শামিম আহমেদ'এর গল্প | মরুকাহিনি



সত্যপীরকে গায়েন বলে, “আপনি যে আমাদের ইহুদি-খ্রিস্টান আর ইসলামি পুরাণের গল্প শোনাতে বলছেন, কিন্তু ওইকাহিনি আমরা টুকরো টুকরো শুনেছি। সবই অন্য ভাষায় লেখা। সে সব পুরাণের হদিশ আমরা কতটুকু জানি! একটু বিস্তৃতভাবে না জানলে শুধু অজ্ঞতার ঝাণ্ডা দুলিয়ে আর কতক্ষণ চালাবো!’’

সত্যপীর বলেন, “হ্যাঁ,এটা ঠিক কথাই বলেছ তুমি। প্রথমে জানতে হবে ইসলামের সঙ্গে ইহুদি আর খ্রিস্টানদের বিরোধের জায়গাটা। তার পর তোমাদের শোনাবো ইসলামের ভিতরে যে দ্বন্দ্ব আছে সেই উপাখ্যান।
সে আর এক কৌরব-পাণ্ডবের লড়াই।’’

গায়েন নড়েচড়ে বসে। সে আর অপেক্ষা করতে পারছে না। সত্যপীরকে সে মিনতি করে, “এক্ষুনি জানান প্রভু। এ কাহিনি শোনানোর লোক তো নেই।’’

সত্যপীর তাকে আশ্বস্ত করেন, “এক জন মানুষ আপাদমস্তক কাপড়ে ঢাকা, তিনি আসবেন একটু পরে। আমি হাওয়ার সঙ্গে মিশে গেলেই।’’

“তা হলে তাই যান সত্যপীর।’’ গায়েনের কথা শেষ হওয়ার আগে ঘোড়ার ক্ষুরের আওয়াজ পাওয়া গেল, টগবগ......টগবগ......

দূরে এক ঘোড়সওয়ার আসছে, তার সারা শরীর আবৃত, মুখমণ্ডলের উপরও পর্দা। সে নারী না পুরুষ বোঝা যায় না। ঘোড়া থামল অদূরে। তার পর শোনা গেল এক অদ্ভুত কন্ঠস্বর, কিন্তু তা থেকেও ঠাহর করা গেল না সে মানব না মানবী! বুঝে আর কাজ কী! গায়েন ও তাঁর শাগরেদরা নীরবে শুনতে লাগল সেই অদ্ভুত মানুষের কথা। এ দিকে ঘোড়া থেমে আছে স্থাণুর মতো, কিন্তু তার কথন থামে না।

“আল্লাহতালা প্রথমে সৃষ্টি করেন মালক-দের, ‘মালক’ আরবি শব্দ। এর ফারসি কথা হল ফেরেশতা।’’

গায়েন জিজ্ঞাসা করে, হজরত মহম্মদ ইসলাম ধর্ম প্রচার করার আগে কি ‘আল্লাহ’ কথাটার চল ছিল?’’

অদ্ভুত মানুষটি জানায়, “নিশ্চয়! আপনারা কি জানেন, হজরত মহম্মদের পিতার নাম আবদাল্লাহ, মানে আল্লাহ-র দাস! তা হলে ‘আল্লাহ’ শব্দ ছিল! আমি সে সব কাহিনি শোনাতে আসিনি। তা বিশদে বলার হুকুম আমার উপর বর্তায়নি। আমি শোনাতে এসেছি, পৃথিবীতে মানুষ আসার কাহিনি, তাদের মধ্যে দাঙ্গা-ফ্যাসাদ, হানাহানি-মারামারির উপাখ্যান।

খোদাতালা প্রথমে সৃষ্টি করেন ফেরেশতাদের। তাঁরা সংখ্যায় অনেক। তাঁদের মধ্যে কয়েক জন ফেরেশতার কথা জানা যায়। সর্বপ্রধান হলেন জিবরাইল। তিনি খোদার দূত। তাঁকে পবিত্র আত্মা বা পাক রুহ অর্থাৎ রুহুল কুদ্দুস বলা হয়। আল্লাহ-র আদেশ-নিষেধ এবং সংবাদ আদান-প্রদানের ক্ষেত্রে ইনি মুখ্য ভূমিকা পালন করেন। আল্লাহ-র সঙ্গে নবিদের যোগাযোগের মাধ্যম জিবরাইল। ফেরেশতা মিকাইল বৃষ্টি ও খাদ্য-উৎপাদনের দায়িত্বে আছেন। ইসরাফিলের কাজ হল, খোদার আদেশে শিঙ্গা ফুঁকে কেয়ামত বা প্রলয় সংঘটিত করা। মালক-আল-মউত হলেন মৃত্যুর ফেরেশতা, তাঁর কাজ প্রাণ হরণ করা।

এ ছাড়া প্রত্যেক মানুষের দু পাশে দু জন ফেরেশতা সর্বদা হাজির থাকেন। তাঁরা হলেন সম্মানিত লেখক—কিরামান ও কাতিবিন। তাঁদের কাজ হল, মানুষের ভাল-মন্দ কাজের হিসাব রাখা। মানুষের মৃত্যুর পরে তাঁকে কবরস্থ করা হলে মুনকির ও নাকির নামের দুই ফেরেশতা মৃতকে উত্থিত করে তাঁর কৃতকর্মের ব্যাপারে জিজ্ঞাসাবাদ করেন।‘মালিক’নামের এক ফেরেশতা নরক বা জাহান্নামের রক্ষণাবেক্ষণ করেন। রিদওয়ান নামের আরেক ফেরেশতা জান্নাত বা বেহেশতের দেখ ভাল করেন বলে জানা যায়।

তাঁদের দায়িত্বপ্রাপ্তির আগে এই সব ফেরেশতারা আল্লাহতালার উপাসনা করে সময় কাটাতে লাগলেন। তার পর খোদা বানালেন আকাশ, মাটি আর নানা কিসিমের প্রাণি।সৃষ্টি করতে প্রভুর লেগেছিল ঠিক ছয় দিন। পৃথিবী তৈরি করতে দু দিন, পর্বতমালা দু দিন, বেহেশত আর তারকামণ্ডলী গড়তে আরও দু দিন। তার পর তিনি নিজের আরশে আসীন হলেন যাতে তাঁর গড়া সৃষ্টির উপর নজর রাখতে পারেন।কেন তিনি এই জগত গড়লেন? কী ছিল তাঁর উদ্দেশ্য? এই প্রশ্নের উত্তর দিতে পারেন একমাত্র তিনিই। অনুমানে যা যা পাওয়া যায় তার কোনওটাই শেষ বিচারে বৈধতা পায় না। তাঁর জ্ঞানের পরিধি যেহেতু মানবের অগম্য তাই মানুষ কেবলমাত্র আন্দাজে অজ্ঞতামূলক কথাবার্তা চালিয়ে যেতে পারে, বা মনগড়া অভিমত জ্ঞাপন করতে পারে। ফেরেশতাদেরও সদা-প্রভু তাঁর সৃষ্টি-রহস্যের কথা বলেননি। মানবের জিজ্ঞাসার জবাবে তিনি শুধু বলেন, আমি যা জানি তা তোমরা জানো না। আর সীমা অতিক্রম করো না, নিজের জ্ঞানের পরিধির বাইরে বেরনো মানুষের পক্ষে বাস্তবিক অসম্ভব। সৃষ্টির শুরুতে কিন্তু মানব আসেনি। অর্থাৎ মানুষের আগে অন্যান্য জীবজন্তু এসেছে, তারা এই গ্রহে মানুষের চেয়ে প্রবীণ। এ বার সৃষ্টিকর্তা বানালেন অদ্ভুত এক সম্প্রদায়। তাদের ‘জ্বিন’ বলা হয়। এরা ধোঁয়াহীন আগুন থেকে পয়দা হয়েছে। তাই তাদের স্বভাব ছিল আগুনের মতো তীব্র। অন্যান্য সৃষ্টির সঙ্গে জ্বিনদের পার্থক্য হল, তাদের মধ্যে খোদার হুকুম লঙ্ঘন করার ক্ষমতা আছে।

সেই সুযোগ নিয়ে জ্বিনেরা কিন্তু দিনে-দিনে খোদার অবাধ্য হয়ে উঠল। তাদের অসভ্যতা এমন জায়গায় গিয়ে পৌঁছল যে খোদা তাদের শায়েস্তা করতে ফেরেশতাদের পাঠালেন। সেই দূতেরা যাকে সামনে পেলেন, একেবারে পেড়ে ফেললেন। কিছু জ্বিন ফেরেশতাদের চোখে ধুলো দিয়ে দুর্গম জায়গায় পালিয়ে গেল। ফেরেশতারা দেখলেন শূন্য প্রান্তর। কিন্তু একটি ফুটফুটে বাচ্চা একা-একা কাঁদছে। এ তো জ্বিন-বংশের। ফেরেশতারা তাকে মারলেন না, সঙ্গে করে নিয়ে এলেন বেহেশতে, যাকে কেউ কেউ স্বর্গও বলে থাকে। সেখানে ওই জ্বিনের বাচ্চা আস্তে আস্তে বড় হতে লাগল। তার নাম ইবলিস। ফেরেশতাদের দেখাদেখি সেও খোদার প্রার্থনায় যোগ দিতে শুরু করল। জ্বিনেদের মতো খোদার অবাধ্য হয়ে উঠল না। তার নিরন্তর তপস্যায় খুশি হয়ে পরম করুণাময় তাকে ফেরেশতাদের সর্দার করে দিলেন। বেশ মর্যাদাসম্পন্ন হয়ে তার দিন কাটতে লাগল।

ইতোমধ্যে আল্লাহতালা ঠিক করলেন আবার তিনি তাঁর প্রতিনিধি পাঠাবেন। জ্বিনেদের মতো তাকে আগুন থেকে বানানো হবে না। আবার ফেরেশতাদের মতো দম-দেওয়া পুতুলও সে হবে না। তাকে খোদা স্বাধীনতা দিয়ে দেখতে চান, সে কী করে! মাটি থেকে বানানো হবে সেই সৃষ্টি। এ কথা ফেরেশতারা শুনে ভাবলেন, খোদা নিশ্চয় আবার জ্বিনেদের মতো আর এক দুর্বিনীত জাতি তৈরি করতে চলেছেন, যারা পৃথিবীর বুকে দাঙ্গা-ফ্যাসাদ আর রক্তপাতে মাতোয়ারা হয়ে উঠবে। ওই দম-দেওয়া পুতুল ফেরেশতারা যান্ত্রিক নিয়মেই এ কথা ভেবে বসলেন। কিন্তু খোদা তাঁদের বললেন, শোনো, আমি যা জানি তা তোমরা জানো না! নূরের তৈরি ফেরেশতারা আল্লাহতালার একান্ত অনুগত, তাঁরা শিশুর মতো পবিত্র আর সুন্দর; অথচ কর্তব্য-পালনে সদা-তৎপর। তাঁরা খোদার প্রতিনিধি হতে পারবেন না, কারণ তাঁরা স্বাধীন নন। আল্লাহতালা স্বাধীন সত্ত্বা চান, যাকে তিনি দান করবেন জ্ঞান আর ভালবাসা। ফেরেশতাদের না আছে প্রজ্ঞা, না রয়েছে প্রেম। মাটি দিয়ে কী বানাতে চান সদা-প্রভু? তার নামই বা কী হবে!

কিন্তু এই সুন্দর বেহেশতে খোদার প্রতিনিধি থেকে কী হবে! এর কি খুব প্রয়োজন আছে! পৃথিবীতেই কি তবে তাকে পাঠানো হবে! কেন! সে তো অতি খারাপ জায়গা। যারাই সেখানে যায় তারাই সেখানে দাঙ্গা-ফ্যাসাদ লাগায়! আর এমন সোনার বেহেশত ছেড়ে খোদার সেই নিষ্কলুষ প্রতিনিধিকে কোন অছিলায় পৃথিবীতে পাঠাবেন সদা-প্রভু!

এই সময় স্বর্গের একটি বৃক্ষ, যার ফল গন্দম নামে পরিচিত, সে মুচকি হেসে উঠল।

আদমেরে কইলা তুমি, গন্দম ওগো খাইয়ো না।

গন্দমেরে কইলা খোদা আদমেরে ছাইড়ো না!।।

কেমন যেন একটা গানের সুর ভেসে আসে। কে এই আদম? খোদার তৈরি সেই প্রতিনিধি কেমন হবে দেখতে, কেমন হবে তার স্বভাব-চরিত্র! যাকে মাটি ছেনে মানুষ করে বানানো হবে, সে ঠিক কী হবে এই নিয়ে ভাবতে লাগল সেই অচেনা সুর! সেই একাকী মানব পৃথিবীতে গিয়ে কী করবে হে সদা-প্রভু!

এক্ষণে রব্বুল আলামিনের আদেশে গোটা পৃথিবী চষে ফেরেশতারা নিয়ে এল মাটি। হরেক কিসিমের মৃত্তিকা। কোনওটা ঘন কৃষ্ণবর্ণ, কোনওটা বা সফেদ বরফের মতো, রক্তবর্ণের মাটিও ছিল সেখানে। তার পর সদা-প্রভুর হুকুমে সেই সব মাটি পচিয়ে কাদা তৈরি করা হল। এই কর্দম শক্ত আঠার মতো চিটচিটে। সূর্যের প্রখর তাপে তা কাদা হয়ে উঠল শুষ্ক ঠনঠনে।

এই মাটিকে রব্বুল আলামিন আদমের রূপ দিলেন।

মাটিকে বানালেন তিনি আদমেরই রূপে।

মর্ত্যে আসিল মানব কার অভিশাপে!।।

শাপ নাকি আশীর্বাদ কেউ কি তাহা জানে!

তবু খোদাকে কেউ মানে কেউ না-মানে।।

তার পর আদমের দেহে ফুঁক দিয়ে সংযোজন করলেন রূহ। এই রূহ হল প্রাণ, কেউ কেউ একে আত্মা বলেও ডাকে। মন কিংবা ইন্দ্রিয় নামে ডাকার লোকেরও অভাব নেই।

সে অনেক কাল আগের কথা। সদা-প্রভু সকল মানবের রূহ তৈরি করেই রেখেছিলেন। ইসলাম বলে, আল্লাহতালা সর্বপ্রথম হজরত মহম্মদের রূহ তৈরি করেন। তার পর সেই আত্মা থেকে আরও বহু। তার পর সেই সব রূহকে তিনি জিজ্ঞাসা করেছিলেন, বলো, তোমাদের প্রভু কে?

সকলেই এক বাক্য বলেছিল, হ্যাঁ! আপনিই আমাদের রব—প্রভু, আপনিই আমাদের মাবুদ, আপনিই প্রতিপালক।

আদমের দেহে এক অদ্ভুত কৌশলে সেই রূহ বসানো হল। এই কৌশল সদা-প্রভু ছাড়া আর কেউ জানেন না, জানবেও না। কী এই রূহ-তত্ত্ব, কাকে বলে রূহ—আত্মা, সে কেমন!

বাসাংসি জীর্ণানি যথা বিহায়।......

যথা জীর্ণমজীর্ণং বা বস্ত্রং তক্ত্বা তু পুরুষঃ।......

এই রূহ কী ভাবে দেহ ছেড়ে বাইরে থাকে! এক দিন যে রূহ দেহের সঙ্গে এই ধরাধামে এসেছিল, সে আবার তার প্রতিপালকের কাছে ফিরে যাবে, কোন অবোধ নিয়মে; তার ব্যবস্থাও রব্বুল আলামিন করে রেখেছেন। কিন্তু ফিরে গিয়ে সে কী করবে, আর কোথায়ই বা যাবে! সে প্রশ্ন আপাতত মুলতুবি থাক। বরং দেখা যাক, আদম দেহে রূহ পেয়ে কী করলেন!

আদম জন্মলাভ করে উঠে দাঁড়ালেন। সদা-প্রভু তাঁকে বললেন, “ওহে আদম, মাটির তৈরি মানব! তুমি যাও, ফেরেশতাদের কাছে। তাঁদের সালাম জানাও। ‘সালাম’ মানে কি তুমি জানো? নিশ্চয় জানো, তোমাকে তো আমি শব্দ-অর্থ, বাক্যের মানে সবকিছু শিখিয়েছি! তুমি যাও, আমার হুকুম তামিল করো।’’

খোদাতালার প্রতিনিধি, স্বাধীন ইচ্ছাশক্তিওয়ালা মানব আদম সফি ফেরেশতাদের কাছে গিয়ে সালাম দিলেন। আসসালামু আলাইকুম। সেই স্বাধীন ইচ্ছাশক্তিসম্পন্ন মানবের প্রথম কাজ ছিল, হুকুম তামিল করা।

আপনাদের প্রতি শান্তি বর্ষিত হোক। ‘সালাম’ মানে শান্তি। ‘ইসলাম’ শব্দের মূলে আছে সালাম। ফেরেশতারা তাঁর উদ্দেশে সালাম দিলেন। আদমেরও শান্তি কামনা করলেন তাঁরা।

এই শান্তির মূলেই ছিল স্বাধীনতা আর হুকুম তামিলের দ্বন্দ্ব। একে কেউ কেউ নিয়ন্ত্রণবাদ বনাম স্বাধীন ইচ্ছার লড়াইও বলে থাকেন। অর্থাৎ আদম জন্মানোর সঙ্গে সঙ্গেই শান্তি বনাম অশান্তির লড়াইয়ের বীজ পেল মাটি আর জল, এবং অবশ্যই হাওয়া।

ফেরেশতাদের সঙ্গে আদমের কথা হল অনেক। আদমের কাজ কী হবে! সদা-প্রভু আগেই ঠিক করে রেখেছিলেন, আদম শান্তি প্রতিষ্ঠা করবেন। শান্তির জন্য তপস্যা করবেন তিনি। তাঁকে তো সে ভাবেই বানানো হয়েছে। তাঁর সারা শরীর, রক্ত, হাড়-মজ্জায় শান্তির স্রোত বইয়ে দিয়েছেন সদা-প্রভু। আদমের মধ্যে তিনি শান্তির সঙ্গে দিলেন আর একটা জিনিস—ইলম, যাকে বলা হয় জ্ঞান। এই জ্ঞান আর শান্তির পাঠ তাঁর সারা শরীর আর মনে। তিনি যেমন সব বস্তুর নাম শিখলেন, তেমনি জানলেন সৃষ্টির রহস্যের নানা দিক। আদম থেকে পয়দা হবেন যাঁরা তাঁরাও শিখে নেবেন এই সব নানা বস্তুর শিরোনাম আর তার হরেক ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ। কিন্তু আদম থেকে পয়দা হবেন কে বা কারা? সে কথা তো এক্ষুনি জানাননি সদা-প্রভু।এই সব কথা ভাবতে ভাবতে ফেরেশতাদের মনে উদয় হল আর একটা কথা, তাঁরা তো নুরের তৈরি, কিন্তু তাঁদের খোদা বানিয়েছিলেন কেন! পরক্ষণে তাঁরা ভাবলেন, এমন কথা তো তাঁদের চিন্তা করাই উচিত নয়; কারণ সদা-প্রভু তাঁদের স্বাধীনতা দেননি। দিয়েছিলেন জ্বিন জাতিদের, আর এই মানব আদম সফিকে দিলেন। জ্বিনেরা না-ফরমানি করেছিল, মানব কি জ্বিনদের থেকে আলাদা হতে পারবে! না, না, এমন জিজ্ঞাসা উত্থাপিত হওয়াও ঠিক নয়।

আদম সর্বশ্রেষ্ঠ এবং সবচেয়ে যোগ্য, এমন কথা খোদা ঘোষণা করে দিলেন। রব্বুল আলামিন চাইলেন, এই কথাটা সবাই স্বীকার করে নিক। সম্মেলন বসল চতুর্থ আসমানে। ফেরেশতারা সদা-প্রভুর কথা মেনে নিলেন, তাঁরা আদমের উদ্দেশে সেজদা দিলেন। এতদিন শুধু তাঁরা খোদাতালাকেই সেজদা করতেন। তবে কি আদম আর খোদা, এই দু জনের উদ্দেশে তাঁদের সেজদা করতে হবে!

ফেরেশতাদের নেতার নাম ইবলিস। এই সেই ইবলিস, যিনি আসলে জ্বিন-সন্তান। আগুনের মতো সুন্দর আর উদ্ধত তিনি। তাঁর ইলম বা প্রজ্ঞা এমনই যে তিনি নুরের তৈরি ফেরেশতাদের নেতৃত্ব দেন। সাত আসমান বা সাত জমিনের এমন কোনও স্থান নেই যেখানে তিনি খোদার উদ্দেশে সেজদা দেননি। উদ্ধত ইবলিস রব্বুল আলামিনের প্রতি অবনত সেই মস্তক আর কোথাও নোওয়াবেন না। যে শির খোদার সেজদা করেছে সেই মস্তক মাটির তৈরি আদমকে সেজদা করতে পারে না, খোদা আদেশ করলেও না। তা হলে তিনি সর্বশক্তিমানের কী এবাদত এত দিন করলেন যে মাটির তৈরি সসীম আদমকে তিনি সেজদা দেবেন! পরক্ষণেই তাঁর মনে ভেসে উঠল অতীত স্মৃতি।

তাঁর পূর্বপুরুষ জ্বিনেরা এক সময় খোদার অবাধ্য হয়ে উঠেছিলেন। তাঁদের না-ফরমানি এমন একটা জায়গায় গিয়ে পৌঁছেছিল যে রব্বুল আলামিন তাঁদের দমন করতে ফেরেশতাদের পাঠিয়েছিলেন। সেই নুরের তৈরি ফেরেশতারাতাঁর পূর্বপুরুষ যাঁদের সামনে পেলেন, একেবারে নিকেশ করে দিলেন। হ্যাঁ, খুন, রব্বুল আলামিন তাঁদের হত্যাকারী হিসাবে নিয়োগ করেছিলেন। ইবলিসের সব মনে আছে। কিছু জ্বিন ফেরেশতাদের চোখে ধুলো দিয়ে দুর্গম জায়গায় পালিয়ে গিয়েছিলেন। ফেরেশতারা দেখলেন ধূ ধূ শূন্য প্রান্তর। কেবল শিশু ইবলিস একা-একা কাঁদছেন। তাঁর মা-বাবাকে খুন করা হয়েছে। তাঁর জ্ঞাতিদের কেউ বেঁচে নেই। সব সেই শিশু নিজের চোখে দেখেছে। এমন এক জীব বড় হলে তাঁর ভিতরে কোন আবেগ কাজ করে, সে কথা কি তারা বুঝতে পারবে, যাদের চোখের সামনে পিতামাতা খুন হননি। তবে ফেরেশতারা দয়া করে তাঁকে মারলেন না, সঙ্গে করে নিয়ে এল বেহেশতে। তিনি জানতেন ফেরেশতাদের স্বাধীন ইচ্ছা নেই, তাঁদের মায়া-দয়াও নেই।তবে তাঁরা কেন ইবলিসকে বাঁচিয়ে রাখলেন! সে তো খোদার ইচ্ছায়। খোদা তাঁকে নিয়ে কী করতে চান! না,না,ইবলিস তো রব্বুল আলামিনের প্রতিদ্বন্দ্বী হতে চান না। কিন্তু তিনি আদমকে সেজদা করতে পারবেন না। যে ইবলিস আল্লাকে সেজদা করেছেন সেই তিনি জ্বিনপুত্র কখনও খোদার তৈরি জীবকে প্রণাম করবেন না। এ তাঁর আত্মসম্মানের প্রশ্ন। খোদাতালা এমন প্রস্তাব তাঁকে দিচ্ছেনই বা কেন! এই সেই বেহেশত যাকে কেউ কেউ স্বর্গও বলে থাকে সেখানে তিনি, মানে, সেই সব মৃত জ্বিনের একমাত্র জীবিত বাচ্চা হিসাবে আস্তে আস্তে বড় হয়েছেন। তাঁর নাম ইবলিস, তিনি জ্বিনেদের একমাত্র স্বর্গীয় প্রতিনিধি। একদা ফেরেশতাদের দেখাদেখি তিনিও খোদার প্রার্থনায় যোগ দিতে শুরু করেছিলেন। জ্বিনেদের মতো তিনি খোদার অবাধ্য হয়ে ওঠেননি, তাঁর মা-বাবাকে হত্যা করা সত্ত্বেও। তাঁর নিরন্তর তপস্যায় খুশি হয়ে পরম করুণাময় তাকে ফেরেশতাদের সর্দার করে দিয়েছিলেন। বেশ মর্যাদাসম্পন্ন হয়ে তাঁর দিন কেটেছে এত দিন। কিন্তু আজ চতুর্থ আসমানে এ কি সমাবেশ হচ্ছে! ফেরেশতারা তাঁর অনুমতি না নিয়ে খোদার আদেশে মাটির আদমকে সেজদা করছেন দলে দলে।

ফেরেশতাদের খোদা একটা করে জিনিস দেখাচ্ছেন আর জিজ্ঞাসা করছেন, বলো তো এর নাম কী, ওটার নাম কী? খোদা নিজেও জানেন, তাঁদের তিনি এগুলো শেখাননি। ফেরেশতারা তো দম-দেওয়া পুতুলের মতো। তাঁরা কী ভাবে এর উত্তর দেবেন! ইবলিসকে খোদা কিছু জিজ্ঞাসা করলেন না। তাঁর এক বার মনে হল, সদা-প্রভুর সামনে দাঁড়িয়ে ওই জিনিসের নাম বলে দেন। কিন্তু নিজেকে সংযত করলেন ইবলিস। তিনি যে নুরের তৈরি নন, তাঁর জন্ম আগুন থেকে। আগুনের মতো তিনি খাঁটি আর পবিত্র। এই আদমকেও তিনি পুড়িয়ে খাঁটি করে দিতে পারেন। সদা-প্রভু কি তাঁকে সেই সুযোগ দেবেন!

ওই মাটির তৈরি মানুষটা কলের পুতুলের মতো এক-একটা জিনিসের নাম বলেন আর তার বিবরণ দিতে শুরু করেন। সদা-প্রভু খুশিতে ডগমগ হয়ে উঠলেন। ভাবখানা এই রকম, দেখো আমি কী বানিয়েছি। ইচ্ছে করে ইবলিসের এক্ষুনি আদমের ঘাড়টাকে ধরে মটকে দিতে। ঠিক এমন সময় খোদা তাঁকে ডাকলেন। বললেন, ইবলিস! এসো, আদমকে সেজদা করো।

ইবলিস উঠে দাঁড়ালেন। দাঁড়িয়েই রইলেন।

কী হলো, এসো ইবলিস! আদমকে সেজদা করো।

ইবলিস বললেন, আমাকে ক্ষমা করুন সদা-প্রভু! আমি আপনাকে সেজদা করেছি। জীবনে আর কাউকে সেজদা করব, এমন কথা তো আপনিই ভাবতে দেননি। আপনি ছাড়া আর কেউ উপাস্য নেই আমার, আর কাউকে আমি সেজদা করতে পারব না। আমাকে ক্ষমা করে দিন।

রব্বুল আলামিন মনে মনে হাসলেন।

ইবলিস তাঁর মা-বাবাকে মনে করতে লাগলেন। কী নিষ্ঠুর ভাবে ওই ফেরেশতারা তাঁদের হত্যা করেছিল! চমক ভাঙল খোদার কথায়।

তুমি কেন আদমকে সেজদা করবে না?

ইবলিস তো আগেই তার জবাব দিয়েছেন। তবে কি সদা-প্রভুর তাঁর সে কথা মনঃপুত হয়নি! ইবলিস অলঙ্কারশাস্ত্রে পণ্ডিত মানুষ। তিনি বললেন, কেন আমি আদমকে সেজদা করব? আমি আগুন, আদম হল মাটি। আমার গতি উর্ধ্বমুখী, আদমের অধঃমুখী। আমি আপনাকে সেজদা করি। আশা রাখি, আদমও আপনাকে সেজদা করবেন। আপনি উপাস্য, আমরা দু জনেই আপনার উপাসক। এখন একজন উপাসক আরেক উপাসককে সেজদা করলে সেটা নিয়মবিরুদ্ধ হয়ে যায় না কি? আমি আদমকে আপনার শরিক করতে পারব না!

খোদা বললেন, আমার আদেশ নির্বিবাদে মেনে নাও ইবলিস।

ইবলিস জানালেন, তিনি স্বাধীন সত্তা। তাঁকে সে ভাবেই বানানো হয়েছে। তিনি নিজের যুক্তি-বুদ্ধি অনুযায়ীই চলবেন। কোনও অযৌক্তিক আদেশের কাছে তিনি মাথা নোয়াবেন না। তাঁর খোদা আল্লাহ-পাক, তিনি তাঁর উদ্দেশে সেজদা করবেন। আর কাউকেই তিনি উপাস্য বলে মেনে নেবেন না। কারও উদ্দেশে শির অবনত করা মানেই হল তাঁকে উপাস্য মেনে নেওয়া। ইবলিস দু জনকে উপাস্য বলে মানেন না। তাতে খোদাকে অসম্মান করা হয়। খোদার আদেশেও তিনি তাঁকে অসম্মান করতে পারেন না।

রব্বুল আলামিন বললেন, হে ইবলিস! শয়তান! তুই বেহেশত থেকে এই মুহূর্তে বেরিয়ে যা। অনন্তকাল তুই আমার অভিশাপ বয়ে বেড়া। তুই আজ থেকে শয়তান।

আগুনের মতো টকটকে লাল চেহারা মুহূর্তে কালো হয়ে গেল ইবলিসের। এ কী কথা বলছেন সদা-প্রভু! মনে সাহস আনলেন তিনি। খোদার সঙ্গে কথা বলার দরকার। এমন স্বেচ্ছাচারী উপাস্যের কি সত্যিই দরকার আছে ইবলিসের!

কী করবে ইবলিস! সে কিছুই বুঝতে পারে না। এতদিন যে আল্লাহ-র শ্রেষ্ঠ প্রার্থনাকারী বলে ফেরেশতাদের নেতার আসনে বসেছিল। সে মুহূর্তকালেই হয়ে গেল শয়তান! এতদিনের সব প্রার্থনা-ইবাদত তা হলে বিফল হয়ে গেল! তা তো হওয়ার নয়। সব কাজেরই ফল আছে। এই যেমন সে আদমকে সেজদা করেনি বলে বেহেশত থেকে তাড়া খেল, শয়তানের তকমা পেল; তেমনি তার এত দিনের ইবাদতের ফলও নিশ্চয় সঞ্চিত আছে। সেই আশায় ইবলিস সদা-প্রভুর কাছে গেল। মনে মনে সে আদমকে দোষী ঠাওরালো, যদিও সে জানে, এর পেছনে আদমের সরাসরি কিংবা পরোক্ষ কোনও হাত নেই; আদম এত শক্তিশালী নন, তিনি মাটির মানুষ। সেই মাটির মানুষের কী এমন গুণ যে ইবলিস তাঁর সামনে সেজদা করবে! তা হলে কি সদা-প্রভু নিজের আদলে আদমকে গড়েছেন! তিনি কি প্রতিদ্বন্দ্বী বানালেন! ইবলিসের মাথায় এই কথাটা কিছুতেই ঢুকছে না, কী ভাবে সে খোদা ও আদম—এই দু জনকেই সেজদা করে! তাঁরা কি তবে এক ও অভিন্ন! লাম ইয়া আলিদ ওয়ালাম ইউলাদ, ওয়ালাম ইয়া কুল্লাহু কুফুয়ান আহাদ—তিনি কাউকে জন্ম দেননি এবং কেউ তাঁকে জন্ম দেয়নি এবং তাঁর সমতুল্য কেউ নেই। তা হলে?

ইবলিসকে এটা প্রতিপন্ন করতেই হবে যে আদম বা আদম থেকে জাত আদমিরা কেউই খোদার সমতূল্য নন। হঠাৎ সে চোখে দেখে, লক্ষ লক্ষ আদম সারি বেঁধে দাঁড়িয়ে আছেন। একি হল ইবলিসের? সে চোখে এমন ভুল দেখছে কেন! তবে কি তার দৃষ্টিশক্তিতে কোনও প্রতিবন্ধকতা তৈরি হল! সবই সদা-প্রভুর ইচ্ছা। সে এখন শয়তান। কিন্তু তার জমা আছে অনেক প্রার্থনার ফল। সেই আশায় সে সটান গিয়ে দাঁড়াল সদা-প্রভুর দরবারে। আদমকে সে শায়েস্তা করতে চায়। তাই সে খোদার কাছে গিয়ে বলল, হে সদা-প্রভু! আমাকে শেষের দিন অবধি আয়ু দিন, আমি যেন রোজ কিয়ামত পর্যন্ত বেঁচে থাকি।

সদা-প্রভু সম্মত হলেন। তিনি ইবলিসকে শেষের দিন পর্যন্ত আয়ুষ্মান হওয়ার বর দিলেন। আর বন্দোবস্ত করলেন তার এবং তার সঙ্গীদের খাদ্যের নিরন্তর যোগানের।

শয়তান ওরফে ইবলিস খুশিতে ডগমগ হয়ে বলে উঠল, হে খোদা! আমি আপনার আদমকে এবং তাঁর উত্তরসূরীদের ভাল ভাবে বাঁচতে দেব না। আপনি যে আদমদের শরীরে শান্তির রক্ত প্রবাহিত করেছেন, আমি সেখানে অশান্তি হয়ে ঢুকে আপনার সব পরিকল্পনা বানচাল করে দেব। যে মানুষকে আপনি সত্যের অনুগামী হওয়ার জন্য তৈরি করেছেন, আমি তাদের মিথ্যার চোরাবালিতে নিমজ্জিত করব। আপনার বেহেশত হবে শূন্য, ধূ-ধূ মরুপ্রান্তর! আমি আমার অনুসারীদের নিয়ে ভরে তুলব আপনার দোজখ।

খোদা হাসলেন। বললেন, আমার অনুসারী যারা, যারা সিরাতুল মুস্তাকিম—সহজ-সরল পথ অনুসরণ করবে তাদের জন্য থাকবে সাত বেহেশত। আর তোর অনুসরণকারীদের জন্য বানিয়ে রেখেছি সাতটি স্তরের দোজখ। এ বার তুই যা!

ইবলিসকে বের করে দেওয়া হল বেহেশত থেকে। তাকে চিরতরে নির্বাসন দেওয়া হল স্বর্গ থেকে, সে কখনও আর এখানে প্রবেশ করতে পারবে না। আদম সফিকে চতুর্থ আসমান থেকে তুলে নেওয়া হল সপ্তম আসমানে। সুরক্ষিত, মনোরম স্থানে।

ইবলিসের পতন হল। সে স্বর্গ থেকে নেমে এল নীচে। এই সেই নীচ, যেখানে শুধু বাস করে উদ্ভিদ, ইতর প্রাণী, পাখি আর অসংখ্য জীব। ইবলিস এই সব সত্তার সঙ্গে কী ভাবে মিশবে, কীভাবেই বা তাদের সঙ্গে কথা বলবে! এদের না আছে স্বাধীন ইচ্ছা, না আছে বুদ্ধিবৃত্তি। এরা প্রবৃত্তির দাস। ইবলিসের আছে এত দিনের ইবাদত, সাধনা। আর তাই সে গর্বিত। খোদাতালার ইবাদতের পূণ্য তার মতো আর কারোর নেই। বেহেশতে এখন সেই মাটির মানুষ আদম কী করছে, তার জানতে খুব ইচ্ছে করছে। কিন্তু তা জানার উপায় তার কাছে নেই।

ওদিকে আদম ঘুরে বেড়াচ্ছেন বেহেশতের বাগানে। একা একা, এক অনন্ত নির্জনতা কখনও তাঁর ভাল লাগছে, কখনও বা তিনি একাকীত্বের ভারে নুইয়ে পড়ছেন। স্বর্গের সৌন্দর্য তাঁর মনে তোলপাড় তুলছে। আদমের নান্দনিক-বোধ কখনও সুতীব্র হচ্ছে, কখনও তিনি হতাশ হয়ে পড়ছেন; কারণ এই নন্দনকানন, এই স্রোতস্বিনী ঝর্ণার ধ্বনিমাধুর্য, ইয়াকুতি পাথরের তৈরি প্রাসাদের দৃষ্টিসুখ তিনি কারও সঙ্গে ভাগ করে নিতে পারছেন না। মাঝেমধ্যে দম-দেওয়া পুতুল ফেরেশতাদের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ হয়। তিনি তাঁদের সালাম জানান, তাঁরাও প্রত্যুত্তরে আদমের শান্তি কামনা করেন। কিন্তু আদমের অন্তরে এক অশান্তির কুয়াশা তৈরি হয়। তিনি তাঁর মধ্যে হারিয়ে যান, পথ ভুল করেন। স্বর্গের অসামান্য রূপসম্পন্ন হুরেরা এসে তাঁকে অভিভাদন করেন। তাঁর সেবা করার জন্য তাঁরা সকলেই মুখিয়ে থাকেন। আদমের এ সব ভাল লাগে না। অপূর্ব চেহারার বালক, যাদের গেলেমান বলা হয়, তারাও চারপাশে ঘোরে, আদম সে দিকে ফিরে তাকান বটে, এমনকি তাদের সৌন্দর্যে মুগ্ধও হন; কিন্তু এ সব তাঁকে ক্রমশ এক ভুলভালাইয়ার দিকে নিয়ে যায়। আদম ভাবতে থাকেন, তাঁর কী কর্তব্য, কী জন্য তাঁর জন্ম! সদা-প্রভু তাঁকে সৃষ্টি করলেন কেন! এই নিঃসঙ্গ জীবন আদমকে বড়ই ভারাক্রান্ত করে তুলছে। এমন সময় এক বেবাক ঘুম এসে আদম সফিকে আষ্টেপৃষ্টে জাপটে ধরল। এই সেই নিদ্রার দেবী, সনাতন ধর্মে যাকে সৃষ্টি করেছিলেন স্বয়ং ব্রহ্মা।

খোদাতালা আলেমুল গায়েব। ‘আলেম’ মানে জ্ঞানী, ‘গায়েব’ বলতে গোপন কথা বুঝতে হয়। আদমের অন্তরের কথা তিনি টের পেলেন। তাই সেই প্রথম মানুষের পাঁজর থেকে একটি হাড় নিয়ে খোদা বানালেন এক নারীকে, তাঁর নাম হাওয়া বিবি।

এমন সময় আবারও এক রহস্যময় আওয়াজ ভেসে আসে গায়েন ও শাগরেদের কানে। দূরে এক ছায়ামূর্তির অস্তিত্ব টের পান তাঁরা। কী বলতে চায় ওই ছায়া!

আর তখনই ভেসে আসে একটি মন্ত্র। যার মানে, হাওয়া বিবির জন্ম আদমের পাঁজরের হাড় থেকে নয়; তাঁকেও খোদা আলাদা করে বানিয়েছেন। যখন রব্বুল আলামিন মাটি দিয়ে মানুষ গড়ার সংকল্প নেন, তখন তিনি শুধু আদমকে বানাননি, ওই মাটিকে ভেঙে দু টুকরো করে দুই অংশে তিনি রূহ ফুঁকে দেন। আদি গ্রন্থের কথা বিকৃত করে কেউ কেউ বলে, হাওয়া বিবি আদমের শরীর থেকে তৈরি, তাই যদি হবে তা হলে হাওয়া বিবির রূহ অর্থাৎ আত্মা এল কোথা থেকে? খোদা হাওয়া বিবির শরীরে রূহ ফুঁকে দিয়েছিলেন। তাঁর দেহও মাটি থেকে তৈরি।

খোদাতালা বলেছেন, আমি প্রত্যেক বস্তু জোড়ারূপে সৃষ্টি করেছি।

তিনি এতই শক্তিমান যে সব কিছু জোড়ায় জোড়ায় বানিয়েছেন।

ছায়ামূর্তি এই কথা বলে হাওয়ায় মিলিয়ে যায়।

ঘোড়সওয়ার আবার কথা বলতে শুরু করেন।

আদম ঘুম ভেঙে দেখেন, তাঁর মতো কিন্তু হুবুহু তাঁর মতো নয় এমন কেউ একজন দাঁড়িয়ে আছে তাঁর অদূরে। তিনি অবাক হয়ে সেই মানবীকে দেখতে লাগলেন। কে এ? একেই কি নারী বলে!ইনি তো বেহেশতের হুর নন, হুর নারী নয়। এই নারীর সৌন্দর্য আদমের মনে তীব্র ঢেউ তুলল। হাওয়া বিবিও অপলক চেয়ে রইলেন এই মানবের দিকে। দু জনেই বুঝলেন, তাঁরা পরস্পরের জন্য তৈরি হয়েছেন। কিন্তু এক অদ্ভুত লজ্জা এসে তাঁদের আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরল। তাঁরা অন্য দিকে তাকালেন, কিন্তু দু জনের হৃদয়ে তীব্র প্রেমের তুফান। তাঁরা একে অপরের কাছে আসতে চাইলেন। কিন্তু সেই আদি প্রাণ, অনন্ত প্রজ্ঞাবান যিনি তাঁদের মাটির শরীরে রূহ ফুঁকে দিয়েছিলেন কোনও এক অবোধ নিয়মে, সেই অসীম স্থান থেকে নির্দেশ এল, বিনা চুক্তিতে তোমরা কেউ কাউকে স্পর্শ করতে পারবে না। তোমরা ক্ষান্ত হও। আদম বুঝতে পারলেন, এই চুক্তির নাম বিবাহ। তিনি হাওয়াকে বিবাহ করার জন্য উতলা হয়ে পড়লেন। হাওয়া বিবিও সেই মানবের প্রেমে উদ্বেল, তিনিও চাইলেন আদমের সঙে পরিণয়সূত্রে আবদ্ধ হতে।

রব্বুল আলামিনের ইচ্ছায় অসংখ্য ফেরেশতা এসে হাজির হলেন। সেজে উঠলেন দুই মানব-মানবী। তাঁদের বিবাহ সম্পন্ন হল রব্বুল আলামিনের ইচ্ছায়। এই ভাবে পরিবার তৈরি হওয়ার আগেই সম্পন্ন হল বিবাহ।

স্বামী এবং স্ত্রী বসে আছেন মুখোমুখি। প্রেমের আলাপ তুঙ্গে উঠলে তাঁরা আলিঙ্গনাবদ্ধ হতে চাইলেন। আবারও এল প্রত্যাদেশ। তাঁরা খোদার প্রতিনিধি। অতএব তাঁদের মেনে চলতে হবে সদা-প্রভুর আদেশ। যদিও খোদা তাঁদের স্বাধীন সত্তা হিসাবেই বানিয়েছেন, কারণ তাঁরা অনন্ত স্বাধীন সত্তা থেকে পেয়েছেন প্রাণ। না তাঁরা কেউ ঈশ্বরের সন্তান নন। কারণ খোদা কারও জনক বা জননী নন, তেমনই তাঁর কোনও পুত্র-কন্যা নেই, ভবিষ্যতেও হবে না। আদম ও হাওয়ার হৃদয়ে তীব্র আকুতির সৃষ্টি হল, উভয়ে নিবিড় হতে চাইলেন। তাঁদের সন্তান-আকাঙ্ক্ষা আছে।

আবার তিনি শুনতে পেলেন, হে আদম! সাবধান! তোমার কামভাব সংযত কর। তুমি হাওয়ার সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হলেও তাঁর অঙ্গ স্পর্শ করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। এই বিবাহ প্রথার মধ্যে আছে আর এক অমোঘ নিয়ম। সেটা শোনো। যুগ যুগ ধরে তোমার বংশ পরম্পরায় এই বিবাহের সঙ্গে সেটাও প্রচলিত থাকবে। তোমার বংশধরের কোন পুরুষ যদি আমার এই নির্দেশ অমান্য করে অবৈধভাবে কোন নারীর অঙ্গ স্পর্শ করে অথবা মিলিত হয় তা হলে সেই পুরুষ মহাপাপী হবে। পরিণামে সেই ব্যক্তি দোজখ যন্ত্রণা ভোগ করবে।

মিলিত হওয়ার আগে দেনমোহর পরিশোধ করো।

আদম চমকে উঠলেন। দেনমোহর! শব্দটার অর্থ তিনি জানেন। কারণ আদি প্রাণ ও অনন্ত প্রজ্ঞাবান তাঁকে শব্দার্থ শিখিয়েছেন। কিন্তু কী দেবেন তিনি? দেনমোহর!

আদম, আমি আমার কয়েকজন ফেরেশতা প্রেরণ করছি। তুমি আমার বিধান অনুযায়ী দেনমোহরের বিনিময়ে হাওয়াকে স্পর্শ করবে।

আদমেরও হাওয়ার বিয়ের জন্য খোদা কয়েক জন ফেরেশতাকে পাঠিয়েছিলেন। তাঁদের একজনকে উকিল ও দুইজনকে সাক্ষী সাব্যস্ত করে বিবাহ সম্পন্ন হয়েছিল। বাকি ছিল দেনমোহর পরিশোধ। এলহাম এল, দেনমোহর হিসাবে দশবার দরুদ শরিফ পাঠ করতে হবে। আদম তাই করলেন। তিনি দরুদ পড়তে লাগলেন।

সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম---আল্লাহ'র শান্তি বর্ষিত হোক তাঁর উপর।

কার উপর? সেই প্রশ্ন আপাতত মুলতুবি থাক।

আদম ও হাওয়ার বিবাহ সম্পন্ন হল।

তাঁরা বেহেশতেই থাকতে লাগলেন। সেখানে অজস্র গাছ, কোনওটা ফুলের, কোনওটা বা ফলের, আবার কোনওটা বা শুধুই শোভা বর্ধনের। তাঁরা সেই বাগিচার মধ্যে ঘুরে বেড়ান, পানাহার করেন, আবার দু জনে গল্পে-গল্পে কাটিয়ে দেন দিনের পর দিন। দীর্ঘদিন একা থাকার অবসাদে কিনা, তা কেবল মাবুদই জানেন, আদম এক দিন খোদাতালার আদেশ অমান্য করে বসলেন। আর সেই বেফরমানিতে হাওয়া বিবিও তাঁকে সঙ্গ দিলেন।

আদম যে সচেতন ভাবে এই কাজ করেছেন, এমন নয়। আদমের উপর খোদা ছাড়াও আর এক ব্যক্তি প্রভাব বিস্তার করে ফেলেছিল। যে ইবলিস তাঁর সামনে প্রণত হয়নি, সেই আদমের কাছে একদিন সূক্ষ্ম শরীর ধারণ করে এসে তাঁর অন্তঃকরণে ঢুকে পড়ল। খোদা আদমকে একটি বৃক্ষের ফল খেতে বারণ করেছিলেন। সেই বৃক্ষের নাম ‘গন্দম’।

রব্বুল আলামিন তাঁকে জানিয়েছিলেন, হে আদম! এই বেহেশতে তোমাদের খিদে পাবে না, বস্ত্রহীন থাকতে হবে না, তোমাদের তৃষ্ণা পাবে না, তোমরা রোদে কাহিল হবে না।

ইবলিস স্থূল দেহে বেহেশতে ঢুকতে পায় না, তার সেই অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়েছে। সে বিতাড়িত, খোদাতালা তাকে বেহেশত থেকে সম্পূর্ণভাবে বিতাড়ন করেছেন। তাই সে সূক্ষ্ম দেহে আদমকে মন্ত্রণা দিল, তুমি গন্দম বৃক্ষের ফল খাও। তা হলে অমরত্ব পাবে।

অমরত্বের হাতছানিকে উপেক্ষা করতে পারলেন না আদম সফি। এ ছাড়া তিনি আর তাঁর সঙ্গিনী জানতেন না, প্রতারণা কাকে বলে! শব্দার্থ-শিক্ষা কালে আদম এই শব্দের অর্থ ও ব্যাপ্তি শিখেছিলেন বটে, কিন্তু প্রতারণার কোনও ব্যবহারিক শিক্ষালাভ তাঁর হয়নি। এই সুযোগটাকেই কাজে লাগাল ইবলিস। সে আদমকে বলল, শুধু অমরত্ব নয়; ওই ফল খেলে তুমি চিরকাল খোদার নৈকট্যলাভ করবে। আদম ‘অমরত্ব’ আর ‘নৈকট্যলাভ’ শব্দ দুটিকে পাশ কাটাতে পারলেন না। শয়তান ওরফে ইবলিস যে তাঁর ভিতরে সূক্ষ্ম শরীরে বাসা বেঁধেছে!

শাগরেদ এ বার মুখ খোলে, “আচ্ছা প্রভু, সূক্ষ্ম শরীর বলতে আপনি কী বোঝাতে চাইছেন?”

শাগরেদের কথা শেষ হওয়া মাত্র আর একটি ঘোড়ার ক্ষুরের আওয়াজ পাওয়া গেল, টগবগ......টগবগ......

অদূরে নবীন এক ঘোড়সওয়ার আসছেন, তাঁর সারা শরীর অনাবৃত, মুখমণ্ডল অলৌকিক জ্যোতিতে পরিপূর্ণ। তিনি একজন নারী। ঘোড়া থামল অদূরে। তার পর শোনা গেল তাঁর কন্ঠস্বর, “এই প্রশ্নের উত্তর আমি দেব। পূর্বের কথকের সময় শেষ।’’

গায়েন সেই নারীকে বিস্ময়ে দেখতে লাগল।

তিনি বলতে থাকেন, “সূক্ষ্ম শরীর বলতে লিঙ্গ শরীরকেই বুঝতে হবে। এখানে ‘লিঙ্গ’ হল জ্ঞানসাধনচিহ্ন। অর্থাৎ বেহেশতের বাইরে থেকেও ইবলিস আদম আর হাওয়ার সঙ্গে কথাবার্তা বলতে পারত, আবার সে তাঁদের মনে অছঅছা সৃষ্টি করতে পারত। সূক্ষ্মশরীর বলতে এই কথাই বুঝতে হবে। তবু আদম আর হাওয়ার মনে খোদাতালার নিষেধের কথা ভেসে উঠল। ইবলিস তা বুঝতে পেরে আবার নতুন এক যুক্তির অবতারণা করল। শুরুতে তোমরা ছিলে দুর্বল। ওই বৃক্ষের ফল খেলে তা সহ্য করার ক্ষমতা তোমাদের ছিল না। এখন তোমরা যথেষ্ট শক্তি সঞ্চয় করেছো। অনেক কিছু শিখেছ। বুঝেছো, বিশ্বাস আর যুক্তির সারকথা। কাকে মানতে হয় আর কাকে অমান্য করলেও কিছু এসে-যায় না। এই ফল আসলে যুক্তিবৃক্ষ। বিশ্বাসে জ্ঞান আসে না, আসে যুক্তি দিয়ে। তাই একে তোমরা জ্ঞানবৃক্ষও বলতে পারো, যদিও এর আসল নাম ‘গন্দম’। এই গাছের ফল খাওয়ার ক্ষেত্রে যে সাময়িক নিষেধাজ্ঞা তোমাদের উপর ছিল, এখন আর তা নেই। আমি তোমাদের শুভাকাঙ্ক্ষী।

ইবলিস আদমকে বলল, হে আদম, তোমাকে অমরত্ব আর অবিচ্ছেদ্য বাদশাহীলাভের ফল খেতে বলছি আমি। খাও! হে মানব! সীমা অতিক্রম করো!

আদম আর হাওয়া সেই ফল খেলেন। তাঁদের পোশাক উড়ে গেল হাওয়ায়। তাঁরা তাঁদের লজ্জাস্থান ঢাকার জন্য গাছের পাতার আশ্রয় নিলেন। তাঁরা তাঁদের গুপ্ত অঙ্গ, কেউ বলে, খারাপ খাসলত ঢাকার আপ্রাণ চেষ্টা করতে লাগলেন।

এমন সময় রব্বুল আলামিনের আদেশ ভেসে এলঃ তোমরা বেহেশত থেকে নেমে যাও। আর শুধু এই শাস্তিই নয়, তোমাদের মধ্যে বিরহ নেমে আসবে যা খুব ভয়ঙ্কর। তোমাদের মধ্যে শুরু হল স্নায়ুর দ্বন্দ্ব। মানসিক বিপর্যয় তোমাদের আর এক শাস্তি। যাও, বেহেশত থেকে নেমে যাও।

আদম আর হাওয়া কাঁদতে লাগলেন। এ দিকে শয়তান ইবলিস মনে-মনে হাসতে লাগল। সে ভাবল, আমি খোদার আদেশ অমান্য করে আদমকে সেজদা করিনি, তাই আমার উপর শাস্তির খাঁড়া নেমে এসেছিল। আদম আর তাঁর সঙ্গিনী খোদার আদেশ অমান্য করেছেন, এ বার তাঁদের পরিণতিও হবে আমারই মতো। এই হল আমার প্রতিশোধের তরিকা।

আদম আর হাওয়া বিবি তাঁদের কৃতকর্মের জন্য অনুতপ্ত হয়ে কাঁদতে লাগলেন। তাঁরা মানুষ। অনুতাপ তাঁদের এক মানবীয় বৈশিষ্ট্য। শয়তানের সেই গুণ বা বৈশিষ্ট্য নেই। সে নিজের সিদ্ধান্তের পক্ষে শুধু তর্ক আর যুক্তির জাল বিস্তার করেছিল। সর্বোচ্চ সত্তার আদেশ বিনা বিচারে মেনে নেয়নি। কৃতকর্মের জন্য অনুতাপ তো দূর-অস্ত! এ দিকে খোদাতালা আদম-হাওয়ার দীর্ঘ অনুতাপে প্রীত হয়ে তাঁদের ক্ষমা করে দিলেন। কিন্তু তাঁদের মাটির পৃথিবীতে যেতেই হবে। রব্বুল আলামিনের কথার নড়চড় হয় না। তাঁরা পৃথিবীতে গেলেন খোদার প্রতিনিধি হয়ে।

তাঁরা শিখলেন, অপরাধ করলে কীভাবে ক্ষমা চাইতে হয়।

গায়েন কথককে জিজ্ঞাসা করে, “ওই বৃক্ষটি কেন স্বর্গে রাখা হয়েছিল? যদি তা এতই খতরনক!’’

পরীক্ষার জন্য। আদম আর হাওয়াকে পরীক্ষা করার জন্য ওই গন্দম-গাছ খোদা বেহেশতে রেখেছিলেন। তিনি দেখতে চেয়েছিলেন, বারণ করা সত্ত্বেও তাঁরা ওই গাছের ফল খান কিনা তা দেখা।

শাগরেদ বলে, “আদম আর হাওয়া বিবি তো সেই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলেন না!’’

ভুল। খোদাতালা দেখতে চেয়েছিলেন, গন্দম-ফল খাওয়ার পর আদমরা কী করেন, তা দেখা। আদেশ লঙ্ঘনের পর ইবলিস তর্ক করেছিল। আদম তা করেননি, তাই তিনি উত্তীর্ণ হয়েছিলেন। তা ছাড়া তাঁকে জমিনে নিজের প্রতিনিধি হিসাবে পাঠাতে চেয়েছিলেন।

গায়েন জিজ্ঞাসা করে, “যদি তাই হয়, তবে আদম আর হাওয়াকে সৃষ্টি করার পরে তাঁদের স্বর্গে রাখলেন কেন চরম উপাস্য? কেনই বা তাঁদের এই গন্দম-কেলেঙ্কারীতে জড়ালেন? আর একটা কথা, এই ‘গন্দম’ শব্দটার কি অন্য কোনও মানে আছে? গন্দম নিয়েও তো আমাদের গান বানাতে হয়!’’

শেষ প্রশ্নের জবাব আগে দিই। ‘গন্দম’ মানে আসলে গম, সে বড় চমৎকার চিজ। তবে ফারসিতে গনদুম হল বেহেশতের নিষিদ্ধ ফল। তবে এ নিয়ে বহু কথা আর মত আছে। নানা জনে নানা কথা বলে, গন্দম আপেল, আঙুর, ডালিম, ডুমুর কিংবা সেই ঘন বাদামি ফল যা গুঁড়ো করলে চকলেটের মতো লাগে খেতে। তবে গন্দমকে কেউ কেউ বলে বড় হলুদ পাতিলেবু, কিংবা ব্যাঙের ছাতা; ধুতুরা ফলও বলে বহু লোকে। ভাবতে পারো, এই ফলকে লোকে তেঁতুলও বলে থাকে, ওই টক-জাতীয় রান্নাবান্নায় লোকে যেটা ব্যবহার করে থাকে, অনেক দূর থেকে তুমি তার গন্ধ পাবে, আর পেলেই তোমার জিভে আসবে জল। কিন্তু জানো তো, এই সব কল্পনা। সবগুলো তো এক সঙ্গে সত্য হতে পারে না। শুরুতে বলেছিলাম, ‘গন্দম’ মানে আসলে গম, সে বড় চমৎকার চিজ। একটি শিশু তার মাতাপিতাকে ডাকতে পারে না যত দিন না সে গম বা এই জাতীয় খাবার খায়। হিব্রু ভাষায় গমকে বলে ‘খিতাহ’ যার একটা অর্থ হল পাপ। কেন তা কে জানে! আদমের আপেল কিংবা ডুমুরকে জ্ঞানবৃক্ষই বা কেন বলা হয়, তা আমার জানা নেই। তবে আমার মনে হয়, গন্দম আসলে আনন্দ। যে বিশেষ আনন্দের ধারেকাছে যেতে আদম আর হাওয়াকে বারণ করা হয়েছিল। তবু তাঁরা গিয়েছিলেন। তাই এই আনন্দ অনৈতিক, খোদার আইনবিরুদ্ধ। আসলে কি জানো, এটা কোনও ফলই নয়। যদি তুমি একে ফল বলো, তা হলে তুমিও ভাষার দুর্বোধ্যতার সাহায্য নিতে পারো, নিতে পারো অলঙ্কারের মতো গুলিয়ে দেওয়ার সরঞ্জাম। এ হল জঠরের ফল—যার নাম যৌনতা আর জীবনবৃক্ষের উদ্ভব।

যদি এই আধিবিদ্যক কুহক থেকে বেরিয়ে জ্ঞানতত্ত্বের জগতে ঢোকো, তা হলে এটাকে ভাবতে পারো, জ্ঞানের সীমা অতিক্রম করে অজানাকে জানার প্রচেষ্টা, যা তোমার সাধ্যের বাইরে। এও কুহক। তবু আকাঙ্ক্ষা তো থেকেই যায়। প্রত্যক্ষ আর অনুমানের স্তর থেকে বেরিয়ে সেই সর্বোচ্চ সত্তাকে ধরার জন্য জ্ঞানের জাবর কাটা।

শাগরেদ একটু বিভ্রান্ত হয়। গায়েনের গানের কূটতত্ত্ব বোঝার জন্য তাকে অনেক পরিশ্রম করতে হয়। কথক যা বলছেন তাতো গায়েনের গানের থেকেও কঠিন। এর মানে বোঝা কি সম্ভব! সে অশ্বারোহী রমণীকে জিজ্ঞাসা করে, “ তা হলে কোনটা ‘ফল’? উঁচু থেকে নীচে পড়ে যাওয়াটা নাকি ওই কামরাঙা ফল! আলঙ্কারিক কুহকে তুমি কাকে ফল বলে মনে করছ?’’

জ্ঞানীয় স্তরের সীমাহীন বিস্তৃতিকে।

গায়েন বলে, “আপনিও তো আমাদের কুহকের মধ্যে টেনে নিয়ে যাচ্ছেন।’’

একটু ভাবো, তা হলে বুঝতে পারবে। বিশ্বাস আর যুক্তি-তর্কের লড়াই। ঈশ্বর আদম আর ইভ অর্থাৎ হাওয়া বিবিকে বিশ্বাস করতে বলেছিলেন। তাঁরা ইবলিসের প্ররোচনায় যুক্তির সাহায্য নিতে গেলেন, সেই যুক্তি আর জ্ঞানের সাহায্যে তাঁরা এমন কোথাও যেতে চাইলেন, যা ছিল তাঁদের অগম্য।

“কোথায়? তাঁরা কি সেই সিদরাতুল মুনতাহারের কাছে যেতে চেয়েছিলেন, যেখান থেকে রব্বুল আলামিনের মানে খোদার সিংহাসন দূরে নয়?’’ গায়েন প্রশ্ন করে।

সেই কথার জবাব দেওয়ার ভার আমার উপর নয়। আমার জ্ঞানের পরিধি অতীব সঙ্কীর্ণ। আমার উপর যে ভার দেওয়া হয়েছে, তাই বলে আমি চলে যাব।

শাগরেদ বলে, “বেশ বেশ! বলো। রাগ করো কেন দিদিভাই!’’

তোমাদের জানা উচিত, ফেরেশতাদের মধ্যে হুকুম অমান্য করার ক্ষমতা নেই। সেই ক্ষমতা খোদা আদম-হাওয়া মানে, মানুষকে দিয়েছেন। এই না-ফরমানির বীজ জিনদের মধ্যেও তিনি দিয়েছেন, যাকে তোমরা ইচ্ছার স্বাধীনতা বলো। এই জন্য জিন-ইবলিস খোদার আদেশ সত্ত্বেও আদমকে সেজদা করেনি!

শাগরেদ জিজ্ঞাসা করে, “আমি কি আর একটা বাজে প্রশ্ন করতে পারি?”

বলো।

“ইবলিসকে বলা হয়েছিল আদমকে সেজদা করতে। হাওয়া বিবিকে তো নয়?’’

আদম বলতে এখানে মানুষ বুঝতে হবে। সেই হিসাবে তিনি বহুবচন এবং স্ত্রী-পুরুষ নিরপেক্ষ। ইবলিস খোদার আদেশ অমান্য করে বেহেশত থেকে তাড়া খেল। আদম আর হাওয়া বিবি তাঁর আদেশ অমান্য করার পরে খোদা তাঁদের বললেন, নীচে নেমে যাও। এই হল তোমাদের কৃতকর্মের শাস্তি। তাঁরা একান্ত চিত্তে দীর্ঘকাল ক্ষমা প্রার্থনা করার পর খোদা বললেন, নীচেই থাকো। আমার প্রতিনিধি হিসাবে।

জ্ঞানবৃক্ষের ফল খাওয়ার ব্যাপারে আদম আর হাওয়া বিবি দু জনেই সমান দায়ী ছিলেন। তাঁরা প্রার্থনা করতে লাগলেন, “হে প্রভু! হে আমাদের পরওয়ারদিগার! আমরা তোমার আদেশ লঙ্ঘন করে নিজেদের সমূহ সর্বনাশ করেছি। তুমি আমাদের উপর করুণা প্রদর্শন না করলে আমরা সর্বহারা হয়ে যাব। তুমি ছাড়া আমাদের আর কেউ ক্ষমা করতে পারে না। তুমি আমাদের তওবা কবুল করো। রব্বানা জলামনা আনফুসানা ওয়া ইল্লাম তাগ্’ফিরলানা অতার্’হামনা লানা কুনান্না মিনাল খাসেরিন—’’

আদম আর হাওয়া বিবি নামলেন পৃথিবীতে। দু’জনে দু-জায়গায়। আদমকে পাঠানো হল তোমাদের দেশে, সিংহল দ্বীপে। হাওয়া বিবিকে পাঠানো হল জেড্ডায়।

“দাঁড়াও, দাঁড়াও। আবার প্রশ্ন! আসলে কি জানো, গুরুগম্ভীর গানের মধ্যে ফাজলামি করা আমার স্বভাব, যাতে লোকজন একটু বিশ্রাম পাই। তাই গায়েনের গান আমাকে খুব ভাল করে বুঝেশুনে ইয়ার্কি তৈরি করতে হয়। গানের সময় আমার ক্ষেত্রে নিয়ম হল যে আমি না-বুঝে কিছু বলতে পারব না। সেই স্বভাব আমার থেকে গিয়েছে। আদম হলেন নবি, প্রথম মানুষ, প্রথম খলিফা। হাওয়া বিবিও। যদিও তাঁর নবিত্ব নিয়ে তুমি কিছু বলোনি। হয়তো তোমার কাছে সেই হুকুম জারি হয়নি, তুমি তো আর মানুষ নও যে দুটো এক্সট্রা কথা বলবে। আমার প্রশ্ন সেটা নয়। আমি বলতে চাইছি, খোদা প্রথমে বানালেন নুর-ই-মহম্মদী অর্থাৎ মহম্মদের আলো। সেই আলো প্রথম নবী হিসাবে আদমকে দেওয়ার কথা। আদম যে এলেন এই পবিত্র ভারতবর্ষে, তা হলে নুর-ই-মহম্মদী প্রথম ভারতেই অবতীর্ণ হয়েছিল, কী বলো?’’ শাগরেদের প্রশ্নে সেই রমনী ঘাড় নেড়ে পুনরায় কথন শুরু করেন।

এ বার শুরু হল ক্রন্দন-অধ্যায়। বেহেশত থেকে অবতরণ! অবতরণবাদী দু জনের দু-জায়গায় থাকার ব্যবস্থা। শত-শত যোজন দূরে তাঁরা দু-জনে। সিংহল দ্বীপে কাঁদেন আদম-বাবা আর জেড্ডায় মা-হাওয়া। হাওয়া বিবির কান্নার অশ্রুতে নেমে আসে প্লাবন। তাঁর অশ্রু থেকে তৈরি হয় মেহেদি গাছ। চোখের জল বালিতে পড়ে সৃষ্টি হয় সুরমা। আর সেই সব অশ্রুকণা যারা সমুদ্রে গিয়ে মিশেছে, তারা হয়েছে মুক্তা।

আদম ভাবেন হাওয়ার কাছে যাবেন, হাওয়া বিবিও ভাবেন কবে তিনি আদমের দর্শন পাবেন! নিঃসঙ্গতা তাঁদের কাছে ধারালো অস্ত্রের মতো মনে হয়, যা প্রতি মুহূর্তে তাঁদের রক্তাক্ত করছে। কিন্তু বিপুলা এই পৃথিবীর কতটুকু তাঁরা জানেন! কীভাবেই বা পথ চিনে যাবেন, খুঁজবেন একে অন্যকে! তাঁরা খোদার কাছে মোনাজাত করে জানালেন বেদনা-বিধুর বিরহের কথা। রব্বুল আলামিন করুণাপ্রবণ, তিনি তাঁদের দয়া করলেন। পাঠিয়ে দিলেন এক ফেরেশতাকে, তাঁর নাম জিবরাইল। জিবরাইল হলেন পরম সত্তার দূত ও সর্বশ্রেষ্ঠ ফেরেশতা। তিনি হলেন পাক রূহ বা রুহুল কুদ্দুস। রব্বুল আলামিনের আদেশ-নিষেধ এবং সংবাদ আদান-প্রদান যে সব ফেরেশতার দায়িত্ব, জিবরাইল তাদের প্রধান। জিবরাইল-ই আল্লাহর বাণী নিয়ে নবীদের কাছে গমনাগমন করেন।

জিবরাইল এসে আদমকে মৃত্যুর কথা বললেন। জানালেন, মরণের আগে হজ-ব্রত পালন করুন।

মৃত্যুর কথা শুনে আদম ভীত হয়ে পড়লেন। তাঁকে তো মরতে হবে, কিন্তু শঙ্কিত হচ্ছেন কেন তিনি! এই বিরহের জীবনের তুলনায় কি মৃত্যু খারাপ! জিবরাইল এসেছেন খোদার আদেশে। তাই তিনি হজ পালনের জন্য মানসিক প্রস্তুতি নিলেন। জিবরাইল তাঁকে রাস্তা বলে দিলেন।

এখনকার যে শ্রীলঙ্কা, সেখান থেকে ভারতে ঢুকতে গেলে সমুদ্র পেরোতে হয়। কিন্তু কী উপায়ে পার হবেন আদম ওই বিশাল দরিয়া। খোদাতালা ইচ্ছে করলেই তাঁকে আসমানের পথে উড়িয়ে নিয়ে যেতে পারতেন বা মাছের মতো পানি দিয়ে পার করে দিতে পারতেন। কিন্তু তিনি তা করলেন না, তিনি আদমের জন্য সেতু বানিয়ে দিলেন। খোদার আদেশে সেই সেতু বানালেন জিবরাইল, আল্লাহ পাকের ফেরেশতা। সেই রাস্তা ধরে আদম উঠলেন এখনকার তামিলনাড়ুতে। তার পর হাঁটতে লাগলেন কেরলের দিকে। কর্ণাটক, মহারাষ্ট্র, গুজরাট হয়ে তিনি পাকিস্তানে এলেন। তখন অবশ্য কোনও দেশ, রাজ্য ছিল না। গোটা পৃথিবী তখন একটাই দেশ। পাকিস্তান থেকে ইরান, তার পর ইরাকের মধ্য দিয়ে সৌদি আরব। এখানেই আছে পবিত্র কাবা ঘর। কে বানাল এই অনুপম সৌধ! হজরত আদম তাজ্জব হয়ে গেলেন। সাত আসমানে তিনি দেখেছিলেন বায়তুল মামুর। ফেরেশতারা সেখানে খোদার প্রার্থনা করে। এ যেন সেই বায়তুল মামুরের প্রতিচ্ছবি। রব্বুল আলামিন তাঁর জন্য কতই না বিস্ময়ের জিনিস ছড়িয়ে রেখেছেন! কাবা শরিফের উপরে রয়েছে লাল ইয়াকুতি পাথরের তৈরি একটি তাঁবু, অলৌকিক আলো ঘিরে রয়েছে সেই তাঁবুকে। বেহেশত থেকে আসা হাজরে আসওয়াদ নামের একটি নুরের পাথর দেখে আদম সেটিকে জড়িয়ে ধরেন এবং চুম্বন করতে থাকেন। খোদাতালা আদমকে জানালেন, তাঁর সমস্ত পাপ তিনি ক্ষমা করে দিয়েছেন। আদম ভাবলেন, তিনিই প্রথম এই হজ পালন করলেন। ভাবা মাত্রই এক দল ফেরেশতা বলে উঠলেন, তাঁরা দু হাজার বছর আগেই এই হজব্রত পালন করেছেন। আদম খোদাতালাকে ধন্যবাদ দেওয়ার জন্য শুকরিয়ার নমাজ পড়লেন। মোনাজাত শেষ হওয়ামাত্র দেখলেন, তাঁর দিকেই ছুটে আসছেন বিবি হাওয়া। বিবি হাওয়া তাঁকে আলিঙ্গন করলেন। আদম ভাবছেন, এ কি স্বপ্ন নাকি মায়া!

সেই স্বপ্ন কিংবা মায়ায় আদম হাওয়ার সঙ্গে সংসার পাতলেন। বাড়ি বানালেন। মাটির বাড়ি। ছাওনি দিলেন লতাপাতার। কোথায় পাবেন বস্ত্র, খাবেনই বা কী? ফেরেশতা তাঁদের সব শেখালেন। জামাকাপড় বানানোর কৌশল, কৃষিকার্য করে ফসল ফলানোর প্রুযুক্তি। সেই ফসল তুলে রান্না করে খাওয়ার পদ্ধতি। জিবরাইল তাঁদের আগুনের ব্যবহার শেখালেন, শেখালেন রান্না। কিন্তু একটা জিনিস তাঁদের শেখাতে হল না। তা হল সন্তানের জন্ম দেওয়া। ভালবাসায় আদম আর হাওয়া দু জনে প্রসব করলেন যমজ সন্তান। একটি ছেলে, অন্যটি মেয়ে। ছেলের নাম রাখা হল কাবিল, মেয়ের অকলিমা।এক বছর যেতে না যেতেই আর এক জোড়া সন্তান। বড়টি পুত্র, ছোট কন্যা। ছেলের নাম হাবিল, মেয়ের লিমুজা।

প্রতি বছরই জোড়ায় জোড়ায় সন্তান প্রসব করতে লাগলেন বিবি হাওয়া। কাবিল-অকলিমা, হাবিল-লিমুজা বড় হতে থাকলেন। ক্রমে তাঁদের বিবাহের বয়স হল। কাবিল কৃষিকার্য করতেন, হাবিল পশুপালন। কাবিল ছিলেন কিঞ্চিৎ উদ্ধত, আর হাবিল শান্ত। আদমের কাছে খোদার নির্দেশ এল, ছেলেমেয়েরা বড় হয়েছে; এ বার তাঁদের বিয়ে দেওয়া দরকার। যমজ ভাইবোনেদের মধ্যে বিবাহ সম্পন্ন হবে না, তা হলে অজাচার প্রশ্রয় পাবে। অতএব হাবিলের সঙ্গে অকলিমার এবং কাবিলের সঙ্গে লিমুজার বিবাহ হবে। হজরত আদম সে কথা ঘোষণা করলেন। এই সিদ্ধান্তে কাবিল ভীষণ রেগে গেলেন। তিনি অকলিমাকে বিয়ে করতে চান। তাঁর যুক্তি হল, মাতৃজঠরে তিনি ও অকলিমা একসঙ্গে ছিলেন, তাই তিনি অকলিমাকে বিবাহ করবেন। তা ছাড়া লিমুজা অকলিমার মতো সুন্দরী নন। অতএব পিতার নির্দেশ তিনি মানবেন না। হজরত আদম মুষড়ে পড়লেন। এ যে খোদার সিদ্ধান্ত। সে কথা কাবিল শুনতে নারাজ। তখন পিতা বললেন, তোমরা দু জনে খোদার উদ্দেশে কিছু উৎসর্গ করো, যার অঞ্জলি তিনি গ্রহণ করবেন, অকলিমার সঙ্গে তার বিবাহ সম্পন্ন হবে। কাবিল সম্মত হলেন। হাবিল পিতার সিদ্ধান্তকে শুরু থেকেই মেনেছিলেন, এ বারেও তার অন্যথা করলেন না।

নির্দিষ্ট দিনে দু ভাই পাহাড়ের পাদদেশে তাঁদের উৎসর্গের জিনিস রেখে এলেন। কাবিল কৃষিজীবী, তিনি রাখলেন উৎকৃষ্ট ফসল। হাবিল পশু পালন করেন। তিনি একটি হৃষ্টপুষ্টাঙ্গ মেষ খোদার উদ্দেশে পাহাড়ের নীচে রেখে এলেন।

দূরে দাঁড়িয়ে কাবিল ও হাবিল দেখলেন, আকাশ থেকে এক অদ্ভুত রঙের আগুন এসে উৎসর্গের বস্তু পুড়িয়ে ভস্ম করে দিয়ে চলে গেল। তবে কি দু জনের কুরবানি সদা-প্রভু কবুল করলেন! তা কী করে সম্ভব! দু জনেই কাছে গিয়ে দেখলেন, হাবিলের উৎসর্গ গ্রহণ করেছেন খোদা, কাবিলের ফসল পড়েই রয়েছে। এ কেমন বিচার খোদার! তিনি হাবিলের প্রতি পক্ষপাতদুষ্ট, কাবিল এই বিচার মানেন না। তিনি অকলিমাকেই বিবাহ করবেন, সদা-প্রভুর নির্দেশ মানতে তাঁর বয়েই গেছে। পথের কাঁটা হাবিলকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দিতে পারলেই তাঁর উদ্দেশ্য সফল হবে। পিতা যেমন সব সময় হাবিলের পক্ষ নেন, খোদাও দেখছি তাই। তোমাদের দু জনের আদরের হাবিলকে আমি খুন করবই। সে হাবিলকে চীৎকার করে জানাল, লানাকতু-লান্নাকা—আমি তোকে হত্যা করবই।

হাবিল শান্ত হয়েই দাদাকে বললেন, এ তো খোদার সিদ্ধান্ত ভাই, মেনে নাও। প্রভু সৎ মানুষদের কুরবানি কবুল করেন।

তার মানে তুই আমাকে অসৎ বলতে চাস? কাবিল গর্জে উঠল।

তুমি আমাকে মারলেও আমি তার শোধ নেব না। মনে রেখ, আমাকে হত্যা করলে আমার এবং তোমার দু জনের পাপের বোঝা তোমাকে বইতে হবে—হাবিল ঠাণ্ডা গলায় বলে উঠলেন।

কাবিল শয়তানের মতো হেসে উঠে বলল, ও! তা হলে তোমারও পাপ আছে! তবে যে বললি, তুই সৎ!

হাবিল কথা না বাড়িয়ে বাড়ি ফিরে সব বৃত্তান্ত জানালেন আদম এবং হাওয়া বিবিকে।

বিবাহের আয়োজন হল। কাবিলের সঙ্গে লিমুজার আর হাবিলের সঙ্গে অকলিমার শাদি মুবারক সুসম্পন্ন হল। বিবাহ হলে কি হবে, কাবিলের মন সর্বদা পড়ে থাকে পরস্ত্রী অকলিমার দিকে, লিমুজাকে তার ভাল লাগে না। বছরের পর বছর কাটতে লাগল। কাবিল আর লিমুজার পুত্রসন্তান জন্ম লাভ করল। তার নাম রাখা হল আখনুখ। এই আখনুখের ছেলে ইরাদ, তার পুত্র মেথুজেল, তার পর লামেখ; লামেখের দুই ছেলে—জিল্লাহ আর আদাহ; জিল্লাহ-র দুটি পুত্র—তুবাল ও নামাহ। আদাহ-র পুত্র জাবেল ও জুবাল। কিন্তু এই বংশধরেরা খোদার অভিশাপে এক ভয়াবহ বন্যায় ধ্বংস হয়ে যায়। সে কথা অন্য। আমরা ফিরে যাব কাবিল ও হাবিলের উপাখ্যানে।

কাবিল হাবিলকে হত্যা করার সুযোগ খোঁজে। সে জানেও না, কী ভাবে খুন করতে হয়। এর মধ্যে তার সঙ্গে দেখা হয় এক অচেনা আগন্তুকের। আগন্তুক কাবিলকে ভীষণ পছন্দ করে ফেলেছে। কী সুন্দর বদমেজাজী আর উদ্ধত এক যুবক, আবার পরস্ত্রীকাতর। কাবিল সেই আগুনরঙা আগন্তুককে দেখতে লাগল। আগন্তুকের এক হাতে একটা লাল মোরগ, অন্য হাতে একটা পাথর। কী করতে চায় ওই অপরূপ আগন্তুক!

লোকটি পায়ের কাছে পড়ে থাকা একটা পাথরের উপর মোরগের মাথাটা রেখে তার উপরে সজোরে হাতের পাথর দিয়ে আঘাত করল। মোরগটি মারা গেল। আগন্তুক হেসে কাবিলের দিকে তাকিয়ে কোথায় যেন মিলিয়ে গেল। বিস্ময়ের ঘোর কাটতেই কাবিল বুঝল, এই হল হত্যার নিয়ম। লোকটি কে ছিল? তাঁর পিতার কাছে সে শুনেছে, ইবলিসের কথা! এ কি সেই অপরূপ মোহময় শয়তান! খোদা যখন হাবিলকে তাঁর প্রিয়পাত্র করেছেন, তখন ইবলিস নিশ্চয় কাবিলকে সমর্থন করবে। সে ইবলিসের শিষ্য হতে চায়। শুধু হুকুম তামিলের মধ্যে আছে দাসত্ব, তা কাবিলের পোষাবে না! সে অকলিমাকে চায়। তাই হাবিলকে খুন করতে হবে। আর হত্যার পদ্ধতি এখন তার করায়ত্ত।

কাবিল অপেক্ষা করে। কবে হাবিলকে নির্জনে একাকী পাওয়া যায়! এক দিন হাবিল পশু চরাতে গিয়েছেন অনেক দূরে। পশুগুলো ঘাস খাচ্ছে, হাবিল একটি গাছের ছায়ায় শুয়ে জিরোচ্ছেন। এমন সময় তাঁর ঘুম এসে গেল। কাবিল তাঁকে আড়াল থেকে দেখছে। এই তো সুযোগ! কাবিল একটি প্রকাণ্ড পাথর নিয়ে হাবিলের মাথাটা গুঁড়ো করে দিল। হাবিলের শরীরটা নড়ে উঠেই থেমে গেল চিরতরে।

পৃথিবীর প্রথম হত্যা। প্রথম মৃত্যু। ভাইয়ের হাতে ভাই খুন। আর এটা ঘটেছিল এখনকার সিরিয়ায়, দামাস্কার কাছে।

কাবিল হাবিলের মৃতদেহ কাঁধে তুলে হাঁটছে। কেউ যেন জানতে না পারে! চার পাশ থেকে আওয়াজ আসতে লাগল, খুন! খুন! কে? কাবিল কাউকে দেখতে পায় না।

কাবিল হঠাৎ দেখতে পেল, দুটো কাক মারামারি করছে। একটি কাক মরে গেল অন্যের আঘাতে। তখন জীবিত কাকটি তার ঠোঁট দিয়ে মাটি খুঁড়ে একটা গর্ত বানাল। সেই গর্তে মৃত কাকটিকে রেখে তার উপর ছোট ছোট পাথর ফেলতে লাগল। এক সময় কাকের মরদেহ ঢেকে গেল পাথরে। তবে কি ওই জীবিত কাক ইবলিস, তার গুরু! কে জানে! কাবিল হাঁফাতে হাঁফাতে একটা বিরাট গর্ত খুঁড়ে ফেলল। হাবিলকে সেখানে রেখে সেও মাটি আর পাথর চাপা দিয়ে পালিয়ে গেল দৌড়ে। কিন্তু কোথায় যাবে সে!

হাবিলের কবরের উপর দামাস্কার জাবাদানি উপত্যকায় এখন গড়ে উঠেছে একটি মসজিদ—নবি হাবিল মসজিদ। অবশ্য হাবিলকে সকলে নবি বলে স্বীকার করেন না। সে ভিন্ন কথা। কাবিল এখন কোথায় যাবে! সে পালাল ইয়েমেনের এক ঘন জঙ্গলে।সদাপ্রভু কাবিলকে বললেন, তোমার ভাই হাবিল কোথায়?

কাবিল বলে, “আমি কী করে বলব! আমি কি আমার ভাইয়ের রক্ষক?”

--তোমার ভাইয়ের রক্ত মাটিতে পড়ে কেঁদেই চলেছে। আর এই মাটিতেই তুমি অভিশাপগ্রস্থ হলে। তুমি পৃথিবীতে পলাতক ও ভ্রমণকারী হবে।

“আমার অপরাধের ভার অসহ্য। আজ তুমি আমাকে মাটি থেকে উৎখাত করলে, সুতরাং তোমার থেকে আমি লুকিয়ে থাকব। আমাকে যে পাবে, সেই খুন করবে।’’

--হ্যাঁ, তোমাকে যে হত্যা করবে, তাকে আমি সাত গুণ প্রতিফল দেব।

বাইবেল বলে, কাবিল নোদ দেশে পালিয়ে গিয়ে একটি নগরের পত্তন করে। আর তার স্ত্রী প্রসব করে হনোককে। হনোকের পুত্র ইরদ, ইরদের মহুয়ায়েল, তার ছেলে মথুশায়েল, মথুশায়েলের পুত্র লেমক বা লামেখ। লামেখের দুই স্ত্রী—আদা ও সিল্লা। আদার গর্ভে জাত পুত্র হল তাম্বুবাসী পশুপালকদের আদি পুরুষ, তার ভাইয়ের নাম জুবল—সে বীণা ও বংশীধারীদের আদিপুরুষ। সিল্লার গর্ভে জন্মায় তুবল-কাবিল—সে পিতল ও লোহার নানা রকমের অস্ত্র বানাতো। তুবল-কাবিলের বোনের নাম নয়মা। লামেখ অনেক মানুষকে হত্যা করে। সে নিজের স্ত্রীদের একদিন বলে, কাবিলের বধের প্রতিফল যদি সাত গুণ হয়, তবে আমার বধের প্রতিফল সাতাত্তর গুণ হবে। কাবিলের প্রপ্রৌত্র লামেখশিকারে গিয়ে কাবিলকে দেখতে পায়। কাবিলের মাথায় শিং দেখে সে তাকে বন্য প্রাণি ভেবে মেরে ফেলে। হাবিলকে হত্যা করার পরে সদাপ্রভু কাবিলের নিমিত্ত একটি চিহ্ন রেখেছিলেন। সে সব অবশ্য অনেক পরের কথা। হাবিল খুন হওয়ার পর আদমের পরিবারের সকলে জানতে পারলেন, কাবিল হাবিলকে হত্যা করেছে; তার পর সে পালিয়েছে। দুঃখে ভেঙ্গে পড়লেন আদম ও হাওয়া। তাঁরা কাঁদতে লাগলেন, দিনের পর দিন, রাতের পর রাত। কিন্তু একটানা শোক তো আর চিরকাল চলতে পারে না। জীবনের নিজস্ব নিয়মে শোক ফিকে হতে থাকে। সে বছরেই জন্ম হল আর এক সন্তানের, যাকে আদম আর হাওয়ার শ্রেষ্ঠ সন্তান বলে দাবি করা হয়, তার নাম শিস। সে যেন একে বারে হাবিলের মতো। হাবিলের ছাঁচে তাকে যেন গড়েছেন সদা-প্রভু, একটু-একটু করে শিস বড় হতে তা যেন আরও বেশি করে মনে হতে থাকল মা হাওয়ার।

পবিত্র গ্রন্থের কোথাও শিস নবির নাম নেই। কিন্তু ইসলামি পুরাণ বলে, হজরত আদমের পরে হজরত শিস নবি হয়েছিলেন। এমনকি কেউ কেউ মনে করেন, শিসের কাছে ধর্মগ্রন্থ অবতীর্ণ হয়েছিল। হাবিলের কোনও সন্তান ছিল না, কাবিলের সন্তানেরাও এক মহাপ্লাবনে ধংস হয়ে যায়। শিসের উত্তরপুরুষরা বেঁচে ছিলেন এবং তাঁরা হলেন ঈশ্বরের অনুগ্রহপ্রাপ্ত। শিস-নবি সুফিবাদের প্রবর্তক ছিলেন। মরমিয়া চিন্তার জনক এই নবি। লেবাননে নাকি এই নবির কবর আছে যার উপরে একটি মসজিদ নির্মিত হয়েছে। প্যালেস্তাইনের একটি গ্রামে শিস নবি বাস করতেন বলে কেউ কেউ দাবি করেন।ইরাকের মসুলে এই নবির মাজার আছে বলে ইসলামের একটি অংশ মনে করে। সম্প্রতি আইসিস বোমা মেরে সেই মাজার ধ্বংস করে দেয়।


শিস নবির এক পুত্রের নাম আনুশ। আনুশের ছেলে কিনান, কিনানের মাহলবিল, মাহলবিলের পুত্র ইয়ারদ। ইয়ারদের ছেলে ইদরিসের কথা ঐশী গ্রন্থে আছে। তিনি ছিলেন নবি। ইদরিসের ছেলে মেথুসেলাহ, পৌত্র লামিক। এই লামিক হলেন হজরত নুহ-র পিতা। নুহ আর একজন নবি।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ