সাব্বির জাদিদ'এর গল্প | অন্তর্বাস

লালশাক মেখে ভাত খেতে গিয়ে শাকের ভেতর লুকিয়ে থাকা পাকা মরিচে কামড় পড়লে চেহারা লালশাকের মতোই লাল হয়ে ওঠে। আর চেহারাটা যদি হয় মাসুমা আক্তারের মতো ফর্সা, তবে তো কথাই নেই। এখন যেমন, মাসুমার চেহারা হয়ে উঠেছে লাল, নাকের উপর বিন্দু বিন্দু ঘাম, যেনবা শিশির, কলমি ফুলের উপর-- যেন সে মাত্রই পাকা মরিচে কামড় দিয়েছে। মেয়েকে দেখে ফিরোজার তাই মনে হল। মাসুমার ঝাল ঝাল চটপটি পছন্দ। কলেজ থেকে ফেরার পথে হয়ত সে চটপটি খেয়েছে। এখন ফিরছে মুখ লাল করে।

দুপুর দুটো। সংসারঅন্তপ্রাণ গৃহিণীর গোসলে যাওয়ার এটাই আদর্শ সময়। ফিরোজা শাড়ি-সায়া-ব্লাউজ কাঁধে নিয়ে কলপাড়ে যাচ্ছিলেন। সামনে প্রাচীর হয়ে দাঁড়াল লালমুখো মাসুমা—‘মা, কথা আছে, ঘরে এসো।’ হাওয়া ভালো না। টের পেলেন ফিরোজা। সুড়সুড় করে মেয়ের পেছন পেছন ঢুকলেন ঘরে। যেন তিনিই মেয়ে, মাসুমা তার শাসনকর্তী মা। মাসুমা নাকের পাটা ফুলিয়ে তোতলাতে তোতলাতে (রেগে গেলে সে তোতলায়) বলল, ‘আব্বাকে ব্যব্যব্যবসা বদলাতে বলো। দুদুদুনিয়ায় আর ব্যবসা নাই!’

আবারো সেই কাহিনী। নিশ্চয় কোন বদ ছোকরা আজেবাজে কিছু বলেছে। ফিরোজা মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে নরম গলায় বললেন, ‘ব্যবসা হলো ধর্মের মতো, মা। চাইলেই কি কেউ ধর্ম বদলাতে পারে! পারে না। একটু মানিয়ে চল। আর কয়টা দিন! বিয়ে হয়ে গেলে আর কেউ তোকে জ্বালাতে আসবে না।’

মাসুমা অবাক গলায় বলল, ‘এ তুমি কী বলছ, মা! ব্যবসা ধমের্র মতো! এই ধর্মেরও কি নবি আছে ! প্লিজ মা, আব্বাকে তুমি বোঝাও।’

সমস্যাটা বেশ পুরনো। মাসুমার আব্বা যখন ফুটপাত ছেড়ে মির্জা মার্কেটে দোকানটা নিলেন, তখন। মাসুমা তখন স্কুলে, ক্লাস টেনে। মিলাদ দিয়ে নতুন মার্কেটে দোকানটা নেয়ার পর সহপাঠীরা জেনে গেল তাদের ক্লাসের সুন্দরী তোতলা মেয়েটার আব্বা রঙবেরঙের ব্রা-পেন্টির ব্যবসা করে। মফস্বল শহর। সবাই চেনাজানা। ভাগ্যিস, তখনো ফেসবুক এতটা পপুলার হয়নি সেকেন্দার আলী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ছেলেদের ভেতর। নয়তো ছেলেদের ওয়ালে ওয়ালে টপকাতে থাকত রসিকতার রস। ঝুলত ব্রা-পেন্টির পিকচার। ফেসবুক নেই বলেই অবসরে তাদের বিনোদনের প্রধান প্রসঙ্গ হয়ে উঠল ব্রা আর পেন্টি। পথেঘাটে একা পেলেই তারা মাসুমাকে খোঁচায়।হয়রানি করে।

মাসুমা প্রায়ই মায়ের কাছে কান্নাকাটি করে। প্রচণ্ড রেগে গিয়ে কখনো তোতলায়। আব্বার ব্যবসা পাল্টানোর কথা বলে। ফিরোজা কখনো ধর্মের দোহায় দেন। আজ যেমন দিয়েছেন। কখনো দেন মা লক্ষ্মীর দোহাই—‘ব্যবসা হল লক্ষ্মী। একে সব সময় খুশি রাখতে হয়। এক খাতে প্রবাহিত করতে হয়। বেজার হলেই বিপদ। বরকত উঠে যায়।’

মায়ের যুক্তি অথবা কুসংস্কার কোনটাই মানতে পারে না মাসুমা। তার অবাক লাগে, দুনিয়ায় এতো এতো ব্যবসা থাকতে আব্বাকে কেন ওই বিব্রতকর ব্যবসাটাই করে যেতে হবে জীবনভর!

মা তখন বোঝান— ‘আমরা গরিব। বড় ব্যবসা করার মতো পুঁজি তোর আব্বার নেই। তাছাড়া এই ব্যবসাটায় সে অনেক দিন আছে। এর লাইনঘাট সব বুঝে গেছে। এখন নতুন ব্যবসায় নামা রিস্কি।’ বুঝেও মাসুমা অবুঝের মতো খিটমিট করে।

আওয়াল, মাসুমাদের ক্লাসের নাম্বার ওয়ান বখাটে, মোটা টায়ারের বাইসাকেল নিয়ে সে স্কুলে আসে। প্রতিদিন আসে না। যেদিন আসে, না দেখেও তার উপস্থিতি টের পাওয়া যায় পারফিউমের ঝাঁঝালো গন্ধে। স্কুলে আওয়ালকে নিয়ে নানান রূপকথা চালু আছে। সে নাকি সাইকেল রেস প্রতিযোগিতায় পুরো জেলার ভেতর তিন তিন বার ফার্স্ট হয়েছে। জেলা প্রশাসকের হাত থেকে কব্জা করা তিনটে ক্রেস্টও নাকি আছে তার বাসায়। এই প্রতিযোগিতা কবে কোথায় হয়েছিল, কেউ আবশ্য তা জানে না। বড়দের মতো সিগারেট খায়। যদিও তার ঠোঁট এখনো কালো হয়ে ওঠেনি পুরোপুরি। না গজাতেই দাড়ি-গোঁফ কামায়। কবে নাকি কোন মেয়ের ওড়না ধরে টান দিয়েছিল ভিড়ের সুযোগ নিয়ে। সেই আওয়াল একদিন মাসুমাকে একা পেয়ে গেল বজলার মোড় পার হয়ে। মাসুমা স্কুল থেকে ফিরছিল বেণী দুলিয়ে। গুনগুন করে গানও বোধহয় ভাজছিল গলায়। আওয়াল ঘ্যাচাং করে তার বাইক থামালো মাসুমার সামনে। ধনুকের মতো অর্ধবৃত্ত তৈরি করে। নিঃশব্দ মাসুমা পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছিল ধনুকীয় সেই বৃত্ত থেকে। হঠাৎ আওয়াল, বলা নেই কওয়া নেই, চেপে ধরল কলার থোড়ের মতো মসৃণ মাসুমার হাত। মাসুমা আঁতকে উঠল। উঃ শব্দটা বেরুলো তার গলার গহ্বর থেকে।

আওয়াল বলল, ‘তোমার বাপ কি খালি তোমাদের জিনিস বেচে? আমাদের জিনিস বেচে না! বড় হয়ে গেছি, বুঝলে, বড় হয়ে গেছি! তোমাদের দোকানে কি বড় পোলাদের জাঙ্গিয়া পাওয়া যাবে?’

মাসুমা সেদিন কী যে কাঁদা কেঁদেছিল, রাস্তায় এবং বাড়িতে এসে! সে এতো লাজুক মেয়ে, স্কুলপথে কলমের মাথাটা হঠাৎ খুলে পড়ে গেলে আর ওঠায় না নিচু হয়ে; এতোই তার লজ্জা, অথচ সেদিন রাস্তার মজা-লোফা শত মানুষ সার্কাস দেখার মতো দেখেছে তার গাল ধুয়ে দেয়া চোখের জল, তবু, একটু লজ্জা কি সংকোচ গায়ে হুল ফোটায়নি মাসুমার। মায়ের শত কাকুতি-মিনতিতেও সে খোলেনি তার কান্না-রহস্যের জট। এত অভিমান তার জমেছিল বুকে, সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, আর কোনদিন বাবার পেশা নিয়ে মাকে কিছু বলবে না। সে লাঞ্চিত হোক, অপমানিত হোক, তাকে নিয়ে টিটকারি করুক বখাটেরা-- কার কী এসে যায়! গভীর রাতে শুধু একটা ইচ্ছে তার জেগেছিল তীব্রভাবে; বাবার দোকানটা যদি সে ছারখার করে দিতে পারত আগুন জ্বালিয়ে!


কলেজে উঠলে নাকি ছেলেরা সভ্য হয়, ভারত্ব আসে আচরণে-- এমনই ধারণা ছিল মাসুমার। ধারণাকে অনিবার্য ভেবে মেট্রিকের রেজাল্টের পর হাইস্কুলের বন্ধুবান্ধবের সাথে মহাআনন্দে মফস্বলের পরিচিত কলেজে ভর্তি হয়ে গেল মাসুমা। বাবার পেশা-সংক্রান্ত সেই বিব্রতকর জীবন বুঝি সে ছেড়ে এলো পেছনে। আসলেই কি ছেড়ে এলো! কলেজের প্রথম দিন প্রথম ক্লাসে আসলেন ইংরেজির স্যার। প্রথম দিন বলেই পড়াশোনা কিছু হল না। প্রথমদিন চিন-পরিচয়ের দিন। স্যার প্রথমে নিজের নাম, বাসা, চাকরি বয়স এবং চাকরির প্রথম দিককার এক মজার অভিজ্ঞতা শেয়ার করলেন নতুন ছাত্রছাত্রীদের কাছে। স্যারের পর ছাত্রছাত্রীদেরও পরিচয় দিতে হলো দাঁড়িয়ে। নাম আর রেজাল্টের পাশাপাশি স্যার যখন বাসার অবস্থান এবং বাবার পেশার খবর জিজ্ঞেস করতে লাগলেন-- মাসুমা পড়ল ফাঁপড়ে। টেকো মাথার এই লোক কি স্যার, না ঘটক! বাবার পেশা দিয়ে তাঁর কী দরকার! দেখা গেল বেশিরভাগ ছেলেমেয়ের বাবা চাকরিজীবী। স্যার আবার শুধু চাকরিতেই সন্তুষ্ট নন। চাকরির ধরণ এবং সেলারি-- এসব ঘরোয়া বিষয়ও ছাড় পেলো না প্রশ্নের জেরা থেকে। মাসুমা শুধু আল্লাহ আল্লাহ করতে লাগল। দ্বিতীয় বেঞ্চের কোণায় বসে সে মানতও করে ফেলল-- আজ যদি সে বাইন মাছের মতো ফসকে যেতে পারে প্রশ্নের মুঠো থেকে, বাড়ি পৌঁছেই সে দুই সালামে চার রাকাত নফল নামাজ পড়বে। আল্লাহকে ডাকা এবং নামাজের মানত কাজে এলো না। নাম আর মেট্রিকের রেজাল্টটা জানিয়েই সে বসে পড়েছিল আসনে। স্যার আবার দাঁড় করালেন। বাসা আর বাবার পেশা জানতে চাইলেন। মাসুমা জানাল—‘বাসা তালতলা। বাবা ব্যবসা করেন।’

চাকরির ভিড়ে ব্যবসা-- এ যেন গোলাপ বাগানে রজনীগন্ধা। রজনীগন্ধার গন্ধ নিতে স্যার আলাপী ঢঙে বললেন, ‘কীসের ব্যবসা?’

ঘামতে লাগল মাসুমা—‘কাপড়ের ব্যবসা, স্যার।’

কাপড়ের ব্যবসা শুনেই বুঝি স্যারের আগ্রহ বেড়ে গেল তিনগুণ। তিনি চেয়ার ছেড়ে দ্বিতীয় বেঞ্চের সামনে এসে বললেন, ‘গুড, ভেরি গুড। তোমাদের দোকানে কি শার্টপ্যান্টের পিচ পাওয়া যাবে, আমার গায়ের?’

কী যে বলবে মাসুমা, খুঁজে পেল না। কতক্ষণ আমতা আমতা করার পর ভূতই যেন নিয়ে নিলো তার বাক্য নির্মানের ভার—‘স্যার, আমাদের দোকানে শুধু মেয়েদের পোশাক পাওয়া যায়।’

--‘দোকানের ঠিকানাটা একটু লিখে দাও তো, কী যেন নাম বললে তোমার, হ্যাঁ, মাসুমা, সময় সুযোগ পেলে তোমার আন্টিকে সাথে করে যাব তোমাদের দোকানে। তোমার আব্বাকে বলে রাখবে, কেমন!’

পেছন থেকে কেউ একজন, সম্ভবত ফরিদ, গলা তেমনই, বলল, ‘জ্বি স্যার, অবশ্যই যাবেন আন্টিকে নিয়ে। ওদের মাল খুব ভালো আর টেকশই। অনেক দিন লাস্টিং করে।’

স্যার একগাল হেসে দিয়ে ফরিদকে বললেন, ‘তুমি বুঝি তোমার গিন্নিকে নিয়ে প্রায়ই যাও ওদের দোকানে।’ হাসির কলরব উঠল। সেই হাসিতে মাসুমার অংশগ্রহণ নেই। সে ক্রমাগত ঘামছে।


আলতাফ হোসেন মেয়ের জন্য পাত্র খোঁজা শুরু করেছেন। মেয়ে বড় হয়ে গেছে, এখন তার বিয়ে দেয়া যায়-- এমন ভাবনা থেকে নয়। পাত্র খোঁজার কারণ, মাসুমা পড়ালেখা ছেড়ে দিয়েছে। ছেড়ে দিয়েছে মানে সে আর আগের মতো পড়ছে না। কলেজে যাচ্ছে না। বাঙালি মেয়েরা মুখে না বললেও আচরণের ভেতর দিয়ে বিয়ের বাসনা প্রকাশ করে দেয়। পড়াশোনায় অমনোযোগ-- এও নাকি বিয়ের আলামত!

মাসুমা চলনসই গোছের মেয়ে। চারিত্রিক কোন বদনাম নেই। হাতের কাজে দক্ষ। অল্প খোঁজেই কয়েকজন পাত্র পরপর এসে মাসুমাকে দেখে গেল। তারা পছন্দও করল মাসুমাকে। কিন্তু কী এক অদ্ভুত কারণে কন্যাগৃহ ত্যাগ করেই তাদের অপছন্দের কথা জানিয়ে দিলো ঘটক মারফত। ব্যাপারটা বেশ ধোঁয়াশাপূর্ণ। আলতাফ হোসেন ঘটককে ধরলেন—‘ঘটনা কী!’

ঘটনা তেমন কিছু না। আবার কিছুও। আলতাফ হোসেনের পেশাই হল ঘটনা। শ্বশুর মশাই ব্রা-পেন্টির ব্যবসায়ী, কোন ছেলেই এটা সহজভাবে নিতে পারছে না। তারা তো সামাজিক জীব। তাদের সমাজ আছে। আত্মীয়-স্বজন আছে। সবাইকে নিয়ে তাদের জীবন। সমাজ আর স্বজনদের কাছে তারা কীভাবে এই বিব্রতকর পেশার খবর উথ্থাপন করবে! সাধ করে কে এই গ্যাড়াকলে পড়তে চায়! দুনিয়ায় মেয়ের অভাব!

আলতাফ হোসেন কতক্ষণ চুপ মেরে থেকে বললেন, ‘এরপর পাত্রপক্ষকে বলবেন, মেয়ের বাপের কাপড়ের ব্যবসা, বুঝছেন?’

পরের অভিযানে নতুন থিওরি প্রয়োগ করা হল। শাহিন তার মায়ের সাথে মেয়ে দেখতে এসে মাসুমার অনামিকায় আংটি পরিয়ে দিল।

শাহিন ছেলেটা দেখতে শুনতে ভালো। পার্শ্ববর্তী থানায় তার বাড়ি। পেশায় এক প্রাইভেট ব্যাংকের সহকারী হিসাবরক্ষক। বাবা বেঁচে নেই। বাবার রেখে যাওয়া বাড়ির অসমাপ্ত কাজটুকু শেষ করেই সে বিয়ে করবে মাসুমাকে। মাসতিনেকের ফ্যারা।

মাসুমা এক উজ্জ্বলতম দিনের প্রতিক্ষায় থাকে। দলে ডাক পাওয়ার পর খেলোয়াড় যেভাবে অভিষেকের দিনটির জন্য মুখিয়ে থাকে প্রবল উত্তেজনা আর হৃদকম্পন নিয়ে। সারাদিন মাসুমা এঘরে যায় ওঘরে যায়, জানালার সামনে দাঁড়িয়ে থাকে, গোপনে ঠোঁট বুলায় আংটির উপর। আজন্ম সাথে থাকা নারীচিহ্নের মতো এই বিয়ে-চিহ্নটাও বড় পবিত্র আর মূল্যবান মনে হয়। শাহিন তাকে স্মার্ট হ্যান্ডসেট কিনে দিয়েছে। এই মোবাইল চালাতে গিয়ে মাসুমা অথৈ জলে পড়ে। সে পাশের বাড়ির রুবি ভাবির কাছ থেকে মোবাইল চালানোর দীক্ষা নেয়। ন

রাতে সবাই ঘুমিয়ে গেলে শাহিন হবুবউয়ের কাছে ভিডিও কল দেয়। এমনিতে শাহিন যথেষ্ট গম্ভীর। অথচ দ্যাখো, যখন সে মাসুমার সাথে কথা বলে, ক্যামন ন্যাকামো করে।

--‘এই সোনা, খুব কাছে পেতে ইচ্ছে করছে তোমাকে।’

--‘বিয়েটা হোক তখন তো সারা জীবনের জন্য কাছে পাবেন।’

হ্যাঁ, মাসুমা আপনি করেই বলে শাহিনকে। শাহিন অবশ্য তুমি করে বলানোর কম চেষ্টা করেনি। মাসুমার একই কথা—‘বিয়ের পর দেখা যাবে। আপনি আমার কত বড়, তুমি করে বলতে লজ্জা করে না বুঝি!’

ভিডিও কলের এক সুবিধা, শোনার সাথে দেখাও যায়। প্রযুক্তির কল্যাণে শোনা আর দেখার সহজতায় অল্পদিনে তাদের প্রেম মন ডিঙিয়ে দেহের ভেতর প্রবেশ করে। শাহিন বলে, ‘তোমার ঠোঁট দেখব ভালো করে। মোবাইলটা ঠোঁটের উপর ধরো না জাদু!’

মাসুমা কটমট করে চোখ পাকায়—‘শুরু হয়ে গেল বাঁদরামো! শুধু ঠোঁটই কিন্তু, আর কিছু না।’ মাসুমা ঠোঁটের খুব কাছে মোবাইল ধরে।

--‘ওহ! কী কিউট তোমার ঠোঁট! কমলার কোয়া। চুমু দিতে ইচ্ছে করছে।’ অপরপ্রান্তে শাহিন মোবাইলের স্ক্রিনে চুমুই বসিয়ে দেয় টকাস করে।

মাসুমা লাফ দিয়ে সরে যায় পেছনে—‘এই এই, করে কি করে কি, ফাজিলটা!’ যেন সত্যি সত্যি চুমুটা পড়েছে তার ঠোঁটে।

এক বিকেলে শাহিন আসে মাসুমাদের শহরে। ফোন দেয়—‘এই, একটু বক চত্বরে আসো না! অফিসিয়াল কাজে এসেছিলাম। কাজ শেষ। তোমাকে দেখে ফিরে যাব।’

মাসুমার বুকের ভেতর রক্ত ছলাৎ ছলাৎ করে আনন্দে—‘মাকে কী বলব?’

--‘আমার কথাই বল।’

--‘উহু, পারব না। লজ্জা করছে।’

--‘তাহলে অন্য কিছু বল।’

মাসুমার মন তখনই বকের মতো উড়ে যায় বক চত্বরে। কিন্তু শরীর ভারি হয়ে আসে। খুব আস্তে ধীরে সময় নিয়ে সে শাড়ি পরে। একটু সাজগোজও করে। কপালে সবুজ টিপ দেয়। মাকে বলে, ‘রিতুর ছোট ভায়ের জন্মদিন আজ। দাওয়াত করেছে। বিকেলটা থাকব।’

পর্দাঘেরা এক রেস্টুরেন্টে হালিমের গরম বাটি সামনে করে ওরা বসে থাকে। লজ্জায় মাসুমা চোখ তুলে তাকাতেই পারে না। শাহিনকেও একটু অপ্রতিভ মনে হয়। তবে খুব অল্পতেই সে সহজ হয়ে ওঠে—‘শাড়িতে তোমায় দারুণ লাগছে।’

মাসুমা একবার তাকিয়েই আবার নামিয়ে নেয় চোখ। শাহিন বলে, ‘এতো লজ্জা কেন, হ্যাঁ!’ বলতে বলতে সে টেবিলের নিচে মাসুমার পায়ে পা দিয়ে ঠোকা দেয়। মাসুমা শুধু হাসে। শাহিনের বুড়ো আঙুল শাড়ির নিচ দিয়ে মাসুমার পা বেয়ে উপরে উঠতে থাকে। মাসুমার পা, শুধু পা কেন, সারা শরীর; সিরসিরিয়ে ওঠে ওই স্পর্শে। এক ঝটকায় দাঁড়িয়ে পড়ে সে বিব্রত গলায় বলে, ‘কী করেন, লোকে দেখবে না!’

শাহিন হবুবউকে হাত ধরে বসিয়ে দিয়ে হাসতে হাসতে বলে, ‘লোক কোথায় পাবে, দেখছ না পর্দা টাঙানো!’

বাড়ি এসেও স্পর্শটা নামে না পা থেকে। একলা ঘরে শাড়ি উঁচু করে সে স্পর্শটাকে ধরতে চায়। শাড়ি ওঠার সাথে সাথে কোথায় যেন পালিয়ে যায়। শাড়ি নেমে গেলে ফিরে আসে আবার।


এক দুপুরে ফিরোজা বেগমের মুখ লাল হয়ে ওঠে। চোখে টলমল করে পানি। না, লালশাকের সাথে তিনি পাকা মরিচে কামড় দেননি। ঘটক খবর এনেছে-- শাহিন বিয়ে করবে না মাসুমাকে। কারণ, মেয়েপক্ষ বাপের পেশা গোপন করেছে। মাসুমা দুপুরের গ্রাম্য রাস্তার মতো নীরব হয়ে গেল। বিয়ের চিহ্ন সেই আংটিটা খুলতে গিয়ে দেখল, আঙুলে সাদা দাগ পড়েছে গোল হয়ে। খবর পেয়ে পড়শিরা এলো সমবেদনা জানাতে। তাদের কথাবার্তা শুনে মনে হল, মাসুমা এক তালাকপ্রাপ্তা নারী। এইমাত্র সে তালাক খেয়ে বাপের বাড়ি এসে উঠেছে বাক্সপেটরাসমেত।

মাসুমা ঘরবন্দী হয়ে রইল। বিয়ে এবং পুরুষ জাত-- দুটোর উপরই জন্মাল প্রবল ঘৃণা। সিদ্ধান্ত নিলো, জীবনে বিয়েই সে করবে না। এতো মধুর সম্পর্ক যদি ভেঙে যায় ঠুনকো অজুহাতে, কী হবে বিয়ে দিয়ে!

আলতাফ হোসেন নতুন ছেলে জোটাতে ব্যস্ত হলেন। মাসুমা তার মাকে স্পষ্ট করে জানিয়ে দিলো—‘ছেলে খুঁজে লাভ নেই। বিয়ে সে করবে না।’

ফিরোজা বুঝলেন, এসব মেয়ের মাথা গরমের কথা। মাথা ঠাণ্ডা হলে সব ঠিক হয়ে যাবে।

মাসুমার কথা গ্রাহ্য হল না পরিবারে। আগামিকাল এক ছেলে আসবে দেখতে। মাসুমা জাত সাপের মতো ফোসফোস করতে লাগল। ভাবল, যে ব্রা আর পেন্টির জন্য বারবার তার বিয়ে ভেঙে যাচ্ছে, সেই ব্রা আর পেন্টি দিয়ে সে নিজেই আগেভাগে ভেঙে দেবে বিয়ে। মিথ্যে স্বপ্ন যেন তার সামনে ফুল হয়ে ফুটতে না পারে। মাসুমা কাল অবশ্যই দর্শন দিতে হাজির হবে ছেলের সামনে, তবে সাধারণ পোশাকে নয়; শুধু ব্রা আর পেন্টিতে সজ্জিত হয়ে। নতুন এই পোশাকে অভ্যস্ত হওয়ার জন্য মাসুমা দরজায় খিল তুলে জামা-পায়জামা খুলে ফেলল। ব্রা আর পেন্টি পরে পায়চারি করতে লাগল ঘরময়। অনেক রাত পর্যন্ত চলল এই মহড়া। ভাত খাওয়ার জন্য ডাক পড়ল, সাড়া দিলো না মাসুমা। সে পায়চারি করতে লাগল মাতালের মতো। একটা সময় মনে হল এই পায়চারিতে মাসুমার কোন নিয়ন্ত্রণ নেই। সে যেন বেটারিচালিত এক পুতুল। নতুন বেটারিতে সুইচ অন করে ছেড়ে দেয়া হয়েছে পুতুলকে। চার্জ শেষ হওয়া তক ঘুরতেই থাকবে মুসা নবির উম্মতের মতো।

ঘুরতে ঘুরতে মধ্যরাতে মাসুমা লাটিমের মতো লুটিয়ে পড়ল বিছানায়। ঘুমের ঘোরে সে অনুভব করল, বুক তার পুরুষের মতো সমান, ব্রার ভেতরটা স্তনশূন্য। ব্রার দুই ঢাকনা দুটো পাঁচকুল্লি টুপি। টুপির ভেতর মুসল্লির মাথা নেই। আতঙ্কে তার হাত নেমে গেল নিচে, উরুসন্ধিতে। তার এতো চেনা নারীচিহ্ন, এতো যত্নের নারীচিহ্ন, পলি পড়া ভরাট নদী। মাসুমা আক্তার কি তবে ধীরে ধীরে মাসুম বিল্লাহ হয়ে উঠছে!



লেখক পরিচিতি
সাব্বির জাদিদ
গল্পকার। জন্ম: ১৯৯৪ সালের ১৭ আগস্ট কুষ্টিয়ায়।
ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয় কুষ্টিয়ায় অধ্যয়নরত। 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

5 মন্তব্যসমূহ