সাদিক হোসেন'এর গল্প : রিফিউজি ক্যাম্প

কিছু না করলে বলা মুশকিল আমি কী করছি। এসব নিয়ে বেশিদিন টিকে থাকা যায় না। যা হোক, আমি তবু দু'দিন এলিতেলি করে চালিয়ে নিয়েছিলাম। এলা জানতেও পারেনি।

যেদিন জানল, দেখি কোনো রিঅ্যাকশন নেই। আমি ব্যাকার্ডি ব্ল্যাক-এ জল ঢালছিলুম। ও আমাকে সিগ্রেট পাস করল। আমরা আরও চার পেগ খেলাম। শেষে ও নিজে একখানা র মেরে পুরো সিগ্রেটটাই শেষ করল। আমাকে কাউন্টার দিল না।


-কী হল?

এলা হেঁচকি তুলছিল। জল খেয়ে দু'বার ঘাড়টা এদিক ওদিক করল। ও চোখ পিটপিট করছিল। নেশা যে হয়নি, তা বোঝাই যাচ্ছিল। তারপর যা হয়, আমরা মেঝেতেই শুরু করে দিলাম। বোতলে তখনও খানিকটা মাল বাকি ছিল। এদিকে করবার পর সিগ্রেট না হলে আমার আবার চলে না। ও হামাগুড়ি দিয়ে আর দুটো বানিয়ে পাশে এসে শুল।

আমি প্যাকেট খুজছিলাম। ও নিজেরটা শেষ করে আমারটায় ভাগ বসাল, আজকেরটা বেস্ট।

-ব্যাকার্ডি? আগে খাসনি?

-চচ্চু।

-তো?

এলার একমাথা কোঁকড়ানো চুল। সেগুলো ঘাড়ে ও কপালে চাউমিনের মতো নেমে এসেছে। সে কপাল থেকে চুল সরিয়ে আমার পেটে এসে বসল, এইটা আমার ফার্স্ট টাইম।

-মেঝেতে? কেন মলয়দার বাড়ির কথা মনে নেই?

- ধুর। সে আমার ঠোট থেকে সিগ্রেটটা নিয়ে লম্বা টান দিল, কোনো ভিকটিমকে এই ফার্স্ট টাইম ট্রাই করলাম।

-ভিকটিম!

- হ্যাঁ, তুই তো এখন ভিকটিম। তোর চাকরি চলে গেছে। এই বাজারে একই মাইনের চাকরি পাওয়া সহজ নাকি? তুই ভিকটিম নোস? কী রে?

- হ্যাঁ, এখন তো বলবিই।

আমি আর একখানা সিগ্রেট ধরিয়েছিলাম। এলা সেটাও কেড়ে নিল, কিন্তু আমার একটা অদ্ভুত ফিলিং হচ্ছে। জাস্ট মনে হল, আমি তোকে সার্ভ করলাম। তোর আমাকে থ্যাঙ্ক ইউ বলা উচিত।

-NGO টাইপ? বলেই আমি ওকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিলাম। ও মেঝেতেই গড়াগড়ি খেতে লাগল। একবার সোফার পায়ার কাছে চলে গেল। আমি পেছনে লাথি মেরে জিজ্ঞেস করলাম, কীরে সিরিয়াস? কোনো উত্তর নেই। এলা ততক্ষণে দু'চারটে চাউমিন চিবিয়ে হুঁশ হারিয়েছে।

সে, এলা, এখন থপথপে মাংসের মতো শুয়ে আছে।

আচ্ছা, আমি কি সত্যিই ভিকটিম?

সেদিন অফিস থেকে ফেরার পথে রঞ্জনদার ফোন, সাদিক তুমি কি চাকরি খুজছ?

- না তো, কেন?

- এবার তাহলি খোঁজো। তোমার চাকরি আর বেশিদিন নেই। তন্ময়ের ব্যবসা আছে। তোমার তো নেই। কাল সকালে একটা মেল পাবে। গুছিয়ে রিপ্লাই কোরো। মাঝে মধ্যেই অফিস বাঙ্ক করছ। ভাইয়ের নাকি অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে। সেইসবও লিখো, কেমন।

পরের দিনই অফিসে গিয়ে মেল চেক করলাম। কোনো মেল আসেনি।

রঞ্জনদার সঙ্গে দু'বছর হল কাজ করছি। ডিফল্টারদের কাছে গিয়ে টাকা হাতড়ানোই আমার কাজ। এইসব কাজে ছ্যাঁচড়ামো করতে হয়। আমিতো করতে গিয়ে দুচারবার বাহবাও পেয়েছি। সেইসব প্রথম দিককার কথা। সেইসব হাস্যকর ব্যাপার।

আসল কথা হল,দুদিন পর আবার রিং বাজল, শকুন্তলা ব্যানার্জির কাছে গিয়েছিলে?

-আমি ঢপ দিলুম, হ্যাঁ।

- নিশ্চয়ই কোনো ভিক্ষাটিক্কা তোমায় দেয়নি?

জবাব দেবার আগেই ডিসকানেক্টেড।

যতবার রিংব্যাক করি শুধু we shall overcome গানটাই বাজে। ফোন ধরছে না।

পরের সপ্তাহে মেল পেলাম। আমার চাকরি চলে গেছে।

চাকরিটা যে চলেই যাবে, তা আমি জানতাম। কিন্তু কীভাবে রিঅ্যাক্ট করব তা ঠিক ভেবে উঠতে পারিনি। কবার ভেবেছিলাম এমন চিৎকার করব যে কাচের জানালাগুলো, সবকটা, ভেঙে যাবে। রঞ্জনদাকে থাপ্পড় মেরে বলব, ফ্যাসিস্ট। শালা শুয়োর। কিংবা কমরেড। মিছিলটাকে এদিকে টেনে এনে অফিসের দরোজায় টাঙিয়ে দেব।

আসলে এসব কিছুই হল না। অফিস থেকে বেরিয়ে কোকাকোলা খেলাম। তারপর সোজা পার্কস্ট্রিট। তিন পেগ চড়িয়ে এলাকে ফোন করলাম।
-কী?

-চলে আয়।

-ধুর, এখন কাজে ফেঁসে আছি। টেনশন দিস না।

-কেন, কী হল? কী?

-ফোনটা রাখ।

কী আর করব। তন্ময়কে ফোনে ধরলাম। রঞ্জনদা বোধ হয় ওর স্পিকার অন করিয়ে সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে। তন্ময় কথা বলতে চাইছে না। আমি ফোন থেকেই নোকরি আর টাইমস জবে দু'চারটে অ্যাপ্লাই করে বেরিয়ে পড়লাম।

কলকাতা একতা হারামিদের শহর। ট্যাক্সি আর প্রাইভেট কার হর্ন দিচ্ছে না খিস্তি করছে বোঝা যাচ্ছে না। তাছাড়া ভাটাকতি-হুয়ি-আত্‌মার মতো ডিফল্টাররা ঘুরে বেড়ায়। এদের চিনতে পারা কিঠিন। এখানে, বার থেকে বেরোলেই কেউ না কেউ তোমাকে ফলো করবেই। একটা তেরো-চোদ্ধ বছরের ছেলে আমাকে ফলো করছিল। সে কিছুতেই ছাড়বে না। শেষ পর্যন্ত এক প্যাকেট চকলেট কিনতে হল। সবুজ প্যাকেট। নামটাও অদ্ভুত--Haitaigum-, চায়নার গোয়াংজং ডিস্ট্রিক্টের তৈরি। চায়না? চাই না? আবার রঞ্জনদাকে ফোন করলাম। we shall overcome শুরু হতেই যাচ্ছিল। কেটে দিলাম। এদিকে রোলের দোকান থেকে বেরোনো ধোঁয়া রাজ কাপুরের সিনেমার মতো অ্যাম্বিয়েন্স তৈরি করে দিয়েছে। না, অত ধোঁয়া পার্কস্ট্রিটে দেখা যায় না। মনে হল, টাই লিখে দিলাম। আরও মনে হল, এই তো একটু নাড়া দিলেই ট্রিংকাস আর পিটার ক্যাট আর ওই ফায়ার ব্রিগেড সব কলকাতার খোলতাই পেটের ভেতর ঢুকে যাবে। তখন ফ্লুরিজ হয়ে যাবে বাঁধাকপির বাগান। এসপ্লানেড আর থিয়েটার রোড জুড়ে গাজর আর মুলো আর বেগুনের চাষ ফলবে, কিন্তু, ওই তো, বেলফুলের মালা নিয়ে ন'বছরের মেয়েটা মারুতির কাচে টোকা দিচ্ছে।Shut up। এসব কিছুই হবে না। আর আমার নেশাও হয়নি, তেমন।

এলা রেস্টুরেন্ট থেকে খাবার কিনে এনেছিল। বলল, এবারে 'কৃত্তিবাস'-এ তোর গল্প বেরিয়েছে।

-কিনলি কেন? ওরা তো পাঠাতই।

রাসবিহারী গেছিলাম। ওখান থেকেই নিয়ে এলাম, বচ্চনের তড়কা এনেছি।

বাথরুমে দেখি নতুন মাউথ ওয়াশ রাখা। আমি আরামসে পায়খানা করলাম।

কিছু না করলে, শেষ পর্যন্ত, কিছুই করা হয় না। তাই চাকরি চলে যাবার দ্বিতীয় দিনটা ভেরি ইম্পর্টেন্ট।

আমি স্কুলবয়দের মতো কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে ঠিক সময়ে বেরিয়ে পড়েছিলাম। ব্রেকফাস্টে ছিল ডিমটোস্ট আর চা।

এলার সঙ্গে আমার পরিচয় নান্দীগ্রামের সময়। কিছু দিন আগে আমার 'সম্মোহন' বইটি বেরিয়েছে। গল্পগুলো মুসলমানদের নিয়ে, তাই (!) দু'চারটে চত্বরে আলোচিতও হয়েছিল। তবে তখনও কোনো পুরস্কার জুটেনি। এদিকে এলা কোনো এক এজিটেশনে গিয়ে সবে মলেস্টেড হয়েছে। তাকে নিয়ে JU-তে হুলস্থূল কাণ্ড। মিলনদার ক্যান্টিনে সবাই তাকে প্রপোজ করতে মুখিয়ে। শেষপর্যন্ত মলয়দার বাড়িতে এলার সঙ্গে দেখা হল।

প্রচুর আড্ডা, মহীনের গানগুলো, রাজনীতি আর ওল্ড মংক। কেউ একজন তামাকের জোগান দিচ্ছিল। এলা বলল, আমি তোর লেখা পড়ব কেন? আমি জিনিয়াসদের লেখা পড়ি। তুই কি জিনিয়াস?

-জিনিয়াস কিনা জানি না। না, জিনিয়াস নই। তবে সাবনরমাল টাইপের কিছু একটা হব। ওই আর কী। স্টাইলটাই তো আসল।

অমনি মলয়দা ফুট কাটল, একদম ফালতু কথা- স্টাইল সবসময় ট্রুথ-এর উপর ডিপেন্ড করে। উইদাউট ট্রুথ স্টাইলের কো নো আলাদা একজিসটেন্স নেই।

-কিন্তু স্টাইলটাই মেন। যতই 'সত্যি' 'সত্যি' বলে চেঁচাও, স্টাইল না থাকলে কিস্যুটি হবে না।

-আই ডিফার। এলা চেঁচিয়ে উঠল।

-তুই করাপ্ট হয়ে গেছিস। এটা করাপশন। মলয়দা আমাকে তামাক পাস করল। কিন্তু স্টাইল ছাড়া আছেটাই বা কী? ট্রুথটাকে কোন উপায়ে বলব, সেইটাই আসল।

-যা শালা। এলা আর মাথা তুলতে পারছিল না। তোমাদের তামাকটা হেভি খারাপ। এই আমি পড়ে যাচ্ছি। পড়ে যাচ্ছি কিন্তু।

-ভাট বকিস না। তুই বসে আছিস। পড়বি কোথায়?

মলয়দা এলাকে পাঁজাকোলা করে তুলে ভাত খাওয়াতে নিয়ে যাচ্ছিল। এলা কিছুতেই যাবে না। শেষে মেঝেতেই শুয়ে পড়ল।

ভোর অব্দি আমরা তখনও জেগে। সবাই আমাকে ছেঁকে ধরেছে। আমি বললাম, এটা তো মোহনবাগানের সঙ্গে আর্জেন্টিনার ম্যাচ হচ্ছে।

-Ok, মলয়দা সবাইকে চুপ করিয়ে দিল, নে, বল, তোর কী বক্তব্য।

-রাজনীতিতেও একইভাবে স্টাইলটাই মেইন। আর এগুলো তোমরা ইগনোর করলে আসলে কিছুই যায় আসবে না। স্টাইল হল পলিটিকাল অ্যানার্কির একটা ভীষণ ইম্পর্টেন্ট পার্ট। আমি ফ্যাশন বলছি না। ফ্যাশন বড্ড চিপ ব্যাপার। আর তোমরা যদি এসব ধরতে পারো, পিছিয়ে পড়বেই। পড়ছও তো। মলিয়দা কফিনে শেষ পেরেক পোঁতার মতো করে বলল, তুই পার্থ চট্টোপাধ্যায় পড়? ঝেড়ে পড়ত। 'দ্য নেশন ইটস ফ্র্যাগমেন্টস' পড়েছিস?

জিজাক একটা লাফাঙ্গা।

মলয়দার বাড়িতে সপ্তাহে দু'তিনদিন আমরা এইরকম ফুর্তি করতাম। ক'দিন পরেই আমাদের মধ্যে ইশারা চলতে লাগল। ভোররাতে আমি আর এলা ব্যালকানিতে উঠে আসতাম। ওখানে স্ট্রিটলাইটের হলুদ আলো এসে পড়ত।

একদিন সকালে এলার ফোন এল, শালা কনসিভ করেছি। কী করব বল।

আমার কাছে হাজার টাকার মতো ছিল। বাকিটা মলয়দার থ্রুতে চাঁদা তুলে জোগাড় হল। ব্যাপারটা দুপুরের আগে মিটে গেলেও এলা মলয়দার বাড়িতে সন্ধ্যে আটটা অব্দি টানা ঘুম দিল। রাতে, ফেরার সময়, ট্যাক্সিতে বলল, এখনও মনে হচ্ছে I gave birth to someone. একজন হাড়গোড়হীন, মাংসহীন, ব্রেনহীন মরা বাচ্চাকে জাস্ট জন্ম দিয়ে এলাম। জন্ম দিয়ে আবার ফেলে দিয়ে এলাম। আচ্ছা, ওটা ছেলে ছিল, না মেয়ে? মেয়েই হবে মনে হয়, বল? এখনও বুকটা কেমন ভারী ভারী হয়ে আছে, দ্যাখ। মনে হচ্ছে দুধ জমছে, না? চাকরি চলে যাবার দ্বিতীয় দিনটা ঠিক এরকমই। সিরিয়াসলি। পিঠের ব্যাগটাকে ভারী ভারী মনে হয়।


ভদ্রলোক হবার প্রাথমিক শর্ত হল যাতে কোনোমতেই সেভিংস না থাকে। সেই অর্থে আমরা এখন চূড়ান্ত ভদ্দরলোক। তবে, ইতিমধ্যেই, বেঁচে থাকবার জন্য কতকগুলো প্রিকশন নিয়ে ফেলেছিলাম-

১ আমি চুল-দাড়ি কাটার ফালতু খরচা ছেড়ে দিলাম।

২ সাবান, শ্যাম্পু, টুথপেস্ট, মাউথওয়াশ বন্ধ করলাম।

৩ দু'সেট করে জামা রেখে বাকি কাপড় চোরবাজারে বিক্রি করে তুমুল বিরিয়ানি খেলাম।

৪ টিভি সেটটা বিক্রি করে দিলাম। তবে ভালো দাম পেলাম না। তাও দু'বোতল দামি হুইস্কি জুটে গেল।

৫ গ্যাস বাঁচাতে বাইরেই চা খেতাম।

৬ দু'মাসের বাড়ি ভাড়া বাকি পড়ে গেছিল। এলার বাপ এসে তা মিটিয়ে দিল। আমরা না বলিনি। তবে লোকটাকে রিজেক্ট করলাম। সোফাটা বেচলাম না।

কিছু না করলে, আসলে কিছুই করা হয় না। তাই, আমরা তখন সারাদিন করতাম। দুবার-তিনবার-চারবার। এক একবার এক একজায়গায়। সেদিন সিঁড়িতে আমাদের বুঝি কেউ দেখছিল। এলা আঁচ করতে পেরেছিল। আমরা তাকেও রিজেক্ট করলাম।

মাঝে একবার মলয়দার বাড়িতে গেছিলাম। মলয়দার ছেলে এখন ফাইভে। এলার সঙ্গে তার বেশ জমেছিল। ক'দিন পর মলয়দা আলু আর পাঁচ কেজি চাল নিয়ে হাজির।

-পৃথিবীতে ভূত আছে। ভূত একজিস্ট করে।

এলা সোফাতে শুয়েই মলয়দাকে বলল। মলয়দা ধমক দিয়ে চলে গেল।

এই সময় এলা হঠাৎই, সব আশা ছেড়ে দিয়েছিল, তবু ওর অ্যাসাইনমেন্টের টাকাটা পেয়ে গেল। এক্কেবারে তিন হাজার। আমরা ঠিক করলাম, এটাই সুযোগ। স্টক বাড়াতেই হবে।

আমি বললাম, কখন কী হয় তা কেউ বলতে পারে না।

এলা বলল, অমনি ঝেঁপে দিলি। হারবার্টের শেষের দিকে এরকম কিন্তু একটা লাইন ছিল। কী ছিল রে?

তো, পরের দিন সকালে CCD-তে গিয়ে আমরা কফি খেলাম। এলা দুটো আইসক্রিমও খেল। বলল, চল সিনেমা দেখি।

-ধুর, অত সময় কার?

এলা হাসছিল।

শেষ পর্যন্ত আলিপুর জু ঘুরে ফেরবার পথে ৫ লিটার ব্যাকার্ডি ব্ল্যাক তুলে নিলাম।

আমাদের চারপাশের বেশিরভাগ লোক ক্যালানে। তারা আমাদের দেখতে আসত। কেউ কেউ দয়ালুও বটে। তন্ময় গতমাসের ইলেকট্রিক বিল জমা দিল। একজন তো এলাকে সেলিব্রেশনও প্রেজেন্টট করেছিল। তাছাড়া কেউ না কেউ মোবাইল রিচার্জ করে দিত ঠিক।

-তুই কি জিনিয়াস? এলা খাটের উপর গড়াতে গড়াতে ধপাস করে পড়ে গেল। কবেকার ভাঙা গেলাসের টুকরো মেঝেতে ছিল। আমি সেফটিফিন দিয়ে ওর কোমর থেকে কাচের কুচি খুঁচিয়ে বের করছিলাম। এলা কাঁদছিল। পরের দিন ধুম জ্বর এল। তিনদিন পর সেরে উঠল আবার।

এলা বলল, বুঝলি, মনে হয় ব্যাপারটা জমছে।

-কী হল আবার?

- একটা স্ক্রিপ্টে অ্যাসিস্ট করার সুযোগ পাব মনে হচ্ছে।

-সিরিয়াসলি?

-তা নয়তো কী!

এলা রোজ সকালে বেরিয়ে যেত। হাজার গণ্ডা লোকের সঙ্গে মিট করতে হত তাকে। আবার সন্ধ্যের পর ফিরত।

এদিকে যা টাকা ওর পার্সেই থাকত। আমি রাস্তায় বেরিয়ে খুঁজে খুঁজে ফেলে দেওয়া হাফ খাওয়া সিগ্রেট ফোঁকা শিখলাম তখন। প্রথম ধোঁয়াটাই বুকে ধাক্কা মারে। এটা ইন্টারেস্টিং। চারদিকের ডিফল্টারদের সামনে দাঁড়িয়ে দৌড়তে দৌড়তে হেজে যাওয়া সফল হারামিদের মুখের উপর ধোঁয়া ছাড়তাম। ভালো লাগত।

খাটের নীচ থেকে কতদিনকার পুরোনো পার্ক অ্যাভিনিউ বডি স্প্রে পাওয়া গেল। তখনও অর্ধেক রয়েছে। এলা আগেই বেরিয়ে গেছিল। আমিও সারাগায়ে পারফিউম ছিটিয়ে বেরিয়ে পড়লাম।

যদুবাবুর বাজার পেরিয়ে সোজা সাদার্ন অ্যাভিনিউ অব্দি হেঁটে এলাম। লেকের ভেতর ঢুকে পোড়া সিগ্রেট খুঁজছিলাম। দুজন কলেজের ছেলে আমার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। আমি হাসলাম। ওরাও হাসল।

সন্ধের দিকে তুমুল বৃষ্টি। ভিজতে ভিজতে হাঁটছিলাম। তারপর মনে হল, কেন ভিজব? একটা দোকানের শেডের তলায় এসে দাঁড়ালাম। দেখি মোটাসোটা নেড়ি কুত্তার বাচ্চাটা আমার পায়ের কাছে ঘুরঘুর করছে। ওকে তুলে নিলাম।

কুকুরের বাচ্চাটাকে দেখে এলা হেভি খুশি। ওর নাম দিল বিট্টু। বিট্টু বলে ডাকলে সে কিন্তু সাড়া দেয় না। সারাদিন সোফার পায়ায় লেজ গুটিয়ে ঝিমোয়। পাউরুটি খায়। মদ খায় না। বিট্টু বলে ডাকলে ফিরেও তাকায় না। কিছু না করা মানে কি কিছুই করা নয়? মাঝে মাঝে এইসব প্রশ্ন করতাম নিজেকে। কিন্তু বিট্টুকে কিছুতেই মদ খাওয়া শেখাতে পারলাম না। রাস্তায় বেরিয়ে দুদিন পর পর বমি করলাম। বমিতে রক্ত ছিল না। দুপুরে খাটে শুতেই তলিয়ে পড়লাম। একবার মনে হল কে যেন লাইট জ্বালিয়েছে। তারপর কিছু মনে নেই।

রাত দশটায় ঘুম ভাঙল। সোফা থেকে তখন আড্ডার আওয়াজ পাচ্ছি। কারা এসেছে? গিয়ে দেখি কেয়া আর সুমনা।

ওরা ইতিমধ্যে ব্যাকার্ডি ব্ল্যাক-এর এক লিটার প্রায় শেষ করে ফেলেছে। মেঝেতে আর একটা 750. তখনও খোলা হয়নি।

এলা চেঁচিয়ে উঠল, ব্রাভো!

-কী হল?

কেয়া আর সুমনা হাসিতে লুটিয়ে পড়ছে।

-তুই এতগুলা মেয়ের সামনে আন্ডারওয়্যার পরে চলে এসেছিস। খেয়াল নেই?

আমি চেঞ্জ করতে যাচ্ছিলাম।

এলা বলল, ঠিক আছে। বসে পড়। জানিস তো ওরা স্কলারশিপের টাকা পেয়েছে। আজ সারারাত পার্টি। পাড়ার সবাইকে জাগিয়ে রাখব।

প্রচুর কথাবার্তা হল। আমি পর পর দুটো র মারলাম। শুনলাম মলয়দা বীরভূমে চলে গেছে। সেখানে খাদান শ্রমিকদের নিয়ে সংগঠন করছে। আমি বললাম, তোরা কিমা খাবি?

এলা আকাশ থেকে পড়ল, মাংস? কোথায় পেলি? তুই জিনিয়াস।

কেয়া আমাকে দেখে এলাকে বলল, এটা তোরা কী করছিস?

-কী আবার! এলা গ্লাসে চুমুক দিল।

-সবাই তোদেরকে নিয়ে আলোচনা করে। এটা জানিস?

-তো? এলা এক চুমুকে শেষ করে আবার গ্লাস ভরল।

সুমনা সিগ্রেট ধরিয়ে বলল, এটা মকারি নয়?

-Shut uo. কত হাড়গোড়হীন, মাংসহীন মানুষের বাচ্চা কিলবিল করছে, তোরা দেখতে পাচ্ছিস না? এলা চেঁচিয়ে উঠেছিল। তারপর হঠাৎই থেমে গিয়ে বলল, আমাকে বাথরুমে নিয়ে চল, বমি করব।

আমি বালতিটা ওর মুখের সামনে ধরতেই ও বমি করে ফেলল।

এলা মুখ মুছে বলল, আর একটা দে। আমার বিট্টু কই?

-একদম না। কেয়া সুমনাকে বারণ করল। আমি এলাকে একটা ট্যাবলেট দিয়ে বললাম, এটা খেয়ে নে।

তারপর আরও খাবি। কিচ্ছু হবে না।

-কীসের ট্যাবলেট?

- অ্যানটাসিড।

আমিন ওকে ট্যাবলেট খাইয়ে কিচেনে চলে গেলাম। ফিরে এসে দেখি এলা আবার গ্লাস নিয়ে বসেছে। এবার সুমনা শুরু করল, সাদিকদা এটা কী করছ তোমরা?

-কিছুই তো করছি না।

-কিছু করছ না টাই না কেন? কেয়া আমার দিকে তাকাল।

-এই সিস্টেমের আমরা ভিকটিম। তোরা বুঝিস না?

এলা মাথা নাড়ল। ও আর তাকাতে পারছিল না। কেয়া বলল, ভাট বোকো না তো। তোমার যা কোয়ালিফিকেশন আর এক্সপেরিয়েন্স তুমি চাইলেই এক মাসের মধ্যে কোথাও না কোথাও চাকরি পেয়ে যাবে। যা করছ তা স্রেফ শখের জন্য করছ। তুমি উপরের তলার মানুষ।

সুমনা আরও এগিয়ে গেল, শুধু তাই না। তোমরা একটা ক্রিমিনাল অফেন্স করছ। সত্যিকারের যারা ভিকটিম তাদেরকে নিয়ে তুমি মকারি করছ। এটা অভিনয় ছাড়া আর কী! তোমার এই সিউডো পলিটিক্যাল স্টান্স সত্যিকারের ভিকটিমদের উপর ওভারল্যাপ করে যাচ্ছে। তোমাদের জন্য ওদেরকে আর আলাদা করে চেনা যাচ্ছে না। ওদের স্ট্রাগলটাকে মকারি করতে করতে তুমি একটা জাস্ট নিজের জন্য এক্সপেরিমেন্ট করছ। এটা অফেন্স নয়।

-এতে আমার দায় কোথায়?

কেয়া ওর আধখাওয়া সিগ্রেটটা আমাকে দিয়ে বলল, দায় তো তোমার আছেই।

-কিন্তু আমি তো কিছুই করি না।

সুমনা আমার থেকে সিগ্রেটটা নিয়ে নিল, কিছু মনে কোরো না সাদিকদা, তোমাকে রাসবিহারীতে ভিক্ষা করতেও দেখা গেছে। এটাকে কী বলবে?

এলা ততক্ষণে ঘুমিয়ে পড়েছিল। তবু জোর করে ওকে দু চামচ কিমা খাওয়ানো হল। বাকিটা আমরা তিনজনে শেষ করলাম।

কেয়া আর সুমনা বেডরুমে চলে গেছে। আমি খানিকক্ষণ পায়চারি করতে লাগলাম। 750 শেষ করলাম।

বেডরুমের দরজাটা খোলাই ছিল। সুমনা মেঝেতে উপুড় হয়ে শুয়ে কেয়া খাটে। কেয়ার উপর উঠতেই ও জেগে উঠল, কী করছ সাদিকদা? আমি ওর প্যান্টিতে হাত দিলাম।

-এলাদি জানলে খুন করে দেবে।

-ও উঠবে না। অ্যালজোলাম খাইয়ে এসেছি।

-তুমি একটা শুয়োর।

আমি ওর বুকে মুখ ঘষছিলাম। ও কোমড়টা আলতো করে তুলে দিল। আমি প্যান্টিটা নাবিয়ে দিলাম।

-তুমি শুয়োর। ও আবার বলল।

এইটা কী জানো তো? আমি ওকে ধাক্কা দিয়ে বললাম, একটা হেভি বড়ো রিফিউজি ক্যাম্প। মাঝে মাঝে ইনভিজিবল, হেলিকপ্টার এসে ইনভিজিবল স্পেস থেকে খাবার, ওষুধ, লিপস্টিক, ফ্ল্যাটবাড়ি এইসব ফেলে দিয়ে যায়। আর আমরা দৌড়ে দৌড়ে সেইসব কালেক্ট করি। অনেকে দৌড়তেও শেখেনি। এই যা।

-তুমি শুয়োর। কেয়া এবার কানে কানে বলল। হঠাৎ দেখি লাইট। সুমনা আমাদের দিকে তাকিয়ে রয়েছে।

সকাল সাতটায় আমাড় ঘুম ভেঙে গেছিল। তখনও ওরা সবাই ঘুমোচ্ছে। কিচেনে গতকালের এঁটো বাসনের উপর আরশোলা ঘুরে বেড়াচ্ছিল। সেটি বেসিনের নলের ভেতর ঢুকে পড়ল।

জানলা খুলতেই সূর্যের আলো স্টিলের থালার উপর এমনভাবে ঝকঝক করে উঠল যে ওদিকে তাকাতে পারলাম না। কিংবা এমনও হতে পারে, চোখে এখনও ঘুম জড়িয়ে, তাই এমন মনে হল, আলো যেন চোখের ভেতর চিকচিক করে ঘুরছে।

যা হোক, শেষ পর্যন্ত বলা যাক-

গত রাতে আমি দুজন মেয়ের সঙ্গে শুয়েছিলাম। আর সবাইকে কুকুরের মাংস খাইয়েছি। এইটুকুই।


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ