নিরাকপড়া দুপুরে সেলুনের উঁচু রিভলভিং চেয়ারটায় একাকী বসে আছে নিবারণ — নিবারণ শীল। সেলুনের মালিক সফদর আলী আর অপর কারিগর মাইজুদ্দি দুপুরের খাবার খেতে গিয়েছে কিছুক্ষণ আগে। একহারা গড়ন নিবারণের। ক্ষুর ধার—দেওয়া পাথরের মত গায়ের রং। বয়স এখন ষাটের কাছাকাছি হলেও দেখলেই বোঝা যায়, একসময় চেহারায় ধার ছিল, টানা চোখ, খাড়া নাক আর প্রশস্ত কপাল। এখন ওর গাল জুড়ে অবহেলায় বেড়ে-ওঠা নলখাগড়ার ঝোপের মত শ্মশ্রূ। আয়নায় নিজেকে দেখে মাঝে মাঝে মনটা বিষাদে ভরে ওঠে। অনেক বছর আগের নিবারণের সাথে আজকের নিবারণকে মেলাতে ওর নিজের কাছেই অসম্ভব ঠেকে।
আগুনঝরা রোদ্দুরে উপুড় হয়ে শুয়ে-থাকা রাস্তার কালো চামড়ায় অসংখ্য ফোসকা — গনগনে তাপে গলে আঠা আঠা। যানবাহন, মানুষজনের চলাচল পাতলা। কিছু কিছু রিকশা আর মটরগাড়ি চাকার চটচট্ শব্দ তুলে এদিক-ওদিক চলাচল করছে। ক্লান্ত ফাঁকা চোখে নিবারণ চেয়ে আছে বাইরের দিকে। রাস্তার ওপারে ডাস্টবিনের ধারে ধ্বস্তাধ্বস্তিরত দুটো নেড়িকুত্তা। মাদিটা লেজ গুটিয়ে প্রাণপণ চেষ্টা করছে ক্ষেপে-ওঠা মদ্দটির অত্যাচার থেকে নিজেকে বাঁচাতে। সাদা চকচকে দুপাটি দাঁত বের করে খেঁকিয়ে উঠছে বারবার। ডাস্টবিন থেকে ভকভক্ ভেসে আসছে উৎকট ঝাঁজালো গন্ধ। কয়েকটা উলঙ্গপ্রায় টোকাই আর্বজনা-স্তূপ থেকে খুঁটে নিচ্ছে ওদের পছন্দের এটা-ওটা। হোটেলের ফেলে-দেওয়া উচ্ছিষ্ট খাবার চেঁচেপুঁছে তুলে নিচ্ছে পলিথিনের ব্যাগে। ভরা জ্যৈষ্ঠ মাস। অথচ সেই কবে ছিটেফোঁটা বৃষ্টি হয়েছিল। এভাবে আর কিছুদিন চললে মানুষ তো না খেয়ে মারা পড়বে। এরই মধ্যে আকালের পদধ্বনি শোনা যেতে শুরু করেছে। ব্যবসার অবস্থাও খুবই মন্দা। জেলা শহর টাঙ্গাইলের একপ্রান্তে মেইন রোডের ধারে মাঝারি ধরনের সেলুন। নামটা কিন্তু খাসা — ‘ডালাস হেয়ার ষ্টাইলিং ষ্টুডিও’! রাজধানী শহরে এক সেলুনের এরকম নাম দেখে শখ করে রেখে দিয়েছিল সফদর আলী। দেওয়ালের গায়ে টাঙানো চুলছাটার হরেক স্টাইলের ছবি। নতুন নতুন অবস্থায় বেশ চলছিল। ধারেকাছে তেমন সেলুন ছিল না তো।এখন তো বেশ ক’টা। তাছাড়া, মনে হয়, লোকের হাতে এখন কাঁচা পয়সারও পড়েছে আকাল। চুল কাটায় আর ক’টাকা; চুলে কলপ, শ্যাম্পু করা, ফেসিয়াল — এগুলোই তো হল লাভের কাজ। লাভের কাজ লাটে উঠেছে অনেকদিন হল। নিবারণ যখন চাকরি নেয় তখন মোট কারিগর ছিল ছ’জন। ঝানু ঝানু সব নরসুন্দর। লোকের ভিড় লেগেই থাকত। তখন পরম সুখে চোখ মুদে কাউন্টারের গদি-আঁটা চেয়ারটায় গা এলিয়ে দিয়ে ক্যাসেটে ফিল্মের হিট গান শুনত আর আঙ্গুল দিয়ে টেবিলের ওপর তাল ঠুকত সফদর মিয়া। সেদিন আর নেই। তবু হতাশ হয় না সফদর, সুদিনের মুখ আবার দেখা যাবে ইনশাল্লাহ্। তাছাড়া ঝানু কারিগর নিবারণ তো আছেই।
প্রচণ্ড গরমে হাঁসফাঁস করছে নিবারণ। ফ্যান চালাবে? নাহ, থাক — কারেন্ট-বিল বেশি এলে সমস্যা। অত্যধিক গরম আর নাওয়া-খাওয়ার অনিয়মে শরীর কষা হয়ে পড়েছে। পেচ্ছাব মাছ-ধোওয়া জলের মত লাল। মাথা ঝিমঝিম করছে বেশ কদিন থেকে। মেজাজটাও চড়া। দু’দিন আগে অন্যমনষ্ক হয়ে শেভ করতে গিয়ে এক কাস্টমারের গাল সামান্য কেটে ফেলেছিল। ধমকে উঠেছিল লোকটা, — ‘অ্যাই মিয়া, ক্ষুর চালান শিখইন নাই নাকি? এইটা কী করলেন, অ্যাঁ?’ অন্যসময় হলে বিনয়ের সাথে মাপ চেয়ে নিত। কিন্তু তখন ঝাঁজালো গলায় বলে উঠেছিল, — ‘আরে সাব, লড়াচড়া করলি গাল তো গাল, গলাও কাটতি পারে... ।’নিজের দোষ ধরতে পেরে অবশ্য পরক্ষণেই মোলায়েম সুরে বলেছিল, — ‘খাড়ান, ফিটকারি লাগায়া দিতাছি, রক্ত বন্দ হয়া যাবিনি।’
নিবারণ কেমন এক ঘোরের মধ্যে ডুবে আছে। রাস্তার দিকে চোখ মেলে রাখলেও কিছু দেখছে বলে মনে হয় না। কে একজন হনহন্ করে হেঁটে যেতে যেতে চেঁচিয়ে বলে ওঠে, — ‘অ নেবারন কাহা, ব্যারামি মুরগির মত ঝুমতাছ ক্যা? কামকাজ নাই বুঝি?’
ভাবলেশহীন একপিণ্ড জড় মাংসের মত চেয়ারটায় বসে থাকে নিবারণ, একটু উবু হয়ে। অবসর ভয়ঙ্কর পীড়া দেয় ওকে। কাজের মধ্যে যতক্ষণ থাকে, সব ভুলে থাকে। কিন্তু কর্মহীন সময় ওকে অতীত স্মৃতির ধূসর অরণ্যে টেনে নিয়ে যায়।
ভাঙ্গুড়া বাজারে একসময় ওর নিজের ছিল ছোট্ট একটা সেলুন। টিনের চাল, টিনের বেড়া। ছোট ছাপরামত ঘরখানা ভাড়া নিয়েছিল বাজারের আড়তদার ফজলু শেখের কাছ থেকে। নিবারণকে পছন্দ করত ফজলু শেখ। সৎ আর নিরীহ স্বভাবের জন্য শুধু ফজলু কেন এলাকার তাবৎ লোকই পছন্দ করত ওকে। ওর হাতে ছিল যাদু। ভাঙ্গুড়া তো ভাঙ্গুড়া, আশপাশের অনেক এলাকাতেই নাম ছড়িয়ে পড়েছিল ওর। চুলে কাঁচি চালানোর সময় খদ্দেরদের তন্দ্রা এসে যেত। ওর হাতে চুল কাটালে চেহারায় কী খোলতাই-ই না আসত। নরসুন্দর তো একেই বলে। দেখতে দেখতেই ব্যবসা জমে উঠল। দু’জন শাগরেদও জুটে গেল। ব্যবসার আয়ের তুলনায় খরচ ছিল কম। খাওয়ার লোক তো মোটে দু’জন। সে আর বৌ হরিদাসী । বিয়ের পর বছর গড়াতে না গড়াতেই হরিদাসী পোয়াতি হল। কোলে এল ফুটফুটে এক মেয়ে। নিবারণের আনন্দ দেখে কে! বাড়িতে যতক্ষণ থাকে, মেয়েটাকে নিয়ে বিচিত্র সব আদরসোহাগে মেতে থাকে। হরিদাসী মাঝেমধ্যে কপট রাগ দেখায়, — ‘মেয়া নিয়া সারাক্ষণ মাইতা থাকলি ব্যবসা চাঙ্গে উঠপিনি, কইলাম কিন্তু, হ...।’ হেসে প্রতিবাদ করে নিবারণ, ‘এই মেয়া আমার অন্নপূর্ণা গো, আমার দুগ্গা মা।’ মেয়ের নাম শেষ পর্যন্ত দুর্গাই স্থির হল। কিন্তু সুখ বেশি দিন টিকল না তার। তিন বছরের মাথায় দ্বিতীয়বার পোয়াতি হল হরিদাসী, আর সন্তান বিয়োবার সময় দুদিন নিদারুণ গব্বযন্তনা ভোগ করে দেহ রাখল। বৌটাকে খুবই ভালোবাসত নিবারণ। খুব ভেঙ্গে পড়েছিল তাই। পরিচিতজনেরা সান্ত্বনা দিয়েছিল, — ‘কী করবা কও নেবারণ, যে গেছে সে তো গেছেই। কচি মেয়াটার দিকে তাকায়া বুকে বল বাঁধো...।’ দিন যায়, ক্রমশ স্বাভাবিক হয়ে ওঠে নিবারণ। আটমাইল দূর থেকে ওর এক বিধবা পিসিকে নিয়ে আসে দুর্গাকে দেখাশোনা করবার জন্য। ক’মাস পেরোতেই কেউ কেউ পরামর্শ দেয় নিখাদ আন্তরিকতা নিয়েই, — ‘যুয়ান বয়স নেবারন, কত দিন আর একলা কাটাবা? আবার একটা কাম কইরা ফালাও, ঘরের লক্ষ্মী ছাড়া কি আর চলে?’ কথার অর্থ যে নিবারণ বোঝে না তা নয়। ঘুমের ভেতর প্রায়ই হরিদাসী আসে, শরীর উদাম করে। ঘুম ভাঙবার পরও অনেকক্ষণ ধরে শরীরের মাঝখানটার বদ্বীপে উষ্ণ স্রোত বয়।
মাঝে মাঝে লোকজনের পরামর্শের কথা নিবারণ যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়ে ভাবে। কিন্তু দুর্গার কথা মনে এলেই ঝেঁটিয়ে দূর করে ওসব ভাবনা। ছিঃ, কী সব ভাবতিছি আমি। ঘরে সৎমা আসলি আমার দুগ্গার কী হবি! তারপর থেকে ওই এতটুকুন মেয়েকে নিয়ে সে একহাতে নাও বেয়ে চলেছিল জীবনের উজান নদীতে। মা মারা যাওয়ার পর দুর্গার দেখাশোনার ভার ছিল ওর পিসির ওপর। বিধবা পিসিরও আপন বলতে কেউ ছিল না তো। দুর্গার বয়স যখন সাত, ইসকুলে ভর্তি করে দিয়েছিল নিবারণ। মেয়েকে অনেক লেখাপড়া শেখাবে, ভগবানের কৃপা হলে বড় অফিসার বানাবে — মেয়েকে নিয়ে কত স্বপ্ন ওর। ছাত্রী হিসেবে দুর্গা তো কম যায় না — ক্লাশে এক নম্বর।
নিবারণের চিন্তার জালে ছেদ পড়ে। ফরসামত প্রৌঢ় এক লোক এসে ঢোকে সেলুনে। মুখে ঘন চাপদাড়ি। মাথায় নকশা-করা গোলটুপি। পায়ের গোড়ালি পর্যন্ত ঝোলানো নস্যিরং পাঞ্জাবি। গা থেকে ভুরভুর করে বেরোচ্ছে আতরের কড়া গন্ধ। কাঁধের ওপর চাপানো হাজিরুমালের কোনা দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে বলে, — ‘আল্লার গজব নাজিল হইছে রে নেবারন। জীবনে এতবড় খরা দেহি নাই। উহ্ , গরমে জানটা কবজ হয়া গেল...’
নিবারণ নিঃশব্দে মাথা নেড়ে তার কথায় সায় দেয়।
‘ভালা কইরা চুল-দাড়ি ছাইটা দিবা, আইজ জামুর্কি মাদ্রাসার নয়া বিল্ডিং উদ্বোধন, কোন মন্ত্রী জানি আসব শুনলাম... দাওয়াত পাইছি, বুঝলানি।’
‘হ, হুজুর, সকাল থাইকা মাইকিং হতিছে…’, নিবারণ বলে।
উঁচু চেয়ারে সওয়ার হয় মৌলানা। চেয়ারের পেছনে লাগানো ইংরেজি ‘টি’ হরফের মত কাঠের স্ট্যান্ডটা কটকট শব্দে ঘাড় পর্যন্ত টেনে তুলে মৌলানার মাংসল গর্দানটা ঠেস দেয় ওতে। তারপর যথারীতি চলতে থাকে কাঁচির ছন্দবদ্ধ আওয়াজ। আয়নায় প্রতিফলিত নিজের চেহারার দিকে নিবিষ্ট দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে মৌলানা। চেহারার নুরানি ভাবটা বেশ কমে এসেছে। বদনের বলিরেখাগুলো এখন স্পষ্ট নজরে পড়ে। মৌলানা বলে, — ‘বুঝলানি নেবা, আল্লাহপাক মানুষরে আগেভাগেই মৌতের সিগনাল দেন...। ইস্টিশান মাস্টারের মত, এই যেমন রেলগাড়ি, মানি হইল গিয়া মৌত আইসা পড়তাছে... হুঁশিয়ার হও, আখেরাতের জন্যি পুঁজিপাট্টা জমাও বান্দারা ...’
নিবারণ মৌলানার তত্ত্বকথার তাৎপর্য বোঝে বলে মনে হয় না। তবুও সম্মতির ভঙ্গিতে মাথা নাড়ে।
‘মৌতের আগে চুলদাড়ি পাকে, চামড়া ঢিলা হইয়া আসে, চোখের জ্যুতি কমতে থাকে, দাঁত পড়তে থাকে, আর তোমারে বলতে অসুবিধা নাই, মর্দামি ক্ষেমতাও কমতে থাকে... এই গুলাই হইল গিয়া সিগনাল, বুঝলানি ?’
‘হ, হুজুর। কিন্তু যারা কম বয়সে মরে ?’ বোকা বোকা ভাব নিয়ে নিবারণ জানতে চায়।
‘থাউক, ওইসব কথা থাউক। তুমি বুঝবা না ...’ থেমে থেমে বলে মৌলানা, — ‘তয় যে কথা কইতেছিলাম, চাটগাঁ বল আর ঢাকাই বল যাতোয়াত তো আছে সবখানেই, চুলদাড়ি কাটাইতে কিন্তু তোমারে ছাড়া চলে না আমার ... হে... হে... হে...।’ চালকুমড়োর বিঁচির মত একসারি দাঁত বের করে হেসে ওঠে মৌলানা। ওয়াজ নসিহতে যত যাই বলুক এমনিতে লোকটা উদার এবং অমায়িক।
আবার অবসর। মৌলানার কথাগুলো মনে আসে, মর্দামি ক্ষেমতা। প্যাট আর চ্যাটের জন্যিই তো বাঁইচা থাহে সবাই; মানুষ, জন্তু জানোয়ার সবাই — ভাবে নিবারণ, কত বচ্ছর, কত বচ্ছর গোনাগুনতি নাই, কোনও মেয়ামানুষের শরীলের স্বাদ পাই না। ওর বামহাতটা উরুসন্ধির কাছে ছোট একটা অঙ্গকে খোঁজে। তারপর মুখ বিকৃত করে দাঁতে দাঁত চেপে উচ্চারণ করে, — ‘জীবনডা শ্যাশ। দ্যাখতে দ্যাখতে জীবনডা শ্যাশ হয়া গেল গা আমার...!’ খুব তেষ্টা পেয়েছে নিবারণের। কোনার টেবিলের ওপর রাখা প্লাস্টিকের জগ থেকে জল ঢেলে খায়। ওয়াক্, কী বিস্বাদ আর গরম! জল তো নয় যেন গরুর চোনা! কিন্তু উপায় কী, ও-ই খেতে হবে। শরীরকষা ভাবটা দূর করতে হলে বেশি বেশি জল খেতে হবে, ‘করুণাময়ী ফার্মেসী’র নিতাই বাবু তাই বলেছেন। নিজ বাড়িতে, কাজ শেষে ক্লান্ত শরীরে ফিরে এলে ঝকঝকে কাঁসার গেলাসে সুশীতল জল এনে সম্মুখে ধরত দুর্গা— ‘দুগ্গা, মা দুগ্গা আমার’... নিঃশব্দে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে নিবারণ। উষ্ণ দীর্ঘশ্বাস মিশে যায় বলকানো বাতাসের সাথে। হু হু করে ওঠে বুকের ভেতরটা।
রাস্তার ওপর মরীচিকার নাচন এখন কিছুটা থিতিয়ে এসেছে। একটু ছায়া ছায়া ভাব। নিবারণ তাকায় আকাশের পানে। ঈশান কোণে কালো মেঘের বিশাল এক চাঁই। জোর বাতাস না দিলে, চাই কি ঠাকুরের কৃপায় ভাল একচোট বর্ষণ হতেও পারে। আকাশের দিকে তাকিয়ে দু’কর কপালে ঠেকিয়ে বিড়বিড় করে কী যেন বলে নিবারণ। আবার চেয়ারে এসে বসে। এবার একটু চাঙ্গা বোধ করছে। মনে পড়ে, দুর্গার বয়স তখন বারো। দুর্গা প্রতিমার মতই দুধে আলতা রং ছিল মেয়েটির। ঢকডিলও ছিল চোখে লাগার মত। দিঘল কালো চুল কোমরের নিচে এসে গড়াত। আত্মীয়স্বজন আর পরিচিতজনেরা আদর করে ডাকত ‘মা দুগ্গা’। ঠাট্টা করে অনেকে বলত, — ‘তুই শালা তো কালা ভূত, বৌ-ও তো তত ধলা আছিল না, এই মেয়া পাইলি কই? ’
বাড়ির দাওয়ায় সুন্দর করে বাঁধানো তুলসীতলায় প্রতিসন্ধ্যায় দুর্গা কী মিষ্টি গলায় আরতি করত আর ধূপধুনো দিত। ধূপের শুভ্র গাঢ় ধোঁয়া বাতাসে দোল খেত আর কেমন মন-পাগল-করা সুবাসে ম-ম করত বাড়ির আঙ্গিনা। ছোট্ট বাড়িটাকে, এতটুকুন মেয়ে একহাতে ছিমছাম করে রাখত। উঠান নিকানো থেকে শুরু করে বিছানাপত্তর, ছোট্ট পড়ার টেবিল, সব পরিপাটি গোছগাছ। পিসি তো বয়সের ভারে ন্যুব্জ; রান্নাবান্নার কাজটাই শুধু সারত কোনওমতে। দীর্ঘদিন কালাজ্বরে ভুগে মারা গেল সেই পিসিও। তারপর থেকে দুর্গাকে দেখবার নিবারণ ছাড়া আর কেউই রইল না। মেয়ে বড় হয়েছে, প্রতিবেশীরা সুযোগ পেলেই স্মরণ করিয়ে দেয়, — ‘তয় নেবারন আর কত দিন? বিয়ার বয়স তো পার হয়া যাতিছে, মেয়া কি আইবুড়া রাখবা?’
নিবারণ আমল দিত না ওদের কথায়, বলত, — ‘আমার দুগ্গাতো আর যে-সে মেয়া না, আমি ওরে উচ্চ শিক্ষিত্ করব, অহন তো সবে ইসকুলে...’
মুখ বেঁকিয়ে তাচ্ছিল্যের সুরে মন্তব্য করত কেউ, — ‘হুঁ, উচ্চ শিক্ষিত্! বামনের চান্দ ছোঁয়ার শখ! নাপিতের মেয়া জজ ব্যালিস্টার হবি ...।’ কেউ আবার মমত্বমেশান সুরে পরামর্শ দিত, — ‘তা দুগ্গা মা আমাগের রূপেগুণে লাখে এক, এ কথা না মাইনা উপায় নাই, কিন্তু যা দিনকাল পড়ছে নেবারন, দ্যাশের যা অবস্থা! বিষয়টা ভাইবা দেহ একবার।’
নিবারণের কপালে ভাঁজ পড়ত। সমস্যাটা নিয়ে যে ও ভাবে না তা নয়। কিন্তু কী করা যায়, ভেবে কূল পায় না। পিসি যতদিন ছিল, দুশ্চিন্তা ছিল না। পিসি মারা যাবার পর আর কাউকে এনে বাড়িতে বসাবার ভরসা পায়নি ও। আবার মেয়েটা একা একা খালি বাড়িতে থাকে তাও ভালো লাগে না। কী করবে? নিজে দোকানে না থাকলেও চলে না। মাথা ঝাঁকি দিয়ে দুশ্চিন্তা ঝেড়ে ফেলতে চায়, — বেশ তো চলতিছে, ঠাকুর সহায় থাকলি এবাই চলবি। কিন্তু ঝেড়ে ফেলতে চাইলেই কি দুশ্চিন্তার ছারপোকারা হুল ফোটানো বন্ধ রাখে?
যত বড় আশাই দুর্গাকে নিয়ে করুক, এভাবে তো চলে না। কী করা যায় তাহলে? রামনগর গাঁয়ের অজিত দাশের ছেলের সাথে যে প্রস্তাবটা এসেছে তাতে কি রাজি হবে? ছেলেটি ভালোই, লেখাপড়া-জানা। ডেমরা তহশিল আফিসে কী যেন কাজ করে। আয় রোজগার কম নয়। উপরিও আছে ভালোই। মেয়ে তার সুখেই থাকবে। অজিতের সন্তান বলতে ওই এক ছেলে। যৌতুকের দাবিও নেই, সামাজিকতা রক্ষা করলেই হল। বিষয়টা নিয়ে খুব ভেবেছিল নিবারণ এবং শেষমেশ সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেলেছিল বলা চলে। মনকে বুঝ দিয়েছিল, — গরিবের অনেক বিপদ গো, বেশি আশা করা গরিবের মানায় না। ভগমানই তো জাতপাত ধনী-গরিব ছিষ্টি করিছেন, আমরা কি বদলাতি পারি তার বিধান?
দেখতে দেখতে সারা আকাশ ছেয়ে গেছে কালো মেঘে। দক্ষিণ কোণে লালচে আভা। অন্ধকার হয়ে এসেছে বিকেল না গড়াতেই। বাতাস বইছে এলোমেলো। আর বাতাসে শীতল পরশ। বাদল নামবে আজ তাহলে। হাঁফ ছাড়ে নিবারণ। কিন্তু পরক্ষণে নিজের অজান্তেই কেঁপে ওঠে বুক — কুঁকড়ে ওঠে সে। আজ থেকে পনের বছর আগে এক ঝড়ো দিনই নিবারণের জীবনের সবকিছু তছনছ করে দিয়েছিল। সে দিনের কথা ভাবলে এখনও দম বন্ধ হয়ে আসতে চায়। সেলুন থেকে গিয়েছিল এক বন্ধুর বাড়ি খুব জরুরি কাজে। ওখান থেকে বেশ দেরি করেই কোনওমতে বাড়ি ফিরেছিল কাকভেজা হয়ে। পৌঁছে দেখে ঘরের দুয়ার লাগানো। ছাঁৎ করে উঠেছিল বুকের ভেতরটা, এ সময় তো দুর্গা ঘরেতেই থাকে। গলা ছেড়ে ডাক দিয়েছিল দুর্গার নাম ধরে। কিন্তু নাহ্, কোনও সাড়া পায়নি। পাশের বাড়ির মকবুল ছলছল চোখে যা বলেছিল তা সংক্ষেপে এ রকম, দুর্গা পড়ে ছিল পাটক্ষেতের ভেতর, অচেতন রক্তাক্ত অবস্থায়। অনেক খোঁজাখুঁজি করেও নিবারণকে না পেয়ে অগত্যা লোকজন ভ্যানগাড়ি করে পৌঁছে দিয়েছে থানা হাসপাতালে। অবস্থা সুবিধার নয়। কথাগুলো যেন ঠিকমত বুঝতে পারছিল না নিবারণ। পাথরের মূর্তির মত ঠায় দাঁড়িয়ে ছিল বেশ কিছুক্ষণ। মাথার ভেতর শোঁ শোঁ শব্দ হচ্ছিল।
হাসপাতালের বেডে নিস্পন্দ পড়ে আছে দুর্গা। তখনও শরীরের কোথাও কোথাও কাদামাটি লেগে আছে। চাপ চাপ তাজা রক্তে ভিজে গেছে বিছানা। ‘মা দুগ্গা... আমার সোনামনি।’ বুকফাটা আর্তনাদ করে মূর্ছা যায় নিবারণ।
দুর্গার মৃত্যুর পর বেশ ক’মাস উন্মাদের মত ছিল নিবারণ। সেলুন বন্ধ। বাড়ির দাওয়ায় তুলসীতলায় একা একা ঘুরে বেড়ানো আর আপনমনে বিড়বিড় করে কীসব বলা — এই ছিল কাজ। তারপর একসময় নিরুদ্দেশ — নিজ গ্রামের সব মায়া ত্যাগ করে নিরুদ্দেশ। বন্ধু মকবুলের মুখ থেকে-শোনা একটা নাম গেঁথে নিয়েছিল মনের ভেতর। মকবুলকে দুর্গা বলেছিল নামটা — অবিনাশ। রমাপদ কুণ্ডুর সেজো ছেলে অবিনাশ কুণ্ডু। বাজারে ওদের শাড়ি আর রেডিমেড পোশাকের দোকান। ছেলেটাকে ভালোবাসত নিবারণ। একবার, যখন ওর বয়স দশ কি বারো, পা হড়কে পড়ে গিয়ে সিঁড়ির কোনায় মাথা ঠুকে কেটে গিয়েছিল কপালের বাম দিকটা। ও-ই পাঁজাকোলা করে নিয়ে গিয়েছিল ডাক্তারের কাছে। ওদের দোকান থেকেই কেনাকাটা করত নিবারণ। মাঝেমধ্যে দুর্গাকেও নিয়ে যেত জামাকাপড় কিনে দিতে।
গ্রাম থেকে চলে আসার পর ঘুরেছে কত জায়গা। একটি বারের জন্যও যদি দেখা মেলে অবিনাশের। জীবনে আর কিছুই তো পাওয়ার নেই। কিন্তু নাহ্, কোনও হদিস মেলেনি। জমানো টাকাকড়ি যা ছিল শেষ করেছে ঘুরে বেড়িয়ে। তারপর যখন প্রায় শূন্যহস্ত, দ্বারেদ্বারে ঢু মেরেছে একটা কাজের খোঁজে। কাজ জানার মধ্যে তো ওই একটাই — নাপিতের কাজ। শেষমেশ কাজ জোটে সফদর মিয়ার সেলুনে।
‘কি লাখান আছইন দাদা?’ খালিক মিয়ার উচ্চস্বর নিবারণের অতীত চিন্তায় ছেদ ঘটায়।
খালিক মিয়া সিলেটের লোক। এ অঞ্চলে সিলেটি খুব একটা দেখা যায় না। সরকারি আফিসে কেরানির চাকরি করে মোহাম্মদ আব্দুল খালিক। সেলুনের পাশ দিয়ে যে গলিটা এঁকেবেঁকে চলে গেছে মেথরপট্টির দিকে, তার মাঝপথে ওর বাসা।
‘ঠাকুরের ইচ্ছা, ভালোই।’ শরীরটা যে খুব একটা ভালো নেই সে কথা তুললে অনেক প্যাচাল পাড়তে হবে, তাই এভাবে বলে নিবারণ ।
‘চুল খাটা দরখার, খুব লম্বা অই গেছে...’ মাথায় আঙ্গুল চালাতে চালাতে বলে খালিক।
নড়েচড়ে উঠে চুল কাটার জোগাড়যন্তরে লেগে পড়ে নিবারণ।
‘বুজলাইন নি দাদা, ফুয়াডা ইবারও ফরীক্ষাত্ ফেইল খরল । ছুটো চাখরি খরি, খিতা খরতাম বুজতাম ফাররাম না...’ ফোঁস করে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে খালিক।
‘কী আর করবেন, আইজকাইলকার ছাওয়ালপানরা পড়াশুনায় মন দেয় না, বাপমা’র কষ্ট বুঝে না। তা জানেন সাব, আমার মেয়া দুগ্গা কেলাসে পরথম অইয়া পাশ করত সবসময়। কিন্তু...’
‘চুল খুব ছুটো খরিয়া খাঠইন, যে গরম ফড়ছে...। হাছা কতা অইল গিয়া ফুয়াডারে তার মায়ে আদর দিয়া দিয়া মাথা খাইছোইন...’
কাঁচি চালাতে চালাতে নিবারণ বলে, — ‘আমার মা দুগ্গা খালি পড়াশুনা না, সব দিক দিয়াই আছিল...।’ নিবারণকে কথা শেষ করতে না দিয়ে খালিক মিয়া বলে ওঠে, — ‘দ্যাখতে দ্যাখতে চুল ফাকি গেল... কলফ খরতাম, কিন্তু ফকেটো অখন ফয়সা নাই!’
নিবারণ ভাবে, বলবে, কলপ করে দেই, পয়সা পরে দিলেও চলবে; আবার ভাবে, খালিক মিয়া যত সদালাপী আর ভালোমানুষই হোক না কেন বাকি করলে ফেরত দেওয়ার নাম করে না।
চুল কাটা শেষ হয়। খালিক মিয়া চলে যাওয়ার পর আবার অবসর। নিবারণ ভাবতে চেষ্টা করে, দুর্গা বেঁচে থাকলে এখন ওর বয়স কত হত। সাতাশ-আটাশ? সাতাশ-আটাশ বছরের এক গিন্নী হিসাবে দুর্গাকে কেমন দেখাত — কল্পনা করতে চেষ্টা করে নিবারণ। জীবনের ঘটনাগুলো কী অদ্ভুতভাবেই না ঘটে! কতক্ষণ চিন্তায় ডুবে ছিল খেয়াল নেই; হঠাৎ পায়ের শব্দে চোখ তুলে তাকায়। মাঝবয়সী এক লোক সেলুনের দরজায় দাঁড়িয়ে। দেখে বোঝা যায় ঝড়ের তাড়া খেয়ে ঢুকে পড়েছে এখানটায়। হাতে-ধরা দামি সিগারেটে লম্বা দুটো টান দিয়ে গোড়াটা দু’আঙ্গুলের টোকায় বাইরে ছুড়ে ফেলে। মাথাটা জোরে ঝাঁকি দিয়ে সোজা এসে বসে গদি-আঁটা উঁচু চেয়ারটায়। নিজ মনেই গজ গজ করে, — ‘শালার কী ঝড়রে বাবা, পুরা গায়ে ধুলার আস্তর জইমা গেছে।’মুখ আর নাক দিয়ে এখনও সিগারেটের পাতলা ধোঁয়া বেরোচ্ছে। বেশভূষায় বেশ পরিপাটি। গায়ে ডোরাকাটা শার্ট, পরনে জিন্সের প্যান্ট। দু’কানের ওপর আর ঘাড়ের কাছে কিছু চুল ছাড়া মাথার সম্মুখ থেকে পেছন পর্যন্ত টানা টাক। ফর্সা টাকে টিউব লাইটের আলো পড়ে চিকচিক্ করছে। মুখে কাঁচাপাকা খোঁচাখোঁচা দাড়ি।
নিবারণ হতাশ হয়। টাকমাথা লোক। দাড়ি কাটার কাস্টমার নিশ্চয়ই। একবার ভাবে যদি শুধু দাড়িই কামাতে চায়, সোজা মানা করে দেবে। বলবে, কারিগর নেই, দাড়ি কাটা যাবে না। আবার ভাবে, বসে থাকার চেয়ে দু’পয়সা কামাই করা ভালো। সাদা চাদরে লোকটার গলা থেকে কোল অবধি ঢেকে দেয় সে।
‘কী করবেন, সাব...?’ চিরাচরিত নিয়মে জানতে চায় নিবারণ।
‘কী আবার? শেভ।’ কাটা কাটা জবাব দেয় লোকটি। তারপর গুনগুনিয়ে হিন্দি ছবির চটুল সুর ভাজতে থাকে খোশমেজাজে।
‘বিদেশি কিরিম, না কি দেশি?’ জিজ্ঞেস করে নিবারণ।
‘বিদেশি। নতুন ভাল ব্লেড লাগান ক্ষুরে...।’
বিদেশি শেভিং ক্রিম আঙ্গুলের ডগায় নিয়ে গালের স্থানে স্থানে লাগিয়ে দেয় নিবারণ। তারপর ব্রাশ দিয়ে ফেনা তোলে। আহ্ কী মিষ্টি গন্ধ! নতুন দামি ব্লেড আঙ্গুলের চাপে লম্বালম্বি দু’টুকরো করে খাঁজকাটা ক্ষুরে বসিয়ে আটকে নেয়। একটু অপেক্ষা করে। খানিকটা সময় দিলে দাড়ি নরম হয়; শেভ করে তখন যেমন জুত, কাস্টমারও পায় আরাম।
বাতাসের বেগ হঠাৎই বেজায় জোরালো হয়ে ওঠে। ঘূর্ণিবাতাসে আশপাশের ধুলোবালি, ঝরাপাতা আর যত জঞ্জাল কুণ্ডলী পাকিয়ে হাতির শুঁড়ের মতো ঊর্ধ্বমুখে ওঠে। ঘনঘন বজ্রের শব্দে কানে তালা লাগার যোগাড়। নিবারণ খেউরির কাজ শুরু করে। চিবুকের ওপর থেকে ক্ষুরের আলতো স্পর্শে ক্রিমের শুভ্র ফেনার সাথে উঠে আসে দাড়ি। ধীরে ধীরে মসৃণ হয়ে ওঠে গাল আর ধুতনির কাছটা।
কক্কড় কড়াৎ, খুব কাছেই কোথাও ঠাটা পড়ল বুঝি। বিকট আওয়াজ আর সেই সাথে চোখ ধাঁধানো আলোর ঝলকানি। চমকে ওঠে নিবারণ! সম্মুখে বসে-থাকা লোকটার মুখ খুব চেনা চেনা ঠেকে। পনের বছরে অনেক বদলেছে, তবুও চোখ, ঠোঁট, নাক আর কপালের বাম দিকটার বেশ বড় কাটা দাগটা এখনও তেমনি রয়েছে। ক্ষুর চালাতে চালাতেই হাত কেঁপে ওঠে ওর।
‘আরে আরে লাগতিছে যে, কাইটা যাবি তো...।’ ঠোঁট ঈষৎ ফাঁক করে নাকি সুরে বলে ওঠে লোকটা।
নিবারণ নির্বিকার।
বাইরে আকাশ গলে মুষলধারে বৃষ্টি শুরু হয়েছে। সে কী বৃষ্টি! বজ্রের মুহুর্মুহু ডাক, দমকা বাতাস আর বৃষ্টির শব্দে কথা ভালো শোনা যায় না। নিবারণ আবার ভালো করে তাকায় লোকটার দিকে। ভুল হচ্ছে না তো! পনের বছর যাকে খুঁজছে, খুঁজে বেড়াচ্ছে, সে-ই কি সত্যি বসে ওর সম্মুখে?
বুকের ভেতর এখন ওর ঝড়ের তাণ্ডব — হৃৎপিণ্ডের ভয়ঙ্কর দাপাদাপি। প্রবল ইচ্ছাশক্তির জোরে স্বাভাবিক রাখতে চেষ্টা করে নিজেকে। সহজ গলায় জিজ্ঞেস করে, — ‘সাব বুঝি নতুন এই শহরে...?’
ফের ঠোঁট সামান্য ফাঁক করে বাঁধো বাঁধো গলায় বলে লোকটি, — ‘উহুঁ, কাপড়ের ব্যবসা আছে, এখান থাইকা শাড়ি নিতে আসি...।’
‘এর আগে দেহি নাই তো, তাই...’
‘দ্যাশের বাইরে আছিলাম অনেক বচ্ছর...।’ লোকটার কথায় একটু গর্বের ছোঁয়া।
নিবারণ আবার প্রশ্ন করে, — ‘ব্যবসা কি ভাইংড়া বাজারে....?’
বিস্ময় ঝরে পড়ে লোকটার গলা থেকে, — ‘হুঁ, তা আপনি জানলেন ক্যামনে...?’
স্মিত হাসির রেখা ফুটে ওঠে নিবারণের ঠোঁটে, — ‘অ্যামনেই বললাম আর কি, রমাপদ কি বাঁইচা আছে, না মারা গেছে...?’
সচকিত হয়ে ওঠে লোকটি, মিনমিনে গলায় বলে, — ‘মারা গেছে। আপনার পরিচয়...?’
রহস্য মেশানো স্বরে জবাব দেয় নিবারণ, — ‘আমারে চিনবেন না...।’
লোকটি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে এবার তাকায় নিবারণের দিকে। সারা মুখে দাড়ি-গোঁফ থাকলেও, আর চেহারায় বয়সের ছাপ পড়লেও মনে হয় চিনতে পারছে ওকে, নিবারণ শীল না?
চেয়ার ছেড়ে উঠতে নেয় লোকটা। ভীষণ আতঙ্কে ওর সারা মুখ ফ্যাকাসে হয়ে পড়েছে।
নিবারণ ওর কাঁধে আলতো চাপ দিয়ে বলে, — ‘লড়াচড়া কইরেন না, ক্ষুরটায় খুব ধার, অজ্জিনাল বিদেশি ব্লেড ...!’
নিশিতে পাওয়া লোকের মত নিশ্চল বসে থাকে লোকটা। ওর চোখ নিবারণের দিকে স্থির।
নিবারণ চেয়ারটা খানিক বাম পাশে ঘুরিয়ে লোকটার দৃষ্টি আয়না থেকে সরিয়ে দেয়।
বামহাত দিয়ে লোকটার চিবুক ওপর দিকে ঠেলে ধরে নিবারণ। আহ্ কী মসৃণ বাইন মাছের মত গলা! থুতনি থেকে ক্ষুরটা ধীরে ধীরে নেমে আসে কণ্ঠনালীর খাঁজের কাছে। ঈষৎ কাত-হওয়া ক্ষুরটা ক্রমশ খাড়া হয়ে ওঠে। উত্তেজনায় নিবারণের হাত কাঁপতে থাকে। কেঁচোর মত কিলবিল-করা হাতের শিরাগুলো ফুলে ওঠে — নিবারণের কালো ঠোঁটের ফাঁক গলিয়ে বেরিয়ে আসে অনুচ্চ অথচ কর্কশ একটি শব্দ, ‘অ-বি-না-শ’। তারপর ভারি একটা দেহসহ রিভলভিং চেয়ারটা একঝটকায় ঘুরিয়ে আবার আয়নামুখো করে দেয়। সামনের আয়নায় উজ্জ্বল লাল রঙের সুন্দর রেখাগুলো এঁকেবেঁকে গড়িয়ে পড়তে থাকে, আর অপরূপ এক আল্পনা আঁকা হতে থাকে।
———
কৈফিয়ত:
মোপাসঁ’র ‘Vendetta’ গল্পটা পড়ে সেই ৬৫-৬৬ সালের দিকে ভয়াবহ পরিণতির গল্প লেখার সাধ জাগে। তৈরি হয় ‘নিবারণ শীল’—যদিও এখন যেমন দাঁড়িয়েছে ঠিক তেমনটি ছিল না সেসময়। চল্লিশ বছর পর দেশের বহুলপ্রচারিত এক দৈনিকের সাহিত্য-পাতায় মুদ্রিত হয় গল্পটি। তারও অনেক পরে, ২০১৩তে, কী আশ্চর্য! দেখি এধরনের পরিণতির একটি নয়, দুজন লেখকের দুটি গল্প, তাও আবার বিখ্যাত দুই কলম্বিয়ান লেখকের, এরনান্দো তেইয়েস [Hernando Téllez,1908-1966]-এর লেখা `Lather And Nothing Else’ এবং গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস[Gabriel García Márquez,1927-2014]-এর `One Of These Days’ বহু আগেই লেখা হয়ে গেছে। ভাগ্যিস, ওঁদের মধ্যে দ্বিতীয় লেখককে কেউ চোর বলেননি!জানতাম,‘গ্রেট মাইন্ডস থিংক এলাইক’— এখন দেখছি, ‘অ্যাভারেজ মাইন্ডস মে অলসো থিংক লাইক গ্রেটস্!’
‘নিবারণ শীল’-এর শেষের দিককার বর্ণনা, মনে হতে পারে, এরনান্দোর উল্লিখিত গল্পটি থেকে মেরে দেওয়া!
– লেখক।
আগুনঝরা রোদ্দুরে উপুড় হয়ে শুয়ে-থাকা রাস্তার কালো চামড়ায় অসংখ্য ফোসকা — গনগনে তাপে গলে আঠা আঠা। যানবাহন, মানুষজনের চলাচল পাতলা। কিছু কিছু রিকশা আর মটরগাড়ি চাকার চটচট্ শব্দ তুলে এদিক-ওদিক চলাচল করছে। ক্লান্ত ফাঁকা চোখে নিবারণ চেয়ে আছে বাইরের দিকে। রাস্তার ওপারে ডাস্টবিনের ধারে ধ্বস্তাধ্বস্তিরত দুটো নেড়িকুত্তা। মাদিটা লেজ গুটিয়ে প্রাণপণ চেষ্টা করছে ক্ষেপে-ওঠা মদ্দটির অত্যাচার থেকে নিজেকে বাঁচাতে। সাদা চকচকে দুপাটি দাঁত বের করে খেঁকিয়ে উঠছে বারবার। ডাস্টবিন থেকে ভকভক্ ভেসে আসছে উৎকট ঝাঁজালো গন্ধ। কয়েকটা উলঙ্গপ্রায় টোকাই আর্বজনা-স্তূপ থেকে খুঁটে নিচ্ছে ওদের পছন্দের এটা-ওটা। হোটেলের ফেলে-দেওয়া উচ্ছিষ্ট খাবার চেঁচেপুঁছে তুলে নিচ্ছে পলিথিনের ব্যাগে। ভরা জ্যৈষ্ঠ মাস। অথচ সেই কবে ছিটেফোঁটা বৃষ্টি হয়েছিল। এভাবে আর কিছুদিন চললে মানুষ তো না খেয়ে মারা পড়বে। এরই মধ্যে আকালের পদধ্বনি শোনা যেতে শুরু করেছে। ব্যবসার অবস্থাও খুবই মন্দা। জেলা শহর টাঙ্গাইলের একপ্রান্তে মেইন রোডের ধারে মাঝারি ধরনের সেলুন। নামটা কিন্তু খাসা — ‘ডালাস হেয়ার ষ্টাইলিং ষ্টুডিও’! রাজধানী শহরে এক সেলুনের এরকম নাম দেখে শখ করে রেখে দিয়েছিল সফদর আলী। দেওয়ালের গায়ে টাঙানো চুলছাটার হরেক স্টাইলের ছবি। নতুন নতুন অবস্থায় বেশ চলছিল। ধারেকাছে তেমন সেলুন ছিল না তো।এখন তো বেশ ক’টা। তাছাড়া, মনে হয়, লোকের হাতে এখন কাঁচা পয়সারও পড়েছে আকাল। চুল কাটায় আর ক’টাকা; চুলে কলপ, শ্যাম্পু করা, ফেসিয়াল — এগুলোই তো হল লাভের কাজ। লাভের কাজ লাটে উঠেছে অনেকদিন হল। নিবারণ যখন চাকরি নেয় তখন মোট কারিগর ছিল ছ’জন। ঝানু ঝানু সব নরসুন্দর। লোকের ভিড় লেগেই থাকত। তখন পরম সুখে চোখ মুদে কাউন্টারের গদি-আঁটা চেয়ারটায় গা এলিয়ে দিয়ে ক্যাসেটে ফিল্মের হিট গান শুনত আর আঙ্গুল দিয়ে টেবিলের ওপর তাল ঠুকত সফদর মিয়া। সেদিন আর নেই। তবু হতাশ হয় না সফদর, সুদিনের মুখ আবার দেখা যাবে ইনশাল্লাহ্। তাছাড়া ঝানু কারিগর নিবারণ তো আছেই।
প্রচণ্ড গরমে হাঁসফাঁস করছে নিবারণ। ফ্যান চালাবে? নাহ, থাক — কারেন্ট-বিল বেশি এলে সমস্যা। অত্যধিক গরম আর নাওয়া-খাওয়ার অনিয়মে শরীর কষা হয়ে পড়েছে। পেচ্ছাব মাছ-ধোওয়া জলের মত লাল। মাথা ঝিমঝিম করছে বেশ কদিন থেকে। মেজাজটাও চড়া। দু’দিন আগে অন্যমনষ্ক হয়ে শেভ করতে গিয়ে এক কাস্টমারের গাল সামান্য কেটে ফেলেছিল। ধমকে উঠেছিল লোকটা, — ‘অ্যাই মিয়া, ক্ষুর চালান শিখইন নাই নাকি? এইটা কী করলেন, অ্যাঁ?’ অন্যসময় হলে বিনয়ের সাথে মাপ চেয়ে নিত। কিন্তু তখন ঝাঁজালো গলায় বলে উঠেছিল, — ‘আরে সাব, লড়াচড়া করলি গাল তো গাল, গলাও কাটতি পারে... ।’নিজের দোষ ধরতে পেরে অবশ্য পরক্ষণেই মোলায়েম সুরে বলেছিল, — ‘খাড়ান, ফিটকারি লাগায়া দিতাছি, রক্ত বন্দ হয়া যাবিনি।’
নিবারণ কেমন এক ঘোরের মধ্যে ডুবে আছে। রাস্তার দিকে চোখ মেলে রাখলেও কিছু দেখছে বলে মনে হয় না। কে একজন হনহন্ করে হেঁটে যেতে যেতে চেঁচিয়ে বলে ওঠে, — ‘অ নেবারন কাহা, ব্যারামি মুরগির মত ঝুমতাছ ক্যা? কামকাজ নাই বুঝি?’
ভাবলেশহীন একপিণ্ড জড় মাংসের মত চেয়ারটায় বসে থাকে নিবারণ, একটু উবু হয়ে। অবসর ভয়ঙ্কর পীড়া দেয় ওকে। কাজের মধ্যে যতক্ষণ থাকে, সব ভুলে থাকে। কিন্তু কর্মহীন সময় ওকে অতীত স্মৃতির ধূসর অরণ্যে টেনে নিয়ে যায়।
ভাঙ্গুড়া বাজারে একসময় ওর নিজের ছিল ছোট্ট একটা সেলুন। টিনের চাল, টিনের বেড়া। ছোট ছাপরামত ঘরখানা ভাড়া নিয়েছিল বাজারের আড়তদার ফজলু শেখের কাছ থেকে। নিবারণকে পছন্দ করত ফজলু শেখ। সৎ আর নিরীহ স্বভাবের জন্য শুধু ফজলু কেন এলাকার তাবৎ লোকই পছন্দ করত ওকে। ওর হাতে ছিল যাদু। ভাঙ্গুড়া তো ভাঙ্গুড়া, আশপাশের অনেক এলাকাতেই নাম ছড়িয়ে পড়েছিল ওর। চুলে কাঁচি চালানোর সময় খদ্দেরদের তন্দ্রা এসে যেত। ওর হাতে চুল কাটালে চেহারায় কী খোলতাই-ই না আসত। নরসুন্দর তো একেই বলে। দেখতে দেখতেই ব্যবসা জমে উঠল। দু’জন শাগরেদও জুটে গেল। ব্যবসার আয়ের তুলনায় খরচ ছিল কম। খাওয়ার লোক তো মোটে দু’জন। সে আর বৌ হরিদাসী । বিয়ের পর বছর গড়াতে না গড়াতেই হরিদাসী পোয়াতি হল। কোলে এল ফুটফুটে এক মেয়ে। নিবারণের আনন্দ দেখে কে! বাড়িতে যতক্ষণ থাকে, মেয়েটাকে নিয়ে বিচিত্র সব আদরসোহাগে মেতে থাকে। হরিদাসী মাঝেমধ্যে কপট রাগ দেখায়, — ‘মেয়া নিয়া সারাক্ষণ মাইতা থাকলি ব্যবসা চাঙ্গে উঠপিনি, কইলাম কিন্তু, হ...।’ হেসে প্রতিবাদ করে নিবারণ, ‘এই মেয়া আমার অন্নপূর্ণা গো, আমার দুগ্গা মা।’ মেয়ের নাম শেষ পর্যন্ত দুর্গাই স্থির হল। কিন্তু সুখ বেশি দিন টিকল না তার। তিন বছরের মাথায় দ্বিতীয়বার পোয়াতি হল হরিদাসী, আর সন্তান বিয়োবার সময় দুদিন নিদারুণ গব্বযন্তনা ভোগ করে দেহ রাখল। বৌটাকে খুবই ভালোবাসত নিবারণ। খুব ভেঙ্গে পড়েছিল তাই। পরিচিতজনেরা সান্ত্বনা দিয়েছিল, — ‘কী করবা কও নেবারণ, যে গেছে সে তো গেছেই। কচি মেয়াটার দিকে তাকায়া বুকে বল বাঁধো...।’ দিন যায়, ক্রমশ স্বাভাবিক হয়ে ওঠে নিবারণ। আটমাইল দূর থেকে ওর এক বিধবা পিসিকে নিয়ে আসে দুর্গাকে দেখাশোনা করবার জন্য। ক’মাস পেরোতেই কেউ কেউ পরামর্শ দেয় নিখাদ আন্তরিকতা নিয়েই, — ‘যুয়ান বয়স নেবারন, কত দিন আর একলা কাটাবা? আবার একটা কাম কইরা ফালাও, ঘরের লক্ষ্মী ছাড়া কি আর চলে?’ কথার অর্থ যে নিবারণ বোঝে না তা নয়। ঘুমের ভেতর প্রায়ই হরিদাসী আসে, শরীর উদাম করে। ঘুম ভাঙবার পরও অনেকক্ষণ ধরে শরীরের মাঝখানটার বদ্বীপে উষ্ণ স্রোত বয়।
মাঝে মাঝে লোকজনের পরামর্শের কথা নিবারণ যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়ে ভাবে। কিন্তু দুর্গার কথা মনে এলেই ঝেঁটিয়ে দূর করে ওসব ভাবনা। ছিঃ, কী সব ভাবতিছি আমি। ঘরে সৎমা আসলি আমার দুগ্গার কী হবি! তারপর থেকে ওই এতটুকুন মেয়েকে নিয়ে সে একহাতে নাও বেয়ে চলেছিল জীবনের উজান নদীতে। মা মারা যাওয়ার পর দুর্গার দেখাশোনার ভার ছিল ওর পিসির ওপর। বিধবা পিসিরও আপন বলতে কেউ ছিল না তো। দুর্গার বয়স যখন সাত, ইসকুলে ভর্তি করে দিয়েছিল নিবারণ। মেয়েকে অনেক লেখাপড়া শেখাবে, ভগবানের কৃপা হলে বড় অফিসার বানাবে — মেয়েকে নিয়ে কত স্বপ্ন ওর। ছাত্রী হিসেবে দুর্গা তো কম যায় না — ক্লাশে এক নম্বর।
নিবারণের চিন্তার জালে ছেদ পড়ে। ফরসামত প্রৌঢ় এক লোক এসে ঢোকে সেলুনে। মুখে ঘন চাপদাড়ি। মাথায় নকশা-করা গোলটুপি। পায়ের গোড়ালি পর্যন্ত ঝোলানো নস্যিরং পাঞ্জাবি। গা থেকে ভুরভুর করে বেরোচ্ছে আতরের কড়া গন্ধ। কাঁধের ওপর চাপানো হাজিরুমালের কোনা দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে বলে, — ‘আল্লার গজব নাজিল হইছে রে নেবারন। জীবনে এতবড় খরা দেহি নাই। উহ্ , গরমে জানটা কবজ হয়া গেল...’
নিবারণ নিঃশব্দে মাথা নেড়ে তার কথায় সায় দেয়।
‘ভালা কইরা চুল-দাড়ি ছাইটা দিবা, আইজ জামুর্কি মাদ্রাসার নয়া বিল্ডিং উদ্বোধন, কোন মন্ত্রী জানি আসব শুনলাম... দাওয়াত পাইছি, বুঝলানি।’
‘হ, হুজুর, সকাল থাইকা মাইকিং হতিছে…’, নিবারণ বলে।
উঁচু চেয়ারে সওয়ার হয় মৌলানা। চেয়ারের পেছনে লাগানো ইংরেজি ‘টি’ হরফের মত কাঠের স্ট্যান্ডটা কটকট শব্দে ঘাড় পর্যন্ত টেনে তুলে মৌলানার মাংসল গর্দানটা ঠেস দেয় ওতে। তারপর যথারীতি চলতে থাকে কাঁচির ছন্দবদ্ধ আওয়াজ। আয়নায় প্রতিফলিত নিজের চেহারার দিকে নিবিষ্ট দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে মৌলানা। চেহারার নুরানি ভাবটা বেশ কমে এসেছে। বদনের বলিরেখাগুলো এখন স্পষ্ট নজরে পড়ে। মৌলানা বলে, — ‘বুঝলানি নেবা, আল্লাহপাক মানুষরে আগেভাগেই মৌতের সিগনাল দেন...। ইস্টিশান মাস্টারের মত, এই যেমন রেলগাড়ি, মানি হইল গিয়া মৌত আইসা পড়তাছে... হুঁশিয়ার হও, আখেরাতের জন্যি পুঁজিপাট্টা জমাও বান্দারা ...’
নিবারণ মৌলানার তত্ত্বকথার তাৎপর্য বোঝে বলে মনে হয় না। তবুও সম্মতির ভঙ্গিতে মাথা নাড়ে।
‘মৌতের আগে চুলদাড়ি পাকে, চামড়া ঢিলা হইয়া আসে, চোখের জ্যুতি কমতে থাকে, দাঁত পড়তে থাকে, আর তোমারে বলতে অসুবিধা নাই, মর্দামি ক্ষেমতাও কমতে থাকে... এই গুলাই হইল গিয়া সিগনাল, বুঝলানি ?’
‘হ, হুজুর। কিন্তু যারা কম বয়সে মরে ?’ বোকা বোকা ভাব নিয়ে নিবারণ জানতে চায়।
‘থাউক, ওইসব কথা থাউক। তুমি বুঝবা না ...’ থেমে থেমে বলে মৌলানা, — ‘তয় যে কথা কইতেছিলাম, চাটগাঁ বল আর ঢাকাই বল যাতোয়াত তো আছে সবখানেই, চুলদাড়ি কাটাইতে কিন্তু তোমারে ছাড়া চলে না আমার ... হে... হে... হে...।’ চালকুমড়োর বিঁচির মত একসারি দাঁত বের করে হেসে ওঠে মৌলানা। ওয়াজ নসিহতে যত যাই বলুক এমনিতে লোকটা উদার এবং অমায়িক।
আবার অবসর। মৌলানার কথাগুলো মনে আসে, মর্দামি ক্ষেমতা। প্যাট আর চ্যাটের জন্যিই তো বাঁইচা থাহে সবাই; মানুষ, জন্তু জানোয়ার সবাই — ভাবে নিবারণ, কত বচ্ছর, কত বচ্ছর গোনাগুনতি নাই, কোনও মেয়ামানুষের শরীলের স্বাদ পাই না। ওর বামহাতটা উরুসন্ধির কাছে ছোট একটা অঙ্গকে খোঁজে। তারপর মুখ বিকৃত করে দাঁতে দাঁত চেপে উচ্চারণ করে, — ‘জীবনডা শ্যাশ। দ্যাখতে দ্যাখতে জীবনডা শ্যাশ হয়া গেল গা আমার...!’ খুব তেষ্টা পেয়েছে নিবারণের। কোনার টেবিলের ওপর রাখা প্লাস্টিকের জগ থেকে জল ঢেলে খায়। ওয়াক্, কী বিস্বাদ আর গরম! জল তো নয় যেন গরুর চোনা! কিন্তু উপায় কী, ও-ই খেতে হবে। শরীরকষা ভাবটা দূর করতে হলে বেশি বেশি জল খেতে হবে, ‘করুণাময়ী ফার্মেসী’র নিতাই বাবু তাই বলেছেন। নিজ বাড়িতে, কাজ শেষে ক্লান্ত শরীরে ফিরে এলে ঝকঝকে কাঁসার গেলাসে সুশীতল জল এনে সম্মুখে ধরত দুর্গা— ‘দুগ্গা, মা দুগ্গা আমার’... নিঃশব্দে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে নিবারণ। উষ্ণ দীর্ঘশ্বাস মিশে যায় বলকানো বাতাসের সাথে। হু হু করে ওঠে বুকের ভেতরটা।
রাস্তার ওপর মরীচিকার নাচন এখন কিছুটা থিতিয়ে এসেছে। একটু ছায়া ছায়া ভাব। নিবারণ তাকায় আকাশের পানে। ঈশান কোণে কালো মেঘের বিশাল এক চাঁই। জোর বাতাস না দিলে, চাই কি ঠাকুরের কৃপায় ভাল একচোট বর্ষণ হতেও পারে। আকাশের দিকে তাকিয়ে দু’কর কপালে ঠেকিয়ে বিড়বিড় করে কী যেন বলে নিবারণ। আবার চেয়ারে এসে বসে। এবার একটু চাঙ্গা বোধ করছে। মনে পড়ে, দুর্গার বয়স তখন বারো। দুর্গা প্রতিমার মতই দুধে আলতা রং ছিল মেয়েটির। ঢকডিলও ছিল চোখে লাগার মত। দিঘল কালো চুল কোমরের নিচে এসে গড়াত। আত্মীয়স্বজন আর পরিচিতজনেরা আদর করে ডাকত ‘মা দুগ্গা’। ঠাট্টা করে অনেকে বলত, — ‘তুই শালা তো কালা ভূত, বৌ-ও তো তত ধলা আছিল না, এই মেয়া পাইলি কই? ’
বাড়ির দাওয়ায় সুন্দর করে বাঁধানো তুলসীতলায় প্রতিসন্ধ্যায় দুর্গা কী মিষ্টি গলায় আরতি করত আর ধূপধুনো দিত। ধূপের শুভ্র গাঢ় ধোঁয়া বাতাসে দোল খেত আর কেমন মন-পাগল-করা সুবাসে ম-ম করত বাড়ির আঙ্গিনা। ছোট্ট বাড়িটাকে, এতটুকুন মেয়ে একহাতে ছিমছাম করে রাখত। উঠান নিকানো থেকে শুরু করে বিছানাপত্তর, ছোট্ট পড়ার টেবিল, সব পরিপাটি গোছগাছ। পিসি তো বয়সের ভারে ন্যুব্জ; রান্নাবান্নার কাজটাই শুধু সারত কোনওমতে। দীর্ঘদিন কালাজ্বরে ভুগে মারা গেল সেই পিসিও। তারপর থেকে দুর্গাকে দেখবার নিবারণ ছাড়া আর কেউই রইল না। মেয়ে বড় হয়েছে, প্রতিবেশীরা সুযোগ পেলেই স্মরণ করিয়ে দেয়, — ‘তয় নেবারন আর কত দিন? বিয়ার বয়স তো পার হয়া যাতিছে, মেয়া কি আইবুড়া রাখবা?’
নিবারণ আমল দিত না ওদের কথায়, বলত, — ‘আমার দুগ্গাতো আর যে-সে মেয়া না, আমি ওরে উচ্চ শিক্ষিত্ করব, অহন তো সবে ইসকুলে...’
মুখ বেঁকিয়ে তাচ্ছিল্যের সুরে মন্তব্য করত কেউ, — ‘হুঁ, উচ্চ শিক্ষিত্! বামনের চান্দ ছোঁয়ার শখ! নাপিতের মেয়া জজ ব্যালিস্টার হবি ...।’ কেউ আবার মমত্বমেশান সুরে পরামর্শ দিত, — ‘তা দুগ্গা মা আমাগের রূপেগুণে লাখে এক, এ কথা না মাইনা উপায় নাই, কিন্তু যা দিনকাল পড়ছে নেবারন, দ্যাশের যা অবস্থা! বিষয়টা ভাইবা দেহ একবার।’
নিবারণের কপালে ভাঁজ পড়ত। সমস্যাটা নিয়ে যে ও ভাবে না তা নয়। কিন্তু কী করা যায়, ভেবে কূল পায় না। পিসি যতদিন ছিল, দুশ্চিন্তা ছিল না। পিসি মারা যাবার পর আর কাউকে এনে বাড়িতে বসাবার ভরসা পায়নি ও। আবার মেয়েটা একা একা খালি বাড়িতে থাকে তাও ভালো লাগে না। কী করবে? নিজে দোকানে না থাকলেও চলে না। মাথা ঝাঁকি দিয়ে দুশ্চিন্তা ঝেড়ে ফেলতে চায়, — বেশ তো চলতিছে, ঠাকুর সহায় থাকলি এবাই চলবি। কিন্তু ঝেড়ে ফেলতে চাইলেই কি দুশ্চিন্তার ছারপোকারা হুল ফোটানো বন্ধ রাখে?
যত বড় আশাই দুর্গাকে নিয়ে করুক, এভাবে তো চলে না। কী করা যায় তাহলে? রামনগর গাঁয়ের অজিত দাশের ছেলের সাথে যে প্রস্তাবটা এসেছে তাতে কি রাজি হবে? ছেলেটি ভালোই, লেখাপড়া-জানা। ডেমরা তহশিল আফিসে কী যেন কাজ করে। আয় রোজগার কম নয়। উপরিও আছে ভালোই। মেয়ে তার সুখেই থাকবে। অজিতের সন্তান বলতে ওই এক ছেলে। যৌতুকের দাবিও নেই, সামাজিকতা রক্ষা করলেই হল। বিষয়টা নিয়ে খুব ভেবেছিল নিবারণ এবং শেষমেশ সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেলেছিল বলা চলে। মনকে বুঝ দিয়েছিল, — গরিবের অনেক বিপদ গো, বেশি আশা করা গরিবের মানায় না। ভগমানই তো জাতপাত ধনী-গরিব ছিষ্টি করিছেন, আমরা কি বদলাতি পারি তার বিধান?
দেখতে দেখতে সারা আকাশ ছেয়ে গেছে কালো মেঘে। দক্ষিণ কোণে লালচে আভা। অন্ধকার হয়ে এসেছে বিকেল না গড়াতেই। বাতাস বইছে এলোমেলো। আর বাতাসে শীতল পরশ। বাদল নামবে আজ তাহলে। হাঁফ ছাড়ে নিবারণ। কিন্তু পরক্ষণে নিজের অজান্তেই কেঁপে ওঠে বুক — কুঁকড়ে ওঠে সে। আজ থেকে পনের বছর আগে এক ঝড়ো দিনই নিবারণের জীবনের সবকিছু তছনছ করে দিয়েছিল। সে দিনের কথা ভাবলে এখনও দম বন্ধ হয়ে আসতে চায়। সেলুন থেকে গিয়েছিল এক বন্ধুর বাড়ি খুব জরুরি কাজে। ওখান থেকে বেশ দেরি করেই কোনওমতে বাড়ি ফিরেছিল কাকভেজা হয়ে। পৌঁছে দেখে ঘরের দুয়ার লাগানো। ছাঁৎ করে উঠেছিল বুকের ভেতরটা, এ সময় তো দুর্গা ঘরেতেই থাকে। গলা ছেড়ে ডাক দিয়েছিল দুর্গার নাম ধরে। কিন্তু নাহ্, কোনও সাড়া পায়নি। পাশের বাড়ির মকবুল ছলছল চোখে যা বলেছিল তা সংক্ষেপে এ রকম, দুর্গা পড়ে ছিল পাটক্ষেতের ভেতর, অচেতন রক্তাক্ত অবস্থায়। অনেক খোঁজাখুঁজি করেও নিবারণকে না পেয়ে অগত্যা লোকজন ভ্যানগাড়ি করে পৌঁছে দিয়েছে থানা হাসপাতালে। অবস্থা সুবিধার নয়। কথাগুলো যেন ঠিকমত বুঝতে পারছিল না নিবারণ। পাথরের মূর্তির মত ঠায় দাঁড়িয়ে ছিল বেশ কিছুক্ষণ। মাথার ভেতর শোঁ শোঁ শব্দ হচ্ছিল।
হাসপাতালের বেডে নিস্পন্দ পড়ে আছে দুর্গা। তখনও শরীরের কোথাও কোথাও কাদামাটি লেগে আছে। চাপ চাপ তাজা রক্তে ভিজে গেছে বিছানা। ‘মা দুগ্গা... আমার সোনামনি।’ বুকফাটা আর্তনাদ করে মূর্ছা যায় নিবারণ।
দুর্গার মৃত্যুর পর বেশ ক’মাস উন্মাদের মত ছিল নিবারণ। সেলুন বন্ধ। বাড়ির দাওয়ায় তুলসীতলায় একা একা ঘুরে বেড়ানো আর আপনমনে বিড়বিড় করে কীসব বলা — এই ছিল কাজ। তারপর একসময় নিরুদ্দেশ — নিজ গ্রামের সব মায়া ত্যাগ করে নিরুদ্দেশ। বন্ধু মকবুলের মুখ থেকে-শোনা একটা নাম গেঁথে নিয়েছিল মনের ভেতর। মকবুলকে দুর্গা বলেছিল নামটা — অবিনাশ। রমাপদ কুণ্ডুর সেজো ছেলে অবিনাশ কুণ্ডু। বাজারে ওদের শাড়ি আর রেডিমেড পোশাকের দোকান। ছেলেটাকে ভালোবাসত নিবারণ। একবার, যখন ওর বয়স দশ কি বারো, পা হড়কে পড়ে গিয়ে সিঁড়ির কোনায় মাথা ঠুকে কেটে গিয়েছিল কপালের বাম দিকটা। ও-ই পাঁজাকোলা করে নিয়ে গিয়েছিল ডাক্তারের কাছে। ওদের দোকান থেকেই কেনাকাটা করত নিবারণ। মাঝেমধ্যে দুর্গাকেও নিয়ে যেত জামাকাপড় কিনে দিতে।
গ্রাম থেকে চলে আসার পর ঘুরেছে কত জায়গা। একটি বারের জন্যও যদি দেখা মেলে অবিনাশের। জীবনে আর কিছুই তো পাওয়ার নেই। কিন্তু নাহ্, কোনও হদিস মেলেনি। জমানো টাকাকড়ি যা ছিল শেষ করেছে ঘুরে বেড়িয়ে। তারপর যখন প্রায় শূন্যহস্ত, দ্বারেদ্বারে ঢু মেরেছে একটা কাজের খোঁজে। কাজ জানার মধ্যে তো ওই একটাই — নাপিতের কাজ। শেষমেশ কাজ জোটে সফদর মিয়ার সেলুনে।
‘কি লাখান আছইন দাদা?’ খালিক মিয়ার উচ্চস্বর নিবারণের অতীত চিন্তায় ছেদ ঘটায়।
খালিক মিয়া সিলেটের লোক। এ অঞ্চলে সিলেটি খুব একটা দেখা যায় না। সরকারি আফিসে কেরানির চাকরি করে মোহাম্মদ আব্দুল খালিক। সেলুনের পাশ দিয়ে যে গলিটা এঁকেবেঁকে চলে গেছে মেথরপট্টির দিকে, তার মাঝপথে ওর বাসা।
‘ঠাকুরের ইচ্ছা, ভালোই।’ শরীরটা যে খুব একটা ভালো নেই সে কথা তুললে অনেক প্যাচাল পাড়তে হবে, তাই এভাবে বলে নিবারণ ।
‘চুল খাটা দরখার, খুব লম্বা অই গেছে...’ মাথায় আঙ্গুল চালাতে চালাতে বলে খালিক।
নড়েচড়ে উঠে চুল কাটার জোগাড়যন্তরে লেগে পড়ে নিবারণ।
‘বুজলাইন নি দাদা, ফুয়াডা ইবারও ফরীক্ষাত্ ফেইল খরল । ছুটো চাখরি খরি, খিতা খরতাম বুজতাম ফাররাম না...’ ফোঁস করে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে খালিক।
‘কী আর করবেন, আইজকাইলকার ছাওয়ালপানরা পড়াশুনায় মন দেয় না, বাপমা’র কষ্ট বুঝে না। তা জানেন সাব, আমার মেয়া দুগ্গা কেলাসে পরথম অইয়া পাশ করত সবসময়। কিন্তু...’
‘চুল খুব ছুটো খরিয়া খাঠইন, যে গরম ফড়ছে...। হাছা কতা অইল গিয়া ফুয়াডারে তার মায়ে আদর দিয়া দিয়া মাথা খাইছোইন...’
কাঁচি চালাতে চালাতে নিবারণ বলে, — ‘আমার মা দুগ্গা খালি পড়াশুনা না, সব দিক দিয়াই আছিল...।’ নিবারণকে কথা শেষ করতে না দিয়ে খালিক মিয়া বলে ওঠে, — ‘দ্যাখতে দ্যাখতে চুল ফাকি গেল... কলফ খরতাম, কিন্তু ফকেটো অখন ফয়সা নাই!’
নিবারণ ভাবে, বলবে, কলপ করে দেই, পয়সা পরে দিলেও চলবে; আবার ভাবে, খালিক মিয়া যত সদালাপী আর ভালোমানুষই হোক না কেন বাকি করলে ফেরত দেওয়ার নাম করে না।
চুল কাটা শেষ হয়। খালিক মিয়া চলে যাওয়ার পর আবার অবসর। নিবারণ ভাবতে চেষ্টা করে, দুর্গা বেঁচে থাকলে এখন ওর বয়স কত হত। সাতাশ-আটাশ? সাতাশ-আটাশ বছরের এক গিন্নী হিসাবে দুর্গাকে কেমন দেখাত — কল্পনা করতে চেষ্টা করে নিবারণ। জীবনের ঘটনাগুলো কী অদ্ভুতভাবেই না ঘটে! কতক্ষণ চিন্তায় ডুবে ছিল খেয়াল নেই; হঠাৎ পায়ের শব্দে চোখ তুলে তাকায়। মাঝবয়সী এক লোক সেলুনের দরজায় দাঁড়িয়ে। দেখে বোঝা যায় ঝড়ের তাড়া খেয়ে ঢুকে পড়েছে এখানটায়। হাতে-ধরা দামি সিগারেটে লম্বা দুটো টান দিয়ে গোড়াটা দু’আঙ্গুলের টোকায় বাইরে ছুড়ে ফেলে। মাথাটা জোরে ঝাঁকি দিয়ে সোজা এসে বসে গদি-আঁটা উঁচু চেয়ারটায়। নিজ মনেই গজ গজ করে, — ‘শালার কী ঝড়রে বাবা, পুরা গায়ে ধুলার আস্তর জইমা গেছে।’মুখ আর নাক দিয়ে এখনও সিগারেটের পাতলা ধোঁয়া বেরোচ্ছে। বেশভূষায় বেশ পরিপাটি। গায়ে ডোরাকাটা শার্ট, পরনে জিন্সের প্যান্ট। দু’কানের ওপর আর ঘাড়ের কাছে কিছু চুল ছাড়া মাথার সম্মুখ থেকে পেছন পর্যন্ত টানা টাক। ফর্সা টাকে টিউব লাইটের আলো পড়ে চিকচিক্ করছে। মুখে কাঁচাপাকা খোঁচাখোঁচা দাড়ি।
নিবারণ হতাশ হয়। টাকমাথা লোক। দাড়ি কাটার কাস্টমার নিশ্চয়ই। একবার ভাবে যদি শুধু দাড়িই কামাতে চায়, সোজা মানা করে দেবে। বলবে, কারিগর নেই, দাড়ি কাটা যাবে না। আবার ভাবে, বসে থাকার চেয়ে দু’পয়সা কামাই করা ভালো। সাদা চাদরে লোকটার গলা থেকে কোল অবধি ঢেকে দেয় সে।
‘কী করবেন, সাব...?’ চিরাচরিত নিয়মে জানতে চায় নিবারণ।
‘কী আবার? শেভ।’ কাটা কাটা জবাব দেয় লোকটি। তারপর গুনগুনিয়ে হিন্দি ছবির চটুল সুর ভাজতে থাকে খোশমেজাজে।
‘বিদেশি কিরিম, না কি দেশি?’ জিজ্ঞেস করে নিবারণ।
‘বিদেশি। নতুন ভাল ব্লেড লাগান ক্ষুরে...।’
বিদেশি শেভিং ক্রিম আঙ্গুলের ডগায় নিয়ে গালের স্থানে স্থানে লাগিয়ে দেয় নিবারণ। তারপর ব্রাশ দিয়ে ফেনা তোলে। আহ্ কী মিষ্টি গন্ধ! নতুন দামি ব্লেড আঙ্গুলের চাপে লম্বালম্বি দু’টুকরো করে খাঁজকাটা ক্ষুরে বসিয়ে আটকে নেয়। একটু অপেক্ষা করে। খানিকটা সময় দিলে দাড়ি নরম হয়; শেভ করে তখন যেমন জুত, কাস্টমারও পায় আরাম।
বাতাসের বেগ হঠাৎই বেজায় জোরালো হয়ে ওঠে। ঘূর্ণিবাতাসে আশপাশের ধুলোবালি, ঝরাপাতা আর যত জঞ্জাল কুণ্ডলী পাকিয়ে হাতির শুঁড়ের মতো ঊর্ধ্বমুখে ওঠে। ঘনঘন বজ্রের শব্দে কানে তালা লাগার যোগাড়। নিবারণ খেউরির কাজ শুরু করে। চিবুকের ওপর থেকে ক্ষুরের আলতো স্পর্শে ক্রিমের শুভ্র ফেনার সাথে উঠে আসে দাড়ি। ধীরে ধীরে মসৃণ হয়ে ওঠে গাল আর ধুতনির কাছটা।
কক্কড় কড়াৎ, খুব কাছেই কোথাও ঠাটা পড়ল বুঝি। বিকট আওয়াজ আর সেই সাথে চোখ ধাঁধানো আলোর ঝলকানি। চমকে ওঠে নিবারণ! সম্মুখে বসে-থাকা লোকটার মুখ খুব চেনা চেনা ঠেকে। পনের বছরে অনেক বদলেছে, তবুও চোখ, ঠোঁট, নাক আর কপালের বাম দিকটার বেশ বড় কাটা দাগটা এখনও তেমনি রয়েছে। ক্ষুর চালাতে চালাতেই হাত কেঁপে ওঠে ওর।
‘আরে আরে লাগতিছে যে, কাইটা যাবি তো...।’ ঠোঁট ঈষৎ ফাঁক করে নাকি সুরে বলে ওঠে লোকটা।
নিবারণ নির্বিকার।
বাইরে আকাশ গলে মুষলধারে বৃষ্টি শুরু হয়েছে। সে কী বৃষ্টি! বজ্রের মুহুর্মুহু ডাক, দমকা বাতাস আর বৃষ্টির শব্দে কথা ভালো শোনা যায় না। নিবারণ আবার ভালো করে তাকায় লোকটার দিকে। ভুল হচ্ছে না তো! পনের বছর যাকে খুঁজছে, খুঁজে বেড়াচ্ছে, সে-ই কি সত্যি বসে ওর সম্মুখে?
বুকের ভেতর এখন ওর ঝড়ের তাণ্ডব — হৃৎপিণ্ডের ভয়ঙ্কর দাপাদাপি। প্রবল ইচ্ছাশক্তির জোরে স্বাভাবিক রাখতে চেষ্টা করে নিজেকে। সহজ গলায় জিজ্ঞেস করে, — ‘সাব বুঝি নতুন এই শহরে...?’
ফের ঠোঁট সামান্য ফাঁক করে বাঁধো বাঁধো গলায় বলে লোকটি, — ‘উহুঁ, কাপড়ের ব্যবসা আছে, এখান থাইকা শাড়ি নিতে আসি...।’
‘এর আগে দেহি নাই তো, তাই...’
‘দ্যাশের বাইরে আছিলাম অনেক বচ্ছর...।’ লোকটার কথায় একটু গর্বের ছোঁয়া।
নিবারণ আবার প্রশ্ন করে, — ‘ব্যবসা কি ভাইংড়া বাজারে....?’
বিস্ময় ঝরে পড়ে লোকটার গলা থেকে, — ‘হুঁ, তা আপনি জানলেন ক্যামনে...?’
স্মিত হাসির রেখা ফুটে ওঠে নিবারণের ঠোঁটে, — ‘অ্যামনেই বললাম আর কি, রমাপদ কি বাঁইচা আছে, না মারা গেছে...?’
সচকিত হয়ে ওঠে লোকটি, মিনমিনে গলায় বলে, — ‘মারা গেছে। আপনার পরিচয়...?’
রহস্য মেশানো স্বরে জবাব দেয় নিবারণ, — ‘আমারে চিনবেন না...।’
লোকটি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে এবার তাকায় নিবারণের দিকে। সারা মুখে দাড়ি-গোঁফ থাকলেও, আর চেহারায় বয়সের ছাপ পড়লেও মনে হয় চিনতে পারছে ওকে, নিবারণ শীল না?
চেয়ার ছেড়ে উঠতে নেয় লোকটা। ভীষণ আতঙ্কে ওর সারা মুখ ফ্যাকাসে হয়ে পড়েছে।
নিবারণ ওর কাঁধে আলতো চাপ দিয়ে বলে, — ‘লড়াচড়া কইরেন না, ক্ষুরটায় খুব ধার, অজ্জিনাল বিদেশি ব্লেড ...!’
নিশিতে পাওয়া লোকের মত নিশ্চল বসে থাকে লোকটা। ওর চোখ নিবারণের দিকে স্থির।
নিবারণ চেয়ারটা খানিক বাম পাশে ঘুরিয়ে লোকটার দৃষ্টি আয়না থেকে সরিয়ে দেয়।
বামহাত দিয়ে লোকটার চিবুক ওপর দিকে ঠেলে ধরে নিবারণ। আহ্ কী মসৃণ বাইন মাছের মত গলা! থুতনি থেকে ক্ষুরটা ধীরে ধীরে নেমে আসে কণ্ঠনালীর খাঁজের কাছে। ঈষৎ কাত-হওয়া ক্ষুরটা ক্রমশ খাড়া হয়ে ওঠে। উত্তেজনায় নিবারণের হাত কাঁপতে থাকে। কেঁচোর মত কিলবিল-করা হাতের শিরাগুলো ফুলে ওঠে — নিবারণের কালো ঠোঁটের ফাঁক গলিয়ে বেরিয়ে আসে অনুচ্চ অথচ কর্কশ একটি শব্দ, ‘অ-বি-না-শ’। তারপর ভারি একটা দেহসহ রিভলভিং চেয়ারটা একঝটকায় ঘুরিয়ে আবার আয়নামুখো করে দেয়। সামনের আয়নায় উজ্জ্বল লাল রঙের সুন্দর রেখাগুলো এঁকেবেঁকে গড়িয়ে পড়তে থাকে, আর অপরূপ এক আল্পনা আঁকা হতে থাকে।
———
কৈফিয়ত:
মোপাসঁ’র ‘Vendetta’ গল্পটা পড়ে সেই ৬৫-৬৬ সালের দিকে ভয়াবহ পরিণতির গল্প লেখার সাধ জাগে। তৈরি হয় ‘নিবারণ শীল’—যদিও এখন যেমন দাঁড়িয়েছে ঠিক তেমনটি ছিল না সেসময়। চল্লিশ বছর পর দেশের বহুলপ্রচারিত এক দৈনিকের সাহিত্য-পাতায় মুদ্রিত হয় গল্পটি। তারও অনেক পরে, ২০১৩তে, কী আশ্চর্য! দেখি এধরনের পরিণতির একটি নয়, দুজন লেখকের দুটি গল্প, তাও আবার বিখ্যাত দুই কলম্বিয়ান লেখকের, এরনান্দো তেইয়েস [Hernando Téllez,1908-1966]-এর লেখা `Lather And Nothing Else’ এবং গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস[Gabriel García Márquez,1927-2014]-এর `One Of These Days’ বহু আগেই লেখা হয়ে গেছে। ভাগ্যিস, ওঁদের মধ্যে দ্বিতীয় লেখককে কেউ চোর বলেননি!জানতাম,‘গ্রেট মাইন্ডস থিংক এলাইক’— এখন দেখছি, ‘অ্যাভারেজ মাইন্ডস মে অলসো থিংক লাইক গ্রেটস্!’
‘নিবারণ শীল’-এর শেষের দিককার বর্ণনা, মনে হতে পারে, এরনান্দোর উল্লিখিত গল্পটি থেকে মেরে দেওয়া!
– লেখক।
0 মন্তব্যসমূহ