শিপা সুলতানা'র গল্প | বন্ধুবৃক্ষের বাদুড়

গ্রামের নাম যা-ই হোক, সেটা অবশ্য আপনার মর্জির ওপরও নির্ভর করে। মর্জি শরিফ থাকলে আপনি একটি যুতসই নাম দিয়ে দিন, খানদানি কোনোও জেলাসহ। মর্জি বিলা থাকলে দেন ফেলে শত্রুর গ্রামে, এবং কর্ম নয় নামই মুখ্য বলে হাত ঝেড়ে ফেলুন।

গ্রামের একেবারে মধ্যভাগে পাঁচপীরের মোকামখানি। সামান্য এদিক সেদিক হতেই পারে। আপনি আপনার সুবিধামত সামান্য উত্তরে, খানিকটা পুবে, কোনাকোনি দক্ষিণে কিংবা বাড়ির সমুখেই বসিয়ে নিন। এখানেও আমার কোনও আপত্তি নেই। যদি পাঁচজনাতে ভাগাভাগি আপনার মনমত না হয়, দেন দু-তিন জনকে ফেলে।


তবে মোকামটি আদতেই নিরালা নির্জন। মূল পাঁচটি বৃক্ষ রেখে ঝাড়ে বেড়ে সুবিশাল একটি বন বাড়িটিতে। সেই অনুপাতে আলদ, অজগর, আতা, তোতা, মেছু আর গেছুবাঘ, শেয়াল, খাটাশ, মানানসই শরিফা ও দু-চারটি কমলাবৃক্ষ অবশ্যই আছে। শরিফা যদি অপরিচিত আর কমলা যদি অপছন্দের হয় তো আম, জাম, নারিকেল কিছু একটা লাগিয়ে দেন। সব আপনার মর্জি মাফিকই হোক।


মোকামের একেবারে সমুখেই নিচুপাড়ের একটি দিঘি আজো বিদ্যমান। আপাত দৃষ্টিতে পুকুর মালুম হলেও চারকোনের ছয়টি বয়স্কা তাল বৃক্ষই তার জাতের সাক্ষী। পুকুরের সবই বড় বড়। বড় বড় কাতল, বড় বড় চিতল, মলা ডেলা ইয়া বড় বড়। মাগুর এমনকি সিনেমায় দেখা দশমুখী দজ্জাল শাশুড়ির মত ঝাটা ঝাটা হাত পাওয়ালা চিংড়ি পর্যন্ত বড় বড়।

সব কিছু বড় বড় বলার আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগও অবশ্য আছে। অবৈধ পানি হাতাহাতির কোনও ঝুঁকি কেউ নেবে না বলে সবই বেখাপ্পা বড় বড়। যদি শীতের শেষান্তে জাল উড়াতে চান, সেও ভেবে দেখতে পারেন।

মোকামের পাঁচজনই বন্ধুস্থানীয়। কোনও এককালে যখন 'ধর্মবর্ণ নির্বিশেষে' ছিল, ঘটনা তৎকালীন। তিনজন মুসলমানের পুত তো বাকি দুজন ব্রাহ্মণ আর শুদ্রের ব্যাটা। এখন 'কী থেকে কী হলো' ভাবতে চাইলে নিজ দায়িত্বে ভাবুন এবং মোকাম বিষয়ক ক্যাচাল বাদ দিন দয়া করে।

মোকামের গ্রামের কোনও নাম আমি দেইনি। পছন্দ হয় নাই বলে দিতে পারিনি। তবু তার পাঁচদিকে পাঁচটি গ্রাম আছে। সাধারণত গ্রামের চারপাশে চারটি গ্রাম থাকার দস্তুর। মজলিশে আঙুল দেয়ার মতো এখানেও ঠেলাঠেলি করে পঞ্চম গ্রামটি ঢুকে পড়েছে। আশা করি এই বিষয়ক বাদানুবাদের অবসান ঘটাতে পেরেছি।

যথারীতি পাঁচটি গ্রামের পাঁচটি করে মানুষের বিয়েতে প্রেমেতে আরো পাঁচটি গ্রামের সংযুক্তি ঘটেছে।

ধরে নিন পাঁচটি গ্রামেই একজন করে ধর্মশিক্ষক, একজন করে মৌলভি, একজন করে লজিং মাস্টার, একজন করে ঠাকুর, একজন করে মুক্তিযোদ্ধা আর পাঁচটি গ্রাম মিলে দুই একজন রাজাকারও আছে। গ্রামে একজন করে হলেও হতভাগী, একজন করে দুঃশ্চরিত্রা ও একজন করে হলেও পোড়ামুখী আছে ।

টিলাটক্করের কোনও গুনাগুনতি নেই। সেই অনুপাতে ছড়া আছে আর ধরেন নাব্তলা আছে হাজারে হাজার। বারোমাস-ই ভেজা ভেজা ধানক্ষেত। সবই খোদার লীলা আর নাব্তলার দয়া। পুকুর আছে গণ্ডা গণ্ডা আর খুঁজে পেতে খুনিও আছে দু/চারজন। চোরচোট্টার কথা নাই বললাম। ধূলপড়া গুনীনও আছে একজন। ধরেন ধর্ষকামী আছে অযুত নিযুত ( বানান ঠিক হলো কিনা সন্দিহান আছি)। বাদ থাকলো কে? মনে পড়লে ভিন্ন আসরে ভিন্ন বেলায় বলবো।


গ্রামীন গল্পের পিণ্ডি চটকাই! পাঁচটি গ্রামের কোনোটির সাথেই জন্মে, আত্মীয়তায়, প্রেমে, ঝগড়ায় কোনও সূত্রই খুঁজে পেলাম না। তাই কোনও আগ্রহই আর নেই। শুধু পাঁচপীরের বাদুড়গুলি উড়ে উড়ে আমার বাড়ির উপর দিয়ে কোথা থেকে যে কোথা যায়, এর কোনও সমাধান আজও হলো না...

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

1 মন্তব্যসমূহ

  1. বাদুড়ী স্বভাব কাঁচা এঁটো পঁচা ছোবলানো ছোঁয় না । খাসা পাকা'র ম ম'র সন্ধানে কেবল ওড়ে আর ওড়ে পাখা ঝাপটায় । 'বাদুড়গুলো উড়ে যায় আমার বাড়ির উপর দিয়ে' বাহ্

    উত্তরমুছুন