গাজী তানজিয়া'র গল্প : দাদন

ওরা এসেছে। আমাদের সবার ধড়ে প্রাণ ফিরে পাওয়ার মতো একটা অনুভূতি হলো। এ যেন দ্বিতীয় জন্মের অনুভুতি। আমরা দিনের পর দিন, রাতের পর রাত এখান থেকে পরিত্রাণের সব আশা যখন ত্যাগ করেছি তখনো ডুবন্ত মানুষের খড়-কুটো আঁকড়ে থাকার মতো ওদের অপেক্ষা করেছি। ওরা আমাদের এভাবে দেখেও না দেখার ভান করে থাকবে না। একদিন সুসজ্জিত হয়ে তারা আসবে। ওরা, যাদেরকে আমাদের ঘৃণ্যতম জীব ছাড়া আর কিছু মনে হয় নাই। ওদের চোখকে মনে হয়েছে পৃথিবীর তাবত বিবর্ণতম বস্তুর অন্যতম।
সবচেয়ে কঠিনতম ওদের অস্ত্র আর তার চেয়েও অসহনীয় সেই অস্ত্রের প্রয়োগ। এতোক্ষণে নিশ্চই বুঝতে পারছেন ওরা কারা? ওরা যাদের কানে সহজে সাধারণ মানুষের আর্তনাদ পৌঁছে না। অথচ ওরা মানুষের সেবা করার উদ্দেশ্যেই সরকারের দেয়া বেতন ভাতা ভোগ করে। পক্ষান্তরে ভোগ করে অনেক কিছু। সেই ওরা যেন কীভাবে প্রকৃত বিষয়টা এতোদিনে আঁচ করতে পেরেছে।

এতোদিন জানলেও কোন এক পরিচিত প্রলেপের কারণে বিষয়টা আঁচ করতে পারেনি আর কি! বিষয়টা আঁচ করার জন্য তাদের ঐ নির্মম কানে ঘটনাটা যাঁরা পৌছে দিয়েছেন তাঁদেরকেও আমরা চিনি। যারা সাধারণের খবর জীবিকার তাগিদে সংগ্রহ করে আর রাজনৈতিক খবর, রাজনৈতিক নেতা কর্তৃক সুযোগ সুবিধা গ্রহণের রেসিও অনুসারে।

তারপরও এই মুহূর্তে ওদেরকে আমাদের শ্রদ্ধা করতে ইচ্ছে করছে এবং একই সাথে ওদের ডাকে সাড়া দেওয়া যাবতীয় অপবাদের শিকার ঐ লোকগুলোকেও। যারা এই গভীর রাতে আমাদের মতো কিছু মানুষ নামের পশুপ্রায় প্রাণীকে বাঁচাতে এগিয়ে এসেছে।

অবশেষে ওরা আসতে পেরেছে তাহলে! আমাদের ঠিক বিশ্বাস হচ্ছে না। গেটে আজরাইল রশিদের সাথে ওদের কথোপকথন শোনা যাচ্ছে। রশিদ ওদের ম্যানেজ করতে ব্যস্ত...।

‘এতো রাইতে! ছার অরাতো ঘুমাইতাছে। বুঝেনইতো অদের বেয়ানে উঠতে অয়।’ ফিসফিস করে আরো কিছু বলতে যায়..।

ওরা বিব্রত হয়, সঙ্গে থাকা লোকগুলোর জন্য।

হুঙ্কার ওঠে, ‘খোল্ দরজা আগে!’

‘ঘুমে তো ছার।’

কেউ একজন বলে, ‘ঘুমন্তই দেখতে চাই।’

‘খোল গেট!’ গেটে লাথির শব্দ!

আজরাইল রশিদের পাছায় রুলারের বাড়ি। আজরাইলের আর্তনাদ শোনা যায়..।

আমরা নড়েচড়ে বসি। আমরা বুঝতে পারি, এবার ওরা আমাদের ত্রাণ কর্তার ভূমিকায় অবতীর্ণ হবে। আমরা প্রতিনিয়ত ত্রাণকর্তা খুঁজি। আর তাইতো ঈশ্বরে আমাদের এতো বিশ্বাস! কিন্তু কেউ আমাদের এখনো সেই পরিত্রাণ দিতে পারে নাই। তারপরও আমরা চিৎকার করে উঠি। রাতের নিস্তদ্ধতা ভেদ করে সেই শব্দ পৌছে যায় গ্রহ থেকে গ্রহান্তরে।

রাতের নিচ্ছিদ্র অন্ধকার ভেদ করে, সব রকম বাধা এবং বাধা দেবার বা লুকিয়ে রাখার সব কৌশল ভেদ করে ওরা যে পৌঁচেছে এখানে, সেজন্য আমরা উচ্ছ্বসিত। এতোদিনে কেউ না কেউ এসেছে - এই গভীর রাতে, এই মৃত্যুকুপে..।

না, এটাকে ঠিক সরাসরি মৃত্যুকূপ বলা যায় না। কারণ, এখান থেকে এখন পর্যন্ত কেউ সেখানে পৌঁছেনি। তবে প্রতিদিন প্রতিনিয়ত এখানে একবার করে আমাদের মৃত্যু ঘটে। আমাদের জীবনের, স্বাধীনতার এবং যৌনতার। মাঝে মাঝে নিজের গায়ে চিমটি কেটে দেখি আদৌ কি আমরা বেঁচে আছি? আমরা সতেরজন।

আমরা সতের জন বিভিন্ন বয়সের পুরুষ! হ্যাঁ আমাদের পুরুষ বলা যায়। যদিও আমাদের হাত-পা বাঁধা। আমাদের এই গণ্ডির বাইরে পা রাখার কোনো অধিকার নেই, তারপরও আমরা পুরুষ। আমাদের, যাদেরকে সবাই ভাবে এই পৃথিবীটাকে আমরা কোনো না কোনোভাবে খুব উপভোগ করি, শাসন ও শোষণ করি, নিজেদের ছাড়া বাকি সবাইকে ভোগ্য বলে জ্ঞান করি। সেই তথাকথিত পুরুষ আমরা। তবে এই মুহূর্তে আজ আমাদের আর একটা পরিচয় আছে। আমরা ভোগ্য এবং দাস। এটাও পৃথিবীর আদী পরিচয়ের মধ্যে একটা। অর্থ ও ক্ষমতার জালে বন্দি আমরা। এবং এটাই চরমতম সত্য এখন পৃথিবীতে। নারী-পুরুষের অসমতা ব্যপারটা অনেকটাই ম্যাড়মেড়ে হয়ে এসেছে।

আমরা সতেরজন এবং ভাগ্য ও প্রকৃতির জাঁতাকলে পৃষ্ঠ এমন অসংখ্য সতের জন এই একবিংশ শতাব্দীতে এসেও একটা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে বসবাস করেও ‘দাস’। ভুল বললাম, দাস না ‘কৃতদাস’। আমরা বিক্রী হয়ে গেছি। আমাদের বিক্রী হয়ে যাওয়াটা খুব স্বাভাবিক ঘটনা। আমাদের মতো শ্রমদাসেরা প্রতিমুহূর্তে এমন বিক্রি হয়। আর যতক্ষণ পর্যন্ত আমাদের এই বিক্রি হয়ে যাওয়া শ্রমঘণ্টাগুলো কড়ায়-গণ্ডায় উসুল না হয় ততক্ষণ পর্যন্ত আমরা একটা পৈশাচিক জীবনের মধ্যে নিজেদেরকে সমর্পণ করতে বাধ্য হই। আমাদের একজন দালাল আছে। ঐ বেশ্যাবাড়ির নটির দালালের মতোই। সে আমাদের গ্রামেরই একজন। খুব পরিচিত এবং তাকে খুব নির্ভরশীল মনে হয় আমাদের। কারণ, সে আমাদের বেঁচে থাকার পথ দেখায়। মাঝে মধ্যে মনে হয় সে আমাদের ত্রাণকর্তা। আমরা যখন কাজের অভাবে না খেতে পেয়ে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যেতে থাকি তিলে তিলে - তখন সে আমাদের শহরে কাজের খোঁজ দেয়। এবং তখনই শুরুতে খেতে পাওয়ার এবং পরে বেঁচে থাকার তীব্র আকাঙ্খায় আমাদের চোখ দুটো চকচক করে ওঠে। আমরা সবাই আমাদের পোটলায় একখানা আঁধছেড়া লুঙ্গি ও গেঞ্জি ভরে নিয়ে ওর পিছু পিছু রওনা হই। ও তখন আমাদের একমাত্র পথ প্রদর্শক। যে দেবে আমাদের খাদ্য ও বেঁচে থাকার নিশ্চয়তা। ওর মাথার চারপাশ থেকে তখন যেন মহা মানবের মতো জ্যোতি বিচ্ছুরিত হয়। ও সামনে হাঁটে, আমরা ওর পিছু পিছু দৃঢ় পদক্ষেপে লোকাল বাস ধরি। আর পেছনে হাঁটু সমান পানির মধ্যে রেখে আসি আমাদের অভুক্ত অর্ধভুক্ত পরিবার।

যারা আমাদের বাসটা অদৃশ্য হতে হতে দিগন্তে মিলিয়ে যাওয়া পর্যন্ত দাঁড়িয়ে ছিল রাস্তার পাশে, তারা এখন দাদনের যে সামান্য টাকা আমাদের হাতে তুলে দেয়া হয়েছিল, সেই টাকা একটা ভাঙ্গা, জীর্ণ, কাদা প্যাঁচপেচে ঘরের মধ্যে কোন এক নিরাপদ স্থানে লুকিয়ে রাখায় ব্যস্ত। কারণ ঐ সামান্য অর্থের ভাঁজে ভাঁজেই লুকিয়ে আছে তাদের জীবন। এই অদ্ভুত পৃথিবীতে বেঁচে থাকার সামান্য রসদ।




আমরা সতেরজন সতেরটা জীবন্ত মেশিন। ফজরের আজান পড়লেই আমাদের ঘণ্টা বেজে ওঠে। ঘুম পূর্ণ না হওয়ায় আমাদের মাথা থাকে ভারী। আর জ্বলতে থাকে চোখ। আর সেই অবস্থায় আমরা মাটি কেটে যাই, ময়ন মেশিনের গহ্বরে ফেলি, ফ্রেমে ঢোকাই, সারি বেঁধে সাজাই আর পোড়াই। দিনের পর দিন এভাবে দগ্ধ করি এবং দগ্ধ হই। তপ্ত খটখটে বিরান ইট-খোলায় রোদে পুড়ে, আগুনের উত্তাপে, কালো বিষাক্ত ধোঁয়ায় জীবনী শক্তি খোয়াই। আর রাত হলে আমাদের ঢুকিয়ে দেয়া হয় খোয়াড়ে।

এখানে, এই মৃত্যুকূপে ঢোকার পর থেকে আমাদের অগ্রিম বিক্রি হয়ে যাওয়া শ্রমঘণ্টা যেন আর শেষই হয় না। এখন নিশ্চই বোঝা যাচ্ছে যে, আমাদের শ্রমঘণ্টা কিন্তু আসলে আট ঘণ্টা না বারো ঘণ্টা বা তারও বেশি। খাবার ওরা সরবরাহ করে। আমাদের বাজার করবার বা রান্না করার কোনো এখতিয়ার নাই। এখানে আসার পর থেকে একটা কথা শুনে আমরা ভীষণ দুশ্চিন্তায় পড়ে গিয়েছিলাম যে, আদৌ আমরা সতেরজনের মধ্যে যে কোনো একজন এই পিতৃপ্রদত্ত জীবনটা নিয়ে এখান থেকে বের হতে পারব কি না। এমন নাকি নিয়ম আছে যে, ভাটার ঐ লকলকে বিশাল গহ্বরটা যতক্ষণ দাউ দাউ করে জ^লে না উঠবে ততক্ষণ আমাদের জীবন মরণের এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে। আগুন জ্বালাবার প্রাচীন পন্থা হিসেবে কখন না জানি আমাদের মধ্য থেকে কোনো একজনকে ধাক্কা মেরে বলি দেয়া হয়! আমরা সবাই তখন ওখান থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখার প্রাণপণ চেষ্টা করতে থাকি। কিন্তু হায়! এটা কি করে সম্ভব! যাদের হাতে আগুন জ্বালানোর ভার তারা কি আর সেখান থেকে দূরে সরে থাকতে পারে! আমরা আমাদের কর্তব্যে কোনো রকম ফাঁকি দিতে পারি না। অথচ আমরা আমাদের অগ্রিম বিক্রি হয়ে যাওয়া শ্রমের টাকার পূর্ণ হিস্যা কখনো পাই না। দিনের পর দিন অনাহারে অর্ধাহারে থেকে যখন আমরা ক্লান্ত, যখন আমরা বেঁচে থাকার উপায় খুঁজতে থাকি দিশেহারার মতো, তখন দালাল নামের ঐ মধ্যসত্ত্বাভোগি যে আমাদের অর্ধেক শ্রমমূল্য খেয়ে নেবে সেই চিন্তা মাথায় আসে না। আমরা শুরুতেই ঠকে বসে থাকি। এর পর আমরা এ যুগের দাসেরা বিনা পারিশ্রমিকে সেই শ্রম বিলাতে বাধ্য হই। আজ কত মাস ধরে আমরা এই পশুর মতো জীবন যাপন করছি বলতে পারব না। আগে দিন তারিখের হিসাব থাকতো, এখন আর মাথাও কাজ করে না। কেউ অর্ধমৃত হয়ে গেলে, পাথরের মূর্তির মতো জড় পদার্থে পরিণত হলে, হাড়ভাঙ্গা খাটুনির চাপে কারো অনুভূতিগুলো ভোতা হয়ে গেলে, মিথ্যা দিনগুনে যাওয়া ছাড়া আর কিছুই করার থাকে না। দিনের বেলা যখন আমরা স্তুপের পর স্তুপ মাটিকে একটা ফ্রেমে পুরে আকৃতি দেয়ার চেষ্টায় ব্যস্ত থাকি, তখন আমাদের পা চলে, হাত চলে, শরীর থেকে রক্ত পানি হয়ে বের হয় আর আমাদের চোখ থাকে শুন্যে। এক সীমাহীন প্রতীক্ষায়; কখন বের হতে পারব! আমাদের চোখ শুন্যে সেই মুক্তি খোঁজে। আর খুঁজে পায় একটা চকচকে রাম-দা। মালিকের খাস লোক রশিদ ঐ রাম’দা হাতে আমাদের পাহারা দেয়; আর কতগুলো হিংস্র শংকর প্রজাতির কুকুর দাঁত খিচিয়ে ভয় দেখায়। তবে ওদেরও স্বাধীনতা আছে, খাদ্যের এবং সঙ্গমের। তবে কি কুকুরগুলো আমাদের ঈর্ষার পাত্র! নাকি প্রতিপক্ষ?




যেদিন এখানে প্রথম আসি, সেদিন কিন্তু আমাদের থাকার ঘরটাকে খুব একটা অদ্ভুত ঠেকে নাই। বরং মনে হয়েছিল বেশ মজবুত তো! কারণ, বছরে বছরে আমাদের নড়বড়ে ঘর গুলোকে হাওয়ায় মিলিয়ে যেতে দেখে ঘর সম্পর্কে এক ধরনের ভীতি তৈরী হয়েছিল। তাই এখানকার ঘরটা দেখে মনের ভেতরে স্বস্তি এসেছিল। আমরা ঘর উড়ে যাওয়া মানুষ তাই মজবুত ঘর দেখলে আশ্বস্ত হই। অন্তত রাত্রির অন্ধকারে শুন্যে ভাসার সম্ভাবনা নাই। লম্বা টিনের চালাঘর, প্রত্যেক চারহাত পরপর একটা খুঁটি। ঘরের খুঁটি থাকে ঘরের চারদিকে কিন্তু এই ঘরটার মাঝ বরাবরও সারিবাঁধা তিনটা খুঁটি। প্রথমে ঘরের এই অদ্ভুত ব্যপারটা বুঝতে পারি নাই। ভেবেছি মাঝখানে খুঁটি দেওয়াতে ঘর খুব মজবুত হয়েছে। যার জানালায় ঘন করে লোহার শিক বসানো। দরজাটা লোহার, স্টিলের পাত বসানো, টানলেই ঘড় ঘড় শব্দে চারদিকে জানান দেয়। টিনের চাল ও টিনের বেড়া, আঘাত করলেই ঝনঝন শব্দ ওঠে রাতের নিস্তদ্ধতা ভেদ করে। এই গরাদে সন্ধ্যাবেলা ঢোকার পরই আমাদের হাতে পরিয়ে দেয়া হয় লোহার শেকল। মাঝের এক একটা খুঁটিতে ছয়জন করে বাঁধা হয়। যাতে আমরা দাদনের টাকা শোধ হওয়ার আগে পালিয়ে যেতে না পারি। অথচ ওরা মানতেই চায় না যে, আমাদের হিসাবের টাকা শোধ হয়ে গেছে অনেক আগেই। তবে দালালের খেয়ে ফেলা বাড়তি টাকা এখন এভাবে শোধ করতে হবে। মাঝে মাঝে মনে হয় এর চেয়ে কি ঝড়ে উড়ে গেলে ভালো হতো না! এই একটা জীবন! না কি আস্ত একটা হাবিয়া দোজখ!

আমাদের মধ্যে জলিল, ওর বয়স কম, ১৮ কি ১৯ হবে! ও এই বাঁধা মানতে চায় নাই। পালাতে গিয়েছিল কিন্ত পারে নাই। ওর পায়ের ক্ষত এখন দিনে দিনে গভীর হচ্ছে। দগদগে ঘা হা মেলে তাকিয়ে ভয় দেখায় সবাইকে। পা বাড়িয়েছ কি তোমাদের সবাইকে গিলে খাবে ঐ রকম ক্ষত। জলিলের পায়ের ক্ষতে বড় বড় মাছি এসে বসে এই রাতের বেলাতেও। যন্ত্রণায় সে চেঁচায়। সেই চিৎকার আমাদের হৃদপিণ্ডের ভিতর দিয়ে ভেদ করে যায়। যন্ত্রণায় তার পা কাটা শোল-মাছের মতো তড়পায়। তারই মধ্যে সবাই তাদের শেকল পরা ভারী হাতে তুলে ধরে ভাতের থালা। অন্য খোলা হাতটা দিয়ে গোগ্রাসে মুখে তোলে সেই কাঁকর বালি মেশানো ভাত, সাথে মরিচ মেশানো খেসাড়ির ডাল আর সব্জি। কতদিন ধরে মনে নেই, খাবার বলতে এই অখাদ্য। এতো স্বল্প আহারে আমাদের শরীরের সব হাড় বের হয়ে এসেছে। ঢিলে হয়ে যাওয়া চামড়ার নিচে চ্যপ্টা হাড়। কড়া পড়ে যাওয়া হাতে পানি ডালের ভেতর থেকে হাতড়ে ভাত মুখে পোরা। আর ডালের পানিতে চোখের পানিতে মাখামাখি করে খেয়ে ওঠা। খেয়ে আর ওঠা কই! থালাটা ঠেলে দিয়ে ওখানেই কুণ্ডুলি পাকিয়ে শুয়ে পড়া। নড়ার ক্ষমতা আমাদের নেই। একহাত লম্বা শেকলে বাঁধা মানুষগুলোর রাতভর শুধু ঝন ঝন শব্দ গুনে যাওয়া।

মাঝে মাঝে মনে হয় যেন এমনি করে মুক্তির প্রতীক্ষায় কাটিয়ে দিতে হবে অনন্তকাল। সেই কবে আইলার পানিতে ডুবে গিয়েছিল উঠোন, রাস্তা, ঘের, খটি, ক্ষেত, খামার আর উপার্জনের সব পথ। তাইতো দালালের হাত ধরে এতোদূর পাড়ি দেয়া।

প্রতিদিন ইটভাটার চুল্লির ভেতরে গুমরে ওঠা ধোঁয়া প্রাচীরের গায়ে লাল আগুনের আভা ছড়িয়ে নীরব স্বস্তিতে যখন কাঁপতে থাকে। ঐ আগুনের দিকে তাকিয়ে আমাদের ভেতরকার ভোঁতা বেদনা, পৃথিবীর রূপ-রস-গন্ধ, থেকে বঞ্চিত জীবন্ত মানুষের যন্ত্রণাময় বেদনা, গোলামের বেদনা প্রকাশিত হয়। আর এইভাবে আমরা বেঁচে থাকি আর প্রতীক্ষা করি মুক্তির।


আমরা আসলে কার প্রতীক্ষা করি? কিসের? কারণ শেষ পর্যন্ত ওরা যখন এলো, রাতের অন্ধকার ভেদ করে ক্যামেরার ফ্লাসের ঝলকানিতে ঝলসে যেতে লাগল চারিদিক। আপাত দৃষ্টিতে আমাদের মুক্তি মিলল! পত্রিকার পাতায় পাতায় আমাদের চিড়িয়া হয়ে যাওয়া পোজের ছবি শোভা পাবে। কোনো এক অভিজাত শ্রেণীর শখের লেখকের কলমে ধরা দেবে আমাদের পচে যাওয়া নির্মম কাহিনীও। কিন্তু জানি, এতে করে আদতে আমাদের অবস্থার কোনো পরিবর্তন হবে না। কারণ, পূঁজিবাদের পাহাড়ের নিচে বিপ্লবের উট এখন বিছুলি চিবোচ্ছে।



-------------------------------------------
টিকা: দাদন- অগ্রিম শ্রমমূল্য হিসেবে প্রাপ্ত অর্থ

লেখক পরিচিতি
গাজী তানজিয়া
গল্পকার। ঔপন্যাসিক


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ