মেঘ অদিতি’র গল্প : একটি পরিবর্তন অথবা

ভোরের হাওয়ায় যে আবাহনের সুর থাকে তাতে লেগে থাকে মিষ্টি একটা গন্ধ আর ছোট ছোট স্মৃতি। শহরে বসে তা যে খুব টের পাওয়া যায় তা বলা যায় না তবে চাইলে বুকের ভেতর থেকে তাকে তুলে আনা যায়। অন্তত কেউ কেউ তা অনায়াস পেরে যান। যেমন পারেন আনোয়ার সাহেব। এই পঁয়ষট্টিতেও চাইলে তিনি যখন তখন তাতে বুঁদ হতে পারেন। তুলে নিতে পারেন জীবনের এক একটা ছবি। বিশেষ করে এইসব ভোর যখন হেমন্তের রঙ বদলে যাবার ইশারায় চঞ্চল তখন চিলের ডানাতেও তো রঙ পালটে যাবার খেলা, এ অনুভূতি থেকে আর মুক্তি কই তার! মুক্তি অবশ্য তিনি চান যে তাও নয় তাই তাকে যখন আলতো টান দেয় এই ভোর তখন তিনি ফিরিঙ্গিবাজার বা আন্দরকিল্লা থেকে বারবার ডুবে যান দূর্গাপুর কি সোমেশ্বরীর হৈমন্তিক ভোরের কোলে। মুখ ডুবিয়ে সেখান থেকে টেনে নেন প্রিয় গন্ধ অথবা জীবন।

যেমন আজ, ছুটির দিনের এই দুপুরে তিনি শুয়ে আছেন অথচ ঘুরে বেড়াচ্ছেন তেমন একটা কিশোর সকালে, প্রিয় হিমগন্ধা যে সকালে ভালবাসার ভেতর ভেতর মিশেছিল ভয়। তেমন এক সকাল যা তাকে কৈশোর থেকে হ্যাঁচকা টান মেরে সামান্য বড়ও করে দিয়েছিল। চোখ বুঁজে তিনি ভাবতে চাইলেন, সে সকালটায় তার মায়ের সাথে সোমেশ্বরীর ঠিক কী কী হয়েছিল। সোমেশ্বরীর কাছে থেকে মাকে ফিরিয়ে এনেছিল ‌ওই সকালই আবার, কেন যে মা সেদিন সাঁতার জানার পরও সোমেশ্বরীর জলে.. মাও কোনোদিন এ ব্যাপারে আর মুখ খোলেনি। বড় হতে হতে সোনাই কেবল নিজে নিজে বুঝতে শিখেছিল জীবনের বাঁকগুলো ঘটনাবহুল কিছু হয়ত অন্ধকারেরও। আর সেই বাঁকে এসে নিজেকে তৈরী না রাখতে জানলে হার নিশ্চিত। হয়ত মা পেরে উঠছিল না বলে সেদিন.. উঠোনে শায়িতা মা’কে ঘিরে যখন বাঁচা মরার লড়াই, রিনি বু’কে জাপটে ধরে থাকা সোনাইয়ের ভেতর নেমে আসছিল ভয় যা তাকে বুঝিয়ে দিচ্ছে কী ঘটতে যাচ্ছিল। মা না থাকা মানে যে সমস্ত পৃথিবীটাই নিমিষে ওলোটপালট হয়ে যাওয়া প্রথমবার সে বোধে আক্রান্ত হতে হতে বুবুকে জড়িয়ে ধরে সোনাই ভ্যাঁ.. সে সময়কে ছুঁতে গিয়ে আজ হঠাৎ মনে পড়ল ‘পরিবর্তন’ এ শব্দের জোর আসলে কতটা। এক জীবনে তিনিও কম কিছু তো দেখলেন না। এসব নিয়েই ভাবনা এগোচ্ছিল কিন্তু শেষ দুপুরে সহসা ঘুমিয়ে পড়লে তার ঘুমের ভেতর কোথা থেকে ঢুকে পড়ল মস্ত এক পর্তুগিজ জাহাজ। পোর্ট গ্রান্ডি ছুঁয়ে মস্ত কুয়াশার চাদর মুড়ে তখন ভোর নামছে। জাহাজ থেকে নেমে আসছেন বার্থালোমিউ দিয়াজ, মসলা ও মসলিন সংগ্রহের পথ তৈরির দায়িত্ব যার ওপর। ও মা কী কাণ্ড! সাহেবের পিছন পিছন মা যে তার, মা’র হাত ধরে আবার রিনি বুবুও। ওরা সাহেবের সাথে কেন? রিনি বুবুর চোখ দু’টো ভোরবেলার মত ঝকঝক করছে। সোনাই মানে এখনকার আনোয়ার হোসেন বার্থালোমিউ দিয়াজকে দেখে সম্ভাষণ জানালেও করমর্দন করার কথা বেমালুম ভুলে মায়ের দিকে দৌড়ে গেলেন। মা একটা লম্বা পিচ রঙা গাউন পরে। এই প্রথম মা শাড়ির বদলে গাউনে, চোখ বড় বড় করে দেখছেন তিনি। একেবারে মেমসাহেবের মতো লাগছে মাকে। রিনি বুবুর জংলী গোলাপছাপ শাড়ি। আচ্ছা দিয়াজ সাহেব আবার কবে কেপ অফ স্টর্ম পাড়ি দিয়ে এ বাংলায় এলেন.. ঝড়ে তো তার যাত্রাভঙ্গ হয়েছিল তখন! দিয়াজ সাহেবের ব্যর্থতায় যিনি সাফল্য পেয়েছিলেন তিনি তো ভাস্কো। কিজানি অত জেনে কাজ কী ভেবে তিনি হা করে তার অল্পবয়সী মা কে দেখতে শুরু করলেন। মাকে নিয়ে রিনি বুবু এগিয়ে আসছে। মা অবশ্য চিনতে পারল না তাকে। দিয়াজ সাহেবের গমন পথের দিকে তার দৃষ্টি। কাছে এসে রিনি বুবু হাত ধরে বলল, সোনাই! কত বড় হয়ে গেছিস! না মানে, বড় নয় আসলে বুড়ো হয়ে গেছিস, বলে ফিক করে হেসে ফেলে বলল, তা চুলগুলো কোথায় হারালি রে! কান ঝাঁ ঝাঁ করছে। ছোটবেলার মতো রেগে উঠতে গিয়েও চুপ করে গেলেন। রিনি বুবুর হাত ছেড়ে কেশহীন মাথাটায় একবার হাত বুলিয়ে আবার মা’কে দেখতে চাই্লেন। দিয়াজ সাহেব আর মা ততক্ষণে অনেকটা দূর কুয়াশা মেখে ফেড আউট! ভালো তো! এতদিন পর মা এল আবার ম্যাজিকের মত হারিয়েও যাচ্ছে! মা.. বলে তিনি ছুট লাগালেন যেই কী একটায় পা জড়িয়ে গেল আর হুড়মুড়িয়ে তিনি পড়ে গেলেন হঠাৎ।

বুকে একটা চাপা অস্বস্তি আর শ্বাস আটকে যাবার অনুভূতি নিয়ে যখন তার ভাতঘুম ভাঙলো তখন ঘর অন্ধকার। পুরোনো এই বাড়িটায় সকাল দুপুর বিকেল বলে অবশ্য আলাদা করে কিছু নেই অর্থাৎ আলোর প্রাচুর্য আশেপাশে মাথা উঁচু করা এপার্টমেন্টগুলোর দিকেই। আবার বুকে একটা ঘাঁই মারল, পরিবর্তন। এই দিয়াজ সাহেবের সাথে মা কেন আজ স্বপ্নে এলেন! পর্তুগিজদের বাণিজ্যনীতি শুরু থেকে লুন্ঠনের। বাংলায় তাদের দস্যুবৃত্তির কথা তো ইতিহাস জুড়ে আর তাতে ভূমিজদের কী হাল হয়েছিল! বুকটা জ্বলছে। অম্বল বোধহয়, সুমনাকে ডাকতে গিয়ে মনে পড়ল নিজেই বেরিয়ে এলেন পাশের ঘরটায়। খাবার টেবিলে ছেলে, ছেলে বৌ আর রিমি নিচু স্বরে কী একটা নিয়ে কথা বলছে। তাকে দেখেই চুপ। সুমনাও আছে। কী নিয়ে এত নিচুস্বরে কথা বুঝলেন না ঠিক। মাথায় তখনও ঘুমের রেশ। মাথার ভেতরবাড়িতে তখনও বার্থালোমিউ দিয়াজ, মা আর রিনি বু সক্কলে মিলে এক্কাদোক্কা খেলছে। রিমি আমার গ্যাসের ওষুধটা..বলতে বলতে তিনি বসার ঘরে এলেন। আলো জ্বালতে ইচ্ছে করল না। সেন্টার টেবিলে রিমোটটা হাতড়ালেন। পেলেন না। যাহ.. গেল কোথায়.. সোফায় গা এলাতেই ডান হাতে ঠেকল রিমোট। অভ্যস্ত আঙুল লাল বাটনে টিপ বসাচ্ছে কিন্তু কই সাড়াশব্দ নেই। ব্যাটারি গেল? সেদিনই পালটালেন। অন্ধকার তখন চোখ সয়েছে। এবার তিনি ঘরে পূর্ণ দৃষ্টি মেললেন কিন্তু তখনও টেলিভিশন নজরে এল না। চোখ কচলে দেখলেন ভুল দেখছেন না, নেই! ব্যাপার কী! এ্যাই সুমনা.. ডাকতে যাবার আগেই অবশ্য সুমনা এসে ঘরের আলো জ্বেলেছে। আর অমনি তার চোখ পড়ল দেয়ালে, স্মার্ট ভঙ্গিতে ঝুলে থাকা স্লিম ফ্ল্যাট বিয়াল্লিশ ইঞ্চির এক ফিলিপসের দিকে। তিনি আগের জায়গাতে আবার চোখ ফেরালেন। শূন্য। ভ্রূ কুঁচকে আবার দেয়ালে চোখ রাখলেন। তাকাতেই তাকে হ্যালো বলল টিভিটা।

এ কী! হচ্ছেটা কী.. এ পদার্খ কোথা থেকে এল?

শব্দগুলো কেটে কেটে ছড়িয়ে পড়ল। পায়ে পায়ে ঘরে ঢুকল শাহিন শম্পা আর রিমি। বাবার চোখের দিকে চোখ তুলে শাহিন খুব নরম স্বরে বলল, বাবা পুরোনো টেস্টটাও থাকুক। তাই ফিলিপসই নিলাম। শাহিনের বৌ শম্পা খুব তড়বড়ে। টিভিটা নিয়ে কিছু বলার জন্য মুখ খুলছিল, শাহিনের চোখে চোখ পড়তে থেমে গেল। একটা বাড়তি শব্দও আর খরচ না করে আনোয়ার সাহেব খুব ধীর পায়ে ফিরে গেলেন নিজের ঘরে। গুম হয়ে বসে থাকতে থাকতে মনে হলো, যা হোক একটা কিছুতে প্রয়োজন মিটে গেলেই তো হয়। তার বাইরে কেন গুচ্ছের টাকা খরচ করে এত সবের সাথে নিজেকে মানাতে হবে! অন্ধকারে শাহিন কখন যেন কাছে এসে বাবার কাঁধে হাত রেখেছে। বলল, বাবা, সময়। তার সাথে যা কিছু বদল আসে তাতে কেন সহজ হবে না বাবা? সময় না স্টেটাস? খিঁচিয়ে উঠতে গিয়ে পুবের দেয়ালের দিকে তিনি মুখ ফেরালেন। আর অমনি অন্ধকারেও একটা ফ্রেমড ছবি স্পষ্ট হয়ে উঠল। ছবিতে আনোয়ার সাহেবের হাতে ক্রেস্ট তুলে দিচ্ছেন মিঃ ফার্নান্দো।

সময়টা ১৯৮৮। সে বছর বৃটিশ এয়ার ওয়েজের টিকিট বিক্রি করে টপ চার্টে ফ্রেন্ডস ট্রাভেল এজেন্সি। বৃটিশ এয়ারওয়েজের ফার্নান্দো সাহেব ডেকেছিলেন। ক্রেস্টের সাথে তুলে দিয়েছিলেন একটি টোকেন। স্টেডিয়াম মার্কেট থেকে তোমার যেমন খুশি ফ্রিজ টেলিভশন নিয়ে নাও। চব্বিশ ইঞ্চির রঙিন ফিলিপসটা সেদিন বাবার আমলে কেনা একুশ ইঞ্চি সাদাকোলোকেও এমনি সরিয়ে জায়গা দখল করেছিল।

ঘটনার পুনরাবৃত্তি! কিজানি কেন তার মনে হল সময়ের সাথে খাপ খাইয়ে না চলতে পারলে তাকেও হয়ত ডায়নোদের মতই..

ঘরের ভেতর এখনও তিনটে ছায়া এক্কাদোক্কা খেলছে। মা একবার ঘাড় ঘুরিয়ে ডাকল, সোনাই খেলবি?

সোনাই হ্যাঁ বলার আগেই আনোয়ার সাহেব উঠে দাঁড়ালেন। ঘর ছেড়ে পা বাড়ালেন বসার ঘরের দিকে।


.......................................
পরিচিতি
মেঘ অদিতি
পেশা গ্রাফিক ডিজাইনার
কবিতা গদ্য ও গল্প

প্রকাশিত বই: জলডুমুরের ঘুম (২০১২), অস্পষ্ট আলোর ঘোড়া (২০১৩), ও অদৃশ্যতা হে অনিশ্চিতি (২০১৪) এবং সময় শূন্যতার বায়োস্কোপ (২০১৫)

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ