ইন্দ্রাণী দত্ত'র গল্প : নাইদার নাইট নর ডে


 
 
লীভস্

একশ তিরিশ কোটি আলোকবর্ষ দূরের দুই ব্ল্যাকহোলের সংঘর্ষ যখন মহাশূণ্যে তরঙ্গ তৈরি করছিল, সেই সকালে, রাজীব আর মায়ার বাড়ির পিছনের সুইমিং পুলের ওপর একটি ফড়িং উড়ছিল। সকালগুলো এরকমই সচরাচর - জলের ওপর ফড়িং, পাখি, প্রজাপতি, রাজীব ব্যস্ত কফি, ল্যাপটপ আর অফিস বেরোনোর প্রস্তুতিতে, মায়া কখনও বাগানে জল দিচ্ছে, পুলের পাম্প অন করছে , জলে পড়ে থাকা ঝরা পাতা, ছোটো ডাল পরিষ্কার করছে। বস্তুতঃ এই বাড়ি, এই বাগান, এই পুল মায়ার জীবনে অনেকখানি। আর ফেসবুক। এই জগতের বাইরে অন্য কোনো কিছু-সে মাধ্যাকর্ষণের তরঙ্গই হোক কি সিয়াচেনের তুষারধস-এমন কিছু যাকে ব্যাকগ্রাউন্ডে রেখে সেল্ফি তুলে সে ফেসবুকে শেয়ার করতে পারবে না- মায়াকে সম্ভবতঃ স্পর্শ করত না।


মায়ার জলপ্রীতি ছিল সর্বজনবিদিত ,অথচ সে সাঁতার জানত না। সেই নিয়ে, মায়ার বিয়ের আগে আত্মীয় বন্ধুমহলে হাসিঠাট্টা লেগে থাকত। রাজীব তাতে যোগ দেয় বিয়ের পরেই যখন হনিমুনে গিয়ে, চেক ইন করার তিনঘন্টার মধ্যে হোটেলের জলের ট্যাংক খালি হয়ে যায়। সেই রাতে রাজীব নতুন বউকে নদীর ধারে বাড়ির প্রতিশ্রুতি দেয়। হানিমুনের প্রতিশ্রুতি সততঃ উদ্বায়ী কিন্তু রাজীব কথা রেখেছিল। শুধু নদীর বদলে সুইমিংপুল। এই বিচ্যুতিটুকু বিদেশবাস দিয়ে পুষিয়ে দিয়েছিল রাজীব। ফলতঃ মায়ার আর কিছুই চাইবার ছিল না। বাড়ি, বাগান, সুইমিং পুল, আর ফেসবুকে সে সবের ছবিতে শতখানেক লাইকে তার জীবন ও সুখ সংজ্ঞায়িত হচ্ছিল।


আজ সোমবার। আজকের দিনটা আলাদা। কাল বিকেল থেকে পুলের পাশে ছড়িয়ে আছে পুল কাভার, পুলি, দড়ি, কাঁচি, রাজীবের চপ্পল। পুলের জল ঢেকে দেবে রাজীব তারপর পুল বুজিয়ে ফেলবে- ঘোঁত ঘোঁত করে এই কথা বলে বেরিয়ে গেছে রাতে। ভোর অবধি ফেরে নি। সূর্য উঠে গিয়েছিল। সকালের কমলা আলোয় ভরে ছিল পুল, পুলের পাশের গাছ, ফড়িঙের ডানা আর মায়ার মুখ। পুলের জল পরিষ্কার, একটা পাতাও পড়ে নেই, ঝকঝকে আকাশের প্রতিফলনে আরো স্বচ্ছ দেখাচ্ছে জল, পুলের তলদেশ দৃশ্যমান। ফড়িংএর ছোটো , কালো ছায়া যখন একটা নির্দিষ্ট সময় অন্তর জলে পড়ছিল, ঝরা পাতার ভ্গ্নাংশ হিসেবে ভ্রম হচ্ছিল মায়ার। ফড়িং, জলের খুব কাছ দিয়ে নির্দিষ্ট উচ্চতায় উড়ছিল। পুলের এক দিক থেকে অন্য দিকে উড়ে যাচ্ছিল আবার ফিরে আসছিল, যেন জলের সমান্তরাল কোনো বাতাসের তরঙ্গে সাঁতার দিচ্ছিল।ফড়িং এর ডানা জলের উপরিভাগ স্পর্শ করছিল না, অথচ বিদ্যমান কালো ছায়াটি সর্বক্ষণ জলের ওপর ছিল, এমন কিছুই ঘটছিল না যাতে ছায়াটি অন্তর্হিত হয়। মনে হচ্ছিল, জল যেন ছায়াটিকে সর্বক্ষণ এক অদৃশ্য ট্র্যান্সমিটার রিসিভারের কৌশলী যোগাযোগে গোচরে রাখছে।যেন নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে ফড়িং এর যাত্রাপথ, ডানার গতি,উচ্চতা। আজ মায়া চাইছিল ট্র্যান্সমিটার রিসিভারের এই অখন্ড যোগসাজস বিঘ্নিত হোক, ফড়িং, তার ছায়া সমেত ট্র্যান্সমিটারের পাল্লার বাইরে কোথাও চলে যাক, একদম হারিয়ে যাক।বাগানের পশ্চিম দিক থেকে একটা হাল্কা গুঞ্জন আসছিল। নাসরীন এতদিন যে দুঃখবাজারের কথা ওকে বলে এসেছে, সেই বাজার এখন যেন ওর খুব কাছাকাছি এসে পড়েছে -এরকম অনুভূতি হচ্ছিল মায়ার। মনে হচ্ছিল, অনেক লোকের ভীড় অপেক্ষা করে আছে খুব কাছেই কোথাও, রাতের দিকে দেখা হয়ে যাবে।ছোটোবেলা থেকে শুনে আসা মাসি, পিসি, মা, দিদার সবার প্রথম পুরীর সমুদ্র দর্শনের গল্প, মায়ার প্রথম দেখার সঙ্গে যেমন হুবহু মিলে গিয়েছিল-সেরকমই কিছু ঘটবে এক্ষেত্রে-এরকম মনে হচ্ছিল মায়ার। সকালের চা খায় নি মায়া, রাতের জামা বদলায় নি; মায়ার উস্কোখুস্কো চুল, মায়ার চোখের তলায় কালি। মোবাইলে অজস্র মেসেজের নোটিফিকেশন দপদপে লাল আলো জ্বালিয়ে জানান দিচ্ছিল রাত থেকে; সকালে চার্জ শেষ হয়ে যাওয়ায় আপাততঃ মৃত।সকালের যাবতীয় কাজকর্ম পড়ে আছে। নাসরীন বর্ণিত দুঃখবাজার এবার সেও দেখতে পাবে- এহেন প্রত্যাশায়, নিতান্ত দীনহীনের মত, জলের ধারে রাত নামার অপেক্ষায় বসেই রইল মায়া।



ফাইভ কুইনস স্ট্রীট

বছর দুয়েক আগে, এপ্রিলের মাঝামাঝি রাজীব মায়াকে এ বাড়ি দেখাতে নিয়ে আসে। পুরোনো বাড়ি, বাগান আলো করে ম্যাগনোলিয়া ফুটেছিল, সবুজ ঘাসে লন ভরে ছিল, গাছের ডালে লাল নীল পাখি, বাথরুমে বাথটব, বাড়ির পিছনে সুইমিং পুল। মায়ার পছন্দ হয়ে গিয়েছিল -ছবি তুলে পাঠাতে লাইকে লাইকে ভরিয়ে দিয়েছিল ওর ফেসবুকের বন্ধুরা। এজেন্টের কাছে অফার করেছিল রাজীব পরদিনই, বাড়ির তৎকালীন মালিক প্যাট্রিক ব্যক্তিগত কারণে কিছু সময় চেয়েছিল; অতঃপর, সমস্ত ফরমালিটিজ মিটিয়ে, সে বছর জুলাইতে এবাড়িতে চলে এসেছিল রাজীব আর মায়া।

এ বাড়ির প্রাক্তন বাসিন্দাদের গল্প মায়া প্রথম শোনে নাসরীনের কাছে অক্টোবারের সকালে। আগের রাতে মায়ার নতুন বাড়ির বাথরুমে সাপ ঢুকেছিল। মাঝরাত নাগাদ বাথরুমে ঢুকে আলো জ্বালাতেই , কমোডের সিস্টার্নের ওপর অসম্ভব সুদর্শন, শান্ত পাইথনটিকে দেখতে পায় মায়া। মোবাইলে ছবি তুলে ফেসবুকে শেয়ার করে সঙ্গে সঙ্গে। তারপর রাজীবকে ডাকে। রাজীব সাপের গায়ে জল ছুঁড়ে দিলে সে নেমে আসে মেঝেয়, রাজীব বড় বালতি উপুড় করে দেয় সাপের ওপর, বাগান থেকে ইঁট এনে বালতির মাথায় রাখে, এমার্জেন্সিতে ফোন করে। রাতেই কাউন্সিলের লোক এসে কফি খেয়ে সাপ নিয়ে যায়, ওদের উপস্থিত বুদ্ধির তারিফ করে বারবার। মাঝরাতের পরে আলো জ্বলা, এমার্জেন্সি ভেহিকেলের হুটারের আওয়াজে সে রাতেই প্রতিবেশীরা ড্রেসিং গাউন জড়িয়ে ওদের বাগানে জড়ো হয়। বস্তুতঃ সে রাতেই , ওদের সঙ্গে প্রতিবেশীদের আলাপ হয় ভালো করে। নাসরীনের সঙ্গে সেই প্রথম দেখা। ম্যাগনোলিয়ার তলায় বেগুণী ড্রেসিং গাউন জড়িয়ে নাসরীন দাঁড়িয়েছিল। মায়ার দু হাত ধরে বলেছিল,” ভয় নেই। প্যাট্রিকের পোষা সাপ, কাউকে কিছু বলে না। আমি নাসরীন। তোমার পুলের দিকের ফেন্স টপকালেই আমার বাড়ি।সেন্ট এডওয়ার্ড হসপিটালের নার্স। কাল আমার নাইট শিফট। সকালের দিকে আসব আবার।“

বাচ্চাদের স্কুল বাসে তুলে দিয়ে নাসরীন এসেছিল মায়ার কাছে। নিজের কথা বলেছিল অল্প করে। ও নাসরীন, নাসরীন জলিল, পাকিস্তানের মেয়ে। মায়ারই বয়সী। ষোলো বছর বয়স থেকেই এ দেশে। স্বামী পারভেজ, দুই ছেলে বকর আর ফিরোজ কে নিয়ে এ'পাড়ার বাসিন্দা বছর দশেক। এসব কথাই কফি খেতে খেতে বলছিল নাসরীন। মায়ার বানানো কফির তারিফ করছিল । নাসরীন বলেছিল, “ তুমি জানতে না-প্যাট্রিক সাপ পুষত? ওর বৌ কায়লির সঙ্গে ডিভোর্স হয়ে যায় ঐ সাপের জন্যই। বাড়ির সামনের ল্যান্ডস্কেপিং, সুইমিং পুল অনেক শখ করে বানিয়েছিল, সইল না। সাপ পোষা নিয়ে কী অশান্তি! শেষে ডিভোর্স। বাড়ি বিক্রির টাকাটা কায়লিকে খোরপোষ দিয়ে থাইল্যান্ড চলে গেছে প্যাট্রিক।“

-" এই সাপটা প্যাট্রিকের পোষা ছিল, তুমি জানলে কি করে?”

-"আর কোত্থেকে পাইথন আসবে? প্যাট্রিকেরই; কাচের বাক্সে থাকত বেশ কয়েকটা। একটা পালিয়েছিল, জানতাম। প্যাট্রিক তোমাদের বলে নি”।

সেই সকালে, মায়ার সুখভরা মনে পোষা সাপ, ডিভোর্স আর অ্যালিমনি শব্দগুলো খচ খচ করে ঢুকেছিল। এবাড়িতে সাপ ছিল একদা, এ বাড়িতেই বিচ্ছেদ হয়েছিল নবীন দম্পতির-এই সব মেনে নিতে অসুবিধে হচ্ছিল মায়ার।

নাসরীন ওর মুখের দিকে তাকিয়ে হেসেছিল। কফির কাপ নামিয়ে রেখে বলেছিল,”এদেশে এসব জলভাত, এনিয়ে মনখারাপ কোরো না। আবার দ্যাখো, তোমার পিছনের বাড়ির ডাফনিকে। গত বছর বিয়ের গোল্ডেন জুবিলি হল, সবাইকে খুব খাওয়ালো। অথচ , ডাফনির বর ফিল চিরকাল ঘোড়দৌড়, বক্সিংএর পিছনে টাকা ঢেলেছে, বাইরে বাইরেই থাকত, ডাফনি একলা বাচ্চাদের বড় করেছে। ডিভোর্স কিন্তু হয়নি।“

সকালবেলায় সাপের কথা, বিচ্ছেদের কথা ভালো লাগছিল না মায়ার। ও কথা ঘোরাতে চাইছিল। টিভি অন করে বলেছিল, “ক্রিকেট দেখ? ওয়র্ল্ড কাপের খুব বেশি দেরি নেই।“

নাসরীন বলেছিল, “পারভেজ আর বাচ্চারা বিশেষ করে বকর ক্রিকেট পাগল। আমার সময় হয় না।“

-" চাকরি করে, দুই ছেলে সামলে সময় পাবেই বা কি করে?"

-" একদম সময় পাই না, তা নয়। যে টুকু সময় পাই, লিখি"

-" আরিব্বাস, তুমি লেখক?"

-" লিখে রাখি এই অবধিই"

-" কোথায় পাবলিশড হয়েছে? আমাকে পড়াবে? তোমাদের আইস ক্যান্ডি ম্যান পড়েছি, আর্থ পড়েছি। দীপা মেহতার সিনেমা দেখার পরে। পাকিস্তানি লিটারেচার আর কিছু পড়িনি তেমন।“

-" আরে আমি কি বাপসি সিদ্ধ্বার মত নামকরা কেউ? আর আমাদের লিটারেচর তোমাদের লিটারেচর বলে আলাদা করে কিছু হয় নাকি! "

-"এই রে! রাগ করলে! অত ভেবে বলিনি গো। কেমন করে যেন এই 'তোমাদের -আমাদের' মুখ থেকে বেরিয়েই যায়। এখন থেকে আর হবে না ।পড়াবে তো তোমার লেখা!"

-“আমার লেখায় নতুন কিছু নেই। সাধারণ লেখা, যেমন হয়।কাল একটা বই দিয়ে যাব, আন্দাজ পাবে। বিকেলে থাকবে তো বাড়িতে"?



রাতে বাড়ি ফিরে রাজীব বলেছিল, "একটু সাবধানে মিশো। বাচ্চাগুলো-ও খতরনাক। একটা টীনএজার গত সপ্তায় আইসিস জয়েন করতে যাচ্ছিল, এয়ারপোর্টে ধরা পড়েছে। টিভিতে দেখনি? দিনকাল ভালো নয়, বুঝলে?"

-"সেই জন্যই তো ছেলেপুলের ঝামেলায় যাই নি"- হেসে গড়িয়ে রাজীবের গলা জড়িয়ে ধরেছিল মায়া। গলা জড়ানোর সেল্ফিটা সকালে ফেসবুকে পোস্ট করে দিয়েছিল।



শী হু ওয়েন্ট লুকিং ফর বাটারফ্লাইজ

পরদিনই নাসরীন তেরোখানি ছোটো গল্পের কালেকশান-'নাইদার নাইট, নর ডে - থার্টীন স্টোরিজ বাই উইমেন ফ্রম পাকিস্তান' দিয়ে যায়। মায়া সূচিপত্রে যায় প্রথমেই।

-" কিরন বশীর আহমেদ, নিক্খত হাসান, জাহিদা হিনা, খালেদা হুসেইন, সাবিন জাভেরি জিলানি, সোনিয়া কামাল, সুরাইয়া খান, মনিজা নকভী... ওমা, কোথায় তোমার নাম? নায়রা রহমান, শেভা সরওয়ার, বীণা শাহ, কইসিরা শেহরাজ, মুনিজা শামসী….-আর তো নেই.. তোমার গল্প কোথায়? ছদ্মনামে লিখেছ?"

নাসরীন হাসে-"হয় একটাও নয়, আবার হয় তো সব কটাই আমার"।

ফেসবুক হ'লে এই হেঁয়ালিতে চোখ বুজে লাইক দিত মায়া। ওর ভ্যাবলা দৃষ্টি নাসরীনের চোখ এড়ায় না।হেসে বলে যায়, " সময় পেলে পড়ে রেখো"।

বই এর মলাটে একটি মেয়ের চোখ, ভ্রূ , নাক আর কপাল এর সামান্য অংশ।বাকিটা আড়ালে। বইটার একটা ছবি তুলে ফেসবুকে পোস্ট করে মায়া-তলায় ক্যাপশন দেয় –‘অচেনাকে চিনে চিনে উঠবে জীবন ভরে' । তারপর বইএর পাতা উল্টায়। পাঠশেষে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে এক হাত দিয়ে কপাল ঢাকে, অন্য হাতে নাক থেকে চিবুক। নিজেকে মলাটের ছবির মত লাগে অনেকটা।

বইটা ফেরত দিতে মায়া নাসরীনের বাড়ি গেলে-নাসরীনের নাইটশিফ্ট, বিকেলে বেরোবে, ছেলেরা স্কুলে , শান্ত ঘরদুয়ার; ওদের ল্যাব্রাডর ভারি শরীর নিয়ে ল্যাজ নাড়ল তারপর আবার ধপ করে শুয়ে পড়ে মায়ার পায়ের কাছে।মেজেনাইনে নাসরীনের পড়ার ঘর। দেওয়ালের তাকে বই, টেবিল, ল্যাপটপ, টবে একটা বনসাই। সেখানে চা নিয়ে আসে নাসরীন।

-“খাও তো চা? না কি কফি?”

-“না না চা।কলকাতার না? তুমি কি লাহোরের মেয়ে?”

-“করাচীর, তবে আমার ঠাকুর্দা, ঠাকুমা পাঞ্জাবের।“

-“করাচীর? তাহলে, এরপর থেকে বাড়ি গেলে করাচী হালুয়া আনতে হবে আমার জন্য।“

-“সেই যে ক্লাস টেন পাশ করে এদেশে চলে এসেছি, আর যাই নি ওখানে, যাই না।“

-“সে কি? একবারও যাও নি?”

-“সে অনেক কথা। পরে কোনদিন বলব। তুমি বলো, কোন গল্পটা সব থেকে ভালো লাগলো?”

-“নাইদার নাইট নর ডে। মেয়েটা আম কিনে এনে খাচ্ছে,মুখে হাতে রস লেগে যাচ্ছে, টপ টপ করে রস পড়ছে দামী কার্পেটে। মেয়েটা তারপর ভ্যাকুয়াম চালিয়ে সেই সব দাগ মুছছে। , ধূপ জ্বালিয়ে আমের গন্ধ তাড়াচ্ছে । মেয়েটার বর বিদেশী, একদিকে সাউথ এশিয়ান কালচারের চর্চা করে, রাশদি পড়ে, ইয়োগা করে, অন্যদিকে বৌ মাছের ঝোল রাঁধলে, নিজের জামা কাপড় প্লাস্টিকের মোড়কে সিল করে রাখে।“

-'ধূপ আর মাছের ঝোল ছিল না গল্পে, কারি ছিল আর রুম ফ্রেশনার….এইরকম কিছু…”

-“আই নো। মাছের ঝোলটা তো আমি বললাম। আই ক্যান আইডেন্টিফাই।“

-“উই অল ক্যান”।

-“আমাকে নিয়ে গল্প লিখবে , নাসরীন? আমি খুব চাই-কেউ গল্প লিখুক আমাকে নিয়ে”।

নাসরীন হাসল,

-"বেশ তো। লিখব। তোমাকে নিয়ে লিখলে, কি নাম দেব গল্পের? এনি সাজেশন্স?"

- " গল্প নয় গল্প নয়, উপন্যাস লিখো। নাম এই বইটার নামেই দিও-নাইদার নাইট নর ডে। এক একটা চ্যাপ্টার এক একটা গল্পের নামে দিও- লীভস, ফাইভ কুঈনস স্ট্রীট, নাইদার নাইট নর ডে, আ স্যান্ডস্টোন পাস্ট- এই রকম।"

-“ কে বলতে পারে, তোমার কথা হয়তো তুমিই লিখবে একদিন”

-“দূর আমি কি লিখব? আমার দৌড়, ফেসবুকে দু লাইন।“

-“তা নয় মায়া। তুমিও লিখবে একদিন। আসলে, আমার কি মনে হয় জানো? একটা নদী আছে কোথাও, দেখা যায় না, তবে আছে। সেই নদীর ধারে, সন্ধ্যার পরে অদ্ভূত এক হাট বসে। সেখানে দুঃখের বেচাকেনা হয়। ঐ নদী যেদিন দেখতে পাবে, লেখা ছাড়া হয়তো আর গতি থাকবে না।"



আ ব্রিফ অ্যাকোয়েন্টেন্স


নাসরীন পেয়ারা দিয়ে গিয়েছিল, ওদের গাছের পেয়ারা। মায়া লেবু পাঠায়। নাসরীন কারিপাতা দিলে, মায়া বাগান থেকে তুলে এক ঝুড়ি লংকা পাঠায়। হ্যালৌইনে র আলো বানাবার জন্য ফিরোজ আর বকরকে বাগানের কুমড়ো পাঠায়। তারপর বিরিয়ানি পর্ব শুরু হয় ।নাসরীন বিরিয়ানি রেঁধে পাঠালে, মায়া স্যামনের পাতুড়ি পাঠিয়েছিল। কোনদিন গুলাবজামুন। রাজীব আঙুল চেটে বলে, “এতদিনে একজন ভালো বন্ধু পেয়েছ তুমি। ওয়াও! কী রান্না!”

মায়া চাইছিল, নাসরীন ওদের বাড়িতে আরো আসুক, পরভেজকে নিয়ে, দুই ছেলে, ল্যাব্রাডর নিয়ে। সেই সঙ্গে রাজীবকে নাসরীনের পড়ার ঘর, ঠান্ডা মেঝে ,বনসাই দেখাতেও ইচ্ছে হচ্ছিল ওর। বকর আর ফিরোজকে রোববার রোববার ওদের পুলে সাঁতার কাটতে আসতে বলে দিল মায়া।

-“ওরা ভীষণ জল ভালোবাসে, কিন্তু তোমাদের অসুবিধে হবে না? ছুটির দিনে হৈ চৈ, ভালো লাগবে তোমার মিস্টারের?”

-“হ্যাঁ হ্যাঁ , খুব খুশি হবে, বাচ্চা টাচ্চা এলে তো ভালো লাগেই।“

হই হই করে শুরু হয়ে গিয়েছিল সাঁতার, কোনোদিন পারভেজ আসত ছেলেদের সঙ্গে, কোনো কোনোদিন নাসরীন, মায়া, রাজীবের দু একজন বন্ধুও আসত তাদের বাচ্চাদের নিয়ে-রোববার রোববার বার-বি-কিউ, সাঁতার, বীয়ার। ক্রিকেটের গল্প, বলিউড।সলমনের আর হৃতিকের ফিল্ম রিলীজ করলে অন লাইনে ৬টা টিকিট কাটত মায়া অথবা নাসরীন। ক্রিকেট ম্যাচেরও। কোনো দিন ভারত পাকিস্তান খেলা হলে কে কাকে সাপোর্ট করবে এই নিয়ে মৃদু রসিকতাও হত। রাজীব বলত-“আমি বিরিয়ানির সাপোর্টার।“ পারভেজ বলত-“ আমি গুলাবজামুনের”। দুই সখি কাঁধে কাঁধ ঠেকিয়ে হাসত, বাচ্চারা জলে ঝাঁপাতো, বৃদ্ধ ল্যাব্রাডর থাবায় মুখ গুঁজে চোখ মিটমিট করত।


আই সি সি ওয়ার্ল্ড কাপের পুল বির খেলা পড়ল ইন্ডিয়া ভার্সাস পাকিস্তান। ঠিক হ'ল, শহরে একটা পাবে জায়ান্ট স্ক্রীনে খেলা দেখবে যাবে রাজীব, ওর বন্ধু সন্তোষ আর পারভেজ। ডে নাইট ম্যাচ, ওদের ফিরতে দেরিই হবে।

দুপুর হতেই দুই সখী ফিরোজ আর বকর কে নিয়ে নাসরীনের বাড়িতে টিভির সামনে বসেছে। ভারত ব্যাট করছিল প্রথমে। দুরন্ত খেলছিল ধ্বনি, বিরাট আর রায়্না। বল উড়ে পড়ছিল বাউন্ডারির বাইরে। বাচ্চারা হাত তালি দিচ্ছিল-ওরা কোহলির ফ্যান। নাসরীন চুপচাপ-শান্ত, স্থিত উচ্ছ্বাসহীন। মায়া অস্বস্তিতে ভুগছিল-ভাবছিল, ইন্ডিয়া এত ভালো না খেললেই পারত আজ। ভাবছিল, বিরাট আউট হয়ে যাক, ইন্ডিয়া হারুক।

বস্তুতঃ উল্টোটাই ঘটছিল। পাকিস্তান ৩০০ রান চেজ করছিল। শুরুটা ভালই ছিল। কিন্তু ১০২ থেকে ১০৩ রানের মধ্যে তিনটে উইকেট পড়ে আর তারপর শহীদ আফ্রিদির ক্যাচ বিরাট ধরে নিতেই মায়ার মুখ শুকিয়ে আসে। গলা খাঁকরে বলে, “এবারে খেয়ে নিলে হত না?”

নাসরীন বলল, “ডোন্ট ওয়রি, দে আর এনজয়িং দ্য গেম।“

বস্তুতঃ বকর আর ফিরোজের মধ্যে কোনই হেলদোল দেখছিল না মায়া। চার, ছয় বা কেউ আউট হলেই ওরা সোফায় উঠে নাচছিল।

খেলা শেষ হতে মায়া বাড়ি ফিরে এলো। ইন্ডিয়ার জয়ে ও কষ্ট পাচ্ছিল আর এই অনুভূতিটা আরও বড় কষ্টের জন্ম দিচ্ছিল ওর মনে। নাসরীনকে বলেছিল-“ মাথা ধরে গেছে, আজ আর খাবো না।“


রাত বাড়ছিল; এতক্ষণে রাজীব, পরভেজদের ফিরে আসার কথা। মায়া ফোন করছিল বারবার। ফোন বেজে যাচ্ছিল রাজীবের, পারভেজের, সন্তোষের।নাসরীনকে বলতে, সে ওকে আশ্বস্ত করেছিল, হেসে বলেছিল-“আরে বিলকুল বে ফিকর রহ।পিকে আয়েঙ্গে না...”

ভোর রাতে পুলিশের গাড়ি এসে নামিয়ে দিয়েছিল পারভেজ আর রাজীবকে। দুজনেই রক্তাক্ত। পাবে মারামারি হয় ইন্ডিয়া আর পাকিস্তানের সাপোর্টারে।সন্তোষ গ্রেফতার হয়েছিল, রাজীব আর পারভেজকে সতর্ক করে ছেড়ে দিয়েছিল পুলিশ।

ঘর্মাক্ত রক্তাক্ত রাজীব ঘরে ঢুকেই প্রথম কথা বলেছিল-“রোববারের পার্টি খতম।ও বাড়িতে আর যাবে না তুমি। ও বাড়ির কোনো শালা যেন এবাড়িতে না ঢোকে”।


এরপরে, যেমন হয়, এই পরিস্থিতিতে অভ্যস্ত হয়ে যাচ্ছিল এবাড়ি, পাশের বাড়ি। ট্র্যাশ ফেলতে , বাগানে জল দিতে গিয়ে মুখোমুখি হলে মায়া হেসেছে ,হাই বলেছে। রাজীব বাড়িতে না থাকলে ফোন করেছে নাসরীনকে। সেদিনের রক্তারক্তির কথা কেউই তোলেনি আর। দুজনেই বুঝেছিল, আগের মত আর হবে না কোনদিন। যা ঘটেছে, ভবিতব্যই ছিল।মায়া মাঝে মাঝে ভাবতে চেয়েছে, সে রাতে পারভেজ বাড়ি ফিরে নাসরীনকে কি বলেছিল।


সেদিন রোব্বার, দুপুরনাগাদ, রাজীব ভাতঘুমে। মায়া পুলের পাশের চেয়ারে বই নিয়ে বসে। ফেন্সের ওদিকে ফিরোজ আর বকরের হুটোপাটির আওয়াজ পাচ্ছিল মায়া। ক্রিকেট খেলছে ব্যাকইয়ার্ডে। হঠাৎই ওদিক থেকে একটা বল উড়ে এসে, ড্রপ খেয়ে পুলে পড়ল, পুলের মাঝবরাবর। আগে এমন হলে , মায়া বা রাজীব বল কুড়িয়ে ফেরত পাঠাতো। এবারে পরিস্থিতি ভিন্ন তার ওপর বল একদম পুলের মাঝখানে। মায়া বই মুড়ে উঠে আসে। লম্বা ডান্ডার মাথায় বাঁধা জাল দিয়ে বল তোলার চেষ্টা করতে থাকে। অধৈর্য ফিরোজ ফেন্সের ওপর থেকে দেখতে থাকে আর চেঁচায়-“আন্টি কুইক, কুইক”। তারপর অধৈর্য হয়ে ফেন্স টপকে জলে ঝাঁপ দেয়।

ঝপাং শব্দটা তখনও পুরোপুরি মিলায় নি,পুলের চারদিকে জল ছিটকে পড়েছে, পুলের মধ্যে ফিরোজ আর তার হলুদ ক্যাম্বিসের বল, লম্বা জাল হাতে মায়া হতভম্ব দাঁড়িয়ে-রাজীব ঘুম ভেঙে বাইরে আসে। ফিরোজ কি বোঝে কে জানে-“গুড আফটারনুন আঙ্কল”বলে, পুল থেকে সাঁতরে বেরিয়ে বল ছুঁড়ে দেয় ফেন্সের ওদিকে। তারপর “বাই আন্টি” বলে ফেন্স টপকায়।

রাজীব মায়ার হাত থেকে লম্বা ডান্ডা কেড়ে নিয়ে জলে আছাড় দেয়। ছিটকানো জলে পা ঠুকতে ঠুকতে বলে-“কতবার বলেছি কতবার বলেছি আমাদের জলে ওরা নামবে না।“ তারপর কোথা থেকে নিয়ে আসে ত্রিপল, দড়ি, কাঁচি, গ্যারাজে পড়ে থাকা পুরোনো পুলি।

-“খুব জলের শখ তোমার তাই না ? তোমার চোদ্দো গুষ্ঠীতে কেউ দেখেছে পুল? কেউ এসেছে বিদেশে? এই পুল আমার, আমার টাকা, আমার পুল। আমার পুলে তুমি টেররিস্টের বাচ্চা নামাও কোন সাহসে? এক পয়সা রোজগার আছে তোমার? এই পুল ঢেকে দেব আমি। কেউ নামবে না জলে , কেউ না, কেউ না।“

মায়া দৌড়ে ঘরে ঢুকতে যায়, রাজীব ওর চুল ধরে টেনে আনে, জলে ফেলে দেয়। পুলের কিনারায় জল বেশি নয়। হাঁটু জলে দাঁড়িয়ে মায়া কাঁদতে থাকে। ধীরে ধীরে এই বোধ তাকে গ্রাস করে, অবশ করে দেয়-এই বিশাল মহাদেশে শুধু সে আর তাকে ঘিরে জল-যে জলে আর দুপা গেলেই সে ডুবে যাবে।



নাইদার নাইট নর ডে

সোমবারের রাত গভীর হলে, মায়া উঠে পুলের দিকের দরজা খোলে। রাজীবের শখের নীল আলো পুলের জলে এখনও জ্বলছে। ইতস্ততঃ নীল ত্রিপল, পুলি, দড়ি, রাজীবের চপ্পল।দেখতে দেখতে মায়ার চোখের সামনে, লোনা জলের পুষ্করিণী অন্ধকার আকাশের নিচে নদী হয়ে বইতে থাকে। নদীর বুকে আলো জ্বলা নৌকোগুলি, নদী তীরে রাতের দুঃখবাজার। নাসরীন যেমন বলেছিল। নীল ত্রিপলের ছাউনি দেওয়া ছোটো দোকান, কুপি জ্বলছে। তাকে ঘিরে ছায়াপিন্ডের মত ক্রেতার দল। ওপারে যাওয়ার জন্য মায়া জলে নামে। প্রথমে পায়ের পাতা, তারপর কোমর তারপর গলা জলে দাঁড়িয়ে মায়া দেখতে থাকে দুঃখশোকের বিকিকিনি। কুপির আলোয় দাঁড়িপাল্লার একদিকে জগদ্দল দুঃখর বাটখারা বসিয়ে, দোকানী কাউকে পাঁচশো গ্রাম কাউকে দেড় কিলো দুঃখ বেদনা কেটে কেটে দিচ্ছে। যে যেমন চায়। ঘন নীল, সবুজ, বাদামী সেই সব দুঃখের রঙ ফোঁটায় ফোঁটায় ঘন রসের ধারা তৈরি করছে। মায়ার ঐ দুঃখের পিন্ড কেনার সাধ হয়। সে আরো এগোয়। গলা ছাপিয়ে জল কানের লতি ছোঁয়, তারপর চোখ, তারপর কপাল, সিঁথি....


পরদিন সকালে কমলা আলোয় ফড়িং উড়ে বেড়াচ্ছিল যথারীতি। আর জলতলে মায়া দুঃখপিন্ডকে মুঠোয় আঁকড়ে শুয়েছিল। তার শরীর এর তলায় নিজস্ব কালো ছায়া চাপা পড়ে ছিল। আকাশে সূর্য, সুপুরি গাছ, টিভি চলছিল কোথাও। পুলের ধারে রাজীব, অ্যাম্বুলেন্স, এমার্জেন্সি সার্ভিসের লোকজন। ঘুমন্ত মায়াকে জল থেকে তোলা হচ্ছিল যখন মায়ার হাতে ধরা দুঃখপিন্ড গড়িয়ে পড়ে জলতলের আঘাতে বিচূর্ণ হয়েছিল। নীল, খুবই নীল দেখাচ্ছিল জলতল। সেই ভগ্ন দুঃখপিন্ড থেকে কোনো তরঙ্গ পুলের জল পেরিয়ে রাজীব, পুলিশ, কোনো মানুষ, অথবা আরো হাজার হাজার মাইল দূরে ওয়াগা কিম্বা এল ও সি তে পৌঁছোচ্ছিল কি না জানা যায় না। আইনস্টাইন এইসব লিখে যান নি।


******************************************************

ঋণস্বীকারঃ Neither Night Nor Day: Thirteen Stories by Women from Pakistan; Editor: Rakhshanda Jalil





নামঃ ইন্দ্রাণী দত্ত

কলকাতা, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত

বর্তমান আবাসস্থলঃ সিডনী, অস্ট্রেলিয়া
পেশাঃ বিজ্ঞানী

লেখালেখির ক্ষেত্র : ছোট গল্প, ফিচার, প্রবন্ধ, কবিতা

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

1 মন্তব্যসমূহ