মোমিনুল আজমের গল্প : লালু সেন ও আমরা


আমাদের তখন শরতের আকাশে পেজো তুলোর মতো মেঘের দিকে তাকিয়ে ক্ষীণ কটির  কোন কিশোরীর অবয়ব কল্পনা করে তাকে নিজের করে পাবার ইচ্ছায় ঘন্টার পর ঘন্টা কাটিয়ে দেয়ার বয়স, রেল লাইন ধরে হাঁটতে হাঁটতে কুন্ডলী পাঁকিয়ে সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়ার  প্রাকটিস করে সিগারেটে আত্নস্ত হওয়া, বড় ভাইদের দেখে জ্বলন্ত সে সিগারেট লুকোতে গিয়ে হাত পুড়িয়ে ফেলা, আগুন গরম চা কেবল ঠোঁটের কাছে, এমন সময় মামা, চাচা বা বড় ভাইয়ের বন্ধু আসছে, বাজার থেকে বাঁচানো টাকার  সে চা তাড়াতাড়ি শেষ করতে জীবের ওপরটা খসখসে করে ফেলা, আগামী দুতিনদিন খেতে বসে মাছ মাংশ, তেল নুনের আর কোন স্বাদ না পাওয়ার জ্বালা নিয়ে বেড়ে ওঠার সময়।


এসময়টায় কারো কাছে আদুরে কিশোর হিসেবে পাত্তা না পেয়ে বরং সন্দিহান দৃষ্টির মাঝে অসহ্য যন্ত্রনা নিয়ে বেড়ে ওঠা। ফটিকের মনস্তাত্নিক বিশ্লেষণ রবীন্দ্রনাথ করেছেন ঠিকই কিন্তু আমাদের মনস্তাত্নিক বিশ্লেষণ করে কেউ কাছে টেনে নেয় নি। তাছাড়া চেহারায় শিশুসুলভ কমনীয়তার পরিবর্তে লিকলিকে তালগাছ গড়নের অবয়ব নিয়ে বেড়ে ওঠার অসামঞ্জস্যতা তো আছেই। রাস্তায় কিংবা বাসার ছাদে ফ্রক পরা কোন মেয়ের সাথে আর্কিমিডিসের সুত্র নিয়ে কথা বলতে দেখলেও দুর থেকে অভিভাবকরা সন্দেহের চোখে তাকায়। খানিক পর সেই অভিভাবক জোর গলায় ডেকে ওঠেন-শিউলি, কই গেলি। পড়ি মড়ি করে সে মেয়ে হয়তো ছোটে, যাই, বাবা ডাকছে।


লালু সেন আমাদের এ অবস্থা শুনে মিটমিট করে হাসে। বড় ভাই বা মুরুব্বিরা যতোক্ষণ না তার দোকানের সামনে এসে দাঁড়ায়, ততোক্ষণ লালু সেন আমাদের এ যাতনার কথা আগ্রহ নিয়ে শোনে। যখনই তারা দাঁড়িয়ে যায় দোকানের সামনে তখনই চোখের ইশারা করে। সে ইশারা আমাদের বুঝতে দেরি হয় না। অর্থাৎ তোমরা এখন যাও, নতুন খদ্দের এর কাছে আমারে কিছু বেঁচতে দাও। দাদার সাথে আমাদের সম্পর্ক যত গভীরই হোক না কেন ব্যবসার এ জায়গায় দাদা কোন ছাড় দেয় না। তার ব্যবসার খাতিরে আমরাও এটা মেনে নেই। টং দোকান থেকে বের হয়ে আমরা পাশে উঠতে থাকা দোকান ঘরের পাঁচ ইঞ্চি ওয়ালের ওপর বসে পা দুলিয়ে গল্প চালিয়ে যাই। মুরুব্বিরা চলে যাওয়ার পর আমরা আবার এসে বসি লালু সেনের দোকানে। আমরা আবার গল্পে মশগুল হয়ে উঠি। সাথে চলতে থাকে লালুদার দোকানের বিস্মাদ চা আর ক্যাপষ্টেন সিগারেট। মাঝে মাঝে দাদা আধা পানের মাঝে চুন লাগিয়ে কাচা সুপারি পেঁচিয়ে দিতে দিতে বলেন-

-আরে দাদা খাও, খাও! অভ্যেস করো। বিয়ের পর রাঙ্গা ঠোঁটে বৌয়ের সাথে গল্প করতে হবে না। 

বিয়ের কথা শুনে এ বয়সে লজ্জা পাওয়ার কথা। কিন্তু দাদার কাছে আমাদের লজ্জা শরমের কোন বালাই নেই। দাদা নিজেই এসব বিষয়ে আমাদের লজ্জা শরমের মাথা খেয়েছে। বিয়ের পর দাদা দাদীর সাথে কী কী করেছে, তা রসিয়ে রসিয়ে বর্ণনা করে। জব্বারের বিয়ের উদাহরণ টেনে বলে, দেখ দাদা, দুই বছর এই আমার দোকানে থেকে স্কুল যাওয়ার সময় মেয়েটার পিছু নিয়ে প্রেম করলো, তারপর পালিয়ে নিয়ে বিয়ে করলো আর বিয়ের ছয়মাসের মাথায় ছাড়াছাড়ি। এটা কোন প্রেম হলো! আরে তোমার দাদীরে তো আমি বিয়ের আগে চোখেই দেখি নি, তারপরও বিয়ের একবছর পর্যন্ত তো একদিনও কামাই দেই নি। রসময় গুপ্তের অসম্ভব ভক্ত মাসুম এ কথায় রসের খোঁজ পেয়ে দাদাকে ছেঁকে ধরে। দাদা পানের মধ্যে খয়ের, চুন মাখাতে মাখাতে বলে, তোমার মতো মাকুন্দা মার্কা চেহারা নিয়ে দাদা একাম করতে গেলে তৃতীয় দিন আর বিছানা থেকে উঠতে পারবা না। দাদার আচমকা শেল খেয়ে মুখ বিকৃত করে মাসুম অন্যদিকে তাকিয়ে থাকে।

কলেজের চতুর্দিকে তখনো ইট-সিমেন্টের প্রাচীর ওঠেনি। কলেজের গেট একটা ছিলো বৈকি তবে তা সবসময় হাট খোলা থাকতো। গেটের উপরে দুটি লোহার খুঁটি দিয়ে সবুজ রংয়ের টিনের পাতে কলেজের নাম লেখা। পাশেই শহীদ মিনার। অরক্ষিত সে শহীদ মিনারে কুকুর গরু ছাগল উঠে দিব্যি দিবানিদ্রা সেরে নিতো। তাদের সে নিদ্রায় ব্যাঘাত ঘটানোর মতো কেউ ছিলো না। কলেজে ঢোকা কিংবা বের হওয়ার জন্য খুব কম সংখ্যক ছাত্র-ছাত্রী ইট বিছানো রাস্তার কলেজের গেট ব্যবহার করতো। শহর থেকে এসে অধিকাংশ ছাত্র ছাত্রী নামতো লালু সেনের দোকানের সামনে। তারপর ফাঁড় রাস্তা ধরে হেঁটে যেত মুল ক্যাম্পাসে। সাধারণত ছাত্রীদের রিক্সাগুলো ঝনঝন শব্দ তুলে কলেজ গেট দিয়ে প্রবেশ করতো। হুট তোলা সে রিক্সার দুপাশে শক্ত করে ধরে থাকতো ছাত্রীরা। শহর থেকে যে সকল রিক্সা শেয়ারে ছাত্র বহন করতো তাদের গন্তব্য ছিলো লালু সেনের দোকান। আরোহীকে জিজ্ঞেস না করে দোকানের সামনে এসে সে রিক্সাগুলো সাঁ করে ঘুরে যেত।

ছাত্র ছাত্রীর কাছে এতো যে পরিচিত লালু সেনের দোকান, তা কিন্তু আহামরি কিছু ছিলো না। মুল রাস্তা থেকে চার পাঁচ হাত দুরে দোকানের অর্ধেকটা মাটিতে আর অর্ধেকটা ডোবার উপর খুঁটি দিয়ে ঝুলে ছিলো। বাঁশের বেড়া দেয়া ঘরের যেখানটা মাটির উপর সেখানে বসার জন্য ছিলো একটা বেঞ্চ। ডোবার উপর ঝুঁলে থাকা অংশে শক্ত মাঁচানের উপর বসতো লালু সেন। গরমের দিনে একটা ময়লা চিটচিটে স্যান্ডো গেঞ্জি আর একটা লুঙ্গি হাটুর উপরে তুলে যাতা দিয়ে সারাদিন সুপারি কাঁটা, পান বানানো, বিড়ি সিগারেট, বিস্কুট কলা বনরুটি বিক্রি করতো। শীতের দিনে খালি গায়ে একটা চাদর পেঁচিয়ে একই কাজ করতো লালু সেন। পিছনের অংশে ছিলো চা বানানোর উনুন। সে উনুনে সারাদিন ধিকি ধিকি করে জ্বলতো চায়ের কেটলি, সর পরা দুধের ছোট হাড়ি। একটা ছোট ছেলে চা বানিয়ে এগিয়ে দিতো সবাইকে। যেদিন ছেলেটি থাকতো না সেদিন দাদার কষ্ট যেত বেড়ে। প্রমান সাইজ ভুঁড়ি নিয়ে বারবার মাঁচান থেকে নেমে চা বানাতে তার কষ্টই হতো।

আমাদের মাঝে রুমুর ছিলো সবচেয়ে বেশি ভাব। এ বয়সে দায়িত্ববোধের বিষয়টি প্রাধান্য পায় না কিন্তু ওর ছিলো দুনিয়ার দায় দায়িত্ব। পাড়ার কারও বিপদ আপদে নিজের বিপদ ছেড়ে অন্যের বিপদ উদ্ধারে ঝাঁপিয়ে পড়তো । ওর এই মুরুব্বী স্বভাবের কারনে ওকে সবাই আমরা বুড়া করে ডাকতাম। দাদা যখন গল্প করতে করতে একটু বেশি বলে ফেলতো, এই যেমন একদিন বলতে ছিলেন-'আরে দাদা যুদ্ধের সময় মিলিটারি আইসা এই দোকানের চা খাইয়া আমারে টাকাও দিয়া গেছে'! এ কথা শুনে রুমু বলে-দাদা, গুলতানি মারা বন্ধ করেন। যুদ্ধের সময় তোমার মতো মালুরে পাইলে, মিলিটারি কচু কাঁটা করতো।'

কথা শুনে দাদা চুপ হয়ে যায়। কিছুক্ষণ পর সামলে নিয়ে বলে-দাদা, তোমার নানীরে জিগাইও তো, জন্মের সময় তোমার মুখে মধু দিছিলো কিনা? 

দাদার দোকানে বসে কলেজের কে কার সাথে প্রেম করছে, ক্লাস শেষে পিছু নেয়া কোন ছেলেকে কোন মেয়ে সেন্ডেল তুলে দেখালো, রিক্সায় করে আসার সময় কে তার বান্ধবীর পিছনে হাত দিয়ে থাকতো, এসব কথা গোগ্রাসে গিলতো নাহীন, আকার আকৃতিতে আমাদের সবচেয়ে ছোট সদস্য। রাস্তা দিয়ে নীল সাদা রংয়ের স্কুল ড্রেসের একটা ছোটখাটো মেয়েকে দেখে দাদা যখন বলতো-নাহীন, তোমারে দিয়ে মানাবে ভালো। সে তখন চোখে মুখে অস্বস্থিকর একটা ভাব নিয়ে আসতো, মনে হতো আর একটা কিছু বললেই কেঁদে ফেলবে। এ অবস্থায় কিছুক্ষণ কোন কথা না বলে হঠাৎ উঠে বলতো-নাহ বাসায় যাই, মা খুঁজবে।

দাদা আবারও বলতো-যাও, যাও দাদা, তাড়াতাড়ি যাও, মায়ের আঁচল ধরে থাকো গে-।
সে কথা শুনে মুখে আষাঢ় মাসের একগাদা মেঘ এনে চলে যেত। পরপর দুদিন হয়তো আর আসতো না। তৃতীয় দিন এসে বলতো-দাদা, আপনার কথায় মাইন্ড করি নাই।
দাদা হয়তো ভুলেই গিয়েছিলেন সে কথা। শোনার পর বললেন- মাইন্ড করো নাই, ভালো কথা, সে আনন্দে সবাইরে চা খাওয়াও। এই বলে দাদা চা রেডি করতে উঠে গেলেন। আমরা সবাই দাদার উপর ভীষন খুশি। নাহীন কিছুটা বিব্রত হয়ে বলে-দাদা, আমার কাছে তো পয়সা নেই।
দাদা তৎক্ষনাত বলে- কেন, আমার খাতা আছে না।
নাহীনের উপর ভর করে দাদার চার পাঁচ কাপ চা বিক্রি হয়ে যায়।

দাদা আসলে এমনই। কে তার কথায় রাগ করলো, মন খারাপ করলো এসবের তিনি ধার ধারেন না। আর তার দোকানে এতো লোকের আনাগোনা যে সবার মন রক্ষা করে চলাও তার পক্ষে সম্ভব হয় না। কলেজের নেতা, পাতি নেতা, উপ নেতা সবাই তার দোকানে একবার না একবার বসে। সবাই দাদার সাথে মন খুলেই কথা বলে। মফস্বলের কোন নতুন নেতা এসে দোকানে বসে হয়তো দুকাপ চায়ের কথা বললো। দাদা তার স্বভাব মতো যাতা দিয়ে সুপারি হয়তো কাটতেই আছে, তার দিকে কোন খেয়াল নেই। কিছুক্ষণ পর হয়তো সেই পাতি নেতা বলে- কী চা দিতে বললাম না?
আরে রইসো, এতো ত্যাজ দ্যাখাও ক্যা- বলে হয়তো দাদা সেই পাতি নেতার জন্য চা ই বানালো না। পাতি নেতা গজ গজ করে উঠে যাওয়ার সময় হয়তো বলে-ত্যাডামী ঠান্ডা করে দেব।

পরের দিন সেই পাতি নেতা  দাদার দোকানের ঝাঁপে মাথা নীচু করে ঢুকে কাচুমাচু স্বরে বলে-দাদা, আমি যদি ভুল করি তাহলে আমারই বলতেন, আপনি আবার দীলিপ দা রে বলতে গেলেন কেন?

বলছি তো কী হইছে, ভালো হও, ব্যবহারটা ভালোমতো শিখো, দেখবা সবাই ভালো বলছে, বলেই হয়তো বলে-দাদা চা খাবা। তারপর থেকে সেই পাতি নেতা হয়তো আর দাদার সাথে নেতাগিরি দেখাতে আসেনি। সেও হয়তো হয়ে গেছে দাদার প্রিয়দের একজন।

দুই দল ছাত্রের মারামারি শেষে বিজয়ী দল হাতে রামদা, চেইন, হকিষ্টিক নিয়ে দাদার দোকানে বসে তা দিয়ে মাটিতে শব্দ করতে করতে দাদাকে চায়ের কথা বলে। দাদা তাদের হাতে এসব মারাত্মক অস্ত্রপাতি দেখেও নির্বাক। রাম দার আগায় হয়তো তখনও রক্তের দাগ লেগে আছে, তা দেখে দাদা জিগায়- আজ কারে বসাইলা দাদা।
দিছি শালার আবুলরে বসায়া-জীবনের মতো আর সোজা হয়া দাঁড়াতে পারবো না। এমন সরল স্বীকারাক্তি তারা করে, কারন তারা জানে, একথা দাদা অন্তত আর কাউকে বলবে না।

এই লালু সেন আমার জীবনে যে ঝড় বয়ে দিয়েছিলো, সে ঝড়ে ছিন্নভিন্ন না হলেও যে সবকিছু ওলোটপালোট হয়ে গিয়েছিলো তাতো অস্বীকার করার উপায় নেই।

সবে মাধ্যমিকের পাঠ চুকিয়ে কলেজে ভর্ত্তি হয়েছি। মাধ্যমিকের ফলাফলের ভিত্তিতে ভর্ত্তি হওয়া তিন চার শ ছেলে মেয়ের মাঝে আমার অবস্থান তিন চারে। গর্বের এ বিষয়টা চিন্তা করে ঠোঁটের উপর সদ্য কালো হয়ে ওঠা লোমের উপর আলগোছে আঙ্গুল ঘষে প্রশান্তি অনুভব করি।

কলেজে ভর্ত্তি হওয়ার পর আমাদের অধিকার জন্মে লালু সেনের দোকানে নির্বিঘ্নে আড্ডা দেয়ার। বড় ভাইরা আসলে এখন আর আমরা দোকান ছেড়ে পাশের দেয়ালের উপর পা দুলিয়ে বসি না, সামান্য জায়গা ছেড়ে দিয়ে পাশেই বসে থাকি। মাঝে মাঝে ক্লাস ফাঁকি দিয়ে লালু সেনের দোকানে আড্ডা দেই। এ সময়টা প্রায়ই নির্জন থাকে। আমরা মন খুলে আলাপ করতে পারি। আলাপের মুখ্য বিষয় হয়ে দাড়ায় নতুন ভর্ত্তি হওয়া কোন মেয়েটা কেমন, কার সাথে কার সম্পর্ক হওয়ার পথে। এসব আলোচনার সময় লালু সেন মাঝে মাঝেই বলে-দাদা, ডাক্তারের ঐ লম্বা মেয়েটার সাথে তোমাকে মানাবে ভালো!

নতুন ভর্ত্তি হওয়া ডাক্তারের ঐ মেয়েটি যে আমাদের চোখে পড়েনি তা নয়। শ্যামল রঙের লম্বা চেহারার মাঝে সৌম্য, শান্ত এবং এমন একটা গম্ভীর ভাব সে ধরে রাখতো, সে গাম্ভীর্য ভেদ করে কেউ তার সাথে হালকা কথাবার্তা বলেছে তা শোনা যায় নি। আমরা সবাই চেষ্টা করেছিলাম আলাপ জমাতে, আলাপ তো হতোই না বরং অপমান আর ব্যর্থতার দায়ভার নিয়ে আমরা মাঝে মাঝেই সমবেত হই লালু সেনের দোকানে। রুমু এসবের মাঝে নেই, কিন্তু সমস্ত অপমানের বোঝা সে কাঁধে নিয়ে বলে-ঐ ঠেঙ্গিরে আমরা দেখে নেব। সেই থেকে ডাক্তারের ছিপছিপে মেয়েটির নাম হয়ে যায় ঠেঙ্গি। সে যখন রিক্সায় করে কলেজে আসে কিংবা কলেজ থেকে বের হয়ে লালু সেনের দোকানের সামনে এসে রিক্সায় উঠে হুড তুলে দেয়, তখন কেউ আড়াল থেকে উচ্চস্বরে বলে ওঠে-ঠেঙ্গি! 

এর মাঝেও আমি তার কাছে ভালো সাজার নিরন্তর চেষ্টা চালাই। সে ক্লাসে থাকলে মনোযোগ দিয়ে স্যারের লেকচার শোনার চেষ্টা করি, প্রয়োজনীয় নোট নেই। যদিও স্যারের লেকচারের সময় মম্তিষ্কের পুরোটা জুড়ে থাকে সে, প্রয়োজনীয় নোটের পরিবর্তে খাতায় শোভা পায় তার নাম। ক্লাস শেষে মাথা নীচু করে তার পাশ দিয়ে হেঁটে চলে যাই, যদিও ষষ্ট ইন্দ্রিয় সজাগ থাকে - সে কিছু বলে কিনা, আমাকে ডাকে কিনা। কেন্টিনে চা খেতে গিয়ে তার বিলসহ সবার বিল দিয়ে দেই, বিল দেয়ার পর সবাই বাহবা দিলেও সে নিরব থাকে। তার এই নিরবতাই আরো জ্বালা বাড়ায়, আমাকে অস্থির করে তোলে। কোনদিন সে ক্লাসে অনুপস্থিত থাকলে তিনচার শ ছাত্রের সে ক্লাস বিশৃঙ্খল জনসভা মনে হয় আর স্যারের লেকচার বিরোধী দলের নেতার ভাষনের মতো বিস্বাদ লাগে। ওয়াশরুমের কথা বলে তখন ক্লাস থেকে বেরিয়ে আসি। মেয়েদের কমনরুম, কলেজের কড়িডোরে, মাঠের বিরান প্রান্তরে তখন চোখ দুটো অস্থিরভাবে ঘুরতে থাকে। 

আমার এই অস্থিরতা ক্লাসের কেউ টের না পেলেও লালু সেনের দোকানের বন্ধুরা টের পায়। তারা এ নিয়ে হাসাহাসি করে। আমার এই অস্থিরতার মাঝেই লালু সেন একদিন বলে- ' দাদা, ডাক্তারের মেয়ে কালকে তোমার খোঁজ করলো।'
কেন খোঁজ করলো, কখন খোঁজ করলো, কী বললো এমন হাজারো প্রশ্নে দাদাকে ব্যতিব্যস্ত করতে মন চায়। কিন্তু এসময় সবাই ছিলো তাই অস্থিরতা চাপা দিয়ে চুপচাপ থাকি। 

সবাই চলে যাওয়ার পর একলা পেয়ে দাদাকে বললাম-দাদা, কখন খোঁজ করেছিলো?
দাদা মুখে রসভর্তি পান নিয়ে  রহস্যের হাসি হাসে। মুখ খুললেই সে রস বেরিয়ে পড়বে  তার ছেঁড়া গেন্জির উপর তাই তাৎক্ষনিকভাবে আমার কথার জবাব দেন না। মুখের পানের রস ঢোক গিলতে যে সময়টা সেটাও আমার কাছে দীর্ঘ মনে হয়। আমার ভিতরের অস্থিরতা দাদা টের পায়, বলে-
আরে দাদা রইসো রইসো, এতো অস্স্থির হইছো কেন? 
এই বলে দাদা আরও একটু সময় নেয়। যাতা দিয়ে সুপারি কুটি কুটি করে কাটতে কাটতে বলে-
বিকেলে, কলেজ যখন ছুটি হলো, তখন। 
এর বাইরে দাদা আর একটি কথাও না বলে পান কিনতে আসা এক রিক্সা চালকের সাথে আলাপে মশগুল হয়ে যায়।

কিন্তু তার সাথে আমার কোন কথা হয় না। পরের দিন ক্লাসে দেখা হয়। তার মনোযোগ আকর্ষণের চেষ্টা করি। চোখে চোখ পড়ার পর সে চোখ ঘুরিয়ে অন্যদিকে নিয়ে যায়। আমার ভিতর যন্ত্রণা বাড়তে থাকে আবার সন্দেহ হয়, দাদা আবার আমার সাথে মসকরা করলো নাতো। আমার বড় ভাই পড়ে তার বড় ভাইয়ের সাথে। তথ্যটা আমার জানা। ভাবলাম বড় ভাইয়ের সাথে একদিন ওদের বাসায় যাব। কোন কারন নেই, এমনিতেই। পরিচয় থেকেই হয়তো ঘনিষ্ঠতা বাড়তে পারে। সম্পর্ক স্বাভাবিক হতে পারে।

দিন শেষে দাদার দোকানে বসি, তিনি জানতে চান, কী দাদা আলাপ সালাপ হলো। আমি নিরুত্তর থাকি। দাদাকে দেয়ার মতো কোন অগ্রগতি নেই। দাদা ঠোঁট চেপে হাসেন, বলেন- চেষ্টা চালাও, চেষ্টা চালাও দাদা। পরিচিত শ্লোক সামান্য পরিবর্তন করে বলেন- চেষ্টার মেলায় বস্তু, তর্কে বহুদুর।

এরমাঝে অনেকদিন কেটে যায়। পরিচিত দু'একজনের মাধ্যমে জানাতে চাই, আমি তারে পছন্দ করি। কোন কাজ হয় না। বরফ গলার পরিবর্তে সে বরফ আরো জমাট বাঁধে। আমাকে খোঁজ করার বিষয়টিও জানতে চাওয়া হয় না।

দাদার কথামতো চেষ্টা চালিয়ে যাই। সবসময়ই তার মনোযোগ আকর্ষনের চেষ্টায় ব্যর্থ হই। নিজের হ্যাংলামোপনার কথা চিন্তা করে মাথাভর্তি চুল দুহাতে ধরে ছিডতে চাই। বিষয়টি স্যারের নজরে আসে। তিনি নাম ধরে ডাকেন। ভুত দেখার মতো করে চমকে উঠে দাঁড়িয়ে যাই। দুমিনিট আগে পড়ানোর বিষয় জিজ্ঞেস করেন, আমি মাথা নীচু করে আমার জুতার সৌন্দর্য দেখি।

একদিন ক্লাস শেষে কড়িডোর দিয়ে যাচ্ছিলাম। ক্লাসটা ছিলো বাংলা সাহিত্যের। এ ক্লাসটা বরাবর জমজমাট থাকে। স্যার বাংলা সাহিত্যের প্রেম ভালোবাসার বিষয়গুলো এতো রসিয়ে রসিয়ে পড়ান যে অন্য ক্লাসের ছাত্র-ছাত্রীরাও এসে ভিড করে এ ক্লাসে। সেদিন স্যার পড়াচ্ছিলেন শ্রীকান্তের প্রেম ভালোবাসা।  রাজলক্ষীর সাথে তার প্রেমের বর্ণনা আবেগী কন্ঠে বর্ণনা করে যখন স্যার উপসংহার টানেন, 'বড় প্রেম শুধু কাছেই টানেনা দুরেও ঠেলিয়া দেয়'- তখন ক্লাস ভর্তি ছাত্রছাত্রীদের মন রাজলক্ষী শ্রীকান্তের প্রেমে আদ্র হয়ে ওঠে। ক্লাসে প্রেম ভালোবাসার এই আবেগী বর্ণনা বা দীর্ঘদিনের চেষ্টায় ধৈর্য হারাবার কারনেই হোক, ক্লাস থেকে বেরিয়ে ভাবলাম, আজ সবকিছু খুলে বলবোই। এতো অপেক্ষার প্রহর আর ভালো লাগে না । 
মহিলা কমনরুমের দরজা দিয়ে দেখতে পেলাম লম্বায় কারনে খানিকটা ঝুঁকে সে  নিবিড মনোযোগ দিয়ে ক্যারোম খেলছে। আমাকে দেখে দরজার কাছে এলো। আমার বুকে তখন ইন্জিনের ধকধক শব্দ, গলা শুকিয়ে কাঠ। কোন কথাই মুখ দিয়ে বের হওয়ার অবস্থা নেই। দরজার কাছে এসে  সে কিছুই বললো না, আমার দিকে চেয়ে থাকলো, ভাবখানা এমন, কিছু বলবে?
আমি সাহস নিয়ে বললাম, লালু সেনের দোকানে আমাকে খোঁজ করেছিলে ?
সে কিছুক্ষণ কড়িডোরের ছাদের দিকে তাকিয়ে থাকলো, ভাব আর বিষয় আশয়ে সিরিয়াস কিছু মনে হলো না। তারপর ইতিহাস পাঠের মতো করে বলে-
'সে অনেককাল আগের কথা, আরবের লোকজন তখন গুহায় বাস করতো।'
তার এই তাচ্ছিল্যে নিজেকে খুব ছোট মনে হয়। ভাবি, দেবো নাকি কডা কথা শুনিয়ে। কিন্তু না, নিজেকে সংযত করি। যাকে ভালোবাসতে চাই, তার অনেক কিছুই সহ্য করতে হয়। তারপর কিছুটা চঞ্চল হয়ে বলে-

ও হাঁ, তোমার বড় ভাই কী এখন বাডীতে, নাকি ইউনিভার্সিটিতে?
আমি বললাম-বাডীতে;
একটু দেখা করতে বলতে পারবে, জরুরী কথা ছিলো।

ইতোমধ্য ক্যারাম বোর্ডের স্ট্রাইক তিনহাত ঘুরে তার কাছে এসেছে। সেদিকে তাকিয়ে, আরে দাঁড়া, দাঁড়া-  আমাকে কিছু না বলেই গেলো ক্যারোম বোর্ডের কাছে। ক্যারোম বোর্ডের একটি সাদা গুটি দিয়ে আরেকটি সাদা গুটিকে পকেটে ফেলার নিশানায় ব্যস্ত হয়ে পড়লো।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ