সিঁড়ি দিয়ে টেনে টেনে ব্যাগ তোলার সময় বোঝা গেল বেশ ভারি। ভাবলাম হেল্প করি কিন্তু পরমুহূর্তে বাদ দিলাম। এ বয়সের ছেলে- মেয়েদের ইগো খুব সেনসেটিভ। আর যে মেয়ে মফস্বল থেকে অত দূরে যাচ্ছে নিজের ভারি ব্যাগটা বহন করার ক্ষমতা তার নিজেরই রয়েছে। ওর জন্য অপেক্ষা করতে করতে অবশ্য একটু বিরক্তিও এসেছে। ইচ্ছে করলে ডুপ্লিকেট চাবিটা দারোয়োনের কাছে সকাল বেলাই রেখে যাওয়া যেত তাহলে অফিস ফেলে আসতে হতোনা। ভাবলাম ছোট মানুষ এসেই একা বাড়িতে অস্বস্তিতে পরতে পারে। তবে সামনা-সামনি দেখে মনে হচ্ছে সহজে বিব্রত হবার মেয়ে সে না।
ধীর-স্থির আচরণে আবরণটা বয়সের তুলনায় কঠিন। স্বপন আমাকে এমনই বলেছে। নীতু বিষয়ে স্বপনের মুখে আমি যত গল্প শুনেছি আর কোন কিছু নিয়ে ওকে এত উৎসাহী হতে দেখিনি। ওর মেধা, বই পড়ার পছন্দ বা নিজের মতো থাকার অভ্যাস এসব শুনতে শুনতে নিজেরও একটা কল্পনা আর আগ্রহ তৈরি হয়ে গিয়েছিল নীতু সম্পর্কে। ও ঘরে ঢোকার পর বললাম
- সো ইউ আর দ্যাট ইয়াং ফেলো, কনগ্রাচুলেশনস। স্বপন কিছুক্ষণের মধ্যে চলে আসবে কোন টেনশন নেই। প্রতি উত্তরে হেসে বলল
- থ্যাংকস আমি টেনশন করছিনা। আপনি কাজল। মামা আপনার কথা বলেছে।
কি বলেছে স্বপন জানতে ইচ্ছে করলেও জিজ্ঞেস করা ঠিক হবেনা। আমি ওর রুম দেখিয়ে দিয়ে খাবার গরম করতে গেলাম।
বাসাটা খুব বেশি বড় নয়। একা মানুষ এর চেয়ে অধিক দৈর্ঘ্য-প্রস্থের দরকারি বা কি? আর সেই জমিতে মানুষের সত্যিকার অধিকারইবা আসলে কতটুকু? বুকের ভেতর যে জমি রয়েছে ইচ্ছে করলেই তো সেখানে জায়গা বাড়ানো যায়, আমি সেই জমি এতদুর বিস্তৃত করেছি যে এখন সবটুকুতে চাষ করা দুরুহ ফলে পতিত হয়ে গেছে অনেকখানি। আগাছা জন্মেছে কোথাও কোথাও। কিচেনের পাশেই মেয়েটার ঘর। শব্দ শুনলাম লাগেজের চেন টানছে। ভারি কিছু রাখলো চেয়ারটায় বই-টই হতে পারে। কিচেনের ফ্লোরোসেন্ট বাল্বের ভেতর মাইক্রোওয়েভ ওভেনের লাল টাইম মেশিনটা বিপ করছে। আচ্ছা এতটুকু মেয়ে মামা না বলে স্ট্রেইট নাম ধরে বলল কেন? আবার যেমন করে বলল টেনশন করছিনা একটু হলেও কানে বাজলো। ধুর আমিই বা কেন এত ছোট ছোট বিষয় নিয়ে ভাবছি? আসলে অনেক ছোট ছোট বিষয়ই মানুষকে বাঁচিয়ে রাখে আবার খুব ছোট জিনিসগুলো থেকেই মানুষের মৃত্যু হয় কিন্তু নিজেও সে এটা টের পায়না। এই মৃত্যুটা আসে ধীরে ধীরে। হয়তো আপন মানুষ একটা মিথ্যে কথা বলেছে আমরা ধরে ফেলেছি আর সাথে সাথে সেই মানুষটার জন্য বিশ্বস্ততায় খানিকটা ক্ষত তৈরি হয় ওই ক্ষতই হল মনের একটি অংশের মৃত্যু। হুমায়ূন আজাদের কোন একটা কবিতার লাইন ছিল ‘হয়তো একটি দীর্ঘশ্বাসের জন্য আমার মৃত্যু হবে’। ওমা আমার পতিত জমির ভেতর সবুজ সর্ষে গাছের চারা দেখা যাচ্ছে, আমি কবিতা নিয়ে ভাবছি ইন্ট্যারেস্টিং তো! ছোট একটা মেয়ের একটা সম্বোধন নিয়ে এত দুর ভাবনা! আসলে যাপিত জীবনের একাকিত্বের কুফল। নিজেকে শাসন করে বললাম কাজল বয়স কত? হতে পারে মেয়েটা এখন থেকেই অভ্যাস করছে বাইরে যেয়ে সব সম্পর্ককে একটা নিউট্রাল যায়গা থেকে দেখার। গুড! তবুও খানিকটা খচখচ করছে মনের ভেতর । স্বপন ওর এই ভাগ্নিটার কথা এর আগেও আমাকে দু’একবার বলেছে। একটু আলাদা থাকতে পছন্দ করে এই নিয়ে ওরা বেশ বিব্রত। তবে স্পষ্ট কিছু বলেনি, আমার মনে হচ্ছে মেয়েটার আরো কিছু সমস্যা রয়েছে। মানুষের জীবনে আসলে বিব্রত হওয়ার শেষ নেই, ম্যাচের শেষ কাঠিটিও না জললে যেমন বিব্রত আবার ছেলেমেয়ে অর্ন্তমুখি-বর্হিমুখি যাই হোক অভিভাবকরা বিব্রত।
ইসিজি মেশিনের মতো শব্দ করে উঠল ওভেনটা। নাহ খাবার সার্ভ করে নেয়া উচিত। মেয়েটাও জার্নি করে এসে নিশ্চই ক্ষুধার্ত। এর মধ্যে দরজায় বেল।
স্বপন ঘরে ঢুকেই যথারীতি হড়বড় করে কথা শুরু করল। কে বলবে এই বাড়িতে গত ঘণ্টাখানেক ধরে দুটো মানুষ ছিল? স্বপনের আচরনে বোঝার উপায় নেই ও নিতুর মামা! বরং উল্টোটা হলেই মানাতো। ঘরে ঢুকেই প্রথম কথা,
- কাজলরে দোস্ত বিয়া না কইরা যে কি সুন্নতটা পালন করছোস শালা যদি বুঝতি!
- এর মধ্যে আবার বিয়ে ঢুকে পড়ল কিভাবে?
- আর কইসনা। নিতুরে আমি তোর এইখানে রাইখা ঝামেলায় ফ্যালাই? কাইলকা তোর ভাবির চৌদ্দ-গুষ্টি আইসা পড়ছে বাসায়। তারা কয় আবার কার ফরজ পালনের বিবাহ খাইতে আইছে। আর একটা কুরবানি হইয়া গেল, আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তারে বেহেশতে নসীব করুক। এই কুরবানীর কারণে আমার বাসার বাতাস পর্যন্ত গরম হইয়া পড়ছে। ঠাঁই নাই ঠাঁই নাই ছোট আমার বাড়ি পড়োস নাই শালা?
আমি শুধরে দিলাম
- ওটা বাড়ি না তরী, মানে নৌকা।
একটুও না থেমে স্বপন বলেই চলেছে
- আরে ব্যাটা ওইডা বাড়ীইরে বাড়ী। তোর দাদা রবি ঠাকুর বাইচাঁ থাকলে এখন ক্ষ্যাতের মধ্যে খাড়ায়া না থাইকা জ্যামের ভিতর বইসা কবিতা লিখত। তখন এরুকমই লিখত, বুঝছস?
কে বলবে এই ছেলে একটা ব্যাংকার ? অফিসে যে ও কিভাবে এত শুদ্ধ বাংলা আর চোস্ত ইংরেজি বলে, বেচারা। স্বপনের ভ্রুক্ষেপ নেই ঘরের মধ্যে হাঁটতে হাঁটতে কথা বলেই চলেছে।
- তার উপর সেই মিরপুর থিকা আইসা নিতু ডেইলি কাজগুলা সারতে পারব না। ওর বলে শিক্ষা বোর্ডের ঝামেলা আছে। নিতু কই গেলেন আম্মা? আসেন আপনের সাথে সৌজন্য সাক্ষাত করি। কই আম্মা আপনার সব্বজ্ঞানী শিক্ষক পিতা এবং আমার নিরীহ ভালোমানুষ বোনটা কিমুন আছে?
নিতুর রুমের দরজা ভিড়ানো দেখেছিলাম আমি ডাকতে যেয়ে দেখি সে রান্নাঘরে, টেবিলে খাবার দেয়ার প্রিপারেশন নিচ্ছে। বাহ এর মধ্যে মেয়েটা ফ্রেস হয়েছে, সুতি একটা হালকা গোলাপী থ্রি-পিছ গায়ে, চোখে কি কাজল দিয়েছে। আলোর বিপরিতে দাঁড়িয়ে থাকায় নীতুর কাজল দেখা গেলেও মুখটা অস্পষ্ট। আরে ওর চুল এত দীর্ঘ কেন? টপ টপ করে বৃষ্টির মতো এক একটা ফোঁটা পড়ছে সাদা মেঝেতে। ওর তো দেখি বাইরে যেয়ে প্রথমেই চুল ছোট করতে হবে।
আমি বললাম নিতু তোমার মামা এসেছে। সেই এক টুকরো কৃপণ হাসি, বলল
-শুনেছি, মামা বাড়ি গেলে পাশের গ্রাম থেকে তার গলা শোনা যায় আমিত ঘরের ভেতর! আসছি আমি।
স্বপন কখন পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে। নিতুর কথা মাটিতে পড়ার আগেই লুফে নিল।
- ওই তুই কি কইলি? ও মামা বাসায় নিয়া যাইতে পারে নাই বইলা একটা দুর্ণাম দিয়া দিছোস?
বলতে বলতে যেভাবে এসে ভাগ্নির চুল টেনে ধরল মনে হল ক্লাস টুতে পড়া মেয়েকে আদর করল স্বপন। নিতুও হেসে উঠল। যাক পরিবেশ তাহলে স্বাভাবিক। তবে সকাল বেলা ম্যাডাম জাহানারার রান্না করে যাওয়া খাবার যে খেতে একটু অসুবিধা হচ্ছে এটা বুঝলাম খাওয়ার টেবিলে। কিন্তু এখানে আমি নিরুপায়। আমার কাছে এই অমৃত। যেখানে একশ চার ডিগ্রি জ্বর নিয়েও ঘরে পড়ে থাকলে কেউ জিজ্ঞেস করার নেই তার কাছে এই ঢের। সত্যিই তো এই শহরে একমাত্র স্বপন ছাড়া কে আছে যে আমার ফোন পেয়েই ছুটে আসবে? তাই তো বলি বাইরের মাটিতে আমার খুব সীমিত অধিকার বলে আমি আমার বুকের ভেতরের জমি প্রশস্ত করেছি সেখানে ঢেউহীন নদী, দু’একটা বাগানও আছে। চাইলে কুড়ে ঘর অন্তত তৈরি করে নেয়া যেত কিন্তু এখন এই প্রায় মাঝ বয়সে এসে দেখি নাহ অনেকটা সময় ফেলে এসেছি। নিজের জমিতে অন্যের অধিকার দিতেও ইচ্ছে করেনা।
খাবার টেবিলে বসে ম্যাডামের উপরে নির্ভরতা এবং সীমাবদ্ধতার বর্ণনা দিলাম। কয়েকটা দিন নিতুর কষ্ট হবে সে ভদ্রতাও করে রাখলাম।
স্বপন চলে গেলে নিতু যেভাবে সব ক্লিন করল আমি আর সাহস পেলামনা এগুতে। মেয়েদের সহজাত প্রবণতাই হয়তো এমন। আমি লিভিং স্পেস এ বসে টকশো বোঝার চেষ্টা করছি। নিতু এসে বলল আপনি চা খাবার প্রস্তাব দিল। চা এনে পাশের শোফায় যেভাবে মুখোমুখি বসল বুঝলাম এটা একটা অজুহাত ও আসলে কথা বলতে চাইছে।
নিতুই শুরু করল
- আমি কি আপনাকে অনেক ঝামেলায় ফেললাম?
- না না ঠিক আছে। কি যেন বলবে বলছিলে?
- আমার ফ্লাইট ৫ দিন পর নেক্সট ৪ দিনও এখানে থাকতে হবে যদি আপনার খুব সমস্যা না হয়। একদিন আগে মামার বাসায় চলে যাবো বাবা-মা আসবেন।
- ও বেশ।
- আর এ’কদিন যদি সকালে আমি আপনার ম্যাডামের সাথে রান্না ঘরে ঢুকি সমস্যা নেই তো? আর একটা কথা রাস্তা হারিয়ে ফেললে বা ঝামেলায় পড়লে কি আমি আপনাকে ফোন করতে পারি? আসলে ঢাকায় একা চলাফেরা করতেত আমি অভ্যস্ত নই তাই বলছি।
এই প্রথম ওর মুখে নিজের দুর্বলতার জন্য নরম সুর। তবুও সব প্রয়োজনের কাটা কাটা হিসেব নিকেশের কথা একটানা বলে যাওয়া। মেয়েটা এমন করে নিজেকে গুটিয়ে রাখে কেন? এই বয়সের ছেলে মেয়েদের অন্যরকম হবার কথা। ওর স্থির দৃষ্টি কেমন কেটে কেটে বসে যায় ভেতরে। ২৪ বছর বয়সি মেয়েটার ব্যক্তিত্বের কাছে আমি কি পরাজিত হচ্ছি? ইচ্ছে হচ্ছিল বলতে যে নিতু এই শহরে আমার সবচেয়ে কাছের মানুষটার আত্মীয় তুমি আমার ভাঙ্গা- চোরা পুরনো গাড়িটা কাজে এলে খুশিই হবো। কিন্তু এমন মেয়ের কাছে এ প্রস্তাব দিলে আবার কিছু মনে না করে বসে! বলা হল না। শুধু বললাম যে কোন সাহায্যে নির্দ্বিধায় ফোন করো। নিতু চায়ের খালি মগ দুটো নিয়ে চলে গেল। আমার একটা অংশও কি সাথে সাথে গেল? হয়তো দেখতে ইচ্ছে হচ্ছিল রান্নাঘরের সিংকের ভেতর চায়ের কাপ ধরে রাখা হাতে জলের ধারার রঙ বদলে যাওয়া অথবা হটাৎ পানি ছিটকে চোখে মুখে পড়লে ওর বিরক্তিতে ভ্রু কুঁচকে ওঠা। আমরা যতই নির্দোষ আর সত্যবাদি হইনা কেন আমাদের নীতিপরায়ণতার ভেতরও কিছু কিছু মিথ্যে থেকে যায়। আমি কি নীতি ভাংছি? হয়তো এই প্রথম আমার বাড়িতে কোন নারীর পদচারণা বলেই আমি উৎসুক হয়ে উঠেছি কিন্তু সেটা কি ঠিক?
ঘুমাতে এলাম। এত রাতে চা’য়ের কারণে কিংবা হটাৎ এই বাড়িতে আরো একটা মানুষের উপস্থিতিতে ঘুম সহজে আসবে বলে মনে হয়না। নিতুর ঘর থেকে লো ভল্যিউমে বাংলা গানের সুর আসছে, এটাকি তরুন বন্দোপাধ্যায়ের সেই গানটা? কাজলও নদীর জলে ভরা আখি ছলছলে প্রদীপও ভাসাও কারে স্মরিয়া....হয়তো কাছাকাছি সুরের অন্যকিছু। গানের সুরের ভেতর দিয়ে বোঝা যাচ্ছে পায়চারি করছে সে। নীতুর পায়ের শব্দ কি আরো খানিকটা কাছে এল? হয়তো ভুল, নাহ এখন দুরে যাচ্ছে তার মানে কাছে এসেছিল সত্যি! কতটা কাছে!
মেয়েটা যেন একটু অন্যরকম আবার ভুলও হতে পারে, হয়তো আমি ভাবছি অন্যরকম।
পরের দিন সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরেই বুঝলাম এখনও ফিরেনি। ডায়নিং টেবিলের উপর ভার্জিলের ঈনিড বইটি উল্টো করে খুলে রাখা।
বইটির মুখ ঘুরিয়ে দেখি পৃষ্ঠা ১৩১, পেন্সিল দিয়ে দাগ দেয়া রয়েছে শেষ অংশটুকু,“পিতা এই ক্ষুধার কথাই বলছিলেন-এ সেই ক্ষুধা যা আমাদের চরম বাঁধা ও প্রাণান্তিক পরীক্ষার নিশানা স্বরূপ। অতএব-চলো। আমরা নন্দিত সূর্যের প্রথম আলোকে দেখি এ কোন দেশ, কারা এর অধিবাসী, কোথায় তাদের সুরক্ষিত নগরী। চলো আমরা বন্দর থেকে ভিন্ন ভিন্ন পথে চলতে থাকি।” এই লাইনগুলো এত জরুরি কেন? মেয়েটা খুব অল্প সময়ের মধ্যেই একার পথে যাচ্ছে। আমার কি ওর জন্য মায়া হচ্ছে? ধুর মায়া বিষয়টাই একটা সুবিধা ভোগের সিস্টেম।
পেছনের বারান্দায় হালকা গোলাপী টাওয়েল ঝুলছে। ঘরের পর্দাগুলো টেনে সরানো। নিতুর খাটে মুখ হা করে রাখা ল্যাপটপ। চিরুণীর সাথে অসচতনে একটা ভুল চুল। হয়তো ঠিক হলনা অনুপস্থিতিতে তার ঘরে প্রবেশ। তবে অনভ্যস্ততাও হতে পারে। প্রতিদিন ফিরে তো আমি এই রুমে এসে কিছুক্ষণ বই পত্র নিয়ে বসি। একদিনে কেমন অন্যের ঘর হয়ে গেছে তবে এই সাময়িক অধিকারে খারাপ লাগছেনা তো আমার! বরং আজ ঘরটাতে প্রাণের স্পন্দন পাওয়া যাচ্ছে। নিতু একগাদা বই পত্র আর কাগজ নিয়ে ফিরল কিছুক্ষণের মধ্যেই। মুখটা লাল হয়ে আছে, ওর চুলগুলোতে কি জট বেধেঁছে? সেই ভুল চুল জড়িয়ে থাকা চিরুনি দিয়ে কি ঘরে ঢুকে সামলে নেবে অবাধ্য চুলগুলো? তারপর কি আবারও কাজল দেবে চোখে? কেন দেবে? কোথায় যাচ্ছে আমার ভাবনা! ও ঢুকেই প্রথমে বলল
- ওহো আমি কি একটু দেরি করে ফেলেছি? স্যরি।
- না না ঠিক আছে।
মেয়েটা বোধহয় একদিনে একটু সহজ হয়ে আসছে। আর স্যরি বলার কোন কারণ নেই। ওর কাজ শেষ হলেই না ফিরবে। কটা দিন পরই তো সম্পূর্ন স্বাধীন জীবন। তাহলে কি আমি অফিস থেকে ফেরার পর এল বলে স্যরি? আমার জমিতে আবারও সবুজ চারা গাছ তাতে জল সিঞ্চন টের পাই।
দ্রুত বলে উঠলাম, কোন ঝামেলা হয়নি তো, রাস্তা-ঘাটের যে অবস্থা! সবকিছু ঠিক ছিল আশ্বস্ত করে নিতু ফ্রেস হতে গেল। খাবার টেবিলে টুকটাক কথা, প্লেটের সাথে গ্লাস বা টুং করে চামচ লেগে যাবার শব্দের ভেতর নিরবতা। তবুও অন্য একজনের উপস্থিতি। এর মধ্যে হটাৎ নিরবতা ভাংলো ও। যেন কয়েকটুকরো হয়ে ঘরময় ছড়িয়ে পড়ল সেই নিঃশব্দ আর তার সাথে আষ্টেপৃষ্টে থাকা শব্দগুলো। নিতু ভড়কে দিল একটা কথা বলে।
- কাজল মামা আপনি কি একবার দারোয়ানকে কোনভাবে জানিয়ে দিবেন আমার পরিচয়টা? একটু অস্বস্তি হচ্ছে। আবার সেই শব্দহীনতা।
দারোয়ান বা জাহানারা ওকে কিছু বলেছে কিনা জিজ্ঞেস করতে উত্তর দিল না সরাসরি। বলল আপনি শুধু একবার ইনফর্ম করে দিন নয়তো আমার এই লোকের চোখের সামনে প্রতিদিন যাওয়া আসা করতে অস্বস্তি হবে। এই প্রথমবার বোধহয় ও আমাকে মামা সম্বোধন করল তবে স্বেচ্ছায় কিনা তাও বোঝা যাচ্ছে না। দুটো দিন দ্রুত চলে গেল। নীতু ওর প্রয়োজনের কাজগুলো একাই সারলো। আমি অফিস করলাম, রাতে ফিরে খাবার টেবিলে দুদিন একসাথে খেলাম, শুনে গেলাম শুধু সেই টুংটাং নিরবতা। মাঝরাতে ওর ঘরের অস্পষ্ট ভেসে আসা সুর। আর আমি কি সেই পায়ের শব্দের জন্য আরো বেশি উদগ্রীব? কাল রাতে শব্দটা আরো বেশি কাছে এসেছে, আরো কাছে আবার দুরে সরে গেছে। যতটা দ্রুত যাওয়া উচিত তার সাথে গতির গুন যোগ হল আমার কাছে।
আজ নীতুর স্বপনের বাসায় চলে যাবার কথা। দুপুরের দিকে ওর বাবা-মা এসেছেন। নীতুও হয়তো ওর সব কাজ গুছিয়ে নিয়েছে। তবে সব কি আর এক জীবনে গোছানো হয় সত্যি! আমি একটু আগেই বাড়ি ফিরলাম আজ। স্বপন এসেছে ওকে নিতে। তিনজন টেবিলে বসে চা খেলাম। স্বপন একাই কথা বলে গেল আগের মতো। সময় পার হচ্ছে যেন কোন অশ্বারোহীর পিঠে করে। খুঁরের শব্দ বড় বেশি দ্রুত বেগে ছুটে চলার। খুব একটা কথা হল না আমার আর নিতুর মধ্যে। ব্যাগ গুছিয়ে বেরিয়ে গেল স্বপনের সাথে। এত হুড়োহুড়ি কেন যে করল মেয়েটা বুঝলাম না। ডুপ্লিকেট চাবিটা বুঝিয়ে দিল দরজার কাছে যেয়ে। সেই একই রকম লাগেজ টানতে টানতে নেমে গেল সিড়ি দিয়ে। একবার ঠাণ্ডা গলায় বলল ‘যাই’।
চলে যাবার পর আর আমি ও ঘরে ঢুকিনি। সকালে জাহানারা এসে ঠিকঠাক করবে কিংবা থাকুক না কয়েকটা দিন ওটা নিতুর ঘর হয়েই। কিন্তু আমার কেন নিজের ঘরেও স্বস্তি নেই? আশ্চর্য ও থাকতেও এমন হতো অথচ চলে যাবার পরও অস্থির লাগছে। ঘরটার প্রসস্তটা কি হটাৎ করেই বেড়ে গেল? মনে হচ্ছে একটা বিস্তৃত মাঠের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছি একা। খুব ধীরে ধীরে শীতের কুয়াশা নামছে আর গাঢ় হচ্ছে দীর্ঘ আর একটা রাত। তিনটি দিনেই কি আমি বাড়ি ফিরে তার উপস্থিতিতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছিলাম? পড়তে পড়তে বই উল্টো করে উঠে যাওয়া, ঘরের এ কোন সেকোন থেকে টুকরো টাকরা কথার শব্দ কি আমাকে সত্যি কোন দ্যোতনা দিত? অথবা বারান্দার গোলাপী টাওয়েল? এত অস্থিরতা নেয়া যাচ্ছে না। ঘুমিয়ে পড়াই ভালো। কিন্তু চাইলেই কি আর ঘুম আসে? বিছানায় এপাশ-ওপাশ করতে করতে তন্দ্রাচ্ছন্ন- মোহগ্রস্থ। আমি যেন কিসের টানে ভেসে চলে যাই। নিয়ম ভাঙ্গি। ভয়ে সরে আসি তবুও তার রেশ রয়ে যায়। পুনরায় নিয়ম ভাঙ্গবার জন্য স্বপ্নের ভেতর উঠে দাড়াই। নিজের কাছেও প্রকাশ করতে ভীষণ জড়তা এই আবেশের। আবারো সেই গলা টিপে ধরা নিজের, কাজল তুমি তো জানো তোমার সমাপ্তি হয়ে গেছে জন্মেই। মানুষত জন্মের সময়ই মৃত্যুর প্রস্তুতি নিয়ে আসে কিন্তু সেই অনুভবটা কারো ক্ষেত্রে হয় আকস্মিক আর বেশিরভাগ মানুষের হয় অভিজ্ঞতা আর বয়সে। কিন্তু তুমি তো কৈশোর পেরোনোর আগেই বুঝে গেছ প্রকৃতি তোমাকে বঞ্চিত করেছে। তোমার শরীরে আগুনের সংমিশ্রণ নেই, জ্বল-মাটির মিশ্রণ নেই, তুমি রঙিন হতে পারোনি কখনো। তুবও কেন এই অসময়ে রঙ মাখছো বুকের ভেতর? অপ্রাপ্তির ক্ষত আরো দগদগে করে দেয়া ছাড়া আর কিবা করতে পারে এই আবেশ? মলয় রায় চৌধুরীর একটি কাব্যনাট্যের কয়েকটি লাইন ঘুরছে মাথার ভেতর, “মৃত্যুতো কারো বাসী স্মৃতির ছত্রাক/ আমার মস্তিস্কে কেন একজন নারী/ বারবার মৃত্যুর ওপার থেকে ডাকে/ সে কোন রহস্যময়ী আছে ওইখানে/ যে আমার শরীরের গন্ধে জেগে উঠে?”
কি অসম্ভব অসহনীয় এবং মোহনীয় একটা রাত কাটল আমার। কাল এমন সময় সে অনেক দূর। মাথার ভেতর একটা তিতকুটে স্বাদ নিয়ে অফিস এলাম। বিষণ্ন একটা খা খা করা সন্ধ্যা নিয়ে বেরিয়েছি অফিস থেকে। আর কতক্ষণ বাকি ফ্লাইটের? ঘণ্টা খানেক? আমি তেজগাঁও থেকে কোনদিকে যাবো? ধানমণ্ডি না উত্তরা এয়ারপোর্ট? কি বলব? কিচ্ছু বলার নেই আমার, আপাত অক্ষম মানুষের আসলে কিছু বলার থাকে না। আমার জন্য সেই শূণ্য গহ্বরই নির্ধারিত। ধানমণ্ডির পথে আমি জ্যামে আটকে আছি। গাড়ির জানালাগুলো বাঁচিয়ে দিচ্ছে আমাকে বহি:বিশ্বের সমস্ত শব্দ থেকে। আমি বাড়ি ফিরছি। প্রশস্ত-বিস্তীর্ণ একটা ঘর। অনুৎপাদিত শষ্যের ফাঁকা মাঠ। পেছনের সিটে গা ঠেসে দিয়ে ফিরছি। ঠিক এমন সময় মোবাইলের নীল স্ক্রীনে নামটা ভেসে উঠল দ্বিতীয়বারের মতো। কয়েকদিন আগে যখন এই একই সময় ক্ষণস্থায়ী এবং স্থায়ী দখল নিতে এসেছিল তখন প্রথম ফোন এরপর আর একবারও নয়। আজ যাবার ঠিক আগ মুহরর্তে আবার স্ক্রীনে নামটা যেন জলের তলা থেকে ভেসে উঠার মতো জেগে উঠল।
- হ্যালো:
- ওপাশে নিরুত্তাপ
- হ্যালো নিতু:
নিশব্দ
- নিতু সব ঠিক আছে?
- আমার চেকিং শেষ, বাড়ি ফিরছেন?
- ফিরছি, সব ঠিক আছে তোমার?
- আপনার ঘরে না বলে একবার ঢুকেছিলা্।
- বেশ, তারপর?
- ওয়্যারড্রোবের ওপরে একটা নোটবুক আপনার।
- হ...
- ওর পাশে কাগজে একটা ছোট্ট নোট রেখেছি আমি
- আগে কেন বলোনি ? কি লিখেছ বলো? ওটা পড়তে পড়তে তুমি নেটওয়ার্কের বাইরে নিতু, বলো কি লিখেছ?
- আপনি বাড়ি ফিরেই জানুন না হয় কি লিখেছি,ভালো থাকবেন (লাইন কেটে গেল)
- নিতু?
ওপাশে শব্দহীন।
বাড়ির পথ এত দীর্ঘ কেন? বড় বেশি দীর্ঘ এই পথ।
আমার হাতে নিতুর লেখা একটা ছোট্ট চিরক’ট।
সম্বোধনহীন
‘ আচ্ছা মানুষ যখন গাছ ভালোবাসে অথবা ধরুন একটা নীল রঙের ফুল? নীল যন্ত্রনার রঙ জানেন তো, আপনার বেলকনিতে ভোরবেলা এসে বসা চড়–ইটার দিকে যখন অবাক হয়ে চেয়ে থাকেন সেই ভালোলাগার কোন ব্যাখ্যা আছে? মানুষ কি তার এই ভালোলাগার ব্যাখ্যা খুঁজে কখনো কিংবা বিভাজন করে? সেভাবে কি অন্য আরেকটা মানুষকে ভালোবাসা যায় শুধু প্রকৃতির অংশ হিসেবে? হয়তো যায়না অথবা হয়ত যায়। যদি নাই যেত গ্রীক দেবতা আর্কেদিয়ান কি করে ভালোবাসলেন নিনমাহকে? এই দেবী মাতার পুরুষ বা নারী হিসেবে কোন মৌলিক বৈশিষ্ট্য ছিলনা। সুমেরিয়ান সভ্যতার এই ইতিহাসটা খ্রীষ্টপূর্ব ২ হাজার বছর আগের। সেখানেও রয়েছে এমন অদ্ভুত ভালোবাসার উপস্থিতি তবে। এখন ভিন্ন কথা। আপনাকে এমন একটা গল্প বলে যাই। সত্যিকার অর্থে কোন পরিচয় আমার নেই, প্রকৃতির অংশমাত্র। স্বপ্ন বুনতে বুনতে সেই গাঁথুনির কৌশল উত্তরসূরীর হাতে ধরিয়ে দেবার সক্ষমতা প্রকৃতি আমায় দেয়নি। আমার স্বপ্ন বহন করে নেয়ার কোন সন্তান আমার থাকবেনা। সমাজ কি নিতে পারে এমন অপূর্ণ মানুষকে। তাই পরিচিতদের কাছ থেকে খানিকটা দুরত্বের এত আয়োজন। তবুও একটা স্বপ্ন দেখেছি। কি নির্মম আর ভুল সুন্দর সেই অভিজ্ঞতা। একটা স্বীকারোক্তি আছে, প্রায় প্রতি রাতেই ইচ্ছে হত আপনাকে যেয়ে বলি, আমার সাথে বারান্দায় এসে বসবেন কিছুক্ষণ? বলতে পারিনি তবে জানিয়ে যাচ্ছি। আপনি কি বুঝতে পারছেন যত্ন করে তৈরি ভুলটা কি?
যাই আমি।
নীতু কি আমাকে একই রকম শৈশবের গল্প বলে গেল!
লেখক পরিচিতি
সাদিয়া মাহজাবীন ইমাম
ফরিদপুর জেলার দয়ারামপুর গ্রামে।
পড়াশুনা করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ও গণমাধ্যম নিয়ে গবেষণা করছেন।
২০০৬ থেকে সাংবাদিকতা করছেন।
প্রকাশিত গল্পগ্রন্থ : পা।
ধীর-স্থির আচরণে আবরণটা বয়সের তুলনায় কঠিন। স্বপন আমাকে এমনই বলেছে। নীতু বিষয়ে স্বপনের মুখে আমি যত গল্প শুনেছি আর কোন কিছু নিয়ে ওকে এত উৎসাহী হতে দেখিনি। ওর মেধা, বই পড়ার পছন্দ বা নিজের মতো থাকার অভ্যাস এসব শুনতে শুনতে নিজেরও একটা কল্পনা আর আগ্রহ তৈরি হয়ে গিয়েছিল নীতু সম্পর্কে। ও ঘরে ঢোকার পর বললাম
- সো ইউ আর দ্যাট ইয়াং ফেলো, কনগ্রাচুলেশনস। স্বপন কিছুক্ষণের মধ্যে চলে আসবে কোন টেনশন নেই। প্রতি উত্তরে হেসে বলল
- থ্যাংকস আমি টেনশন করছিনা। আপনি কাজল। মামা আপনার কথা বলেছে।
কি বলেছে স্বপন জানতে ইচ্ছে করলেও জিজ্ঞেস করা ঠিক হবেনা। আমি ওর রুম দেখিয়ে দিয়ে খাবার গরম করতে গেলাম।
বাসাটা খুব বেশি বড় নয়। একা মানুষ এর চেয়ে অধিক দৈর্ঘ্য-প্রস্থের দরকারি বা কি? আর সেই জমিতে মানুষের সত্যিকার অধিকারইবা আসলে কতটুকু? বুকের ভেতর যে জমি রয়েছে ইচ্ছে করলেই তো সেখানে জায়গা বাড়ানো যায়, আমি সেই জমি এতদুর বিস্তৃত করেছি যে এখন সবটুকুতে চাষ করা দুরুহ ফলে পতিত হয়ে গেছে অনেকখানি। আগাছা জন্মেছে কোথাও কোথাও। কিচেনের পাশেই মেয়েটার ঘর। শব্দ শুনলাম লাগেজের চেন টানছে। ভারি কিছু রাখলো চেয়ারটায় বই-টই হতে পারে। কিচেনের ফ্লোরোসেন্ট বাল্বের ভেতর মাইক্রোওয়েভ ওভেনের লাল টাইম মেশিনটা বিপ করছে। আচ্ছা এতটুকু মেয়ে মামা না বলে স্ট্রেইট নাম ধরে বলল কেন? আবার যেমন করে বলল টেনশন করছিনা একটু হলেও কানে বাজলো। ধুর আমিই বা কেন এত ছোট ছোট বিষয় নিয়ে ভাবছি? আসলে অনেক ছোট ছোট বিষয়ই মানুষকে বাঁচিয়ে রাখে আবার খুব ছোট জিনিসগুলো থেকেই মানুষের মৃত্যু হয় কিন্তু নিজেও সে এটা টের পায়না। এই মৃত্যুটা আসে ধীরে ধীরে। হয়তো আপন মানুষ একটা মিথ্যে কথা বলেছে আমরা ধরে ফেলেছি আর সাথে সাথে সেই মানুষটার জন্য বিশ্বস্ততায় খানিকটা ক্ষত তৈরি হয় ওই ক্ষতই হল মনের একটি অংশের মৃত্যু। হুমায়ূন আজাদের কোন একটা কবিতার লাইন ছিল ‘হয়তো একটি দীর্ঘশ্বাসের জন্য আমার মৃত্যু হবে’। ওমা আমার পতিত জমির ভেতর সবুজ সর্ষে গাছের চারা দেখা যাচ্ছে, আমি কবিতা নিয়ে ভাবছি ইন্ট্যারেস্টিং তো! ছোট একটা মেয়ের একটা সম্বোধন নিয়ে এত দুর ভাবনা! আসলে যাপিত জীবনের একাকিত্বের কুফল। নিজেকে শাসন করে বললাম কাজল বয়স কত? হতে পারে মেয়েটা এখন থেকেই অভ্যাস করছে বাইরে যেয়ে সব সম্পর্ককে একটা নিউট্রাল যায়গা থেকে দেখার। গুড! তবুও খানিকটা খচখচ করছে মনের ভেতর । স্বপন ওর এই ভাগ্নিটার কথা এর আগেও আমাকে দু’একবার বলেছে। একটু আলাদা থাকতে পছন্দ করে এই নিয়ে ওরা বেশ বিব্রত। তবে স্পষ্ট কিছু বলেনি, আমার মনে হচ্ছে মেয়েটার আরো কিছু সমস্যা রয়েছে। মানুষের জীবনে আসলে বিব্রত হওয়ার শেষ নেই, ম্যাচের শেষ কাঠিটিও না জললে যেমন বিব্রত আবার ছেলেমেয়ে অর্ন্তমুখি-বর্হিমুখি যাই হোক অভিভাবকরা বিব্রত।
ইসিজি মেশিনের মতো শব্দ করে উঠল ওভেনটা। নাহ খাবার সার্ভ করে নেয়া উচিত। মেয়েটাও জার্নি করে এসে নিশ্চই ক্ষুধার্ত। এর মধ্যে দরজায় বেল।
স্বপন ঘরে ঢুকেই যথারীতি হড়বড় করে কথা শুরু করল। কে বলবে এই বাড়িতে গত ঘণ্টাখানেক ধরে দুটো মানুষ ছিল? স্বপনের আচরনে বোঝার উপায় নেই ও নিতুর মামা! বরং উল্টোটা হলেই মানাতো। ঘরে ঢুকেই প্রথম কথা,
- কাজলরে দোস্ত বিয়া না কইরা যে কি সুন্নতটা পালন করছোস শালা যদি বুঝতি!
- এর মধ্যে আবার বিয়ে ঢুকে পড়ল কিভাবে?
- আর কইসনা। নিতুরে আমি তোর এইখানে রাইখা ঝামেলায় ফ্যালাই? কাইলকা তোর ভাবির চৌদ্দ-গুষ্টি আইসা পড়ছে বাসায়। তারা কয় আবার কার ফরজ পালনের বিবাহ খাইতে আইছে। আর একটা কুরবানি হইয়া গেল, আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তারে বেহেশতে নসীব করুক। এই কুরবানীর কারণে আমার বাসার বাতাস পর্যন্ত গরম হইয়া পড়ছে। ঠাঁই নাই ঠাঁই নাই ছোট আমার বাড়ি পড়োস নাই শালা?
আমি শুধরে দিলাম
- ওটা বাড়ি না তরী, মানে নৌকা।
একটুও না থেমে স্বপন বলেই চলেছে
- আরে ব্যাটা ওইডা বাড়ীইরে বাড়ী। তোর দাদা রবি ঠাকুর বাইচাঁ থাকলে এখন ক্ষ্যাতের মধ্যে খাড়ায়া না থাইকা জ্যামের ভিতর বইসা কবিতা লিখত। তখন এরুকমই লিখত, বুঝছস?
কে বলবে এই ছেলে একটা ব্যাংকার ? অফিসে যে ও কিভাবে এত শুদ্ধ বাংলা আর চোস্ত ইংরেজি বলে, বেচারা। স্বপনের ভ্রুক্ষেপ নেই ঘরের মধ্যে হাঁটতে হাঁটতে কথা বলেই চলেছে।
- তার উপর সেই মিরপুর থিকা আইসা নিতু ডেইলি কাজগুলা সারতে পারব না। ওর বলে শিক্ষা বোর্ডের ঝামেলা আছে। নিতু কই গেলেন আম্মা? আসেন আপনের সাথে সৌজন্য সাক্ষাত করি। কই আম্মা আপনার সব্বজ্ঞানী শিক্ষক পিতা এবং আমার নিরীহ ভালোমানুষ বোনটা কিমুন আছে?
নিতুর রুমের দরজা ভিড়ানো দেখেছিলাম আমি ডাকতে যেয়ে দেখি সে রান্নাঘরে, টেবিলে খাবার দেয়ার প্রিপারেশন নিচ্ছে। বাহ এর মধ্যে মেয়েটা ফ্রেস হয়েছে, সুতি একটা হালকা গোলাপী থ্রি-পিছ গায়ে, চোখে কি কাজল দিয়েছে। আলোর বিপরিতে দাঁড়িয়ে থাকায় নীতুর কাজল দেখা গেলেও মুখটা অস্পষ্ট। আরে ওর চুল এত দীর্ঘ কেন? টপ টপ করে বৃষ্টির মতো এক একটা ফোঁটা পড়ছে সাদা মেঝেতে। ওর তো দেখি বাইরে যেয়ে প্রথমেই চুল ছোট করতে হবে।
আমি বললাম নিতু তোমার মামা এসেছে। সেই এক টুকরো কৃপণ হাসি, বলল
-শুনেছি, মামা বাড়ি গেলে পাশের গ্রাম থেকে তার গলা শোনা যায় আমিত ঘরের ভেতর! আসছি আমি।
স্বপন কখন পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে। নিতুর কথা মাটিতে পড়ার আগেই লুফে নিল।
- ওই তুই কি কইলি? ও মামা বাসায় নিয়া যাইতে পারে নাই বইলা একটা দুর্ণাম দিয়া দিছোস?
বলতে বলতে যেভাবে এসে ভাগ্নির চুল টেনে ধরল মনে হল ক্লাস টুতে পড়া মেয়েকে আদর করল স্বপন। নিতুও হেসে উঠল। যাক পরিবেশ তাহলে স্বাভাবিক। তবে সকাল বেলা ম্যাডাম জাহানারার রান্না করে যাওয়া খাবার যে খেতে একটু অসুবিধা হচ্ছে এটা বুঝলাম খাওয়ার টেবিলে। কিন্তু এখানে আমি নিরুপায়। আমার কাছে এই অমৃত। যেখানে একশ চার ডিগ্রি জ্বর নিয়েও ঘরে পড়ে থাকলে কেউ জিজ্ঞেস করার নেই তার কাছে এই ঢের। সত্যিই তো এই শহরে একমাত্র স্বপন ছাড়া কে আছে যে আমার ফোন পেয়েই ছুটে আসবে? তাই তো বলি বাইরের মাটিতে আমার খুব সীমিত অধিকার বলে আমি আমার বুকের ভেতরের জমি প্রশস্ত করেছি সেখানে ঢেউহীন নদী, দু’একটা বাগানও আছে। চাইলে কুড়ে ঘর অন্তত তৈরি করে নেয়া যেত কিন্তু এখন এই প্রায় মাঝ বয়সে এসে দেখি নাহ অনেকটা সময় ফেলে এসেছি। নিজের জমিতে অন্যের অধিকার দিতেও ইচ্ছে করেনা।
খাবার টেবিলে বসে ম্যাডামের উপরে নির্ভরতা এবং সীমাবদ্ধতার বর্ণনা দিলাম। কয়েকটা দিন নিতুর কষ্ট হবে সে ভদ্রতাও করে রাখলাম।
স্বপন চলে গেলে নিতু যেভাবে সব ক্লিন করল আমি আর সাহস পেলামনা এগুতে। মেয়েদের সহজাত প্রবণতাই হয়তো এমন। আমি লিভিং স্পেস এ বসে টকশো বোঝার চেষ্টা করছি। নিতু এসে বলল আপনি চা খাবার প্রস্তাব দিল। চা এনে পাশের শোফায় যেভাবে মুখোমুখি বসল বুঝলাম এটা একটা অজুহাত ও আসলে কথা বলতে চাইছে।
নিতুই শুরু করল
- আমি কি আপনাকে অনেক ঝামেলায় ফেললাম?
- না না ঠিক আছে। কি যেন বলবে বলছিলে?
- আমার ফ্লাইট ৫ দিন পর নেক্সট ৪ দিনও এখানে থাকতে হবে যদি আপনার খুব সমস্যা না হয়। একদিন আগে মামার বাসায় চলে যাবো বাবা-মা আসবেন।
- ও বেশ।
- আর এ’কদিন যদি সকালে আমি আপনার ম্যাডামের সাথে রান্না ঘরে ঢুকি সমস্যা নেই তো? আর একটা কথা রাস্তা হারিয়ে ফেললে বা ঝামেলায় পড়লে কি আমি আপনাকে ফোন করতে পারি? আসলে ঢাকায় একা চলাফেরা করতেত আমি অভ্যস্ত নই তাই বলছি।
এই প্রথম ওর মুখে নিজের দুর্বলতার জন্য নরম সুর। তবুও সব প্রয়োজনের কাটা কাটা হিসেব নিকেশের কথা একটানা বলে যাওয়া। মেয়েটা এমন করে নিজেকে গুটিয়ে রাখে কেন? এই বয়সের ছেলে মেয়েদের অন্যরকম হবার কথা। ওর স্থির দৃষ্টি কেমন কেটে কেটে বসে যায় ভেতরে। ২৪ বছর বয়সি মেয়েটার ব্যক্তিত্বের কাছে আমি কি পরাজিত হচ্ছি? ইচ্ছে হচ্ছিল বলতে যে নিতু এই শহরে আমার সবচেয়ে কাছের মানুষটার আত্মীয় তুমি আমার ভাঙ্গা- চোরা পুরনো গাড়িটা কাজে এলে খুশিই হবো। কিন্তু এমন মেয়ের কাছে এ প্রস্তাব দিলে আবার কিছু মনে না করে বসে! বলা হল না। শুধু বললাম যে কোন সাহায্যে নির্দ্বিধায় ফোন করো। নিতু চায়ের খালি মগ দুটো নিয়ে চলে গেল। আমার একটা অংশও কি সাথে সাথে গেল? হয়তো দেখতে ইচ্ছে হচ্ছিল রান্নাঘরের সিংকের ভেতর চায়ের কাপ ধরে রাখা হাতে জলের ধারার রঙ বদলে যাওয়া অথবা হটাৎ পানি ছিটকে চোখে মুখে পড়লে ওর বিরক্তিতে ভ্রু কুঁচকে ওঠা। আমরা যতই নির্দোষ আর সত্যবাদি হইনা কেন আমাদের নীতিপরায়ণতার ভেতরও কিছু কিছু মিথ্যে থেকে যায়। আমি কি নীতি ভাংছি? হয়তো এই প্রথম আমার বাড়িতে কোন নারীর পদচারণা বলেই আমি উৎসুক হয়ে উঠেছি কিন্তু সেটা কি ঠিক?
ঘুমাতে এলাম। এত রাতে চা’য়ের কারণে কিংবা হটাৎ এই বাড়িতে আরো একটা মানুষের উপস্থিতিতে ঘুম সহজে আসবে বলে মনে হয়না। নিতুর ঘর থেকে লো ভল্যিউমে বাংলা গানের সুর আসছে, এটাকি তরুন বন্দোপাধ্যায়ের সেই গানটা? কাজলও নদীর জলে ভরা আখি ছলছলে প্রদীপও ভাসাও কারে স্মরিয়া....হয়তো কাছাকাছি সুরের অন্যকিছু। গানের সুরের ভেতর দিয়ে বোঝা যাচ্ছে পায়চারি করছে সে। নীতুর পায়ের শব্দ কি আরো খানিকটা কাছে এল? হয়তো ভুল, নাহ এখন দুরে যাচ্ছে তার মানে কাছে এসেছিল সত্যি! কতটা কাছে!
মেয়েটা যেন একটু অন্যরকম আবার ভুলও হতে পারে, হয়তো আমি ভাবছি অন্যরকম।
পরের দিন সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরেই বুঝলাম এখনও ফিরেনি। ডায়নিং টেবিলের উপর ভার্জিলের ঈনিড বইটি উল্টো করে খুলে রাখা।
বইটির মুখ ঘুরিয়ে দেখি পৃষ্ঠা ১৩১, পেন্সিল দিয়ে দাগ দেয়া রয়েছে শেষ অংশটুকু,“পিতা এই ক্ষুধার কথাই বলছিলেন-এ সেই ক্ষুধা যা আমাদের চরম বাঁধা ও প্রাণান্তিক পরীক্ষার নিশানা স্বরূপ। অতএব-চলো। আমরা নন্দিত সূর্যের প্রথম আলোকে দেখি এ কোন দেশ, কারা এর অধিবাসী, কোথায় তাদের সুরক্ষিত নগরী। চলো আমরা বন্দর থেকে ভিন্ন ভিন্ন পথে চলতে থাকি।” এই লাইনগুলো এত জরুরি কেন? মেয়েটা খুব অল্প সময়ের মধ্যেই একার পথে যাচ্ছে। আমার কি ওর জন্য মায়া হচ্ছে? ধুর মায়া বিষয়টাই একটা সুবিধা ভোগের সিস্টেম।
পেছনের বারান্দায় হালকা গোলাপী টাওয়েল ঝুলছে। ঘরের পর্দাগুলো টেনে সরানো। নিতুর খাটে মুখ হা করে রাখা ল্যাপটপ। চিরুণীর সাথে অসচতনে একটা ভুল চুল। হয়তো ঠিক হলনা অনুপস্থিতিতে তার ঘরে প্রবেশ। তবে অনভ্যস্ততাও হতে পারে। প্রতিদিন ফিরে তো আমি এই রুমে এসে কিছুক্ষণ বই পত্র নিয়ে বসি। একদিনে কেমন অন্যের ঘর হয়ে গেছে তবে এই সাময়িক অধিকারে খারাপ লাগছেনা তো আমার! বরং আজ ঘরটাতে প্রাণের স্পন্দন পাওয়া যাচ্ছে। নিতু একগাদা বই পত্র আর কাগজ নিয়ে ফিরল কিছুক্ষণের মধ্যেই। মুখটা লাল হয়ে আছে, ওর চুলগুলোতে কি জট বেধেঁছে? সেই ভুল চুল জড়িয়ে থাকা চিরুনি দিয়ে কি ঘরে ঢুকে সামলে নেবে অবাধ্য চুলগুলো? তারপর কি আবারও কাজল দেবে চোখে? কেন দেবে? কোথায় যাচ্ছে আমার ভাবনা! ও ঢুকেই প্রথমে বলল
- ওহো আমি কি একটু দেরি করে ফেলেছি? স্যরি।
- না না ঠিক আছে।
মেয়েটা বোধহয় একদিনে একটু সহজ হয়ে আসছে। আর স্যরি বলার কোন কারণ নেই। ওর কাজ শেষ হলেই না ফিরবে। কটা দিন পরই তো সম্পূর্ন স্বাধীন জীবন। তাহলে কি আমি অফিস থেকে ফেরার পর এল বলে স্যরি? আমার জমিতে আবারও সবুজ চারা গাছ তাতে জল সিঞ্চন টের পাই।
দ্রুত বলে উঠলাম, কোন ঝামেলা হয়নি তো, রাস্তা-ঘাটের যে অবস্থা! সবকিছু ঠিক ছিল আশ্বস্ত করে নিতু ফ্রেস হতে গেল। খাবার টেবিলে টুকটাক কথা, প্লেটের সাথে গ্লাস বা টুং করে চামচ লেগে যাবার শব্দের ভেতর নিরবতা। তবুও অন্য একজনের উপস্থিতি। এর মধ্যে হটাৎ নিরবতা ভাংলো ও। যেন কয়েকটুকরো হয়ে ঘরময় ছড়িয়ে পড়ল সেই নিঃশব্দ আর তার সাথে আষ্টেপৃষ্টে থাকা শব্দগুলো। নিতু ভড়কে দিল একটা কথা বলে।
- কাজল মামা আপনি কি একবার দারোয়ানকে কোনভাবে জানিয়ে দিবেন আমার পরিচয়টা? একটু অস্বস্তি হচ্ছে। আবার সেই শব্দহীনতা।
দারোয়ান বা জাহানারা ওকে কিছু বলেছে কিনা জিজ্ঞেস করতে উত্তর দিল না সরাসরি। বলল আপনি শুধু একবার ইনফর্ম করে দিন নয়তো আমার এই লোকের চোখের সামনে প্রতিদিন যাওয়া আসা করতে অস্বস্তি হবে। এই প্রথমবার বোধহয় ও আমাকে মামা সম্বোধন করল তবে স্বেচ্ছায় কিনা তাও বোঝা যাচ্ছে না। দুটো দিন দ্রুত চলে গেল। নীতু ওর প্রয়োজনের কাজগুলো একাই সারলো। আমি অফিস করলাম, রাতে ফিরে খাবার টেবিলে দুদিন একসাথে খেলাম, শুনে গেলাম শুধু সেই টুংটাং নিরবতা। মাঝরাতে ওর ঘরের অস্পষ্ট ভেসে আসা সুর। আর আমি কি সেই পায়ের শব্দের জন্য আরো বেশি উদগ্রীব? কাল রাতে শব্দটা আরো বেশি কাছে এসেছে, আরো কাছে আবার দুরে সরে গেছে। যতটা দ্রুত যাওয়া উচিত তার সাথে গতির গুন যোগ হল আমার কাছে।
আজ নীতুর স্বপনের বাসায় চলে যাবার কথা। দুপুরের দিকে ওর বাবা-মা এসেছেন। নীতুও হয়তো ওর সব কাজ গুছিয়ে নিয়েছে। তবে সব কি আর এক জীবনে গোছানো হয় সত্যি! আমি একটু আগেই বাড়ি ফিরলাম আজ। স্বপন এসেছে ওকে নিতে। তিনজন টেবিলে বসে চা খেলাম। স্বপন একাই কথা বলে গেল আগের মতো। সময় পার হচ্ছে যেন কোন অশ্বারোহীর পিঠে করে। খুঁরের শব্দ বড় বেশি দ্রুত বেগে ছুটে চলার। খুব একটা কথা হল না আমার আর নিতুর মধ্যে। ব্যাগ গুছিয়ে বেরিয়ে গেল স্বপনের সাথে। এত হুড়োহুড়ি কেন যে করল মেয়েটা বুঝলাম না। ডুপ্লিকেট চাবিটা বুঝিয়ে দিল দরজার কাছে যেয়ে। সেই একই রকম লাগেজ টানতে টানতে নেমে গেল সিড়ি দিয়ে। একবার ঠাণ্ডা গলায় বলল ‘যাই’।
চলে যাবার পর আর আমি ও ঘরে ঢুকিনি। সকালে জাহানারা এসে ঠিকঠাক করবে কিংবা থাকুক না কয়েকটা দিন ওটা নিতুর ঘর হয়েই। কিন্তু আমার কেন নিজের ঘরেও স্বস্তি নেই? আশ্চর্য ও থাকতেও এমন হতো অথচ চলে যাবার পরও অস্থির লাগছে। ঘরটার প্রসস্তটা কি হটাৎ করেই বেড়ে গেল? মনে হচ্ছে একটা বিস্তৃত মাঠের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছি একা। খুব ধীরে ধীরে শীতের কুয়াশা নামছে আর গাঢ় হচ্ছে দীর্ঘ আর একটা রাত। তিনটি দিনেই কি আমি বাড়ি ফিরে তার উপস্থিতিতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছিলাম? পড়তে পড়তে বই উল্টো করে উঠে যাওয়া, ঘরের এ কোন সেকোন থেকে টুকরো টাকরা কথার শব্দ কি আমাকে সত্যি কোন দ্যোতনা দিত? অথবা বারান্দার গোলাপী টাওয়েল? এত অস্থিরতা নেয়া যাচ্ছে না। ঘুমিয়ে পড়াই ভালো। কিন্তু চাইলেই কি আর ঘুম আসে? বিছানায় এপাশ-ওপাশ করতে করতে তন্দ্রাচ্ছন্ন- মোহগ্রস্থ। আমি যেন কিসের টানে ভেসে চলে যাই। নিয়ম ভাঙ্গি। ভয়ে সরে আসি তবুও তার রেশ রয়ে যায়। পুনরায় নিয়ম ভাঙ্গবার জন্য স্বপ্নের ভেতর উঠে দাড়াই। নিজের কাছেও প্রকাশ করতে ভীষণ জড়তা এই আবেশের। আবারো সেই গলা টিপে ধরা নিজের, কাজল তুমি তো জানো তোমার সমাপ্তি হয়ে গেছে জন্মেই। মানুষত জন্মের সময়ই মৃত্যুর প্রস্তুতি নিয়ে আসে কিন্তু সেই অনুভবটা কারো ক্ষেত্রে হয় আকস্মিক আর বেশিরভাগ মানুষের হয় অভিজ্ঞতা আর বয়সে। কিন্তু তুমি তো কৈশোর পেরোনোর আগেই বুঝে গেছ প্রকৃতি তোমাকে বঞ্চিত করেছে। তোমার শরীরে আগুনের সংমিশ্রণ নেই, জ্বল-মাটির মিশ্রণ নেই, তুমি রঙিন হতে পারোনি কখনো। তুবও কেন এই অসময়ে রঙ মাখছো বুকের ভেতর? অপ্রাপ্তির ক্ষত আরো দগদগে করে দেয়া ছাড়া আর কিবা করতে পারে এই আবেশ? মলয় রায় চৌধুরীর একটি কাব্যনাট্যের কয়েকটি লাইন ঘুরছে মাথার ভেতর, “মৃত্যুতো কারো বাসী স্মৃতির ছত্রাক/ আমার মস্তিস্কে কেন একজন নারী/ বারবার মৃত্যুর ওপার থেকে ডাকে/ সে কোন রহস্যময়ী আছে ওইখানে/ যে আমার শরীরের গন্ধে জেগে উঠে?”
কি অসম্ভব অসহনীয় এবং মোহনীয় একটা রাত কাটল আমার। কাল এমন সময় সে অনেক দূর। মাথার ভেতর একটা তিতকুটে স্বাদ নিয়ে অফিস এলাম। বিষণ্ন একটা খা খা করা সন্ধ্যা নিয়ে বেরিয়েছি অফিস থেকে। আর কতক্ষণ বাকি ফ্লাইটের? ঘণ্টা খানেক? আমি তেজগাঁও থেকে কোনদিকে যাবো? ধানমণ্ডি না উত্তরা এয়ারপোর্ট? কি বলব? কিচ্ছু বলার নেই আমার, আপাত অক্ষম মানুষের আসলে কিছু বলার থাকে না। আমার জন্য সেই শূণ্য গহ্বরই নির্ধারিত। ধানমণ্ডির পথে আমি জ্যামে আটকে আছি। গাড়ির জানালাগুলো বাঁচিয়ে দিচ্ছে আমাকে বহি:বিশ্বের সমস্ত শব্দ থেকে। আমি বাড়ি ফিরছি। প্রশস্ত-বিস্তীর্ণ একটা ঘর। অনুৎপাদিত শষ্যের ফাঁকা মাঠ। পেছনের সিটে গা ঠেসে দিয়ে ফিরছি। ঠিক এমন সময় মোবাইলের নীল স্ক্রীনে নামটা ভেসে উঠল দ্বিতীয়বারের মতো। কয়েকদিন আগে যখন এই একই সময় ক্ষণস্থায়ী এবং স্থায়ী দখল নিতে এসেছিল তখন প্রথম ফোন এরপর আর একবারও নয়। আজ যাবার ঠিক আগ মুহরর্তে আবার স্ক্রীনে নামটা যেন জলের তলা থেকে ভেসে উঠার মতো জেগে উঠল।
- হ্যালো:
- ওপাশে নিরুত্তাপ
- হ্যালো নিতু:
নিশব্দ
- নিতু সব ঠিক আছে?
- আমার চেকিং শেষ, বাড়ি ফিরছেন?
- ফিরছি, সব ঠিক আছে তোমার?
- আপনার ঘরে না বলে একবার ঢুকেছিলা্।
- বেশ, তারপর?
- ওয়্যারড্রোবের ওপরে একটা নোটবুক আপনার।
- হ...
- ওর পাশে কাগজে একটা ছোট্ট নোট রেখেছি আমি
- আগে কেন বলোনি ? কি লিখেছ বলো? ওটা পড়তে পড়তে তুমি নেটওয়ার্কের বাইরে নিতু, বলো কি লিখেছ?
- আপনি বাড়ি ফিরেই জানুন না হয় কি লিখেছি,ভালো থাকবেন (লাইন কেটে গেল)
- নিতু?
ওপাশে শব্দহীন।
বাড়ির পথ এত দীর্ঘ কেন? বড় বেশি দীর্ঘ এই পথ।
আমার হাতে নিতুর লেখা একটা ছোট্ট চিরক’ট।
সম্বোধনহীন
‘ আচ্ছা মানুষ যখন গাছ ভালোবাসে অথবা ধরুন একটা নীল রঙের ফুল? নীল যন্ত্রনার রঙ জানেন তো, আপনার বেলকনিতে ভোরবেলা এসে বসা চড়–ইটার দিকে যখন অবাক হয়ে চেয়ে থাকেন সেই ভালোলাগার কোন ব্যাখ্যা আছে? মানুষ কি তার এই ভালোলাগার ব্যাখ্যা খুঁজে কখনো কিংবা বিভাজন করে? সেভাবে কি অন্য আরেকটা মানুষকে ভালোবাসা যায় শুধু প্রকৃতির অংশ হিসেবে? হয়তো যায়না অথবা হয়ত যায়। যদি নাই যেত গ্রীক দেবতা আর্কেদিয়ান কি করে ভালোবাসলেন নিনমাহকে? এই দেবী মাতার পুরুষ বা নারী হিসেবে কোন মৌলিক বৈশিষ্ট্য ছিলনা। সুমেরিয়ান সভ্যতার এই ইতিহাসটা খ্রীষ্টপূর্ব ২ হাজার বছর আগের। সেখানেও রয়েছে এমন অদ্ভুত ভালোবাসার উপস্থিতি তবে। এখন ভিন্ন কথা। আপনাকে এমন একটা গল্প বলে যাই। সত্যিকার অর্থে কোন পরিচয় আমার নেই, প্রকৃতির অংশমাত্র। স্বপ্ন বুনতে বুনতে সেই গাঁথুনির কৌশল উত্তরসূরীর হাতে ধরিয়ে দেবার সক্ষমতা প্রকৃতি আমায় দেয়নি। আমার স্বপ্ন বহন করে নেয়ার কোন সন্তান আমার থাকবেনা। সমাজ কি নিতে পারে এমন অপূর্ণ মানুষকে। তাই পরিচিতদের কাছ থেকে খানিকটা দুরত্বের এত আয়োজন। তবুও একটা স্বপ্ন দেখেছি। কি নির্মম আর ভুল সুন্দর সেই অভিজ্ঞতা। একটা স্বীকারোক্তি আছে, প্রায় প্রতি রাতেই ইচ্ছে হত আপনাকে যেয়ে বলি, আমার সাথে বারান্দায় এসে বসবেন কিছুক্ষণ? বলতে পারিনি তবে জানিয়ে যাচ্ছি। আপনি কি বুঝতে পারছেন যত্ন করে তৈরি ভুলটা কি?
যাই আমি।
নীতু কি আমাকে একই রকম শৈশবের গল্প বলে গেল!
সাদিয়া মাহজাবীন ইমাম
ফরিদপুর জেলার দয়ারামপুর গ্রামে।
পড়াশুনা করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ও গণমাধ্যম নিয়ে গবেষণা করছেন।
২০০৬ থেকে সাংবাদিকতা করছেন।
প্রকাশিত গল্পগ্রন্থ : পা।
0 মন্তব্যসমূহ