-- ড্যাবড্যাব করে কি দেখছেন বলুন তো! একটু হেল্পও তো করতে পারেন...
-- মা-আ-নে?
-- মা-আ-আ-নে কিছুই না। যাক গে যান আর হেল্প করতে হবে না...
-- আপনি তো আশ্চর্য, ...চিনি না জানি না বাসে গায়ে পড়ে হেল্প করতে যাব কেন খামোকা?
-- খামোকা আবার কিসের হ্যাঁ? দেখছেন তো অফিস ব্যাগ, টিফিন ব্যাগ, আজকে আবার বৃষ্টি পড়ার
জন্য ছাতা, সব নিয়ে সামলাতে পারছি না। একটু না হয় ধরতেনই...
-- হ্যাঁ, নিজের থেকে ধরি আর কেস খেয়ে যাই...
-- খুব ঝগড়া করতে পারেন তো আপনি...
-- আমি? ঝগড়া করতে পারি? দেখুন ম্যাডাম উল্টোপাল্টা কথা বলবেন না।
-- উল্টোপাল্টা তো আপনি। একটু ওদিকে সরে বসুন না।
-- সরবো? কোথায়? জায়গাটা দেখিয়ে দিন তো। একেবারেই তো জানলা সেঁটে বসেছি।
-- বেশ তো জানলাটা নিজে বাগিয়ে নিয়েছেন আগে-ভাগে এসে।
-- তাই তো নিয়ম। যে আগে আসবে সেই তো জানলার ধারে বসবে।
-- দেখছেন তো আমার এদিকে কত অসুবিধে হচ্ছে, দাঁড়ানো যাত্রী গায়ে পড়ছে একেবারে, তাও তো একবারও জানলার সিটটা ছেড়ে দিচ্ছেন না।
-- আশ্চর্য তো। নিন আসুন, জানলার ধারে। এমন জানলে কোন শালা আসত এই বাসে। সেক্টর ফাইভে এই এসি বাসগুলো খুব তাড়াতাড়ি নিয়ে যায় বলে এই বাস এভেইল করা।
-- বাব্বা একটু জানলার সিটটা একজন অবলা মহিলাকে দিয়েছেন তার জন্য এত কথা শোনাচ্ছেন?
-- অ..ব..লা? হু:। যাকগে এবার একটু চুপ করুন, আমি একটু গান শুনছি।
কিছুক্ষণ চুপচাপ। মহিলা যাত্রীটি নিজের মোবাইল এদিক-ওদিক টিপেটুপে কিছুতে হতাশ হয়ে আবার—
-- এই যাহ দেখুন তো কি কান্ড। মোবাইলে রিচার্জ করাতে ভুলে গেছি। ইশ কি হবে এবার...পুরুষ যাত্রীটি নিরুত্তর।
-- শুনুন না এই যে। কিছু যদি মনে না করেন আপনার মোবাইলটা একটু দেবেন প্লিজ। মা'কে বাসে বসার সিট পেয়েছি এটা জানিয়ে দেব।
-- হ্যাঁ আমি মনে করব। অফিসে পৌঁছে সেখানকার ফোন থেকে জানিয়ে দেবেন।
-- উফ মা' যে এতক্ষণ টেনশন করবেন। প্লিজ ঠিক আছে বাবা, আপনাকে না হয় কলচার্জ বাবদ দু-টাকা দিয়ে দিচ্ছি।
-- আশ্চর্য আজ কার মুখ দেখেছি যে সকালে উঠেই। নিন নিন।
-- থ্যানক ইউ।
এসডিএফ-এর মোড়ের কাছাকাছি এসে গিয়েছে।
-- শুনুন!
-- আবার কি?
-- বলছি কি আপনি না কাল থেকে বেশ সকাল সকাল এসে আপনার পাশের ওই জানলার সিটটা আমার জন্য একটু রাখবেন প্লিজ? দেখুন না আমার বড্ড দেরি হয়ে যায়। এতটা রাস্তা দাঁড়িয়ে যাওয়া যায় বলুন আপনি!
-- আপনাকে আমার কিচ্ছু বলার নেই।
পরপর দু'দিন জানলার সিট রেখে নিজের সহযাত্রীদের কাছ থেকে বেদম মুখঝামটা খেয়ে তৃতীয় দিন আর মিহির সিট রাখে না। আজ রাখলে নির্ঘাত তাকে চড়-চাপড়টিও খেতে হতো। আশ্চর্য মেয়ে, সিট রাখতে বলে আর পাত্তা নেই। আর নিজের ওপরও রাগ হয় মিহিরের, কে না কে! একদিন এসে বকবক করল মিহিরের সাথে, আর সেও অমনি গলে গেল? দূর ছাই। আর ওই মেয়ের কথা ভাববে না। মোবাইলের হেড-ফোন লাগিয়ে গান শুনতে শুরু করে মিহির। পাশে বয়স্ক একজন অফিস যাত্রী। গড়িয়া বাস ডিপো থেকে বাস ছেড়ে দিয়েও এগিয়ে আবার একটু দাঁড়ায় বাস। আর সেখান থেকেই আজ উঠল সেই মেয়েটি। মিহিরের চোখ বাসের দরজাতেই ছিল, যেই দেখল সেই মেয়েটি উঠছে অমনি সে চোখ বন্ধ করে।
-- এই যে --ওহ কি ঘুম --বাসে উঠেই ঘুমিয়ে পড়লেন? মিহির চোখ খুলে খানিক অবাক, যেন চিনতে পারছে না এমন ভান করল।
-- ওহ আপনি? আবার সেই, আপনি?
-- হ্যাঁ, হ্যাঁ, আমিই, আবার কে? আমার সিট কই?
মিহির কটমট করে তাকিয়ে আবার চোখ বন্ধ করল। পাশের সিটে বসা বয়স্ক ভদ্রলোক একবার মিহিরের দিকে তাকাচ্ছেন পর মুহূর্তেই ওদিকে দাঁড়ানো মেয়েটির দিকে তাকাচ্ছেন। মিহির চোখ বুজে একটুও স্বস্তি পাচ্ছে না, মেয়েটি যদি পেছনের সিট খালি পেয়ে সেখানে গিয়ে বসে পড়ে? বারবার তাই চোখ পিটপিট করে দেখে নিচ্ছে মেয়েটির পোজিশন। এবার দেখল মেয়েটি 'উহ' 'আহ' ইত্যাদি কষ্টের মুখভঙ্গি করছে। আর পারল না মিহির। দাঁড়িয়ে মেয়েটিকে নিজের জায়গা ছেড়ে দিল। মেয়েটি অমনি অম্লান বদনে সিট’টিতে গিয়ে বসে পড়ল। মিহির বুঝল এদিক-ওদিকের সহযাত্রীরা খানিক মুখ টেপাটেপি করল। নিজের ওপর খুব রাগ হল মিহিরের। চেনা-নেই জানা-নেই একটি স্বার্থপর মেয়ের জন্য ও কেন বারবার নিজের সিট ছেড়ে দিচ্ছে!
-- আপনার কষ্ট হচ্ছে? আপনার হাতের ব্যাগটা আমি ধরব? মিহির কটমট করে মেয়েটির দিকে তাকিয়ে বলল,
-- না না, আপনাকে কিছু ধরতে টরতে হবে না।
মিহিরের কথা শেষ হয়েছে কি হয়নি, হঠাৎ বাসটি বিকট শব্দ করে উঠল, আর একটু এগিয়েই বাঁদিক করে দাঁড়িয়ে পড়ল। 'কি হল কি হল' গুঞ্জনের পরেই কানে এল বাসের টায়ার পাংচার হয়ে গেছে।বাস ছাড়তে খানিক দেরি হবে। সবাই হুড়মুড় করে বাস থেকে নামতে শুরু করে, কেউই আর বাসের ঠিক হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে রাজি নয়, বাপ রে! অফিসে লালকালি পড়ে যাবে যে। মিহির'ও নেমে পড়ে। মাঝ রাস্তায় প্রচুর লোক এদিক-ওদিক ছোটাছুটি করে অন্য বাস, ট্যাক্সি ধরার চেষ্টা করতে শুরু করে। প্রতিটি বাসেই সাংঘাতিক ভিড় আর অফিস-টাইমে এরকম মাঝ রাস্তায় কলকাতা'য় ট্যাক্সি পাওয়া তো দূর অস্ত। ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে মিহির বাস থেকে হড়বড় করে নেমে গেছিল, সাড়ে দশটা’তেই তার একটা মিটিং আছে। হঠাৎ মেয়েটির কথা খেয়াল হয় কিন্তু এদিক-ওদিক তাকে দেখতে পায় না। 'উফ যা ধড়িবাজ মেয়ে! নিশ্চয়ই কিছু একটা বাগিয়ে নিয়ে এতক্ষণে এগিয়ে গেছে'। সামনে একটা ভিড়ে ঠাসা বাস এসে দাঁড়াতে অনেকে তার মধ্যেই ঠেলে ঠুলে ঢুকতে শুরু করে। হঠাৎ মিহির দেখে সেই মেয়েটিও কোথা থেকে ছুটে এসে বাসের দরজার মুখে সিঁড়িতে কোনোমতে দাঁড়িয়ে পড়ল। 'ইশ কি দস্যি মেয়ে রে বাবা! এভাবে ঝুলে কিভাবে যাবে?' মিহির'ও ছুট লাগায় বাসের কাছে।
--এই যে,শুনুন, শু-নু-ন, নামুন বাস থেকে!
মেয়েটি নিজের ব্যাগের ওপর ধপ ধপ শুনে থতমত হয়ে নেমে যেই বুঝল যে মিহির ওকে নামাল তক্ষুণি চোটপাট শুরু করল।
-- আরে মশাই, আপনি তো আশ্চর্য লোক। বাস থেকে নামালেন কেন? ইশ এবার আমি কিভাবে অফিস যাব? আপনি একটা যাচ্ছেতাই লোক।
মিহির একটাও উত্তর না দিয়ে নিজের মোবাইলে খুব মনোযোগ দিয়ে কি দেখতে শুরু করে।
-- আপনাকে আমি জিজ্ঞেস করছি একটা কথা, মোবাইল দেখা হচ্ছে! গার্ল্ফ্রেন্ডের মেসেজ পরে পড়বেন। যা তা!
-- ওভাবে কেউ যায়? এক্সিডেন্ট হত তো।
-- হত হত! আপনার কি?
-- আমি উবের ক্যাব বুক করে দিয়েছি, মোবাইলে ওটারই পোজিশন দেখছি ম্যাডাম। এক মিনিটের মধ্যেই এসে যাবে। রাগ রাগ সুরে হলেও মেয়েটি বলে ওঠে।
--ম্যাডাম বলবেন না তো কেমন বুড়ি বুড়ি লাগে। আমার নাম রাধিকা।
-- রা-ধি-কা? বাহ!
সাদা ধবধবে একটি গাড়ি এসে দাঁড়ায়, মিহির আর রাধিকা গাড়িতে বসে হাঁফ ছেড়ে বসে। না, অফিসে বেশি দেরি হবে না মনে হচ্ছে। রাধিকা ব্যাগ থেকে একটা জলের বোতল বার করে খানিক গলায় ঢালে। মিহিরের দিকে বোতল বাড়ায়, মিহির ঘাড় নেড়ে 'না' বলে। কোথায় থাকে, কোন অফিসে কাজ করে রাধিকা, তার হদিশ নেয় মিহির।
-- আচ্ছা ম্যাডা.. ওহ সরি রাধিকা, আমি যদি কাল থেকে গাড়ি নিয়ে বেরোই, আপনি কি যাবেন আমার সঙ্গে? তবে হ্যাঁ, দেরি করে এলে চলবে না কিন্তু। অবশ্য --যদি না আপনার বয়ফ্রেন্ডের কোনো আপত্তি থাকে!
-- আপনাকে দেখতে ক্যাবলা হলে কি হবে --কায়দা করে কিরকম জেনে নিচ্ছেন যে আমার বয়ফ্রেন্ড আছে কি না, তাই না? শুনুন আমি ওই ন্যাকা ন্যাকা প্রেম-ট্রেম করি না। তারপর সেই ছুটির দিনেও এখানে এসে দাঁড়াও, সিনেমা দেখতে এসো। দূর দূর শেষে যদি মনে না থাকে, ঘুমিয়ে পড়ি, তাহলেই চিত্তির! ওসবে আমি নেই। যেদিন বিয়ে করতে হবে সোজা ছাদনাতলায় বসে পড়ব।
মিহির একমনে রাধিকার কথা শুনছে, আর খুব মজা পাচ্ছে। সে মেয়েদের সাথে তেমন মেশেনি, কিন্তু এই দুষ্টু-দুষ্টু রাধিকা'কে তার ভালো লাগতে শুরু করেছে।
-- ফেরেন কখন অফিস থেকে রাধিকা?
-- সাতটা। কেন তখনও বুঝি গাড়িতে লিফট দেবেন? হাসতে হাসতে জিজ্ঞেস বলে রাধিকা।
-- দিতেই পারি। আমার একা একা এত দূর যাতায়াত করতে ভালো লাগে না বলেই বাসে যাতায়াত করি। আচ্ছা আপনি তো আমার নাম জানতে চাইলেন না। এই-যে এই-যে করে কতদিন ডাকবেন?
-- আরে হ্যাঁ,কি নাম আপনার?
-- গোবিন্দ।
-- কি...? গোবিন্দ? গোবিন্দো, গোবিন্দো, ও ও ...বলে ডাকব? এই যে এই যে-ই তো ভালো।
-- আপনার নাম রাধিকা আমার নাম গোবিন্দ, মন্দ কি?
-- উফফ আপনার তো পেটে পেটে খুউউব!
মিহির জোরে হেসে ওঠে।
-- আমি মিহির, ঠাকুমা ছোটতে গোবিন্দ বলে ডাকতেন।
বেশ কিছুক্ষণ চুপচাপ, মিহির অবশ্য তাকিয়ে আছে রাধিকা’র দিকে। রাধিকা সেটি বুঝে একটু যেন আরক্ত হয়। এই প্রথম। ফরসা গালে লালের আভাস দেখে মিহির। রাধিকা'কে ওর অফিসের সামনে নামিয়ে মিহির যাবে আর একটু। রাধিকা'র অফিস প্রায় এসে গেছে দেখতে পেয়ে মিহির হঠাৎ বলে ওঠে।
-- মা ভীষণ ঘ্যানঘ্যান করছেন, আপনার বাড়ির ফোন নাম্বারটা দিন তো, মা'কে বলব আপনার মা-বাবার সাথে কথা বলতে।
-- ধ্যাত!কি না আপনি!
-- কেন? আমি কি পাতে দেবার খুবই অযোগ্য, রাধিকা?
-- আমি কি তা বলেছি? কিন্তু এক্ষুণি কেন?
-- আপনার তো প্রেম-ট্রেম ন্যাকামো লাগে, সোজা ছাদনাতলায় বসবেন বললেন যে—
রাধিকা কি একটা বলতে গিয়ে মিহিরের মুখের দিকে তাকিয়ে হেসে ফেলে।
-- সাব, কগজিনেন্ট আ গয়া।
ড্রাইভারের কথায় দুজনেই চমকে বাইরের দিকে তাকিয়ে দেখে রাধিকা’র অফিসের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে ওদের গাড়ি।
-- মা-আ-নে?
-- মা-আ-আ-নে কিছুই না। যাক গে যান আর হেল্প করতে হবে না...
-- আপনি তো আশ্চর্য, ...চিনি না জানি না বাসে গায়ে পড়ে হেল্প করতে যাব কেন খামোকা?
-- খামোকা আবার কিসের হ্যাঁ? দেখছেন তো অফিস ব্যাগ, টিফিন ব্যাগ, আজকে আবার বৃষ্টি পড়ার
জন্য ছাতা, সব নিয়ে সামলাতে পারছি না। একটু না হয় ধরতেনই...
-- হ্যাঁ, নিজের থেকে ধরি আর কেস খেয়ে যাই...
-- খুব ঝগড়া করতে পারেন তো আপনি...
-- আমি? ঝগড়া করতে পারি? দেখুন ম্যাডাম উল্টোপাল্টা কথা বলবেন না।
-- উল্টোপাল্টা তো আপনি। একটু ওদিকে সরে বসুন না।
-- সরবো? কোথায়? জায়গাটা দেখিয়ে দিন তো। একেবারেই তো জানলা সেঁটে বসেছি।
-- বেশ তো জানলাটা নিজে বাগিয়ে নিয়েছেন আগে-ভাগে এসে।
-- তাই তো নিয়ম। যে আগে আসবে সেই তো জানলার ধারে বসবে।
-- দেখছেন তো আমার এদিকে কত অসুবিধে হচ্ছে, দাঁড়ানো যাত্রী গায়ে পড়ছে একেবারে, তাও তো একবারও জানলার সিটটা ছেড়ে দিচ্ছেন না।
-- আশ্চর্য তো। নিন আসুন, জানলার ধারে। এমন জানলে কোন শালা আসত এই বাসে। সেক্টর ফাইভে এই এসি বাসগুলো খুব তাড়াতাড়ি নিয়ে যায় বলে এই বাস এভেইল করা।
-- বাব্বা একটু জানলার সিটটা একজন অবলা মহিলাকে দিয়েছেন তার জন্য এত কথা শোনাচ্ছেন?
-- অ..ব..লা? হু:। যাকগে এবার একটু চুপ করুন, আমি একটু গান শুনছি।
কিছুক্ষণ চুপচাপ। মহিলা যাত্রীটি নিজের মোবাইল এদিক-ওদিক টিপেটুপে কিছুতে হতাশ হয়ে আবার—
-- এই যাহ দেখুন তো কি কান্ড। মোবাইলে রিচার্জ করাতে ভুলে গেছি। ইশ কি হবে এবার...পুরুষ যাত্রীটি নিরুত্তর।
-- শুনুন না এই যে। কিছু যদি মনে না করেন আপনার মোবাইলটা একটু দেবেন প্লিজ। মা'কে বাসে বসার সিট পেয়েছি এটা জানিয়ে দেব।
-- হ্যাঁ আমি মনে করব। অফিসে পৌঁছে সেখানকার ফোন থেকে জানিয়ে দেবেন।
-- উফ মা' যে এতক্ষণ টেনশন করবেন। প্লিজ ঠিক আছে বাবা, আপনাকে না হয় কলচার্জ বাবদ দু-টাকা দিয়ে দিচ্ছি।
-- আশ্চর্য আজ কার মুখ দেখেছি যে সকালে উঠেই। নিন নিন।
-- থ্যানক ইউ।
এসডিএফ-এর মোড়ের কাছাকাছি এসে গিয়েছে।
-- শুনুন!
-- আবার কি?
-- বলছি কি আপনি না কাল থেকে বেশ সকাল সকাল এসে আপনার পাশের ওই জানলার সিটটা আমার জন্য একটু রাখবেন প্লিজ? দেখুন না আমার বড্ড দেরি হয়ে যায়। এতটা রাস্তা দাঁড়িয়ে যাওয়া যায় বলুন আপনি!
-- আপনাকে আমার কিচ্ছু বলার নেই।
পরপর দু'দিন জানলার সিট রেখে নিজের সহযাত্রীদের কাছ থেকে বেদম মুখঝামটা খেয়ে তৃতীয় দিন আর মিহির সিট রাখে না। আজ রাখলে নির্ঘাত তাকে চড়-চাপড়টিও খেতে হতো। আশ্চর্য মেয়ে, সিট রাখতে বলে আর পাত্তা নেই। আর নিজের ওপরও রাগ হয় মিহিরের, কে না কে! একদিন এসে বকবক করল মিহিরের সাথে, আর সেও অমনি গলে গেল? দূর ছাই। আর ওই মেয়ের কথা ভাববে না। মোবাইলের হেড-ফোন লাগিয়ে গান শুনতে শুরু করে মিহির। পাশে বয়স্ক একজন অফিস যাত্রী। গড়িয়া বাস ডিপো থেকে বাস ছেড়ে দিয়েও এগিয়ে আবার একটু দাঁড়ায় বাস। আর সেখান থেকেই আজ উঠল সেই মেয়েটি। মিহিরের চোখ বাসের দরজাতেই ছিল, যেই দেখল সেই মেয়েটি উঠছে অমনি সে চোখ বন্ধ করে।
-- এই যে --ওহ কি ঘুম --বাসে উঠেই ঘুমিয়ে পড়লেন? মিহির চোখ খুলে খানিক অবাক, যেন চিনতে পারছে না এমন ভান করল।
-- ওহ আপনি? আবার সেই, আপনি?
-- হ্যাঁ, হ্যাঁ, আমিই, আবার কে? আমার সিট কই?
মিহির কটমট করে তাকিয়ে আবার চোখ বন্ধ করল। পাশের সিটে বসা বয়স্ক ভদ্রলোক একবার মিহিরের দিকে তাকাচ্ছেন পর মুহূর্তেই ওদিকে দাঁড়ানো মেয়েটির দিকে তাকাচ্ছেন। মিহির চোখ বুজে একটুও স্বস্তি পাচ্ছে না, মেয়েটি যদি পেছনের সিট খালি পেয়ে সেখানে গিয়ে বসে পড়ে? বারবার তাই চোখ পিটপিট করে দেখে নিচ্ছে মেয়েটির পোজিশন। এবার দেখল মেয়েটি 'উহ' 'আহ' ইত্যাদি কষ্টের মুখভঙ্গি করছে। আর পারল না মিহির। দাঁড়িয়ে মেয়েটিকে নিজের জায়গা ছেড়ে দিল। মেয়েটি অমনি অম্লান বদনে সিট’টিতে গিয়ে বসে পড়ল। মিহির বুঝল এদিক-ওদিকের সহযাত্রীরা খানিক মুখ টেপাটেপি করল। নিজের ওপর খুব রাগ হল মিহিরের। চেনা-নেই জানা-নেই একটি স্বার্থপর মেয়ের জন্য ও কেন বারবার নিজের সিট ছেড়ে দিচ্ছে!
-- আপনার কষ্ট হচ্ছে? আপনার হাতের ব্যাগটা আমি ধরব? মিহির কটমট করে মেয়েটির দিকে তাকিয়ে বলল,
-- না না, আপনাকে কিছু ধরতে টরতে হবে না।
মিহিরের কথা শেষ হয়েছে কি হয়নি, হঠাৎ বাসটি বিকট শব্দ করে উঠল, আর একটু এগিয়েই বাঁদিক করে দাঁড়িয়ে পড়ল। 'কি হল কি হল' গুঞ্জনের পরেই কানে এল বাসের টায়ার পাংচার হয়ে গেছে।বাস ছাড়তে খানিক দেরি হবে। সবাই হুড়মুড় করে বাস থেকে নামতে শুরু করে, কেউই আর বাসের ঠিক হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে রাজি নয়, বাপ রে! অফিসে লালকালি পড়ে যাবে যে। মিহির'ও নেমে পড়ে। মাঝ রাস্তায় প্রচুর লোক এদিক-ওদিক ছোটাছুটি করে অন্য বাস, ট্যাক্সি ধরার চেষ্টা করতে শুরু করে। প্রতিটি বাসেই সাংঘাতিক ভিড় আর অফিস-টাইমে এরকম মাঝ রাস্তায় কলকাতা'য় ট্যাক্সি পাওয়া তো দূর অস্ত। ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে মিহির বাস থেকে হড়বড় করে নেমে গেছিল, সাড়ে দশটা’তেই তার একটা মিটিং আছে। হঠাৎ মেয়েটির কথা খেয়াল হয় কিন্তু এদিক-ওদিক তাকে দেখতে পায় না। 'উফ যা ধড়িবাজ মেয়ে! নিশ্চয়ই কিছু একটা বাগিয়ে নিয়ে এতক্ষণে এগিয়ে গেছে'। সামনে একটা ভিড়ে ঠাসা বাস এসে দাঁড়াতে অনেকে তার মধ্যেই ঠেলে ঠুলে ঢুকতে শুরু করে। হঠাৎ মিহির দেখে সেই মেয়েটিও কোথা থেকে ছুটে এসে বাসের দরজার মুখে সিঁড়িতে কোনোমতে দাঁড়িয়ে পড়ল। 'ইশ কি দস্যি মেয়ে রে বাবা! এভাবে ঝুলে কিভাবে যাবে?' মিহির'ও ছুট লাগায় বাসের কাছে।
--এই যে,শুনুন, শু-নু-ন, নামুন বাস থেকে!
মেয়েটি নিজের ব্যাগের ওপর ধপ ধপ শুনে থতমত হয়ে নেমে যেই বুঝল যে মিহির ওকে নামাল তক্ষুণি চোটপাট শুরু করল।
-- আরে মশাই, আপনি তো আশ্চর্য লোক। বাস থেকে নামালেন কেন? ইশ এবার আমি কিভাবে অফিস যাব? আপনি একটা যাচ্ছেতাই লোক।
মিহির একটাও উত্তর না দিয়ে নিজের মোবাইলে খুব মনোযোগ দিয়ে কি দেখতে শুরু করে।
-- আপনাকে আমি জিজ্ঞেস করছি একটা কথা, মোবাইল দেখা হচ্ছে! গার্ল্ফ্রেন্ডের মেসেজ পরে পড়বেন। যা তা!
-- ওভাবে কেউ যায়? এক্সিডেন্ট হত তো।
-- হত হত! আপনার কি?
-- আমি উবের ক্যাব বুক করে দিয়েছি, মোবাইলে ওটারই পোজিশন দেখছি ম্যাডাম। এক মিনিটের মধ্যেই এসে যাবে। রাগ রাগ সুরে হলেও মেয়েটি বলে ওঠে।
--ম্যাডাম বলবেন না তো কেমন বুড়ি বুড়ি লাগে। আমার নাম রাধিকা।
-- রা-ধি-কা? বাহ!
সাদা ধবধবে একটি গাড়ি এসে দাঁড়ায়, মিহির আর রাধিকা গাড়িতে বসে হাঁফ ছেড়ে বসে। না, অফিসে বেশি দেরি হবে না মনে হচ্ছে। রাধিকা ব্যাগ থেকে একটা জলের বোতল বার করে খানিক গলায় ঢালে। মিহিরের দিকে বোতল বাড়ায়, মিহির ঘাড় নেড়ে 'না' বলে। কোথায় থাকে, কোন অফিসে কাজ করে রাধিকা, তার হদিশ নেয় মিহির।
-- আচ্ছা ম্যাডা.. ওহ সরি রাধিকা, আমি যদি কাল থেকে গাড়ি নিয়ে বেরোই, আপনি কি যাবেন আমার সঙ্গে? তবে হ্যাঁ, দেরি করে এলে চলবে না কিন্তু। অবশ্য --যদি না আপনার বয়ফ্রেন্ডের কোনো আপত্তি থাকে!
-- আপনাকে দেখতে ক্যাবলা হলে কি হবে --কায়দা করে কিরকম জেনে নিচ্ছেন যে আমার বয়ফ্রেন্ড আছে কি না, তাই না? শুনুন আমি ওই ন্যাকা ন্যাকা প্রেম-ট্রেম করি না। তারপর সেই ছুটির দিনেও এখানে এসে দাঁড়াও, সিনেমা দেখতে এসো। দূর দূর শেষে যদি মনে না থাকে, ঘুমিয়ে পড়ি, তাহলেই চিত্তির! ওসবে আমি নেই। যেদিন বিয়ে করতে হবে সোজা ছাদনাতলায় বসে পড়ব।
মিহির একমনে রাধিকার কথা শুনছে, আর খুব মজা পাচ্ছে। সে মেয়েদের সাথে তেমন মেশেনি, কিন্তু এই দুষ্টু-দুষ্টু রাধিকা'কে তার ভালো লাগতে শুরু করেছে।
-- ফেরেন কখন অফিস থেকে রাধিকা?
-- সাতটা। কেন তখনও বুঝি গাড়িতে লিফট দেবেন? হাসতে হাসতে জিজ্ঞেস বলে রাধিকা।
-- দিতেই পারি। আমার একা একা এত দূর যাতায়াত করতে ভালো লাগে না বলেই বাসে যাতায়াত করি। আচ্ছা আপনি তো আমার নাম জানতে চাইলেন না। এই-যে এই-যে করে কতদিন ডাকবেন?
-- আরে হ্যাঁ,কি নাম আপনার?
-- গোবিন্দ।
-- কি...? গোবিন্দ? গোবিন্দো, গোবিন্দো, ও ও ...বলে ডাকব? এই যে এই যে-ই তো ভালো।
-- আপনার নাম রাধিকা আমার নাম গোবিন্দ, মন্দ কি?
-- উফফ আপনার তো পেটে পেটে খুউউব!
মিহির জোরে হেসে ওঠে।
-- আমি মিহির, ঠাকুমা ছোটতে গোবিন্দ বলে ডাকতেন।
বেশ কিছুক্ষণ চুপচাপ, মিহির অবশ্য তাকিয়ে আছে রাধিকা’র দিকে। রাধিকা সেটি বুঝে একটু যেন আরক্ত হয়। এই প্রথম। ফরসা গালে লালের আভাস দেখে মিহির। রাধিকা'কে ওর অফিসের সামনে নামিয়ে মিহির যাবে আর একটু। রাধিকা'র অফিস প্রায় এসে গেছে দেখতে পেয়ে মিহির হঠাৎ বলে ওঠে।
-- মা ভীষণ ঘ্যানঘ্যান করছেন, আপনার বাড়ির ফোন নাম্বারটা দিন তো, মা'কে বলব আপনার মা-বাবার সাথে কথা বলতে।
-- ধ্যাত!কি না আপনি!
-- কেন? আমি কি পাতে দেবার খুবই অযোগ্য, রাধিকা?
-- আমি কি তা বলেছি? কিন্তু এক্ষুণি কেন?
-- আপনার তো প্রেম-ট্রেম ন্যাকামো লাগে, সোজা ছাদনাতলায় বসবেন বললেন যে—
রাধিকা কি একটা বলতে গিয়ে মিহিরের মুখের দিকে তাকিয়ে হেসে ফেলে।
-- সাব, কগজিনেন্ট আ গয়া।
ড্রাইভারের কথায় দুজনেই চমকে বাইরের দিকে তাকিয়ে দেখে রাধিকা’র অফিসের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে ওদের গাড়ি।
0 মন্তব্যসমূহ