মৌসুমী কাদের-এর গল্প : নিমপাতা

অমাবস্যা-পূর্ণিমা কিছুই ছিলনা, তবু নক্ষত্রের ছোবল খায় সেই রাত। পাড়ার পাহাড়াদার লাঠি চড়িয়ে ইলেক্ট্রিক থাম্বায় ইস্পাতি শব্দ তুলে জোরে জোরে হাঁক ছাড়ে; ‘খবরদার! চুরি করসিশ তো ধরা খাইসিশ, সাবধান! সাবধান...!’ বিদ্ঘুটে সেই চিৎকার নিভু নিভু আলো আর অন্ধকারে মিলিয়ে যায়।


ছটফট করছিল উর্মি, ঘুমাতে পারছিল না। রাত বারোটার দিকে জমিরন একগ্লাস জল দিয়েছিল শেষবার। তারপরও বুকের ভেতর চাপ চাপ ব্যথাটা কমেনি। মনে হচ্ছিল ফেটে যাবে; হৃৎপিণ্ড, খাঁচা, হাড়গোড় সব! এপাশ ওপাশ করেই রাত আড়াইটা। নয় বছরের তপু পাশে ঘুমাচ্ছে। ওর আলাদা বিছানা নেই তাই একা ঘুমাবার সুযোগও নেই। বিছানা ছেড়ে উঠতেই হলো উর্মিকে। গতকাল ওদের যৌথ বন্ধু নম্রতা এসেছিল। ভালোবেসে উর্মি যাকে ডাকে ‘নুম’ বলে। শপিং আর অন্যান্য গোছগাছ করে দিতে চেয়েছিল মেয়েটা। কিন্তু মার্কেট থেকে ফিরে এসে দৃশ্যপট বদলে গেল। শেষবার দেখা মতে মেয়েটা তারেকের সাথে গল্প করছিল। কালো কফি আর বাদাম খাচ্ছিল ওরা । কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে বসার ঘরের ম্যাট্রেসটায় লেপ্টালেপ্টি করে শুয়ে আছে দুজন। বোঝার চেষ্টা করছিল উর্মি, ঠিক কতক্ষণ আগে ওদের সংগম হয়েছে। নুমের অর্গাজম হয়েছিল কিনা সেটাও খানিকটা মাথায় ঘুরছে। কেমন যেন পাগল পাগল লাগছে উর্মির। এরকম অসভ্য চিন্তা কেনইবা মাথায় আসছে সেটাও ঠিক বুঝতে পারছেনা সে। শুধু মনে পড়ছে, তারেক যতবারই উর্মির সঙ্গে শুয়েছে ততবারই ছেড়াভেড়া করে মাল ফেলেছে। নপুংসক পুরুষের নাকি কামনা বেশী।

দাম্পত্য ঢিলেঢালা হয়েই ছিল অনেক আগে থেকে। তাই, অন্যপাত্রের স্বাদ বেড়ে যাবার ব্যাপারটা ছিল স্বাভাবিক। এই অবস্থায়, প্রিয়বান্ধবী নম্রলতা প্রেম কুহক হয়ে কাছে আসলো। ‘না’ বলবার সুযোগই থাকলোনা তারেকের, এমনই তরল পরগাছা সে। আজ নুমের প্রভাব পড়েছে,কাল থাকবে অন্যকেউ। আর এখনতো বোঝাই যাচ্ছে একটা নেশাখোর মেয়ের পাল্লায় পড়েছে সে। এটা ঠিক প্রেম না অন্য কোন টার্নিং পয়েন্ট সেটা দুজনের কেউই হয়ত জানেনা। নইলে একটা বাচ্চা ছেলে যে বাড়িতে আছে সে খেয়াল পর্যন্ত নেই! উথাল পাথাল ভাবনা থেকে উর্মির ইচ্ছেই করেনা তারেককে ঘুম থেকে টেনে তুলে বলে, ‘এমারজেন্সি চলো, প্রচন্ড বুকে ব্যথা।’ কিন্তু কাউকে কিচ্ছু বলেনা। মায়ের বাড়ি কাছেই, ডাকা যায় কাউকে । তবে ফোন করলে প্রথমেই প্রশ্ন করবে, ‘তারেক কই? ওকে নিয়ে যাচ্ছিস না কেন?’ রাত তিনটায় সিএনজি বা রিকশা কোনোটাই পাওয়া সহজ না। তার উপর মোহাম্মদপুর এলাকাটায় ছিনতাই, ধর্ষণ এত বেড়েছে যে এত রাতে কেউ একা বেরোয়না। বুকে তিনবার ফু ফু ফু দিলে উর্মির ভয় করেনা। চেয়ারে পা তুলে জুতোর ফিতা লাগাতে লাগাতে প্রেমিক যুগলকে আরেক পলক দেখে সে। আহাহা, ওদের গায়ে জড়ানো উর্মির ভালোবাসার নকশী কাঁথা, যশোর থেকে ছোটখালা পাঠিয়েছিলেন। নম্রলতা সেকথা জানেনা। কিইবা হবে জেনে। ওরা মগ্নতায় ঘুমায়, কোনো শব্দ ওদের কানে পৌছয়না। জমিরন বুয়া রান্নাঘরে ঘুমুচ্ছে, ডেকে তুললেও ঝামেলা। প্রেমদৃশ্য হজম করতে পারবে বলে মনে হয় না। উর্মিকে জড়িয়ে ধরে কান্নাকাটিও শুরু করতে পারে। দুনিয়াটা বড় অচেনা, কেবলি প্ররোচিত হল্লা, বিশোধ্য ধোঁয়াশা; এসব ভাবতে ভাবতে মধ্যরাতে পেছনে সবটা ফেলে রেখে একাই বেরিয়ে পড়ে উর্মি।


ছ'তলা বিল্ডিং-এর নিচে দারোয়ান ভোঁসভোঁস করে ঘুমুচ্ছে। কলাপ্সেবল গেটটাও খোলা। চারপাশের দালানগুলো কেমন নিঃশব্দ, থমথমে। অন্ধকারটা ঠিক ঘন কালো নয়। আকাশে একটা ফ্যাকাশে আলো লেগে আছে। তাজমহল রোডের মোড়ে যেতেই একটা রিকশা পাওয়া গেল। রিকশাওয়ালা দরদাম করেনি। টেনে চালিয়ে নিয়ে গেছে। বোধহয় চেহারা দেখেই আতঙ্ক হয়েছিল ওর। রাতের ঢাকা অন্যরকম। মোহাম্মদপুর বাসস্ট্যান্ডে কোলাহল নেই, হোটেলগুলো ঝিম মেরে পড়ে আছে, থানার মোড়টায় কিছুটা আলো বেশী বলে ফিজিক্যাল কলেজের মাঠটা পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে, এরপর শংকর বাসস্ট্যান্ড ছাড়িয়ে সাতাশ নম্বরের মোড়ে বাংলাদেশ মেডিকেল সেন্টার।

এমার্জেন্সির ছেলেটা জিজ্ঞেস করল, 'আপনার সাথে কেউ নেই? নাম ঠিকানা বলেন। বিবাহিত? না অবিবাহিত?' এমনিতেই মন ভাল নেই, তার উপর অযথাই সব প্রশ্ন, মেজাজটাই চটে গেল উর্মির। মেয়েমানুষের সাথে সবসময়ই কেউ না কেউ থাকা লাগে! স্বামী নয়তো বাপ। এইতো? কিন্তু ঠান্ডা মাথায় উত্তর দিল সে, 'না একাই এসেছি।'

ডাক্তার আবার জিজ্ঞেস করল; ‘নাম ঠিকানা বলেন।

‘উর্মি নিশাত’। বিবাহিত। বয়েস পঁয়ত্রিশ। আর কিছু?’

‘এত রাতে একা এসেছেন? ভয় করেনি?

‘কী সমস্যা আপনার? এত জেরা করছেন কেন? আমি কার সাথে এলাম গেলাম তাতে আপনার কি?'

ছেলেটা কিছুটা ঘাবড়ে গিয়ে বলল, ‘ইটস ওকে, কিছু মনে করবেন না আপু, প্রবলেমটা কী বলেন’।

'বুকে ব্যথা, হঠাৎ দু’তিন ঘন্টা হল, ব্যথাটা বাড়ছে’। বড় ডাক্তারের নির্দেশে পালস, ইসিজি সব করা হল। তারপর পরপর দুটো ইঞ্জেকশনও দেয়া হল। একটা ডান হাতে আরেকটা তলপেটে। আধাঘন্টা ওইভাবে শুয়ে থাকলো উর্মি। বুকটা ফাঁকা ফাঁকা লাগছে এখন। বাড়ি ফিরে যাওয়া যায় বোধহয়।


বেকুব ডাক্তার আবার প্রশ্ন করল, 'কাউকে কল করতে চান?’

এবার কিছুটা তেতে গিয়ে উত্তর দিলো উর্মি, ‘কাকে কল করবো? কোনো দরকার আছে তার?’

ডাক্তার আর কথা বাড়াল না। মিনমিন করে বললো, ‘দেখুন, আপনার আলসার আছে। নিয়ম করে খেতে হবে। খালি পেটে থাকা যাবে না। আর একেবারেই টেনশন নেবেন না। হার্টে কোনো সমস্যা নেই। তবে এরকম অ্যাসিড জমে গেলে হার্ট বিকল হতে সময় নেবে না।'

টেনশন? সাত দিন পর একজন মানুষ দেশ ছেড়ে চলে যাবে, তার আবার টেনশন কি? ছেড়ে যাওয়া কী জিনিস বোঝে এই ছেলে? তার উপর একটা আস্ত শুয়োর সঙ্গে নিয়ে যাচ্ছে, টেনশন হবে না? এসময়ে এরকম অসুস্থ হলে তপুকে কে দেখবে?


গতরাতের ঘটনাটা কিছুতেই মাথা থেকে নামাতে পারছেনা উর্মি। ওরা অনেক শপিং করে ফিরল। হাসিখুশী তৃপ্ত চেহারা দুজনের। লুঙ্গি, মোজা, আন্ডারওয়্যার, গামছা, দামী জুতো, আরো কতকিছু কিনেছে। নুম একটা একটা করে বের করে দেখাচ্ছিল উর্মিকে। তারেকের জন্য অনেক টাকা খরচ করেছে বোঝা গেল।

এক পর্যায়ে উর্মি সহ্য করতে না পেরে জিজ্ঞেস করে ফেললো; 'আন্ডারওয়্যার গিফট?'

তারেক হাসতে হাসতে বললো, 'মোজাও'। খুশীতে আটখানা সে। দাঁত বের করে ক্যালাচ্ছিল।

নুম হালকা হালকা ঘামছিল। শুধু বললো; 'বেস্ট ফ্রেন্ডকে সবচেয়ে কম্ফোর্টেবল জিনিসটাই দিতে হয়। আর আমিতো জিজ্ঞেস করেছিলাম তারেককে, ও বলেছিল আন্ডারওয়্যার চায় সে’।

'ও বলল আর তুমি কিনে আনলে? ডু ইউ হ্যাভ এনি ডিসেন্সি?' রাগ থামাতে পারছিলনা উর্মি।

'এটা ইনডিসেন্টই বা হল কী করে? বাঙালী মেয়েদের এসব ন্যাকামি আর যাবে না।' কটকট করে চিবিয়ে বললো নুম।

'অন্য সব পোশাকের মতো এটাও একটা পোশাক? তাই না?' বলে তারেক হাসছিল।

'এটা একটা বিশেষ জায়গার পোশাক', উর্মি ভুরু কুঁচকে উত্তর দিয়েছিল।

'সেই বিশেষ জায়গার কম্ফোর্টটাও তো ইম্পর্টেন্ট, তাই না? রহস্য করে মাথা ঝাঁকিয়ে একটু ঠান্ডা স্বরে নুম বললো।

উর্মি আর কোন কথা বাড়ায়নি। কিন্তু চোখে মুখে স্পষ্ট রাগ ছিল ওর। মনে মনে বলেছিল; ‘ঐ জায়গার কম্পফোর্ট দেখার দায়িত্ব কি তোমার? শালা হিপোক্র্যাট। আমার বাড়ীতে খেয়ে আমার সাথেই নখরামি?'

উর্মির অনমনীয় আচরন দেখে নুম উত্তেজিত হয়ে কাজের বুয়া জমিরনকে ডাকতে লাগলো। 'জমিরন...। জমিরন..বটিটা আন তো?'

জমিরন বটি নিয়ে এলে তারেক নুমের হাতটা ঝপ করে ধরে ফেলে। বলে, ‘এটা কি করছো তুমি?’

নুম খুব শান্ত গলায় বলে, ‘কেটে ফেলছি...’

‘কেন?’

‘আমার ইচ্ছে’।

উর্মি চোখ বড় বড় করে তামাশা দেখছে; একজন আন্ডারওয়্যার কেটে ফেলবে আর আরেকজন তা হতে দেবে না। দুইজনে মিলে একরকম টানাটানির দৃশ্য!!

শেষ পর্যন্ত নুম কেটেই ফেলল। কুটি কুটি করে পাঁচটা আন্ডারওয়্যার পনেরো টুকরা। জমিরন মহাখুশী হয়ে টুকরোগুলো নিয়ে গিয়ে ময়লার বাসনে ফেলে দিল।

পরিস্থিতি থমথমে। তারেককে দেখে মনে হচ্ছিল উর্মিকে একা পেলে কাঁচা গিলে খাবে ! কিন্তু নুমের কোনো বিকার হল না। ও বসার ঘরের ম্যাট্রেসটায় গিয়ে শুয়ে পড়ল। এরপর ওদের মধ্যে কী হয়েছে বা ওরা কী করেছে তা উর্মির জানা নেই। উর্মি ছেলেকে নিয়ে শোবার ঘরে ঘুমাতে চলে গিয়েছিল।

নুমের চোখদুটো তীক্ষ্ণ, বুদ্ধিদীপ্ত, দেখলেই মায়া হয়, চুলগুলো ঢেউ তুলে বাতাসে দোল খায়। পাখায় ওম লুকিয়ে ডুবসাঁতার দিয়ে ছিবুড়ি খেলে সে; একে ছোঁয়, ওকে ছোঁয়, আর পরতে পরতে প্রেম বদলায়। উর্মি এসবকিছুই জানে, তবু কেমন করে যেন বন্ধুত্বটা থেকে যায়। কিছুদিন আগে নুমের বাবা আর বোন মারা গেছে। কষ্টগুলো উপচে পড়ছে বলে উর্মি ওকে বাড়িতে নিয়ে আসে। এই আলগা অতিথি আপ্যায়ন যদিও জমিরনের পছন্দ নয় তবু সে নুমের জন্য মুরগীর ঝোল আর খিচুড়ি রান্না করে। কিন্তু রান্না করতে করতেই আবার অভিযোগ করে, ‘আফা, ঐ বেডি সিগারেট খায়’, ‘বেডিডা ভালা না, ভাইজানের লগে রঙঢঙ করে; উর্মি শুনেও না শোনার ভান করে। মনে মনে ভাবে, আর কয়েকটা দিন। প্লেনে উঠে গেলে রঙঢঙ কোথায় যাবে?

এখনও স্যুটকেস গোছানো শেষ হয়নি। টুকটাক শপিং বাকি। বাংলা বাজারে জ্যাকেট কিনতে যেতে হবে। এ সময়ে কে প্রেম করল, কী যায় আসে? ফুপু বলত, নিমপাতা দিয়ে ঘরবাড়ি সব ধুয়ে ফেলবি, পরিষ্কার হয়ে যাবে সব। উর্মি ভাবছিল যাওয়ার আগে তারেককে গরম পানি আর নিমপাতার গোসল করিয়ে নেবে। রোগ প্রতিরোধে এর বিকল্প কিছু নেই। কিন্ত বাধ সাধলো তপু। এবাড়ীতে একটাই শাওয়ারসহ বাথরুম। আরেকটা যেটা আছে সেটা বুয়াদের ব্যবহারের জন্য। তপু ওটা ব্যবহার করতে চায় না। আর বাবা ছাড়া সে গোসলেই যাবেনা।

তাই, নিমপাতার আইডিয়াটা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলতে হল ।

তারেক কখন কোথায় যাচ্ছে সেই হিসেবও ছেড়ে দিল উর্মি।

ড্রাইভারকে টাকা পয়সা দিয়ে বিদায় করা হল ।

তারেকের সব আন্ডারওয়্যার একটা ব্যাগে ঢুকিয়ে গোপন করে রাখা হলো।

জমিরনকে ভাইয়ের বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়ে নিষ্ঠুর সময় কাটাতে থাকলো উর্মি। তপু জমুখালা...জমুখালা বলে বাড়ী মাথায় তুললো।

বাড়ী ভাড়া-টাড়া শোধ করে হোটেলের খাবার খাওয়া শুরু হল ।

এভাবে ভাসমান সময়টা পার করে ঠিক ঠিক একদিন প্লেনে চড়ে বসলো সবাই। এদেশ থেকে ওদেশে ভেসে ভেসে উড়ে চললো সংসার। দীর্ঘক্ষন ‘হ্যাঁ’-‘হু’ ছাড়া আর কোনো কথা হল না দুজনের।

সিডনী পৌঁছে প্রথম যেদিন ঘুম ভাঙলো, উর্মি দেখতে পেল বেডসাইড টেবিলে একটা সোনার আংটি। দেখতে এতই ভারী যে মনে হচ্ছিল উজবেকিস্থানের সোনার খনি তুলে এনেছে কেউ। এর আগে কখনও এ জিনিষ চোখে পড়েনি। জানালার ফাঁক গলে প্রখর রোদ পড়ে ঝলমল করছিল আংটিটা। তপু তখনও গভীর ঘুমে অচেতন। তারেক ওয়াশরুমে।

সুটকেসটা খুলে কয়েকটা নিমপাতা বের করে আংটিটাকে মুড়িয়ে জানালা দিয়ে পাশের বাড়ির ব্যাকইয়ার্ডে ফেলে দিল উর্মি।

নিমপাতা থাকলো না খুলে পড়ল পিছনে ফিরে তাকিয়েও দেখলোনা কেউ।



১৯/২/২০১৬
টরন্টো, কানাডা।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ