বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় ভালবাসার গল্প - মরফোলজি




নির্মলার সঙ্গে মেডিকেল কলেজে যেদিন ঢুকি সেদিনই প্রথম দেখা। আমি আই-এসসি পাশ করে মেডিকেল কলেজে ঢুকেছি, বয়েস উনিশ ।

চোখে প্রথম যৌবনের রঙীন নেশাটেশা একেবারেই ছিল না বললে ভুল বলা হবে, যতই কেন অধ্যয়নপরায়ণ ভালো ছেলে হই না কেন। সেই নেশার ঘোরেই বোধহয় নির্মলাকে স্বর্গের দেবী বলে মনে হলো প্রথম দর্শনেই। ছিপছিপে সুন্দর মেয়ে, টানা-টানা চোখ, জোড়া ভুরু, দিব্যি দেখতে মুখখানি।
নীল রংয়ের শাড়ী পরণে, গায়ে ফুল-হাতা ব্লাউজ, সরু চুড়ি ক-গাছা হাতে। চোখে মুখে একটা দীপ্ত বুদ্ধির ছাপ। নারীসুলভ লজ্জা তার মধ্যে মোটেই নেই। আছে বিদ্রোহিনীর উগ্র চ্যালেঞ্জ। আমার মনে হোত ওর সতর্ক ও সজাগ দৃষ্টি পুরুষজাতকে চ্যালেঞ্জ করছে যে, আমার সঙ্গে বেশি ঘনিষ্ঠতা করতে এসো না, আমি সে ধরনের মেয়ে নই। খবরদার!

সেইজন্যেই যত দিন যেতে লাগলো তত আমি ওর দিকে বেশি আকৃষ্ট হয়ে পড়তে লাগলাম। তখন জানি নে যে, আমার জীবনটা একেবারে মাটি করে দেবার জন্যে ও এসেছে। কার জন্যে আজ আমি এই পয়তাল্লিশ বছরের প্রৌঢ়তায় পদার্পণ করেও অকৃতদার, সস্তান-সন্ততিহীন, ছন্নচাড়া, লক্ষ্মীছাড়া মানুষ ? কার জন্যে সারা জীবন তৃপ্তি পেলুম না, সুখ পেলুম না, আপনার বলতে কাউকে পেলুম না, টাকা রোজকার করতে হয় করে যাচ্ছি, খেতে হয় খেয়ে যাচ্ছি, কলেজে অধ্যাপনা করতে হয়, করে যাচ্ছি, জীবনের না আছে কোনো উদ্দেশ্য, না আছে কোনো অবলম্বন।

শুনেছি অনেকের এরকম হয়, প্রেমের নেশায় পড়ে অল্প বয়সে, সে নেশা কাটিয়েও ওঠে। কিন্তু আমার মত এমন উচ্ছন্নে যায় কে ?

যাক সে সব কথা।

কেমন করে কি হোল বলি।

আমাদের ক্লাসে অনেকগুলি মেয়ে ছিল। কেউ বি-এসসি কেউ আই-এসসি পাশ করে এসে মেডিকেল কলেজের ফাস্ট ইয়ারে ভর্তি হয়েছিল। পাঁচটি মেয়েকে আমার আজও বেশ মনে আছে। একজনের নাম শকুন্তলা সেন, শ্যামবর্ণ, দোহারা চেহারা, বড়-বড় চোখ ও মুখশ্রী মন্দ নয়—হাতের কব্জির কাছটা বড্ড মোটা বলে মনে হোত। শকুন্তলা ছিল বড় শান্ত মেয়ে, কোনোদিকে চাইতো না, একমনে প্রোফেসরের বক্তৃতা শুনে নোট করে যেতো। একজনের নাম সুনীতি, তার উপাধি আমার মনে নেই, ওর রং ছিল খুব ফর্সা গোল চাঁদের মত মুখখানা, ফ্লার্ট টাইপের মেয়ে, ক্লাসের ছেলেদের নাচিয়ে নিয়ে বেড়াতো। একটির নাম ছিল মহামায়া বন্দোপাধ্যায়—সেকেলে নাম কিন্তু বড় একেলে মেয়ে—সুন্দরী হিসেবে মন্দ নয়, অতি চমৎকার গঠন পরিপাট শরীরের, খুব শৌখিন, চোখে চশমা, কথায় কথায় হেসে লুটিযে পড়তো, এটিও ফ্লার্ট টাইপের মেয়ে। মহামায়ার সঙ্গে একসঙ্গে আসতো, ওরই কি রকম বোন হয়, চপলা বন্দ্যোপাধ্যায়। দেখতে শুনতে মহামায়ার চেয়েও ভালো, কিন্তু বড় নিরীহ, ভালমানুষ, সাত চড়ে কথা বের হোত না। আর একটি গরীব ঘরের মেয়ে ছিল, ওর নাম বেলা চক্রবর্তী। মোটাসোটা, ফর্সা সাদাসিদে সুতীর শাড়ী পরে আসতো, সাদা ব্লাউজ ফুল হাতা—সকলের সঙ্গে মিশতো সকলের সঙ্গেই হেসে কথা বলতো— বুদ্ধিশুদ্ধি একটু কম বলেই মনে হোত! এদের সকলের বয়স উনিশ-কুড়ির মধ্যে। সেদিক থেকে আমরা প্রায় সকলে সমবয়সী, এক-আধ-বছরের বেশি বা কম, শকুন্তলা ছাড়া, তার বয়েস ছিল আমাদের চেয়ে তিন-চার বছর বেশি। আমরা আড়ালে নিজেদের মধ্যে বলতাম—শকুন্তলাদি।

যেমন হয়ে থাকে। ক্লাসসুদ্ধ ছেলে ঝুঁকে পড়লো মেয়েদের দিকে। যে যার সঙ্গে জমিয়ে নিতে পারে, প্রাণপণে চেষ্টা করতে লাগলো। মাস দুই অগ্রসর হয়নি, ফাস্ট ইয়ার এম-বি ক্লাস। এরই মধ্যে বেঁধে গেল প্রণয়ের জন্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা ঝগড়া, রেষারেষি। এক এক মেয়ের পেছনে চার-পাঁচটি বা ততোধিক ছেলে। থার্ড ইয়ার ক্লাসে সেবার বিখ্যাত সুন্দরী ফিরিঙ্গি মেয়ে মিস ইভশ্যাম পড়তো— আমরা কলেজে ঢুকেই শুনি, মেডিকেল কলেজসুদ্ধ ছাত্র তার জন্য পাগল। এই ফিরিঙ্গি মেয়েটির নাম চিরকাল লেখা থাকা উচিত মেডিকেল কলেজের অলিখিত ইতিহাসে। অন্ততঃ দুটি আত্মহত্যা ও বহু সংখ্যক উচ্ছন্নে যাওয়ার জন্যে এই মেয়েটি দায়ী। চার-পাঁচটি পিতার বিষয় পুত্র কর্তৃক সমর্পিত হয়েছে এই দেবীর বেদীমূলে অর্থ্যস্বরূপ। তবুও এর আকাঙক্ষা মেটেনি!

আমি মিস ইভশ্যামকে দেখলুম কলেজের বার্ষিক উৎসবে ছাত্রীদের গ্যালারীতে। এই প্রথম তাকে দেখি—খুব চটকদার সুন্দরী বটে। বয়েস বাইশের বেশি নয়। বিদ্যুৎলতা। তবে আমি দূর থেকে দেখেছি এই পর্যন্ত। আরও অনেকবার দেখেছি, লম্বা করিডরের পাশ কাটিয়ে চলে যেতে—কিন্তু ফাস্ট ইয়ারের ছেলেদের সঙ্গে কথা কইবার বা নড় করবার মত সহৃদয়তা মিস ইভশ্যামের ছিল না। ফাস্ট বা সেকেণ্ড ইয়ারের কোনো ছেলেকে সে পুছতো না। কেনই বা পুছবে? তার স্তাবকবর্গের মধ্যে পাশ-করা হাউস-সার্জনরাও ছিল, উচু ক্লাসের ধনী ছাত্র ছিল, শোনা যায় দু-একজন অধ্যাপকও ছিলেন।

আমি ছিলাম লাজুক ও গম্ভীর প্রকৃতির। আই-এসসিতে স্কলারশিপ পাওয়া ছাত্র। লেখাপড়া ছাড়া আর কিছু বুঝতামও না, মেযেদের সসঙ্কোচে পাশ কাটিয়ে যেতেই চিরদিন অভ্যস্ত। লজ্জায় চোখ তুলে অপরিচিত মেয়েদের দিকে চাওয়া ছিল আমার পক্ষে সুকঠিন ব্যাপার। আজকার দিনের কথা নয়, কথা হচ্ছে আজ থেকে ছাব্বিশ বছর আগে। তখন মেয়েরা বেথুন কলেজ ছাড়া অন্য কোনো কলেজে পড়তো না— আর পড়তো মেডিকেল কলেজে। মেয়েরা তখন অনেক ছাত্রের কাছেই অন্য জাতের জীব বা দেবী-টেবী বলে গণ্য হোত।

মেডিকেল কলেজে ঢুকে প্রথম সহপাঠিনীরূপে ওদের পেয়ে—ছাত্রদল যদি ঝুঁকে পড়েই ওদের দিকে, ওদের নিয়ে যদি বাঁধিয়ে দেয় হুড়োহুড়ি—তবে আশ্চর্যের কথাটা এমন কি ?

এই আবহাওয়ার মধ্যে আমি ভালোছেলে রূপে ফাস্ট ইয়ারের তিন-চার মাস দিলাম কাটিয়ে। এর মধ্যেই নির্মলাকে নিয়ে ক্লাসে অনেক কিছু হয়ে গিয়েছে। ধনী ছাত্র শশধর মূহুরী নির্মলার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা করবার চেষ্টা করতে গিয়ে সেই চ্যালেঞ্জ পূর্ণ উগ্র দৃষ্টির সামনে এতটুকু হয়ে গিয়েছে। আরও কয়েকটি ছাত্র চোখরাঙনি খেয়েছে রীতিমত। অথচ ওরাই মহামায়াকে বা সুনীতিকে নিয়ে মটরবিহার করতো, কলেজ রেষ্টুরেন্টে গিয়ে একসঙ্গে খেতো, গেটের কাছে দাড়িয়ে থেকে সঙ্গে করে ট্রামে উঠতো।

আমার কি ছিল, ক্লাসে এসে নির্মলার দিকে চেয়ে থাকতাম যখনই সুবিধা হোত চেয়ে দেখবার। ভয় হোত, বুক টিপ টপ করতো, পাছে নির্মলা কিছু মনে করে। একদিন আমি ওর দিকে চেয়ে আছি, ওব সঙ্গে চোখাচোখি হয়ে গেল। সেও এক অপ্রত্যাশিত ধরনের আশ্চর্য ব্যাপার! আমি ওর দিকে চাইতে গিয়ে দেখি ও-ও আমার দিকে চেয়ে আছে। আমার আগে থেকেও ও আমার দিকে চেয়ে আছে। আমার সারা শরীর দিয়ে যেন বিদ্যুৎ খেলে গেল। কেন নির্মলা আমার দিকে চেয়ে আছে?

আমাকে কি ওর ভাল লাগে ?

নইলে কেন আমার দিকে চাইলে ও !

আমার চেহারা বলতো সকলে ভালো। চিরকাল শুনে এসেছি এই কথা আত্মীয়অনাত্নীয় সকলের মুখ থেকে। আয়নায় নিজের চেহাবা দেখেও খারাপ মনে হয় নি কোনোদিন। দেখতে ভালো বলে বিয়ের সম্বন্ধও দু-একটি আসতে আরম্ভ করেছিলো বড় ঘর থেকে। আমাদের অবস্থাটাও ভালো, কলকাতায় তিন-চারখানা বাড়ী, ভাড়া থেকে মাসিক আয় হোত মন্দ নয়। তারপর আমিও স্কলারশিপ পাওয়া ছেলে। পড়াশুনোয় নামকরা ভালো ছেলে। বিয়ের সম্বন্ধ আসবার অপরাধ কি?

একদিনের কথা আমার মনে আছে।

শ্রাবণ মাসের দিন। কেমিস্ট্রি ক্লাস থেকে বেরিয়ে মাঠে নেমেছি, উদ্দেশ্য কলেজ রেস্টরেন্ট থেকে এক পেয়ালা চা খেয়ে নেবো, এমন সময়ে হঠাৎ আমার পেছনে কে মৃদুস্বরে ডাকলে—

আমি চমকে উঠে পেছনে চাইলুম।
নির্মলা !

নির্মলা আমায় ডাকছে!
আমি এদিক ওদিক চেয়ে দেখলাম। না আর কেউ কোনোদিকেই নেই তো? আমাকেই ডাকচে বটে।
আমি বিস্ময়ের সুরে বললাম—আমাকে ডাকছেন!
নির্মলা বোধ হয় আমার আনাড়ি ও আড়ষ্ট ভাব দেখে হাসতে যাচ্ছিল, হাসির রেখা ওর মুখে ফুটে উঠে মিলিয়ে গেল।

বললে—আপনাকেই ডাকছি–

—ও, বলুন—

—আপনি প্রফেসর গুপ্তের নোট টুকেচেন ?

—হাঁ, টুকেছি।

—খাতাখানা কাইন্ডলি দেবেন একদিনের জন্যে ? কালই ফেরত দেবো।

—নিশ্চয়ই, নিশ্চয়ই! এই নিন। আপনি যে ক-দিন ইচ্ছে রাখতে পারেন।

—না, আমি কালই ফেরত দেবো। থ্যাঙ্কস।

আমি যে সময় ওর হাতে খাতা দিচ্ছি, ঠিক সেই সময় আমাদের ক্লাসের বিশ্ববখাটে ছোকরা সোমেশ্বর গুহঠাকুরতা অদূরে আবির্ভূত হোল, কোথা থেকে কি জানি!

পায়ের শব্দে নির্মলা খাতা নিতে নিতে যেন চমকে উঠে পিছন ফিরে তাকালো। পরক্ষণেই খাতা নিয়ে আর কোনো কথা না বলে হন হন করে চলে গেল।

সোমেশ্বর আমার কাছে এসে দাঁত বের করে হেসে বললে—কি বাবা ভাল ছেলে, ডুবে-ডুবে জল খাওয়া?

আমার রাগ হোল, লজ্জাও হোল। সোমেশ্বরের সঙ্গে আমার এমন কিছু ঘনিষ্ঠতা নেই। অত ঘন-ঘন সিগারেট খাওয়া দেখে আমি ওর সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে আলাপ করতে ঘৃণা করতাম। ওরাও ভালো ছেলে বলে আমায় ঘৃণা করতো। সব কলেজেই বখাটে ছেলেরা ভালো ছেলেদের ঘৃণা করে থাকে।

আমি বললাম—কি ?

—মানে, ধরে ফেলেছি। নির্মলা সরকারের সঙ্গে জমালে কবে থেকে তলায় তলায়?—হু হু বাবা—হাতে-হাতে ধরে ফেলেছি আজ—

—কি বলছেন বাজে কথা? উনি আমার কাছে আজই কেমিষ্ট্রির নোট চেয়ে নিলেন।

—আজই ? মানে আজই ? সোমেশ্বর শর্মা যেদিন দেখে ফেলেচে সেই দিনই ?

—সত্যি বলছি ।

—বেশ বাবা বেশ। তবে বলে দিচ্ছি, বেশি ওদিকে নজর দিও না। হরিপ্রসাদকে চেনো তো? হরিপ্রসাদ ডুয়েল লড়বে তোমার সঙ্গে। সে বড়লোকের ছেলে, নির্মলার জন্যে সে নিজের জমিদারী বিলিয়ে দেবে বলেছে। পয়সা খরচ করতে সে হটবে না।

—বাপের জমিদারী আমারও আছে জেনে রাখবেন।

কথা শেষ করে আমি রেস্টরেন্টের দিকে চলে গেলাম। ওদের মত ছেলের সঙ্গে দাড়িয়ে কথা-কাটাকাটি করতে আমি ঘৃণা বোধ করি। কলেজ থেকে বের হয়ে একটা নির্জন স্থান খুঁজতে খুঁজতে চলে গেলুম গড়ের মাঠে। চিনেবাদাম চিবুতে-চিবুতে কতক্ষণ ভাবলাম আজকার কথাটা। নির্মলা সরকার কি ধরনের মেয়ে আমি জানি। সে দেবী, আমার চোখে অতি পবিত্র। তার নামে কেউ কিছু বললে আমার সহ্য হয় না। এতো মেয়ে তো আছে কলেজে কিন্তু ওকে আমার অত ভাল লাগে কেন? এর জবাব নেই।

সেই নির্মলা আজ আমার সঙ্গে কথা বলছে ? নিজের থেকে ? নোট চেয়ে নিয়ে গেল? কেন আমারই নোট নিয়ে গেল, কলেজে তো কত ছেলে রয়েছে ? ভালো ছেলে বলে নিয়ে থাকে যদি। মধুপ্রসাদ বা মাধোপ্রসাদ বলে একটি জৈন ছাত্র নাকি আমার চেয়ে ভালো—অবিশ্যি এটা শুনেছি আমি তাদের কাছে, যারা ক্লাসে আমাকে হেয় প্রতিপন্ন করতে পারলে খুশী হয়। যাই হোক সে রয়েছে তো?

আজ কি সুন্দর দিনটি আমার! কার মুখ দেখে না জানি উঠেছিলাম।

পরিদিন রবিবার নেশার ঘোরে সারাদিন কেটে গেল। আমার মনে সেই এক ভাবনা—নির্মলা আমার সঙ্গে ডেকে কথা বলেছে। ওর সঙ্গে আর দেখা হবে না। চলে যাবো বহুদূর বিদেশে। অনেকদিন পরে ফিরে আসবো। ওকে দেখিয়ে দেবো আমি কত বড় ত্যাগী। হঠাৎ আমায় দেখে ও অবাক হয়ে যাবে।

এ সব সংকল্প অবশ্য সংকল্পই থেকে গেল! সোমবার ক্লাসে আবার ওর সঙ্গে দেখা হোল। সহজভাবেই ও আমায় খাতা ফেরত দিলে এবং আমিও সহজভাবে নিলুম।

এর পরে মাঝে মাঝে ও আমার কাছ থেকে খাতা নিয়ে যায়। আবার ফেরত দেয় দু-তিন দিন পরে। আমি ভাবি ওকে একদিন নির্জনে দেখা করতে বলবো। কিন্তু খাতা ফেরত নেবার সময় মুখ শুকিয়ে যায়, বুক চিপ টিপ করে, কোনো কথাই মুখ দিয়ে বেরোয় না। কোনো একটি কথাও বেরোয় না। সহজভাবে আমি ওর সঙ্গে ব্যবহার করতে পারি নে দেখলুম। সহজভাবে চলতে চেষ্টা করি, বাইরে দেখাই সম্পূর্ণ সহজভাবেই চলছে–কিন্তু ভেতরে ভেতরে ভয়ানক আড়ষ্ট ও মুখচোরা হয়ে যাই। জিভ শুকিয়ে আসে কেন কে বলবে? বুকের টিপ টিপ শব্দ যেন ও শুনতে পাবে মনে হয়। কিসের একটা ঢেউ গলা পর্যন্ত পৌঁছে গলার স্বর আটকে দেয়।

গোটা ফাস্ট ইয়ার এভাবে কেটে গেল।

অন্য কোনো মেয়ের দিকে আমার মন নেই, তাদের মধ্যে অনেকে কথা বলে আমার সঙ্গে। অত্যন্ত সহজভাবে তাদের সঙ্গে মিশি। দু-একজনকে চা-ও খাওয়াই কলেজের মধ্যে ও বাইরে। কিন্তু নির্মলার বেলা সব গোলমাল হয়ে যায়।

কিন্তু এসব তো সাধারণ কথা।

আসল ব্যাপার হচ্ছে আমার প্রতিদিনের ভীষণ বেদনা ও মনোকষ্ট। সে যন্ত্রণা দিন দিন আমার বাড়ছে। ভেতরে-ভেতরে শুকিয়ে যাচ্ছি। অথচ কাউকে বলতেও পারি নে সে দারুণ যন্ত্রণা। সকাল থেকে সাগ্রহে প্রতীক্ষা করি সে সময়টির, কখন আবার ওর সঙ্গে আমার দেখা হবে।

আটটা বাজলো! এখনো তিন ঘণ্টা। এগারোটার ক্লাস।

দশটা বাজলো অমনি শুরু হলো। কিছুতেই মনকে শাস্ত করতে পারি নে। প্রতিদিন ভাবি, আজ কলেজে গিয়ে ওর সঙ্গে সব কথা খুলে বলবো। কিংবা আশা করি ও আজ হয়তো আমাকে বলবে, চলুন আপনি ও আমি বেড়িয়ে আসি। কিছুই ঘটে না কোনো দিন। -

কি সব যন্ত্রণার দিন আমার গিয়েছে, এখনো মনে করলে আমার হৃৎকম্প হয়। ভগবানের কাছে বলি, অমন অবস্থা যেন অতি বড় শত্রুরও না হয়। পুরো দেড়বৎসর সহ্য করলাম সে যন্ত্রণা।

সেকেণ্ড ইয়ারে উঠে ঠিক করলাম মেডিকেল কলেজ ছেড়ে দেবো। এরকম যন্ত্রণা আর বেশি দিন সহ্য করতে পারবো না। অসহ্য হয়ে উঠেছে আমার পক্ষে। সত্যই অসহ্য হয়ে উঠেছে।

বাড়ীতে বলে সব রাজি করলুম। বললুম ডাক্তারি পড়ায় মন নেই আমার। এবার মড়া-কাটা শুরু হবে। মড়া-কাটা আমার দ্বারা হবে না। ছেড়ে দেবো মেডিকেল কলেজ। বি-এসসি পড়বো।

এই সময় একটা ঘটনা ঘটলো একদিন।

আমার একটা নোট-বই চার-পাঁচদিন হোল নির্মলার কাছে ছিল। হঠাৎ ভাবলুম ওর হোষ্টেলে গিয়ে খাতাখানা নিয়ে আসবো। খুব দুঃসাহসিক সংকল্প। মেডিকেল কলেজের কম্পাউণ্ডের মধ্যেই মেয়েদের হোস্টেল।

বেলা সাড়ে চারটে। কিছুক্ষণ আগে অ্যানাটমির ক্লাস শেষ হয়েচে। দেওয়ান বাহাদুর হীরালালবাবুর নাম-করা ক্লাস, টু শব্দটি করবার যো ছিল না কোনো ছাত্র বা ছাত্রীর। ফিরিঙ্গি ছাত্রগুলো পর্যন্ত চুপ করে থাকতো।

গার্লস হোস্টেলের দরজায় যেতেই দরোয়ান বললে—কাকে খুঁজছেন বাবু? আমি বললাম—মিস নির্মলা সরকার, সেকেণ্ড ইয়ার।

—নামঠো লিখা দিজিযে বাবু ইস স্লিপ মে। মেট্রনকো পাস লে যানে হোগা।

দরোয়ান স্লিপ নিয়ে চলে গেল মেট্রনের কাছে। আমাব বুকের মধ্যে ততক্ষণ বিরাট তোলপাড় শুরু হয়ে গিয়েছে। মুখ শুকুতে আরম্ভ করেছে। মনকে বোঝালাম, কেন! আমি তো ছেড়েই যাচ্চি কলেজ। নির্মলার জন্যে আসি নি। আমি এসেছে আমার নোট-বই নিতে। নির্মলার সঙ্গে আমার কি সম্পর্ক ? বা রে, আমার নোটবই আমি চেয়ে নেবো না? এতে আর কি হয়েছে ? নির্মলা কিছু মনে করে করুক।

একটু পরে দরোয়ান দেখি ফিরে আসছে। আমার বুকের মধ্যে যে গর্ত হয়ে খানিক বসে গিয়ে একটা ভ্যাকুয়ামের সৃষ্টি হোল হঠাৎ দরোয়ান কি বলবে? নির্মলা বিরক্ত হয়ে হয়তো বলে পাঠিয়েছে, এখানে কেন? কাল ক্লাসে দেখা করবেন। ভারি বিরক্ত হয়েছে আমার ওপর। আমার নোট-বইয়ে আমার দরকার থাকতে পারে না? জরুরি দরকার থাকতে পারে না ? তুমি, এনেছিলে কেন আমার নোট-বই ? বেশ তো ?

দরোয়ান এসে বললে—আইয়ে বাবু! ভিজিটার্স রুমমে বৈঠিয়ে।

ভিজিটার্স রুমে বসতে বলে যে! তাহলে নির্মলা চটে নি। না, তা কেন চটবে। চটবার কি আছে এর মধ্যে।

ভিজিটার্স রুমে গিয়ে বসবার একটু পরেই একখানা ফিকে নীলরঙের শাড়ী পরে স্যাণ্ডাল পায়ে দিয়ে নির্মলা হাসিমুখে ঘরে ঢুকলো। পিঠে চুল খুলে এলিয়ে দেওয়া। ক্লাস থেকে ফিরে স্নান করেছে।

ও ঘরে ঢুকে বললে--কি ব্যাপার? আপনি যে হঠাৎ?

আমার মনে অবদমিত আবেগ যেন উত্তাল হয়ে উঠলো বুকের মধ্যে। এখানে তো কেউ নেই। নির্মলা—নির্মলা সরকার আমার সামনে। শুধু দু-জন এই ঘরের মধ্যে। কেউ নেই। কোথাও কেউ নেই। বলে ফেলি। এমন সুযোগ জীবনে আর আসবে না। দেড় বৎসরের মধ্যে মহা প্রতীক্ষিত সেই পরম শুভ মুহুর্তটি আজ সমাগত এই মেয়েদের হোস্টেলের নির্জন ভিজিটার্স রুমে। ছেড়ো না এ সুযোগ। যা হয় হবে। হয় এস্পার—নয় ওস্পার।

আমি ওর চোখের দিকে চাইলাম। নির্মলাও আমার চোখের দিকে দেখি চেয়ে আছে। আমার মনে হোল, অবশ্য আমার ভুল হোতে পারে তবে আমার আজও তাই ধারণা—যে ওরই চোখে সেদিন প্রতীক্ষার দৃষ্টি দেখেছিলাম। অতি অল্পক্ষণের জন্যে একথা আমার মনে হয়েছিল। তার পরেই ওর দিকে চেয়ে আমি বললাম— নোট-বইখানা নিতে এসেছি—

—ও

—কাল একবার ভেবেছিলুম আসব—

নির্মলা আবার যেন প্রতীক্ষা ও আহ্লানেৰ দৃষ্টিতে আমার দিকে চাইলে। দেবীর মত রূপ। কি উজ্জ্বল মুখ-চোখ, কি ঢেউ খেলানো কালো মেঘের মত একরাশ চুল। অপূর্ব রূপ ফুটেঞ্ছে ওর। আমি চেয়ে চোখ নামিয়ে নিলাম। কেন চোখ নামিয়ে নিলাম? আজ আমার মনে হয় আমি ভুল করেছিলাম। মেয়েদের রূপ পুরুষের পূজোর জন্যে নয়। তাকে আকৃষ্ট করবার জন্যে। নির্মলা আশা করে এসেছিলো সেদিন। ওর আশা আমি ভঙ্গ করেছিলুম সেদিন–নিজের ভীরুতার জন্যে।

ও বললে—তবে এলেন না কেন!

--আসতে পারি নি শেষ পর্যন্ত, কাজ ছিল।

আর একটি আশ্চর্য কথা ও বললে। সে কথা ও যে আমাকে বলবে এমন আশা করিনি। তবুও বলি, এ কথার গুরুত্ব তখন তত বুঝি নি, পরে যত বুঝেছিলাম।

ও বললে—কাজ থাকলে বুঝি আমার কাছে আসা যায় না?

আমি শুধু বোকার মত হাসলাম।

নির্মলা আবার বললে—বলুন না?

—না-না-না—তাই দেরি হয়ে গেল কি-না? আমার উত্তরের বিশেষ কোনো মানে হয় না। অসংবদ্ধ প্রলাপ ।

—কিসের দেরি হয়ে গেল?

—না, দেরি হয় নি। এমনি বলছি।

—আপনি অদ্ভুত লোক।

—কেন ?

-—কেন? আপনাকে কি বোঝাবো। নিজে বুঝতে পারেন না ? বসুন, আমি খাতাখানা আনি।

আমি তো বুঝতে পারলুম না, কিসে আমি অদ্ভুত লোক হোলাম। নির্মলার এ কথার মানে কি ? একটু পরে ও ফিরে এলো। এসে একটি অদ্ভুত কাণ্ড করলে। খাতাখানা আমার হাতে দিয়ে হঠাৎ ঈষৎ নিচু হয়ে যেন আমার দিকে এগিয়ে ঝুঁকে পড়ে আমার মুখের ওপর দৃষ্টিপাত করে মুখ সরিয়ে নিলে। আর মুখ ফিরিয়ে নিয়েই সরে গেলো এবং খিল খিল করে হেসে উঠলো। আমার মাথা ঘুরে উঠলো। গম্ভীর ও সংযত মেয়ে নির্মলা ক্লাসের মধ্যে। তার একি লীলা! আমি খাতা হাতে নিয়ে উঠে বললুম—তবে আজ আসি। নির্মলার মুখের হাসি মিলিয়ে গেল, বললে—বসুন না?

—যাই। বেলা গিয়েছে। কাজ আছে বাড়ীতে।

—চললেন তা হোলে ? ডিসেকশ্যন রুমে দেখা হবে কাল তো?

—হ্যা, যাই।

—কাল ডিসেকশ্যন রুমে আসবেন তো ঠিক ?

—আসবো। নির্মলা ফটক পর্যন্ত এগিয়ে এল। আমি টলতে-টলতে বাইরে এলাম। বাইরে এসে বাড়ী যাবার পথে কতবার ভাবলাম নির্মলার এ অদ্ভুত আচরণের অর্থ কি? ও তো অতি গম্ভীর মেয়ে। অন্য কারো সঙ্গে তো কথাই কয় না ভালো করে। আমাকে কি অন্য চোখে দেখে ? কি জানি।

বাড়ীতে তখন আমার বিয়ের জন্যে খুব পীড়াপীড়ি চলছে। বিয়ে করা আমার পক্ষে অসম্ভব।

নির্মলা আমার চোখে ও মনে জ্বল জ্বল করছে। অন্য মেয়েকে ওর আসনে বসাতে হবে?

নির্মলা খুব বড় লোকের মেয়ে। অভিজাত ও উচ্চ শিক্ষিত পরিবারের মেয়ে ও। আমি খোঁজ নিয়ে দেখেছি। ওকে পেতে যাওয়া মানে বামন হয়ে চাঁদে হাত। আমার মত একজন নগণ্য ছেলেকে মেয়ে দেবে—ওর মা-বাপ ?

আমি কলেজ ছেড়ে দিলাম...

কলেজে তিলে তিলে দগ্ধ হোতে পারবো না আমি। মেডিকেল কলেজে মড়াকাটা আমার দ্বারা হবে না। -

বি-এসসি পড়লুম, প্রথম শ্রেণীর অনার্স পেলুম। এম-এসসিতে দ্বিতীয় শ্রেণী বটে, কিন্তু সেবার আমার বিষয়ে প্রথম শ্রেণীতে কেউ ছিল না।

কলকাতায় একটা কলেজের অধ্যাপকের চাকরি জুটে গেল সহজেই। ডেপুটি ম্যাজিস্টেট হওয়া কঠিন হোত না, কিন্তু আমি নির্ঝঋটে কাটাতে চাই জীবন। পয়সার অভাব নেই আমার ভগবানের ইচ্ছায়। কার জন্যেই বা অত খাটতে যাবো? না বিয়েথা, না ছেলেপূলে, বেশ আছি।

নির্মলার কথা ভুলি নি। তার জন্যেই বিয়ে করতে পারলুম না। এ যে কি টান, কি মোহ, কি করে বলবো। মন থেকে কিছুতেই তাড়াতে পারলাম কই ?

নির্মলার বিয়ে হয়েছিল একজন বিলেত-ফেরত ডাক্তারের সঙ্গে। নিজে সে একজন লেডি ডাক্তার ; কবার তার সঙ্গে দেখা হয়েছিল কিভাবে তা বলি।

লেডি ডাফরিন হাসপাতালে নির্মলা তখন কাজ করে, আমি জানতাম।

রোজ কলেজ থেকে বেরিয়ে লেডি ডাফবিন হাসপাতালেব কাছে এসে মুখ উঁচু করে দাঁড়াই। সম্পূর্ণ অকারণে, কেন দাঁড়াই নিজেই তা জানি নে। কলেজের ছুটির পর পা দু-খানার গতি হয় লেডি ডাফরিন হাসপাতালের দিকে—আপনিই হয়। যে সময়ের কথা বলছি, তখনও নির্মলাব বিবাহ হয় নি।

একদিন ওই রকম অভ্যাসমত এসে দাঁড়িয়েছি স্কট্স লেনে, হাসপাতালের ঠিক নিচে । এমন সময় এল বর্ষা। সেটা ছিল আশ্বিন মাস। আমার কাছে ছাতি নেই— ছাতি বওয়া আমার অভ্যাস নেই। দাঁড়িয়ে ভিজছি, সরে যেতে ইচ্ছে করছে না, ভিজে যাচ্ছি তবুও কিসের আশায় চাতক-পাখির মত আকুল আগ্রহ নিয়ে মুখ উঁচু করে দাঁড়িয়ে অসাড়ে ভিজছি—বোধহয় সাধনার কঠোরতায় সিদ্ধি আসে সর্বসিদ্ধিদাতা ভগবানের কাছ থেকে। তিনিই দক্ষিণ পাণি প্রসারিত করে অকপট সাধনার ফল হাতে হাতে দেন। তাই শব-সাধনার এত নাম আমাদের দেশে। রাতারাতি সিদ্ধিলাভ। শব-সাধনা টব-সাধনা যাক গে।

আমার ফল এল সম্পূর্ণ প্রত্যাশিত ভাবে। এখনও তা ভেবে অবাক হয়ে যাই। হঠাৎ রাস্তার দিকের জানলা খুলে গেল হাসপাতালের দোতলায়। একটি মেয়ে উঁকি মেরে রাস্তায় আমায় দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থায় দেখলে। আমি চিনলাম, সে নির্মলা।

নির্মলা কিন্তু আমাকে একবার দেখেই হাত দিয়ে এগিয়ে যেতে ইঙ্গিত করেই জানলা থেকে তখুনি সরে গেল।

আমি তো অবাক। আমার রক্ত তখন দ্রুত স্রোতে বুকের দিকে ঠেলে উঠছে। আমি তাড়াতাড়ি এগিয়ে গেলাম। হাসপাতালের গেটের কাছে নির্মলা দাঁড়িয়ে আছে, হাতে একটা ছাতি। আমি এগিয়ে গেলাম, কতকাল পরে দেখা। ও হাত জোড় করে বললে—নমস্কার, কোথায় আছেন, কি করছেন ? কতদিন পরে দেখা—



—হ্যা—ইয়ে—তাই—

—কি, করছেন আজকাল ?

—কলেজ প্রফেসরি করি। ছুটির পরে এ পথে আসছিলাম, তাই, বৃষ্টি এল হাসপাতালের কাছে, ওই জায়গায়—তাই—

—এম-এসসিতে তো ব্রিলিয়ান্ট রেজাল্ট করেছিলেন। বিলেত গেলেন না কেন ? আপনি তো স্টেট স্কলারসিপ পেতেন—

—না, কি হবে গিয়ে ?

পরক্ষণেই সংশোধন করে নিয়ে বললাম—বাবার শরীর খারাপ। আপনি এখানে কি করছেন ?

—রেসিডেন্ট হাউস সার্জেন। আমি তো আর বছর পাস করে বেরিয়েছি–

নির্মলার দিকে চেয়ে দেখলাম ভাল করে। বালিকার চাঞ্চল্যের লেশমাত্র নেই ওর মধ্যে, এসেছে সুন্দরী পূর্ণ-যৌবনের দীপ্তি ও গাম্ভীর্য। একটু যেন মোটা হযে পড়েছে—তবে আমারই চোখে পড়লো, অন্য কেউ দেখলে ওকে মোটা বলবে না। মধুত্তে পূর্ণিমা চন্দ্রের পূর্ণতা।

নির্মলাও দেখি আমার দিকে চেয়ে আছে। নির্মলা কি বুঝতে পেরেছে আমি রোজ ওর হাসপাতালের পাশে দাঁড়িয়ে থাকি? আরও কোনোদিন দেখেছে নাকি ?

আমি বললাম—ভালো আছেন?

—মন্দ নয়। আপনি মেডিকেল কলেজ ছাড়লেন কেন? ক্লাসের মধ্যে সবচেয়ে ভাল ছেলে ছিলেন তো।

আমি ওর কথা উডিযে দেওয়া সূচক হেসে বললাম—-ও কিছু না। কত ভাল ছেলে ছিল। আপনিও তো খুব ভাল ছাত্রী ছিলেন। আমার মড়া-কাটা পছন্দ হোল না।।

ও খপ করে একটা প্রশ্ন করে বসলো। এ প্রশ্নের জন্য আমি প্রস্তুত ছিলাম না। বড় ব্যথা দিলে প্রশ্নটা করে। বললে—বিয়ে করেছেন ?

—না। আচ্ছা—নমস্কার—

—দাঁড়ান, দাড়ান-ছাতিটা নিয়ে যান। ভিজছেন দেখে ছাতিটা নিয়ে এলাম। কাউকে দিয়ে পাঠিয়ে দিলেই হবে।

চলে এলুম ছাতি নিয়ে। নিজে যাই নি। ছাতি অন্যের হাত দিয়েই ফেরত পাঠিয়ে দিয়েছিলাম।

এর পরের বছরই কি সেই বছরই নির্মলার বিবাহের সংবাদ পাই। এর পরে নির্মলার সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল আর একটিবার।

আর্মহাস্ট স্ট্রীট বেয়ে আমি হেঁটে যাচ্ছি। হঠাৎ একটা মোটর দাঁড়িয়ে গেল পাশে।

নারীকণ্ঠে কে বললে—এই যে, নমস্কার—। চেয়ে দেখি নির্মলা। বেশ মোটা হয়েছে। আমার লজ্জা হোল হঠাৎ এভাবে ওর সঙ্গে দেখা হওয়াতে। কারণ আমিও মেদবৃদ্ধি পথে কম অগ্রসর হই নি। ওর চেয়ে দুজনের পাল্লাপাল্লিতে বোধহয় আমিই জিতবো।

—কোথায় যাচ্চেন? আসুন গাড়ীতে—উঠুন—

ও একাই ছিল গাড়ীতে।

—না, আর গাড়ীতে উঠবো না। ধন্যবাদ। এই তো সুকিয়া ষ্ট্রীটে যাবো—

—গাড়িতে আসুন না? নামিয়ে দেবো ওখানে—সুকিয়া স্ট্রীটের কোথায় বলুন।

—না না থাক, থ্যাঙ্কস্—ওই তো পাশের গলি, মোড়ের মাথায়। কতটুকু— নমস্কার—আমার অসহ্য হোল। আর দাঁড়াতে পারলুম না। নিজে মোটা হয়েছি বলে লজ্জাও হোল ওর সামনে দাড়াতে।

এর পর আর ওর সঙ্গে দেখা হয় নি।

সে আজ বহু বৎসরের কথা। সতেরো-আঠারো বছর আগের কথা। দিন যায় যত, নির্মলার কথাও তত ভুলি। ক্রমে নির্মলার ছবিও অস্পষ্ট হয়ে এসেচে।

এমন সময় সেদিন এক ব্যাপার হয়ে গেল। মাস-খানেকও হয় নি।

আমাদের কলেজে বি-এসসি প্র্যাকটিকাল পরীক্ষা হচ্ছে। অন্য কলেজের কয়েকটি মেয়ে পরীক্ষা দিচ্ছে। মেয়েদের পরীক্ষা আমি তত্ত্বাবধান করছি ও পাহারা দিচ্ছি সেই রুমে।

একটি মেয়েকে দেখেই আমার মন ছাত করে উঠলো। আমি অবাক হয়ে ওর মুখের দিকে চেয়ে রইলুম। এর মুখ আমার সুপরিচিত। মনে হোল অনেকদিন আগে একে চিনতাম। আমি ওর মুখের দিকে চেয়ে ভাবছি একে কোথায় দেখেছিলাম প্রথম যৌবনের কোনো দিন।

হঠাৎ আমার চমক ভাঙলো। কি মনে করবে। আমি প্রৌঢ় অধ্যাপক। ওরা অন্য কলেজের মেয়ে, আমাকে চেনে না, কি ভাবতে পারে।

মেয়েটির ব্যাপার দেখে বুঝলুম সে ফাঁপরে পড়েছে। দুটি প্রশ্ন আছে উদ্ভিদ বিজ্ঞানের। একটি হিস্টোলজির, অপরটি মরফোলজির। মেয়েটি একটি লতার অংশ সরু করে কেটেছে। কিন্তু কিছুতেই সেটাকে রাঙাতে পারছে না। তিনবার, চারবার ধরে চেষ্টা করলে। ওর হাত কাপছে, চোখে জল টলমল করছে।

আমি দেখলুম মেয়েটি এ কাজ কখনো মন দিয়ে করে নি। সিনেমা দেখে বেড়িয়েছে, ক্লাসে ফাঁকি দিয়ে এসে এখন নিজেই ফাঁকে পড়ে গিয়েছে ।

কাছে গিয়ে বললুম—কি হচ্ছে খুকী ?

মেযেটি কাঁদো কাঁদো সুরে বললে—সেকশনটা স্টেইন নিচ্ছে না—জডিয়ে জডিয়ে যাচ্ছে—আমি হেসে বললাম—তুমি কোন কলেজেব স্টুডেন্ট ?

—স্কটিশচার্চ।

—সেকশন কাটতে শেখো নি তো ? এতো মোটা করে সেকশন কাটে ? তাছাড়া দেখছো না এ লতায় লাল হড়হড়ে আঠা রয়েছে। ওটা অ্যালকোহলে ধুয়ে না নিলে কখনো স্টেন নেয় ? ওটা অ্যালকোহলে ওয়াশ করে নাও।

মেয়েটি আমাব কথায় অ্যালকোহলে ধুতে গেল। কিন্তু মা লক্ষ্মী দেখলুম সিনেমা দেখেই কাটিয়েছেন। লেখাপড়া কিছুই করেন নি।

বললাম—ও কি হচ্ছে ? তুমি অ্যালকোহলে ধুতে জানো না? গ্রেডে তোলো— নইলে সেকশনটা গুটিয়ে যাবে যে। আগে কুড়ি, তারপরে পঞ্চাশ, তাবপবে সত্তর, তারপরে নববুই—তারপর অ্যাবসলিউট অ্যালকোহলে তোলো—

—কেন, লাইজল দিয়ে ধুয়ে ফেলবো না?

—পাগল, লাইজল দিয়ে এখন ধোবে কেন ? অ্যাবসলিউট অ্যালকোহলে আগে তোলো। ওর হাত কাঁপছে। কখনো একাজ করেনি। গ্রেডে তোলা কাকে বলে তাই ভালো করে শেখেনি। হাতে-কলমে করতে, আমার মায়া হোল। বললুম—ছেড়ে দাও খুকী—তুমি মরফোলজির কোশ্চেনটা ট্রাই কবো-আমি দেখছি–


আমি ল্যাববেটরীর হেড অ্যাসিস্টান্ট নরেনকে ডাকলুম। নরেন আমারই ছাত্র, প্র্যাকটিক্যাল কাজে ঘুণ। তাকে বললাম—নরেন, এই সেকশনটা মাউন্ট করে নিয়ে এসে দাও তো ?

নরেন আমার মুখের দিকে চেয়ে দেখে সেকশনটা হাতে নিয়ে চলে গেল। হয়তো ভাবলে প্রৌঢ় অধ্যাপকের এ দুর্বলতা কেন? সুন্দরী মেয়ে দেখে তাকে পরীক্ষায় বে-আইনি সাহায্য করছেন।

একটু পরে নরেন বেশ চমৎকার ভাবে নিপুণ হস্তে সেকশনটা শ্নাইডের ওপর বসিয়ে কানাদা বালমম দিয়ে বন্ধ করে আমার হাতে এনে দিলে। আমি নিয়ে গিয়ে বললাম—এই নাও খুকী।

তার প্রশ্নের উত্তর বে-আইনি ভাবে পেয়ে মেয়েটি কৃতজ্ঞতামূলক হাসলে। অনেকদিন আগে এ হাসি কোথায় দেখেছি। এ হাসি আমার কুয়াশাচ্ছন্ন জীবন-দিনের প্রথম অরুণবাগের হাসি। বিস্মৃত অরুণবাগের সে শুভ ক্ষণটি আজও কি ভুলেছি?

মৃদু কৌতুহলের সুরে প্রশ্ন করলুম—তোমার নাম তো নীলিমা বসু লেখা রযেচে-- তোমাদের বাড়ি কোথায় ?

—লোয়ার সারকুলার রোড, ডাক্তার বিভাস বসুকে চেনেন?

—ডাক্তার বিভাস বসু—আই স্পেশালিস্ট?

—হ্যা, তিনি আমার বাবা।

—ও |

—আমার মাথা ঘুরে উঠলো। ডাক্তার বিভাস বসু নির্মলার স্বামী। মেয়েটি হেসে বললে—আসবেন আমাদের বাড়ি। বাবা বড় খুশী হবেন।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ