মতি নন্দীর গল্প একটি পিকনিকের অপমৃত্যু

থায় কথায় চিত্রা বলেছিল, তার প্রেমিক অরুণ সাহাদের গ্রামের বাড়িটা বাগান-পুকুর সমেত বিশ বিঘের । ফাঁকাই পড়ে থাকে, কালেভদ্রে বাড়ির লোকেরা পিকনিক করতে যায়। তাই শুনে চিত্রার চার বন্ধু অর্থাৎ ইতিহাস অনার্সের শীলা, করুণা, দীপালি, আর সুপ্রিয়া ওকে বলে, আমরাও একদিন গিয়ে পিকনিক করে আসব। কিছুদিন পরে চিত্রা ওদের জানাল অরুণ রাজি হয়েছে। সামনের রোববার সে বাড়ির স্টেশন ওয়াগানটাও পাচ্ছে, সবাইকে এক জায়গা থেকে তুলে নিয়ে যাবে। কলকাতা থেকে আঠারো মাইল দূরে ওদের গ্রামে যেতে বড়জোর আধঘণ্টা লাগবে । অরুণ খুব জোরে চালায় ।

কলেজ ছুটির পর কাছের এক চায়ের দোকানে বসে ওরা কথা বলছিল। শীলা তার সরু গলাটা ঝুঁকিয়ে লিকলিকে হাত দুটো টেবিলে রেখে বলল, 'পারহেড কত করে দিতে হবে, সেটা এখনই ঠিক করে নেওয়া ভাল।' 

“কাউকে কিচ্ছু দিতে হবে না, সব খরচ অরুণের' চিত্রা তাচ্ছিল্যভরে বলার খুব চেষ্টা করেও গর্ব লুকোতে পারল না । 

“না, তা কেন।” দিপালি আপত্তি করল, “একজনের ঘাড়ে সব খরচ চাপানো উচিত হবে না।' 

“আমাদের পাঁচজনের জন্য ক'টাকাই বা খরচ হবে । ওদের ব্যবসার পাবলিসিটিতেই তো বছরে যায় চল্লিশ হাজার টাকা'- বলতে বলতে চিত্রা নিজেও অবাক হয়ে গেল । 

“তাহলেও আমাদের বাধো-বাধো ঠেকবেই। অরুণের সঙ্গে তোর ভাব, তোর খরচ নয় সে দিল। কিন্তু আমাদের কেন দেবে?” 

“তোরা আমার বন্ধু ।” 

“হলেই বা । পিকনিকে সবাই সমান না হলে আনন্দ জমে না। একজনই সব দিলে বাকিদের মনে হবে অনুগ্রহ নিচ্ছি, তাই না?” দীপালি অন্যদের সমর্থন চাইল। শীলা ইতস্তত করল । সুপ্রিয়া ঘাড় নাড়ল। করুণা বলল, “কিন্তু ভাল মনে যদি খরচের সব দায়িত্ব নেয়, তাহলে অবশ্য অনুগ্রহ নিচ্ছি বলে মনে হবে না ।'

'হ্যাঁ হবে ।' দীপালি হঠাৎ গোঁয়ার হয়ে উঠল। “অরুণের সঙ্গে যেদিন চিত্রা আলাপ করিয়ে দিল, মনে আছে তোর সেই চীনে রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়েই তুই কি বলেছিলি ?”

শীলা সম্মত হয়ে বলল, “কি বলেছিলাম ?”

'এত খরচ করছে আর আমরা একপয়সাও খরচ করতে পারছি না, কেমন লজ্জা-লজ্জা করে। বলেছিলি কিনা বল?'

'বড় বড়লোক বাপু ।' শীলা আত্মসন্মান বজায় রেখে হাসবার চেষ্টা করল, “ফসফস করে যেরকম পাঁচ-দশটাকার নোট বার করছিল। পিকনিকে অবশ্য বড়জোর পাঁচটাকা পর্যন্ত দিতে পারব, কিন্তু তাতে তো পেট্রোল খরচও উঠবে না।”

“ট্রেনে যাব।" সুপ্রিয়া বলল। 

'এতই যখন তোমাদের মান-সন্মানবোধ, তাহলে বরং না যাওয়াই ভাল।' চিত্রা উঠে দাঁড়াচ্ছিল, করুণা আর সুপ্রিয়া টেনে বসাল। 

“না, না আমার কাজ আছে ।' 

'রাগ দেখাতে হবে না আর ” করুণা চিমটি কাটল চিত্রার হাতে। “বাড়িতে তাহলে বলে দেব সব ।” 

“দে-না। সবাই জেনে গেছে।' 

“এসব কথা এখন থাক।” দীপালি বিরক্ত হয়ে বলল, “আগে ঠিক কর যাওয়া হবে কি হবে না। মোট কথা একদম কিছু কন্ট্রিবিউট না করে যাওয়ার ইচ্ছে আমার নেই।”

“আমি জানতুম, দীপালি একটা না একটা ফ্যাকড়া বার করবেই। অরুণের বাড়িতে যাচ্ছি, সে তো আতিথেয়তা করবেই। সুপ্রিয়া তোর বাড়িতে যদি যাই, বল, তুই কি অ্যালাও করবি আমাদের পয়সা খরচ করতে দিতে?” 

সুপ্রিয়া ঘাড় নাড়ল মাদ্রাজী ঢঙে । 

এই সময় একটি ছেলে ঢুকল চায়ের দোকানে। ওদের দেখে লাজুক হেসে দূরের একটা টেবিলে বসল। আদ্দির পাঞ্জাবি পরার জন্য জিরজিরে বুকের পকেটে একটাকার নোট এবং কণ্ঠার হাড় পষ্ট। শ্যাম্পু করা চুল ফাঁপিয়ে এলোমেলো। রুমোলে সুগন্ধি ঢালে। মেয়েদের ফাই-ফরমাস পাওয়ার জন্য সতত ব্যস্ত। মুখটি কাঁচা দেখায় দাড়ি না ওঠায়। কলেজের মেয়েরা হাসাহাসি করে ওকে নিয়ে। 

“শিবুটা এখানেও । জ্বালালে। শীলা গভীর হয়ে চেয়ারে হেলান দিল বুকেটা চিতিয়ে। 

“আঃ, আবার। ” করুণা কৃত্রিম ধমক দিল শীলাকে । 

"দেখুক না, ওটা আবার পুরুষ মানুষ নাকি ৷”

ওসব কথা থাক।” দীপালি বিরক্ত হয়ে বলল, “কি আমরা দিতে পারি সেটা আগে ফয়সালা হোক ৷” 

শীলা বলল, “টাকাপয়সার কথা বাদ দে। পিকনিক মানেই তো শুধু খাওয়া নয়। সকাল থেকে সন্ধে পর্যন্ত সময়টাও কাটাতে হবে। সেই রকম কিছু তো আমরা নিয়ে যেতে পারি।" 

“আমাদের একটা ট্র্যানজিস্টার আছে।” করুণা উৎসাহভরে বলল । 

'অরুণদের তিন-চারটে আছে ।'

“দীপালি তুই কি বলিস ?” 

এরপর পাঁচজন চুপ করে ভাবতে শুরু করল। চা খেতে খেতে শিবু ওদের দিকে তাকাচ্ছে। টেবিলে টোকা দিয়ে একটু গুনগুন করল । খাতাটা খুলে মনোযোগে খানিকটা পড়ল। রাস্তা দিয়ে দুটি মেয়েকে যেতে দেখে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল। তারপর ফুরুত ফুরুত শব্দ করে চা খেতে লাগল। 

“পেয়েছি।” শীলা চাপাস্বরে বলল, “শিবুটাকে নিয়ে চল, চমৎকার সময় কাটবে।' 

চারজনেই প্রথমে খুব অবাক হয়ে গেল শীলার কথায় । কিছুক্ষণ চাপা স্বরে তর্ক করল। 

'পাঁচটা মেয়ে আর একটা ছেলে পিকনিক করবে, কেমন যেন দেখায় । আর একটা ছেলেও চলুক না।' 

“পিকনিকে খাটাখাটুনিও তো আছে, করবে কে ? ওকে বরং লাগিয়ে দেওয়া যাবে।' 

“না না অরুণদের মালি আছে, ওসব কাজ কাউকেই করতে হবে না। বরং ওকে জব্দ করব সারাদিন ধরে।' 

'কথা এখন থাক বরং ওকে গিয়ে বল।' 

হঠাৎ পাঁচজনকে টেবিলের সামনে এসে দাঁড়াতে দেখে শিবু হকচকিয়ে গেল । ওদের অনুরোধ শুনে তার সারা শরীরটাই দুলে উঠল।

“না না, তোমরা যাচ্ছ, তার মধ্যে আমি কেন?' 

“তাতে কি হয়েছে।' চিত্রা বোঝাবার জন্য বলল, “তুমিও তো আমাদের বন্ধু, আমরা তোমায় ইনভাইট করছি । আমাদের সঙ্গে যাওয়া কি তুমি পছন্দ কর না?' 

“না না, তাই বলেছি নাকি । তবে যার বাড়িতে যাব তারও তো মতামত নেওয়া দরকার।' 

চিত্রা বলল, “তুমি আমাদের গেস্ট, তার নয়। আমরা যাকে খুশি নিয়ে যেতে পারি।'

'শিবনাথ, তাহলে না কোরো না। অরুণ তো আমাদের কাছেও প্রায় অপরিচিত। অবশ্য চিত্রার অসুবিধে হবে না, কিন্তু আমাদের চেনা একজন পুরুষমানুষ থাকলে স্বস্তি পাওয়া যাবে। ধরো ফট করে কারো যদি কিছু হয়ে যায়?' শীলা গম্ভীর হয়ে বোঝাতে চেষ্টা করল। 

“নিশ্চয় নিশ্চয়,” শিবু জোরে ঘাড় নাড়ল । “আজকাল কখন কি হয় কে বলতে পারে। ধরো পাড়াগাঁয়ের রাস্তায় গাড়ি খারাপ হয়ে গেল।” 

'তা কেন হবে। অরুণদের গাড়িটা নতুনই, গতবছর কেনা হয়েছে।” 'চিত্রা তুই থাম। শিবু ঠিকই বলেছে, ধর তেল ফুরিয়ে যায় যদি।' 

অতঃপর শিবুর যাওয়া ঠিক হয়ে গেল। পাঁচটি মেয়ে চায়ের দোকান থেকে বেরিয়ে কিছু দূরে হেঁটে গিয়ে হাসতে শুরু করল। তারপর যে যার বাড়ির দিকে রওনা হল ।

দীপালির বাঁ-কানের উপর দগদগে পোড়া চিহ্ন। বারো বছর বয়সে অ্যাসিডের শিশি তাক থেকে পড়ে যায় ওর মাথায় । কানটা দোমড়ান, চুলও ওঠেনি। একসঙ্গে কিছু যুবক সামনে দিয়ে আসছে দেখে সে মুখ ঘুরিয়ে ক্ষত লুকোবার চেষ্টা করল । তার মুখের দিকে তাকিয়ে ওরা দ্বিতীয়বার আর তাকাল না। তবে ঘাড় ঘুরিয়ে ওদের মধ্যে একজন তাকে পিছন থেকে দেখল। দীপালি জানে, যে দেখল তার মুখ দিয়ে আক্ষেপসূচক ধ্বনি নির্গত হবে, দুই চোখে বিস্ময় ফুটবে। তার সুঠাম দেহ বহুক্ষণ ফিরে ফিরে দেখবে । ওই পর্যন্তই, দীপালি তা জানে। গভীর রাতে মাঝে মাঝে সে কাঁদে । 

বাস স্টপে দাঁড়িয়ে শীলার ভাবনা হল, পিকনিকে যাওয়া তার হয়ে উঠবে কিনা। আবার ভাই কিংবা বোন হবে। ক'দিন ধরে মা আর নড়াচড়া করতে পারছে না। অতবড় সংসার চালানোর ভার এখন তার ঘাড়ে। অবশ্য তেরোবছর বয়স থেকেই সে মার আঁতুড় তুলছে। কিন্তু একদিনের জন্যও কি এখন বাড়ির বাইরে থাকা চলে ? ভাবনায় পড়ল শীলা । তারপর মা বাবা ভাই বোনদের উপর প্রচণ্ড রাগে দপদপ করে উঠে, বাসের অপেক্ষায় না থেকে হাঁটতে শুরু করল।

দ্রুত চলেছে সুপ্রিয়া, টিউশনিতে তার দেরি হয়ে গেছে । কুড়িটাকার জন্য রোজ দুটো বিচ্ছুকে নিয়ে একঘণ্টা বসতে হয়। তার থেকেও সমস্যা ওদের মা-ঠাকুমাকে নিয়ে। রোজ শুনতে হচ্ছে তার মিষ্টিমুখ দেখে নাকি সংসারী হবার সাধ জেগেছে বাড়ির টাকমাথা হোৎকা চেহারার প্রৌঢ় ছোটছেলের । প্রায় ছ'শো টাকা মাইনে পায়। সুপ্রিয়া টের পাচ্ছে হয়তো একেই বিয়ে করতে হবে । কেননা ওরা শিগগিরই তার বাবার কাছে প্রস্তাব নিয়ে আসবে এবং তা ফেরাবার সাধ্য চার মেয়ের স্কুল-শিক্ষক বাবার নেই। চলতে চলতে সুপ্রিয়ার মনে হলো, সামনের মোড়টা ঘুরলেই কেউ যদি তার মুখে অ্যাসিড ছুঁড়ে দেয়।

মোড় ঘুরে দেখল একটি সুদর্শন তরুণ তাকে দেখে উজ্জ্বল হয়ে উঠছে ৷সুপ্রিয়ার মন খারাপ হয়ে গেল । 

করুণা একা দাঁড়িয়ে চৌমাথার মোড়ে। কাছেই বাড়ি। কিন্তু বাড়ি গিয়ে কি করবে? বৌদি বলবে সিনেমা চলো, বাবা বলবে সেতার বাজিয়ে শোনা, মা বলবে একফোঁটাও দুধ ফেলে রাখা চলবে না, মাস্টারমশাই বলবে ফাস্ট-ক্লাস পাবার মত মাথা আছে, বাবা বলবে ওকে ফরেন পাঠাব, বৌদি বলবে রোজ স্কিপিং করো, মা বলবে সন্ধেবেলায় শুয়ে থাকতে নেই, মাস্টার মশাই বলবে যে-সব প্রশ্নের উত্তর লিখিয়ে দিয়েছি মুখস্থ করোনি কেন, বৌদি বলবে এখনো কেউ তোমাকে প্রেমপত্র দেয়নি তা কি হয়, বাবা বলবে পছন্দ করে যদি বিয়ে করিস আপত্তি করব না, মাস্টার মশাই বলবে আজকাল আর তুমি মন দিয়ে মোটেই পড়াশোনো না । করুণা একা দাঁড়িয়ে ভাবল, বাড়ি গিয়ে কি করব?


গাড়ি চালাতে চালাতে অরুণ বলল, “নিন সিগারেট খান ।” 

শিবু ঘাড় নাড়ল । 

“সে কি! আপনি তো অ্যাডাল্ট, প্রাপ্তবয়স্ক' বলে অরুণ ঘাড় ফিরিয়ে মেয়েদের দিকে চেয়ে হাসল।

“শিবু লজ্জার কি আছে, আমরা কি তোমার মা-মাসি? করুণা আঙুল দিয়ে শিবুর কাঁধে খোঁচা দিল । 

‘ইন্ডিয়ান সিগারেট নয় । খেয়েই দেখো একটা ।' চিত্রা গম্ভীর স্বরে বলল । 

এরপর সকলের অনুরোধে শিবু খেতে শুরু করল। অভ্যাস নেই। একটু পরেই কাশতে লাগল। “ও কি, ছেলেমানুষের মত কাশছ কেন? আমি হলে তিন টানে শেষ করে দিতুম” শীলা ধমক দেবার ভঙ্গিতে বলল, এবং হাত বাড়াল, “দাও দেখিয়ে দিচ্ছি।” -

“না না।' শিবু সিগারেটটা সরাতে গিয়ে অরুণের স্টিয়ারিং ধরা হাতে ছ্যাঁকা দিল। অরুণ চমকে উঠতেই গাড়িটা বেটাল হয়ে ধাক্কা দিল পথের পাশে দাঁড়ানো একটা সাইকেল রিকশার চাকায় । চাকাটা দুমড়ে গেল । 

হৈ-হৈ করে কোত্থেকে ছুটে এল একদল লোক। গাড়ি ঘিরে তারা উত্তেজিত কথাবার্তা বলতে থাকল। চিত্রা ভয়ে আঁকড়ে ধরল অরুণের হাতটা। অন্য মেয়েরা শুকনো মুখে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে । শ্বাস-প্রশ্বাস ছাড়া শিবুর দেহযন্ত্রের বাকি অংশ মৃতবৎ। 

“হয়েছে কি।' অরুণ দরজা খুলে বেরোল। দু-পা ফাঁক করে দাঁড়িয়ে বুক চিতিয় সুন্দর স্বাস্থ্যটা জনতাকে দেখাল। 'কেউ তো মরেনি, তবে এত কথা কিসের?” তার কর্তৃত্ববাচক কণ্ঠের দাপটে ওরা থ মেরে গেল। “সারাতে লাগবে?' পকেট থেকে জাঁদরেল একটা ওয়ালেট এবং তার মধ্য থেকে অনেকগুলো নোট বেরিয়ে আসতে দেখে নিভন্ত অগ্নিস্তুপ থেকে ফুলকির মত কিছু ফিসফাস ছিটকে উঠল। 

“পঞ্চাশ টাকা লাগবে।' ওদের মধ্য থেকে একজন বলল । 

“সারিয়ে নিতে পঞ্চাশ টাকা?” ভ্রু কুঁচকে অরুণ ধমকাল। কতকগুলো নোট একজনের হাতে গুঁজে দিয়ে গাড়িতে উঠল। স্টার্ট দিতেই জনতা পথ ছেড়ে দিল । 

মাইলখানেক যাবার পর চিত্রা প্রথম কথা বলল, “ওরা গাড়িটা পুড়িয়ে দিত, না?' 

“কি জানি।' অরুণ শিস দেবার জন্য ঠোঁট সরু করে কি ভেবে, ঘাড় ফিরিয়ে মেয়েদের দিকে তাকাল । “সব চুপচাপ কেন। আরে ও কিছু নয়, নিন গান ধরনে।” বলেই চেঁচিয়ে শুরু করল, “আমরা অদ্ভূত।' শুধু চিত্রা ওর সঙ্গে যোগ দিল ।


পিছনের সিটের চারজন মেয়ে কাঠের মত বসে । হঠাৎ শিবু প্রাণপণে অরুণের সঙ্গে গলা মেলাতে লাগল। মিহি স্বরকে উদাত্ত করতে গিয়ে স্বর ভেঙে যাচ্ছে, সেটা বুঝতে পেরে খানিক বাদে থেমে গেল। 

“থামলেন কেন, চলুক - আমরা ভাঙিগড়ি— 

শিবু বাকি পথটা চীৎকার করতে করতে একা গান গেয়ে গেল। গাড়ি থেকে নেমেই দীপালি চাপা স্বরে শীলা, সুপ্রিয়া, করুণাকে বলল, “ওটাকে না আনলেই হত।' . 

কিছুক্ষণ পরেই ওরা রান্নার উদ্যোগে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। মালি বারো মাইল দুরে তার গ্রামে গেছে। সকালে খবর আসেছে বাঘে তার বাবাকে মেরে, আধ-খাওয়া দেহটা ফেলে রেখেছে। শুনেই সুপ্রিয়া বলল, “বাঘটা যদি এখানে আসে।'

'কেন শিবু রয়েছে, ভয় কি আমাদের।' তিক্তম্বরে দীপালি বলল । 

'বাঘ কিন্তু মানুষ নয়,” অরুণ হাসতে থাকল। “টাকা দিয়ে পার পাওয়া যাবে না।' 

চিত্রা ছাড়া কেউ উচ্চস্বরে হাসল না। কলকাতা থেকে খাওয়ার সামগ্রী অরুণ এনেছে। শিবু উনুন ধরানোয় ব্যস্ত। কাজের ছুতোয় সে সকলের আড়ালে থাকতে চাইছে। অন্যরা কিছুক্ষণ বাগানে বেড়ালো। বেল এবং কলা ছাড়া আর কিছু ফলেনি। কয়েকটা নারকেল গাছ রয়েছে। অরুণ জুতোজামা খুলে একটা গাছে ওঠার চেষ্টা করল । হাত দশেক উঠে হাল ছেড়ে নেমে এসে বলল, “বড্ড পিছল। তবে দিন দুয়েক তালিম নিলেই হয়ে যাবে।' 

করুণা ফিসফিস করে শীলার কানে বলল, “সব কিছুতেই বাহাদুরির চেষ্টা, না?' 

শীলা ঘাড় নাড়ল। চিত্রা লক্ষ করেছে এই কানাকানি । কাছে এসে কারণ জানতে চাইল। শীলা বলল, “করুণা বলছিল তোদের দুজনকে বেশ মানায়।' 

চিত্রা উথলে উঠে কি করবে ভেবে না পেয়ে বলল, “শিবুটার এমন মেয়েলি স্বভাব, রান্না ছেড়ে কিছুতেই আসবে না। চল ওকে ধরে আনি ।” 

করুণা আর শীলাকে টানতে টানতে চিত্রা নিয়ে চলল রান্নার দিকে । তখন সে বলল, “তোদের ভাল লাগছে অরুণকে? খুব চঞ্চল ছটফটে, নারে ?' 

“সেইটাই তো ভাল, তবে কি শিবুর মত হবে?' শীলা বলল, এবং করুণা ঘাড় নাড়ল । 

'ওর সঙ্গে কোন তুলনাই চলে না। খুব ভাল হত যদি অরুণের মত তোদেরও কেউ থাকত।' চিত্রা সমবেদনা জানাল যেন। তাতে দুজনেই হাসবার চেষ্টা করল। তিনজনকে দেখে শিবু বলল, “দেখ তো নুন হয়েছে কিনা।” বাটিতে খানিকটা ঝোল এগিয়ে ধরল। চোখেমুখে উত্তেজনা । চিত্রা চুমুক দিয়ে জানাল নুন কম হয়েছে। 

“শিবু, আমরা একসঙ্গে রয়েছি, আর তুমি এভাবে আলাদা হয়ে থাকলে খুব খারাপ লাগবে । চলো।' 

“বাঃ, খাওয়া-দাওয়া করতে হবে না বুঝি !' 

“হবে । ওসব পরে করলেও চলবে, এখন তুমি বেরিয়ে এস।” 

শিবু কিছু আপত্তি করে অবশেষে, “নুন দিয়ে মাংসটা নামিয়েই যাচ্ছি' বলে ওদের বিদায় করল ।” 

পুকুরের বাঁধানো ঘাটে বসে কিছুক্ষণ গল্প করে ওদের আর ভাল লাগল না। তখন অরুণ বলল, সাঁতার কাটা যাক। কেউ সাঁতার জানে না। কস্টিউম পরে অরুণ যখন বাড়ি থেকে বেরিয়ে এল, ওর জানুন্বয় ও নাভি এই নির্জ'ন স্থানে মেয়েদের কাছে অস্বস্তিকর হয়ে উঠল। তারা মুখ চাওয়া-চাওয়ি করে নিজেদের মধ্যে আবোল-তাবোল কথা শুরু করল আর অন্যমনস্ক হবার ভান করতে লাগল। অরুণ একাই জলে কিছুক্ষণ ঝাঁপাঝাপি করে, জলে নামার জন্য ওদের ডাকতে থাকল। অবশেষে চিত্রা নামল এবং তাকে পিঠে নিয়ে অরুণ সাঁতরাতে শুরু করল । 

“বড্ড বাড়াবাড়ি হচ্ছে ।' 

“রীতিমত অসভ্যতা। এসব কি! আমরা রয়েছি খেয়াল নেই?'

চারজন মেয়ে এইভাবে কথা বলতে থাকল এবং শিবু চুপ করে দেখছিল সিঁড়ির ধাপে দাঁড়িয়ে । 

দীপালি বলল, “সাঁতার জান না, তুমি যে কি একটা ।” 

লজ্জায় তোতলা স্বরে শিবু বলল, “একটু একটু পারি।' 

“নামো তাহলে।” চারজন একসঙ্গে টানতে টানতে শিবুকে জলে ঠেলে দিল । অরুণ খুবই উৎসাহিত হলো। চিত্রাকে ঘাটে পৌঁছে দিয়ে বলল, “চলুন পারাপার করি।” 

“না না পারব না আমি' প্রায় পঞ্চাশ মিটার লম্বা পুকুরের ওপারে তাকিয়ে শিবু বলল। “সেই ছোটবেলায় সাঁতার শিখেছিলাম, বছর দশেক হয়ে গেল। তারপর আর কাটিনি।” 

কিন্তু সকলের বারংবার অনুরোধে রাজি হয়ে গেল। অরুণ যখন ওপারে ছুঁয়ে এপারের ঘাটে এসে পৌঁছল, শিবু তখনো ওপারেই পৌঁছয়নি। শুরুতে মেয়েরা হৈ-হৈ করে শিবুকে উৎসাহ দিচ্ছিল। পরে চিত্রা ছাড়া বাকি চারজন চুপ করে গেল এবং ক্রমশ তাদের মুখে কাঠিন্যের জটিলতা এল । সুপ্রিয়া বলল, “ইচ্ছে করছে চুলের মুঠি ধরে ওটাকে চুবুনি দিই।” 

“আমারও।” দীপালি বলল। তারপরই একসঙ্গে ওরা চেঁচিয়ে উঠল, “একি! ডুবে যাচ্ছে নাকি?' মাঝ-পুকুরে শিবু ঘাটের দিকে অসহায় চোখে তাকিয়ে প্রাণপণে হাত-পা ছাড়ছে, হাঁ করে নিশ্বাস নিচ্ছে। ঝাঁপিয়ে পড়ল অরুণ। শিবু ওকে জড়িয়ে ধরতে যেতেই মুখে ঘুষি মেরে চুল ধরে টানতে টানতে নিয়ে এল ঘাটে। অবসন্ন হয়ে কিছুক্ষণ বসে থেকে মাথা নামিয়ে শিবু বাড়ির মধ্যে ঢুকে গেল। চিত্রা বলল, “ও কি ডুবে যাচ্ছিল ?” 

“বোধহয় ।” অরুণ কাঁধ ঝাঁকাল। মাংস ভাত ছাড়া আর কিছু রান্না হয়নি। ঝোলমাখা ভাত মুখে দিয়েই সবাই শিবুর দিকে তাকাল । থু থু করে ফেলে দিয়ে দীপালি ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। অরুণ উঠে গিয়ে তাকে ধরে আনল, “নুন বেশি হয়ে গেছে হোক না । দই মেখে সন্দেশ দিয়ে ভাত খান ।” 

“একটা কিছুও যদি পারে।” শীলা চেঁচিয়েই বলল। “খালি বাহার দিয়ে মেয়েদের পিছনে ঘুরঘুর করা।” 

শীলাকে চুপ করিয়ে দেবার জন্য অরুণ তাড়াতাড়ি বলে ওঠল, “এমন আর কি নুন হয়েছে, আমার তো বেশ লাগছে। শিবুনাথবাবু ওদের কথা একদম বিশ্বাস করবেন না। ওরা না খায় তো না খাক, আমরা বরং ভাগাভাগি করে সাবড়ে দি' অরুণ ভাতের গ্রাস মুখে দিল। 

“আমি একাই খেয়ে ফেলতে পারি সবটা : শিবু টেনে টেনে হাসতে শুরু করল ।

থাক, আর বাহাদুরি করতে হবে না।” শীলা তাচ্ছিল্যভরে বলতেই শিবু মাংসের হাঁড়িটা নিয়ে ঘর থেকে ছুটে বেরিয়ে গেল। কেউ ওকে ফিরিয়ে আনল না ।

খাওয়ার পর দোতলার বারান্দায় পা ছড়িয়ে সবাই গল্প করছে। অরুণ আর চিত্রা পরস্পরের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসছে, ভ্রুকুটি করছে, জিভ দেখিয়ে ভেংচি কাটছে, কিল দেখাচ্ছে, আর মাঝে মাঝে গল্পে যোগ দিচ্ছে । হঠাৎ চিত্রা উঠে তিনতলার ছাদে চলে গেল। কিছুক্ষণ উসখস করে অরুণও উঠল—“কি করছে দেখে আসি' অজুহাত দিয়ে।

চারটি মেয়ে মুখ চাওয়া চাওয়ি করে দেয়ালে ঠেস দিয়ে বসে থাকল। কিছু পরেই শিবু এল জ্বলজ্বলে চোখে ।

“ভেবেছিলে পারব না ? সব শেষ করে দিয়েছি।' 

“দু-কিলো মাংস খেয়ে ফেললে?'

“বাজে কথা। নিশ্চয় কোথাও ফেলে দিয়েছ কি কুকুরগুলোকে খাইয়ে দিয়ে বাহাদুরি ফলাচ্ছ।'

“মোটেই না । তোমরা চারদিক পরীক্ষা করে দেখতে পার।'

বসে থাকতে ভাল লাগছে না। একটা উপলক্ষ পেয়ে বাগানে বেরিয়ে চারজন চারিদিকে খুঁজতে শুরু করল। একসময় করুণা ছুটতে ছুটতে দীপালির কাছে এসে বলল, “একটা ব্যাপার দেখবি আয়।'

বাগানের একধারে একটা মাটির ঘর। সম্ভবত চেলাকাঠ, ঝুড়ি-কোদাল ইত্যাদি রাখার। দরজা বন্ধ। দীপালিকে টেনে এনে করুণা বলল, “কান পেতে শোন।'

সন্তর্পণে দীপালি দরজায় কান ঠেকিয়ে ফিরে এল পাংশু মুখে । আর চিত্রা।'

“হ্যাঁ ছাদে যাবার ভান করে এখানে!”

'আগে থাকতেই প্ল্যান করেছিল।'

অন্য দুজনকে ডেকে ওরা খবরটা দিল। অবশেষে চারজনেই যখন ফিরে এল শিবু প্রবল উত্তেজনা নিয়ে জিজ্ঞাসা করল, 'পেলে ?”

“কি পাব ?”

“যা খুঁজতে গিয়েছিলে ?”

ওরা কেউ জবাব দিল না। নিজেদের মধ্যে এলোমেলো কথা শুরু করল।

“আজকের খবরের কাগজটা পড়ে আসা হয়নি।'

“বাবা বারণ করেছিল আসতে, জোর করে এসেছি।'

“আমার ঠিক উলটো, মা কোন ভোরে ঘুম থেকে তুলে দিয়েছে। বড্ড খিদে পাচ্ছে ।

পাবেই তো । ভাত না খেলে মনে হয় খাওয়াই হলো না ।' 

“দেখনা কিছু যদি পাওয়া যায়। দেখেছিস কি সুন্দর ডাব হয়েছে।' 

“পাড়বে কে, অরুণ তো উঠতে গিয়ে পারল না। আজ যদি ওদের মালিটা থাকত।' 

'তার বাবাকে এই সময়ই বাঘে খেলো।' 

“আমি ডাব পাড়তে পারি।' শিবু হঠাৎ বলে উঠল। 

ওরা গ্রাহ্য করল না কথাটা। শিবু আবার বলল, “যদি পাড়তে পারি তাহলে কি দেবে?' 

“তা হলে?” শীলা চোখ সরু করে বলল, “আমাদের যাকে চাও ওই ঘরে নিয়ে যেতে পারবে।” আঙুল দিয়ে বাগানের মাটির ঘরটা দেখাল। শিবু কথাটার অর্থ বুঝতে না পেরে বলল, “তাহলে আজ সকাল থেকে যা-যা ঘটেছে সব ভুলে যাবে বলো ?” 

“হ্যাঁ যাব। কিন্তু যদি না পাড়তে পারো ?” দীপালি তেরিয়া হয়ে এগিয়ে গেল কয়েক পা। একটু ভেবে শিবু বলল, “তাহলে অন্য কলেজে ট্রান্সফার নোব।' 

“না, না । তোমাকে পারতেই হবে । এইটে অন্তত পারতেই হবে ।” করুণা অদ্ভূত গলায় বলল। শিবু অবাক হয়ে তাকিয়ে উত্তেজিত হিংস্র, এবং কাতর চারটি মুখ থেকে কোন অর্থ বার করতে পারল না। 

খালি গায়ে, পাজামাটা উরু পর্যন্ত গুটিয়ে, শিবু প্রায় চারতলা উঁচু একটা নারিকেল গাছে ওঠার চেষ্টা শুরু করল । ওরা গাছটাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে । কয়েক হাত উঠেই সে নেমে এল । 

“পেটে বড় চাপ লাগছে।' 

“জানতুম এইরকম একটা অজুহাত দেবে। দীপালি স্থান ত্যাগ করার ভঙ্গি করল । 

শিবু কথা না বলে আবার ওঠার চেষ্টা শুরু করল। ধীরে ধীরে সে দোতলার উচ্চতা পার হল । চারটে মুখে বিস্ময় ফুটল। শিবু তিনতলার কাছাকাছি পৌঁছচ্ছে। একজন হাততালি দিয়ে উঠল । শিবু গাছটাকে জড়িয়ে হাঁপাচ্ছে। দুটো পা পিছলে যাচ্ছে বারবার, আঙুলগুলো বেঁকিয়ে আঁকড়ে ধরতে চাইছে, পারছে না। একটা ইটের টুকরো কুড়িয়ে শীলা শাসানি দিল, “শিবু খবরদার। এক ইঞ্চি নেমেছো কি ইট ছুড়ে মাথা ফাটিয়ে দোব।' এই বলে সে ইট ছুঁড়ল। ঠক করে গাছে শব্দ হতেই ধড়ফড়িয়ে শিবু ওঠার চেষ্টা আরম্ভ করল । কয়েকহাত উঠে আবার সে জড়িয়ে রইল গাছটা । শরীর থরথর করে কাঁপছে, নিশ্বাস নিতে হাঁ করল, একটুখানি পিছনে নেমে এল! সঙ্গে সঙ্গে চারটি মেয়েই ইট কুড়িয়ে এলোপাথাড়ি ছুঁড়তে শুরু করল।

পারতে হবে । পারতেই হবে, নইলে নামতে দোব না।' উন্মাদের মত দীপালি চীৎকার করে উঠল ।

“আর একটু বাকি। শিবু চেষ্টা করো, চেষ্টা করো।' করুণা জোরে ইট ছুড়ল । শিবুর পাশ দিয়ে সেটা এবং এধারে শিবু একসঙ্গে পড়ল। মাথাটা প্রথমে পাঁচিলে পড়ল সেখান থেকে দেহটা ছিটকে এল হাত পাঁচেক দুরে । বারকয়েক পা দুটো খিঁচিয়ে শিবু মরে পড়ে রইল।

ওরা কেউ কাছে এগোল না। সুপ্রিয়াই প্রথম জড়ানো স্বরে টেনে টেনে বলল, “আমি মোটে দুবার ছুড়েছিলাম, অনেক দুর দিয়ে চলে গেছে।”

শীলা শান্ত গলায় বলল, “কারুর ইটই ওর গায়ে লাগেনি। বোকার মত ওঠার চেষ্টা করেছিল, এটা অ্যাকসিডেন্ট।’

তখন ঘরে দাঁড়িয়ে সুপ্রিয়া ছুটতে ছুটতে সেই মাটির ঘরের দরজায় আছড়ে, হাউহাউ করে কেঁদে উঠল। ব্যস্ত হয়ে ঘর থেকে অরুণ আর চিত্রা বেরোল । তারপর ছুটে এল শিবুর মৃতদেহের কাছে । তখনি গাড়িতে তুলে ওরা রওনা হল কলকাতার দিকে। 

সুপ্রিয়া শুধু একবার বলেছিল, ‘যদি বাঘটা এখন বেরোয়!' তাছাড়া পথে কেউ কথা বলেনি। সারাপথ ওদের পায়ের কাছে শাড়ি ঢাকা শিবু শোয়ান ছিল। 


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

1 মন্তব্যসমূহ