতেই পারচ...।

রেললাইনের ধারে সাজাহানের খানিকটা জমি পড়ে আছে। বছরে দুএকবার সবজি টবজি লাগায়। জমির ধারে একটা সরু খাল। গ্রীষ্মে শুকনা খাঁ খাঁ, বর্ষায় জল উপচে বয়ে যায়। তখন সেঁউতি দিয়ে জল ছেঁচে সাজাহান জমিতে জল পাওয়ায়। খালের জলে হাত পা ধুয়ে কুলকুচি করে সন্ধেবেলা ঘরে ফেরে। বছরের ফসল কিছু ঘরে খাওয়া হয়, কিছু বাজারের আড়তে দিয়ে কটা পয়সা পাওয়া যায়। তাতে সাজাহানের চলে যায়, আরো অনেকের মতো। সেই জমিটাই কারখানাওয়ালাদের হাতে দিতে বলচে শিবতোষ পধান। সাজাহান কি করবে ভেবে পায় না। বিপদে আপদে যাদের পরামর্শে সে চলে, তারাই তো পারামর্শ দিল, এতে ভালই হবেক তার । আর তাছাড়া সে একা লয়, তার মাত্র দেড় বিঘা, আরঅ অনেকেই তো জমি দিচ্চে। জমির টাকা পাওয়া যাবেক। সঙ্গে কাজ । আর ঐ জমি রেখে কটাই বা টাকা পাওয়া যায় বছরে।

সাজাহান জমিটা ছেড়ে দেয়। লেবারের কঠিন কাজ তার গতরে কুলায় নাই। কাজ ছেড়ে দেয়। দোকানটাই চালায় , যেমন চলছিল...।

ছেলেটা মায়ে মুখ দিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিল। ফতেমা কোলের থেকে নামিয়ে তাকে মাটিতে চাটাই এর উপর একপাশে শুয়িয়ে দেয়। সাজাহান দোকানের ঝাঁপ ফেলে ভেতরে আসে। চাটায়ের একপাশে বসে পড়ে ধপ করে। ফতেমা দুটো থালায় ভাত বেড়ে পাশে বসে। সাজাহানের খাওয়ায় মন নাই। ভাত নাড়াচাড়া করে আর কি যেন ভাবে ।

দুপুরে খাওয়া ধোয়ার পর ফতেমা একটু গড়িয়ে নেয় চাটায়ে। পাশে সাজাহান খড়ের চালের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ পাশ ফিরে ঘুমন্ত ফতেমা কে জড়িয়ে ধরে। ফতেমার চটক ভেঙে যায়। ভাবে কি হল লোকটার, হাঠাৎ দিনদুপুরে এমন আদর কেনে? সাজাহান ফতেমার শুকনো স্তনের ভিতরে মুখ ডুবিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে। আর তাদের মাথার উপর অন্ধকার খড়ের কাঠামোর উল্টোপিঠে তীব্র সূর্যরস্মি খেলা করে। বৃক্ষহীন ছায়াহীন সভ্যতার উপর, অনেক উপরে, ফতেমা-সাজাহানের চুম্বন ও ফুঁপিয়ে ওঠার অনেক উপরে, মেঘ ও ট্রপোস্ফিয়ার ছাড়িয়ে যেখানে অনন্ত শূন্যতা, সেখানে দিন রাতের তফাৎ নাই এমন অন্ধকার। সেই চির আঁধারের মাতৃজগৎ থেকে পৃথিবীতে যাবতীয় নির্দেশ আসে আর ঘটনা ও অঘটনা ঘটে...। সাজাহান বলে—ফতিমা, চল তোর বাপকে মাকে দেখে আসবি, আজ বিকালের বাসেই যাই, চল...।

সেদিন রাত্রে সবাই দেখে সাজাহানের মুদিখানা দাউদাউ করে জ্বলছে। তার কালো ধোঁয়া বৃক্ষহীন ফাঁকা ধূ-ধূ জাতীয় সড়কের আকাশ জুড়ে ছড়িয়ে পড়ছে। তার ভেতরের সামান্য মালপত্ত সমেত গোটা দোকানটা ছাই হয়ে যায়। কতটুকুই বা দোকান, সমস্ত পুড়ে যেতে আধঘন্টাও লাগে না।

সাজাহান শ্বশুরবাড়িতে বৌ-বাচ্চা কে রেখে একদিন ফিরে আসে। যাদিও এখন তার কোনো ঘর নাই, তবু ঘরের দিকেই ফিরে আসে। যেমন সমস্ত অপরাধী তার অপরাধস্থলে একবার ফিরে আসে, তেমন করে। এসে দেখে ধূ-ধূ জাতীয় সড়কের বিস্তার । কিছুই চেনা যায় না। পাশের ঘরের জহির তাকে দেখতে পেয়ে ডাকে—হৈ সাজান, এই যে এদিকে...। জহিরের সাইকেল সারাইয়ের অস্থায়ী দোকান আরো পিছনে সরে গেছে। তারও মাথার ছাদ সরে গেছে। সাজাহান শূন্য চোখে চায়। জহিরের কথার জবাব দেয় না। তারপর হাঁটতে শুরু করে।

পঞ্চায়েত অফিসের বারান্দায় রাত্রে শুয়ে থাকে, সবজিবাজারের আড়তের পাশে দাঁড়িয়ে নতুন নতুন লোক দেখে, বিকেলে খাল পারে বসে থাকে, আর তার নীল শার্ট ধীরে ধীরে ধূসর হয়, সাদা পাজামা ধূসর হয়।

ধূসর হতে হতে একদিন সাজাহান অর্জুনপুরের বাতাসে মিশে যায়।


৩.

সুতনু যে লোকটাকে রেললাইন ধরে হেঁটে যেতে দেখেছিল সে শেখ সাজাহান। সুতনু চেনেনা তাকে। সাজাহান দশ বছর আগে ধূসর হয়ে যাওয়া একজন মানুষ। অর্জুনপুর তাকে ভুলে গেছে। তবু সাজাহান অর্জুনপুরের পথে পথে ঘুরে বেড়ায় । কারো সাথে কথা বলে না। কেউ তার সাথে কথা বলে না। তাকে দেখতেও কি পায় কেউ? সুতনু সাজাহানকে দেখতে পায় কোনো এক অজ্ঞাত কারনে। সাজাহানের সাথে পরিচয় করতে চায় সে, সাজাহান তবু সুতনুকে পরিচয় দেয় না। সুতনুকে দেখতে পায় কি সে ? তার সূক্ষ শরীর এক অজ্ঞাত রহস্যে তবু সুতনুর কাছে প্রতীয়মান হয়ে ওঠে।

সকালবেলা বাজারে বেরোবার সময় দেখে সাইকেল পাংচার। হ্যান্ডেলে ব্যাগ ঝুলিয়ে সাইকেল ঠেলতে ঠেলতে সুতনু জহিরের সাইকেল সারাইয়ের দোকানে এসে দাঁড়ায়। জহির হাতের কাজ থামিয়ে বলে, একটু বসতে হবেক দাদা, এই হাতের কাজটা সেরে আপনেরটা দেখছি। সুতনু বাঁশের বেঞ্চিটার উপর বসে পড়ে। সামনে হাইওয়ের উপর ঝাঁ-ঝাঁ শব্দে বহুচক্র ট্রাকগুলো ছুটে যাচ্ছে। ট্রাকের পিঠে নাম না জানা আশ্চর্য্য সব চাকাওয়ালা দুর্বহ যন্ত্রাংশ। কি এগুলো? কোথায় যায়? কোথা থেকে আসে ? জগতে কত কিছুই জানা হবেনা কোনোদিন। ট্রাকগুলো পেরিয়ে যেতেই সুতনুর চোখ যায়, রাস্তার মাঝে, দুটো লেনের মধ্যিখানের ডিভাইডার লাইনে সেই লোকটা। সেই নীলশার্ট।

--জহির, ঐ লোকটা কে চেনো ? ও কি অর্জুনপুরের লোক?

--কার কথা বলচেন দাদা ?

--ঐ যে, রাস্তার মাঝে...

জহির রাস্তার দিকে তাকিয়ে কিছুই দেখতে পায় না।

--কার কথা বলচেন? কুন লোক ?

--ঐ যে নীলশার্ট...

জহির এবার থমকায় ।

--নীলশার্ট! কুথায় !

এবার জহিরও দেখতে পায় সাজাহানকে । রাস্তার দুই লেনের মাঝে উদাস দাঁড়িয়ে থাকা সাজাহানের শরীর জহিরের চোখে অনেকদিন পর বাতাসের ভেতর থেকে অনচ্ছ হয়ে ওঠে। সকালের আলোয় সাজাহানের ধুলি ধূসর চুলগুলো খলবল করে ওঠে । জহিরের হাতের কাজ থেমে যায় । সে দেখে সাজাহানের শরীর মাটি থেকে কিছুটা উপরে, শূন্যে দাঁড়িয়ে আছে । জহির স্থির চোখে তাকিয়ে বলে--

--উ হল সাজান, আমার বন্ধুলোক, আপনি চিনলেন কি করে ?

--কে সাজাহান ? তুমি চেন ওকে ?

--হ্যাঁ, আমার ন্যাংটোবেলার বন্ধু, একসাথে পাঠশালে গেছি...খেলেছি, মারামারি করেছি...এখনো মাঝে মাঝে সেইসব কথা মনে পড়ে, দুখু: হয় খুব...ঐ যিখেনে সাজান দাঁড়িয়ে আছে ঐখেনে ছিল সাজানের মুদিখানা, আমার সাইকেল সারাইএর দোকানও ছিল ওর পাশেই...অনেকদিন তাকে দেখিনাই, আজ আবার দেখলম...আপনি দেখালেন বলে...খুব খারাপ লাগে দাদা...আমিও কি ভুলে গেলম সাজান কে...!

জহির তার সাইকেল সারাইয়ের সাথে সাথে সুতনুকে সেই কাহিনী শোনায় । সাজাহানের হারানো জমি, দাউদাউ দোকান, সংসার, নিরুদ্দেশ এবং ফিরে আসা অবদি...পথে পথে ঘুরে বেড়ানো আর কারো সাথে কথা না বলার , কোনো কথাই না বলার, সম্পুর্ণ চুপ হয়ে যাওয়ার কাহিনী শোনায় ।


সেদিন সন্ধ্যাবেলা টাবুকে নিয়ে বারান্দায় বসেছিল সুতনু। তার বাড়িওয়ালা শিবতোষ ভটচাজ্যি বাইক নিয়ে পঞ্চায়েত থেকে ফিরে ঘরে ঢোকার মুখে প্রায়দিন টাবুর সাথে একপ্রস্থ গল্প করে যায়।

--কি টাবলু বাবু, আজ বেড়াতে যাও নি ?

--হ্যাঁ এএ, আজ নদী দেখেছি আমি আর বাবা...

--তাই নাকি? কোন নদী, নদীর কি নাম বলতো ?

--নদীর কোনো নাম নেই, আমি নদীর নাম দেব কাল ...

শিবতোষ শব্দ করে হেসে ওঠে। সুতনু হঠাৎ শিবতোষকে জিজ্ঞাসে

--সাজাহান কে শিবতোষদা ?

--কোন সাজাহান ?

--ঐ যে, জহিরের সাইকেল দোকানের কাছে, মুদিখানা ছিল...

--মুদিখানা! কোথায়? কার কথা বলছো ? এখানে সাজাহান নামে তো কেউ থাকেনা...

সুতনু কি বলবে বুঝতে পারে না, এর বেশী সাজাহানের আর কোনো পরিচয় সে জানেনা। জহির বা কতটা বিশ্বাসযোগ্য ? সে চুপ করে থাকে । শিবতোষ প্রধান সুতনুর দিকে খানিক অবাক হয়ে চেয়ে থেকে চলে যায়।

আর এই ঘটনার পর অনেক দিন সুতনুও আর সাজাহান কে দেখে না ।

সুতনুর মনে এইবার একটা সন্দেহ জেগে ওঠে—সাজাহান কী তাহলে সেই হাওয়া-মানুষ ! যাকে সকলে দেখতে পায় না ? বিশেষ অবস্থা আর পরিস্থিতির মধ্যে সে কেবল মাঝে মাঝে দৃশ্যমান হয়ে ওঠে কারো কারো কাছে ? কি সেই অবস্থা ? কি সেই পরিস্থিতি ? মনে পড়ে, ছোটোবেলায় সুতনু এইসব হাওয়া-মানুষদের দেখা পেত। সেইসব নির্জন নিঝুম দুপুরে, যখন বাড়ির সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে, তখন সুতনু পায়ে পায়ে বেরিয়ে পড়ত বাড়ির পিছনের বোসদের পরিত্যক্ত বাগানে, ছায়া ছায়া অন্ধকারে সেখানে কোনোদিন তারা আসতো, তাদের সাথে কত কথা হত, তারা তাদের সুখ দু:খের অতীত কাহিনী শোনাত । বলত—খোকাবাবু বড় হও, মানুষের দু:খ দূর কর...। তারপর সুতনু বড় হয়ে তাদের কথা ধীরে ধীরে ভুলে গেল। আর তাদের সাথে দেখা হয় না বহুদিন। সুতনু ভুলেই গিয়েছিল সেসব হাওয়া-মানুষদের কথা । যারা ঠিক মৃত নয়, মৃত মানুষের প্রেত নয়, স্রেফ হাওয়ায় মিশে যাওয়া জীবিত মানুষ। আমাদের চারপাশে আরেক জগত তৈরী করে তারা দিনাতিপাত করে। তাদের খবর আমাদের জগত পায় না । এই ঝকঝকে দোকান-বাজার অধ্যুষিত, তীব্র আলো ও উৎসব মুখরিত সভ্যতার থেকে অল্প দূরে এক ছায়া জগতে তারা ঘোরে ফেরে আর মাঝে মাঝে আমাদের রোদ্দুর খুব তীব্র হলে বাতাসের মধ্যে থেকে কেউ কেউ অনচ্ছ হয়ে ওঠে ।

--বাবা, তুই যে বলেছিলি শরের কলম করে দিবি, শরগাছ কৈ ?

--বাবু, ইখ্যানে আগে অনেক শরবন ছিল, তখন মানষের অব্ সর ছিল কত...

খালের উপর পুল পেরিয়ে জঙ্গলের দিকে যে রাস্তা গেছে, সেদিকে হাঁটতে হাঁটতে অনেক টা ভেতরে এসে পড়েছে সুতনু আর টাবু। জঙ্গল নাকি আগে আরো কাছে ছিল । এখন পিছিয়ে পিছিয়ে সে কোনঠাসা হয়ে পড়ছে। রাস্তার দুধারে শুকনো ক্ষেত। নেড়া রাস্তা। সুতনু চমকে তাকিয়ে দেখে টাবুর পাশেই সেই নীলশার্ট, সাজাহান। টাবু অবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে।

--তুমি সাজাহান ?

--হ বাবু...

--কোথায় শরবন?

--এই ত রাস্তার দুধারে, শরবন, শিয়াকুল, বনকুল আরঅ কত কাঁটাঝোড় যে ছিল...পঞ্চায়েত একশ দিনের কাজ দিলেক উ বছর, কুনু কাজ ত নাই, তা কি করবেক, রাস্তা সাফ করালঅ, সব ঝোপঝাড় পুড়িয়ে কেটে ফেললেক, আমি হুইখেনে, খালপারে বসে বসে দেখলম টুনটুনির বাসা গুলা পুড়ে গেলেক, নেউল গুলা ফাঁকা মাঠে ছুটাছুটি কত্তে লাগলেগ, সন্ধ্যাবেলা টুনটুনির ঝাঁক এসে দেখে তাদের ঘর-দুয়ার সব খাঁ-খাঁ, এখন আর নাই সেসব...

টাবু জিজ্ঞাসে—টুনটুনির বাসা কোথায় বাবা ? কে ভেঙে দিল তার বাসা, সেই লক্ষীছাড়া বিড়ালিনী ?

সাজাহান জবাব দেয়—হ্যাঁ বাবা লক্ষীছাড়া বিড়ালিনী টুনটুনির বাসা ভেঙে ফেলেছে। তুমি বড় হয়ে বিড়ালিনী কে বকে দিবে ।

টাবু জিজ্ঞাসে—আর বাচ্চা গুলো...?

সাজাহানের চোখ ছলছল করে ওঠে । সে মনে মনে ভাবে—টুনটুনির বাচ্চাটা আজ কত বড় হল ? বেঁচে থাকলে বছর বারো হবে সে এখন। সাজাহানের চোখ ঝাপসা হয়ে আসে, সোঁ সোঁ বাতাসে একটা ধুলোর পাক উড়ে এসে মাঠের মাঝখান দিয়ে বয়ে যায়। মরা কাশবন দুলে ওঠে। তারপর সব শান্ত। সাজাহানের শরীর ঝাপসা হতে হতে সতনুর চোখ থেকে মুছে যায় । সুতনু বুঝতে পারে, আসলে টাবুর জন্যই আবার এতদিন পর একজন হাওয়া-মানুষের সাথে দেখা হল। তার কাছে, নাকি টাবুর কাছেই এসেছিল সাজাহান ?

টাবু দূরে এক নিস্তরঙ্গ বাতাসের দিকে চেয়ে থেকে ভাবে-- টুনটুনির বাসা ভেঙে গেছে। তার উড়তে না শেখা বাচ্চা গুলো এখন বেড়ালিনীর থাবার ভেতর...। মুখে বলে—বাবা ঘরে চ, আমার ভয় করছে...।


অদৃশ্য বাতাস মাঠের শুকনো পাতা নিয়ে খেলা করে। ধুলো ওড়ে । সুতনু টাবুর ছোট্টো শরীরটা কোলে জড়িয়ে ধরে বাড়ির পথ ধরে।



লেখক পরিচিতি
কৌশিক বাজারী
জন্ম ১৯৭৪ সালে, বাঁকুড়ার বিষ্ণুপুর শহরে। এতাবৎ প্রকাশিত গ্রন্থ “নাচে জন্ম নাচে মৃত্যু”(অনলাইন পড়ার ঠিকানাঃ http://khata-kobitar.blogspot.in/2012/09/blog-post_15.html ) । ‘মিরুজিন’ নামক সাহিত্য পত্রের সম্পাদক। মূলতঃ কবি হিসাবে পরিচিত হলেও অনন্য গদ্যশিল্পী। ইমেইলঃ koushik.bazari@gmail.com . ধারাবাহিক উপন্যাসঃ ফেরিওয়ালার ডায়েরি ।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ