পিয়াস মজিদ'এর গল্প : জীবন ও ফ্ল্যাশ-মব বাস্তবতা

আরেকটি রাত। আগের দিন রাশেদ পড়ছিল সোপ অপেরার জন্মবৃত্তান্ত। খানিকটা ভেবেছিল ম্যাডনেস নিয়ে। সুস্থতার পক্ষে দাঁড় করিয়েছিল হাজারটা যুক্তি। শেষ পর্যন্ত বাঁচতে হবে মানুষকে। লড়তে হবে, পৌঁছতে হবে গন্তব্যে। আর আর কী কী যেন। নিষ্কাম আমি কুন্ডেরাতে ঢুকে দুই পৃষ্ঠা অর্গাজম দেখি। কিন্তু গত পরশুর ভাবনাটা ছিল পাতাল রেল বিষয়ক। তুমুল তর্ক হল হিমার সাথে।


আচ্ছা ‘মনোযৌনতা’ শব্দটা কীভাবে আনা যায় কবিতায়! কবিতায় না পারলে তাকে আনব গল্পে। ব্যর্থ কোন গল্পে। গল্পে গল্পে কাটিয়ে দেব একটি জনম। পাগলি, তোমার সঙ্গে কিন্তু ভয়াবহ জনম কাটাব। একটু লিটলম্যাগ, একটু বড়কাগজ, একটু লালন, একটু লাকা, একটু বুশ, একটু লাদেন, একটু চরম, একটু নরমে মিলে ভালই চলতে পারে একটি জনম। ও বাসু ভাই, দুটো চা বানাও গরম গরম। ক্লাসে যাই গরম চা খেয়ে। ইতিহাস ক্লাসে গিয়ে নামিয়ে আনি ক্লান্ত দুপুর। জানতে থাকি আলেকজান্ডারের বিবির নাম রোকসানা।

ন্যায়-অন্যায় কিছুই জানিনে। আমির রাশেদ বলছি, হিমা, শুধু তোমাকে জানি। জানি তুমি ছাড়া আর সব অহিমা। এই যে গ্রামায়ন, নাগরিকতা, এত আলো ঝলমল, এত টুইস্টে ভরা দুনিয়া। এর মধ্যে জায়গা কোথায় আমার? আমি যে কিনা রাশেদ। রাশেদ যে কিনা হিমার। হিমা যে কিনা পার্সোনা, স্কাইপ, গুগল প্লাস, কেএফসি, বিএফসি, পিৎজাহাট আর একরাশ সেল্ফি পিকচারের।


রাতভোরের ঝর্ণাতলা

আমাদের অনেক দিনের খরাচোখে কিছু কান্নার জন্ম দিয়ে মেরি আপা মারা গেলেন ডিসেম্বরে। শীতে। সেই মেরি আপা, বিমল মিত্রের প্রতি ছিল যার অন্ধ মুগ্ধতা। বলতেন, তোর আছে মার্কেজ, নিস্তব্ধতা। আমার শুধু কড়ি দিয়ে কিনলাম, সাহেব বিবি গোলাম। গ্রহান্তরের শ্রী যেন ভর করেছিল মেরি আপার উপর। আর তার সব অসুখের নিদান ছিল নূরজাহানের গান। কোমল-ভারি সব রাগ। মেরি আপা যে বইয়ে কিংবা গানেই ভাসতেন শুধু তা নয়। ভালোবাসতেন কাউকে কোনকালে। আমরা জানতাম না। কারণ তার কথা হত তারার সাথে, পশুর সাথে, পাখির সাথে। তবে এক সময় আমার সাথেও হত তার কিছু কথা। কিন্তু তার নৈঃশব্দ্যের শ্রোতা হিসেবে, নিভৃতির দর্শক হিসেবেই আমাকে মানাত বেশি। একদিন মেরি আপা বলে উঠলেন, ‘দ্যাখ। আমি তো জীবনভর পাপের বোঝা বড় করলাম; তুই যেন আমার কনফেশন’। তখন আমার সামনেই দপ করে মোমটা নিভে গেল। জ্বলে উঠল অর্ধশত হিমবাতি। গলতে থাকা তুষারে ভেসে যেতে দেখলাম পিকাডর, ম্যাজিক লণ্ঠন কিংবা কিছু অন্ধকার। মেরি আপা কেন বলতে অমন উল্টাপাল্টা কথা?

...না ওসব গল্পেই হয়। আজকাল গল্পেও তো আর ছিচকাঁদুনে বিষয়ের জায়গা নেই। আমি কি বলতাম কিছু মেরি আপাকে? হ্যাঁ হ্যাঁ, একবার বোধ হয় বলেছিলাম- ‘পৃথিবীটা একটা সোনালি হিংস্র ভালুক। গিলে খাবে আমাদের, তারপর উগরে ফেলবে। আমরা একটু আধটু বদলে যাব। ভালুক হব, মানুষ হব। ভালুক মানুষ। মানুষ ভালুক। ভালুক ভালুক। মানুষ মানুষ।’ আচ্ছা মেরি আপা কেন তখন সেন্ট অগাস্টিনের কথা তুলেছিলেন। জানি না, এমনিতেই হবে। কেউ মরে গেলে আমরা তার মধ্যে দেবত্ব খুঁজি। সাধারণ কথাবার্তার ভেতর সন্ধান করে আনি রহস্য-সৌন্দর্য। আদতে হয়তো ধর্তব্য কিছু নয়। এমনিতেই সেন্ট অগাস্টিনের কথা বলেছিলেন মেরি আপা। পরজনমে মানুষটা সাধনা বোস হতে চাইতেন। ঠিক মধ্যরাতে তিনি নাকি শহরময় সাধনা বোসের মত নেচে বেড়াতেন। তার পা দুটো উড়ে যেত। রক্তস্রোতে ডুবত ঘর-দোর, বিছানা।

হায়রে সাধনা বোস। হায়রে মেরি আপা! সাধনা বোস হলেন কিনা মেরি আপা! নষ্টালজিয়ায় পুড়ে গেল রাশেদ। মৃত্যুর নয়দিন পর মেরি আপা কুস্বপ্নে এলেন। বললেন, ‘এই যে রাশেদ। তোকে অনেক ভালোবাসতাম। তাই তোর হাতেই দিলাম আমার সিজোফ্রেনি সব।’

আজ রাতে নাচের মজলিশে আমিও থাকব। মেরি আপার উড়ন্ত পা দেখে ভাবতে থাকব সত্যিই কি আমি তার কনফেশন!

গত রাতে মেরি আপা আমাকে এই জটিল জিজ্ঞাসার জন্যে প্রস্তুত হতে বলে গেলেন।

তাকে খুব সুন্দর অথবা কুৎসিত দেখাচ্ছিল।

মেরি আপা...



সমস্ত সিডারবৃক্ষ পতিত হইয়াছে

সমস্ত সিডারবৃক্ষ পতিত হইয়াছে। আমরা আবার তাহা নতুন করিয়া রোপন করিব। বাইবেল এমত বলিলেও রক্তে কেবল পতনের প্ররোচনা। তবু এই পতনই আমার শ্রেষ্ঠ বিনোদ। ও নিৎসে, এভাবেই তবে বার্থ অব ট্রাজেডি! পতনকে উদ্যাপন করে আমরা টেক্সটকে পাল্টাই। কিসের নির্বাণ, কিসের পতন?

ও মেয়ে, কিসের ঘুমঘোর জাগরণঘোর? তুমি শুধু পাঠক হও। আমার মনের পাঠক। সোনালি-রূপালি ভাবনার পাঠক। পাঠক থেকেই তুমি আমার দরবারি কানাড়া। কাসাব্ল্যাঙ্কা ভেঙেচুরে তুমিই দিবস, তুমিই রাত্রি। তোমাতেই কাম তোমাতেই শুদ্ধিস্নান। তুমি তুমি তুমি, মৃত্যুর বান্ধবী। সুস্থ সাইকি। মধুর পাগল। সমস্ত মাধুর্য অবসিত। শুধু রোদনভরা বসন্ত। বসন্ত এক দুঃখী রাজকন্যা। বেনজিরের মত। আমরা সব ক্ষুধার্ত-তৃষ্ণার্তরা শুষে নেই বসন্তকে। একটা রেণু পর্যন্ত অবশিষ্ট রাখি না। তবু ফিরে ফিরে আসবেই চৈত্র ও ফাল্গুন। দেবার যা দেবেই। রিক্ত হওয়াতেই আনন্দ তার। আমি বাঁধ সাধার কে? কেউ না।

আমি কারো কেউ না। না রাজনীতির না ধর্মনীতির না অর্থনীতির না সুনীতির।

নাড়ার আগুনে পুড়িয়ে খাব ভুট্টা। খাব বন্ধন খাব মুক্তি।

তারপর ছাইভষ্মের দিকে চোখ রেখে গল্প লিখব।

দেখব প্লট নেই, পাত্র নেই, পাত্রী নেই তবু গল্পের আকাক্সক্ষাটা থাকবে। অথবা লুইজ পিরেন্দেল্লোর নাটকের মতো স্বয়ং নাট্যকারকে খুঁজে ফিরবে তারই রচিত নাটকের ছয়টি চরিত্র।

এই হিংস্রপ্রহর তবু ফিরে ফিরে সেই শ্রমণগৌতম। দ্বিভুজ, ত্রিভুজ, বহুভুজ পাড়ি দিয়ে এসেছে সে। জীব ও জড়ের বেঁচে থাকার সুরসূত্র তার জানা।

হিমা, চলো পাগলামি ছেড়ে সন্ন্যাসের সাথে মিত্রতা করি। তারপর নাশকতা করি। দু’জন মিলে জাগাতে থাকি প্রতিবুদ্ধের ধ্যান। ওই তো বামদিকে লুনা, মুক্তাদির, ইভা, তূর। ডানদিকে রুম্মান, শ্রেষ্ঠ, হৃদয়, উর্মি। কিন্তু আমাকে যেতে হবে গহন কোনো বনের ধারে। খুঁজে পেতে বের করতেই হবে-মিথ এন্ড মিনিং, সিলভিয়া প্লাথ-আনা সেক্সটন- রবার্ট লাওয়েল, সামন্ত অবশেষ, দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ, মাদকের সমাজতত্ত্ব, শিল্প হিসেবে কবিতা ও আবৃত্তির দূরত্ব, ভারতে মোদিবাদের উত্থান ও কর্পোরেট মিডিয়ার ভূমিকা, আবহাওয়া বার্তায় আগামী দু’দিনের ভয়াবহ উষ্ণতা কি আর্দ্রতা...



জীবন ও ফ্ল্যাশ-মব বাস্তবতা

আর কিছু না। আমার জীবনসমুদ্রে শুধু অর্ন্তলীন অগ্নিই তরঙ্গবান। আমি রাশেদ। আমার অমোঘ অসুখই আমার সুখ নিরবধি।

কোথাও কোকিল ডেকে উঠল কি? হাওয়া এত হাওয়া। হাওয়া এসে বিতিকিচ্ছিরি আমার ভাবনাসব উড়িয়ে নিয়ে যায়। পুড়িয়ে দিয়ে যায়। দাউ দাউ। যে জীবন ফড়িঙের, দোয়েলের- তা খাক হয়ে যায়।

অঙ্গার। ছাই। ভষ্ম।

শ্মশাণ-নির্ঝর। পার হব? উপায় নেই। এই পাকে-চক্রে বাঁধা থাকতে হবে আমাকে এর মধ্য থেকেই খোঁজ পেতে হবে অনন্ত নক্ষত্রবীথির। হ্যাঁ হ্যাঁ। এতক্ষণে পেয়েছি। নক্ষত্রের দোষ লেগেই আমি মানুষটা এমন। যার খাবারে রুচি নেই। কাজে কর্মে মন নেই। উপরে উঠবার সাধ নেই।



আর ১টা উইকেট পড়ল।

আরে আরে-চার, ছক্কা হই হই, বল গড়াইয়া গেল কই?

ফ্ল্যাশ-মবের সমসাময়িক মচ্ছবে কারা যেন শ্লোগান দেয়- ‘বিজয়ী হয়েই ফিরব। নইলে ফিরবই না।’

তার মানে বিজিতের জন্যে কোন জায়গা খালি নেই!

আমি তবে কোথা যাই?

আমি; যে এমন বিজিতশ্রেষ্ঠ...



গোলাপের গলিপথ

এই গ্রীষ্মে, এই দারুণ দহনদিনে মনোপ্রাণের প্রবেশপথে দাঁড়িয়ে আছে জাপানি বসন্তের হাইকু-হাহাকার। ঘুমহীন রাত আর অনন্ত নেব্রিয়ামে গা ছেড়ে দিয়ে কিছুক্ষণ হারুকি মুরাকামিতে রাখি চোখ। কিন্তু বেশিক্ষণ থাকার জো নেই; নোংরা লিরিকের প্রবল জোয়ার ডাকছে আমাদের। উচ্চাঙ্গ সংগীতের উৎসবে মুহুর্মুহু ঘনিয়ে আসে লঘুমেঘ। রবীন্দ্র সার্ধশতবর্ষ-টলস্টয় মৃত্যুশতবর্ষ কিংবা শেক্সপীয়রের সার্ধচতুশতবর্ষ পেরিয়ে-মাড়িয়ে লবণপানি ছেঁকে আমি খুঁজে চলেছি সুগার স্ট্রিট। সেখানেও ঝামেলা; ডায়াবেটিকসের আশঙ্কা।

সেলফে পাশাপাশি দুটি বই। গৌরকিশোর ঘোষের উপন্যাস প্রেম নেই আর শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ের আলো নেই। এই সব প্রাতঃস্মরণীয় কথাশিল্পীদের নেই কিন্তু আছে আছে, আমার আছে।

ঝরা পাতার ক্বাসিদা শেষ হতে দাও। তারপর গাছে গাছে দেখবে আমার অন্ধকার ও অপ্রেম কী বিপুল রাজকীয় বর্ণাঢ্যে মুকুলিত!

রিক্ত আমার এই শোভা দেখতে

আসবে তো তুমি?



একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ